৪৫. ভোর বেলা ট্রেন

ভোর বেলা ট্রেন! সকাল-সকাল উঠতে হবে। ছোট টিনের বাক্সটা গুছিয়ে রেখেছে ভূতনাথ। বৌঠানের দেওয়া কাপড়জামা সব। বাক্সটা পরিষ্কার করতে গিয়ে ননীলালের সেই পুরোনো চিঠিটা তলায় এক কোণে পড়ে রয়েছে দেখলে। আশ্চর্য। সেই ননীলালই-বা কোথায় আজ! ধাপে-ধাপে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। নিজের দেশ, সমাজ ছেড়ে, স্ত্রী, আত্মীয়, স্বজন পরিত্যাগ করে কত দূরে গিয়ে রইল। কিন্তু কীসের আকর্ষণে? প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর হতে পেরেছে কি শেষ পর্যন্ত। দ্বারকানাথ যেমন নীল আর রেশমের কুঠি করেছিলেন, ননীলাল কি তেমনি পাট আর কয়লার সঙ্গে জীবনকে জড়িয়ে দিয়েছিল? আর তারপর? তারপরের পথ কি ননীলালের জানা আছে? ননীলালই বলেছিল—এ যুগের খৃস্ট, চৈতন্য আর বুদ্ধ হচ্ছে শেঠ, শীল আর মল্লিক। ভূতনাথ ভাবতে চেষ্টা করে—ননীলাল কি তার ইষ্টদেবতার সন্ধান আজ পেয়েছে? সে তো মেম সাহেবদের রূপের মোহে ভোলবার ছেলে নয়! সে তো বলেছিল একবার—মেয়েমানুষের নেশা এখন কেটে গিয়েছে ভাই, ও যে-বিন্দি, সে-ই মিসেস গ্রিয়ারসন—এখন কেবল চাই টাকা! টাকার নেশা কি তার মিটেছে! সে কি তৃপ্তি পেয়েছে? শান্তি পেয়েছে?

আবার মনে হয় হঠাৎ যেন জবা এসে ঘরে ঢুকেছে। ঘরে ঢোকবার সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত ঘরখানা যেন গন্ধে ভরে গেল। মাঘোৎসবের দিন যেমন করে সাজতে জবার তেমনি সাজ। শুধু মাথায় ঘোমটা, সিঁথিতে সিঁদুর। এইটুকু কেবল তফাৎ। দরজায় খিল লাগিয়ে দিয়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো। হাতে এক গেলাশ জল।

জবা বলে—আমায় ক্ষমা করো তুমি।

ভূতনাথ বললে—আমিই কি জানতাম?

—ছি, ছি, আমায় কিন্তু ক্ষমা করো তুমি।

ভূতনাথ বললে—কেন, তুমি আমার সংসারে এলে?

জবা বললে—সে উত্তর তো দিয়েছি আমি।

–শুধু সংস্কার, শুধু দুটো মন্ত্র আর একটা ষড়যন্ত্রের জন্যেই তোমার দুর্ভোগ, নইলে তোমার জীবন তত অন্য রকম হতো—তাতে তুমি সত্যিকারের সুখী হতে হয় তো।

জবা বলে-বার-বার তুমি কেন একথা বলো?

ভূতনাথ বলে—সত্যি বলছে জবা?

-সত্যি না তো কি মিথ্যে? মিথ্যে তো বলি না আমি, তুমি আমায় বিশ্বাস করে, কোনো দুঃখ নেই আমার।

-কিন্তু এ-কথা তোমায় কে বলতে শেখালে জবা?

-এ-কথা আমি জ্ঞান হওয়া থেকেই শিখে এসেছি যে, ঠাকুমা’র সঙ্গে কত শিব পূজো, কত ব্ৰত করেছি, কত ঠাকুর প্রণাম করেছি, ঠাকুমা যে আমায় সব শেখাতো।

–কিন্তু সুপবিত্র, তাকে ভুলতে পারবে তো?

সঙ্গে-সঙ্গে জবার হাত থেকে জলের গেলাশটা ঝনাৎ করে মাটিতে পড়ে ছত্রখান হয়ে গেল। সে-শব্দে ভূতনাথেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। চোরকুঠুরির মধ্যে চোখ মেলে ভূতনাথ দেখে সে একলা অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে। কেউ কোথাও নেই। শেষ রাতের নিস্তব্ধ কলকাতা শহর। রাস্তায় কয়েকটা ঠেলাগাড়ি চলার শব্দ শুধু। আর রাস্তায় বুঝি জল দেওয়া হচ্ছে। দু একজন বুঝি জাগছে। ওপাশে অনেক দূর থেকে গঙ্গার বুকের ওপর একটা জাহাজের বাঁশী বেজে উঠলো। হয় তো জাহাজের বাঁশী নয়, জুটমিলের। কারখানা হয়েছে অনেক ওদিকে। হয় তত বা ননীলালেরই জুটমিল। কে জানে।

সমস্ত স্বপ্নটা আবার পুরোপুরি ভেবে দেখতে লাগলো ভূতনাথ সত্যি এ কেমন করে হয়। ভূতনাথেরই মনগড়া কথাগুলো জবার মুখ দিয়ে যেন বলিয়ে নিয়েছে সে। কিন্তু আশ্চর্য কথা আট-ন’ বছর পর্যন্ত জবা ছিল বলরামপুরে, তার মধ্যে একবার জানতেও পারলো না!

সুবিনয়বাবুকে জবার ঠাকুমা পরে আর একটা চিঠিতে লিখেছেন —“তোমাকে লুকাইয়া এ চিঠি লিখিতেছি, উনি জানিতে পারিলে অনর্থ বাধাইবেন। কিন্তু এখানে কাহাকেও জানানো হয় নাই। কেবল পাত্র পক্ষ জানে আর পুরোহিত মশাই জানেন। জানি না জবার কপালে কত দুঃখ আছে। উনি সদা-সর্বদা জবাকে চোখেচোখে রাখেন, বাড়ির বাহিরে যাইতে দেন না, পাছে তুমি বা তোমার লোক হরণ করিয়া লইয়া যাও। জবার শ্বশুরবাড়ি লোকেরা আর একদিনও আসে নাই, নিতান্ত অনিচ্ছার বিবাহ বলিয়া তাহারাও আর খোঁজ করেন না। আমরা লোক পাঠাঁইয়াছিলাম,কিন্তু শুনিলাম পাত্রের পিতার মৃত্যু হইয়াছে—বাড়িতে শুধু একমাত্র পিসীমা আছে”।

পরে আর একটা চিঠিতে লিখেছেন-“বাবা, তোমার পত্র পাইলাম, অনেকদিন সংবাদ না পাইয়া বড় মনোকষ্টে ছিলাম, আমার কপালে অনেক দুঃখ ছিল তাই তোমার মতন সন্তান পাইয়াও নিকটে থাকিতে পারি না, জবা ভালো আছে, জবার শরীর ভালো আছে—জবাকে আশীর্বাদ করিতেছি সে সুখী হইবে। মায়ের ইচ্ছায় যাহা হইয়াছে, তাহার তো আর নড়চড় নাই—সুতরাং সকলই তাহার ইচ্ছা বলিয়া জানিবা…”

এই রকম অনেকগুলো চিঠি লিখেছেন সুবিনয়বাবুর মা। নিজে লিখতে জানতেন না তাই গোপনে পাড়ার কোনো লোককে দিয়ে লিখিয়েছেন। আর সুবিনয়বাবু সমস্ত চিঠিগুলো সযত্নে রক্ষা করে এসেছেন আজ পর্যন্ত।

আর একটা চিঠিতে একবার ঠাকুমা লিখেছিলেন—“শুনিলাম পাত্র পক্ষ সংবাদ পাইয়াছে জবা আমার নাতনী হইলেও, হিন্দু-কন্যা নহে। এই সংবাদ লোকমুখে পাইবার পর তাঁহারা বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়াছেন, তাহারা বলিতেছেন আমরা ঠকাইয়া জবার সহিত হিন্দু পাত্রের বিবাহ দিয়াছি…শুনিতেছি তাহারা নাকি আবার পুত্রের বিবাহ দিবেন…শুনিয়া অবধি মন খারাপ হইয়া আছে, কিছুই ভালো-মন্দ বুঝিতে পারিতেছি না। এখন মায়ের ইচ্ছার উপরই সমস্ত নির্ভর করিতেছে, আমরা অবোধ মনুষ্য মাত্র, মায়ের লীলা বুঝিবার শক্তি আমাদের নাই—অহরহ মাকে ডাকিতেছি, এখন মা যা করেন।”

ভোরবেলা ট্রেন। সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠেই রওনা দিয়েছে ভূতনাথ।

বংশী বলেছিল—কবে আসছেন আবার?

ভূতনাথ বলেছিল—কাল, নয় তো পরশু ঠিক।

তা শেয়ালদ’ স্টেশনে যখন পৌচেছে ভূতনাথ তখন বেশ সকাল। ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে। ধীরে-সুস্থে টিকিট কেটে ট্রেনে গিয়ে বসার সময় আছে। চারদিকে ঝাঁট দেওয়া চলেছে। ট্রেনে গিয়ে পৌঁছুবে মাঝদে’তে সেই বিকেল নাগাদ। তারপর ফতেপুর। সোজা হাঁটা রাস্তা। মাঝখানে শুধু ইছামতি নদী পার হওয়া। তা নদীতে খেয়া আছে। গ্রামে পৌঁছুতে সেই যার নাম রাত। সন্ধ্যে হতে-না-হতে নিশুতি হয়ে যাবে সব।

বড় জোর বারোয়ারিতলায় নিতাই ঘোষের দোকানে টিম-টিম করে রেড়ির তেলের দেয়াল গিরিটা তখনও জ্বলছে। রাস্তায় অত রাতে পায়ের শব্দ পেয়েই নিতাই হয় তো চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে

-কেনা যায় গো?

—আমি নিতাই, আমি—বলবে ভূতনাথ।

—আমি কেডা, বাড়ি কনে?

–ওরে, আমি ভূতো।

–ওমা, ভূতোদা’—কী সর্বনাশ কবে ফিরলে?

নন্দজ্যাঠাও খুব অবাক হয়ে যাবে বৈকি! উঠোনের ধারে সেই আতাগাছটার ধারে গিয়ে ডাকবে—জ্যাঠাইমা-–ও জ্যাঠাইমা–

নন্দজ্যাঠা হয় তো তখন অকাতরে ঘুমোচ্ছ আট চালায়। জ্যাঠাইমা অত সকালে শোয় না। তখনও হয় তো কথা সেলাই করছে, নয় তো সলতে পাকাচ্ছে পিদিমের। ডাক শুনে সেখান থেকেই বলবে—কে ডাকে গাকে তুমি?

-আমি ভূতত, জ্যাঠাইমা।

-ওমা, ভূতো, কোত্থেকে—বলেই মরি-বাঁচি করে ছুটে আসবে, পিদিমটা হাতে নিয়ে। বলবে—ওমা, দেখোদিকি, একটা খপর দিতে হয় তো। আয়-পা ধো এখেনে, এই জলচৌকিতে বোস, ঘটিতে জল আছে। থাক-থাক, হয়েছে, ভালো আছিস তো?

জ্যাঠাইমা’র পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকাবে ভূতনাথ। তারপর জিজ্ঞেস করবে-জ্যাঠা কোথায়? ঘুমুচ্ছে বুঝি?

হাত পা মুখ ধুয়ে, ভূতনাথ বসবে বোয়াকে। ওই বাঁধানো বোয়াকে বসেই কতদিন রাধার সঙ্গে গল্প হয়েছে ছোটবেলায়। কতদিন গল্প করতে-করতে রোয়াকের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শেষে জ্যাঠাইমা এসে ডেকে দিয়েছে।-ওরে ভূতো, তোর পিসী ডাকছে, ঘরে গিয়ে শুগে যা।

সে কতকাল আগের কথা। সমস্ত গ্রামটা যেন চোখের ওপর ছবির মতন ভেসে ওঠে। গাঙে যাবাঃ পথে বটগাছের বুরি ধরে কতদিন দোল খেয়েছে ভূতনাথ। আম কুড়িয়েছে কত বাদলের রাতে। কত যে আম! ধামা ধামা। কাঁচা আমগুলো মাটিতে পড়ে ফেটে চৌ-চাকলা হয়ে যেত। সে-আম পাতা পেতে তক্তপোশের তলায় সাজিয়ে রাখতে পিসীমা। বলতো-বোটাঅলা আমগুলো আমায় দে—দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

রাত্তির বেলায় বাঁশঝাড়ের সেই মড়মড় শব্দ। চারদিক নিস্তব্ধ, কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ মড়মড়মড় শব্দে একটা বাঁশ দুলে উঠলো আগাপাশতলা। পিসীমা বলতো-ও ভূতের বাঁশ–বাঁশে ভর দিয়ে ভূত মাটিতে নামলো।

সন্ধ্যেবেলা রান্নাঘরের দিকে যেতে কী যে ছমছম করতে গা’টা। কিন্তু সকাল বেলা আবার যে-কে সেই। মধু কেরষাণ গরু-বাছুর চরাতে তারই তলা দিয়ে মাঠে চলেছে। হাতে লাঠি। সেই রকম একটা তেলালো লাঠির জন্যে কত খোশামোদ করেছে মধু কেরণকে। অথচ কত সামান্য জিনিষ!

পিসীমা বলতো—তোর যখন বিয়ে হবে, তখন ওই রকম লাঠি গড়িয়ে দেবো।

বিয়ের সঙ্গে লাঠির যে কী সম্বন্ধ তা ভূতনাথ বুঝতে পারতো না। পিসীমা বলত—তোর শ্বশুর তো ওমনি-ওমনি খেতে দেবে, কাজ করতে হবে, হয় তো গরু চরাতে বলবে—তখন? তখন লাঠি কোথায় পাবি?

শুনে যেন কেমন ভয় হতে মনের ভেতর। দুর-দুর করতে বুক। ভূতনাথ বলতো—তবে আমি বিয়ে করবো না পিসীমা।

পিসীমা বলতে—বিয়ে করবি না তো ভাত বেঁধে দেবে কে? আমি তো মরে যাবো একদিন।

পিসীমা মরে যাবে শুনলেই কেমন যেন ভয় করতো। বেজিটা কেমন করে মরে গিয়েছে তা তখনও মনে আছে ভূতনাথের। চোখে জল আসতো। হঠাৎ পিসীমার কোলের ভেতর মুখ লুকিয়ে ফেলতে ভূতনাথ।

পিসীমার তখন সান্ত্বনা দেবার পালা। মাথায় হাত বুলোতে বুলোত বলতো—আচ্ছা, আচ্ছা, বিয়ে দেবো না তোর, হলো তো!

নন্দজ্যাঠা মাসের মধ্যে অর্ধেক দিন বাইরে-বাইরে ঘোরে। বলা-কওয়া নেই, হঠাৎ একদিন হয় তো মুটের মাথায় মাল-পত্তোর নিয়ে বাড়ি এসে হাজির। কাঁঠাল দুটো, এক বোরা নারকোল, এক বাণ্ডিল ঝাটার কাঠি, কেষ্টগঞ্জের কদমা, ভাজা মুগের ডাল, কেরোসিন তেল। বলত—ছেলেমেয়েরা সব দূরে সরে যাও কেরোসিন তেল আছে ওতে।

কেরোসিন তেল-এর নামে তখন কী ভয়ই যে ছিল। মনে হতো হাতে লাগলেই বুঝি হাত জ্বলে-পুড়ে যাবে।

কিন্তু মাল-পত্তার খোলা হলে জ্যাঠা বলতে—ভূতোর আর রাধার হাতে দুটো করে কদমা দিও তো?

নন্দজ্যাঠা বলতে—তোর বাবা কদমা খেতে ভালোবাসতে খুব। তা সেবার ছিন্নাথপুরে গাজনের মেলায় গিয়ে বললে— দাদা, কদম খেতে হবে আমার তখন কাজ পড়ে রয়েছে, সতীশেরও কাজ, কিন্তু খিদে পেলে কাজের কথা খেয়াল থাকতো না। সতীশ বললে-রেলবাজারের সাদা চিড়ে, মামারাকপুরের দই, কলের চিনি, কেষ্ট ময়রার কাঁচাগোল্লা আর কেষ্টগঞ্জের কদমা দিয়ে ফলার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে দাদা..হা রে, বাপকে তোর মনে পড়ে অতুল?

ভূতনাথের কিছুই মনে পড়ে না।

নন্দজ্যাঠা বলে—সেই, মনে নেই, তোকে সঙ্গে নিয়ে টুঙিতে গিয়ে কী হয়রানি? রাত্তির বেলা বিছানার মধ্যে সাপ, সাপের

গুষ্টি—তুই অঘোরে ঘুমোচ্ছিস—আর ওদিকে…

খানিক থেমে নন্দজ্যাঠা আবার বলে—তবে ধন্যি ছেলে বটে তুই, পাঁচ-ছ’ বছরের ছেলে—কি হাঁটাটাই হাঁটতে পারতিস! তোর বাবা বলতো—ওকে বড় হলে ডাক-পিওন করে দেবো দাদা।

শেয়ালদ’ স্টেশনের কল-কোলাহল বাড়ছে। ওদিক থেকে কয়েকটা ট্রেন হুশ-হুশ করে আসে। আর গিজগিজ করে লোক নামে।

একজনকে জিজ্ঞেস করলে—আর কত দেরি মশাই পোড়াদ’র ট্রেনের?

নন্দজ্যাঠাই ঠিক লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলেই সব জানা যাবে। বাবার সঙ্গে নন্দজ্যাঠাও ঘুরতে গ্রামে-গ্রামে। নন্দজ্যাঠা ছিল বাবুদের নায়ের, আর বাবা ছিল গোমস্তা। জমিদারীর কাজে অনেক জায়গায় কাছারি করেছে। আদায়-পত্তোর করতে, মামলা-মোকদ্দমার তদ্বির করতে নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। আর মা-মরা ছেলেটাকে কোনো কোনো বার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে বিশেষ পীড়াপীড়িতে।

হঠাৎ পেছন থেকে যেন কে ডাকলে—ঠাকুরমশাই?

-আরে, প্রকাশ? কোত্থেকে ফিরছো? ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে।

প্রকাশ বললে—এই তত ফিরে এলাম ফতেপুর থেকে আজ্ঞে। গিয়ে শুনি পাত্তোরের দাদামশাই আবার এখানে এসেছে, আর ওদিকে আমি ওখানে গিয়ে হাজির। এখন মিছিমিছি দুনন খরচ…তা আপনি যাচ্ছেন কোথায়?

-দেশে।

—দেশে! তা সন্ধ্যেবেলার গাড়িতে চলুন না কেন, একসঙ্গে আবার যাবো, পাত্তোরের দাদামশাইও যাবে আমার সঙ্গে, আপনাদের গাঁয়েরই লোক, আহা, ভারী ভদ্দরলোক, মাটির মানুষটি। আমি মেয়ের মাকেও তাই বলেছি—এমন দাদাশ্বশুর কারো হয় না, বৌমাকে আদর-আত্তি করতে—মাথায় তুলে রাখবে একেবারে …

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আমাদেরই গায়ের লোক? নামটা কী বলো তো?

—নন্দ চক্কোত্তি।

—নন্দজ্যাঠা?

প্রকাশ বললে—তা হবে, শুনলাম বাবুদের খালের ধারের পাটের আড়তে উঠেছে, চেনেন নাকি?

ভূতনাথ বললে—খুব চিনি, তার সঙ্গে দেখা করতেই তো যাচ্ছিলাম দেশে, বিশেষ জরুরী দরকার ছিল একটা।

—তা বেশ তো, চলুন—আমিও যাচ্ছি।

এমন অনায়াসে যে সমস্ত ঘটনার নিষ্পত্তি হতে পারে ভাবা যায়নি। নন্দজ্যাঠা নিশ্চয়ই জানেন। বাবার অত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নন্দজ্যাঠাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করতেন না বাবা।

ভূতনাথ বললে—তাহলে তাই চলো—আমারও খরচা বেঁচে গেল—সময় বেঁচে গেল।

প্রকাশ বললে—ভালোই হলো ঠাকুরমশাই, তাহলে একসঙ্গে সন্ধ্যেবেলার ট্রেনে সবাই মিলে যাওয়া যাবে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেন-জ্যাঠার কার বিয়ে?

—ওঁর নাতির, বিধবা যে এক মেয়ে আছে, তারই ছেলে—তা জামাই দেখে চোখ ফেরাতে পারবে না। কনের বাড়ির লোক—তা আমি আগেই বলে রেখেছি ওদের।

 

আজো মনে আছে ভূতনাথের। সেদিন নন্দজ্যাঠাকে দেখে ভূতনাথ যতখানি অবাক হয়েছিল, ভূতনাথকে দেখে নন্দজ্যাঠাও ঠিক ততখানি অবাক। কিন্তু নন্দজ্যাঠাকে চিনিয়ে না দিলে চেনা যেতো না। সে-চেহারাই নেই আর। বাবুদের পাটের আড়তের একধারে লোকজনদের থাকবার জায়গা। নৌকো থেকে নেমে আড়তে ওঠে পাটের গাঁট। সোজা চালান আসে নদী ধরে-ধরে। এখানে ওজন হয়, বাছাই হয়। তারপর বিক্রি হয় ব্যাপারীদের কাছে।

খালের জলে দেদার নৌকোর ভিড়। এক-এক গাঁট পাট, নামে আর বাবুদের লোক গুণতি করে।

একটা গাঁট নামে আর চিৎকার করে গুণতি হয়—রামে রাম— আবার নামে গাঁট।

—দুই-এ-দুই—

তারপর আড়তের ভেতরে লম্বা গুদাম। সেখানে সামনেই কাঁটায় ফেলে ওজন করে কয়াল। বলে—লেখো, এক মণ সাঁইত্রিশ সের তিন কাঁচ্চা

এক পাশে রান্না চড়িয়েছে একজন লোক। বড়-বড় কই মাছ। আস্ত-আস্ত ভাজছে লোহার কড়ায়। গামছা পরে রান্না করছে।

আর বাঁ হাতে ডাবা হুঁকো। বলে-ও ভূষণ, কাঁচা নঙ্কা দিতি পারে?

ভূষণ বলে—কাঁচা নঙ্কা কোথায় পাবো, এ কি ফতেপুর পেয়েছো, এখানে বাজার থেকে কিনতি হয় সব।

—তবে ঝালও তেমনি হবে, কাঁচা নষ্কা না দিলি কইমাছের ঝাল হয়?

এদিকে যে এত পাটের আড়ত হয়েছে তা ভূতনাথের জানা ছিল না। এই সব পাটই বুঝি ননীলালের কলে গিয়ে উঠবে। তারপর সেখান থেকে জাহাজে ভর্তি হয়ে বিলেত যাবে। কী সব ব্যবসাই হলো! কতরকম ব্যবসাই করছে লোকেরা। আর বড়বাড়ির চৌধুরীবাবুরা কিছুই করলে না। আর যা-ও বা কয়লার ব্যবসায় নামতে গেল, তা-ও টিকলো না। কপালের ফের বৈকি!

প্রকাশকে দেখেই নন্দজ্যাঠা খাপ্পা। বলে—এই তোমার কথার ঠিক, আর ওদিকে…তারপর হঠাৎ ভূতনাথকে দেখেই যেন চিনতে পেরেছে। একেবারে রাতারাতি মুখের ভাব বদলে গেল। অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে দেখতে লাগলো। বললে—আমাদের অতুল না?

ভূতনাথ একেবারে সোজাসুজি পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালে। বললে—আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল জ্যাঠামশাই।

একেবারে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলে নন্দজ্যাঠা। বললে—ওরে অতুল আমার—সেই যে দেশ থেকে গেলি একটা খবর পর্যন্ত দিলিনি। তোদের বাড়িটা জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে, দেখি আর ভাবি সতীশের কত সাধের বাড়ি। আসল সেগুন কাঠ দিয়ে কড়ি-বরগা করেছিল…সেই বাড়ির কাছে ঘেঁষতে আজ গা ছমছম করে।

নন্দজ্যাঠার চোখও বুঝি সজল হয়ে এল।কী করছিস আজকাল? সতীশ বলতো-ডাকপিওন করে দেবো অতুলকে—তা ডাকপিওন হতে পেরেছিস অতুল?

ভূতনাথ মাথা নিচু করে বললে—ওভারসিয়ারী করছি এখন —বিলবাবু ছিলাম, এই ক’দিন হলো ওভারসিয়ার হয়েছি—এক বাঙালীবাবুর আপিসে…

নন্দজ্যাঠা যেন শুনে ভারী খুশি হলো। বললে—যাক, সতীশের ছেলে মানুষ হলো তাহলে। তোর বাপ দেখে যেতে পারলে খুশি হতো—তা হ্যাঁ রে, কত বেতন পাচ্ছিস?

—এই মাস থেকে কুড়ি টাকা হলে আর কি।

—তা বাপু, এইবার গায়ের বাড়িটা সারিয়ে-সুরিয়ে তোল, জঙ্গল সাফ করাও—বিয়ে-থা করে, আমরা বুড়োর যাবার আগে দেখে যাই—তা যাক, তুই তবু গা ছেড়ে বেরিয়েছিলি বলে মানুষ হলি। তারাপদ সেই পাঠশালার পণ্ডিত হয়েছে, আর সব কেউ কিছু করে না, কেবল বিড়ি টানে বসে-বসে বারোয়ারিতলার মাচায়—আর পূজোর সময় একবার করে যাত্রা করে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে জ্যাঠাইমা ভালো আছেন?

—আর ভালো, রোগ-ভোগ হয়ে সে-ফতেপুর আর নেই আমাদের, ম্যালেরিয়া আরম্ভ হয়েছে, ভদ্দরলোকদের আর থাকা চলবে না ওখানে। ক’ঘর বামুন-কায়েত ছিল, মরে-ঝরে এখন কমে আসছে, বামুনকে ভক্তি নেই—ছোটলোকদেরই প্রতিপত্তি বাড়ছে কেবল দিন-দিন।

আরো অনেক কথা বলতে লাগলো নন্দজ্যাঠা। অনেক অভিযোগ। নন্দজ্যাঠাও যেন সামঞ্জস্য করতে পারছে না সময়ের সঙ্গে। ওখানেও ‘বন্দে মাতরম্ হয়েছে। কী যে সব করে! স্বদেশী করছে। তাঁত করছে। বলে—ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে। শুনি আর হাসি। যে রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না-ভূগোলে পড়েছি—তাদের সঙ্গে বিরোধ! ইংরেজরা এসেছে বলে তবু সুখে খেতেপরতে পারছি। আগে কী অরাজক অবস্থা ছিল তোরা কি জানবি! ডাকাতির জ্বালায় রাস্তায় বেরোনো যেতো না। সতীদাহ দেখেছি। আমার মায়ের ঠাকুরমাকে পেছমোড়া করে বেঁধে পুড়িয়ে মেয়েছিল শুনিছি। তা ওই ইংরেজরাই এসে তো সব বন্ধ করলে। আর এখন সেই ইংরেজই আবার খারাপ হয়ে গেল!

ভূতনাথ চুপ করে শুনতে লাগলো। সেই নন্দজ্যাঠা! ঘুণাক্ষরেও একবার রাধার উল্লেখ করলে না! বোধহয় ভুলেই গিয়েছে। অথচ ভূতনাথ তো ভুলতে পারেনি রাধাকে।

বেলা হয়ে যাচ্ছিলো।

নন্দজ্যাঠা বললে—তা এবার তোর বিয়ের একটা প্রস্তাব করি অতুল—কি বল—ভালো মেয়ে আছে স্বরূপগঞ্জের ভুবন চৌধুরীর, দেবে থোবে ভালো, শহুরে জামাইও খুজছে। আমাকে বলে রেখেছে অনেক দিন থেকে।

ভূতনাথ হঠাৎ বললে—ওই সম্বন্ধেই কথা ছিল আপনার সঙ্গে।

–কী কথা? বিয়ের কথা?

তবু কেমন যেন লজ্জা করতে লাগলো ভূতনাথের। হাজার হোক, গুরুজন তো!

–বল না, লজ্জা কিসের?

ভূতনাথ দ্বিধা-সঙ্কোচ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, আপনি কি জানেন, আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?

নন্দজ্যাঠা যেন আকাশ থেকে পড়লো। প্রথমটা কিছু হাঁ-না বলতে পারলে না। তারপর বললে–কিন্তু তুই জানলি কী করে, কার কাছে শুনলি?

ভূতনাথ বললে—আমি জেনেছি, সত্যি কি না বলুন?

নন্দজ্যাঠা কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। আড়তের টিনের চালের তলায়, চারিদিকের পাটের গুদামের মধ্যে যেন দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। কোঁচার খুটটা দিয়ে বুকটা মুছতে লাগলো বার কয়েক। তারপর বললে—কিন্তু তোর তত জানবার কথা নয় অতুল—তোর তখন চার-পাঁচ কি ছ’ বছর বয়েস।

—সে কি বলরামপুরে?

নন্দজ্যাঠা বললে–হ্যাঁ, বলরামপুরে, সেবার বাবুদের নতুন মহাল কেনা হলো ওখানে। তাই তোর বাপকে নিয়ে গিয়েছিলাম প্রজাবিলি করতে..তুইও সঙ্গে ছিলি।

–সে কি রামহরি ভট্টাচার্যের নাতনীর সঙ্গে?

–হ্যাঁ, কিন্তু আমরা তো প্রথমে বুঝতে পারিনি…

—সে মেয়ের কি বয়সে তখন দু’মাস?

-হ্যাঁ, কিন্তু—নন্দজ্যাঠা আরো অবাক আরো অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে।

—সে পাত্রীর নাম কি জবাময়ী?

—হ্যাঁ—কিন্তু আমরা তো প্রথমে বুঝতে পারিনি, অত বড় পণ্ডিত লোক, বলরামপুরে ওদের অত নাম-ধাম, নৈয়ায়িক পণ্ডিত, যেবার সেই শোভাবাজারের রাজবাড়িতে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ থেকে সক লোক এসেছিল, দাক্ষিণাত্য থেকে পর্যন্ত পণ্ডিতরা এসে বিচারে বসেছিল, রামহরি ভটচার্যির ঠাকুর্দাও সেখানে হাজির ছিল, বিচারে তারই শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল শুনেছি—তা সেই অত বড় পণ্ডিত মানুষ যে আমাদের ঠকাবে কে জানতত বল?

ভূতনাথ আবার জিজ্ঞেস করলে—তার আর কোনো দিন আমাদের খোঁজ খবর নিয়েছেন?

–নিয়েছে বৈকি, লোক পাঠিয়েছিল, তখন তোর বাপ গত হয়েছে, আমার কাছে আসতেই সাফ বলে দিলাম—ও বিয়ে অসিদ্ধ।

—কেন, অসিদ্ধ কেন?

নন্দজ্যাঠা বললে—সেই কথাই তো বলছি, তোর বাপ তো বড় ভালোমানুষ ছিল, ভটচার্যি মশাই ধরলে এসে—তা তখন তুইও সেবার গিয়েছিলি আমাদের সঙ্গে। আমাকে সতীশ বললে— ভারী পণ্ডিত মানুষ, এমন বংশে বিয়ে দিতে আপত্তি কি দাদা, শরীরের যা গতিক, কবে আছি কবে নেই—বিয়েটা দিয়েই কাজ সেরে নিই—তা এরকম বিয়ে তো হতো তখন—এই দেখ না আমারই তো যখন ছ’ বছর বয়স তোর জ্যাঠাইমার তখন এক বছরও বয়েস হয়নি, বিয়ে হয়ে গিয়েছিল—যখন ঘর করতে এল তোর জ্যাঠাইমা তখন বাবার কোলে চড়ে বেড়াতে দিনরাত… আমার এখনও মনে পড়ে—আর আমার ঠাকুমা যখন শ্বশুরবাড়িতে এসেছিল তখন মা’র কাছে শুনেছি কোমরে নাকি কাপড় থাকতো না—তা ঠাকুমা’র শাশুড়ী কোমরে দড়ি দিয়ে কাপড়টা বেঁধে দিতে খানিক থেমে নজ্যাঠা আবার বলতে লাগলো—তা সতীশের কথায় আমিও ভাবলাম—দেখাই যাক মেয়ে। তা মেয়ে আর দেখবো কি, দু’ মাস তো বয়েস, তবু চোখ নাক মুখ দেখে ভালোই মনে হলো। বললাম—আমরা রাজী। রামহরি ধরে বসলেন— আজই ভালো দিন আছে—আজই হয়ে যাক—শুভস্য শীঘ্রম্। পাঁজি দেখে একেবারে পাকা বন্দোবস্ত হয়ে গেল।

ভূতনাথ উদগ্রীব হয়ে শুনছিল। বললে—তারপর?

–তারপর সেদিন কী ঝড়-বৃষ্টি বাবারে বাবা! সতীশ বললেছেলের বিয়ে তো দেবে টাকা-কড়ি যে কিছু হাতে নিয়ে আসিনি। আমি বললুম—ত’বিল আমার কাছে, আমি দেবো’খন—তা বিয়ে নয় বিয়ে, রাত দেড়টার পর লগ্ন। সেই ঝড়ের মধ্যেই ঘুম থেকে তোকে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম, গরুর গাড়ি বলে রেখেছিলাম একটা আগে থেকেই।

–তারপর?

—তারপর আর কি? পরদিনই ফিরে এলাম ফতেপুরে। সতীশ বলেছিল—কাউকে খবরটা দিও না দাদা। টাকার যোগাড়-যন্তর করে একেবারে খাওয়া-দাওয়ার দিন জানিয়ে দেবে—কিন্তু তার আগেই সংবাদ এসে গেল—সর্বনাশ কাণ্ড!

–কিসের সর্বনাশ?

–রামহরি ভটচার্যি আমাদের ঠকিয়েছে, মেয়ের বাপ হিন্দু নয়, ব্ৰহ্মজ্ঞানী, ভটচার্যি মশাই-এর ছেলে কলকাতায় গিয়ে কেশব সেন-এর দলে মিশে ধর্ম ত্যাগ করেছে, পৈতে খুলে ফেলেছে, গায়ত্রী জপ করে না, মুরগী খায়, গরু খায়, শোর খায়, বিধর্মীকে বিয়ে করেছে—সেই ছেলেরই মেয়ে এ-শুনে তো আমাদের চক্ষুস্থির!

–তারপর?

—তারপর সব শুনে সতীশের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সতীশ বললে—দাদা, একথা আর কাউকে জানিয়ে কাজ নেই, আমাদের মেয়ে নয় তাই রক্ষে। এখন চুপ-চাপ করে যাও। আমিও বললাম তাই ঠিক। শেষে যেবার বারুণীর মেলা হলো, সেবার তোকে নিয়ে গিয়ে খানিকটা গোবর খাইয়ে দিয়ে শুদ্ধ করে নিলাম, যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে, কথায় বলে—মনের অজান্তে পাপ নেই…তা সে সব অনেক দিনের কথা, তুই জানলি কী করে?

ভূতনাথ সে-কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলে—রামহরি ভটচার্যির ছেলের নাম কি সুবিনয়বাবু?

—তা হবে, অত-শত মনে নেই বাবু—সে কি আজকের কথা রে?

ভূতনাথ হঠাৎ বললে—আমি এবার উঠি তাহলে জ্যাঠামশাই বলে আবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।

নন্দজ্যাঠা বললে—সে কি রে, এই কথা জানতেই কি এসেছিলি নাকি?

ভূতনাথ বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ, এখানে দেখা না হলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আজ দেশেই যাচ্ছিলাম।

—কিন্তু, কী ব্যাপার, খুলে বল তো?

সে-কথার উত্তর না দিয়ে ভূতনাথ সোজা আড়তের বাইরে বেরিয়ে এল। এতদিন যদিও বা একটু সন্দেহ ছিল, আজ তারও সমাধান হয়ে গেল। খালের ধারে তখন ব্যাপারীদের নৌকোয় হৈ-চৈ চলেছে। ভারে-ভারে পাট, তিসি, সরষে, কাঠ নামছে। নৌকো থেকে সোজা লম্বা একটা করে কাঠের পাটা পেতে দিয়েছে। তার ওপর দিয়ে মাথায় করে মাল নিয়ে আসে মুটেরা। চারদিকে বেলা হয়েছে বেশ। রোদের তেজ বেড়েছে। খালের বারের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ভূতনাথের কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। হাতের টিনের বাক্স ভারী মনে হলো খুব।

কিন্তু এখন সে কোথায় যাবে! সাত দিনের ছুটি নিয়েছে আপিস থেকে। আপিস না গেলে আজ আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না বটে। তা ছাড়া রূপচাঁদবাবু তাকে একটু

প্রীতির চোখেই দেখেন!

সেদিন রূপচঁদবাবু বলেছিলেন—আমার এখানে আর তোমার কতই বা উন্নতি হবে—আমার সামর্থ্যই বা কতটুকু।

ভূতনাথ বলেছিল-আমার ওপর আপনার অসীম অনুগ্রহ।

রূপচাঁদবাবু বলেছিলেন—অনুগ্রহ-নিগ্রহের কথা নয় ভূতনাথবাবু, ঈশ্বরের তেমন ইচ্ছে হলে কী না হয় তাকে ধন্যবাদ দিন— তাহলেই কাজ হবে। তারপর বলেছিলেন—আর একটা নতুন আপিস হবার কথা হচ্ছে, দেখি সেখানে যদি হয় তো আপনাকে ঢুকিয়ে দেবো—অবশ্য দেরি আছে। সেখানে ঢুকতে পারলে আপনার উন্নতি হবে ভবিষ্যতে।

-কোন্ আপিস?

—ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট আপিস হবার কথা হচ্ছে কলকাতায়, এই রাস্তা-ঘাট তৈরি করবে, পুরোনো সরু রাস্তা ভেঙে চওড়া করবে, বস্তি ভেঙে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে—শহর বড় করবে আর কি।

খালের ধারে একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে ভূতনাথ টিনের বাক্সটা রাখলে। তারপর তার ওপরেই বসে পড়লল। খালের ওপর দিয়ে মালপত্র বোঝাই নৌকো চলছে। বড়-বড় বাঁশের লগ্নি দিয়ে ঠেলতে-ঠেলতে ভোঙা চলেছে। ওরা কত দূর-দূরান্ত থেকে আসছে কে জানে। শহরে এসে কাঁচামাল বিক্রি করবে। ফেরবার সময় কেরোসিন, দেশলাই, নুন, কলের কাপড় কিনে নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবে আবার। অলস দৃষ্টিতে সব দেখতে-দেখতে ভূতনাথের কেমন মনে হলো—কেন সে এখানে বসে আছে। তার কি যাবার জায়গার অভাব। এখনি সে বড়বাড়িতে যেতে পারে। তার চোরকুঠুরিতে তার নিশ্চিন্ত আশ্রয় বাঁধা। বৌঠানকে নিয়ে বরানগরে একবার যাবার কথা আছে। সেখানে গিয়ে ভূতনাথ নিজেও একবার মানত করে আসবে পাঁচ পণ সুপুরি আর পাঁচ গোছ পান দিয়ে।

আবার উঠলো ভূতনাথ। আস্তে-আস্তে চলতে শুরু করলে সোজা রাস্তা ধরে। বংশী তাকে দেখে খুব অবাক হয়ে যাবে বটে। বলবে—এ কি, ফিরে এলেন যে-দেশে যাননি শালাবাবু?

ভূতনাথ বলবে—না রে বংশী, তোদের ছেড়ে যেতে চাইলো না মন। ফিরেই এলাম তাই—আর কটাই বা দিন। তারপরে তো বড়বাড়ি খালি করতেই হবে! তখন?

কিন্তু আর একজনের কথা যেন জোর করেই ভুলে থাকতে চেষ্টা করলো ভূতনাথ। সে কি করে সম্ভব! ভালোবাসার প্রশ্ন নয়। চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্নও নয়। কিন্তু সে কেমন করে গিয়ে বলবে তাকে—আমিই সেই! আমার অধিকারের দাবি নিয়ে আমি এসেছি—আমাকে গ্রহণ করো। শুধু দুটো মন্ত্র আর এক রাত্রির ষড়যন্ত্রের পরিণামফল! জবার জীবনে সে-রাত্রিটা কি চিরকাল একটা বিড়ম্বনা হয়েই থাকবে? জবার সেই বিড়ম্বনাই কি ভূতনাথ চেয়েছিল?

ভাবতে-ভাবতে এক সময় ভূতনাথ আবার চলতে আরম্ভ করেছে। হাতে টিনের বাক্সটা যেন ক্রমেই ভারী ঠেকছে। মনে হলো—পথ চলা যেন তার শেষ হবে না। কোথায়ই বা যাবে। কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে সে। রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে। ট্রাম, ঘোড়ার গাড়ি, সাইকেল, মোটর সমস্ত চলছে। হঠাৎ কেমন যেন মনে হলো-সংসারে কেউ তো স্থির হয়ে নেই। কিন্তু যাচ্ছে কোথায় সবাই? সবাই কি উদর পূরণের অন্ন খুজছে? নিজের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের চারিদিকেই প্রতিদিন প্রদক্ষিণ করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে?

বহুদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়লো ভূতনাথের। ফতেপুরে নদীর ধারে একদিন এক বাউল এসে উঠেছিল। তখন সবে তার পিসীমা মারা গিয়েছে। কিছুই ভালো লাগে না। একদিন বেড়াতে-বেড়াতে গিয়েছিল ভূতনাথ সেখানে। ছোট খাচার মধ্যে একটা ময়না পাখী, একটা ঝোলা আর একটা একতারা—এই ছিল তার সম্বল। কিন্তু সেই একতারার মধ্যে দিয়েই সেদিন কী সুন্দর সব সুর যে বেরিয়ে এসেছিল! কত ভালো ভালো গান যে সেদিন শুনেছিল তার মুখে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিলা গো ঠাকুর, তোমরা কি জাত?

বাউল উত্তর দিয়েছিল—আমরা বাউল বাবা।

—তোমরা আমাদের মতো হিন্দু তো?

বাউল বলেছিল—না বাবা, আমরা বাউল।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—তোমরা আমাদের মতো ঠাকুর পূজো করো? ভগবান মানে?

—তা মানি বৈকি বাবা!

—তবে তোমাদের সঙ্গে আমাদের তফাৎ কোথায়? বাউল উত্তর দিয়েছিল—তফাৎ তত বাইরে নয় বাবা, ভেতরে। হিন্দুরা মন্দির গড়ে, প্রচার করে আমরা প্রচার করিনে, মন্দিরও গড়িনে। হিন্দুরা বাইরে ছড়ায়, আমরা ভেতরে গুটোই। আমাদের গুরুর উপদেশ হলো প্রথমে নিজেকে জানতে হয়, নিজেকে জানলে ভবেই নিজের মধ্যে ভগবানকে পাওয়া যায়।

—কিন্তু সে-কথা তোমরা দশজনকে জানাও না কেন? না ‘জানালে লোকে তোমাদের কাছে আসবে কেন?

বাউল হেসেছিল। কলকেতে টান দিতে দিতে বলেছিলআসবে বাবা আসবে, একদিন নিশ্চয়ই আসবে।

আজ এতদিন পরে ভূতনাথ যেন বাউলের সে-কথাটার মানে বুঝতে পারলে। মনে হলে সবাই যেন নিজেকে খুঁজে পাবার জন্যেই বেরিয়ে পড়েছে। নিজেকে না পেলে নিজের চেয়ে যে বো তাকে পাবার যেন কোনো উপায় নেই। মনে হলোছোটবেলা থেকে প্রত্যেকটি মানুষ যেন সেই একটি লক্ষ্য ধরে ছুটে চলেছে। মানুষের নিজের গড়া আচার-অনুষ্ঠানই তাকে কেবল মনে করিয়ে দেয়—এই দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এর সমাপ্তি নেই। প্রাত্যহিক উদরপূরণ আর সামাজিকতা রক্ষার মধ্যে তার পূর্ণচ্ছেদ নয়। সে এমন এক আত্মসত্তাকে খুঁজছে যে তার বর্তমানকে, তার অতীতকে, তার প্রবৃত্তিকে, তার বাসনাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর-দূরান্তে চলে গিয়েছে।

মনে পড়লো—সুবিনয়বাবুও সেই কথাই বলতেন। আত্মানং বিদ্ধিঃ। আপনাকে জানো। মনে পড়লো—এই আপনাকে জানার সাধনাই করে গিয়েছেন সুবিনয়বাবু। এই আপনাকে জানার সিদ্ধিলাভ করতেই ব্রজরাখাল দীক্ষা গ্রহণ করেছে। পটেশ্বরী বৌঠান আপনাকেই জানতে চাইছে এতদিন ধরে। ছোটকর্তা, ছুটুকবাবু, ননীলাল, চুনীদাসী, বংশী, বিধু সরকার সবাই যেন সেই আপনাকেই জানার সাধনা করে আসছে।

সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চললো। রোদের তেজ বাড়ছে, কিন্তু তবু যেন কষ্ট হলো না ভূতনাথের। হাতের টিনের বাক্সটা যেন ক্রমশ বড় হাল্কা হয়ে গিয়েছে। হাল্কা হয়ে গিয়েছে শরীর।

ভূতনাথ আবার একটা জায়গা দেখে বসে রইল কিছুক্ষণ। মনে পড়লো—আর একদিনের কথা। সুবিনয়বাবু বলেছিলেন— একদিন এ কলকাতা ছিল না, এ ভারতবর্ষ ছিল না, এ পৃথিবীও ছিল না। শুধু ছিল বাষ্প। বাষ্পের পরমাণুগুলো তাপের বেগে চারিদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। তার না ছিল সার্থকতা না ছিল সৌন্দর্য। তারপর যখন সে সংহত হয়ে এক হলো, তখন গড়ে উঠলো এই পৃথিবী। ভূতনাথেরও মনে হলো—এতদিন সে-ও যেন প্রবৃত্তির তাপে, বাসনা-কামনার বেগে ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে। কিছু দেয়ওনি। পায়নি কিছু। হঠাৎ যেন বড় সংযত হয়ে এসেছে মন। যেন সমস্ত বিচ্ছিন্ন-জানা একটি পরম প্রজ্ঞায় ঘনীভূত হয়ে এসেছে। সমস্ত বিচ্ছিন্ন-বাসনা একটি পরম প্রেমে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।

নিজের মনের গভীরে দৃষ্টিপাত করে দেখলে ভূতনাথ। সেখানে জবা নেই।

কিন্তু পরমাশ্চর্যের ব্যাপার হলো-যা আপাত বিচ্ছেদ বলে মনে হবার কথা—তা যেন পরম পাওয়া বলে মনে হলো তার। মনে হলো—জবা আছে। এতদিন সে কাকে চেয়ে এসেছিল কে জানে। কিন্তু যাকেই সে চেয়ে আসুক—কখনও বা ভুল করে, আবার কখনও বা ভুল ভেঙে-আসলে সে-ও বুঝি সেই নিজেকে জানার সাধনাই করে এসেছে। ছোটকর্তা বুঝি আজীবন নিজেকেই চেয়ে আসছে, চুনীদাসীও তাই, বৌঠানও তাই, সবাই তাই। সবাই যেন বলছে—সেই এককে জানো-জানো সেই নিজের আত্মাকে।

বনমালী সরকার লেন-এর সামনে এসেই কেমন যেন ধাধা লাগলো।

বড়বাড়ির সামনে যেন অনেক ভিড়। অনেক লাল পাগড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। ভিড় করে আছে চারপাশে আরো দশ-বিশজন লোক। বাড়ির গেট খোলা! বাড়ির ভেতরের অনেক জিনিষ উঠোনে এনে নামিয়েছে। পাহাড় হয়ে জমে আছে বাক্স, বালতি, বাসন, কাঠের সরঞ্জাম–সমস্ত।

ভূতনাথ একজনকে জিজ্ঞেস করলে—এ-সব কী?

একজন বললে-পটলডাঙার বাবুরা বাড়ির দখল নিচ্ছে।

—দখল নিচ্ছে কেন? পরোয়ানা আছে?

—আজ্ঞে, আদালত থেকে পরোয়ানা নিয়ে তবে এসেছে, পটলডাঙার বাবুরা কি কাঁচা নোক নাকি?

—তোমাদের সেই ম্যানেজার কই?

ম্যানেজারকে দূরে কাছে কোথাও দেখা গেল না।

হঠাৎ দূর থেকে বংশী ভূতনাথকে দেখতে পেয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে দৌড়ে এসেছে।–শালাবাবু, কী হবে? কী হকে শালাবাবু?

ভূতনাথ বললে—এসব কী হচ্ছে? ছোটকর্তার হুকুম নিয়েছে? মাল বার করতে কার হুকুম নিয়েছে এরা?

–কার আবার হুকুম নেবে শালাবাবু?

–কেন, যার বাড়ি তার?

–হুকুম তো নেয়নি।

–তবে কেন মাল বার করতে দিলি তুই?

পুলিশগুলো দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। আর পটলডাঙার বাবুদের লোক ঘাড়ে করে, মাথায় করে ভারী-ভারী মাল নামাচ্ছে উঠোনের ওপর।

বংশী বললে—আমি এতগুলো লোকের সঙ্গে পেরে উঠবো কেন, শালাবাবু?

ভূতনাথ যেন কী ভাবলে খানিকক্ষণ। তারপর বললে— বৌঠান কি করছে রে?

বংশী তখনও কাঁদছিল। গলা নিচু করে বললে—আজ সকাল থেকে নেশায় একেবারে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে শালাবাবু-আজ যেন বড় বাড়িয়েছে ছোটমা।

—আর ছোটকর্তা?

ছোটকর্তা কিছু বলছে না আজ্ঞে, চুপ করে শুধু জানালার বাইরে চেয়ে আছে ঠায়। একটা কথারও উত্তর দিলে না আমার এত বললুম—এত বোঝালুম।

ভূতনাথ বললে—আমার সাইকেলটা একবার দে তো রে বংশী?

বংশী চোরকুঠুরি থেকে সাইকেলটা বার করে এনে দিলে।

ভূতনাথ বললে—তুই দেখিস লে—ছোটবৌঠান, ছোটকর্তা কেউ যেন কিছুতেই ঘর থেকে বেরোয় না। আমি আসছি এখুনি—বলে সাইকেল-এ উঠে সোজা বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়লো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *