পঁয়তাল্লিশ
দরজাটা ভেজানোই ছিল। এখন রাত বেশী নয়। অন্যমনস্ক অর্ক দরজা ঠেলতে দেখল ঘরের আলো নেবানো। সে একটু অবাক হয়ে ডাকল, ‘মা।’
‘আলো জ্বাল।’ মাধবীলতা যেন নিঃশ্বাস চেপে উচ্চারণ করল। গলার স্বরটা অস্বাভাবিক ঠেকতেই অর্ক দ্রুত ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললো। মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে আছে মাধবীলতা। মুখ লাল, ঠোঁট ফ্যাকাশে। আলো জ্বলতেই চোখ বন্ধ করল সে। একটা হাত পেট খামচে ধরেছে। দৌড়ে এল অর্ক, ‘কি হয়েছে মা?’
‘কিছু না। আজ আমি রান্না করতে পারছি না। ওখানে টাকা আছে, তুই কিছু কিনে খেয়ে নে।’ মাধবীলতার মুখ দেখে অর্ক বুঝতে পারল মা যন্ত্রণা চাপছে। সে মাথার পাশে বসে কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে বিহ্বল গলায় বলল, ‘তোমার জ্বর এসেছে?’
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘ও কিছু নয়, আমাকে একটু শুয়ে থাকতে দে।’
‘তোমার পেটে কিছু হয়েছে?’
‘ব্যথা করছে। শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।’ তারপর একটা হাত বাড়িয়ে অর্ককে আঁকড়ে ধরল মাধবীলতা। অর্ক দেখল তার বাজুতে মায়ের আঙ্গুলগুলো চেপে বসেছে। শক্ত হয়ে যেন ব্যথাটাকে সামলাতে চাইছে মা। সঙ্গে সঙ্গে অর্ক অসহায়ের মত চারপাশে তাকাল। জ্ঞান হবার পর থেকেই সে মাকে একরকম দেখে আসছে। কোন বড় অসুখে কখনও পড়েনি মাধবীলতা। এইভাবে যন্ত্রণায় কাতর হতে মাকে সে কখনো দ্যাখেনি। মাথার ভেতরটা ঘুরে গেল অর্কর। মা ছাড়া পৃথিবীতে তার কেউ নেই। হাতটা ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠল সে। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘তুমি শুয়ে থাকো, আমি এখনই আসছি।’
‘কোথায় যাচ্ছিস?’ মাধবীলতা কোনক্রমে জিজ্ঞাসা করল।
‘ডাক্তার ডাকতে।’
‘না।’ চিৎকার করে উঠল মাধবীলতা, ‘আমার কিছুই হয়নি। ডাক্তার ডাকতে হবে না।’ শেষ কথাটা বলতে বলতে মুখ বিকৃত হয়ে গেল তার।
‘এখন কোন কথা বলবে না। আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।’
মাধবীলতা চোখ মেলে তাকাতেই অর্ক আড়ষ্ট হল। দুফোঁটা জল চিক চিক করছে চোখের কোণে। অর্ক আর দাঁড়াল না। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গলিতে পা দিতেই মনে হল মাকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিছু ভাবতে না পেরে সে অনুপমাদের ভেজানো দরজায় হাত দিতেই দেখল মেঝেতে অনুপমা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। অনুপমার পায়ের কাপড় হাঁটুর ওপর ওঠা। দৃশ্যটা চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই আর দাঁড়াল না অর্ক। এক দৌড়ে ঈশ্বরপুকুর লেনে চলে এল সে।
ডাক্তারের চেম্বারে বেজায় ভিড়। কিন্তু ডাক্তার নেই। তিনি কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতে পারছে না। কম্পাউণ্ডার জানাল, কলে গিয়েছেন। ছটফট করতে লাগল অর্ক। এপাড়ায় আর একজন ডাক্তার আছেন। তিনি বসেন ট্রাম লাইনের ধারে। যত দেরি হচ্ছিল তত অধীর হচ্ছিল অর্ক। মায়ের যেন কিছু না হয়ে যায় ভগবান। ট্রাম লাইনের ধারেই যাবে ঠিক করল সে।
কিন্তু রাস্তায় নামতেই সে ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেল। হন হন করে হেঁটে আসছেন। পেছনে ঝুমকি। অনেক ফর্সা অনেক ঝকঝকে চেহারা হয়েছে ঝুমকির কিন্তু সেদিকে তাকানোর সময় ছিল না অর্কর। ও এগিয়ে গিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনাকে এখনই আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। আমার মার ভীষণ অসুখ।’
ডাক্তার যেন অসহায় হয়ে মাথা নাড়লেন, ‘কোন বাড়ি? ওহো, তোমাদের বাড়িতে তো আমি গিয়েছি। কিন্তু এখন তো হবে না, রাত্রে ফেরার সময় যাব।’
অর্ক বলল, ‘না, মা খুব কষ্ট পাচ্ছে, আপনি একবার চলুন।’
‘কি হয়েছেটা কি?’
‘খুব জ্বর আর পেটে ব্যথা।’
এই সময় ঝুমকি কথা বলল, ‘ডাক্তারবাবু—।’
‘হ্যাঁ। তোমার বাবার ওষুধ-টা তুমি কম্পাউণ্ডারবাবুকে আমার নাম করে বলো, তিনি দিয়ে দেবেন। আমি এক্ষুনি এর বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। চলো।’ ডাক্তারবাবু আবার পেছন ফিরতে অর্ক ঝুমকির দিকে তাকাতেই সে হেসে বলল, ‘ভালো?’
অর্ক উত্তর না দিয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গ নিল। শুনছে মায়ের অসুখ, ডাক্তার নিয়ে যাচ্ছে তবু জিজ্ঞাসা করছে ভালো? হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মনে হল ঝুমকি এখনও পাকাপাকি মিস ডি হয়নি। মিস ডি হলে তো আর এই বস্তিতে থাকার কথা নয়। তবে চেহারা পাল্টে গিয়েছে। এখন মহিলা মহিলা মনে হয় ওকে।
দরজা ঠেলে অর্ক বলল, ‘আসুন।’
ঘরে আলোটা জ্বলছিল। মাধবীলতা হাতের কনুইতে চোখ আড়াল করে শুয়েছিল। শব্দ হতে চোখ মেলে ডাক্তারবাবুকে দেখে বলল, ‘কি অন্যায় বলুন তো, মিছিমিছি আপনাকে ডেকে আনল।’
ডাক্তারবাবু ব্যাগটাকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে?’
‘পেট ব্যথা করছিল। বললাম শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে—।’
কথা শেষ করতে না দিয়ে কপালে হাত দিলেন ডাক্তারবাবু, ‘চমৎকার জ্বর বাধিয়েছেন। কদ্দিন থেকে হচ্ছে?’
মাধবীলতা এবার জবাব দিল না। ডাক্তারবাবু এবার পেটে হাত দিলেন। বিশেষ জায়গায় স্পর্শমাত্র আর্তনাদ করে উঠল মাধবীলতা। অর্ক লক্ষ্য করল ডাক্তারের মুখ কালো হয়ে গেল। মিনিট দশেক ধরে নানান পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রথম কবে পেইন অনুভব করেছেন?’
মাধবীলতা একটু ইতস্তত করছিল, ডাক্তারবাবু আবার বললেন, ‘লুকিয়ে কোন লাভ হবে না। এ জিনিস একদিনে হয়নি। আপনারা যে কেন চেপে থাকেন তা আমি আজো বুঝতে পারি না। সেই শেষ পর্যন্ত তো জানতে দিতেই হয়। পেটেরটা তো বুঝলাম, বুকেরটা কি করে ঘটালেন?’
‘বুকের?’
‘নিঃশ্বাস নিতে গেলে খচ্ করে লাগছে তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আমি ওষুধ দেব, ভাল ঘুম আসবে।’ ডাক্তারবাবু ব্যাগ তুলে নিয়ে অর্ককে ডাকলেন, ‘এসো।’
বাইরে বেরিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তোমার বাবাকে ডাকো, ওঁর সঙ্গে কথা আছে।’
অর্কর চোয়াল শক্ত হল, ‘উনি এখন এখানে নেই।’
‘আঃ! এখন ওকে ভীষণ দরকার।’
‘আপনি আমাকে বলুন।’
ডাক্তারবাবু অর্কর দিকে তাকালেন, ‘শোন, তোমার মায়ের অসুখটা খুব সামান্য নয়। এক্সরে না করিয়ে আমার কিছু বলা উচিত নয়। আমি তোমাকে সাজেস্ট করব ইমিডিয়েটলি হসপিটালে নিয়ে যেতে।’
‘হসপিটাল?’ হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক।
‘হ্যাঁ। ওর লিভার আর ফুসফুস, দুটোই একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আর এটা অনেকদিন ধরেই হচ্ছে, উনি তোমাদের জানাননি। তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি ওষুধ দিচ্ছি, রাত্রে ঘুমুবে, ব্যথাটাও কমবে। কিন্তু এটা নেহাতই টেম্পোরারি রিলিফ। তুমি আমার চিঠি নিয়ে হসপিটালে যেও কোন অসুবিধে হবে না।’ কথা শেষ করে ডাক্তার হাঁটতে শুরু করলেন। অর্কর ভেতর তখন তোলপাড় হচ্ছিল। মায়ের যে খুব বড় একটা অসুখ হয়েছে এটা স্পষ্ট। সে কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবু, মা ভাল হয়ে যাবে তো?’
‘ভাল হবেন না কেন? অসুখ আছে আবার তার ওষুধও আছে। বাড়িতে যে সেবাযত্ন করা দরকার, যে ওষুধপথ্য প্রয়োজন তা তোমার একার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই আমি ওঁকে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলছি। তবে এসব কথা যেন ওকে বলো না।’
‘কিন্তু হসপিটালে তো চিকিৎসা হয় না।’
‘কে বলল?’ ডাক্তারবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন।
‘সবাই বলে। আমার মাকে আপনি বাঁচিয়ে দিন ডাক্তারবাবু।’
‘সবাই বলে স্কুলে পড়াশুনা হয় না। তবু শিশুদের আমরা সেখানে পাঠাই। তাদের অনেকেই ভাল রেজাল্ট করে বের হয়। অতএব অন্য লোক কি বলল সেকথায় কান দিয়ে লাভ নেই। তোমার মাকে বাঁচাতে হলে হসপিটালে নিয়ে যাবে।’
ঈশ্বরপুকুরে পা দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তোমার মায়ের যে প্রায়ই জ্বর আসতো, পেট ব্যথা করত, তোমরা জানতে না?’
‘না। জলপাইগুড়িতে আমরা বেশ কিছুদিন ছিলাম। তখন যদি—।’
‘না না এ অন্তত মাস কয়েক ধরে চলছে।’
চেম্বারের ভিড় যেন ডাক্তারবাবুকে দেখে স্বস্তি পেল। চেয়ারে বসে একটা কাগজে তিনটে ওষুধের নাম লিখে কম্পাউণ্ডারকে বললেন, ‘ওকে এখনি দিয়ে দাও। কেসটা ভাল নয়।’ তারপর আর একটা চিঠি লিখে বললেন, ‘এটা নিয়ে কাল সকালেই চলে যাবে। মাকে ভর্তি না করে অন্য কাজ নয়। ওই ওষুধগুলো এখনই খাইয়ে দাও। সারা রাতে আর বিরক্ত করার দরকার নেই।’
অর্কর মনে পড়ল ডাক্তারবাবুকে ফি দেওয়া হয়নি। মায়ের কাছে টাকা চাইতে হবে। সে বলল, ‘ডাক্তারবাবু আপনার টাকাটা নিয়ে আসি—।’
চোখ তুলে দেখলেন ভদ্রলোক, ‘হ্যাঁ দিতে তো হবেই। তবে কাল দিলেই হবে। হসপিটাল থেকে ফিরে এসে দেখা করবে আমার সঙ্গে।’
ডাক্তারবাবু এবার অন্য রোগীদের দেখতে আরম্ভ করলে অর্ক সরে আসতেই ঝুমকি বলল, ‘কার কি হয়েছে?’
‘আমার মায়ের, জ্বর আর পেটে ব্যথা।’
‘হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল?’
‘হ্যাঁ। ঝুমকির সঙ্গে কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছিল না অর্কর। কিন্তু কেউ যদি গায়ে পড়ে প্রশ্ন করে জবাব না দিয়েও থাকা যায় না।
‘খুব জ্বর?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার বাবা তো এখানে নেই!’
‘কে বলল?’ অবাক হল অর্ক।
‘আমি জানি।’
এই সময় কম্পাউণ্ডার এসে ঝুমকিকে ওষুধ দিতে সে বলল, ‘বাবার খুব টান বেড়েছে। চলি।’ অর্ক লক্ষ্য করল ঝুমকির উপস্থিতি অন্য সবার নজর কেড়েছে। সবাই টেরিয়ে টেরিয়ে ওকে দেখছিল। বছর খানেক আগেও বোধহয় এরকম হতো না। এই সময় কম্পাউণ্ডার ডাকতেই অর্ক এগিয়ে গেল।
ওষুধ নিয়ে রাস্তায় নামতেই অর্কর শীতবোধ হল। সমস্ত শরীর সিরসির করছে। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। মা যদি আর ফিরে না আসে? না, অসম্ভব, সে প্রায় দৌড়েই গলিতে ঢুকল।
দরজা ঠেলতেই অর্ক অবাক হয়ে গেল। মাধবীলতা স্টোভ জ্বালিয়েছে। অর্ক আঁতকে উঠল, ‘তুমি কি করছ?’
সাদা মুখে মাধবীলতা হাসল, ‘খেতে হবে তো।’
‘তুমি ওঠো।’
‘কি আশ্চর্য! আমার এখন ভাল লাগছে। আমি তোকে ডিমটা করে দিচ্ছি।’
‘তোমার ভাল লাগছে?’
‘হ্যাঁ! দ্যাখ, মনে হচ্ছে জ্বরটাও কম। তুই মিছিমিছি ডাক্তার ডাকতে গেলি। ডাক্তারকে টাকা দিয়েছিস?’ কথা বলতে বলতে মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল।
অর্ক দ্রুত পায়ে মায়ের কাছে চলে গেল। তারপর দু-হাতে মাধবীলতাকে জোর করে দাঁড় করাল, ‘আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না, তোমাকে এখন শুয়ে থাকতে হবে। তুমি এই শরীর নিয়ে রান্না করছ?’
মাধবীলতা বাধা দিতে চেষ্টা করেও পারল না। ছেলের শরীরের শক্তির কাছে সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ল। আর অর্ক অবাক হয়ে দেখল মায়ের শরীর কি হালকা, একরত্তি ওজন নেই যেন। সে মাধবীলতাকে খাটের কাছে নিয়ে এসে বলল, ‘তুমি ওপরে শোও।’
দ্রুত মাথা নাড়ল মাধবীলতা, ‘না!’
শুধু অসম্মতি নয়, অর্কর মনে হল শব্দটা উচ্চারণের সময় মা যেন আরও বেশি কিছু বলতে চাইল। সে জোর করল না। মেঝেতেই আবার শুয়ে পড়ল মাধবীলতা। শুয়ে বলল, ‘শরীরটা বড় দুর্বল হয়ে গেছে রে।’
অর্ক পকেট থেকে ওষুধগুলো বের করে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে ধরল, ‘এগুলো খেয়ে নাও। তারপর চুপটি করে শুয়ে থাকো।’
মাধবীলতা হাসল, ‘বাবাঃ, তুই এমন ভঙ্গীতে কথা বলছিস যেন আমাকেই পেটে ধরেছিস। আমাকে এই ট্যাবলেট খেতে হবে?
‘হ্যাঁ। অ্যাদ্দিন তো নিজে না খেয়ে শুধু আমাদের খাইয়ে এসেছ এখন আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।’
‘এসব তোকে কে বলল?’
‘ডাক্তারবাবু।’
‘বাজে কথা। আমি তোদের সঙ্গে দু’বেলা খেতাম না? মাধবীলতা ওষুধ খেলে অর্ক তার বিছানাটা ঠিক করে দিল। তারপর মাধবীলতার মাথার পাশে বসে কপালে হাত রাখল। জ্বর আছে তবে সামান্য কম। মায়ের শরীরের স্পর্শ পাওয়া মাত্র আবার কেঁপে উঠল অর্ক। কাল সকালে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবেই। নাহলে নাকি বাঁচানো যাবে না। অর্ক মাধবীলতার শরীরের দিকে তাকাল। মাকে বাঁচাতেই হবে, যে করেই হোক।
কিন্তু এই মুহূর্তে, যখন মাধবীলতা চোখ বন্ধ করে রয়েছে, তখন তাকে হাসপাতালের কথা বলতে গিয়েও সামলে নিল অর্ক। মা নিশ্চয়ই হাসপাতালে যেতে চাইবে না। অথচ ডাক্তারবাবু বলেছেন হাসপাতালে না নিয়ে গেলে মা বাঁচবে না। যা করার কাল সকালেই করা যাবে। এখন মা ঘুমুক।
এই সময় অর্কর চোখ খাটের দিকে গেল। এবং তখনই পরিষ্কার হয়ে গেল কেন মাধবীলতা ওখানে শুতে চায়নি। খাটটা ছিল বাবার দখলে। সঙ্গে সঙ্গে অর্কর মনে হল মায়ের এইসব অসুখের জন্যে দায়ী একটি মানুষ। কিন্তু আশ্চর্য, সেই মানুষটার জন্যে মা কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে। সে নিচু গলায় বলল, ‘মা, তোমার শরীর তো ঠিক নেই, জলপাইগুড়িতে চিঠি দেব?’
মাধবীলতা কোন কথা বলল না। শুধু নিঃশব্দে তার মাথাটা না বলল।
অর্ক দেখল মায়ের বন্ধ দুই চোখের কোণে আচমকা জল ফুটে উঠল। সে সেই জলটার দিকে স্থির হয়ে চেয়ে রইল। এক ফোঁটা টলটলে জল শরীর ছেঁকে বেরিয়ে এসেছে। কেটে গেলে রক্ত পড়ে, পুড়ে গেলে ফোস্কা হয়, কিন্তু কষ্ট হলে চোখে জল আসে কেন? তাহলে মনের সঙ্গে শরীরের অবশ্যই যোগাযোগ আছে। মন খারাপ হলে শরীরও খারাপ হবে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে মায়ের শরীরের এইসব কষ্ট বাবারই দেওয়া।
হঠাৎ অর্কর খেয়াল হল মাধবীলতা জেগে নেই। ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক হয়ে থাকায় দাঁতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বুক নামছে নিঃশ্বাসের তালে তালে, নামছে উঠছে। সমস্ত শরীর থেকে একটা চাপা উত্তাপ বের হচ্ছে। পরম মায়ায় অর্ক মায়ের গালে কপালে চিবুকে হাত বোলালো। বুকের ভেতর একটা ভয় এখন তির তির করে বাড়ছে। অর্ক চোখের কোণদুটো আঙুলে মুছিয়ে দিতে গিয়ে থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে নিচু হয়ে নিজের ঠোঁটদুটো মায়ের দুই চোখের কোণে আলতো করে ছুঁইয়ে জলকণা মুছিয়ে দিল। মাধবীলতা তার কিছুই টের পেল না। ওষুধের কল্যাণে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে সে।
কতক্ষণ ওভাবে বসেছিল অর্ক জানে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ যেন একটা নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। দরজায় শব্দ হতে সে চেতনায় ফিরল। খুব সন্তর্পণে কেউ দরজাটা খুলছে, কিন্তু আওয়াজটাকে এড়াতে পারছে না। অর্ক সোজা হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’
এই সময় মুখটা দেখতে পেল সে, ‘কেমন আছে এখন?’
অর্ক যতটা অবাক তার চেয়ে বেশি গম্ভীর হয়ে গেল, ‘ভাল।’
ঝুমকিকে সে এখানে কিছুতেই আশা করেনি। অথচ ঝুমকি এখন ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণে সে মাধবীলতার শায়িত শরীরটাকে দেখতে পেয়েছে। এক পা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, ‘ঘুমুচ্ছেন?’
অর্ক মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পারছিল না কি করবে! ঝুমকিকে এই ঘরে দেখলে নিশ্চয়ই মা খুশি হবে না। তাছাড়া ঝুমকি যে জীবনযাপন করে সেটা শুনলে—! ঝুমকি জিজ্ঞাসা করল, ‘জ্বর কত?’
‘জানি না।’
‘থার্মোমিটার নেই?’
‘না।’
ঝুমকি মাধবীলতার পাশে বসে মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল, ‘উঃ, বেশ জ্বর। মাথায় জলপটি দিতে হবে। আমাকে একটা কাপড় জলে ভিজিয়ে দাও।’
অর্ক মাধবীলতার জ্বরতপ্ত ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারছিল ঝুমকি আসায় তার অসহায় ভাবটা ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। একা মাকে কিভাবে সেবা করা যায় তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। তবু সঙ্কোচে বলল, ‘থাক, আমি দিচ্ছি।’
‘সরো তো! এসব ছেলেদের কাজ নয়।’
‘তোমার বাবার তো অসুখ!’
‘এখন টান কমেছে, ঘুমুচ্ছে। কাল সকালের আগে উঠবে না। এরকম মাঝে মাঝেই হয়। তুমি একটা বাটিতে জল আর ছোট কাপড় এনে দাও। হাতপাখা আছে? ঝুমকি ঘরের চারপাশে তাকাল। তার পরে উঠে খাটের ওপর থেকে পাখা নিয়ে এসে অর্ককে সরে যেতে ইঙ্গিত করল।
একটা বাটিতে জল আর ছেঁড়া পরিষ্কার ন্যাকড়া এনে দিল অর্ক। ঝুমকি পরিপাটি করে কপালে জলপটি দিয়ে নরম হাওয়া করতে লাগল। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে অর্কর সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। মিস ডি ক্যাবারের পোশাকে নাচছে। এখন এই ঝুমকিকে দেখে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না, মেলানো যায় না।
ঝুমকির মুখ ঝুঁকে পড়েছে মাধবীলতার ওপর, এক হাতে পাখা চালাচ্ছে, অন্য হাতে কাপড়টা পাল্টে দিচ্ছে।
শেষপর্যন্ত একসময় অর্ক বলল, ‘এবার আমাকে দাও।’
ঝুমকি মাথা তুলল, ‘খেয়েছ?’
অর্ক হাসল, ‘সময় পাইনি।’
‘বাড়িতে রান্না হয়নি?’
‘না।’
‘তাহলে বাইরে থেকে খেয়ে এসো, ততক্ষণ আমি এখানে আছি।’
অর্কর এই মুহূর্তে একটুও খিদে পাচ্ছিল না। তাছাড়া ঝুমকিকে একা রেখে তার যাওয়াটাও ভাল দেখায় না। যে কোন মুহূর্তে মায়ের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। সেসময় সে না থাকলে—! তাছাড়া আর একটা ব্যাপার সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ ঝুমকি কেন এল তাদের ঘরে? শুধু মায়ের অসুখের খবর পেয়ে তার এখানে আসার কি এমন গরজ পড়ল! শেষ যখন দেখা হয়েছিল তখন ঝুমকির সঙ্গে এমন কিছু ভাল সম্পর্ক ছিল না, তাহলে? ওর মনে হচ্ছিল ঝুমকির এই আসার পেছনে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। তাছাড়া এসময় ওর পাড়ায় থাকার কথা নয়। না হয় আজ বাবার অসুখ তাই বের হয়নি কিন্তু তাহলে তো বাবার কাছেই থাকা উচিত ছিল। অর্ক কোন কূল পাচ্ছিল না।
এই সময় ঝুমকি বলল, ‘ডাক্তার তোমার মাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে, না?’
অর্ক বলল, ‘কি জানি!’
‘নিশ্চয়ই দিয়েছে। এটা স্বাভাবিক ঘুম না। তাড়াতাড়ি খেয়ে এসো, আমি এখানে সারা রাত থাকব নাকি?’ প্রশ্নটা করে ঝুমকি ঠোঁট টিপে হাসল।
এইবার অর্কর মনে হল ঝুমকি এই ঘরে আছে জানলে মা হয়তো রাগ করবে কিন্তু বস্তির অন্য মানুষের জিভ টসটসে হয়ে উঠবে। অতএব যত তাড়াতাড়ি ওকে এখান থেকে সরানো যায় ততই ভাল। সে বলল, ‘তুমি যাও, আমি বসছি।’
ঝুমকি মাথা নাড়ল, ‘উঁহু, না খেয়ে এলে আমি এখান থেকে উঠবই না।’
অর্ক অসহায় ভঙ্গীতে বলল, ‘কি আশ্চর্য!’
‘কিছুই আশ্চর্যের নয়। আমাদের বাড়িতেও সন্ধ্যেবেলায় রান্না হয়নি। তুমি খেয়ে আসবার সময় আমার জন্যে একটা হাফ পাউণ্ড রুটি নিয়ে এস। মা-মেয়েতে হয়ে যাবে। পয়সা নাও।’ ব্লাউজের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে একটা ব্যাগ বের করে বারো আনা পয়সা দিল ঝুমকি।
অর্কর আর কোন উপায় রইল না। সে পয়সাটা তুলে নিয়ে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি আজকাল সন্ধ্যেবেলায় বের হও না?’
ঝুমকি মুখ তুলে তাকাল। ওর মুখে যে ছায়া খেলে গেল সেটা অর্কর নজরে পড়ল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, ‘যাই। তবে আমার আর নাচা হবে না।’
‘কেন?’
‘আমি পারলাম না।’
অর্ক আর দাঁড়াল না। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল। এখন যে এত রাত হয়ে গেছে তা সে টের পায়নি। এমনকি তিন নম্বর পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। নিমুর দোকান বন্ধ। শুধু একটা পানের দোকান ছাড়া কিছুই খোলা নেই। হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম রাস্তায় চলে এল অর্ক। তারপর দুটো হাফ পাউণ্ড রুটি কিনে আবার ফিরে আসছিল তিন নম্বরে। আর এই সময় সে কোয়াকে দেখতে পেল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোয়া চিৎকার করছে। ওর দুটো পা মাটিতে সমানভাবে স্থির থাকছে না, শরীরটা বারংবার হেলে পড়ছে সামনে। কোয়ার সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা। বারংবার তিনি কোয়াকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু কোয়া তাঁকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। এবং সেইসঙ্গে চলছে অশ্রাব্য গালাগালি। বৃদ্ধা যে কোয়ার মা তা বুঝতে দেরি হল না এবং সেই মাকেই কোয়া একনাগাড়ে খিস্তি করে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার জন্যে এত রাত্রেও বেশ কিছু লোক জমে গিয়েছে। যাওয়ার সময় এদের এখানে দ্যাখেনি সে। এর মধ্যেই এত কাণ্ড ঘটে গেছে। অর্ককে দেখতে পাওয়া মাত্র কোয়া সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল, ‘এই যে ভদ্দরনোক, শালা ভদ্দরনোকের বাচ্চা! শালা তোর মাকে—।’
সঙ্গে সঙ্গে অর্কর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। রুটি দুটোকে পাশের রকে রেখে সে ছুটে গেল কোয়ার দিকে। তারপর পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। মিনিট দেড়েক বেধড়ক পেটালো সে কোয়াকে। ততক্ষণে আরও লোক জমেছে কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়েছিল কোয়া। অর্ক এবার বৃদ্ধার দিকে তাকাল, ‘আমি আপনার ছেলেকে মেরে ফেলতাম। ও আমার মাকে অপমান করেছে আপনি নিজের কানে শুনেছেন।’
বৃদ্ধা পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছেলের মার খাওয়া দেখছিলেন। এবার বললেন, ‘তুমি ঠিক করেছ বাবা।’
অর্কর মাথায় আগুন জ্বলছিল। সে কোয়াকে আবার টেনে তুলল, ‘অনেক সহ্য করেছি। এই ঈশ্বরপুকুরে যে শালা মাল খেয়ে মাতলামি করবে আর খিস্তি দেবে তাকে আমরা পুঁতে ফেলব। তোর মনে থাকবে? তুই মাস্তান হচ্ছিস হয়ে যা, কিন্তু মাতলামি আর খিস্তি করা চলবে না।’
সেই অবস্থায় কোয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘কেউ মাতলামি করবে না?’
‘না। কাউকে আমি মাতলামি করতে দেব না।’
‘ঠিক হ্যায়। আমি তোর সঙ্গে আছি। মালের ঠেকগুলো সব আমাকে কলা দেখাচ্ছে। সবকটাকে তুলে দিতে হবে।’ কোয়া টলছিল।
অর্ক বলল, ‘আমি কালকে তোর সঙ্গে কথা বলব।’ তারপর রুটিদুটো তুলে নিয়ে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। তার শরীর ঘিন ঘিন করছিল। সে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করল একটা দল গড়বে। এই ঈশ্বরপুকুর থেকে মাল খেয়ে মাতলামি করা বন্ধ করতেই হবে। তারপরেই খেয়াল হল কোয়া নাকি এখন খুব বড় মাস্তান। অথচ অমন মার খেয়েও সে প্রতিবাদ করল না। কি ব্যাপার?
ঘরে ঢুকে অর্ক দেখল ঝুমকি ঢুলছে। তার হাত থেকে পাখা পড়ে গিয়েছে, মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। মাধবীলতা এখনও অসাড়ে ঘুমুচ্ছে। অর্ক ডাকল, ‘এই ঝুমকি, বাড়ি যা।’
ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল ঝুমকি। তারপর লজ্জিত ভঙ্গীতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অর্ক তার পিছু ডাকল, ‘তোর রুটি।’