ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও গোপীপ্রেম
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — মহাশয়, একাঙ্গী প্রেম কাকে বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — একাঙ্গী, কিনা, ভালবাসা একদিক থেকে। যেমন জল হাঁসকে চাচ্চে না, কিন্তু হাঁস জলকে ভালবাসে। আবার আছে সাধারণী, সমঞ্জসা, সমর্থা। সাধারণী প্রেম — নিজের সুখ চায়, তুমি সুখী হও আর না হও, যেমন চন্দ্রাবলীর ভাব। আবার সমঞ্জসা, আমারও সুখ হোক, তোমারও হোক। এ খুব ভাল অবস্থা।
“সকলের উচ্চ অবস্থা, — সমর্থা। যেমন শ্রীমতীর। কৃষ্ণসুখে সুখী, তুমি সুখে থাক, আমার যাই হোক।
“গোপীদের এই ভাব বড় উচ্চ ভাব।
“গোপীরা কে জান? রামচন্দ্র বনে বনে ভ্রমণ করতে করতে — ষষ্টি সহস্র ঋষি বসেছিলেন, তাদের দিকে একবার চেয়ে দেখেছিলেন, সস্নেহে! তাঁরা রামচন্দ্রকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। কোন কোন পুরাণে আছে, তারাই গোপী।”
একজন ভক্ত — মহাশয়! অন্তরঙ্গ কাহাকে বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিরকম জানো? যেমন নাটমন্দিরের ভিতরে থাম, বাইরের থাম। যারা সর্বদা কাছে থাকে, তারাই অন্তরঙ্গ।
[জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের সমন্বয় — ভরদ্বাজাদি ও রাম — পূর্বকথা —
অরূপদর্শন — সাকার ত্যাগ — শ্রীশ্রীমা দক্ষিণেশ্বরে ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি) — কিন্তু জ্ঞানী রূপও চায় না, অবতারও চায় না। রামচন্দ্র বনে যেতে যেতে কতকগুলি ঋষিদের দেখতে পেলেন। তাঁরা রামকে খুব আদর করে আশ্রমে বসালেন। সেই ঋষিরা বললেন, রাম তোমাকে আজ আমরা দেখলুম, আমাদের সকল সফল হল। কিন্তু আমরা তোমাকে জানি দশরথের বেটা। ভরদ্বাজাদি তোমাকে অবতার বলে; আমরা কিন্তু তা বলি না, আমরা সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দের চিন্তা করি। রাম প্রসন্ন হয়ে হাসতে লাগলেন।
“উঃ, আমার কি অবস্থা গেছে! মন অখণ্ডে লয় হয়ে যেত! এমন কতদিন! সব ভক্তি-ভক্ত ত্যাগ করলুম! জড় হলুম! দেখলুম, মাথাটা নিরাকার, প্রাণ যায় যায়! রামলালের খুড়ীকে ডাকব মনে করলুম!
“ঘরে ছবি-টবি যা ছিল, সব সরিয়ে ফেলতে বললুম। আবার হুঁশ যখন আসে, তখন মন নেমে আসবার সময় প্রাণ আটুপাটু করতে থাকে! শেষে ভাবতে লাগলুম, তবে কি নিয়ে থাকব! তখন ভক্তি-ভক্তের উপর মন এল।
“তখন লোকদের জিজ্ঞাসা করে বেড়াতে লাগলুম যে, এ আমার কি হল! ভোলানাথ[1] বললে, ভারতে[2] আছে’। সমাধিস্থ লোক যখন সমাধি থেকে ফিরবে, তখন কি নিয়ে থাকবে? কাজেই ভক্তি-ভক্ত চাই। তা না হলে মন দাঁড়ায় কোথা?
———————–
১ ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় তখন রাসমণির ঠাকুর বাড়ির মুহুরী ছিলেন, পরে খাজাঞ্চি হইয়াছিলেন।
২ মহাভারত।