তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অবতার ও সিদ্ধ-পুরুষের প্রভেদ — মহিমা ও গিরিশের বিচার
ভক্তসঙ্গে ঠাকুর গিরিরশের বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিলেন। গিরিশ অনেকগুলি ভক্তকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা অনেকেই সমবেত হইয়াছেন। ঠাকুর আসিয়াছেন শুনিয়া সকলে দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। ঠাকুর সহাস্যবদনে আসন গ্রহণ করিলেন। ভক্তেরাও সকলে বসিলেন। গিরিশ, মহিমাচরণ, রাম, ভবনাথ ইত্যাদি অনেক ভক্ত বসিয়াছিলেন। এ ছাড়া ঠাকুরের সঙ্গে অনেকে আসিলেন, বাবুরাম, যোগীন, দুই নরেন্দ্র, চুনি, বলরাম ইত্যাদি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি) — গিরিশ ঘোষকে বললুম, তোমার নাম করে, ‘একজন লোক আছে — গভীর, তোমার এক হাঁটু জল।’ তা এখন যা বলেছি মিলিয়ে দাও দেখি। তোমরা দুজনে বিচার করো, কিন্তু রফা করো না। (সকলের হাস্য)
মহিমাচরণ ও গিরিশের বিচার হইতে লাগিল। একটু আরম্ভ হইতে না হইতে রাম বলিলেন, “ও-সব থাক — কীর্তন হোক।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি) — না, না; এর অনেক মানে আছে। এরা ইংলিশম্যান, এরা কি বলে দেখি।
মহিমাচরণের মত — সকলেই শ্রীকৃষ্ণ হতে পারে, সাধন করিতে পারিলেই হইল। গিরিশের মত — শ্রীকৃষ্ণ অবতার, মানুষ হাজার সাধন করুক, অবতারের মতো হইতে পারিবে না।
মহিমাচরণ — কিরকম জানেন? যেমন বেলগাছটা আমগাছ হতে পারে প্রতিবন্ধক পথ থেকে গেলেই হল। যোগের প্রক্রিয়া দ্বারা প্রতিবন্ধক চলে যায়।
গিরিশ — তা মশাই যাই বলুন, যোগের প্রক্রিয়াই বলুন আর যাই বলুন, সেটি হতে পারে না। কৃষ্ণই কৃষ্ণ হতে পারেন। যদি সেই সব ভাব, মনে করুন রাধার ভাব কারু ভিতরে থাকে, তবে সে ব্যক্তি সেই-ই; অর্থাৎ সে ব্যক্তি রাধা স্বয়ং। শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত ভাব যদি কারু ভিতর দেখতে পাই, তখন বুঝতে হবে, শ্রীকৃষ্ণকেই দেখছি।
মহিমাচরণ বিচার বেশিদূর লইয়া যাইতে পারিলেন না। অবশেষে এক-রকম গিরিশের কথায় সায় দিলেন।
মহিমাচরণ (গিরিশের প্রতি) — হাঁ মহাশয়, দুই-ই সত্য। জ্ঞানপথ সেও তাঁর ইচ্ছা; আবার প্রেমভক্তি, তাঁর ইচ্ছা। ইনি যেমন বলেন, ভিন্ন পথ দিয়ে এক জায়গাতেই পৌঁছানো যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি একান্তে) — কেমন, ঠিক বলছি না?
মহিমা — আজ্ঞা, যা বলেছেন। দুই-ই সত্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আপনি দেখলে, ওর (গিরিশের) কি বিশ্বাস! জল খেতে ভুলে গেল। আপনি যদি না মানতে, তাহলে টুঁটু ছিঁড়ে খেত, যেমন কুকুরে মাংস খায়। তা বেশ হল। দুজনের পরিচয় হল, আর আমারও অনেকটা জানা হল।