এদিক ওদিক থেকে নানারকম খবর পেয়ে কেষ্ট পাল আসল খবর জানতে আসে গোলাবাড়ি হাটে। ক্যা রে বৈকুণ্ঠ, বাবু কোটে? ইগলান কি সোমাচার শুনিচ্ছি, ক তো?
কেষ্ট পালের সঙ্গে পালপাড়ার আরো কয়েকজন। এরা সবাই জিগ্যেস করতে শুরু করলে বৈকুণ্ঠ ঘাবড়ে যায়, আমতা আমতা করে বলে, বাবু তো গেছে রাণাঘাট। বাবুর শ্বশুর সিরাজগঞ্জ থ্যাকা রাণাঘাট যাবার সময় কুটি য্যান মোসলমানের হাতে খাম হছে, পিঠেত চোট পাছে, বাঁচে কি না বাঁচে। বাবু তাক দেখবার গেলো।
পরিবার?
সোগলিক লিয়া গেছে। শ্বশুরের কী হয় না হয়! পালদের স্তম্ভিত মুখ দেখে সে তাদের আশ্বাস দেয়, রাণাঘাট কয়দিন থাকবি। তারপরে কলকাতা যাবি। কলকাতা থ্যাকা আসতে দিন বিশেক লাগবার পারে।
ইগলান বিত্তান্ত বাদ দে, কেষ্ট পাল চড়া গলায় বলে, বাবু বলে বাড়ি বেচ্যা দিছে?
এই গুজবটা বৈকুণ্ঠ শুনেছে কাল বিকালে। আলিম মাস্টার বলে গেলো, হাজারখানেক টাকা নিয়ে মুকুন্দ সাহা নাকি তার দুই বিঘা জমির ওপর বাড়ি, মানে একটা আটচালা আর দুটো চারচালা ঘর, দুইটা কাঁঠাল গাছ, ভালো জাতের আমগাছ গোটা বিশেক, চারটে লিচু গাছ এবং একটা করে বিলাতি আমড়া, জামরুল, কামরাঙা আর মেলা কূলগাছের বাগান আর পুকুর বেচে গেলো শরাফত মণ্ডলের কাছে। একে মোসলমান, তায় দাপটের মানুষ, ওদের হাত থেকে লুট করার সাধ্যি কারো হবে না।
আরে চাবি তো নিলো লুট করা পালপাড়ার অর্জুন এই কথা বললে কেষ্ট পাল তাকে থামায়। বৈকুণ্ঠকে ফের জিগ্যেস করে, দোকানের ব্যবস্থা কী করিছে?
হামাক কলো, দোকান ভালো করা দেখিস। ভালো দর পাস তো মাল যা আছে। ব্যামাক ছাড়া দিস। কলকাতা থাকা মালের অর্ডার দিয়াই আসবি। মুকুন্দ সাহার ওপর বৈকুণ্ঠের আস্থা এখনো অটুট, দোকান ছাড়ার মানুষ তাই লয়। দোকান হলো তার জান। দেখো না, কয়টা দিন যাক। গোলমাল, কাটাকাটি কমুক। শ্বশুরের কী হলো তাও তো জানি না। কয়টা দিন দেখি। আসার দেরি হলে বাবু হয়তো দুই চারের মধ্যে টেলিগ্রাম করবার পারে।
পালপাড়ার দল কাদেরের দোকানে গিয়ে গফুরকে একলা পেয়ে আসল খবর জানতে চায়। বলবে না বলবে না করেও সে শেষ পর্যন্ত বলে, ছোটোসাহেব ন্যাশনাল গার্ডের দুইটা মানুষ সাথে দিছে, তারা বর্ডার পার করায়া দিয়া আসিছে।
ভক্ষক গেছে রক্ষকের কাম করবার? পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের লোকদের তৎপরতা নিয়ে অসন্তোষ জানাতে কেষ্ট পাল প্রবাদটির উল্টো ব্যবহার করেও কেষ্ট পালের উদ্বেগ যায় না, মালপত্র ব্যামাক লিবার পারিছে? ব্যামাক। সোনাদানা তো বাবুর কম আছিলো না। কাঁসার বাসনকোসন, তামার বাসন, পূজার ঠাকুর,–জিনিস বাদ দেয়। নাই একটাও। বাড়ির দর কম হলে কী হয়, ব্যামাক হিসাব করলে তার লাভই হছে।
কেষ্ট পালের উৎকণ্ঠা, হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ে চতুর্গুণ। তার মোটাসোটা পা দুটো কাঁপতে লাগলে গফুর তার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়। বৈকুণ্ঠ অবশ্য বারবার বলে, আরে বাপু দুইটা দিন যাক না। বাবুর ব্যবসা আছে না?
বৈকুণ্ঠের কথা কেষ্টর কানে ঢোকে কি-না সন্দেহ। গফুর জানায়, বাড়ি বিক্রির কাজটা সাহাকে করতে হয়েছে একটু গোপনেই, নইলে কালাম মাঝি টাকাপয়সা না দিয়েই তার সম্পত্তি গ্রাস করে ফেলতো।।
কেষ্ট পাল এখন করেটা কী? লাঠিডাঙা কাছারির দিকে যাবার কথা বলতে গফুর জানায়, লায়েবাবাবু কাচারিত আসেই না।
কেষ্ট পালের তরুণ সঙ্গী একজন তাড়া দেয়, টাউনেত চলো। লায়েববাবু না থাকলেও সতীশ মুক্তার আছে।
টাউন বলে গরম হয়া আছে, গফুর কলু হুঁশিয়ার করে দেয়, ইনডিয়ার রিফিউজি আসিচ্ছে দলে দলে। কখন অরা কী করে, কওয়া যায় না।
কী করবার পারবি? অর্জুন পাল বীরত্ব দেখালেও পরবর্তী বাক্যেই তার তেজ। অর্ধেক ক্ষয় হয়ে যায়, পোড়াদহ মেলার আর তিন দিন। কাছারিত থাকা বরাদ্দ আসে নাই, সাহামশাই নাই।
বিকালবেলাতেই কালাম মাঝি উঠে আসে মুকুন্দ সাহার বারান্দায়। বৈকুণ্ঠকে ডেকে বলে, তোর বাবু খুব নিমকহারাম রে! বাড়িঘর তো দেওয়ার কথা হামাক। হামার বেটা পুলিস ফোর্স সাথে দিয়া বর্ডার পার কর্যা দিবি, কথা পাকা হয়া গেলো। তো আজ কেষ্ট পালের কাছে শুনি অন্য কথা। হামি বায়নাও করলাম পাঁচশো টাকা, দোকান দিবি, বাড়ি ঘর ব্যামাক দিবি। পাঁচ হাজার চায়, তা হামি তিন দিবার চাছিলাম। মণ্ডল কতো দিছে রে?
পালরা চলে গেলে অনেকদিন পর ছিলিমখানেক গাঁজা খেয়ে বৈকুণ্ঠ চমৎকার একটা ঘুম দিয়ে উঠেছিলো। মেলার দিন ছাড়া এসব নেশা সে ছেড়ে দিয়েছে বহু আগে, আজ কী হলো, বাবুও নাই, চুপচাপ কয়েকটা সুখ টান দিয়ে সে বেশ মৌজে আছে। এখন তার মুখভরা পান। মুখে জর্দা ঢেলে ঠোঁটে পিক চেপে রেখে জবাব দেয়, কী যে কও মাঝিকাকা। বাবুর ঠাকুর্দার আমলের দোকান, সেটা ছাড়া যাবার পারে? ব্যবসাপাতি ঠিকই চলিচ্ছে। যদি কিছু লেওয়ার থাকে তো কও। সস্তায় ছাড়া দেই।
কম দামে জিনিস কেনার টোপ গেলার বান্দা কালাম মাঝি নয়। প্যাচাল পাড়িস। সাহা ও বৈকুণ্ঠের দেশপ্রেমে সে কটাক্ষ করে, তোরা ভাত খাস এটি আর কুলিপানি খাস ঐপার। এটা কেমন কথা রে? বেটাবেটি রাখবি ইনডিয়াত, আর ব্যবসাপাতি করবি পাকিস্তানেত?
কালাম মাঝি বলে, এই দোকান তো তার দখলেই আসবে। তবে আরো কয়েকটা দিন সে দেখবে। দেরি হলে বৈকুণ্ঠকেই সে পাঠাবে মুকুন্দ সাহাকে ডেকে আনতে। বৈকুণ্ঠের রাহা খরচ বহন করবে সেই।
বৈকুণ্ঠ রাজি হয় না, তাই কী হয়? বাবু কোটে না কোটে থাকে, কেটা জানে? হামি কলকাতা যাই নাই জেবনে, বাবুর শ্বশুরবাড়ি, সেটাও দেখি নাই। পানের পিক একটু ফেলে সে ফের বলে, কয়টা দিন সবুর করো। পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান কও, ইগলান কী হয় দেখা যাক।
পাকিস্তানের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠের এরকম সন্দেহে কালাম মাঝির দেশপ্রেম চোট খায়, বৈকুণ্ঠ, কথাবার্তা সামলায়া কোস। যে পাতেত খাস, সেই পাতেত তোরা হাগিস! ফল ভালো হবি না কচ্ছি।
বৈকুণ্ঠের গাঁজা কিংবা পানজার মৌজ এতেও কাটে না। এমন কি পরদিন তমিজ বৈকুণ্ঠদা, মানুষের মাথা খারাপ হওয়া আরম্ভ হছে, কাত্তিক মাসের কুত্তাগুলার লাকান মানষে এখন পাগলা হয়া ঘোরে। তোমার এ্যানা হুঁশিয়ার থাকা লাগে। বললে জেগে ওঠে তার পূর্বপুরুষের তেজ। পানের পিক গিলে বুক চিতেয়ে সে বলে, এটি হামাক হুঁশিয়ার থাকা লাগবি কিসক রে? এই হাট পিতিষ্টা করিছিলো কেটা সেই খবর রাখিস? খবর রাখতে বয়ে গেছে তমিজের। বৈকুণ্ঠ গোলাবাড়ি হাটের প্রতিষ্ঠাতার নাম উল্লেখ না করে তোলে তার পুরনো প্রসঙ্গ, শোন, হামার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা, না-কি তার বাপ নাকি তারও ঠাকুর্দা, যথাযথ প্রজন্মটিকে চিহ্নিত করতে না পারলেও তার কিছু এসে যায় না, গোরা সেপাইদের সঙ্গে ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে তাদের লড়াইয়ের কাহিনী সে বলে ছাড়লো। তার সেনাপতি, নাকি মজনু ফকিরের সেনাপতি ছিলো পাকুড়গাছের মুনসি, ইগলান সোমাচার জানিচ্ছিলো তোর বাপ, পাকুড়গাছের মুনসিক লিয়া তোর বাপ কতো খবর পাচ্ছিলো।
পাকুড়গাছই নাই। তমিজ একটু তুচ্ছই করে, কিসের পাকুড়তলা পাকুড়তলা। করো? পাকুড়গাছ কাটা পড়লো কোনদিন, হামরা দিশাই পালাম না!
পাকুড়গাছ কাটা অতো সহজ লয় রে পাগলা!
কিন্তু এখন গোলাবাড়ি থেকে গিরিরডাঙার রাস্তা তো বিলের উত্তর সিথান দিয়েই, ইটখোলা হওয়ার পর সেখানে ঝোপজঙ্গল সাফ হয়ে কী সুন্দর রাস্তা হয়েছে। হাজার খুঁজেও তমিজ তো পাকুড়পাছের একটা পাতাও দেখতে পায় নি।
তা হলে কুলসুম এতো খবর পায় কোত্থেকে? ভর সন্ধ্যায় সেদিন খুব শীত পড়লে তমিজ ঘরে গেলো একটু সকাল সকাল। ঘর বন্ধ, ভেতরে ঘুটঘুটে আন্ধার, দরজা বন্ধ করে কুলসুম কথা বলে কার সঙ্গে? কেরামত আলি আসে নি তো? মানুষটাকে কুলসুম সহ্যই করতে পারে না, অথচ সুযোগ পেলেই সে প্যাচাল পাড়তে আসে তার সঙ্গে। আজ কি কুলসুম তাকে আস্কারা দিলো নাকি?। তা আন্ধার ঘরের মধ্যে জোয়ান মানুষটার সঙ্গে সে কিসের আলাপ করে? দরজার বাইরে কান পাতলে তমিজ শোনে কুলসুমের কথা, তুমি লিজে কবার পারো না? উদিনকা বেটার ওপরে আসর করিছিলা না? এখন আসর না করো, তাক বুঝায়া কও। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। কুলসুম ফের কথা শুরু : করলে বোঝা যায়, সে কারো কথার জবাব দিচ্ছে। কিন্তু আরেকজনের প্রশ্ন কিংবা অভিযোগ কিংবা প্রতিবাদের কিছুই শুনতে না পেলেও তমিজের বুক কাঁপে, কুলসুম তো কথা বলছে তমিজের বাপের সঙ্গে। তার এতোই ভয় করে যে, কুলসুমের গলার আওয়াজ পেলেও সেদিকে সে আর মনোযোগ দিতে পারে না। কতোক্ষণ পর সে জানে না, কাল আসো। ওটি তোমার খিদা নাগে না গো? বলতে বলতে কাউকে বিদায় দিতে দরজা খুলে তমিজকে দেখে কুলসুম খুশিতে খলবল করে ওঠে, ল্যাও বাপু, তোমরা বাপবেটা ফয়সালা করো। এই সময় তমিজের গায়ে হাওয়ার একটা ঝাপটা লাগে। কে গো? কাউকেই তো দেখা গেলো না।
অন্ধকার ঘরে দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ে বাইরের কুয়াশা-ছাকা আলো। ঐ সুযোগে কুয়াশাও খানিকটা ঢুকে অদ্ভুত একটি সুরত নিয়ে ঝুলতে থাকে ঘরের ছোট্টো ঐটুকু শূন্যতায়, সেটা ছড়ানো একেবারে মাচার ওপর পর্যন্ত। নিজের ভয় কাটাতে তমিজ খ্যাক করে ওঠে, ঘরত বাতি দেও না কিসক?
তোমার বাপ তো আবার সলোক থাকলে ঘরত ঢুকবার পারে না। এখনি গেলো, তুমি দেখলা না?
তোমার মাথা খারাপ হছে! ইগলান কী কও?
কুলসুম কুপি জ্বালালে তার দিকে তাকাতেও তমিজের ভয় করে। নিজের ঘরের মেঝেতে পিড়ি পেতে সে ভাত খেতে বসে, সামনে বসে কুলসুম বলে খালি তমিজের বাপের গল্প। তোমার বাপ আজ কয়দিন খালি এক কথা কয়! কী?-বেটাক হুঁশিয়ার হবার কও গো। কাল্লাহার বিলেত আগুন লাগবি, পানি থ্যাকা আগুন উঠা ঘরত ধরবি।
তোমার মাথা পুরা খারাপ হছে। ইগলান হাবিজাবি কী কও গো? তমিজের শাসন করার চেষ্টা চাপা পড়ে তার ভয়ের নিচে। পাঁচাল পাড়া বন্ধ করো। আর চারটা ভাত দেও।
তমিজের ভয়-পাওয়া গলার ধমকে কাবু না হয়ে কুলসুম হাঁড়ি থেকে ভাত তুলে দেয় হাত দিয়ে। তারপর জানায় তার বাপের আজকের অভিযোগ-কাম-হুঁশিয়ারিটি, তুমি বলে হুরমুতল্লার ঘেগি বেটিটাক লিকা করিছো? তোমার বাপ কয়, বেটা যেটি খুশি লিকা করুক, কিন্তু বৌয়ের সাথে থাকবার পারবি না।
তমিজ চমকে উঠলে তার গলায় ভাত আটকে যায়। পানি খেয়ে ফের খেসারি ডাল দিয়ে ভাত মাখে আর ভাবে, শালা শরাফত মণ্ডল হুরমতুল্লাকে যেভাবে শাসাচ্ছে, বুড়া খুব ভয় পেয়ে গেছে। মাঝির বেটার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে মণ্ডল হুরমতুল্লাকে জমি বর্গা করতে দেবে না। ওর জমি বর্গা করার দরকার কী? ফুলজানের হিস্যা বিঘা দেড়েক জমি তমিজ পাবে, অন্য দুই মেয়ের ভাগও চাষ করবে সে নিজেই। হুরমতুল্লা তো থাকবেই, বুড়া চাষবাসের তদারকি করে ভালো। এই সাড়ে চার বিঘা জমিতে তমিজ যে ফসল তুলবে, তার সঙ্গে আর কারো জমি বর্গা করে তার ও তার শ্বশুরের ও কুলসুমের চমৎকার চলে যাবে। ধান বরং খাওয়ার পর আরো বাঁচবে। সেই থেকে তমিজ বাপের জমি আর ভিটাঘর সব উদ্ধার করবে।
এখন এই কথাগুলো বাপজানকে জানায় কে? তাকে জানাতে স্বপ্নে বাপকে আসার সুযোগ দিতে তমিজ তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চায়। কিন্তু ঘুমাতে না ঘুমাতে স্বপ্নে বাপের বদলে সে দেখে কালাহার বিল সে পার হচ্ছে সাঁতরে। ফকিরের ঘাটে পানিতে নামলো, উত্তরপুবে সাঁতরে সে পাড়ি দিচ্ছে বিলের পানি। ওপারে ঘাট। ঘাট থেকে নামলেই মোষের দিঘি। মোষের দিঘির ওপর তালগাছের নিচে উঁইটিবির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুলজান। ফুলজানের কোলে বাচ্চাটার রোগ যেন সেরে গিয়েছে। সবই দেখছে। কিন্তু বিলের মাঝামাঝি পৌঁছুতেই তমিজের ঘুম ভেঙে যায়। পাশের ঘরে একা একাই কথা বলে চলেছে কুলসুম। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতে তমিজ ফের ঘুমিয়ে পড়ে।