বিম্ববতী বাণপ্ৰস্থ গ্রহণের পর বিধুশেখর আর একদিনও সিংহবাড়িতে যাননি। আর কোনো আগ্ৰহ নেই তাঁর। শুধু দূর থেকে তিনি নজরে রাখবেন, নবীনকুমার বিষয়সম্পত্তি সব একেবারে উৎসন্নে না দেয়। অবশ্য হিসাবপত্রের শুষ্ক ব্যাপার নিয়েও তাঁর আজকাল আর মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না, তবু এতদিনের অভ্যাস। দিনের মধ্যে একবার না একবার কাগজ-কলম নিয়ে বসবেনই। তাঁর নিজস্ব ঐশ্বৰ্যও কম জমেনি। এরও ঠিক মতন বিধিব্যবস্থা করে যেতে হবে। কোন দিন তিনি চোখ বুজবেন, তার ঠিক নেই। ভরসা তো একমাত্র নাবালক নাতি, আর নবীনকুমার—তার ওপর কি ভরসা করা যায়?
এরই মধ্যে বিধুশেখরের কানে এসে পৌঁছোলো গঙ্গানারায়ণের আগমন বার্তা। তিনি খুব একটা বিস্মিত হলেন না। গঙ্গানারায়ণের মৃত্যু সম্পর্কে তিনি কখনোই খুব একটা ধ্রুব নিশ্চিত হননি। পুরুষমানুষ এত সহজে মরে না। বিশেষত যার মৃত্যু হলে অপর কারুর খুশী হবার কারণ আছে। যম যেন ইচ্ছে করে তাদেরই স্পর্শ করতে ভুলে যায়। তাঁর ধারণ হয়েছিল গঙ্গানারায়ণের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে, তাতেই তিনি ভেবেছিলেন, যাক, আপদ গেছে!
দিবাকর যখন এসে প্রথম জানালো যে গঙ্গানারায়ণ ফিরে এসেছে, বিধুশেখর তৎক্ষণাৎ চক্ষু বুজে মনে মনে বললেন, নিয়তির যেমন বিধান, সেই মতনই ঘটুক, আমার আর কোনো দায় নেই। গঙ্গানারায়ণের সহিত কেমন ব্যবহার করা উচিত, তা ছোট্কুই বুঝবে, আমি আর মাথা গলাতে যাবো না।
কিন্তু তিনি অন্তরে একটা তীব্ৰ জ্বালা অনুভব করলেন। তাঁর অশক্ত, পঙ্গু শরীরটা যেন মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠলো, যেন তিনি এখনো তাঁর ছড়িটা দিয়ে গঙ্গানারায়ণকে সাপ-পেটা করতে পারেন! গঙ্গানারায়ণের প্রতি এমনই এক বিতৃষ্ণা ও ক্ৰোধ জমে আছে তাঁর মনে, যা তিনি কিছুতেই বিস্মৃতি হতে পারেন না। গঙ্গানারায়ণ যে কিছুদিন বারানসীতেও ঘোরাঘুরি করেছে সে সংবাদ লোকপরম্পরায় তিনি অবগত হয়েছিলেন। তাতে তাঁর ক্ৰোধে আরও ইন্ধন পড়েছিল। এই মতিচ্ছন্ন যুবকটি তাঁর কাছ থেকে বিন্দুকে সরিয়ে দেবার জন্য তাঁকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। কিন্তু সে জন্য তাঁর মন যে কতখানি পুড়েছে, সে কথা তো কেউ জানে না।
চাপা শ্লেষের সঙ্গে তিনি দিবাকরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হুঁ, ফিরে এসেচে! ভালো কতা! আসল লোক কি না দেকে নিইচিস তো? নাকি আবার জাল প্ৰতাপচাঁদের মামলা হবে? নিজের ভাগের সম্পত্তি দাবি করেচে। নিশ্চয়?
দিবাকর আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, আজ্ঞে, দেকে তো মনে হয় আমাদের সেই বাবু-ই বটে। তবে কি না হলফ করে কে বলতে পারে? সম্পত্তির কতা তো কিচু বলেননিকো এখুনো, অনেকটা সন্ন্যোসীদের মতন ভাব।
বিধুশেখর বললেন, হুঁ।
একটু থেমে বিধুশেখরকে খুশী করবার জন্য দিবাকর বললো, ভেক ধরেচেন কি না তা আর আমাদের মতন ছার লোকে কী বলবে! আজকাল কে আসল, কে নকল বোজা শক্ত। আপনি তো সবই জানেন।
বিধুশেখর মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
দিবাকর জিজ্ঞেস করলো, একবার ছোট্কুবাবুকে দেকা কত্তে বলবো আপনার সঙ্গে?
এবার বিধুশেখর উদানীসভাবে বললেন, না, থাক। যদি তার ইচ্ছে হয় আসবে, ডাকবার দরকার নেইকো। আমি আর এ-সবের মধ্যে থাকতে চাই না।
ক্রোধের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু কৌতুকও বোধ করছিলেন বিধুশেখর। গঙ্গানারায়ণ ফিরে এলেও যাতে সে-কোনো সুবিধে করতে না পারে, সে ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছেন। গঙ্গানারায়ণ মৃত বলে রটিত হবার পর তার ভাগের সম্পত্তি নবনীকুমারের নামেই বর্তে ছিল। ইদানীং মহাভারত অনুবাদের হুজুগে নবীনকুমার প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। সে জন্য কিছু সম্পত্তি বিক্রয় করার প্রয়োজন হয়েছিল। বিধুশেখর কৌশলে নবীনকুমারকে দিয়ে গঙ্গানারায়ণের জায়গা-জমিই সব বেচে দিয়েছে। এখন কার্যত গঙ্গানারায়ণ কপর্দকশূন্য, এবার সে বুঝুক! কনিষ্ঠ ভ্রাতার কাছে সে হাত-তোলা হয়ে থাকতে পারবে? যে পুরুষমানুষের হাতে পয়সা থাকে না, বাড়ির কুকুর-বিড়ালটা পর্যন্ত তাকে সমীহ করে না। আবার না নিরুদ্দেশে চলে যেতে হয় গঙ্গানারায়ণকে। আর যদি ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ বাধে, তখন বাধ্য হয়েই হস্তক্ষেপ করতে হবে বিধুশেখরকে।
মুখে যা-ই বলুন, বিধুশেখর মনে মনে প্রত্যাশা করেছিলেন যে ছোট্কু ঠিকই আসবে তাঁর কাছে। বিষয়-বুদ্ধি ছোট্কুর খুবই কম। গঙ্গানারায়ণের ফিরে আসা জনিত সংকটে পরামর্শ নেবার জন্য বিধুশেখরের কাছে আসতেই হবে ছোট্কুকে। কিন্তু দিনের পর দিন যায়, ছোট্কু আর আসে না। বিধুশেখর জানেনই না যে ছোট্কু আর এবাড়িতে কোনোদিনই আসবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে।
ছোট্কু এলো না, তার বদলে গঙ্গানারায়ণ নিজেই এলো একদিন।
ছোটভাই নবীনকুমার নিজের উদ্যোগে জেলখানা থেকে জামিনে খালাস করে এনেছে। গঙ্গানারায়ণকে। কলকাতায় এসে গঙ্গানারায়ণ দেখলো, যে গৃহে সে আবাল্য প্রতিপালিত হয়েছে, সে গৃহে তার আর কোনো চিহ্নই নেই। বিম্ববতী নেই শুনে গঙ্গানারায়ণের অন্তর হাহাকার করে উঠেছিল, সে চেয়েছিল, সেই দণ্ডেই হরিদ্বারের দিকে রওনা হবে, জননীর সঙ্গে দেখা করে আসবে। নবীনকুমার অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে নিবৃত্ত করেছে। কারণ গঙ্গানারায়ণ এখনো আসামী, তার নামে মামলা বুলছে, তার যত্রতত্র গমনের স্বাধীনতা নেই।
গঙ্গানারায়ণের নিজস্ব কক্ষটিও এখন অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়। সেজন্য কারুকে দোষও দেওয়া যায় না। কেইবা ভেবেছিল গঙ্গানারায়ণ ফিরে আসবে? তার পত্নী লীলাবতী বাপের বাড়ি থেকে আর কখনো এ-বাড়ীতে আসেনি। সেই নিরপরাধ বালিকাটি কত কষ্টই না পেয়েছে। বিনা দোষে সে পতি-সহবাসে বঞ্চিতা হয়ে বিধবা সেজে রইলো। শেষ পর্যন্তও সুখের মুখ দেখতে পেল না। সে। মাত্র আট মাস আগে সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে সে এই ভবধাম পরিত্যাগ করেছে। কানাঘুষো শোনা যায় যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি লীলাবতীর, কিছু একটা অসমীচীন ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার ফলে আত্মঘাতিনী হয় সে। তার মৃত্যুর ঠিক দুই দিন পরেই তার পিত্ৰালয়ে তার এক পিসতুতো দাদা গলায় ফাঁস লাগিয়ে অপঘাতে মরে বলেই এমন গুজবের জন্ম হয়। সে যাই হোক, লীলাবতী মুছে গেছে এ পৃথিবী থেকে।
পত্নীর মৃত্যুসংবাদ শান্তভাবে গ্রহণ করে গঙ্গানারায়ণ। লীলাবতীর প্রতি সে সীমাহীন অবিচার করেছে ঠিকই, কিন্তু সেজন্য যেন সে নিজে দায়ী নয়, দায়ী তাদের দুজনের নিয়তি। লীলাবতী বেঁচে থাকলেও গঙ্গানারায়ণ কি তাকে এখন আবার গ্ৰহণ করতে পারতো?
নবীনকুমার এখন মহাভারত অনুবাদ-কার্যে খুবই ব্যস্ত বলে গঙ্গানারায়ণের ফিরে আসা নিয়ে খুব বেশী হই হই করলো না। এক একজন মানুষ থাকে, যাদের দেখলেই মন প্ৰসন্ন হয়ে ওঠে। গঙ্গানারায়ণকে দেখা মাত্র নবীনকুমার অনুভব করেছিল, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাটির পরতি তার অন্তরের টান আছে। এর সঙ্গে তার শৈশব স্মৃতিগুলি মধুর। দু-তিনদিন অনবরত গল্প শোনার পর নবীনকুমার বলেছিল, দাদামণি, তুমি এসে পড়ে আমায় বড় বাঁচা বাঁচিয়েচো! জমিদারি দেকাশুনোর ভার এবার থেকে তুমি আবার নেবে, ওসব আমার পোষায় না। বাপরে!
গঙগানারায়ণ হেসে উত্তর দিয়েছিল, আমিও আর ওসব পার্বো না রে, ছোট্কু! এতকাল পথে পথে ঘুরে ঘুরে আমি জমিদারি চালচলন সব ভুলে গেচি। আমায় আর কেউ মানবে না।
নবীনকুমার বলেছিল, ওসব কতা শুনচিনি! তুমি গায়ে ফুঁ দিয়ে থাকবে ভেবোচো! তোমার কাঁধে সব জোয়াল চাপিয়ে আমি এবারে নিশ্চিন্দি। দুদিন থাকো না তারপর নিজেই দেকবে, আমার এখন কত কাজ! বিদ্যেসাগর মশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে শপথ করিচি, মহাভারত অনুবাদের কাজ আমার সম্পন্ন কর্তেই হবে।
বিধুশেখর এ বাড়িতে আসে না দেখে খটকা লেগেছে গঙ্গানারায়ণের। এ বিষয়ে ছোট্কুকে কিছু প্রশ্ন করলে সে এড়িয়ে যায়। বিধুশেখরের প্রসঙ্গই যেন তার কাছে অস্বস্তিকর। তবু গঙ্গানারায়ণের মনে হলো, সৌজন্য এবং ঔচিত্যবোধে তারই একবার যাওয়া দরকার বিধুশেখরের কাছে।
আগে ছিল ইটের দেওয়াল। এখন লোহার রেইলিং দিয়ে ঘেরা হয়েছে সামনের বাগানটি। যে পামগাছগুলিকে গঙ্গানারায়ণ ছোট দেখেছিল, এখন সেগুলি পূর্ণ বয়স্ক। তাদের পত্ররাজিতে বাতাসের হিল্লোলে এ গৃহটিকে দূর থেকে আরও সুশ্ৰী দেখায়। গেটের এক পাশে দ্বারবানদের বসার জন্য একটা গুমটি ঘর, এটাও ছিল না। আগে। দ্বারবান গঙ্গানারায়ণকে চেনে না, অবশ্য তাকে বাধাও দিল না। ভেতরে এসে গঙ্গানারায়ণ দেখলো, দক্ষিণ দিকের উদ্যানে একটি বালক আকষি দিয়ে একটা পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ার চেষ্টা করছে। ঐ বালকটিকে চেনে না গঙ্গানারায়ণ। সুহাসিনীর পুত্রকে সে চিনবেই বা কী করে! গঙ্গানারায়ণ নিজেও বাল্যকালে ঐ গাছে চড়ে অনেক পেয়ারা পেড়েছে। ঐ গাছের পেয়ারা পাকলে ভেতরটা লাল টুকটুকে হয়।
গঙ্গানারায়ণের বক্ষ কম্পিত হলো না। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসও বেরুলো না। গঙ্গানারায়ণ নিজেই যেন একটু অবাক হলো। মানুষ অনেক সময় নিজের থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে যাচাই করে। অপর কোনো দর্শকের মতন লক্ষ্য করে নিজের গতিবিধি। গঙ্গানারায়ণ ধরেই নিয়েছিল, এ গৃহে পা দেওয়া মাত্রই বিন্দুবাসিনীর স্মৃতিতে মন উচাটন হবে তার। সে দুর্বল হয়ে পড়বে। কই, সে রকম কিছুই হলো না তো, বিন্দুবাসিনীর স্মৃতি যেন এরই মধ্যে তার হৃদয়ে হালকা ফিকে হয়ে এসেছে। যে-সব দিনগুলি যন্ত্রণার, কাতরতার, আশাভঙ্গের, তা মুছে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, শুধু সুখকর দিনগুলিই এখন ধরে রাখতে চায় স্মৃতি। সময় এমনই ধন্বন্তরী!
সিঁড়ি দিয়ে গঙ্গানারায়ণ উঠে এলো বৈঠকখানায়। সে কক্ষ শূন্য। পাশে আর একটি বৈঠকখানা আছে, সেখানে বিধুশেখর শুধু তাঁর মক্কেলদের সঙ্গে দেখা করতেন। সেখানেও উঁকি দিয়ে দেখলো গঙ্গানারায়ণ। সারা বাড়িতেই কেমন যেন খাঁ খাঁ ভাব। এক সময় প্রতিদিন সকালে এখানে প্রচুর লোকসমাগম হতো। বেশ কয়েক বৎসর হলো, বিধুশেখর ওকালতি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছেন।
একজন নতুন ভৃত্য গঙ্গানারায়ণের দিকে উৎসুক ভাবে চেয়ে আছে। একবার সে কিছু জিজ্ঞেসও করলো, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ তাকে কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল ভেতরের দালানের দিকে। সেখানে বসে থাকা এক বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বললো, কেমন আচো, নরহরি?
এই নরহরি এ-বাড়িতে কাজ করছে বহুকাল ধরে। তার বয়েসের যেন গাছপাথর নেই। গঙ্গানারায়ণ এর কোলে-পিঠে চড়েছে শৈশবে। গঙ্গানারায়ণকে নরহরি ভারি ভালোবাসতো। স্নেহ জিনিসটা যত পুরোনো হয়, ততই পাক ধরে। অতকাল পরে ছানি পড়া চোখে নরহরি গঙ্গানারায়ণকে দেখামাত্র চিনতে পারলো। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সে একেবারে হেসে কেঁদে অস্থির। একবার সে গঙ্গানারায়ণের গায়ে হাত বুলোয়, আবার সে গঙ্গানারায়ণের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্যাকুলভাবে বলতে থাকে, কোতায় গিসলে, দাদু আমার? কেঁদিচি তোমার জন্যে, ও-বাড়ির মা-ঠাকরুণকে গিয়ে জিগিয়িচি…।
অন্যান্য দাস-দাসীরাও ভিড় করে দেখতে এলো গঙ্গানারায়ণকে। অন্দর মহলের কেউ এখনো খবর পায়নি, বিধুশেখরও নিচে নামেনি আজ। আগে বিধুশেখরের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করা উচিত, কিন্তু এ-বাড়িতে লোকমুখে সংবাদ পাঠিয়ে তারপর দেখা করার মতন সম্পর্ক নয় গঙ্গানারায়ণের। সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো। সে আগেই জেনেছে যে এ-বাড়ির জ্যাঠাইমা মারা গেছেন, তাঁর দুই মেয়ে রয়েছে এখানে।
একজন দাসী গঙ্গানারায়ণের আগে আগে। ওপরে উঠে এসেছিল, সে তড়িঘড়ি ডেকে আনলো সুহাসিনীকে। ধীর পায়ে হেঁটে সুহাসিনী এসে তার কাছে দাঁড়ালো। গঙ্গানারায়ণ চিনতে পারলো না তাকে। মুখের অবগুণ্ঠন সরিয়ে সুহাসিনী বললো, গঙ্গাদাদা, তুমি ফিরোচো, শুনিচি…এতদিন পরে এলে?
–-কে?
–চিনতে পাল্লে না? সুহাসিনীকে মনে নেই তোমার?
গঙ্গানারায়ণ প্রায় স্তম্ভিত। এই সুহাসিনী? কত ছোট দেখেচে ওকে, গঙ্গানারায়ণের বিবাহের পরে পরেই বিবাহ হয়েছিল ওর। সে আজ বিধবা, শরীর অত্যন্ত শীর্ণ। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে। মনে হয় কত না যেন বয়েস! অথচ সে তো বিন্দুবাসিনীর চেয়েও ছোট। বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে চেহারারও কোনো মিল নেই সুহাসিনীর। গঙ্গানারায়ণের চকিতে মনে পড়লো কাশীতে গঙ্গার ওপরে রামনগরে পাল্কীর মধ্যে বিন্দুবাসিনীকে দেখার কথা। ঠিক যেন রাজরাজেন্দ্ৰাণীর মতন রূপ। না, ঠিক হলো না। কোনো রাজেন্দ্ৰাণীর পাথরে গড়া মূর্তি।
–তুই? সেই সুসি?
—আমি কিন্তু তোমায় দেকা মাত্তর চিনিচি! তুমি সেই একই রকম রয়োচো!
—তাই? সবাই যে বলে আমি অনেক বদলে গেচি? খুব একটা উচ্ছ্বাস বা আবেগ নেই সুহাসিনীর ব্যবহারে। এককালে কী ছটফটেই না ছিল এই মেয়ে! গঙ্গানারায়ণের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সুহাসিনীর দুই চক্ষু দিয়ে নেমে এলো অশ্রুবিন্দু।
-ও কি, সুসি, তুই কাঁদচিস কেন?
—এতকাল পরে তোমায় দেকেও কাঁদবো না, আমি কি এমনই পাষাণ। গঙ্গাদাদা, পৃথিবীটা কেমন হয়ে গেল বলে তো?
-লক্ষ্মী দিদি আমার, কাঁদে না। চোখ মুছে ফ্যাল! আয়, তোকে অনেক মজার মজার গল্প শোনাবো–
—চলো, ঘরে গিয়ে বসবে চলো। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কতা আছে। ছোট্কু তো মস্ত লোক হয়েচে, এ বাড়িতে আসেই না! দিদি গঙ্গাচ্চন কত্তে গ্যাচে, এক্ষুণি এসে পড়বে!
-আগে জ্যাঠাবাবুকে প্ৰণাম করে আসি।
-বাবা বোধহয় ঘুমুচ্চেন।
—এখন, এই সকাল দশটার সময় ঘুমুচ্চেন?
— বাবা তো এদানিং সব সময় প্রায় ঘুমোন। দাঁড়াও, দেখি জেগেচেন কি না। বিধুশেখরের ঘরের পাশ দিয়েই ছাদে ওঠার সিঁড়ি। গঙ্গানারায়ণ একবার সেদিকে তাকালো। ছাদে শুধু ঠাকুর ঘর।
বিধুশেখরের ঘরের দরজা খোলা। পালঙ্কের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন তিনি, চক্ষু মুদিত,হাত দুটি বক্ষের ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। সুহাসিনী বাবা বলে ডাকাতেও বিধুশেখর সাড়া দিলেন না।
একটু আগে সুহাসিনীর সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের কথোপকথন কিছু কিছু কানে গেছে। তাঁর, তিনি গঙ্গানারায়ণের উপস্থিতি টের পেয়েছেন। তবু তিনি সময় নিচ্ছেন ওর মুখোমুখি হবার জন্য।
সুহাসিনী বললো, গঙ্গাদাদা, তুমি শিয়রের কাচে গিয়ে ডাঁরাও, ডাকো, তাহলেই জেগে উঠবেনখন।
গঙ্গানারায়ণ বললেন, এখন থাক। বরং, পরে আসবো।
–না, তুমি ডাকো না, সারাদিনই তো অমনি! শিয়রের কাছে নয়, বিধুশেখরের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো গঙ্গানারায়ণ। মৃদুকণ্ঠে ডাকলো, জ্যাঠাবাবু, জ্যাঠাবাবু।
ধীরে চক্ষু মেলে বিধুশেখর বললেন, কে?
—জ্যাঠাবাবু, আমি গঙ্গা।
বিধুশেখর এক চক্ষু দিয়ে চেয়ে রইলেন নির্নিমেষে। যেন তিনি ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না। শায়িত ব্যক্তির পদধূলি গ্ৰহণ করতে নেই তাই গঙ্গানারায়ণ বিধুশেখরের পা স্পর্শ করলো না, বিনীত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
-হাতখানা একটু ধর তো, সুসি।
সুহাসিনী এসে সাহায্য করতে বিধুশেখর উঠে বসলেন আস্তে আস্তে। নষ্ট চক্ষুটির ঠুলিটা কপালের ওপর তোলা ছিল, সেটাকে ফিরিয়ে আনলেন যথাস্থানে। পালঙ্কের বাইরে পা ঝোলাতে হবে, অসাড় বাঁ পা-টি নিয়ে এলেন অতি কষ্টে। তারপর বললেন, গঙ্গা? তুমি সত্যিই ফিরোচো তাহলে। গঙ্গানারায়ণ এবার বিধুশেখরের পদধূলি গ্রহণ করলো। অভ্যেসবশে বিধুশেখর একটি হাত তুললেন তার মাথার কাছে, মুখে কিছু বললেন না।
—আপনার শরীর গতিক ভালো আচে তো, জ্যাঠাবাবু?
–হ্যাঁ, বেশ ভালোই আচি। দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো। সুসি, কারুকে বল মিষ্টি এনে দিতে। তোরঙ্গ খুলে একটা রূপের রেকবি বার করে দিগে যা। হ্যাঁ, তারপর বলো, গঙ্গা, এতদিন তুমি গেসলে কোতায়?
বসলোনা গঙ্গানারায়ণ, দাঁড়িয়ে থেকেই বললো, বোধকরি আমার মস্তিষ্কে কিচু গোলমাল হয়েছেল, তাই বিনা কারণে দেশে দেশে ঘুরিচি।
—হুঁ। ইব্রাহিমপুর থেকে উধাও হয়েছেলে, আবার সেখানেই ফিরে এয়োচো, এমন শুনতে পাই।
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
—তোমার পত্নী ইতিমধ্যে গত হয়েচেন শুনিচি, তুমি কি অন্যত্র বিবাহ করেচো?
–আজ্ঞে না।
–তোমাদের জননী তো হঠাৎ হরিদ্বারে চলে গ্যালেন। আর ফিরবেন না বলেচেন। দ্যাকো দিকি কাণ্ড। ও বাড়ি একেবারে ফাঁকা। তুমি এখুন কালকেতাতেই থাকবে?
-আজ্ঞে, সে রকম কিচুই ভাবিনি। ছোট্কু আমায় জেলখানা থেকে এনেচে, এখনো মোকদ্দমা ঝুলচে—
—দেশের রাজার সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা করে কেউ জেতে? যতসব আজগুবি কাণ্ড। দুপাঁচ বচর যদি জেল খাটতে হয়, সে তোমায় রাজ-সরকার আগেও খাটাতো, পরেও খাটাবে, মধ্যেখান থেকে টাকাকড়ির ছেরাদ্দি হবে।
—ছোট্কু এসব ব্যাপারে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেনি? আমি তো অত শত জানি না, কেষ্টনগরে সে দুজন উকিল নিয়ে পৌঁচোলো, তারাই সব ব্যবস্থা কর্লে।
—ছোট্কুর মাতাটা বিগড়েচে ছোটবেলা থেকেই। আমার সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার বোধ করে না সে। টাকাকড়ি একেবারে নয় ছয় কচ্চে। শোনো, আমি বলি কি, তুমি এখেনে থাকচো যখন…দিবাকরটা বুড়ো হয়েচে, ওর দ্বারা আর কাজ কম্মো হয় না, চুরি করেও তো ফাঁক কল্লে, তুমি ওর কাজটা নাও, হিসেব পত্তরগুলো যদি ঠিকঠাক রাকা যায়, তুমি লেকাপড়া শিকোচো—
কাটা কাটা শুষ্ক ধরনের কথা! শেষের বাক্যটিতে বিধুশেখর পরিষ্কার ইঙ্গিত করলেন যে, গঙ্গানারায়ণকে ও বাড়িতে দিবাকরের মতন কর্মচারী হয়ে থাকতে হবে। গঙ্গানারায়ণের মামলার জন্য অর্থ ব্যয় হবে, সেটাও বিধুশেখরের একেবারেই মনঃপূত নয়। এতকাল বাদে দেখা হবার পর এই আপ্যায়ন!
গঙ্গানারায়ণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো বিধুশেখরের দিকে। অপমান বোধ অল্প অল্প জ্বালা ধরাতে শুরু করেছে তার শরীরে। এই মানুষটির সঙ্গে সে একবার সম্মুখ যুদ্ধে নামবে বলে মনস্থ করেছিল। এতকাল পরেও যে বিধুশেখর ঠিক সেই আগেকার মতনই ব্যবহার করবেন, সে ভাবতে পারেনি। আবার শুরু হবে দ্বৈরথ?
কিন্তু বিধুশেখরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বক্ষে ক্রোধের বদলে জেগে উঠলো অনুকম্পা। লড়াই হবে কি, বিধুশেখর তো আগে থেকেই হেরে বসে আছেন। এই সেই বিধুশেখর, সেই কঠোর তেজী, আদর্শনিষ্ঠ পুরুষ? একচক্ষু নেই, বা হাতটা অক্ষমভাবে ঝুলে আছে, বাঁপায়ে জোর নেই, সারা শরীরটাই যেন মর্চে ধরা, এ তো এক ভগ্নস্তূপ! আর কিছুই অবশিষ্ট নেই বলেই প্ৰাণপণে প্ৰতাপ দেখাবার চেষ্টা। কী করুণ, কী হাস্যকর। একে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেই বা ইনি কী করবেন? কিন্তু গঙ্গানারায়ণের দয়া হলো, জীবিত অবস্থায় বিধুশেখরের ঐ প্রতাপটুকুও কেড়ে নেওয়া সঙ্গত হবে না।
সে হাঁটু গেড়ে বসে বিধুশেখরের পা জড়িয়ে ধরে বললো, জ্যাঠাবাবু, আমি আপনার কাচে অনেক অন্যায় করিচি, আপনার মনে দুঃখ দিয়িচি, জানি, আমার ওপর এখনো আপনার রাগ আচে, আপনি আমায় ক্ষমা করুন, যা হবার তা তো হয়েই গ্যাচে, আপনি আমার গুরুজন, আপনি ক্ষমা না কর্লে…এবার থেকে আপনার সব কতা শুনে চলবো
বেদব্যাসের উপমা ধার করে বলা যায়, একটু ক্ষণের জন্য বিধুশেখরের হৃদয় গ্ৰীষ্মকালের মধ্যাহ্নের দীঘির মতন হয়ে উঠলো। উপরিভাগের জল খুব উষ্ণ, আবার তলদেশের জল তেমনই ঠাণ্ডা। হৃদয়ের সেই তলদেশের অংশে তিনি চাইলেন ছেলেটিকে ক্ষমা করতে, ক্ষমার মতন একটা শান্ত স্নিগ্ধ ব্যাপার উপভোগ করার বাসনা হলো তাঁর। জীবন সায়াহ্নে এসে তো সকলকেই ক্ষমা করে যেতে হয়। কিন্তু এ মনোভাব একটুক্ষণের জন্য মাত্র। গঙ্গানারায়ণকে কিছুতেই সহ্য করতে পারবেন না তিনি। এ তাঁর জীবনের রাহু, এ কেন ফিরে এসেছে? এই যে ক্ষমা চাইছে, এটাও ওর প্রতারণা?
গঙ্গনারায়ণ তখনও বিধুশেখরের পা ধরে আছে, কিন্তু একটা আশ্বাস বা স্বস্তিবচন উচ্চারণ করতে পারলেন না বিধুশেখর। আশীর্বাদের জন্য তাঁর হাত উঠলো না। তিনি শুধু বললেন, যাক, যাক, হয়েচে, হয়েচে, এবার ওঠো।