দরজা খুলতেই কাটার চাবুকের আঘাত। টলতে টলতে সামলে নিল আনন্দ। যতটা সম্ভব মুখচোখ থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে নেওয়া সত্ত্বেও শরীরে হিমঅনুভূতি। ঝড়টা বইছে এখনও। বরফের কুচিগুলো আর তীরের মত ছিটকে আসছে না এই যা। দরজা ভেজিয়ে আনন্দ সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখন অন্তত সকাল দশটা। অথচ অন্ধকার পাতলা হয়ে ঝুলে আছে তাপল্যাঙের ওপরে। আকাশের রঙের বর্ণনা করা অসম্ভব। চরাচর দেখা যাচ্ছে কিন্তু সাদা তুষারের গায়ে যে ছায়া পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে অন্য কোন গ্রহে চলে এসেছে ওরা। এখন তাপল্যাও বরফে মোড়া। যেদিকে তাকাও শুধু বরফ আর বরফ।
তিন রাত দুদিন ব্লিজার্ড বইছে। ব্লিজার্ড শব্দটার সঙ্গে বইয়ে পরিচয় ছিল। য়ুরোপ আমেরিকায় তুষারঝড়ে পথ হারানো বা মৃত্যুমুখে পড়া মানুষের গল্প অনেক পড়েছে সে। ব্লিজার্ড শব্দটার মধ্যে একটা রোমান্টিক ভাবনা সে আরোপ করে নিয়েছিল। কিন্তু গত তিনরাতের প্রতি মুহূর্তের আতঙ্কে সেসব শিকেয় উঠেছে। মনে হয়েছে যে কোন সময় আস্তানাটা উড়ে যাবে। কাঠের দেওয়ালে অনবরত বরফের কুচি নেকড়ের নখের আওয়াজ তুলেছে। ঠাণ্ডা নেমে গেছে এতটা যে আগুন জ্বালিয়েও মনে হয়েছে ওতে হাত ডোবালে ফোসকা পড়বে না। প্রাকৃতিক প্রয়োজনগুলোও চাপা পড়ে গিয়েছিল। দরজা খোলার সাহস হয়নি। নিরুপায় হলে বাইরের জানলার নিচে বসতে হয়েছে। এবং এইখানে, এই সময়ে তার এবং সুদীপের সঙ্গে জয়িতা মেয়েটির কোন পার্থক্য ছিল না।
কাল সারারাত ঝড়ের দাপট ছিল মারাত্মক। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব বাতাস যেন একত্রিত হয়েছে। আর এভারেস্ট যেন আচমকা গলে এগিয়ে আসছে। কাল সারারাত ঘুম আসেনি কারও। এমন কি সুদীপেরও। ওর চেতনা এখন অনেক স্পষ্ট। মেয়েটি বিশ্বাস করে নোলেনদের গ্রাম থেকে চেয়ে আনা পর্বতশৃঙ্গের পবিত্র জলের কণা ওর কপালে মাখিয়ে দেওয়ায় এই পরিবর্তন। কিন্তু লা-ছিরিঙের মুখে সে শুনেছে গুহা থেকে নামিয়ে আনার সময় সুদীপ পা পিছলে অনেকটা পড়ে গিয়েছিল। নরম বরফে শরীর পড়ায় তেমন আঘাত লাগেনি, কিন্তু পড়ার পর আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল। আনন্দ ছিল অনেকটা আগে। চিৎকার শুনে পিছিয়ে গিয়ে দেখেছিল সুদীপ উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তখনও ওর মুখে মৃত্যুভয় সেঁটে আছে। আনন্দর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়েছিল সে। ওই আঘাত থেকে ওর চেতনা ফিরে এসেছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য। এখনও সুদীপ কথা বলে না। কিন্তু অন্যরা কথা বললে আগ্রহ নিয়ে শোনে। এটা কম স্বস্তির নয়।
দরজাটা দ্বিতীয়বার খুলল। জয়িতার গলা শোনা গেল, উঃ বাবা।
আনন্দ কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে। যেন ঠাণ্ডায় স্বরনালী বিকল হয়ে গেছে। জয়িতা বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ইশারা করে দৌড়াবার চেষ্টা করল সামনে। কিন্তু হাঁটু অবধি জমে থাকা নরম বরফে দৌড়ানো যে অসম্ভব ব্যাপার তা আবিষ্কার করে অসহায় চোখে তাকাল সে। আনল সাবধানী পায়ে ওর পাশে দাঁড়াল। হাওয়ার দাপটে শরীর সোজা রাখা প্রায় অসম্ভব। সে জয়িতার হাত ধরল।
কয়েক পা এগোতে ওরা একটা ঘরের ছাদকে বরফের ওপর মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখল। আশেপাশে ঘর নেই। ভাঙচুর হওয়া ছাদটি কোত্থেকে উড়ে এসেছে বোধগম্য হচ্ছিল না। গ্রামের ভেতরে ঢোকার পর মনে হল কেউ যেন দুরমুশ করে দিয়েছে চৌদিক। অথচ কোন মানুষের শব্দ নেই। নবনির্মিত যৌথগৃহের প্রথমটির দরজা বন্ধ। আনন্দ দরজায় শব্দ করে যখন কোন সাড়া পেল না তখন চিৎকার করতে লাগল হাওয়ার দাপট ছাড়িয়ে।
দরজাটা খুলতে সময় লাগল। যে যুবকটি দরজা খুলেছিল সে তাদের দেখে যেন হতবাক। চটপট ভেতরে ঢুকে নিজেদের সামলে নেওয়ার আগেই অনেকগুলো গলা থেকে বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারিত হল। তারপর একসঙ্গে অনেকেই কথা বলে উঠল। অন্তত জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে বৃদ্ধ মাচার ওপরে স্কুপের মত বসেছিল। তারা আনন্দদের দেখে বিস্মিত এবং আনন্দিত। নিচে আগুন জ্বলছে। জঙ্গল থেকে কেটে এনে সঞ্চয় করে রাখা কাঠ এখন ওদের উত্তাপ দিচ্ছে। যুবকটি ওদের আগুনের কাছে নিয়ে আসার বেশ কিছুক্ষণ পরে দেহে সাড় এল। জীবনে প্রথমবার আনন্দ অনুভব করল শরীরে রক্ত চলাচল করার অনুভূতি কি রকম। দাঁতের কাঁপুনি থামেনি কিন্তু এখন অনেক কম। আনন্দ যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল, পালদেমরা কোথায়?
যুবকটি মাথা নাড়ল, আমরা জানি না। বরফঝড় শুরু হওয়ার পর আমরা কজন এখানে এসেছি।
একজন বৃদ্ধ চিৎকার করে বলল, তোমরা এই ঘর বানিয়ে দিয়েছ বলে আমরা বেঁচে গেলাম। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।
জয়িতা এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। জ্বলন্ত কাঠের মধ্যে শরীর নিয়ে গিয়েছিল সে। সেই অবস্থায় মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এই ঝড় কখন থামবে?
বৃদ্ধ উত্তর দিল, জানি না, এবার সবই অদ্ভুত। আমি জ্ঞান হবার পর এমন মারাত্মক ঝড় দেখিনি। এত বরফ ঝড়ের সঙ্গে কখনও পড়েনি।
আনন্দ যুবকটির দিকে তাকাল। এরা এখানে কি খাচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করা বাহুল্যমাত্র। যৌথগৃহের সব আয়োজন শেষ করার সময় পাওয়া যায়নি। ঝড়টা এসে পড়েছে আচমকা। কিন্তু তার আগে দেখা দরকার গ্রামের সমস্ত মানুষ নিরাপদ কিনা। সে জয়িতাকে বলল, যতই ঝড় উঠুক একবার গ্রামটা ঘুরে আসা উচিত। মনে হয় কেউ বিপদে পড়তে পারে। তুই বরং এখানে থাক। ওদের ভাবতে দে আমরা ওদের সঙ্গে আছি। কোন আপত্তি আছে?
জয়িতা মাথা নাড়ল, বেঁচে গেলাম। ওই ঠাণ্ডায় আমি আবার বের হলে বেঁচে থাকতাম না।
আনন্দ যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল, কাহুন কোথায়?
যুবক বলল, মন্দিরে। মন্দিরে ঝড় ঢোকে না।
আনন্দর মনে হল শেষ তিনটে শব্দ খুব স্বাভাবিক গলায় বলা হল না। কানের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার ব্যাপারে এই যুবকের নিশ্চয়ই আপত্তি আছে। কিন্তু এখনই সে ওকে প্রশ্রয় দিল না। সে চিৎকার করে বলল, আপনারা যারা এখানে এসেছেন তারা ঝড়ের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। কিন্তু গ্রামের অন্য মানুষেরা কি অবস্থায় আছেন তা আমাদের দেখা কর্তব্য। আপনাদের মধ্যে যেসব যুবক শক্ত এবং সমর্থ তাঁরা আমার সঙ্গে আসুন।
গুঞ্জন উঠল। আনন্দর চোখ তিন-চারজন যুবকের ওপর ছিল। তারা ইতস্তত করছে। মাচার ওপর গুড়িসুড়ি মেরে বসেছিল, প্রস্তাবটা শোনামাত্র সামান্য নড়ল। যে বৃদ্ধ আগবাড়িয়ে কথা বলছিল সে বলল, কি হল, কেউ মাচা থেকে নামছে না যে? বাইরের মানুষরা ঘর থেকে ঝড়ে বের হতে পেরেছে আর আমাদের হাত পা কি শরীরে ঢুকে গেল! কি হল?
আর একটি বৃদ্ধার গলা শোনা গেল, সবাই ঠিক আছে। নইলে এই ঝড়ে তারাও আশ্রয়ের খোঁজে আসত।
আনন্দ জবাব দিল, আপনি হয়তো ঠিক বলছেন মা কিন্তু তবু আমাদের নিজের চোখে দেখে আসা উচিত।
সম্ভবত মা শব্দটি কানে যাওয়ায় বৃদ্ধার গলার স্বর পালটে গেল, তা ঠিক, ঠিক। এই ছেলেরা, তোরা এখানে বসে আরাম করছিস, একটুও লজ্জা করছে না? তোদের বয়সী ছেলেমেয়েগুলো বাইরে বেরিয়ে আমাদের জন্যে কষ্ট করছে আর তোরা, নাম, নাম! বৃদ্ধার ঝাঝালো গলায় কাজ হল। তিন যুবক কোনরকমে শরীর মুড়ে নেমে এল এবং আসাটা যে নিতান্তই অনিচ্ছায় তা বোঝা যাচ্ছিল ওদের মুখের চেহারায়। আনন্দ ব্যাপারটাকে পাত্তা দিল না। দরজা খুলে সে এবং চারজন যুবক বেরিয়ে এল। যে যুবকটি প্রথম দরজা খুলেছিল সে এখন তার পাশে, পেছনে তিনজন। সোঁ সোঁ করে হাওয়া চলছে। বাতাসে যে আবার গুড়ি গুড়ি তুষার মিশছে তা কয়েক পা হাঁটতেই বোঝা গেল। শরীর সাদা হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম যে ঘরটিকে মুখথুবড়ে পড়ে থাকতে দেখল সেটার সামনে দাঁড়াল ওরা। সঙ্গী যুবকটি নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। কিন্তু সেই চিৎকার বেশিদূর পৌঁছানোব কথা নয় হাওয়ার দাপটে। কাঠের স্থূপ কোনমতে সরিয়ে ভেতরে পা রাখতেই ওরা চমকে উঠল। একটি শরীর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। অনড়। মুখে চমৎকার শান্তি। যুবকটি দুহাতে তাকে ধাক্কা দিয়ে হাউমাউ করে উঠল। মধ্যবয়স্কা মহিলাটিব ভাবান্তর হওয়ার কথা নয়। আনন্দ যুবকটিকে টেনে তুলল। এই মাজাভাঙা ঘরে আর কোন মানুষ নেই। বোঝাই যাচ্ছে কাঠ চাপা পড়ে প্রৌঢ়া মারা গিয়েছেন। ওর পেটের ওপর থেকে এখন স্থূপটাকে সরিয়ে নেওয়ার কোন মানে হয় না।
কিন্তু ব্যাপারটা অন্য তিন যুবকের মধ্যে আচমকা পরিবর্তন আনল। এই দুর্যোগ মৃত্যুর কারণ হয়েছে জানার পর যেন তাদের সঙ্কোচ দুর হল। যতটা সম্ভব চটপট পায়ে তারা পরের ঘরে আঘাত করল। ভেতর থেকে সাড়া মিলল, কে?
যুবকটি বলল, তোমাদের যদি এখানে থাকতে অসুবিধে হয় তাহলে নতুন ঘরে চলে যাও, সেখানে আরামে থাকতে পারবে।
খানিক পরে এই ঝড়ের মধ্যে এক চমকপ্রদ দৃশ্যের অবতারণা হল। দলে দলে ছেলেবুড়ো ছুটছে মাথা নিচু করে যৌথগৃহের দিকে। যে কটি যৌথগৃহ এই গ্রামে বানানো হয়েছিল তা সম্ভবত এতক্ষণে ভরে উঠেছে। যাওয়ার আগে সবাই অবাক চোখে আনন্দকে দেখছিল। পালদেমের ঘরের সামনে এসে আনন্দ চিৎকার করল। এই সময় সে আবিষ্কার করল বিপরীত আবহাওয়া প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেবার পর সহনীয় স্তরে পৌঁছে যায়। এখনও অবশ্য ঠাণ্ডা লাগছে, ঝড়ে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সেই কাঁপুনিটা নেই। ভেতর থেকে পালদেমের গলা পাওয়া গেল, কে, কে ডাকে?
দরজা খোল, আমি আনন্দ। আনন্দ এবার আঘাত করল।
দরজা খুলল পালদেমের বউ। আনন্দকে দেখে সে চমকে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে ঢুকতে দিল। ভেতরে আসামাত্র বউটি হাউমাউ করে কিছু বলতে লাগল। পালদেম যে নেশায় চুর হয়ে বসে আছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না। ঘরে আগুন নেই। বউটিও মদ খেয়েছে। বাচ্চাটা কুঁকড়ে একপাশে পড়ে আছে ছেড়া জামাকাপড় জড়িয়ে। একটা জীর্ণ কম্বল তার শরীরের ওপর চাপানো। আনন্দ এক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর দুহাতে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল। ওর ভারী শরীর কিন্তু ঠাণ্ডায় যে কাতর তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এই সময় যুবকদের একজন এসে পৌঁছতেই আনন্দ তাকে বলল, এর মাকে নিয়ে এস যেখান থেকে তোমরা এসেছ। তারপর মাথা নিচু করে দৌড়াতে লাগল ঝড়ের তাণ্ডব বাঁচি। বাচ্চাটা ককিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর আনন্দ ছুটন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল, দুটো কচি হাত তাকে আঁকড়ে ধরেছে। আর মানুষের শরীরের উত্তাপ আনন্দকে এই মুহূর্তে উত্তপ্ত করল। এই আরামের কোন বিকল্প নেই। পথ বেশি দূরের নয় কিন্তু আনন্দর কাছে যেন ফুরাতেই চাইছিল না।
ভেতরে ঢোকামাত্র জয়িতা এগিয়ে এল। আনন্দ কোনরকমে ওর হাতে বাচ্চাটাকে তুলে দিয়ে বলতে পারল, একে বাঁচা। প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে জয়িতা বাচ্চাটাকে আগুনের পাশে রাখল। ঠাণ্ডায় নীল হয়ে গেছে ঠোঁট। মুখ নীরক্ত। সে উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছিল পরম মমতায়। এখন বৃদ্ধরা তার আশেপাশে। তারা নির্দেশ দিচ্ছিল কি করা উচিত এক্ষেত্রে। আনন্দ দম নিল। ঘর গিজগিজ করছে। মাচা নয়, এখন মাটিতেও মানুষ। অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে দুধারে। সঞ্চিত কাঠ নিয়ে আসছে কেউ কেউ। এখন বেহিসাবী খরচ করা ঠিক নয়। কিন্তু কথাটা বলার সময়ও এটা নয়। এই সময় যুবকরা বাচ্চাটির মাকে নিয়ে এল। একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে সে। এখনও তার হাবভাবে নেশার প্রতিক্রিয়া আছে। আনন্দ আবার বেরিয়ে এল। এবং আসতেই পালদেমকে দেখতে পেল। পালদেমের পা টলছে এবং সেটা যে ঝড়ের দাপটে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। আনন্দকে দেখামাত্র পালদেম বলল, আমার বাচ্চা-বউকে চুরি করে নিয়ে গেছে, মার শালাকে, মার।
সঙ্গে সঙ্গে রক্ত উঠে গেল মাথায়। আনন্দ হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গে পালদেমের শরীরটা বরফের ওপর আছড়ে পড়ল। যে-যুবকটি পালদেমের বউকে নিয়ে গিয়েছিল যৌথগৃহে সে বেরিয়ে এসেছিল এই সময়। পালদেমের অভিযোগ তার কানে পৌঁছেছিল। তাই ওর পড়ে যাওয়া দেখেও হাসি সামলাতে পারল না সে। বরফের ওপর পড়ে গিয়ে এখন পালদেম টানটান হয়ে শুয়ে আছে। আনন্দ যুবকটিকে বলল, ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে যাও। এখানে পড়ে থাকলে জমে যাবে। যুবকটি চটপটে পায়ে কাছে গিয়ে পালদেমের হাত ধরে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল। তাপল্যাঙের বেশির ভাগ মানুষ যৌথগৃহে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের ঘর মজবুত তারা সেখানেই থেকে গেছে। মৃত্যুর সংখ্যা আপাতত চার। অবশ্য ঝড় থামলে সঠিক বোঝা যাবে। শেষ যাকে আবিষ্কার করল তাকে আশা করেনি কেউ। নিজের ঘরের খুব কাছাকাছি জমে থাকা বরফে মুখগুঁজে শরীরটা পড়েছিল। আবিষ্কৃত হওয়ার পর চেঁচামেচি করে সবাই ধরাধরি করে তাকে তুলে নিয়ে এল। প্রায় লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে পালার দেহ। আনন্দ দেখল, মৃত্যুসংবাদ পাওয়ামাত্র তামাম তাপল্যাঙ চোখের জল ফেলছে। কেউ কেউ গলা খুলে কাঁদছে। যৌথগৃহের মাহলারা সুর করে একটানা কাঁদতে আরম্ভ করল। পালা এই গ্রামের প্রধান। অন্যতম বয়স্ক ব্যক্তি। জরা তাকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু দীর্ঘকাল মানুষটাকে সবাই পালার সম্মান দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে ঝড় শুরু হওয়ার পর যখন তার ঘরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তখন পালা আশ্রয়ের খোঁজে বাইরে রেরিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তার শরীরের ওপর তুষার জমে ওঠায় চট করে কারও নজরে পড়েনি।
যৌথগৃহের আগুন এখন অত্যন্ত দুর্লভ বস্তু। সবাই তার চৌদিকে ভিড় করছে। কিন্তু আনন্দ ঢোকামাত্র কেউ কেউ তাকে আগুনের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিল। নিজেকে কোনরকমে সেখানে নিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বুকভরে বাতাস নিতে লাগল সে। মনে হচ্ছিল শরীরে একফোঁটা, শক্তি
অবশিষ্ট নেই। তার নাক দিয়ে অসাড়ে জল পড়ছিল। মুখের খোলা জায়গাগুলোতে কোন সাড়া নেই। এই যৌথগৃহে এখন কান্না এবং শিশুদের চিৎকার সমানে চলছে। এই সময় একটা হাত আনন্দর কাঁধে উঠে এল। আনন্দ তাকাচ্ছিল না। আগুনের গনগনে তাপ শরীরে ছড়িয়ে দিতে উন্মুখ ছিল সে। হাতের মালিকের গলা শুনতে পেল সে, তোমরা যা করলে তার তুলনা নেই। প্রত্যেক বছর শীত শুরু হবার ঝড়ে অন্তত জনা সাতেক বুড়োবুড়ি মরে যায়। তোমরা আমাদের বাঁচালে। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করবেন।
এবার আনন্দ চোখ তুলল। ভেনা। পালদেমের ভগ্নীপতি। এই ভেনাই সেদিন অসহযোগিতা করেছিল। তাপল্যাঙের সচ্ছল মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু ভেনা কেন যৌথগৃহে? ধরেই নেওয়া যায় ভেনার ঘরবাড়ি অনেক মজবুত। কিন্তু আনন্দ কোন কথা বলল না। আসলে কিছু বলার মত শক্তি সে খুঁজে পাচ্ছিল না। এত তীব্র ঠাণ্ডা এবং হাওয়ার ধার সে কোনদিন কল্পনাতেও আনেনি। পশ্চিমবাংলার মানুষের কাছে এই প্রকৃতি অচেনা। এবং যা অচেনা তাই অবাস্তব নয়। কলকাতার ঠাণ্ডায় যারা দারুণ শীত বলে অভ্যস্ত তাদের কাছে এই আবহাওয়ায় মৃত্যু স্বচ্ছন্দে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আর এক ধরনের সুখ চুইয়ে আসছিল আনন্দর মনে, সে অন্তত গ্রামের লোকগুলোকে আপাতত একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছে।
এখন দুপুর। হাওয়া কমেছে। তুষারমাখা ঠাণ্ডা বাতাস গুনগুনিয়ে ফিরছে। এই চেহারা দেখলে কে বলবে যে গত তিন রাতে কি ঘটেছিল! এখন বরফ পড়ছে না। জয়িতা শেষ পর্যন্ত পালদেমের বাচ্চাটাকে স্বাভাবিক নিঃশ্বাসে ঘুমাতে দেখল। পালদেম আর তার বউ এখনও মড়ার মত পড়ে আছে। এই যৌথগৃহের অনেকেই মদ খেয়েছে। বস্তুত শীতের হাত থেকে বাঁচার সহজতম হাতিয়ার এদের কাছে মদ। যে বাচ্চাগুলো ঘ্যানর ঘ্যানর করছে তাদের যে খিদে লেগেছে তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মায়েরা প্রায় নির্বিকার। বৃদ্ধরা পালার শোকে কেঁদে চলেছে এখনও। এই কান্না চলবে যতক্ষণ পালার শরীর মাটির ওপরে থাকবে। জয়িতা আনন্দকে খুঁজল। আনন্দ বসে আছে যে ভঙ্গিতে তা দেখে আপাতত ওকে না ডাকার সিদ্ধান্ত নিল সে। তারপর তিনজন যুবকসঙ্গীকে নিয়ে বাইরে বের হল। চমৎকার হলদে বোদ নেতিয়ে আছে বরফের ওপরে। আকাশের ফাঁক গলিয়ে সূর্য আপাতত এটুকুই তাপল্যাঙকে দিতে পারছে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। সমস্ত পাহাড় আর তার গায়ের বরফগুলো হলুদে মাখামাখি এখন। আর এসব দেখার মুহূর্তে জয়িতার কল্যাণের কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর একটা মোচড়, টপটপ করে জল ঝরতে লাগল গাল বেয়ে। এই কান্নার একটুও প্রস্তুতি ছিল না। এই সময় হালকা হিম-বাতাস বয়ে যেতেই দুটো গাল জুড়িয়ে গেল। ফেটে যাওয়া চামড়ায় একটা নরম আরাম ছড়িয়ে পড়ল। এবং সেটা টের পেতেই বুক নিংড়ে নিঃশ্বাস বের হল।
বাকি যৌথগৃহগুলোয় মানুষ উপচে পড়ছে। লা-ছিরিঙ একা তাদের দেখাশোনা করছে। জয়িতাকে দেখতে পেয়ে সে লাল দাঁত বের করে হাসল, আরও তিনটে এই রকম বাড়ি তৈরি করলে ভাল হত।
জয়িতা বলল, আমাদের তো ধারণাই ছিল না। তোমার দেখা পেয়ে ভাল হয়েছে। আমরা যেসব চাল ডাল কিনে রেখেছিলাম সেগুলো বের করে রান্নার ব্যবস্থা কর! সন্ধ্যের আগেই প্রত্যেককে খাবার দিয়ে দাও।
লা-ছিরিঙ মাথা নাড়ল, আমি এই কথাই ভাবছিলাম।
হাওয়া বন্ধ হতে অনেকেই বেরিয়েছে যৌথগৃহ ছেড়ে। জয়িতা লক্ষ্য করল যে মানুষই তার সামনে পড়ছে সে-ই খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে তাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে। যারা ঘর ছেড়ে বের হয়নি এবার তাদের খোঁজ নেওয়া শুরু হল। বৃদ্ধরা বলছে আজ রাত্রে আরও ভারী বরফ পড়বে। অতএব এখন থেকেই সাবধান হওয়া উচিত। কিন্তু যারা ঘরে রয়ে গেছে তারা জানে আপাতত কোন বিপদ নেই। তাদের উনুনে আগুন পড়েছে। স্পষ্টত এখন গ্রামে দুটো শ্রেণীর অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। এটা হতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু জোর করে এক করার চেষ্টা বোকামির নামান্তর হবে। সে প্রত্যেক দরজায় গিয়ে বলে এল যদি কোন অসুবিধে হয় তাহলে বিনা দ্বিধায় যেন সবাই যৌথগৃহে চলে যায়।
এই সময় কানকে দেখতে পেল সে। শিষ্যদের পেছনে নিয়ে তিনি মন্দির থেকে নেমে আসছেন। তাকে দেখে সবাই জড়ো হল। কাহন ঘঘাষণা করলেন পালার অন্ত্যেষ্টিকাজ আগামীকাল হবে। তারপর তিনি তাকালেন জয়িতার দিকে। এক মুহূর্ত যেন চিন্তা করলেন। তার শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি চাও? নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এই গ্রামের মানুষদের সাহায্য করছ কেন?
জয়িতা বলল, এই গ্রামের মানুষরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয়দাতারা আমাদের বন্ধু।
খুব ভাল উত্তর। কিন্তু তোমাদের জন্যে পুলিস এসেছিল এই গ্রামে। আমিও জীবনে পুলিশ এই প্রথম দেখলাম। শুনেছি তারা একবার আসলে বার বার আসে। আবার এলে কি হবে? কাহুনের মুখে হাসি।
এবার লা-ছিরিঙ জবাব দিল। তার গলায় যেন আঁঝ মেশানো, এবার এলে আমরা সবাই লড়াই করব। আমাদের এই পাহাড়ে বাইরের পুলিশ কি করতে পারে! এরা না থাকলে আজ আমরা কোথায় যেতাম বলতে পারেন?
জয়িতা মাথা নাড়ল। তারপর এগিয়ে গিয়ে বলল, কাহুন, আপনি ঈশ্বরের সেবক। সত্যি কথা বলছি, ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব মানুষের সঙ্গে। এই গ্রামের মানুষরা যদি মানুষের মত বাচার পথ খুঁজে পায় তাহলে আমাদের বন্ধুত্ব মূল্যবান হবে। আপনার ঈশ্বর কি চান না যে এরা মানুষের মত বেঁচে থাকুক!
কাহুন মাথা নাড়লেন। কি যেন বিড়বিড় করে বললেন। বোঝা গেল তিনি জয়িতার কথার অর্থ ধরতে পারছেন না। যাওয়ার আগে বললেন, মৃতদের নিয়ে এস মন্দিরে। ওদের জন্যে প্রার্থনা করতে হবে।
শুধু চাল এবং ডালের ঘাট যে মানুষের কাছে উপাদেয় লাগে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। জয়িতার গলা দিয়ে বস্তুটাকে নামাতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ক্ষুধা এমন জিনিস যে শরীরকে বাধ্য করে একটু রসের লালা নিঃসরণ করাতে, যা খাদ্যদ্রব্যটিকে পেটে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। অথচ চারপাশের মানুষ গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে। সেই সম্মিলিত শব্দ শুনতে শুনতে জয়িতার মনে হল এই মানুষগুলো পৃথিবীর অনেক লোভনীয় খাবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে। যারা বছরে এক আধবার চালের স্বাদ পায় তাদের কাছে এই খাবার অমৃত। আসলে আরও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই মানুষের মনে অসন্তোষের বীজ বোনে।
আনন্দ এখন সহজ। কিন্তু সামান্য কাশি হয়েছে ওর এর মধ্যেই। জয়িতা ওকে বলল, তুই আজ এখান থেকে বের হোস না। আমি একবার আস্তানা থেকে তোর বিছানা আর ট্যাবলেট এনে দেব।
ট্যাবলেট কি হবে? আনন্দ হাসল।
বলা যায় না, এ যা ঠাণ্ডা কি থেকে কি হয়ে যায়! জয়িতার আবার কল্যাণের মুখ মনে পড়ল। ওর পাঠানো ওষুধের ঝোলায় ঠাণ্ডা থেকে তৈরি জ্বর এবং কাশির ওষুধ ছিল।
আনন্দ বলল, ঠিক আছে। অনেকক্ষণ সুদীপের খবর পাইনি। ওরা কিছু খেল কিনা তাও জানি না। কাউকে পাঠালে ভাল হয়।
জয়িতা মাথা নাড়ল, দরকার নেই। আস্তানায় যা আছে তাই দিয়ে মেয়েটা খাবার বানিয়ে নিতে পারবে। এখন কি কি কাজ বাকি আছে চিন্তা কর।
আনন্দ চারপাশে তাকিয়ে নিল। তারপর বলল, লোকগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। একটাতে বাচ্চা আর মেয়েরা থাকবে। আর একটায় বুড়োবুড়ি। জোয়ানরা আলাদা। মেয়েদের একটা দল তৈরি করে তাদের ওপর রান্না আর সেবাশুশ্রুষার ভার দে। বুড়োবুড়িদের আপাতত কোন কাজ করতে হবে না। আজ আর সম্ভব হবে না, কাল থেকে ছেলেদের নিয়ে কাজে বের হতে হবে আমাদের।
লা-ছিরিঙ পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বাংলা বোঝে না। জয়িতারা কথা বলছিল বাংলায়। অতএব সে উদ্বিগ্ন মুখে শুনছিল সব। শেষ হতে বলল, তিনটে মুরগি মারা গিয়েছে। একটা ছাগল খুব চোট পেয়েছে। যে মেয়েটা তোমাদের সঙ্গে আছে তার ঘরে ওদের নিয়ে গিয়েছি। মুশকিল হল বরফ পড়ার পর ওদের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কি করা যায় বল তো?
জয়িতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, আনন্দ তাকে বাধা দিল, লা-ছিরিঙ, ওই জীবগুলো এই গ্রামের সম্পত্তি। ওদের সংখ্যা বাড়লে এই গ্রামের উপকার হবে। অতএব ওদের বাঁচিয়ে রাখা তোমাদের কর্তব্য। কিভাবে সেটা করবে তা তোমরাই ঠিক করবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বলব এটা ঠিক নয়।
লা-ছিরিঙ হাসল, আজ আমি ওদের ভাতডাল সেদ্ধ খেতে দিয়েছি।
না, তুমি অন্যায় করেছ। আনন্দ রেগে গেল, তুমি অন্যায় করেছ। মানুষের জন্যে খাবার ব্যবস্থা করা যেখানে কষ্টকর ব্যাপার সেই খাবার ওদের দেওয়া উচিত হয়নি। তুমি এখনই কিছু ছেলেকে পাঠিয়ে দাও জঙ্গলে। ছাগলরা যেমন পাতা খায় তা যেন সন্ধ্যের আগেই ওরা কেটে নিয়ে আসে। আর ঘরে ঘরে খোঁজ নিয়ে দ্যাখো মকাই-এর নষ্ট হয়ে যাওয়া দানা কার কাছে কত আছে। সেগুলো মুরগিদের জন্যে রাখ।
লা-ছিরিঙ মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতে জয়িতা বলল, ওর ওপর ছেড়ে দিয়েও তো নিজে না বলে পারলি না। একটু আগে কানের সঙ্গে কথা হল। আজ লোকটার হাবভাব ঠিক মনে হল না।
চমকে উঠল আনন্দ, কেন? কি বলেছে কাহুন?
প্রশ্ন করছিল। কেন এসব করছি আমরা? পুলিশের দায় কে বইবে, এই সব।
লোকটাকে খাবার দেওয়া হয়েছে?
জানি না।
না দেওয়া হলে তুই নিজে দিয়ে আয়। এখনই ওকে চটানো ঠিক হবে না। এদের জন্ম-মৃত্যু ওই লোকটার সঙ্গে বাঁধা হয়ে আছে। এতবড় একটা দুর্যোগের পর বোধহয় কান্থন আশা করছিল গ্রামবাসীরা ওর কাছে প্রার্থনার জন্যে যাবে। আমার ভুলও হতে পারে, কি জানি। শেষদিকে অন্যমনস্ক দেখাল আনন্দকে।
জয়িতা আর সময় নষ্ট করল না। একটা পাত্রে খাবার নিয়ে সে মন্দিরের দিকে রওনা হল। ধাপে ধাপে ওপরে উঠে সে দেখতে পেল শিষ্যরা মন্দিরের চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে একই খাবার খাচ্ছে। অর্থাৎ এখানেও খাবার পৌঁছে গেছে। জয়িতা ফিরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই কাহুন বেরিয়ে এলেন শুন্য পাত্র হাতে। এবং তখনই তিনি জয়িতাকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে জয়িতার মাথায় মতলবটা খেলে গেল। সে ধীরপায়ে কাহুনের সামনে গিয়ে পাত্রটা এগিয়ে ধরল। এক পাত্র শেষ করার পরও যে কাহুনের তৃপ্তি আসেনি তা বোঝা গেল তিনি যে তৎপরতায় জয়িতার হাত থেকে পাত্রটি নিলেন তা দেখে। খেতে খেতে কাহুন মাথা নাড়লেন, আমাকে একথা বলতেই হবে যে তোমরা গ্রামের মানুষদের উপকার করছ। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন।
জয়িতা বলল, আজ সবাইকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। কাল ঠিক হয়েছে, যারা গ্রামের মানুষের জন্যে পরিশ্রম করবে তাদেরই খাবার দেওয়া হবে।
পরিশ্রম! কানের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, কেন, পরিশ্রমের কথা উঠছে কেন?
যারা কাজ করবে না তাদের খাওয়ানো হবে না, তাই।
কাজ বলতে কি বোঝ তোমরা?
যা করলে গ্রামের মানুষের উপকার হবে তাই।
এবার কাহুনের মুখে হাসি ফুটল, তাই বল। আমি যে প্রতিনিয়ত ভগবানের কাছে গ্রামের মানুষের জন্যে প্রার্থনা করে যাচ্ছি সেটাও তো একটা কাজ। গ্রামের উপকারের জন্যেই করা।
জয়িতা বলতে যাচ্ছিল যে-উপকার চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না তাকে স্বীকার করা যাচ্ছে না। কিন্তু আনন্দর পরামর্শ মনে রেখে সে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। পাত্রটি শেষ করে ফিরিয়ে দিয়ে কান মালা জপতে জপতে ফিরে গেলেন ভেতরে। এঁটো হাত ধোওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
আস্তানায় ঢোকার আগেই চমকে উঠল জয়িতা। তীব্র গন্ধটা নাকে লাগছিল। দরজা খুলে ভেতরে পা দিতেই সে হতবাক হয়ে গেল। মেয়েটি হাসছে। মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে। সুদীপ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেই চেষ্টার সময়েই বোঝা যাচ্ছিল ও প্রকৃতিস্থ নয়। সুদীপ এমনিতেই আপাতত সুস্থ নয়। কিন্তু এই ভঙ্গি সেই ছবিটা থেকে ভিন্ন। চিলের মত ছোঁ মেরে মাটিতে পড়ে থাকা গ্লাসটা যে ক্ষিপ্রতায় সে তুলে নিল তা অনেকদিন সুদীপের কাছ থেকে আশা করেনি কেউ। দু ঢোক গলায় নিয়ে মেয়েটার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সুদীপ। তারপর চিৎকার করে বলল, আঃ!
জয়িতা যে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তা দুজনের কারোর লক্ষ্যে নেই। দুবার টলে সুদীপ হাঁটু মুড়ে আবার বসে পড়ল মাটিতে। তার মাথা এবার মেয়েটার পাশে এলিয়ে পড়তে সে সযত্নে তাকে তুলে নিল কোলে। তারপর ঝুঁকে পড়ে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ভাল লাগছে? তোমার ভাল লাগছে?
খু-উ-ব। খু-উ-ব। চোখ বন্ধ করে শব্দ দুটো বিভিন্ন স্বরে উচ্চারণ করে মাথা নাড়ল সুদীপ। জয়িতা আরও অবাক। এখন সুদীপের কথা বুঝতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। মেয়েটা সুদীপের কপালে হাত বোলাচ্ছে। কিন্তু এই দুর্যোগের মধ্যে ও মদ পেল কোথায়? বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটি জোগাড় করে এনেছে। তীব্র মদ সুদীপের চেতনা মুছে দিয়েছিল। সেই মদই কি আবার চেতনা ফিরিয়ে আনছে? বিষে বিষক্ষয়? এই সময় মেয়েটি ঝুঁকে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট চেপে ধরল সুদীপের কপালে। হঠাৎ জয়িতা আবিষ্কার করল তার শরীরে রক্ত সচল হয়েছে। আচমকা অস্বস্তি হচ্ছে তার। সুদীপ পড়ে রয়েছে স্থির হয়ে। মেয়েটি মুখ তুলল। আলতো হাত বোলাল সুদীপের গালে। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট ছোঁয়াল সুদীপের বন্ধ চোখের পাতায়। প্রথমে বাম তারপরে ডান। সুদীপ নড়ছে না। কোন প্রতিক্রিয়া নেই। মুখ তুলে মেয়েটি সুদীপের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর খিলখিলিয়ে হাসল। সেই হাসির ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল তারও বেশ নেশা হয়েছে।
জয়িতা নড়তে সাহস পাচ্ছিল না। এই দৃশ্যকে অশ্লীল বলা যায় না। অথচ এককালে যা অবশ্যম্ভাবী বলে সে আশঙ্কা করেছিল তা চোখের সামনে দেখে স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেইসঙ্গে তার মনে দ্বিতীয় একটা ইচ্ছে জন্ম নিল। সুদীপ সাড়া দিক, মেয়েটি যে কামনার আগুন জ্বালতে চাইছে তাতে উদ্দীপ্ত হোক। এবং তা হলেই ও স্বাভাবিক সুদীপে ফিরে আসবে। মেয়েটির বোধহয় দেখা শেষ হল। তার মাথা আবার ঝুঁকে পড়ল সুদীপের ওপরে। খুব যত্নে সে নিজের ঠোঁট দুটো ছোঁয়াল সুদীপের ঠোঁটে। প্রথমে আলতো। তারপর নিচের ঠোঁট বোলাল। ওর সাপের মত জিভ দেখতে পেল জয়িতা এবং এই প্রক্রিয়ার পর সে প্রচণ্ড শক্তিতে চেপে ধরল ঠোঁট সুদীপের ঠোঁটে। যেন সুদীপের ঠোঁট কামড়ে তুলে নিতে চায় এমন মনে হচ্ছিল তার ভঙ্গিতে।
এবং তখনই ঝটপট করে উঠে বসল সুদীপ। দুহাতে নিজের ঠোঁট ঢাকল। মুখ থেকে উচ্চারিত হল, আঃ! শোনামাত্র মেয়েটি আবার খিলখিলিয়ে হাসল। হেসে মদের গ্লাস তুলে ধরল। সুদীপ সেদিকে একবার তাকাল। তারপর ঢকঢক করে তরল পদার্থটি গলায় চালান করে দিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট ড়ু ইউ ওযান্ট? ঠিক এতটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না জয়িতা। সুদীপের চেতনা ফিরছে বোঝা যাচ্ছিল কিন্তু ও যে অত স্পষ্ট ইংরেজী বলতে পারবে এবং সেই একই ভঙ্গিতে তা বিশ্বাসে ছিল না। ওর এত আনন্দ হচ্ছিল যে ছুটে গিয়ে সুদীপকে জড়িয়ে ধরতে পারলে তৃপ্তি পেত। সুদীপ সুস্থ হওয়া মানে জীবনটাকে সচল দেখা।
মেয়েটা সুদীপের ইংরেজী বুঝতে পারল না। কিন্তু ওই প্রশ্ন উচ্চারণ করার ধরন হয়ত অনুমান করতে পারল। সে চোখ বন্ধ করে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে দুটো ঠোঁট তুলে ধরল। সুদীপ এক মুহূর্ত তাকিয়ে বলল, গুড। তারপর দায়সারা গোছের একটা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়াল, দ্যাটস এনাফ। কিন্তু দাঁড়ানো মাত্র তার শরীর টলতে লাগল। নিজের মনে সুদীপ বিড়বিড করল, যাঃ শালা! আই অ্যাম ড্রাঙ্ক? শী ওয়ান্টস টু শ্লিপ উইথ মি! শু্যড আই? কৃতজ্ঞতা বলেও তো একটা জিনিস আছে। লুক, আই হ্যাভ নেভার প্টে বিফোর। আমি যে শোব কিন্তু আমার বন্ধুরা কি বলবে? আনন্দ, কল্যাণ—! হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সুদীপ। মাটিতে বসে পড়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। মেয়েটি এমন হতভম্ব হয়ে গেল যে তার মুখ থেকে সমস্ত বাসনার চিত্র উধাও হয়ে গেল। দূর থেকেই সে সুদীপের পায়ের ওপর একটা হাত আলতো করে রাখল। জয়িতার মনে হল ওই হাতের যে স্পর্শ তা যে কোন মায়ের হতে পারত।
বাইরে বেরিয়ে এসে স্বস্তি পেল জয়িতা। যাক, সুদীপ এখন সুস্থ হয়েছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, ওই মেয়েটির সঙ্গে সুদীপ কাল নয় পরশু শারীরিক সম্পর্কে আসবে। এটা ন্যায় না অন্যায় সে জানে না। মেয়েটি যে দিনের পর দিন সুদীপের সেবা করে গেছে তা সবাই দেখতে পেয়েছে। সুদীপও সেটা জানে। নইলে বলত না কৃতজ্ঞতা বলে একটা জিনিস আছে। হঠাৎ মাথার ভেতর সব গোলমাল হয়ে গেল জয়িতার। সটান ফিরে এল আস্তানায়। শব্দ করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, কি অবলার মত কাঁদছিস! তোর লজ্জা করছে না?
মুখ তুলে তাকাল সুদীপ। তার মুখে হাসি ফুটল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, এই যে জোয়ান অফ আর্ক এসে গেছে! নাকি লক্ষ্মীবাঈ! আমি কাঁদছি তো কার কি? তুই তো একটা মরুভূমি, এক ফোঁটা জল নেই যে কাঁদবি। তাকাচ্ছিস কি, তুই কাঁদতে পারিস?
জয়িতা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল, আমি মরুভূমি!
নোস? টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সুদীপ, তাহলে দাঁড়া। দেখি তোকে।
কোনরকমে এগিয়ে এল সুদীপ। তারপর জয়িতার মুখের দিকে ঝুঁকে সোজা হয়ে হাসল। একটা হাত তুলে আঙুল দিয়ে জয়িতার চিবুক থেকে কিছু তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরল, এটা কিরে? ভাত? তুই এখানে এসে জংলী হয়ে গেছিস জয়! খেয়েদেয়ে মুখ ধুতে হয় ভুলে গেছিস! আমাকে তোর খুব ঘেন্না দিতে ইচ্ছে করছে, না?
বাংলাটা ঠিক করে বল। মরুভূমি দেখলি?
মাথা নাড়ল সুদীপ। তারপর বলল, তোর দুটো হাত আমার গালে রাখবি জয়?
নাড়া খেল জয়িতা। তারপর ধীরে ধীরে সে দুটো হাতে সুদীপের মুখ ধরল। পবিত্র আলো ফুটে উঠল সুদীপের মুখে, আঃ! জন্মদিনে এত আরাম কখনও পাইনি রে!