সেবারের দূর্গাপূজোর কয়েকটি দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তা ছাড়া, সেবারে আমাদের মামাবাড়ির পূজোর বর্ণনা আমি বিষ্ণুকে চিঠিতে লিখে পাঠিয়ে ছিলাম, বেশ কয়েক বছর পর সেই চিঠি ঘুরে ফিরে আবার আমার হাতে চলে এসেছিল।
পূজোর প্রায় এক মাস আগে থেকেই বেশ একটা পূজো পূজো ভাব। আকাশের মেঘ হালকা হালকা সাদা রঙের হয়ে গেছে, শিউলি গাছে এসেছে অজস্র ফুল। আমাদের ঠাকুরদালানে এর মধ্যেই মূর্তি গড়া শুরু হয়ে গেছে। দুর্গা ঠাকুর যে বাইরে থেকে কিনে আনা যায়–এ কথা গ্রামের লোক জানেই না। বাড়িতে মূর্তি তৈরি করারই রেওয়াজ ছিল পূর্ববঙ্গে।
আমাদের মামাবাড়ির মূর্তি বানাত জলধর। হঠাৎ একদিন তার নৌকো এসে ভিড়ত পুকুরঘাটে। বড় রহস্যময় ছিল তার নৌকোটি। ভেতরে কত রকম তুলি আর রঙের পাত্র আর মুখের ছাঁচ। রুপোলি জরির কলকা আর রেশমি কাপড়ও থাকত প্রচুর। মাঝখানে একটা পরদা ফেলা–সে পরদার ও পাশে কী থাকত কে জানে।
জলধর লোকটি বেশ বেঁটেখাটো এবং গম্ভীর। তাকে আমরা কথা বলতে শুনেছি খুব কম। সে যে একজন শিল্পী ছিল, তার গাম্ভীর্যই তার প্রমাণ। তার মতন অবস্থার একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে আমার মামাবাড়ির অহংকারী ধনীদের সঙ্গে হাত কচলে তোষামোদের সুরে কথা বলাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু জলধর সেসবের ধার ধারত না, অনেকের কথার সে উত্তরই দিত না–একমাত্র আমার দাদামশাইয়ের সঙ্গেই তাকে দু-চারটে কথা বলতে শুনেছি। তা ছাড়া, কোনও একটা জিনিসের দিকে তার অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা দেখেও তাকে আমার অসাধারণ মনে হয়েছিল।
কিন্তু শিল্পী হলেও জলধর ছিল নিচু জাত। তাকে সেই জন্য বাড়ির সকলেই তুমি তুমি বলে কথা বলত।
পূজোর এক মাস আগেই প্রতিমার খড়ের কাঠামো তৈরি হয়ে যেত। সে কাজে জলধর নিজে আসত না, পাঠাত তার দু’জন সহকারীকে। কিছুদিন পর সেই দু’জন সহকারীই আবার এসে মাটি লাগিয়ে যেত খড়ের কাঠামোতে। এই ভাবে প্রতিমা একমেটে, দু’মেটে হবে। সব মূর্তিই মুন্ডুহীন এবং ন্যাংটো। দু’দিনেই সেই মাটি শুকিয়ে ফেটে ফেটে কী রকম অদ্ভুত চেহারা হয়–সে-দিকে তাকাতে আমাদের একটু লজ্জা লজ্জা করে। এরপর সেই মূর্তিগুলোতে আবার মাটি লেপে তারপর লাগানো হল সাদা খড়ি রং। তখন সবাই সাদা, দুর্গা, সিংহ, কার্তিক-গণেশ এমনকী ময়ূরটা পর্যন্ত। এরপর জলধর নিজে আসবে আসল প্রতিমা গড়তে।
বাড়ির পেছন দিকের পুকুরপাড়ে আমরা ছোটরা খেলা করছিলাম, এমন সময় পুকুরের উত্তর দিকের জান দিয়ে সেই নৌকোটা ঢুকল। আমার খেলার সাথী অনেকেরই জন্ম থেকে সেই নৌকোটা চেনা। তারা চেঁচিয়ে উঠল, জলধরকাকা এসেছে, জলধরকাকা এসেছে।
নৌকো ঘাটে এসে ভিড়তেই আমরা সবাই জলধরকাকাকে ঘিরে ধরলাম। কেউ একটা ময়ূরের পালক চায়, কেউ জরির টিপ চায়। জলধর কারোকেই নিরাশ করে না।
জলধর বার বাড়ির রোয়াকে এসে মাটিতে শুয়ে পড়ে দাদামশাইকে প্রণাম করল। দাদামশাই বললেন, কী জলধর, এবার এত দেরি করলে যে? কালই না চতুর্থী?
জলধর জানাল যে সে সারা রাত জেগে কাজ করবে।
দাদামশাই জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির সব খবর ভালো?
জলধর সংক্ষিপ্ত ভাবে জানাল তার বড়ছেলেটার খুব অসুখ। ম্যালেরিয়া।
দাদামশাই বললেন, যাবার সময় আমার কাছ থেকে কয়েকটা কুইনিন নিয়ে যেয়ো। মনে করে চেয়ে নিয়ো।
কুইনিনের এক একটা ট্যাবলেট তখন সোনার টুকরোর সমান। কালোবাজারে বিশেষ প্রতিপত্তি না থাকলে ও-ওষুধ জোগাড় করাও যায় না। দাদামশাই যে সেই দুর্লভ জিনিস দিয়ে দিতে চাইলেন, তার মানে জলধরের প্রতি তার সত্যিকারের দুর্বলতা ছিল।
জলধরের মূর্তি তৈরির কাজ দেখবার মতন। সে সাধারণ একজন গ্রাম্য কুমোর–এবং জলে বিসর্জন দেবার জন্যই সে মূর্তি বানায়। তবু তার নিষ্ঠা অদ্ভুত। সে চব্বিশ ঘণ্টা টানা কাজ করে, খায় না, ঘুমোয় না, কারওর সঙ্গে কথা বলে না। প্রতিমার গায়ের রং, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার সজ্জা–সবই নিখুঁত। লক্ষ্মী সরস্বতী আর কার্তিকের মুখ সে ছাঁচে ঢেলে বানায়। গণেশের মুণ্ড তো হাতে বানাতে হবেই। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে দুর্গার মুখতার জন্য সে কোনও দিন ছাঁচ ব্যবহার করেনি। একতাল মাটি সে অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে ছানাছানি করে, এদিক-ওদিক ঘোরে, নানা কথা ভাবে। তারপর হঠাৎ একসময় বিদ্যুৎবেগে সে মুখোনি বানিয়ে ফেলে। দেড় মিনিট-দু’মিনিটের বেশি লাগে না। তখন সেই মুখটা প্রতিমার ওপর বসিয়ে সে অনেক দূরে চলে যায়, চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এক একবার ছুটে এসে নাকের পাশটা একটু টিপে দিয়ে যায়, চোখটা একটু বড় করে। পরদিন সে রং তুলি নিয়ে বসে।
আমরা স্নান-খাওয়া ফেলে হাঁ করে সেই মূর্তি তৈরি করা দেখি। সিংহটা কখন তৈরি হবে, তার জন্য আমি ছটফট করছি। সিংহ আর অসুরের সম্পর্কে যেন ওদের কোনও গরজই নেই।
দুর্গাপুজোর এক মাস আগে থেকেই বাড়ির কর্তা থেকে ছোট ছেলেটি পর্যন্ত সবাই কোনওনা-কোনও কাজে জড়িয়ে পড়ে। আমার ওপরেও একটা কাজের ভার পড়েছিল। গোপালগঞ্জের হাট থেকে চারটি কালো রঙের পাঁঠা কিনে আনা হয়েছে কয়েক দিন আগে। চারটে পাঁঠাই ঠিক এক রকম দেখতে। বাড়ির চার জন বাচ্চার ওপর ভার পড়েছিল সেই পাঁঠাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করার। অন্য লোক যে ছিল না তা নয়, তবু বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার এই একটা কৌশল। আমাদের অবশ্য উৎসাহের অন্ত ছিল না।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই আমরা কয়েক জন পাঁঠাগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। টাটকা শিশিরভেজা ঘাস খাওয়ালে ওদের স্বাস্থ্য ভালো হবে। এক মাসের মধ্যে বেশ নাদুসনুদুস করে তুলতে হবে ওদের। ওরা ফুলগাছ খেয়ে ফেললে বকিনি। কখনও খেতে না চাইলে কত আদর করেছি। ওদের জন্য ধানখেত থেকে নতুন ধানের পাতা ছিঁড়তে গিয়ে কচাৎ করে আমার আঙুলের অনেকখানি কেটে গেল। কচি ধানপাতায় ব্লেডের। মতন ধার। রক্তমাখা ধানপাতাগুলো আমি হাত থেকে ফেলে দিলাম, পাঁঠাটা দিব্যি সেগুলো খেয়ে নিল। কয়েক দিন পরে আমি ওর মাংস খাব তো, তার আগে আমার রক্ত ওর খাওয়া হয়ে গেল।
পাঁঠাবলির সময় যারা দাঁড়িয়ে থাকবে না, তাদেরকে সবাই ভিতু বলে খুব রাগায়। আমার ধারণা ছিল, আমি ভয় পাব না। তখন মনে মনে কত বাঘ-সিংহ শিকার করি, পাখি দেখলেই গুলতি ছুড়ি, আর সামান্য একটা পাঁঠাবলি দেখে ভয় পাব কেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি থাকতে পারিনি, বলির খাঁড়া যখন উঠেছে, আমি একছুট্টে পালিয়ে গিয়েছিলাম। মৃত্যুর আগে পাঁঠাটার ম্যা ম্যা ডাক কতক্ষণ যে আমার কানের কাছে। বেজেছে!
ভোরবেলা উঠে পাঁঠা চরাতে চরাতে আমি চলে যেতাম খালধার পর্যন্ত। পরবর্তী জীবনে আমি রাখাল বা মেষপালকদের সম্পর্কে অনেক কাব্য-গাথা পড়েছি, কিন্তু পাঁঠা-চরানোর ব্যাপারটা সে রকম কবিত্বময় মনে করা যায় না। কিন্তু আমি বেশ আনন্দ পেতাম। তখন আমার আপন মনে কথা বলার স্বভাবটা খুব বেশি ছিল। বাচ্চা পাঁঠাটাকে সঙ্গে পেয়ে আমার কত কথা যে ওকে শুনিয়েছি! শিশিরভেজা মাঠে ওর সঙ্গে সেই যে ছুটোছুটি করেছিলাম–মনে হয় যেন আজও সেই গ্রামের প্রান্তরে আমার পায়ের ছাপ রয়ে গেছে।
খালধারে ছিল আমার ইস্কুলের বন্ধু মুর্তজার বাড়ি। মুর্তজার বাবা ইফতিকার সাহেব। শহর আদালতে ওকালতি করতেন। মুর্তজা আমার সমবয়সি হলেও ছিল শান্ত গম্ভীর প্রকৃতির, পড়াশুনোয় খুব মনোযোগী। খেলাধুলোর বদলে সে বইপত্রের আলোচনা করতে ভালোবাসত। আমাকে দেখলেই সে বাংলা বানান জিজ্ঞেস করত। ইস্কুলের মাস্টারমশাইরা কলকাতার ছেলে বলে আমাকে বেশি প্রশংসা করলেও আঁক আর বাংলায় মুর্তজা আমার থেকে অনেক ভালো ছেলে। সকালবেলা ওর বাড়ির কাছাকাছি। গেলে মুর্তজা আমাকে দেখেই ওর মাকে ডাক দিয়ে বলত, আম্মা, বাদল আইছে, আমি একটু ঘুইরা আসি।
সেবারের দুর্গাপুজো যে দুটি কারণে আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে, তার মধ্যে অন্যতম মূর্তজার কয়েকটি কথা। পুজোর কয়েকটি দিন আমার মামাবাড়িতে গ্রামসুদ্ধ লোকের নিমন্ত্রণ হত–হিন্দু-মুসলমান কেউ বাদ যেত না। সেই জন্যই আমি মুর্তজাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই অষ্টমীর দিন সারা রাত থাকবি তো? মাঝ রাত্তিরে আরতি হবে, খুব মজা হবে।
মুর্তজা বলেছিল, আমি তো যাব না। বাবা বলেছেন, হিন্দুদের পুজোয় আমাদের যেতে নেই।
আমি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলাম, কেন?
তোরা তো পুতুল পুজো করিস। আমাদের ও-সবে যোগ দিতে নেই।
আমি বলেছিলাম, পুতুল নয়। অনেক বড় বড়। মা দুর্গা তো মস্ত বড়। পুতুল তো পুজো করে ছোট মেয়েরা।
মুর্তজা বলল, তোদের ঠাকুরঘরে যে কেষ্টঠাকুরের পুতুল থাকে, সেটা কত বড়।
এই ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখিনি এবং আগেই একটা ভুল যুক্তি দিয়ে ফেলেছি বলে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই। কিন্তু মুর্তজার কাছে হার স্বীকার করব কেন? চোখ গোল গোল করে ওকে ভয় দেখিয়ে বললাম, কেষ্টঠাকুরকে কখনও পুতুল বলতে নেই। তা হলে ঠাকুর তোকে পাপ দেবে।
মুর্তজা বলল, তোদের ঠাকুর আমাকে পাপ দিতে পারবে না। আমাদের খোদাতাল্লা আছেন। খোদাতাল্লা অনেক বড়।
তোদের খোদাতাল্লাকে দেখতে কী রকম?
মুর্তজা বড়দের মতন গলার আওয়াজ করে বলল, আল্লা সর্বশক্তিমান এবং নিরাকার। আল্লার কোনও বর্ণনা হয় না।
আমি বললাম, যা, যা, কৃষ্ণ সুদর্শনচক্র দিয়ে সবাইকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে, তা জানিস?
তারপর আমরা দুই খুদে ফ্যানাটিক ঝগড়া শুরু করে দিলুম। ঝগড়া আর একটু হলে মারামারিতেও গড়াতে পারত। মুর্তজাদের বাড়িতে রীতিমতন ধর্মশিক্ষা আছে, আমাদের বাড়িতে সেসব কোনও পাট নেই। আমি শুধু রামায়ণ-মহাভারতের গল্প জানি এবং কিছু দিন আগেই পইতে হবার জন্য নিজেকে ব্রাহ্মণ ভেবে বেশ গর্ব অনুভব করি। আমি মুর্তজাদের ধর্ম কিংবা আল্লা সম্পর্কে কিছুই জানি না, কিন্তু মুর্তজা হিন্দুদের ধর্ম সম্পর্কে অনেক খবর রাখে–সুতরাং সে বেশ যুক্তি ও তুলনা দিয়ে কথা বলতে পারে–আমার সে-সুযোগ ছিল না বলেই আমি চাচাতে লাগলুম। এক ধরনের অভিমানে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি চলে আসবার আগে ওকে বললুম, তুই তোদের আল্লার পুজোয় আমাকে কখনও নেমন্তন্ন করেছিস? আমি দুর্গা ঠাকুরের পুজোয় তোকে নেমন্তন্ন করলুম, আর তুই আমাকে এ রকম বললি?
মুর্তজা তখন ছুটে এসে আমার পিঠে হাত দিয়ে ভাব করতে গেল, আমি তবু কথা না বলে চলে এলাম।
এটা একটা সামান্য ছেলেমানুষি ব্যাপার। কিন্তু খালধারে দুই বালকের সেই অনর্থক ঝগড়ার দৃশ্য যে-কোনও কারণেই হোক আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। পরে ওই ঘটনা মনে করে অনেক হেসেছি।
দ্বিতীয় স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটেছিল আমার সেজোমামার জন্য। আমার এই মামাকে আমি আগে কখনও দেখেছি কিনা মনে পড়ে না, এইবারই ভালো করে চিনলাম। সেজোমামাকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। লম্বা ছিপছিপে চেহারা, গায়ের রংটি মাজা মাজা, সদ্য ঢাকা থেকে ডাক্তারি পাস করেছেন। আমরা তাঁকে অতীনমামা বলে ডাকতাম–মানুষটি খুব আমুদে, সব সময় হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে থাকতেন। অতীনমামা যখন যেখানে থাকতেন, সেখানেই একটা আনন্দের হাওয়া বয়ে যেত।
এই অতীনমামা পুজোর ঠিক দুদিন আগে জলধরকে একটা ছবি দেখিয়ে বললেন, জলধর, তুমি এই ছবি দেখে ঠিক এ রকম মূর্তি বানাতে পারো?
জলধর মাথা নেড়ে বলল, এ আর কঠিন কী!
তারপর অতীনমামার সঙ্গে জলধরের আর কী কী কথা হয়েছিল আমরা জানি না। তখনই ঠাকুরদালানের চার পাশ ঘিরে দেওয়া হল কাপড় দিয়ে। সেখানে আমাদের প্রবেশ নিষেধ হয়ে গেল।
ষষ্ঠীপুজোর দিন যখন পরদা উঠল, ঠাকুরের মূর্তি দেখে আমরা সবাই অবাক। অনেক কিছুই বদলে গেছে।
আর সবই ঠিক আছে, রাংতাজরির ডাকের সাজ রয়েছে, কলকা বসানো বিশাল চালচিত্র পেছনে, সরস্বতী হংসবাহিনী–তাঁর রং দুধেআলতা, লক্ষ্মীর রং কাঁচা হলুদ, লাল রঙের পেটমোটা গণেশ, দুর্গার মুখও জলধরের নিজস্ব–কিন্তু কার্তিক নেই– সেখানে সুভাষ বসু দাঁড়িয়ে। সুভাষ বসুর মূর্তির গায়ে পুরোপুরি সামরিক পোশাক– দেবসেনাপতির যোগ্য তার বীরত্বব্যঞ্জক ললাট ও চক্ষু, শুধু গোল চশমাটা একটু কেমন কেমন দেখায়। আর নীল রঙা অসুরের বদলে সেখানে রয়েছে একজন ইংরেজ মিলিটারি–সে সিংহের দিকে বেয়োনেট উঁচিয়ে আছে, আর মা দুর্গা সেই মিলিটারির বুকে বর্শা বিধিয়ে দিয়েছেন। খবর পেয়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে লোক আসতে। লাগল সেই মূর্তি দেখবার জন্য।
সেই মূর্তি দেখে আমি কী যে অভিভূত হয়েছিলুম, তা বলে বোঝানো যাবে না। যতক্ষণ তাকিয়ে থাকি, আশ মেটে না। আমি যেখানেই দাঁড়াই, মনে হয় মা দুর্গা আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
রাত্তিরবেলা অনেকক্ষণ ধরে ঠাকুর সাজানো হল। আমি মায়ের ডাক উপেক্ষা করে সেখানে বসে রইলাম। আমার একটুও ঘুম আসেনি। শেষে, বড়রা যখন খেতে গেল, তখন আমাকে শুতে যেতেই হল।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই মনে হল, ঠাকুরদালানে এখনও ঠাকুর সাজানো হচ্ছে। টুপ করে বিছানা থেকে নেমে আমি এক ছুটে চলে গেলাম সেখানে।
গিয়ে দেখি, দু’-তিনটে হ্যাঁজাক আর পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে কিন্তু কোনও লোক নেই। ঠাকুরদালানে আমি একা বাইরে গভীর রাত ঝিমঝিম করছে। আমার ভয় করল না, ভীষণ ভালো লাগল। আমি সব ঠাকুরের পায়ে হাত বুলোতে লাগলাম, অন্য সময় আমাকে এই সুযোগ কেউ দেবে না।
আমি সরস্বতী ঠাকুরের পায়ে হাত দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ আমার মনে হল, মূর্তির যেন চোখের পলক পড়ল। বুক কেঁপে উঠল আমার। এ কি সত্যি? শুনেছি এ রকম সত্যিই হয়। অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইলাম সেই মূর্তির দিকে, না, আর পলক পড়েনি। তবে, সেই সরস্বতীর মুখ আমি ভুলিনি, বুকের মধ্যে ছাপ পড়ে গিয়েছিল, বহুকাল পরে সেই মুখ আমি আবার দেখতে পেয়েছিলাম।
ষষ্ঠী পেরিয়ে সপ্তমী এসেছে। গ্রামের মেয়েরা কেউ তখনও ফ্রক পরে না–সকলেই শাড়ি পরা এক একটি খুদে গিন্নি। ছোট ছেলেরা পরে ইজেরের ওপর পাঞ্জাবি আর পায়ে পাম্পশু। আমি কলকাতার ছেলে, আমার কথাই আলাদা। আমি তো ঘটি হয়ে গেছি। আমি ‘আইছি’ ‘খাইছি’ ‘দেখছি’র বদলে তখন এয়েচি, খেয়েচি, দেখেচি, বলি, আমার পোশাকও আলাদা–আমার বেল্ট লাগানো হাফপ্যান্ট, আর চেন বসানো সিল্কের গেঞ্জি আর নটিবয় বুটজুতো। কলকাতা থেকে আনা সাদা লম্বা লম্বা এক রকম লজেন্স তখনও কয়েকটা আমার কাছে ছিল, তার একটা দু আঙুলে ধরে মুখে দিয়ে আমি সমবয়সিদের। বললাম, এই দেখ, আমি সিগ্রেট খাচ্ছি, মেজোমামার মতন। হু-স! সবাই অবাক, শুধু আমার মাসতুতো বোন পান্তি বলল, দাঁড়াও না, দাদামশাইকে বলে দেব। তুমি অঞ্জলি দেবার আগেই খেয়েছ!
আমি ভয় পেয়ে রাগ দেখিয়ে বললাম, ইল্লি! খেয়েছি নাকি! শুধু তো মুখে দিয়েছি।
দালান থেকে ভোগের থালা লাইন করে আসতে লাগল। পুরুতমশাই এক হাতে আরতির ঘণ্টা অন্য হাতে পঞ্চপ্রদীপ–দু হাত একসঙ্গে নাড়াতে লাগলেন, শুরু হল ঢাকের বাজনা। তিন জন ঢাকি, দু’জন ঢুলি, দু’খানা কাসি, ঢাকের আওয়াজ বলছে, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ? ঠাকুর যাবে বিসর্জন? আর কাসি বলছে, তাই দেখ না, তাই দেখ না! অমূল্য ঢাকির নাম সারা তল্লাট জুড়ে, পালকের ফুল বসানো বিচিত্রিত জয়োক নিয়ে সে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, সেই তালে তালে দুলছে আমাদের শরীর। কঁসি যে দু’জন বাজাচ্ছে, ওদের মধ্যে একজনের নাম দুলাইল্যা, ও নাকের ওপর মস্ত বড় আগুন জ্বালা ধুনুচি নিয়ে আরতির সময় দারুণ নাচ নামতে পারে।
দুই ব্যাচে খাওয়ানো হয়–দাদামশায়ের হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের জন্য আলাদা আলাদা ব্যাচ। মুর্তজা না এলেও অনেক মুসলমানই উৎসবে যোগ দিতে এসেছে।
জন পনেরো লোক পরিবেশন করছে আঁকা ঝকা লুচি আসছে আর উড়ে যাচ্ছে। ও এনাতালি, তোমাকে আর একখানা অমৃতি দিই? ও আইনন্দি, তুমি গতবার ছ’ গন্ডা রসগোল্লা খেয়েছিলে, এবার মাত্র সাড়ে চার গন্ডা খেয়েই কাত? ভৈরব কাকা, আপনি নাকি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন? এবার থেকে তা হলে বাঘেও আর মানুষ খাবে না। হা-হা-হা-হা। এই রকম সব কোলাহল।
প্রতিবেশী জমিদার ইমানুল্লা দাদামশায়ের পাশে মখমল মোড়া চেয়ারে বসে আছেন। জঁদরেল ভঙ্গিতে। গড়গড়ায় টান দিয়ে তিনি বললেন, এবার যা পিরতিমা বানাইছেন, সব মাইনষে ধন্য ধন্য করতাছে।
দাদামশাই মৃদু হাস্যে শুধু বললেন, পোলাপানগো খেয়াল!
ইমানুল্লা সাহেব আবার বললেন, এ তো দুর্গাঠাকুর নয়, এ তো ভারতমাতা। জলধররে বেশি কইরা ইনাম দিয়া দেবেন।
এমন সময় একটা শোরগোল উঠল। কিছু লোকের ছুটোছুটি। পুকুরঘাটে নৌকো থেকে উঠে এল আট-দশ জন লালপাগড়ি পুলিশ আর মহকুমার পুলিশ বড়বাবু বিপিন চৌধুরী। গট গট করে তিনি এগিয়ে এসে বললেন, বড়কর্তা, এসব কী? আপনার মতন একজন মানী লোক এই কাণ্ড করবেন, এ রকম শান্তিপূর্ণ গ্রামে?
কারোকে দেখে বিচলিত হবার লোক নন দাদামশাই। তার মনের ভাব মুখ দেখে। কিছুতেই বোঝা যাবে না। তিনি নিরুত্তাপ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে কী?
বিপিন চৌধুরী বললেন, পেছনের নৌকোয় হারবিনজার সাহেব নিজে আসছেন। আজ সকালেই ওঁর কাছে রিপোর্ট গেছে।
দাদামশাই বললেন, তা কী হবে?
এক্ষুনি এ পুজো বন্ধ করে দিন।
কী?
দাদামশাই ছোটখাটো মানুষ, কিন্তু তার গলায় তেজ আছে। এমন কঠিন ভাবে তিনি কী’ কথাটা উচ্চারণ করলেন যে, সবাই এক নিমেষের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।
বিপিন চৌধুরী দমলেন না। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আপনার ভালোর জন্যই বলছি।
আমার ভালোর কথা, তোমাকে ভাবতে হবে না। আসল কথাটা কী বলো।
এ-প্রতিমা পুজো বন্ধ রাখতে হবে। গভর্নমেন্টের হুকুম।
পুজোআচ্চাও কি এখন থেকে গভর্নমেন্টের হুকুমে চলবে নাকি?
এ-প্রতিমা এক্ষুনি বিসর্জন দিয়ে দিন। ঘট পুজো করুন।
ইমানুল্লা মাঝখানে এসে বললেন, আপনে কন কী চৌধুরী সাহেব। নিজে হিন্দু হইয়া আপনি হিন্দুর পূজা বন্ধ করতে চান। দোষটা হইছে কী?
চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে দোষ বুঝবেন? অসুরকে করেছেন ব্রিটিশ সৈন্য, এই যুদ্ধের সময়–আর সুভাষ বোস একজন রাজদ্রোহী, এ ট্রেইটার…এ-বাড়ির সবকটা। পুরুষমানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার পরোয়ানা আছে।
দাদামশাই জিজ্ঞেস করলেন, আমাকেও?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে। তাও না হয় যাব। আগে পুজো শেষ হোক। বিজয়া দশমীর পর এসো।
হারবিনজার সাহেব একটু বাদেই এসে পড়বেন।
আসুক তা হলে সাহেব।
এক ঘণ্টার মধ্যেই হারবিনজার সাহেব এসে পৌঁছোলেন। তাঁর চোখদুটি নীল, মাথার চুলগুলো সম্পূর্ণ সোনালি–দেখলে যেন মানুষ বলে মনে হয় না।
এক ব্যাচের তখন অর্ধেক খাওয়া হয়েছে, সাহেব দেখে অনেকেই উঠে দাঁড়াল। ছোটরা পালিয়ে গেল ভয় পেয়ে। শুধু আমি, কলকাতা-ফেরত, অনেক সাহেব দেখেছি কিনা–তাই একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সাহেব ঘুরে ঘুরে দেখলেন সবকিছু। হাতের ছড়িটা ঘঘারাতে লাগলেন আলগা ভাবে। কত দূরে এই সাহেবটির দেশ, এখানে এই এক অচেনা পাড়াগাঁয়েও কত স্বাভাবিক ভাবে ঘুরতে পারেন। তার কারণ কি তার কোমরে গোঁজা পিস্তলটি?
ঢাকি-টুলিরা বাজনা বন্ধ করে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে। ধূপধুনোর গন্ধে আচ্ছন্ন থমথমে পূজামণ্ডপ। সব দেখে শুনে সাহেব বললেন…..
সাহেব কী বললেন, সে বয়সে আমরা ঠিক বুঝিনি। পরে মামাদের মুখে শুনেছিলুম, সাহেব হাসতে হাসতে বিপিন চৌধুরীকে বলেছিলেন, তুমি তো সব সময়েই ঘাসের মধ্যে সাপ দেখো। আমি তো এখানে সিডিশাস কিছু দেখতে পাচ্ছি না। শখ করে মূর্তি বানিয়েছে–কোনও ইনস্টিগেশন নেই। আমি তো রিপোর্ট পেয়েছিলুম ওইখানে গ্যান্ডি আর বোসের স্পিচ রিসাইট করা হচ্ছে!না, না, এ রকম সুন্দর আবহাওয়া নষ্ট করা উচিত নয়। সব চলুক। আঃ, কী সুন্দর গন্ধ এখানে।
সাহেব আরও বলেছিলেন, ড্রাম বিটিং শুনতে তার ভালো লাগে। ঢাকের বাজনা থামল কেন? ইঙ্গিত পেয়ে অমূল্য ঢাকি আর তার দলবল দ্বিগুণ উৎসাহে লাফিয়ে লাফিয়ে বাজনা শুরু করল, কাসির আওয়াজ ক্যান ক্যান সুরে বলতে লাগল, তাই দেখো, তাই দেখো না! সবাই ইংরেজ সরকারের মহানুভবতার জন্য ধন্য ধন্য করতে লাগল।
বড়দিদিমা একটা থালায় সব রকম প্রসাদ সাজিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, যা সাহেবকে দিয়ে আয়।
সাহেব আমার দিকে মৃদু হাস্য করে আগ্রহের সঙ্গে থালাটি নিলেন। আমি লক্ষ করলুম সাহেবরা একদম খেতে জানে না। শাঁকালু আর কলাও পায়েসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছে।
সেবার বিজয়া দশমীর দু’দিন বাদেই বড়বাবুর কাছ থেকে এক চিঠিতে জানতে পারলাম, সূর্যদা খড়গপুর রেল স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।