৪৬. নীলুরা ঢাকায় পৌঁছাল

নীলুরা ঢাকায় পৌঁছাল সোমবার ভোরে। নীলুর ইচ্ছা ছিল সোমবারে অফিস ধরা। তা করা গেল না। নটা বাজতেই জহির এসে উপস্থিত। জহির বলল, আমার সঙ্গে একটু আসতে হবে ভাবী। দশ মিনিটের জন্যে। আমি আপনাকে অফিসে পৌঁছে দেব।

ব্যাপার কি বল তো।

তেমন কিছু না। আবার কিছুটা আছেও। ভাবী, একটু চলুন আমার সঙ্গে।

বেশ চল। আমি কাপড় বদলে নিই। তোমরা ভালো ছিলে তো?

জহির শুকনো গলায় বলল, ভালোই ছিলাম। টুনি কোথায় ভাবী?

ওর বাবার সঙ্গে গিয়েছে। ওর শরীরটা ভালো না, জ্বর। যাবার সময়ও জ্বর নিয়ে গিয়েছে। ফেরার পথেও জ্বর নিয়ে ফিরল।

জামাইয়ের খোঁজ পেয়ে হোসেন সাহেব বেরিয়ে এলেন। নীলগঞ্জের বিস্তারিত গল্প জুড়ে দিলেন।

রাস্তাঘাট চেনা যায় না। বড়ো একটা রাস্ত করে ইট বিছিয়ে দিয়েছে। রিকশা চলে। ইচ্ছা করলে তুমি গাড়ি নিয়েও যেতে পারবে। এইটুক গ্রামে চারটা টিউবওয়েল। দাঁতব্য চিকিৎসালয় একটা করেছে, ওষুধপত্র অবশ্যি তেমন নেই। আসলে দরকার ছিল একটা হোমিও হাসপাতাল। ওষুধ সস্তা, ইচ্ছা করলে বিনামূল্যে দেওয়া যায়। তাই না?

জহিল বিরস মুখে হ্যাঁ-ই দিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখে যে-কেউ বলে দিতে পারবে, সে কিছুই শুনছে না। তার মন অন্য কোথাও। হোসেন সাহেব অবশ্যি বুঝতে পারছেন না। তিনি উৎসাহের সঙ্গে একের পর এক গল্প বলে যাচ্ছেন। নীলু কাপড় বদলে তৈরি হয়ে এসেছে, তখনও তাঁর গল্প থামে নি। নীলুকে বললেন, পাঁচটা মিনিট দেরি কর মা। জহিরের সঙ্গে একটা দরকারী কথা বলছি। তুমি বরং এর মধ্যে আমাদের জন্যে চট করে চা বানিয়ে আন। আমারটায় চিনি কম।

নীলু চা আনতে গেল। হোসেন সাহেব শুরু করলেন মহিষের গল্প।

মহিষ দেখেছি নাকি জহির?

দেখিব না কেন?

আরে না। ঐ দেখার কথা বলছি না। কাছে থেকে দেখা। প্রাণী হিসেবে মহিষ অসাধারণ। বড়ো ঠাণ্ডা প্রাণী। দেখতেই বিশাল, কিন্তু এর মনটা শিশুদের মতো।

তাই বুঝি?

আমি অবাক হয়েছি। এই টুনি, পর্বতের মতো এক মহিষের পিঠে বসে থাকত। সে দিব্যি বসে আছে, আর মহিষ নিজের মনে হেলেন্দুলে ঘাস খাচ্ছে।

বাহ, চমৎকার তো।

জিনিসটা নিয়ে আমি টেনে আসতে আসতে অনেক চিন্তা করলাম। আমার ধারণা, মহিষকে যদি ঠিকমতো টেনিং দেওয়া যেত, তাহলে ঘোড়ার মতো একে ব্যবহার করা যেত। এই জিনিসটা কারোর মাথায় খেলে নি। তুমি কী বল?

হতেপারে।

মহিষের পিঠে বসাও খুব আরামের। পিঠ অনেক চওড়া। জিন ব্যবহার করার দরকার হত না।

শেষ পর্যন্ত জহির বলতে বাধ্য হল, আমি পরে এসে বাকিটা শুনব। আমার একটা বিশেষ জরুরি কাজ।

সন্ধ্যাবেলা চলে এস! শাহানাকে নিয়ে এস, অনেক গল্প বাকি রয়ে গেছে।

আচ্ছা দেখি।

দেখাদেখির কিছু না। নিয়ে আসবে। রাতে আমাদের সঙ্গে খাবে। মনে থাকে যেন।

জ্বি, মনে থাকবে।

আসল গল্পগুলিই বলা হয় নি।

 

জহিরের কথা শুনে নীলু আকাশ থেকে পড়ল। তার মুখ দিয়ে কথাই বেরুচ্ছে না। সে বহু কস্টে বলল, এসব তুমি কী বলছি।

যা ঘটেছে, তাই বললাম।

আমাদের খবর দিলে না কেন?

আপনারা আনন্দ করতে গিয়েছেন। এর মধ্যে হঠাৎ তাঁবু খবর নিশ্চয়ই দিতাম। দেখলাম, খবর না দিয়ে যদি পারা যায়।

শাহানা এখন আছে কেমন?

এখন ভালো।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে?

হ্যাঁ। গতকালসন্ধ্যায়বাসায় এনেছি। কথা হচ্ছিল জহিরদের বাড়ির একতলায়। নীলু বলল, তুমি আবার গোড়া থেকে বল কী হয়েছে।

আপনারা যেদিন নীলগঞ্জ গেলেন, ঐদিনই ঘটনা ঘটল। সারা দিন দরজা বন্ধ করেছিল। রাত দশটার সময় কাজের মেয়েটা বলল-সে নাকি ধাপ করে কি পড়ার শব্দ শুনেছে। আমি দরজা ধাক্কা দিলাম। শেষ পর্যন্ত দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলাম। তখনও বুঝতে পারি নি, ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা সন্দেহ করলেন। যমে-মানুষে ন কাকে বলে এই প্রথম দেখলাম। ডাক্তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে, ভাবী। ওরা অসাধ্য সাধন করেছে।

নীলু উঠে দাঁড়াল। ক্লান্তগলায় বলল, আমি শাহানার কাছে যাচ্ছি।

জহির বলল, আমিও কি আসব?

না, তোমার আসার দরকার নেই। তুমি এখানেই থাক।

কড়া কথা কিছু বলবেন না ভাবী, মনের যে অবস্থা।

আমি সেটা দেখব। তোমাকে ভাবতে হবে না।

শাহানা নীলুকে দেখে হাসিমুখে বলল, কবে ফিরলে ভাবী?

আজই ফিরলাম। তুমি আছ কেমন?

এই আছি। আমার কাছে থাকা না-থাকা সমান।

তোমার কোনো লজ্জা লাগছে না? লজ্জা লাগবে কেন?

আসতে না হয়।

কী বলছ তুমি ভাবী?

খবৰ্দার, আমাকে ভাবী বলবে না। ফাজিল মেয়ে।

শাহানা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। নীলুর এই উগ্রমূর্তি সে কখনো দেখে নি। নীলু রুদ্ধ গলায় বলতে লাগল, এতটুক মেয়ে ছিলে। চোখের সামনে বড়ো হয়েছ। কত আদর, কত মমতা। আর এই মেয়ে এমন করে? তোমার মরাই উচিত। তুমি উঠে আসে। দোতলা থেকে আমার সামনে নিচে লাফিয়ে পড়। এস বলছি।

এই বলে সে সত্যি-সত্যিই শাহানার হাত ধরে খাট থেকে নামাল। শাহানা কিছু বোঝার আগেই নিলু গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। শাহানা কাত হয়ে খাটে পড়ে গেল। সে চোখ বড়ো-বড়ো করে ভয়াত চোখে তাকিয়ে আছে। তার ফর্সা গালে আঙুলের দাগ ফুটে উঠেছে। যেন সেখানে রক্ত জমে গিয়েছে। নীলুকিয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল তার দিকে, তারপর একটি কথা না বলে নিচে নেমে গেল। জহিরকে বলল, তুমি এখন শাহানার কাছে যাও। আমি চলে যাচ্ছি।

আসুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।

তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে না। তোমাকে যা করতে বললাম, কর।

জহির দোতলায় উঠে এল। শাহানা চুপচাপ খাটে বসে আছে। মাথায় ঘোমটা। শাড়ির আঁচল এমনভাবে টানা যে মুখ দেখা যাচ্ছে না। জহিরকে দেখে সে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল। হাসিমুখেই বলল, ভাবী আমাকে মেরেছে। জহির বিস্মিত হয়ে বলল, সে কি?

দেখ না, গালে দাগ বসে গেছে।

গালের দাগ দেখাতে গিয়ে শাহানা আবার হাসল। মৃদুস্বরে বলল, ভাবী এর আগে আরো এক বার আমাকে চড় দিয়েছিল। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার এক বান্ধবী খুব খারাপ একটা বই দিয়েছিল আমাকে। কুৎসিত সব ছবি ছিল সেই বইটাতে। আমি লুকিয়ে—লুকিয়ে পড়ছিলাম। আমার হাতে এই বই দেখে ভাবী কী যে অবাক হল। কেমন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তারপর আমি কিছু বোঝার আগেই একটা চড় মোরল আমাকে। হাত থেকে বই কেড়ে নিল না বা কিছু বলল না। এই ঘটনার কথা কাউকে বললও না। আমি কী যে লজ্জা পেয়েছিলাম। আজ আবার সেদিনের মতো লজ্জা পেলাম।

জহির লক্ষ করল শাহানা কাঁদছে। খুব সহজেই সেই কান্নাও তার থেমে গেল। চোখ মুছে বলল, আমাকে ভাবীর কাছে নিয়ে চল।

এখনি যাবে?

হ্যাঁ। আমার এই ব্যাপারে ভাবী। খুব কষ্ট পেয়েছে। আরেকটা কথা তোমাকে বলি-আমি আর কোনো দিন এ-রকম করব না।

তাই নাকি?

মাঝে মাঝে আমার এ!–রকম হয়। মনে হয় কেউ আমাকে ভালোবাসে না। তখন অদ্ভুত সব কাণ্ড করি। ক্লাস নাইনে যখন পড়ি, তখন এক বার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে যাবার নাম করে বের হয়ে সোজা হাঁটা। হাঁটতে-হাঁটতে যাত্রাবাড়ি বলে একটা জায়গা, সেখান পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম।

তারপর?

সেখান থেকে ফিরে এসেছি। কেউ জানে না। কাউকে বলি নি। আমি বোধ হয় একটু পাগল।

একটু না, অনেকখানি। তোমাকে আমি খুব ভালো এক জন ডাক্তার দেখাব।

দেখিও। তুমি আমার উপর রাগ কর নি তো?

না।

সত্যি না?

হ্যাঁ, সত্যি।

আমার গা ছুঁয়ে বল।

জহির হেসে ফেলল। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসল শাহানা। জহির মুগ্ধ চোখে শাহানার দিকে তাকিয়ে আছে। কী অসম্ভব রূপবতী একটি তরুণী-কুচিবরণ কন্যা রে তার মেঘবরণ চুল!

শাহানা।

বল। তোমার গান কেমন এগুচ্ছে?

মোটেই এগুচ্ছে না। সকালবেল উঠে। ভ্যা ভ্যা করতে আমার ভালোও লাগে না। আমি আর গান শিখব না। আমি পড়াশোনা শুরু করব।

খুব ভালো কথা।

মাস্টার-টাস্টার রাখতে পারবে না। আমি নিজে-নিজে পড়ব।

সে তো আরো ভালো।

কিন্তু একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত?

আমি যতক্ষণ পড়ব, তুমি আমার পাশে বসে থাকবে। চুপচাপ বসে থাকবে।

শর্ত খুব কঠিন বলে তো মনে হচ্ছে না।

জহির কিছু বোঝার আগেই শাহানা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। জহির কিছু বলল না, শাহানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *