৪৫. সোনালি ডানার চিল চক্রাকারে ওড়ে

মুনা লক্ষ্য করল আজ সারাদিন বকুল মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুপুরে ভালমত খেল না। খানিকটা মুখে দিয়েই উঠে পড়ল। মুনা বলল, কি হয়েছে রে?

বকুল হাসিমুখে বলল, ক্ষিধে নেই। ক্ষিধে হলেই আবার খাব। তুমি আজ অফিসে গেলে না। কেন আপা?

আজ শুক্রবার। অফিস বন্ধ।

ও আচ্ছা। আমার কিছু মনে থাকে না।

বকুল উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাতে গল্পে বই। পাড়ায় পারলিক লাইব্রেরি হয়েছে। বাবু তার মেম্বার। রোজ বই নিয়ে আসছে। সাত আট পাতা পড়ে বকুল সে সব বই ফেরত পাঠাচ্ছে। পড়তে ভাল লাগে না। অথচ আগে কোনো একটা বই হাতে পেলে শেষ না কর উঠতে পারত না।

আজও পড়তে ভাল লাগছে না। হাই উঠছে। বকুল বই নামিয়ে রাখল। ঘুম ঘুম আসছে। অথচ ঘুমুতে ইচ্ছা করে না। কারো সঙ্গে গল্প করতে পারলে ভাল লাগতে গল্প করার মানুষ নেই।

ঘুমুচ্ছিস নাকি বকুল?

বকুল বিছানায় উঠে বসল। মুনা আপা গম্ভীর মুখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে।

কিছু বলবে আপা?

তোর কি হয়েছে বল তো?

কী আর হবে কিছু হয়নি।

জহির কী রাগ করে চিঠিতে কিছু লিখেছে?

না তো। বিশ্বাস না হলে তুমি চিঠি পড়ে দেখ আপা। এনে দেই? ড্রয়ারে আছে।

না। এনে দিতে হবে না। তোর কি বাচ্চ-কাঁচা হবে? বল তো ঠিক করে।

বকুল অবাক হয়ে বলল, বাচ্চ-কাচ্চা হবে কী জন্যে?

মুনা বিরক্ত গলায় বলল, যা জিজ্ঞেস করেছি। তার জবাব দে। হ্যাঁ বা না বল।

না।

নেত্রকোনা যেতে ইচ্ছে করছে? জহিরের কাছে?

না।

ইচ্ছা না করলেও যেতে তো হবে। সারা জীবন এখানে পড়ে থাকবে? তোর নিজের ঘর-সংসার আছে না?

কী করে যাই আপা। আমার তো শরীর খারাপ। মাথার ঠিক নেই।

মাথা খুব ঠিক আছে।

আজেবাজে। জিনিস যে দেখি।

এখন তো আর দেখছিস না।

ঐখানে গেলেই দেখব।

তাহলে আবার চলে আসবি।

আচ্ছা। তুমি যা বল তাই

বকুল একটু আগে বন্ধ করা বই আবার মেলে ধরল। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। আপা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে যে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

মুনা বলল, একটা দিন ঠিক করে বাবুকে নিয়ে চলে যা। বাকের ভাইও সঙ্গে যাবে। নয়ত জহির রাগ করবে। কে জানে হয়ত করেও বসেছে। রাগ না করলে এর মধ্যে এখানে একবার আসত।

রাগ করেনি।

রাগ না করলেই তো ভালই।

মামলায় হার হয়েছে এই জন্যে মনটন খারাপ। আরেকটা কী মামলা দিয়েছে। ঐটাতোও হারবে।

কে বলল হারবে?

আমার মনে হচ্ছে। একবার হারাতে শুরু করলে হারিতেই হয়।

তোকে বলল কে?

কেউ বলেনি। আমি জানি আপা। পান খেতে ইছে হচ্ছে। বাবুকে পাঠিয়ে একটা পান আনাও তো। ঐ বাড়িতে থেকে থেকে আমার পান খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমিও একটা খাও আপা। ঠোট লাল হবে। দেখতে সুন্দর লাগবে।

মুনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরুল। যতই দিন যাচ্ছে বকুলের ছেলেমানুষি ততই বাড়ছে। মানুষের বয়স বাড়ে বকুলের বয়স কমছে। শরীরও খারাপ হচ্ছে। এই বয়েসী মেয়েদের চোখে-মুখে যে উজ্জ্বল আভা থাকে বকুলের তা নেই।

রাতে খেতে বসেও খানিকক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে বকুল উঠে পড়ল। মুনা বলল, কী হয়েছে রে?

পেট ব্যথা করছে আপা?

পেট ব্যথা করছে?

হুঁ।

বেশি?

না বেশি না।

দুপুরেও তো খাসনি।

শোবার আগে এক গ্লাস দুধ খাব। আপা ওতেই হবে।

মুনা দুধ নিয়ে নিজেই গেল। বকুল বিনা বাক্যে ব্যয়ে দুধ শেষ করে হঠাৎ নিচু গলায় বলল, তুমি যা বলছিলে তাই সত্যি আপা।

আমি কি বলছিলাম।

ঐ যে দুপুরে বললে। বাচ্চা হবার কথা।

সে কি?

এখন কি করব। আপা?

কি করাবি মানে? করাকরির কি আছে?

বাবুকে মিষ্টি দিয়ে একটা পান আনতে বল তো আপা। খেতে ইচ্ছে করছে। আলাদা করে যেন জর্দা আনে। আমি নিজেই বাবুকে বলতাম। কিন্তু এখন ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে হয়েছে সমস্যা।

বকুল হাসছে। কেমন অদ্ভুত ভয় এবং সংকোচ মেশানো হাসি। মুনা এসে বলল বকুলের পাশে। বকুল প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, রাগ করনি তো আপা?

রাগ করব কেন?

বাচা হচ্ছে যে এই জন্যে।

পাগলের মতো কথা বলছিস কেন রে বকুল? তুই কী পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি?

হ্যাঁ আপা পাগল হয়ে যাচ্ছি। পুরোপুরি যেদিন হব সেদিন বুঝবে। আমাকে একটা পাগলাগারদে রেখে আসতে হবে।

বকুল এবার কাঁদতে শুরু করল। শিশুদের কান্না। সবাইকে জানাতে হবে যে কান্না শুরু হয়েছে। চোখে পানি তেমন থাকবে না। ফুপানোর শব্দ থাকবে, না ফুপানোর শব্দ থাকবে, শরীর বারবার দুলে উঠবে। আশপাশের সবাই বুঝবে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে।

কাঁদছিস কেন রে বকুল?

মনের দুঃখে কাঁদছি।

এত কি তোর মনে দুঃখ যে কাঁদতে হবে?

তাহলে যাও মনের আনন্দে কাঁদছি।

মুনা হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে বকুলেরও হাসি পেলে গেল। অনেক কষ্টে সে হাসি৷ থামিয়ে রাখল। মুনা বলল, কাল ভোরে তোকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তারপর জহিরুকে টেলিগ্ৰাম করব চলে আসতে। বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত তুই থাকবি আমার কাছে।

আমার বুঝি ঘর-সংসার নেই আপা?

একটু আগেই না থাকতে চাচ্ছিলি।

একন চাচিছে না।

বেশ তো জহির এসে নিয়ে যাবে। য

মুনা, বকুলের হাত ধরে খানিকক্ষণ বসে রইল। মুনার মুখ এখানো হাসি হাসি। বকুল খাকিনকটা গম্ভীর হয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না।

কিছু বলবি বকুল।

হুঁ।

কী বলবি বলে ফেল।

বাবু যেন কিছু জানতে না পরে আপা।

বাবু জানলে কী?

লজ্জা লাগে আপা।

বকুল, মুনাকে জড়িয়ে ধরল। তার গা কাঁপছে। হয়ত আবার কাঁদবে। কিংবা কে জানে হয়ত আনন্দে হাসছে। বকুলের হাসি কান্নার কোন ঠিকঠিকানা নেই।

 

বুড়ো ডাক্তার সাহেব খুব আগ্রহ করে বকুলকে অনেক কিছু বললেন, সকাল-বিকাল হাঁটতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম খুব প্রয়োজন এতে রক্তের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা বাড়ে। শরীর সুস্থ থাকে। সুষম খাদ্যও খুব ইম্পর্টেন্ট। সেই সঙ্গে দরকার মানসিক প্রশান্তি।

তিনি বকুলকে একটা চটি বই দিলেন মা ও শিশু। বইটির মলাটে একটি শিশুর ছবি যে মার দুধ খাচ্ছে। লজ্জায় লাল হয়ে বকুল বই হাতে নিল। ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বয়স কত?

ষোল।

এত অল্প! আজিকাল তো এ বয়সে মেয়েরা মা হচ্ছে না। তবে মা হবার জন্যে বয়সটা খারাপ ও না। তুমি কিন্তু খুকি প্রথম বাচ্চার পর খুব সাবধান হবে। শিশু দিয়ে দেশ ভর্তি করে ফেলার কোন মানে হয় না। এক মাস পরে আবার আসবে।

বকুল মাথা কাত করল। লজ্জায় তার মুখে কথা ফুটছে না। ডাক্তার সাহেব বললেন, এক মাস পর যখন আসবে তখন বাচার হাট বিট তোমাকে শুনিয়ে দেব। আর এক মাস পর থেকেই হার্টবিট করতে শুরু করবে। নিজের বাচার হার্টবিটি শোনা একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা।

বকুল ফিসফিস করে বলল, কিভাবে শুনব?

খুব সোজা। ঐদিন টের পাবে।

মুনা ডাক্তার সাহেবের কথাবার্তায় বেশ অবাক হচ্ছে। কোন ডাক্তার রুগীর সঙ্গে এত আগ্রহ নিয়ে কথা বলেন না। ইনি বলছেন। এমন না যে এর কাছে রুগী আসে না। অনেক’দিন পর একজন রুগী পাওয়া গেছে। ডাক্তার সাহেবের চেম্বার রুগীতে ভর্তি। নম্বর লেখার স্লিপ হাতে নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে।

বকুলের জন্যে এই ডাক্তার এতটা আগ্রহ কেন দেখালেন?

চলে আসবার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে মৃদু গলায় বললেন, রিকশায় চলাফেরা করলে সাবধানে করবে যেন ঝাকুনি না লাগে। কেমন?

পৃথিবীতে অনেক রহস্য আছে! সেই সব রহস্যের একটা হচ্ছে মানবিক সম্পর্ক। এর কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। হঠাৎ যে কোনো একজন মানুষের জন্যে হৃদয় মমতায় উদ্বেলিত হতে পারে।

মুনা, ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, চল বকুল তোর বাচ্চার জন্যে কিছু একটা কেনা যাক।

বকুল লজ্জিত গলায় বলল, কি কিনবে?

চল নিউ মার্কেটে গিয়ে দেখি কি পাওয়া যায়। আমি তো ছাই জানিও না।

লজা লাগে যে আপা।

লজ্জার কী আছে? তাছাড়া তোরই যে বাচ্চা তাও তো কেউ বুঝবে না।

নিউ মার্কেট থেকে কিনবে না। কিনবে না করেও অনেক কিছু কেনা হয়ে গেল। যাই দেখে তাই বকুলের পছন্দ হয়ে যায়। নিচু গলায় বলল, এটা কিমব আপা, বেবি সোপ। এত দাম গাচ্ছে। থাক লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করলেই হবে। এত বাবুয়ানির দরকার নেই। বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুনাকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়–কিনে নে।

এই টাওয়াল কিনব। আপা? হাত দিয়ে দেখি কত নরম।

পছন্দ হলে নে।

পরে কিনলেও তো হবে। এত আগেভাগে কিনে লাভ কী আপা?

তাহলে পরে কিনব।

কিন্তু পরে যদি না পাওয়া যায়। ভাল জিনিস কিছুই থাকে না।

তাহলে কিনে ফেলাই ভাল।

গভীর সুখ ও গভীর আনন্দে বকুলের চোখ ঝলমল করে। তার দিকে তাকিয়ে মুনার বড় মায়া লাগে। পুঁটলা পুটলি সব বকুলের নিজের হাতে। মুনার কাছে দিতে রাজি না। মুনা বলল, তোর কষ্ট হচ্ছে কিছু আমার কাছে দে।

বকুল হাসিমুখে বলল, কষ্ট হচ্ছে না আপা। তাছাড়া পরিশ্রম করার দরকার। ডাক্তার সাহেব তো। তাই বললেন।

কিছু খাবি ক্ষিধে পেয়েছে?

হুঁ পেয়েছে? ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছ করছে।

চল কিছু খাই।

ঝাল খেলে বাচার আবার ক্ষতি হবে না তো আপা? ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল। বাসায় ফেরার পথে একবার থেমে জিজ্ঞেস করে যাব আপা?

তা করা যেতে পারে।

কাঠের একটা দোলনা বানাতে দিতে হবে। তুমি এ রকম করে হাসছ কেন আপা?

যা আর হাসব না।

তোমার অনেক টাকা খরচ করিয়ে দিলাম।

তা দিলি। কি আর করা।

তুমি আবার মনে মনে আমার ওপর রাগ করছ না তো?

করছি।

বকুল হাসল। চমৎকার হাসি। মুনার মনে হল এত সুন্দর করে বুকল এর আগে কখনো হাসেনি। সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে তার মুখে। গায়ে হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি। সেই নীল রঙের আভা পড়েছে তার মুখে-চমৎকার ছবি।

 

জহির বৃহস্পতিবার ভোরে এসে উপস্থিত। তার দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠতে হয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনেক দিন চুল কাটা হয়নি বলেই মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। এই গরমে গায়ে হলুদ রঙের ময়লা একটা কোট। বাসায় পা দিয়েই প্রথম যে কথাটি বলল তা হচ্ছে–বিরাট ভুল হয়ে গেল। নিতান্ত বেকুবের মতো কাজ করেছি। ছিঃ ছিঃ!

বেকুবের মতো কাজ আর কিছুই না। সঙ্গে সে একটা মাছ নিয়ে এসেছিল। রুই মাছ। ট্রেনে সিটের নিচে রাখা ছিল। নামার সময় মাছ না নিয়েই নেমে এসেছে।

মুনা বলল, এখন আর আফসোস করে কি হবে? মাছ গেছে গেছে। রুই মাছ ঢাকাতেও পাওয়া যায়। তোমার এই অবস্থা কেন? দেবদাসের মতো লাগছে।

গালে অ্যালার্জির মত হয়েছে। আপা–ব্লেড ছুলেই ফুলে ওঠে। এই জন্যে দাড়ি কাটা বন্ধ। মন মেজাজও খারাপ।

কেন?

পর পর দুটো মামলায় হেরেছি। তৃতীয় একটা শুরু হয়েছে। এটাতেও মনে হচ্ছে হারব। ঢাকা আসার মূল কারণ হচ্ছে বড় বড় উকিল ধরব।

টেলিগ্রাম পাওনি?

না তো। কিসের টেলিগ্রাম?

ঠিক আছে, পরে শুনবে। যাও মুখ ধোও। দয়া করে কাপড়গুলিও বদলাও। এত ময়লা কাপড় তোমার আছে জানতাম না।

জহির টেলিগ্রামের বিষয়ে কোন রকম আগ্রহ প্রকাশ করল না। গোসল করে পর পর দুকাপ চা খেয়ে চাদর গায়ে ঘুমিয়ে পড়ল। টানা ঘুম। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন সে আরাম করে ঘুমুতে পারছে না।

মুনা অফিসে যাবার আগে বকুলকে বলে গেল ঘুম ভাঙলেই সব গুছিয়ে বলবি। জহিরের মনটন খুব খারাপ। খরবদার ঝগড়া-টগরা করবি না।

বকুল অবাক হয়ে বলল, শুধু শুধু ঝগড়া করব কেন?

জহির রেগে কিছু বললে ও চুপ করে থাকবি।

ওইবা রেগে রেগে কথা বলবে কেন? রাগ করবার মত আমি কী করলাম?

তুই বড়ই বোকা বকুল। এই রকম বোকা হলে তো মুশকিল।

তোমার মতো চালাক হলে আপা মুশকিল। চালাক মেয়েরা বিয়ে-টিয়ে কিছুই করতে পারে না। একা একা থাকে এবং মনে করে বিরাট একটা কাজ করা হল।

মুনা, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কি অদ্ভুত কথা বকুলের। চোখ-মুখ শক্ত করে কথা বলছে। আগের বকুলকে এখন আর চেনা যাচ্ছে না। মুনা কিছু বলল না। বাবুকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। বাজার করে বাবুকে পাঠাবে। ঘরে প্রায় কিছুই নেই। আজও নিশ্চয়ই অফিসে যেতে দেরি হবে।

দুপুর বেলা জহির ঘুম থেকে উঠল। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল। খেতে খেতেই বকুলের খবর শুনে সহজ গলায় বলল, ভালই তো। আমি অবশ্যি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। ডাক্তারকে দিয়ে কনফার্ম করিয়েছ তো?

হুঁ।

এখন খাওয়া-দাওয়া ঠিক করবে। তোমার এনিমিয়ার ভাব আছে।

নতুন শিশু প্রসঙ্গে এখানেই তার আগ্রহের সমাপ্তি। যেন যা বলার বলা হয় গেছে। আর কিছু বলার নেই। নতুন একটি শিশু আসার ঘটনাটা যেন কোনো ঘটনাই না। জ্বর বা সর্দি হবার মতো একটা ব্যাপার।

বকুল।

বল।

তোমার ঐ অসুখটা সেরেছে। স্বপ্লটপ্ল কী যেন দেখতে।

সেরেছে।

গুড। আমি ভেবেছিলাম এসে দেখব তোমাকে পাগলাগারদে ট্রান্সফার করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর হা হা হি হি করছে।

বকুল কিছু বলল না। ডালের বাটি এগিয়ে দিল। জহির বলল, যন্ত্রণা যখন শুরু হয় চারদিক থেকে এক সঙ্গে শুরু হয়। আটপাড়ার জল মহাল হাতছাড়া হবার উপক্রম হয়েছে।

কেন?

আরে কাজগপত্র কিছু নেই। সরকারি রেকর্ডে গণ্ডগোল। আমি তো এইসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। মা দেখত। কি করে রেখেছে। এখন আমার মাথায় হাত। পথের ফকির হচ্ছি বুঝলে। স্ট্রিট বেগার। এমন অবস্থা হয়েছে শান্তিমত ঘুমোতে পারি না।

ঘুমোতে পার না কেন?

মা সারাক্ষণ কাঁদে। দরজায় মাথা বাড়ি দেয়। এর মধ্যে ঘুমোব কী করে বল। এক’দিন আবার পুকুরে ডুবে মরতে গিয়েছিল। বিরাট কেলেংকারি।

এইসব কথা তো কিছু লেখনি।

লেখার মত কোনো কথা তো না। চা কর তো বকুল। ভাতটা শেষ করেই চা খেয়ে রওনা হব।

কোথায় রওনা হবে?

তিনজন দেওয়ানি উকিলের এ্যাড্রেস নিয়ে এসেছি। দেখি ব্যাটাদের কাউকে রাজি করানো যায় কিনা।

জহির চা পুরো শেষ করল না। দুচুমুক দিয়ে বের হয়ে গেল। তার ভাবভঙ্গি পুরোপুরি স্বাভাবিক, এ রকম বলা যাবে না। কিছুক্ষণ পরপর বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। বকুলের বড় মায়া লাগছে। সারাক্ষণ তার ইচ্ছা হচ্ছিল বলে–তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও কিন্তু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। আমি সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকব। বলা হল না। লজ্জা লাগতে লাগল।

জহির ফিরল রাত এগারটার দিকে। বিধ্বস্ত চেহারা। বঁ হাতের কনুইয়ের কাছে অনেকটা কেটে গেছে। হলুদ শার্ট রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে। জহির বিব্রত স্বরে বলল, রিকশা থেকে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে এই অবস্থা।

বকুল গরম পানিতে হাত ধুইয়ে দিল। ঘরে ডেটল ছিল না। বাবু এক বোতল ডেটল, তুলা, গজ কিনে আনল।

জহির বলল, এ্যাকসিডেন্ট হওয়ায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল বুঝলে বকুল। ভাবলাম অযাত্রা। আসলে তা না। বেনী মাধব বাবুকে পেয়ে গেলাম।

বেনী মাধব কে?

খুব নামকরা লইয়ার। দিনকে রাত করতে পারে। ঘাণ্ড লোক। কাগজপত্র দেখেই সব বুঝে ফেলল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল, তারপর বলল দাগ নম্বরে গণ্ডগোল আছে। তখনি বুঝলামএ হচ্ছে আসল জিনিস। এর কাছে হেংকি–পেংকি চলবে না।

বকুলের বড় মায়া লাগছে। জহিরের কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে সে গভীর জলে পড়েছে উদ্ধারের আশা নেই। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে ও তেমনি ধরেছে বেনী মাধবকে।

রাতে ঠিকমত খেতেও পারল না। একগাদা ভাত মাখিয়ে দু’এক নলা মুখে দিয়েই বলল খেতে পারছি না বকুল।

কেন খেতে পারছি না?

বুঝতে পারছি না। খুব ক্ষিধে লেগেছিল। হঠাৎ ক্ষিধেটা মরে গেল।

একটু দুধ দেই। দুধ গুড মাখিয়ে খাও।

দাও।

দুধ দেয়া গেল না। ঘরে দুধ ছিল না।

বকুলের কেমন জানি কান্না পেতে লাগল। আহ বেচারি দুধ ভাত খাবার জন্যে হাত গুটিয়ে বসে ছিল। বকুল ভেবে রেখেছিল রাত জেগে অনেক গল্প করে জহিরের মনটা সে ভাল করবে। গল্প ছাড়াও তো পুরুষদের অন্যসব দাবিও থাকে। সেই সব সে খুব আগ্রহ করেই মেটাবে। ঘুমুবার সময় ঘুমুবে জহিরকে জড়িয়ে ধরে। আহা বেচারা একা একা কত ঝামেলা সহ্য করছে। আর তাকে একা ঝামেলা সহ্য করতে দেবে না। এবার সে নিজেও সঙ্গে যাবে।

জহির বলল, এক কাপ আদা চা খাওয়াবে বকুল। শরীরটা কেমন ঝিম মেরে আছে। কিছু ভাল লাগছে না।

তুমি বিছানায় শুয়ে থাক। আমি চা বানিয়ে আনছি।

মাথা ধরার ট্যাবলেট থাকলেও একটা নিয়ে এস। মাথাটা কেমন ধরা ধরা মনে হচ্ছে।

বকুল চা নিয়ে এসে দেখে জহির ঘুমুচ্ছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের ঘুম; বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। মাথাটা বালিশ থেকে খানিকটা সরে গেছে। বকুলের ঘুম এল না।

জহিরকে জড়িযে ধরে সে জেগে রইল। পুরানো কথা মনে পড়তে লাগল। প্রথম যখন পরিচয় হয়। জহিরের সঙ্গে কথা বলতে কেমন ভয় ভয় লাগত। আবার ভাল ও লাগত। জহিরের ফার্মেসির সামনে দিয়ে যাবার সময় সে হাঁটতে মাথা নিচু করে যাতে জহির তাকে দেখতে না পায় অথচ মনে মনে সারাক্ষণ চাইত জহির তাকে দেখে ফেলুক। প্রায় সবদিনই জহির তাকে দেখতে। যেদিন দেখতে না সেদিন এমন কষ্ট হত চোখে পানি এসে যেত। আবার চোখে পানি আসার জন্যে নিজের ওপর রাগ লাগত। কী অদ্ভুত সময় গেছে। ইস এই সময়টা আর ফিরে আসবে না। ভালবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে না হওয়াটাই বোধ হয় ভাল। বিয়ে হলে মানুষটা থাকে ভালবাসা থাকে না। আর যদি বিয়ে না হয় তাহলে হয়ত বেশি প্ৰিয।

বকুল।

কি?

ক’টা বাজে দেখ তো।

জহির বিছানায় উঠে বসল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। সে কোথায়। বকুল বাতি জ্বালাল। ঘড়ি দেখল।

ক’টা বাজে?

দেড়টা। চা এনে দেখি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ-তাই আর জাগাইনি।

ঠাণ্ডা পানি খাওয়াও তো। গরম লাগছে খুব। জানালা খোলা না?

হ্যাঁ খোলা।

দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে।

বকুল পানি নিয়ে এসে দেখে জহির সিগারেট ধরিয়েছে। দুচুমুক পানি খেয়েই সে গ্রাস নামিয়ে রাখল। করুণ গলায় বলল, শরীরটা কেমন যেন লাগছে।

কেমন লাগছে?

বুঝতে পারছি না।

শরীর খারাপ লাগছে তো–সিগারেট টানছ কেন?

জহির সিগারেট ফেলে দিল। বকুল লক্ষ্য করল জহির খুব ঘামছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, তল পেটে কেমন জানি চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। বমি বমি লাগছে।

আপাকে ডেকে আনব?

উনাকে ডেকে এনে কি হবে? উনি কি করবেন? তুমি বরং চিনির সরবত করে দাও। তৃষ্ণা লাগছে।

বকুল চিনির সরবত করে আনল। দুচুমুক দিয়ে সরবতের গ্লাস নামিয়ে জহির ক্লান্ত গলায় বলল, বোধ হয় মারা যাচ্ছি।

কী বলছ তুমি? মারা যাবে কেন?

আপাকে ডাক। শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে স্ট্রোক। আমাকে সোহরাওয়াদীতে নিতে বল। আমি নিজে ডাক্তার।

মুনা বাবুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাকেরকে খুঁজে বের করতে হবে। জহিরকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেত হবে। এক একটা মিনিটও এখন মূল্যবান।

বাকের ঘরে ছিল। স্যান্ডেল খুঁজে বের করার সময়ও সে নিল না। খালি পায়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে কি করার জন্যে যাচ্ছে তাও সে জানে কি না কে জানে।

বাকের অসাধ্য সাধন করল। চল্লিশ মিনিটের মাথায় জহিরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারল। বড় রকমের একটা ঝাপটা সামলান গেল। তবে জহিরের শরীরের বা অংশ অচল হয়ে গেল।

বকুল ক্রমাগত কাঁদছিল। জহির ক্ষীণ স্বরে বলল, কাদার কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাব। আমি ডাক্তার আমার কথা বিশ্বাস কর।

বকুল কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না–সে শুধু দেখছে। একজন সুস্থ সবল মানুষ হঠাৎ পা নাড়াতে পারছে না। এটা কেমন করে হয়।

মুনা বলল, এ রকম বিশ্ৰী করে কাঁদছিস কেন? বকুল থমথমে গলায় বলল, সুন্দর করে কাঁদাটা কেমন আমি জানি না আপা। তাই বিশ্ৰী করে কাঁদি। তোমার ভাল না লাগলে তুমি অন্য ঘরে যাও।

জহিরের শরীর যত দ্রুত সারবে ভাবা গিয়েছিল তত দ্রুত সারল না। মাস খানেক পর দেখা গেল। ডান পা কিছু কিছু নাড়াতে পারে; বা পায়ের আঙুল নাড়াতে পারে এর বেশি কিছু না।

এভাবে হাসপাতালে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। জহির নেত্রকোনায় ফিরে গেল। সঙ্গে গেল বকুল এবং বাবু।

 

মা হবার লক্ষণ বকুলের মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে–বেশি পরিশ্রম করতে পারে না হাঁপিয়ে উঠে। কিন্তু তবু জহিরের সব কাজ নির্জের হাতে করতে চায়। তার শাশুড়ির এই জিনিসটা কেন জানি ভাল লাগে না। এক’দিন তিনি বলেই ফেললেন, আলগা আদর কিন্তু ভাল না বৌমা। বকুল সঙ্গে সঙ্গে বলল, আলগা আদর কাকে বলে মা?

তুমি যা করছি তার নাম আলগা আদর।

এর নাম আলগা আদর কেন?

দু’দিন আগের কথা ভুলে গেছ। দু’দিন আগে তো এক ঘরে ঘুমুতে পর্যন্ত পারতে না।

এখন পারি তাতে অসুবিধা কি?

অসুবিধা কিছুই না। মুখের ধার একটু কমাও তো বাউ। এত ধরা ভাল না।

বকুলের মুখের ধার কমে না। বরং বেড়েই চলে। বাবু অবাক হয়ে বোনকে দেখে। অবাক হয়ে ভাবে কত দ্রুত একজন মানুষ বদলায়। কত ভাবেই না বদলায়।

বাবুকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে। তার কিছুই ভাল লাগে না। ঢাকায় যেতেও ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়। তখন শুধু মরে যেতে ইচ্ছা করে। মরণের কথা ভাবতে তার বড় ভাল লাগে।

 

জোবেদ আলি শুকনো মুখে অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথা অন্য দিনের চেয়েও নিচু করে রেখেছে। মনে হচ্ছে পিঠের কাছে একটা কুঁজ বের হয়েছে। তার হাতে একটা আধখাওয়া সিগারেট। সিগারেট টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে থুথু ফেলছে। তার গায়ে হলুদ রঙের চাদর। পরনের পায়জামা ইন্ত্রি করা। তবে গায়ের চাদর বেশ ময়লা।

জলিল মিয়া ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। যদি সে তার নিজের দোকান ছাড়া অন্য কিছুই লক্ষ্য করে না। চাদরের হলুদ রঙটাই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মনে মনে বলল, দুপুরের এই গরমে গায়ে চাদর কেন? অসুখ-বিসুখ নাকি? অসুখ-বিসুখের কথা মনে হবার কারণ হচ্ছে তার নিজেই আজ জ্বর এবং তার গায়েও হলুদ খন্দরের চাদর। দোকানে তার আসার কোন ইচ্ছাই ছিল না। তবু এসেছে। ক্যাশে বসে ঝিমুচ্ছে। জলিল মিয়া লক্ষ্য করল জোবেদ আলি দুবার তার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। মাথা নিচু করেই আড় চোখে তাকাল তার দিকে। লোকটা কী কাউকে খুঁজছে? কাকে খুঁজবে?

খুঁজুক যাকে ইচ্ছা। তোর কি? জলিল মিয়া মাথা ধরার দুটো ট্যাবলেট খেয়ে চোখ বন্ধ করল। কোন কাস্টমার নেই। তিনটার পর থেকে দোকান খাঁ খা করে। এ রকম হলে তো ব্যবসা তুলে ফেলতে হবে। জলিল মিয়া বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখতে পারল না। একজন এসেছে দশ টাকা ভাংতি নিতে। কৰ্কশ গলায় বলা যেতে পারে।–ভাংতি নাই। কিন্তু বলাটা ঠিক হবে না। এরা হচ্ছে কাস্টমার। এদের সঙ্গে ভদ্র ও বিনয়ী আচরণ করতে হবে। সে দু’টা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে তেলতেলে ধরনের হাসি হাসল আর ঠিক তখন দোকানে ঢুকল জোবেদ আলি। চিচি করে বলল, ভাই সাহেব চা হবে?

জলিল মিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। জ্বর চেপে আসছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। শরীর ভাল থাকলে দু’একটা টুকটাক কথা বলা যেত যেমন–এতদিন এই অঞ্চলে আছেন, আর আজ প্রথম চা খেতে আসলেন ব্যাপার কী ভাই? গায়ে চাদর যে? অসুখ-বিসুখ নাকি? এই দেখেন আমারো একই অবস্থা। নির্ঘাৎ একশ তিন জ্বর। তবু দোকানে আসতে হয়। উপায় কী ভাই বলেন? একটা বিশ্বাসী লোক নাই। সব চোর।

জোবেদ আলি চায়ে দু’টা চুমুক দিয়েই বসে আছে। সিগারেট ধরিয়ে খুঁক-খুক কাশছে। কেমন ভয়পাওয়া চোখে তাকাচ্ছে। জলিল মিয়া নিঃসন্দেহ হল এই লোক চা খেতে আসেনি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। থাকুক উদ্দেশ্য। তার তা দিয়ে কোনো কাজ নেই। সে ব্যবসা করতে এসেছে ব্যবসা করবে। তার বেশি কোন কিছুতেই কাজ কী?

জোবেদ আলি চায়ের দাম দিলা চকচকে একটা এক টাকার নোট দিয়ে। এতে জলিল মিয়ার মনটা খানিকটা ভাল হল। কাস্টামাররা তাদের ছেড়াখুড়া পচা নোটগুলি তাকে দিয়ে পার পায়।

জলিল মিয়া বলল, ভাল আছেন?

জোবেদ আলি আগের মতোই চিঁচিঁ স্বরে বলল, জি ভাল। আপনি বাকের সাহেব কোথায় আছে বলতে পারেন?

জি না।

কোথায় পাওয়া যাবে উনাকে?

জানি না।

জোবেদ আলি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, খুব দরকার ছিল! যদি বলতে পারেন উপকার হয়।

ইদারিসের ওখানে খোঁজ করেন। ফার্নিচারের দোকান দিয়েছে যে ঐ ইদারিস। দুপুর বেলায় ঐ দোকানের দুতলায় ঘুমায়।

জি আচ্ছা। আপনার এখানে আসবে না?

জানি না। ইনার চলার তো কোন ঠিকাঠিকানা নাই।

খুব দরকার ছিল।

শরীর ভাল থাকলে জলিল মিয়া বলত, কী দরকার? শরীর ভাল নেই বলেই সে কিছু বলল না। তাছাড়া জোবেদ আলি মুখের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। অসুস্থ শরীরের কারণে ধুয়া সহ্য হচ্ছে না। নাড়ির ভেতর পাক দিয়ে উঠছে। কিছু বলাও যাচ্ছে না। এরা কাস্টমার ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে এদের খাতির করে চলতে হয়। জোবেদ আলি বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হলে একটা খবর দিতে পারবেন?

কি খবর?

জোবেদ আলি বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, থাক কিছু বলতে হবে না। সে ইদারিসের ফার্নিচারের দোকানো গেল। ইদারিস একটা সোফাসেটে বানিস ঘসছে। সে জোবেদ আলিকে অনেক কথাই বলল, যার সারমর্ম হচ্ছে বাকের ভাই ঘুমুচ্ছে তাকে ডাকা যাবে না। ডাকলে খুব রাগ করবে।

খুব দরকার ছিল ভাই।

দুই ঘণ্টা পরে আসেন–মাত্র ঘুমাইছে।

আমি না হয় বসি?

ইচ্ছা হইলে বসেন।

জোবেদ আলি আধঘণ্টার মত বসল, এর মধ্যে সে পাঁচটা সিগারেট খেয়ে ফেলল। ৬ষ্ঠ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এক কাপ চা খেয়ে আসি। এর মধ্যে ঘুম ভাঙলে বলবেন আমার কথা। আমার নাম জোবেদ আলি। উনার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন।

সন্ধ্যার আগে ঘুম ভাঙবে না। আপনার যেখানে ইচ্ছা যান।

জোবেদ আলি চা খেতে গিয়ে আর ফিরল না। রাত নটার দিকে আবার তাকে দেখা গোল বিভিন্ন জায়গায় বাকেরের খোঁজ করছে। তাঁকে আরো চিন্তিত ও বিষন্ন দেখাচ্ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাকেরের সে কোনো হদিস পেল না।

সন্ধ্যা মেলানোর পর বাকের ঘর থেকে বেরুল। জোবেদ আলি তাকে খোঁজ করছে এই খবরে সে বিশেষ আগ্রহ বোধ করল না। খোঁজ করছে বলেই ব্যস্ত হয়ে ছুটে যেতে হবে নাকি? যার দরকার সে আসবে।

বাকের চা খেতে খেতে ভাবতে লাগল। আজ রাতে করার কিছু আছে কী না। অনেক ভেবেও করার মত কিছু পেল না। মুনার সঙ্গে দেখা করা যেত। কিন্তু মুনা খুব একটা অন্যায় কাজ করছে। বাকেরকে কিছু না বলে তার কোনো এক মামার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। মামার বাড়িটা কোথায় তা অবশ্যি সে জানে। কী দরকার আগ বাড়িয়ে যাওয়ার? যে আমাকে চিনে না। আমিও তাকে চিনি না। মরে গেলেও মুনার বাড়ি সে খোঁজে বের করবে না। তার দায়টা কী?

রাত আটটার দিকে সে ইয়াদের বাসায় গেল। পুরানো বন্ধু-বান্ধব সব একেবারে ছেড়ে দেয়া ঠিক না। খোঁজখবর রাখা দরকার। ইয়াদের বাসার ভোল পাল্টেছে। নতুন রঙ করা হয়েছে। দরজার ওপর কায়দার একটি কলিং বেল। টিপলেই মিউজিক বাজে। বেশ লম্বা-চওড়া মিউজিক। কলিংবেল টেপার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াদ দরজা খুলে দিল। হাসি মুখে বলল, আরো দোস্ত তুই। বাকেরের মনে হল ইয়াদের হাসিটা আসল নয়, মেকি মাল। তাছাড়া ইয়াদ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বাকেরকে ভেতর ঢুকতে দিতে রাজি না।

খোঁজখবর নিতে এলাম। আছিস কেমন?

ভাল। আরেক’দিন আয় তোস্ত। আজ একটা ব্যাপার আছে। মানে একটা ঝামেলা।

কি ঝামেলা?

আমার ওয়াইফ বাচ্চার জন্মদিন না কি যেন করছে। শ্বশুর বাড়ির দু’একজনকে বলেছে। মানে…

আমি থাকলে অসুবিধা কি?

মেয়েদের কারবার তোর ভাল লাগবে না।

অপমানিত বোধ করার মত কথা কিন্তু ইয়াদের ফ্যাকাশে মুখ দেখে বাকেরের মজাই লাগছে। ইয়াদ অপ্রস্তুত গলায় বলল, তুই কাল আয় দোস্ত। ভাত খাঁ আমাদের সাথে।

ঠিক আছে আসব।

সন্ধ্যা বেলা চলে আসিস–এক সঙ্গে ছবি দেখবে। ভিসিআর কিনলাম একটা, জি টেন।

ভিসিআরও কিনে ফেলেছিস? বাকি রইল কী?

নিজে কিনি নাই দোস্ত। আমার এক শালা প্রেজেন্ট করেছে। যা মুশকিলে পড়েছি…

মুশকিল কী?

রোজ ছবি আনতে হয়। এমন অভ্যাস হয়েছে দোস্ত–শোয়ার আগে একটা ছবি না দেখলে ভাল লাগে না। বোম্বের লেটেস্ট ছবি সবই পাওয়া যায়। ওদের হলে রিলিজ দেয়ার আগে ঢাকায় চলে আসে।

ভালই তো।

পয়সা যার যায়। সেই বুঝে ভাল কী মন্দ। তিনটা ভিডিও ক্লাবের মেম্বার হয়েছি। পঁচিশ টাকা করে ক্যাসেট। জলের মত টাকা যাচ্ছে রে দোস্ত।

তুই ভেতরে যা। তোর বউ বোধ হয় রেগে যাচ্ছে।

যাচ্ছি। চল তোকে একটা সিগারেট খাওয়াই। ঘরে সিগারেট টোটেলি স্টপড। কোথেকে শুনেছে ক্যানসার মেয়েছেলের কারবার।

ইয়াদ রাস্তা পর্যন্ত এল। দু’টা সিগারেট কিনল। বাকেরকে একটা দিয়ে নিজে একটা ধরাল, ফুর্তির ভঙ্গিতে বলল, কাল তোর জন্যে ছবি এনে রাখব। আন্ধা-কানুন। মারাত্মক।

বাকের বলল, সিগারেট খাচ্ছিস গন্ধে তোর বউ বুঝে ফেলবে?

বাথরুমে ঢুকে হেভি ওয়াসিং দিব কেউ টের পাবে না। বিয়ে করা বড় যন্ত্রণা রে দোস্ত। ভাল কথা ঐ তিন মেয়েওয়ালা বাড়ির ব্যাপারটার খোঁজ পাওয়া গেছে। তুই যা ভাবছিলি তাই। পাক্কা খবর আছে আমার কাছে।

তাই নাকি?

হাই ক্লাস মেয়েছেলে–শুধু মালদার পার্টির জন্যে। রুই-কাতলাদের জিনিস। তবে দোস্ত একটা রিকোয়েস্ট তুই এদের ঘাটাস না। বিপদে পড়বি।

কি বিপদ?

রুই-কাতলা ঘটালে বিপদ হয় না? পাগলামি করবি না। খবরদার। কাল বলব সব কিছু। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসবি।

বাকের ঘড়ি দেখল। মাত্র আটটা দশ। সময় কাটানোই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারোটার আগে ঘুম আসে না। বারোটা পর্যন্ত সে করবে কী? মুনার খোঁজে যাওয়াটা খুবই উচিত। মামার কাছে থাকলেও তো মেয়েটা একা। তাছাড়া আপন মামাও নিশ্চয়ই না। আপন মামা হলে ভাগীর খোঁজখবর করত। এর মধ্যে একবারও তো খোঁজ করতে দেখেনি।

এদিকে বকুলদেরও একটা খবর নেয়া দরকার। জহিরের অবস্থাটা কী। এত বড় রুগী গ্রামে নিয়ে ফেলে রেখেছে বেকুবীর চূড়ান্ত করছে। মুনার সঙ্গে কথা বলে আবার ঢাকা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এই কথাটা বলার জন্যেই মুনার কাছে যাওয়া দরকার। অনন্য কিছু না। রাগ করে ঘরে বসে থাকার কোন অর্থ হয় না। রাগ বড় না রুগী বড়?

মুনা খুব সহজ স্বরে বলল, ভেতরে আসুন বাকের ভাই। মুনার গলায় মাফলার জড়ানো। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখ ঈষৎ লাল। বাকের চিন্তিত মুখে বলল, অসুখ নাকি?

হ্যাঁ জ্বর। গতকাল মাত্র কমেছে। এখন আবার শরীর খারাপ লাগছে। আবার জ্বর আসবে কী না কে জানে। এ বাড়িতে এসেই জ্বরে পড়লাম। এই জন্যেই আপনাকে খবর দিতে পারিনি। কিছু মনে করবেন না বাকের ভাই।

আরে কি মুশকিল। মনে করার কি আছে?

এ বাড়ির দোতলার একটা ঘরে মুনা থাকে। মুনা বাকেরকে সরাসরি তার ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা বেশ বড়। মুনার যাবতীয় জিনিসপত্র গাদাগাদি করে রাখা। কিছুই গোছানো নেই। বাকের বিস্মিত হয়ে বলল, এই অবস্থা কেন?

টেম্পোরারি থাকার জন্যে আসা তাই কিছুই গুছাইনি। হোস্টেল টোস্টেল কিছু আমার জন্যে পান কী না দেখবেন তো। অবিবাহিত মেয়েদের একা থাকা যে কি সমস্যা।

হুট করে চলে এলে একটা খবর দিলে না।

মামা জোর করে নিয়ে এল। একা একা একটা বাড়িতে থাকি শুনেই মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। আমার নিজেরও ভয় ভয় লাগিছিল। কাজের মেয়েটা চলে গেল তো। বাকের ভাই আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন। খাটটায় বসুন। আমি চট করে আসছি।

চা-টা কিছু খাব না কিন্তু।

চা আনছি। আপনাকে বলল কে?

রাড়ি একদম খালি খালি লাগছে। লোকজন নাই।

অনেক লোক। বিয়ের দাওয়াতে গেছে। এগারটার দিকে আসবে।

মুনা নিচে নেমে গেল। বাকের দীর্ঘ সময় একা একা বসে রইল। মেঘ ডাকছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে মুশকিল। এতক্ষণ ধরে মুনা নিচে কী করছে কে জানে। একটা সিগারেট খেতে পারলে হত। সিগারেট পকেটে আছে। দেয়াশলাই নেই।

অনেক দেরি করে ফেললাম। তাই না বাকের ভাই?

মুনার হাতে ট্রে। ট্রেতে রাতের খাবার।

এসব কী?

ভাত নিয়ে এসেছি। বসে যান।

আরে কি মুশকিল।

কথা বাড়বেন না তো বসে পড়ুন। আপনার জন্যে আলাদা কিছু করিনি। আমারটাই আপনাকে দিচ্ছি। আমি রাতে কিছু খাব না। জ্বর আসছে।

আবার জ্বর আসছে?

হ্যাঁ আসছে। এই দেখুন কত জ্বর।

মুনা বাকেরকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বাকেরের হাত ধরল। সত্যি সত্যি জ্বর এবং অনেক জ্বর। এতটা জ্বর নিয়ে কেউ এমন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে কী করে কে জানে।

হাত ধরায় লজ্জা পেলেন নাকি বারেক ভাই?

না লজ্জা পাব কেন? জ্বর দেখাবার জন্যে হাত ধরেছি। অন্য কিছু তো না।

মুনা হাসতে হাসতে বলল, তা ঠিক। ভাত নিয়ে বসুন। আপনাকে কেউ তো আদর করে খাওয়ায় না। আদর করে খাইয়ে দি।

বাকেরের চোখ ভিজে উঠল। সে আতংকে কাঠ হয়ে গেল। টপ করে যদি এক ফোঁটা চোখের পানি পড়ে যায় বড় মুশকিল হবে। মুনা দেখে ফেলবে। আর সে যা মেয়ে এই জিনিস দেখলে

বাকের ভাই!

বল।

আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?

বাকেরের অস্বস্তির সীমা রইল না। এইসব আবার কি ধরনের কথা? জ্বরে কি মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ভাত শেষ করে একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে হবে। ডিলে করা ঠিক হবে না।

কথা বলছেন না কেন? আমাকে পছন্দ করেন?

কেন করব না। করি। কতটুকু পছন্দ অল্প না অনেকখানি?

জানি।

আমি কিন্তু আপনাকে পছন্দ করি না বাকের ভাই।

জানি।

আপনি একজন অপদাৰ্থ মানুষ। আকাজের মানুষ।

জানি।

জানেন তো নিজেকে বদলান না কেন?

বাকের জবাব না দিয়ে ভাত মাখতে লাগল। সে এখন বেশ আরাম পাচ্ছে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এ্যাকসিডেন্ট হবার সম্ভাবনা নেই।

নিজেকে বদলান না কেন?

বদলেছি তো।

কিছুই বদলাননি। আগে যেমন এখনো তেমনি আছেন। ভবঘুরের মতো চলাফেরা, গুণ্ডামি, বড় বড় কথা। এইসব ছাডুন তো।

আচ্ছা ছাড়ব।

আর ছাড়বেন। এই জীবনে ছাড়বেন না; বরং এক কাজ করুন খুব ভাল, খুব লক্ষ্মী এ রকম একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলুন। তাতে কাজ হতে পারে। মেয়েরা মানুষ বদলাতে ওস্তাদ।

বাকেরের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। তবু থালা হাতে বসে আছে। মুনা তার সামনে। কী সুন্দর সরল মুখ অথচ কি কঠিন একটা মেয়ে।

বাকের ভাই।

উঁ।

কয়েকদিন জ্বরে খুব কষ্ট পেয়েছি। জ্বরের সময় মনে হত আমার মতো একলা এই পৃথিবীতে কেউ নেই। খুব কষ্ট হত।

কি যে কাণ্ড তোমার। একটা খবর দিলে চলে আসতাম না? রাত দিন থাকতাম। খবর দিবে না। কিছু না।

জ্বরের সময় আমি আরেকটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে আপনাকে আমি খুব পছন্দ করি। আপনার মত বাজে ধরনের একজন মানুষকে এতটা পছন্দ করি ভেবে নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল।

রাগ হওয়ার কথা।

তারপর মনে হল আপনার মত ভাল মানুষই বা কজন আছে। আপনি যে একজন ভালমানুষ সেটা কী আপনি জানেন?

কি সব কথাবার্তা তুমি বলছ?

সবদিন কি এইসব কথা বলা যায়? হঠাৎ এক আধাদিন বলতে ইচ্ছা করে। বাকের ভাই আমি খুব একলা হয়ে পড়েছি। আর পারছি না।

মুনার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বাকের কি বলবে কিছু বুঝতে পারল না। কী বললে মুনা খুশি হবে? সে যা করতে বলবে তাই করবে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে বললে লাফিয়ে পড়বে।

ঝড়বৃষ্টি আসবে বাসায় চলে যান। আপনার বাসা তো আবার নেই। কোন একটা দোকানেটোকানে গিয়ে উঠে পড়ুন। ঐ কাঠের দোকানেই তো এখন থাকেন?

হ্যাঁ।

আপনাকে এই রকম আর আমি থাকতে দেব না। সুন্দর একটা একতলা বাড়ি ভাড়া করব। সারাদিন যত ইচ্ছা গুণ্ডামি করবেন। সন্ধ্যার পর ফিরে আসবেন। রাতে দু’জন মুখোমুখি বসে ভাত খাব।

মুনার গলা ধরে এল। কথা শেষ করতে পারল না। বাকের একটা ঘোরের মধ্যে তার ঘরে ফিরে এল। বৃষ্টি হচ্ছিল সে পুরোপুরি ভিজে গেছে। কাদায় পানিতে মাখামাখি। অথচ কিছুই বুঝতে পারছে না। ভেজা কাপড়েই সে তার বিছানায় বসে আছে। ঘোর কাটল রাত তিনটার দিকে।

পুলিশের বাঁশি বাজছে। ওসি সাহেব দরজায় লাথি দিচ্ছেন। পুলিশ কর্কশ গলায় ডাকছেন–বাকের, এই বাকের।

বাকের দরজা খুলতেই তাকে অ্যারেস্ট করা হল। অভিযোগ গুরুতর। জোবেদ আলি খুন হয়েছে। খুন করার দৃশ্য এবং খুনির পালিয়ে যাবার দৃশ্য তিনজন দেখে ফেলেছে। তিনজনই বলছে– খুন করছে বাকের।

বাকেরের এই মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলল। ডেটের পর ডেট পড়ে। মামলা পরিচালনা করলেন মুনার সেই পরিচিত উকিল। কখনো তিনি মুনাকে বললেন না যে মামলা টিকবে না। উল্টোটাই বললেন। একবার না। অনেকবার বললেন। বলার সময় প্রতিবারই কিছুটা বিষন্ন হলেন।

ব্যাপারটা কি জানেন, ওরা মামলাটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। আমি কোন ফাক ধরতে পারিনি। মোটিভ আছে প্রত্যক্ষদশীর সাক্ষী আছে। মিথ্যা মামলার সাজানোটাই হয় অসাধারণ। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি আপনাকে মিথ্যা কোন আশ্বাস দিতে যাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কনভিকশন হয়ে যাবে।

উকিলের মুখ বিষন্ন দেখা যায়।

বিষন্ন দেখায় না। শুধু বাকেরকে। মুনার সঙ্গে তার যতবারই দেখা হয় সে ততবারই বলে, কোনমতে যদি বের হতে পারি তাহলে সিদ্দিক শালাকে পুতে ফেলবে। তবে আমাকে আগেই যদি ঝুলিয়ে দেয় তাহলে তো কিছু করার নেই।

ভয় লাগে না বাকের ভাই। যদি সত্যি সত্যি…

আরে না। ভয় লাগে না।

সত্যি ভয় লাগে না।

রাতের বেলা একটু গা ছমছম করে। রাতের বেলা ফাঁসি দিলে একটা ভয়ের ব্যাপার হত। ফাসিটা তো দিনে দেয়। তাই ভয়টা থাকে না।

পাগলের মত কথাবার্তা বলছেন বাকের ভাই।

পাগলের মতো বলব কেন এটা হচ্ছে ট্রথা। রাতের বেলা মরা খুবই ভয়ংকর। দিনের মৃত্যু কিছু না। সিদ্দিক শালাকে আমি রাতের বেলা মারব। ওয়ার্ড অব অনার।

মামলা চলতে থাকে।

মুনা অপেক্ষা করে।

ক্লান্তির অপেক্ষা। দীর্ঘ দিবস। দীর্ঘ রজনী কিছুতেই যেন মার কাটে না।

 

আশা ও আনন্দের কথায় ভর্তি করে সুন্দর সুন্দর চিঠি লেখে বকুল। তার ছেলের কথা লেখে, ছেলের দুষ্টামির কথা লেখে, জহির যে ক্রমে ক্রমেই সেরে উঠছে সে কথাও লেখে। সে নিজেও সেরে উঠেছে। সেই কথাও থাকে।

এখন সে আর পুরনো দুঃস্বপ্ন দেখে না। স্বামীর গায়ে হাত রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। তাকে সাবধান করে দিতে অশরীরী কেউ আর আসে না। কত সুন্দর সুন্দর চিঠি কিন্তু মুনার পড়তে ভাল লাগে না।

চিঠি লিখে জাহানার নামের অপরিচিত একটি মেয়ে। অচেনা একজন কিন্তু বড় চেনা একজন। বড় সুন্দর করে সে লেখে–আপা, আমরা দু’জন কিছু কী করতে পারি আপনার জন্যে? আপনার জন্যে ও বড় কষ্ট পচ্ছে। একটা কিছু করার সুযোগ আপনি ওকে দিন। বাকের সাহেবের মামলা যেদিন কোর্টে উঠে ও সেই সব দিনগুলিতে মামুন কোর্টে উপস্থিত থাকে। লজ্জায় আপনার সামনে যেতে পারে না। এক’দিন সে বলল, আপনি নাকি খুব কাঁদছিলেন বলতে বলতে সেও খুব কাদল। আপা, আপনি ওকে কিছু করার সুযোগ দিন।

এই মেয়েটির চিঠি পড়তে তার ভাল লাগে। কিন্তু জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। বড় আলস্য লাগে। মাঝে মাঝে এমন ক্লান্তি লাগে যে কোর্টে যেতে পর্যন্ত ইচ্ছা করে না। তবু তাকে যেতে হয়। এক কোণে বসে থেকে সে প্রাণপণে চেষ্টা করে হাই গোপন করতে। কোর্ট থেকে বেরুতে বেরুতে কোন কোন দিন তিনটা সাড়ে তিনটা বেজে যায়। ক্ষিধেয় শরীর কেমন করতে থাকে। কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। ঝিম ধরা দুপুরে সে রাস্তায় একা একা হাঁটে।

হাঁটতে হাঁটতেই কোনো কোনো দিন হঠাৎ সুখের কোনো কল্পনা মাথায় চলে আসে যেন সে রিকশা করে যাচ্ছে হঠাৎ পথে বাকেরের সঙ্গে দেখা। বাকের তাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে। উৎসাহ নিয়ে বাকের বলল–যাচ্ছ কোথায়?

মুনা বলল, তা দিয়ে আপনার দরকার কি?

না কোনো দরকার নেই। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

বলতে বলতে বাকেরের মুখ একটু যেন বিষন্ন হয়ে গেল। মুনা বলল, আপনার কোনো কাজ না থাকলে আসুন তো আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাব।

বাকের রিকশায় উঠল। আনন্দে তার চোখ ঝিকমিক করছে। বৃষ্টি শুরু হল তখন। তারা হুঁড তুলল না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দু’জন এগুচ্ছে। হাওয়ায় মুনার চুল উড়ছে। বাকের বলছে বাতাসটা খুব ফাইন লাগছে তো। বড় ফাইন।

মুনার কোনো কল্পনাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ঝিম ধরা ক্লান্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে। আকাশের রঙ ঘন নীল। সেখানে–সোনালি ডানার চিল চক্রাকারে ওড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *