1 of 3

৪৫. হেমাঙ্গর কোনও ওয়ারিশন থাকবে না

৪৫

হেমাঙ্গর কোনও ওয়ারিশন থাকবে না। তার জিনিসপত্র বা টাকাপয়সা দশ ভূতে লুটেপুটে খাবে। তার মুখাগ্নি বা শ্রাদ্ধ হবে কি? ক’জন কাঁদবে তার জন্য? একজন ব্যাচেলর মারা গেলে কান্নাকাটি করার লোক পাওয়া কঠিন। তবে মরার পরের অবস্থাটা নিয়ে হেমাঙ্গ চিন্তিত নয়। বরং মরার আগেই কিছু সমস্যা ও জটিলতা দেখা দেবে। মাঝরাতে স্ট্রোক হলে ডাক্তার ডাকবে কে? বেডপ্যান এগিয়ে দেওয়ার দরকার হলে কি হবে? কিংবা মাথা ঘোয়ানো? কিংবা পাশে বসে একটু আহা-উহু করা? সুতরাং বুড়ো বয়সটাকে হেমাঙ্গ খুব ভয় পায়। ব্যাচেলরদের খুব বেশিদিন বেঁচে না থাকাই ভাল।

কিন্তু আজকাল বেঁচে থাকাটাকেই সে নানা প্রশ্নে কণ্টকিত করে তুলছে! এই বেঁচে থাকাটার মানেই বা কী? অধীত বিদ্যা ভাঙিয়ে উপার্জন। খাওয়া, ঘুম, কাজ। ব্যাঙ্কে টাকা জমছে নিয়মিত, প্রত্যেকটা দিনই যেন এক ছাঁচে ঢালা। ওঠা নেই, পড়া নেই, কিছু নেই। কপাল তার এমনই যে, জীবন-সংগ্রামটা অবধি করতে হয়নি। পয়সাওলা পরিবারে জন্ম হয়েছিল, নিজেও দিব্যি পাস-টাস করে গেল, পয়সা উপার্জন করতে লাগল। যারা বেঁচে থাকার লড়াই করে, প্রত্যেকটা পয়সার জন্য যাদের ঘাম ঝরাতে হয়, যারা ছপ্পড় খুঁড়ে পায় না তাদের কাছে বোধ হয় জীবন এমন আলুনি নয়। হেমাঙ্গর অনেকদিন ইচ্ছে হয়েছে একদিন সকালে ঠেলাওলা সেজে বেরিয়ে পড়ে, বা এক সপ্তাহের জন্য ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে দেখে। ছেড়া জামাকাপড় পরে মাঝে মাঝে ভিক্ষে করতেও ইচ্ছে হয় তার।

আজ সকালে উঠে তার মনে হল, বার্ধক্যের একা এবং অসহায় দিনগুলির জন্য তার কিছু আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। তার বয়স যদিও ত্রিশের এদিক ওদিক, তবু প্রস্তুত হয়ে থাকা ভাল। অন্তত ভাবনাচিন্তা এখনই শুরু করা দরকার। জন্মাবধি এ পর্যন্ত তার জীবন অতীব মসৃণ এবং তৈল নিষিক্ত মেশিনের মতো ত্রুটিহীন। কিন্তু কিছু পরে সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকবে।

পরমানন্দকে সে মাঝে মাঝে টাকা দেয়। পরমানন্দ চায় না, সে নিজে থেকেই দেয়। পরমানন্দ আসলে তথাগত। ইস্কুলে তার গলাগলি বন্ধু ছিল। তথাগত ছিল ফার্স্ট বয়। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছিল ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে। চাকরি করেছিল কিছুদিন। তারপর রামকৃষ্ণ মিশনে ব্রহ্মচারী হল, কিছু পরে সন্ন্যাসী। মিশন ছেড়ে সে এখন আলাদা আশ্রম করেছে কয়েকজন অনুগামী নিয়ে। আগাগোড়া তথাগতকে লক্ষ করে এসেছে হেমাঙ্গ। তথাগত ঈশ্বরের সমীপবর্তী হতে পারল কিনা, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে ফেলল কিনা এসব জানার কৌতূহল ছিল প্রবল। সেসব না হলেও পরমানন্দ একটা সন্তোষের ভাব নিয়ে থাকে। সোনারপুরের কাছেই সে একটা অনাথ আশ্রম, একটা আশ্রমিক বিদ্যালয়, তাঁত সেন্টার আর মন্দির নিয়ে আছে। তাতে দেশের কতটা উপকার হচ্ছে তা জানে না হেমাঙ্গ। তবে জীবনের একটা অর্থ হয়তো পরমানন্দ পেয়েছে।

একদিন সে পরমানন্দকে জিজ্ঞেস করেছিল, যদি সন্ন্যাসীই হবি তা হলে এত লেখাপড়া শিখতে গেলি কেন? সময়টা নষ্ট হল।

পরমানন্দ স্মিত মুখে বলল, নষ্ট হয় না। কাজে লাগে। ঠাকুরেরই কাজে লাগে।

হেমাঙ্গর ঠাকুর নেই বলে কথাটা খুব গভীরে ঢোকে না তার।

আর একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আগে তুই ক্রিকেটের খুব ভক্ত ছিলি। এখনও আছিস? ইন্ডিয়া-পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ হলে টিভিতে দেখিস?

পরমানন্দ অবাক হয়ে এবং পরে হেসে বলে, কেন দেখব না? খুব দেখি।

এর পরের প্রশ্নটা হঠাৎ মাথায় কি করে যে এল হেমাঙ্গর কে বলবে! সে জিজ্ঞেস করল, তুই তো সন্ন্যাসী, যখন খেলা দেখিস তখন সম্পূর্ণ পক্ষপাতশূন্য হয়ে দেখিস?

এ কথায় পরমানন্দ খুব হতবাক্ হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে ছিল হেমাঙ্গর দিকে। তারপর বলল, হেমাঙ্গ, তুই কিন্তু খুব অদ্ভুত!

কেন?

তুই আমাকে চমকে দিয়েছিস। বড় মারাত্মক প্রশ্ন। পক্ষপাতশূন্যতা।

ওটা তো জবাব হল না।

ওটাই জবাব। বোধ হয় ঈশ্বর স্বয়ং ছাড়া আর কেউ পক্ষপাতশূন্য হতে পারে না।

তা হলে সন্ন্যাসী হয়ে তোর কী লাভ হল?

লাভ হয়েছে কে বলল? লাভ লোকসান নয়। এটা একটা মোড অফ লাইফ। সন্ন্যাসও একটা রিসার্চ, এক ধরনের গবেষণা।

সেই সঙ্গে কি একটা স্যাটিসফ্যাকশনও? একটু ইগো? একটু সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সও?

পরমানন্দ খুব হাসল। বলল, তোকে নিয়ে পারা যায় না।

হেমাঙ্গ সামান্য উত্তেজিত হয়ে বলে, দেখ, সন্ন্যাসীদের বাইরে যতই বৈরাগ্য মাখা থাক, ভিতরে ভিতরে সে কিন্তু সংসারী মানুষদের চেয়ে নিজেকে উন্নত স্তরের মানুষ ভাবে। তুইও কি ভাবিস না? সত্যি করে বল তো, এই আমাকে দেখেই কি তোর মনে হয় না যে, ইস, হেমাঙ্গটা কোন অন্ধকারে লোভলালসার মধ্যে পড়ে আছে!

পরমানন্দ স্মিত মুখে বলে, অতটা হয় না। তবে ইগো একটা পাজি জিনিস। মৃতদেহের দাহ শেষ হওয়ার পরও একটা পিণ্ডাকার জিনিস থাকে। সেটা পুড়ে পুড়ে শেষ হতে চায় না। লোকে ওটাকে বলে অস্তি। অর্থাৎ যার লয়ক্ষয় নেই। ইগো ঠিক ওরকম। তবে সংসারী তার ইগোকে পুষে রাখে, তাকে যত্নআত্তি করে। যেন পোষা পাখি। আর সন্ন্যাসী তার ইগোকে তাড়ানোর একটা চেষ্টা অন্তত করে। সেটাই তার তপস্যা।

নইলে সংসারী আর সন্ন্যাসীতে তফাত নেই বলছিস?

তফাত সামান্যই। শুধু অ্যাটিচুড়ের তফাত। পারপাসের তফাত।

আমি পারপাসের তফাতটাই জানতে চাই। তুই কেন বেঁচে আছিস তা বুঝিস? বেঁচে থাকাটার পারপাস কী?

সেটাই তো বুঝবার চেষ্টা করছি। কেন জন্ম, কেন এই বেঁচে থাকা, কেন চৈতন্য, কেন অনুভূতি। শুধু পান, ভোজন, রমণ, অস্মিতা এর তো কোনও উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নেই।

আমাকে বুঝিয়ে দে। বুঝতে পারলে আমিও সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসী হব।

সন্ন্যাসী হবি! কোন্ দুঃখে। দুনিয়ায় সবাই সন্ন্যাসী হলে যে সৃষ্টি রসাতলে যাবে। চাষবাস, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রোডাকশন সব লাটে উঠবে। সন্ন্যাসীরও তখন ট্যানা কমণ্ডলু বা ভিক্ষে জুটবে না।

তোর আশ্চর্য পাটোয়ারি বুদ্ধি। সংসারীরা কাজকর্ম করে দুনিয়ার ইকনমি আর প্রোডাকশন বহাল রাখুক, আর তোর মতো সন্ন্যাসীরা তাদের ঘাড় ভেঙে খেয়ে দিব্যি ঈশ্বর-সাধনা করে পরব্রহ্মে লীন হয়ে যাক। ভগবান যদি এতই বোকা লোক হয়ে থাকে তবে তার জন্য তপস্যা করার মানেই হয়। না।

সন্ন্যাসীরা কাজ করে না, কে বলল? ঠাকুর নিজেই তো সংসারী ছিলেন। সন্ন্যাসীরাও সংসারেরই কাজ করে, তবে বৃহৎ সংসার।

ওটা তত্ত্বকথা নয় তো রে?

পরমানন্দ মৃদু মৃদু হাসছিল। বলল, তত্ত্বকথা যখন ফলিত হয় তখনই ধর্ম। কিন্তু মুশকিল হল সব তত্ত্বকে ফলিয়ে তোলা কঠিন কাজ।

হেমাঙ্গ হতাশ হয়ে বলে, তোর ইস্কুল, অনাথ আশ্রম, তাঁত এসবও আমার কাছে ছেলেখেলা বলে মনে হয়। তুই তো রোজগার করে এর চেয়ে অনেক বেশি করতে পারতিস বৃহৎ সংসারের জন্য। তাই না? তুই কি এসকেপিস্ট?

তুই আজ আমার স্বরূপ না বের করে ক্ষান্ত হবি না নাকি?

স্বরূপ আবার কিছু আছে নাকি?

আছে বৈকি। ভণ্ড সন্ন্যাসীর স্বরূপ তো তার করুণ দুর্বল চেহারাটা।

তুই ভণ্ড বলে নিজেকে জানিস?

ভণ্ড ছাড়া আর কি? তবে অ্যাটিচুডটা মিথ্যে নয়। জীবনকে বুঝবার এটাও হয়তো একটা রাস্তা।

আমার পক্ষে সন্ন্যাসী হওয়ায় কোনও বাধা নেই। বিয়ে করব না, কোনও বাইন্ডিং নেই, বেঁচে থাকার অর্থও কিছু পাচ্ছি না। তোর আখড়ায় আমাকে থাকতে দিবি?

থাকবি? এ আর বেশি কথা কি? চলে আয়।

আমি ঝঁটপাট দিতে পারব না, কষ্ট করতে পারব না, খারাপ রান্না খেতে পারব না আগেই বলে দিচ্ছি।

দুর পাগল! তোকে কি আমি চিনি না? আমরা কি খারাপ খাই?

আরও একটা শর্ত আছে। মোটা মোটা ধর্মের বইগুলো পড়তে ভীষণ খটোমটো। আমি ওবও পড়ব না।

তোকে কিছু করতে হবে না। চলে আয় তো! এ সপ্তাহেই আয়।

দুর বোকা! এত তাড়াতাড়ির কথা বলছি নাকি? আমি আসব বুড়ো বয়সে, যখন দেখাশোনার কেউ থাকবে না, কথা বলার কেউ থাকবে না, তখন আসব।

পরমানন্দ খুব হাসল, তাই বল। ওন্ড এজ হোম হিসেবে এসে থাকবি তো! কিন্তু বুড়ো বয়স অবধি ইচ্ছেটা থাকবে না হয়তো।

না থাকলে আসব না। তবু একটা ঠেক তো রইল। দায়ে দফায় আসা যাবে।

বাস্তবিকই তথাগত তথা পরমানন্দের আশ্রমের জন্য বেশ কিছু টাকা অযাচিতভাবেই দিয়ে রেখেছে হেমাঙ্গ। এমনকি একটা অ্যাটাচড্‌ বাথওলা পাকা ঘর তার টাকাতেই করা হয়েছে দোতলায়। হেমাঙ্গ বলে রেখেছে, ওই ঘরটাই আমাকে দিবি।

পরমানন্দ হেসে কুটিপাটি হয়ে বলেছে, এরকম শর্তাধীন দান কি আসলে দান? তুই টাকাই বা দিচ্ছিস কেন? এমনি আয়, তোর জন্য জায়গা থাকবে।

এটা প্রায় এক বছর আগেকার কথা। তখন কিছুদিন হেমাঙ্গর খুব মানসিক নিঃসঙ্গতা চলছিল। তারপর আবার কাজকর্ম ইত্যাদি নিয়ে জড়িয়ে পড়ায় পরমানন্দর কাছে যাওয়া হয়নি। পরমানন্দকে তার কোনওদিনই পুরোপুরি সন্ন্যাসী বৈরাগী বলে মনে হয় না। হতে পারে, সেও এক বিবাহভীত, সংসারভীত, ঝামেলাভীত, কম্পিটিশনভীত, পলায়নকামী মানুষ। সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশের ভিতরে, পরমানন্দের ভিতরে পালিয়ে আত্মগোপন করে আছে ভীরু তথাগত। রামকৃষ্ণ মিশন ছেড়ে কেন যে আলাদা আশ্রম খুলল তারও কোনও সদুত্তর কখনও দেয়নি পরমানন্দ। হতে পারে, মিশনকে নয়, সন্ন্যাসের ভাবটুকুই তার প্রয়োজন ছিল।

আজ সকালে আবার ডিপ্রেশনটা টের পাচ্ছে হেমাঙ্গ। ছুটির দিন। শরতের এক চমৎকার সকাল। অথচ এক বুক অন্ধকার নিয়ে সে বসে আছে ডিনার টেবিলে। সামনে ইলেকট্রিক কেটলিতে তৈরি করা পাইপিং হট চা।

আজ কোথাও নেমন্তন্ন নেই। আজ বাড়িতেই খাবে বলে ফটিককে বাজারে পাঠিয়েছিল। ফটিক বাজার করে ফিরে এল একটু আগে। আস্ত মুর্গি এনেছে। যেদিন হেমাঙ্গ বাড়িতে খায় সেদিন ফটিকের একটু আহ্লাদ হয়। কারণ সেও একটু ভালমন্দ খেতে পায় সেদিনটা। আজ ফটিকের আনন্দের দিন। কিন্তু হেমাঙ্গর নয়। এত অর্থহীন বেঁচে থাকার কোনও মানেই সে খুঁজে পাচ্ছে না।

আজ একবার পরমানন্দের কাছে গেলে কেমন হয়? তার সন্ন্যাসে ফাঁক থাকতে পারে, কিন্তু পরমানন্দ সব সময়ে একটা খুশির আবহাওয়ার মধ্যে থাকে। তাকে ঘিরে সব সময়েই কিছু লোক। বাচ্চা সন্ন্যাসী, অর্থ, প্রার্থী, নানা ধরনের মানুষ। সব সময়ে জীবনের একটা ধারার মধ্যে, নানা কাজের মধ্যে ডুবে থাকে পরমানন্দ। ব্যক্তিগত উন্নতি, সঞ্চয়, সম্মান নিয়ে কোনও বালাই নেই। টেনশন নেই। পরমানন্দের কাছে বসে থাকতেও ভাল লাগে হেমাঙ্গর।

ফটিক মুর্গি কাটতে নিচে গেছে। নিঃশব্দে পোশাক পরে নেয় হেমাঙ্গ। দরজায় তালা দিয়ে নিচে নেমে ফটিকের সামনে চাবিটা ফেলে দিয়ে বলে, আমার দেরি দেখলে খেয়ে নিও ফটিকদা, একটু বেরোচ্ছি।

ই বাবা! রাঁধতে বললে যে!

ফ্রিজে রেখে দিও।

এবেলা তবে খাবে না?

ঠিক নেই। একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে গেল।

বেরোবার মুখেই বাধা পেল হেমাঙ্গ। বেশ বড় বাধা। ফটক থেকে সিঁড়ি বেয়ে একতলা বারান্দায় উঠে আসছিল রশ্মি।

বেরোচ্ছিলেন। ইস! আর একটু হলেই আপনাকে মিস করতাম।

হেমাঙ্গ কেন যে থতমত খেয়ে গেল কে জানে! বলল, আসুন! আপনি তো কখনও আসেননি। এ বাড়িতে!

রশ্মি মৃদু হেসে বলে, আসতে বলেছেন কখনও? ব্যাচেলর্স ডেন বলে কথা, তাই না? মেয়েদের বোধ হয় আসতে নেই?

লজ্জা পেয়ে হেমাঙ্গ বলে, না, তা নয়। আসলে আপ্যায়ন করার মতো ব্যবস্থা নেই কিনা। ওপরে আসুন।

ও মা! আসব কি? আপনি যে বেরোচ্ছেন!

তেমন জরুরি কাজ কিছু নয়। এক বন্ধুর কাছে যাচ্ছিলাম।

তা হলে যান না! আমি এমনিই এসেছিলাম। আমার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করার দরকার নেই।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট কিছু নেই। আমার বন্ধুটি এক সন্ন্যাসী। যে কোনও সময়েই তার কাছে যাওয়া যায়।

সন্ন্যাসী! হঠাৎ সাধুসঙ্গ করছেন যে বড়!

সাধু বলে নয়। বাল্যবন্ধু। এক সঙ্গে পড়েছি।

তা হলে তিনিও তো ইয়ং ম্যান। এত অল্প বয়সে সন্ন্যাসী কেন?

তা কে বলবে? আমার তো মনে হয় এসকেপিস্ট।

বেশির ভাগ মানুষই তো তাই। কত দূরে থাকেন তিনি?

বেশি দূর নয়। সোনারপুর। যাবেন?

রশ্মি অবাক হয়ে বলে, আমি! সন্ন্যাসীরা তো নারীমুখ দেখেন না।

আমার বন্ধুর অত শুচিবায়ু নেই। ওর ইস্কুলে, তাঁতকলে কত মেয়ে পড়ে, শেখে।

ঢুকতে দেবেন তো, কিন্তু পাত্তা দেবেন না হয়তো।

চলুন না। আপনাকে পাত্তা না দিলে আমিও বসব না।

রিস্ক কিন্তু আপনার। চলুন। গাড়ি বের করতে হবে না, আমি গাড়ি এনেছি।

অস্টিন অফ ইংল্যান্ড গাড়ি আজকাল কলকাতায় দেখাই যায় না। কলকাতা ভরে আছে একঘেয়ে অ্যাম্বাসাডার, মারুতি আর প্রিমিয়ার গাড়িতে। গাড়ির ভিতরটা কিছু অন্ধকার এবং বিষন্ন। আজকালকার খোলামেলা ঝলমলে গাড়ি নয়। যেন একটা গর্তের মতো অভ্যন্তর। তার ওপর কালো বা কালচে ধরনের চামড়ায় মোড়া সীট।

এ গাড়ি কোথায় পেলেন?

রশ্মি মৃদু হেসে বলে, অনেক পুরনো। বড় একটা বের করা হয় না। বাবা ইংল্যান্ড থেকে এনেছিল। মেইনটেনেলের খরচ অনেক। একজন পুরনো মিস্ত্রি আছে, সে-ই সারিয়ে-টারিয়ে দেয়। তবে না চালালে ব্যাটারি ডাউন হয়ে যায়, যন্ত্রপাতিতে মরচে ধরে। আজ বেরোবার সময় বাবা বলল, গাড়িটা একটু চালিয়ে নিয়ে এসো। তাই আজ এটা বের করেছি। ভয় নেই, মাঝপথে ট্রাবল দেবে না। এটার নাম আমরা রেখেছি ‘দি ওল্ড রিলায়েবল’।

বেশ গাড়ি।

আধুনিক নয়, এই যা। আপনার কি আজ মুড একটু অফ?

কেন বলুন তো!

গম্ভীর মনে হচ্ছে।

মুড অফ বলাটা ঠিক হবে না। আসলে…

আসলে?

আমার মাঝে মাঝে কেমন যেন সব কিছু মিনিংলেস লাগে। ঠিক বোঝাতে পারব না কেমন।

মিনিংলেস না লাগাটাই তো আশ্চর্যের।

তার মানে?

মিনিংলেসের কি মানে থাকে?

বলে রশ্মি একটু হাসল। মেয়েটা হাসলে রূপ যেন ফুলঝুরির মতো উপচে পড়ে। মাথার ওপর ছোট কনভেক্স আয়নায় মুখখানা দেখছিল হেমাঙ্গ। চারুদি খবর নিয়েছে। এর সঙ্গে তার বর্ণে মিল, বয়সে মিল। যোটক বিচারটা এখনও হয়ে ওঠেনি। হাওয়া বুঝে ওটাও করা হবে। সম্ভবত মিলেও যাবে। কথাটা হেমাঙ্গর মা ও বাবার কাছে পৌঁছে দিয়েছে চারুদি। বাড়ি থেকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, রশ্মির বাড়ি থেকেও আগ্রহ দেখা গেছে। আর রশ্মি? হেমাঙ্গ বুঝতে পারছে না বটে, কিন্তু অন্যেরা বলছে, রশ্মিও নাকি রাজি। খুব রাজি। কিন্তু ওর কোনও ব্রীড়া নেই কেন? ভাবী বর বলে যদি ধরে নিয়েও থাকে, তবে দেখা হলে কই লজ্জায় রাঙা হয় না তোর কিংবা চোখে একটা ঝলমলে ভাব ফুটে ওঠে না তো! সে কি বিলেতবাস এবং অনেক পুরুষসঙ্গ করার ফল? হবেও বা!

রশ্মিকে তার কেমন লাগে? অনেক ভেবেছে হেমাঙ্গ। রশ্মি এক অদ্ভুত ভাল মেয়ে। কাছে এলেই তার ভাল লাগে। কিন্তু এই মেয়েটির সঙ্গে তার নিরাবরণ ঘনিষ্ঠতা হবে, এই মেয়েটি তার সঙ্গে দিনরাত বসবাস করবে—ঠিক এরকমটা কেন সে ভাবতে পারে না!

আপনার ডিপ্রেশনের কথাটা এবার একটু বলবেন?

হেমাঙ্গ কুষ্ঠিত হয়ে বলে, বলার মতো কিছু নয়। হয়তো ছেলেমানুষী।

হয়তো তা নয়। কে জানে! বলুন তো একটু শুনি।

আপনি কি সাইকিয়াট্রিস্ট?

নয় কেন? আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনো করেছি। কাজও করেছি। আমার প্রিয় সাবজেক্ট।

ও বাবা, তা হলে তো আপনাকে বলা ঠিক হবে না। হয়তো আমার ভিতর সূক্ষ্ম পাগলামি ধরে ফেলবেন।

সূক্ষ্ম কেন, আপনার চারুদিদি তো বলে, আপনি খুব পাগল।

হয়তো তাই। বলে স্নান মুখে বসে থাকে হেমাঙ্গ।

মুখে একটু চুক চুক করে আফসোসের শব্দ করে রশ্মি। তারপর বলে, আহা রে, কেমন দুঃখী মুখ করে বসে আছে দেখ! পাগল তো আমরা সবাই। কিছু কম, কিছু বেশি। আমি ডিপ্রেশনের কথাটা জানতে চাইছি। ওটা পাগলামি নয়।

বললাম তো, একটা অর্থহীনতা। মনে হয়, জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল। সেটা জানাই। হল না, কি ছাই শরীরসর্বস্ব হয়ে বেঁচে থাকা।

রশ্মি একটু চুপ করে থেকে বলল, শরীর ছাড়া তো বাঁচাও যায় না। শরীর কি উপেক্ষার বস্তু?

তা নয়। কিন্তু শরীর ছাড়াও, এই অস্তিত্ব ছাড়াও যেন আরও কিছু ছিল। জানা হল না।

ঈশ্বর কি?

হতে পারে। আমার ঠাকুর-দেবতার বায়ু কিন্তু নেই।

আমার আবার একটু আছে। সে যাক গে। আপনার যখন মন খারাপ হয় তখন কী করেন?

কিছু না। চুপচাপ একা বসে থাকি।

শুনেছি, মন খারাপ হলেই আপনি অকাজের জিনিস কেনেন!

কে বলল?

যেই বলুক, কথাটা কি মিথ্যে?

লজ্জিত হেমাঙ্গ বলে, আমার একটা বদ-অভ্যাস।

চারুদি আপনাকে খুব ভালবাসেন। আপনার সব কিছু ওঁর নখদর্পণে।

ও একটা স্পাই।

ভালবাসার জনের ওপর একটু গোয়েন্দাগিরি করতে হয় মাঝে মাঝে।

কেনাকাটা করা ছাড়া আর আমার কোনও বদ-অভ্যাস নেই। চারুদির অবশ্য নানা সন্দেহ। আছে।

ব্যাচেলরদের সকলেই একটু সন্দেহ করে। ওটাকে গুরুত্ব না দিলেই হয়। কিন্তু আপনি এত জিনিসপত্র কেনেন কেন? শুনেছি সেসব জিনিস আপনার কোনও কাজে লাগে না!

জিনিসপত্র কিনি সে কথা ঠিক। কিন্তু আমি খুব মেটেরিয়ালিস্ট নই।

সেটাও মনে হয়। ডিপ্রেশনটা আপনার কখন হয়?

তার কোনও ঠিক নেই। আজ ভোরবেলা হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে মনে হল, সব যেন শূন্যতায়। ভরা।

আপনি নাকি কনফার্মড ব্যাচেলর?

হ্যাঁ। বিয়ে করাটাও এক অর্থহীন রিচুয়াল।

মেয়েদের ভয় পান?

বোধ হয় আমিও এসকেপিস্ট।

আপনি আমাকেও ভয় পান না তো!

আপনাকে? না, আপনাকে নয়।

ঠিক বলছেন? প্রথম দিন কিন্তু খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন আমার সামনে। খেতে অবধি পারেননি। লজ্জা আর ভয় কি একই জিনিস?

ঠিক এক নয়। তবে লজ্জা আর ভয়ের মধ্যে একটা মিলও আছে।

কি রকম?

লজ্জাও এক রকমের ভয়। লজ্জার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, ইনফিরিয়রিটি থাকে।

আর কিছু নয়?

থাকতে পারে। লজ্জা জিনিসটা ইউনিভার্সাল নয়। যেমন নয় অভিমান।

হেমাঙ্গ খানিকটা ভাবল। তারপর বলল, বোধ হয় ঠিকই বলেছেন। পশ্চিম দেশে ও দুটি অনুভূতির খুব অভাব। কিন্তু আজ আপনি বড্ড মাস্টারি করছেন। আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমার ডিপ্রেশন কয়েক দিনেই কেটে যায়।

কিন্তু আসে কেন? হাজার মানুষের হাজারো ডিপ্রেশন, তার আবার হাজার কারণ। আপনারটা কেন আসে? আপনার তো মানিটারি প্রবলেম নেই, ফ্যামিলি প্রবলেম নেই, জব স্ট্রেস নেই। তা হলে?

ওসব থাকলে বোধ হয় ডিপ্রেশনটা হত না। আমার মনে হয় জীবনে বাঁচার লড়াই করাটাও দরকার। তা হলে এইসব ফ্যান্সি জিনিসগুলো কেটে যায়।

তার কোনও মানে নেই। তবে আপনি সাইকোলজিক্যাল কেস নন।

তা হলে মনোরুগী নই?

রশ্মি হাসল। যাদবপুরের সরু রাস্তায় ঢুকে সে গাড়ির স্পীড কমিয়ে সাবধানে চালাতে চালাতে বলল, আর বেশি কথা বলবেন না কিন্তু। আমি খুব নার্ভস ড্রাইভার। কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চালানো এক নাইটমেয়ার।

কষ্ট করে চালাচ্ছেন কেন? স্টিয়ারিং আমাকে দিন।

আপনার যে ডিপ্রেশন! বলে হাসে রশ্মি।

গাড়ি চালাতে ওটা বাধা নয়। গাড়ি চালিয়ে নেয় গাড়ি চালানোর অভ্যাস।

বেঁচে থাকাটাও কি ওরকমই এক অভ্যাস নয়?

রশ্মি গাড়ি দাঁড় করাল। সীট বদল করল। হেমাঙ্গ নিপুণ হাতে গাড়িটা চালু করে বলল, বেশ গাড়ি। চালিয়ে আরাম।

রশ্মি তার উড়োখুড়ো চুল দু’হাতে পাট করতে করতে বলল, জীবনটাও ঠিক ওরকম। চালাতে পারলে আরাম। শুধু স্টিয়ারিংটা আর কারও হাতে দিতে হয়।

রশ্মি খুব হাসছে। হেমাঙ্গ ততটা হাসতে পারছে না। সে হাসছে কৃত্রিম হাসি, সঙ্গ দিতে।

পরমানন্দের ঠেক-এ পৌঁছানোর পর সে হাঁফ ছাড়ল।

প্রায় বিঘা চারেক জমি আর একটা ছোটো পুকুর নিয়ে পরমানন্দ তার শ্রীরামকৃষ্ণ সেবা সঙ্ঘ গড়ে তুলেছে। একা হাতে। বিস্তর গাছপালা, ফুল আর সবুজ ঘাসে তৈরি করেছে এক মায়ার রাজ্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা কুটির, একটা দোতলা বাড়ি আর একটা টিনের শেড-এ ল্যাবরেটরি।

পরমানন্দ রবিবার মঠে যায়। বেলুড়ে। সেটা খেয়াল রাখেনি হেমাঙ্গ। তবে পরমানন্দের অনুগত তরুণ আর এক সন্ন্যাসী প্রেমানন্দ এসে আদর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। পাখা খুলে দিল। বলল, চা না কফি?

আশ্রমে চা কফি অফার করা হয় বুঝি? ঠাকুরকেও চা বা কফি ভোগ দেন তো?

রশ্মির এই প্রশ্নে প্রেমানন্দ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, না, তা দিই না। তবে খাওয়ার আগে নিবেদন করে নিই।

রশ্মি খুব হাসি-মুখে বলে, তবু ভাল যে চা কফির চেয়ে কড়া নেশা নেই। থাকলে ঠাকুরের বিপদ ছিল, তাই না?

প্রেমানন্দ একটু লজ্জা পেল। বলল, তা হলে খাবেন না?

খাবো না কেন?

প্রেমানন্দ তড়িঘড়ি চলে গেল সামনে থেকে। পালাতে পারলে বাঁচে।

হেমাঙ্গ রশ্মির দিকে চেয়ে বলল, পারেনও বটে আপনি। এসব ধর্মকর্ম বোধ হয় আপনার ভাল লাগে না?

লাগবে না কেন? আমি একটু ধর্মও করি। আমার খারাপ লাগছে না তো!

তা হলে ওভাবে বললেন যে!

একটু মজা করলাম। কিন্তু আপনি এখানে কেন আসেন বলুন তো! ধর্ম করতে?

না। তবে হয়তো একদিন এখানেই এসে পার্মানেন্টলি থাকব।

ওমা! কেন?

কোথায় আর যাবো?

এ জায়গাটা কি খুব ভাল?

খারাপ তো নয়!

রশ্মি খুব হাসতে লাগল। হাসলে মেয়েটাকে এত ভাল দেখায়। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে হেমাঙ্গর দিকে চেয়ে বলল, আপনার খুব মৃত্যুভয়? না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *