৪৫. এত দূর ছিল

৪৫

দেবাশিস বলতে লাগল—এত দূর ছিল? এত দূর?

সে ভাবতে চাইল না, দেবোপম কেন মারা গেল। বুঝতে চাইল না, সম্পর্ক কতখানি গভীর হলে কেউ আত্মোৎসর্গ করে এবং ততখানি গভীরতা শিঞ্জিনী ও দেবোপমের মধ্যে কেমন করে হওয়া সম্ভব!

লক্ষ্মী বলতে লাগলেন—ছি ছি ছি! একই পাড়ায় বন্ধুতে বন্ধুতে, এ কী কেলেঙ্কারি! মুখ দেখাবার উপায় রাখল না।

তিনিও বুঝতে চাইলেন না, পুরী থেকে ফিরে জিনি একটি দিনও বাড়ি থেকে কোথাও যায়নি। দেবোপমের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ বজায় রাখেনি। তাঁর মধ্যে কুটিল সন্দেহ প্রশ্রয় পেয়েছিল। এখন লালিত হতে লাগল। তিনি বলতে লাগলেন, প্রতিষ্ঠা করতে লাগলেন, প্রেম অতি দুর্বার, যদি তা অবৈধ হয় তবে অপ্রতিরোধ্য, তা অসততা জড়িত, তাই অশ্লীল—কে জানে, তারা টেলিফোনে যোগাযোগ রাখত কি না। যখন বাড়িতে জিনি ছাড়া অন্য কেউ নেই তখন সেই ছেলে এসেও পড়ত কি না। হ্যাঁ, অন্ধর মা থাকে বটে তখন। কিন্তু গরিব বস্তিবাসী সে, অভাবী। তার মুখ বন্ধ করতে কতক্ষণ!

এমনকী বিকাশও ভাবতে লাগলেন—আর সন্দেহ রইল না। এতটুকু সন্দেহ রইল না।

পাড়া-প্রতিবেশী—যারা আগেই লক্ষ্মীর মুখে কিছু কিছু শুনেছিল, তেমন আমল দেয়নি, তারা বিস্ময়ে ও করুণায় তাকাতে লাগল জিনির জানালার দিকে। মেয়েটিকে দেখা যায় কি? সে কি কাঁদছে? সেও কি ভাবছে মরে যাবে কি না! এই অপূর্ব অবৈধ প্রেম, এই প্রেমিকের আত্মাহুতি, মেয়েটিকে কেমন রেখেছে! কেমন!

দেবাশিস খোঁজও নিতে যায়নি। মাথা নিচু করে হেঁটেছে রাস্তায়। ভাবছে। মেলাতেও পারছে না। তা হলে কি আরও বেশি ছিল? আরও কিছু? শিঞ্জিনীকে পুরোপুরি অধিকার করেছিল দেবোপম? জিনির প্রত্যেকটি ‘না’ দেবাশিসের কাছে চাবুক প্রতিভাত হয়। প্রত্যেক রাত্রির শীতলতা উন্মাদ করে তাকে। প্রেমের মতো—অবৈধ অবাধ্য প্রেমের মতো সহজ সরল বিষয় পেয়ে দেবোপমের মৃত্যুর কারণে কোনও সুস্থ খোঁজ ও যুক্তি আলোচিত হয় না। দেবোপম যদি সত্যিই জিনির জন্য আত্মহত্যা করে থাকে তবে এই হননের প্ররোচনা কখন রচিত হল! কখন বোঝা গেল জিনি, দেবোপমের জন্য তেমন লভ্য নয় যে আত্মহনন বিনা গতি নেই! এই অল্প সময়ে এমনকী সম্পর্কটিকে জীবন-মরণ করে তোলা এমনই সম্ভব! ভাবে না কেউ। আর দেবোপম অবৈধ প্রেমিক হয়ে যায়। আর লক্ষ্মী ছেলেকে কাছে বসিয়ে আহা-উঁহু করেন। তোর কী কষ্ট বড়খোকা—বলেন! বলেন না—এ রকম ভাবতে নেই। এ রকম করতে নেই।

আর জিনি নিজে নির্বাক রয়ে গেছে। সে প্রেমও জানে না। বৈধতা অবৈধতা জানে না। তার ও দেবোপমের মধ্যে সম্পর্কের কথা জানে না, শুধু মনে পড়ে ওই সমুদ্রস্নান, ওই বমিলিপ্ত পোশাক খুলতে থাকা একটি পবিত্র মুখ মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া প্রশান্ত মুখ। মনে পড়ে অন্ধকারে গভীর উচ্চারণ—

… …সে এক বিস্ময়।

পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল,

চেনে নাই তারে ঐ সমুদ্রের জল;

রাতে-রাতে হেঁটে হেঁটে নক্ষত্রের সনে

তারে আমি পাই নাই; …

এরপর এক টুকরো মুহূর্ত, যখন তার চোখে চোখ রেখেছিল জিনি। মনে পড়ে না কিছুই। কী ছিল চোখে? মনে পড়ে না। জিনি তো খোঁজেনি। একটুও খোঁজেনি। সে আপনি যতটুকু ধরা দিয়েছিল তার মধ্যে মৃত্যু ছিল না কোথাও। অত সততায়, অত পবিত্র ইচ্ছায় মৃত্যু কোথায় স্থান পাবে? সুন্দর মৃত্যুকে কোলে নিতে পারে না কখনও। জিনির বিশ্বাস হয় না দেবোপম আত্মহত্যা করেছে। তার পকেটে একটি কাগজ ছিল। লেখা—

কেউ দায়ী নয়।

পৃথিবীর সমস্ত মৃত্যুর নাম

লিখে দেয় জনক-জননী

আমিও তেমন মৃত্যু

জিনি বিশ্বাস করে না তবু। কেউ দায়ী নয়। মৃত্যুর জন্য কেই-বা দায়ী থাকে। যে মরে সে নিজেও নয়। তার হাতে দুধের ক্যান ছিল। আঁকড়ে ছিল সে।

সমস্ত জগৎ স্তব্ধ হয়ে থাকে। নির্বাক হয়ে থাকে। জিনির সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন বিকাশ লক্ষ্মী দেবাশিস। অথবা শুধু কথা, শুধু দোষোরোপ, শুধু ছিছিক্কারে আকাশ ভরে যায়। জিনি জানালা খুলে চেয়ে থাকে। সে জানত না অবিশ্বাস কী—জেনেছে। সে জানত না প্রেমহীন সঙ্গম কী—জেনেছে। সে জানত না এই দোষারোপ ছিছিক্কারের কত দুর্বহ ভার—জানছে এখন। সমস্ত আগামীকাল শূন্য হয়ে গেছে। এই বেঁচে থাকা মৃত্যুর মতো। এই দিনযাপন মৃত্যুর যাপন। সে মনে মনে মার কাছে চলে যায়। আগরতলার পথে-ঘাটে ফ্রক পরে দু’ বিনুনি বেঁধে ঘোরে। তার স্কুলের ইংরিজি দিদিমণির স্বর মনে পড়ে—

Fair is foul, and foul is fair,

Hover through the fog and filthy air

মনে পড়ে ইউনিভার্সিটির কথা। এস. পি. জি. স্যরের ভরাট কণ্ঠ—

একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;

হৃদয়ের পথ-চলা শেষ হলো সেই দিন—গিয়েছে সে শান্ত হিম ঘরে,

অথবা সান্তনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল—পৃথিবীর এই মাঠখানি

ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন; এ মাঠের কয়েকটা শালিখের তরে

আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি চেয়ে র’বো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে, …

সে ভুলে যায়, ক্রমশ ভুলতে থাকে, কবিতাই শুধু নয়, সঙ্গীতই শুধু নয়, মৃত্যুর চেয়েও আরও বেশি অন্ধকার দাবি নিয়ে ছুটে আসে মানুষেরা। অধিকার চায়। কেউ খেতে ডাকল না, শুধাল না কেউ—খিদে পায়নি জিনি? খাবে না? কিন্তু অভুক্ত মেয়েটিকে ধাক্কায় শুইয়ে দিল পুরুষ। অধিকার চাই, তাই সে প্রায় নগ্ন হয়ে গেছে, এক টানে খুলে ফেলছে শাড়ি। চূড়ান্ত অনিচ্ছায় ভীত হয়ে পালাতে চাইছে জিনি। আঁচড়ে-কামড়ে দিচ্ছে। অসম্ভব মানসিক প্রতিরোধ থেকে চলে যাচ্ছে শারীরিক প্রতিরোধের দিকে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য সে, দরজা খুলে ছুটে যাচ্ছে পথ দিয়ে শায়া ও ব্লাউজ পরা অবস্থায়। খোঁপা খোলা, চোখ দু’টি বিস্ফারিত, ঢুকে পড়ছে মিথিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সেতারির বাড়ি। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে— কাকিমা! দরজা খুলুন কাকিমা!

সেতারির স্ত্রী দরজা খুলছেন—এ কী এ অবস্থায়!…ঘরে এসো জিনি!

তিনি জিনিকে জড়িয়ে ধরছেন। জিনি কাঁপছে—ওরা আমাকে মেরে ফেলবে কাকিমা। আমি যাব না। আমি আর ওই বাড়ি যাব না।

সেতারি স্ত্রীর শাড়ি এনে তুলে দিচ্ছেন স্ত্রীরই হাতে। বলেছেন—‘ঢাকো ওকে। ঢেকে দাও। হে ঈশ্বর! এ সব কী?’ আপন নগ্নতা ঢাকতে ঢাকতে এসে পড়েছে দেবাশিস। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন লক্ষ্মী আর বিকাশ। আর কিছু রইল না। আর কিছু বাকি রইল না।

দেবাশিস নরম করে বলছে—চলো।

ভীত চোখে দেখছে জিনি৷ বলছে—আমি যাব না কাকিমা।

সেতারির স্ত্রী জিনির হাত দেবাশিসের হাতে তুলে দিচ্ছেন। তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। তবু দিচ্ছেন। কোন অধিকারে রাখবেন মেয়েটিকে? কোন সাহসে? তাঁর প্রত্যয় হচ্ছে, মেয়েটি পাগল, সত্যিই পাগল। এঁরা এতদিনের প্রতিবেশী। কেমন করে এঁদের অবিশ্বাস করেন!

জিনি ফিরে যাচ্ছে। দেবাশিসের শক্ত হাতে ফিরে যাচ্ছে। সে-দিনের মতো আলো নিভেছে বিকাশের পরিবারে। কিন্তু ভোর হল। অপ্রতিরোধ্য শাস্তি পাওয়ার ভোর। দেবাশিস রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড চাপিয়ে দিল। পুরুষ কন্ঠে সাবলীল বাজতে লাগল—

কোলাহল তো বারণ হল

এবার কথা কানে কানে

দেবাশিস গর্জন করে উঠল—কেন গিয়েছিলে? কাল কেন গিয়েছিলে?

লক্ষ্মী চড় মারলেন জিনির গালে। বলতে লাগলেন—আমাদের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিলে?

হাওয়া এসে ফরফর উড়িয়ে দিল কাগজ। দেবার্চনের তত্ত্ব লেখা খাতার অস্পৃশ্য পাতাগুলি। বিকাশ গাছের যত্ন নিতে বা বস্তিতে নলকূপ বসানো যায় কিনা এ বিষয়ে তদ্বির করতে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। ওইসব চড় মারার শব্দ বা ওইসব শাসানি ও গর্জন তিনি শুনতে পাননি ভঙ্গিতে হাত রাখলেন জারুলগাছের ডালে আর তা থেকে শুকনো পাতা খসে পড়ল। আর জিনি ওইরকম খসে পড়া পাতার মতো লুটিয়ে কাঁদতে লাগল। নীরব কান্না নয়। উচ্চরবে, নিজেকে ভুলে, জগৎসংসার ভুলে—অন্ধর মা সেই কান্না দেখল আর শুনল, পাড়া-প্রতিবেশী শুনল কিন্তু দেখল না। লক্ষ্মী বললেন—মুখ আটকা। মুখ আটকা বড়খোকা, কীরকম কাঁদছে দেখ। কেলেঙ্কারী করে ছাড়বে। …দেবাশিস লাফিয়ে উঠছে। রেকর্ড প্লেয়ারের আওয়াজ বড় করে দিচ্ছে। গান বাজছে—আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে/চেয়েছিলেম চেয়ে থাকা তারার সাথে… কান্না মিলিয়ে যাচ্ছে গানে। সুরে সুর মিলছে। আর দেবাশিস ভোয়ালে দিয়ে মুখ বেঁধে দিচ্ছে জিনির। লক্ষ্মী চড় মারছেন। সশব্দে। সবলে। বলছেন—চুপ। চুপ। চুপ।

দুপুরবেলা, যখন বাড়িতে কেউ নেই, জিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অন্ধর মা। তার চোখ থেকে জল পড়ছে। সে খেটে খাওয়া মানুষ এক, ধমক খাওয়া, উচ্ছিষ্ট খাওয়া মানুষ। তারও মেয়েরা সংসার যাপন করছে। দারিদ্রের সঙ্গে লড়ছে। কিল খাচ্ছে। কিল হজম করছে। দিচ্ছেও। আর অন্ধর মা নিজে পরম মমতায় উপার্জন করে ভাত তুলে দিচ্ছে অসুস্থ স্বামী আর বৃদ্ধা শাশুড়ি ও অন্ধ ছেলের মুখে। সে যখন ফিরে যায় ঘরে, শাশুড়ি কাঁপা কাঁপা হাতে আলুচচ্চড়ি আর ভাত ধরে সামনে। একটু কাঁচকলার খোসা বাটা, বলে—‘খাও। প্যাটটা ভইরা খাও। না খাইলে বাঁচবা না। গতরে খাটো, খাও শান্তি কইরা।’ সে খায়। স্বামী বাঁচবে না। তবু খায়। ছেলে অন্ধ। তবু খায়। যেহেতু দু’মুঠো শান্তির ভাত দেয় কেউ—। সে মমতাময়ী হয়ে জিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে—বউদি, চইলা যান বাপের বাড়ি। মার কাসে থাকেন গিয়া।

—না, না, যাব না আমি অন্ধর মা। ওরা ভাববে আমি পালিয়ে গেলাম। ওরা মাকে সব বলে দেবে। সে আমার সহ্য হবে না। আমি কি বিশ্বাস নষ্ট করেছি অন্ধর মা? আমি অন্যায় করেছি? মা কি বুঝবে আমি কিছু করিনি?

—আপনে মইরা যাইবেন, বউদি, আপনেরে মাইরা ফালাইব।

—না, না অন্ধর মা। শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলবে না আমাকে। বলো, মেরে নিশ্চয়ই ফেলবে না।

সে ভূতগ্রস্তের মতো উঠে বসে। লাল হয়ে থাকা গাল, হাড় উঁচু হয়ে থাকা, চোখের কোলে কালি—বলে যায়—

Go to, go to; you have known what you should not.

She has spoke what she should not, I am sure of that. Heaven knows what she has known.

Here’s the smell of the blood still; all the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand. O, O, O.

অন্ধর মা কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু বস্তিতে ফিরে কথা রটিয়ে দিচ্ছে। বউটাকে মেরে শেষ করে ফেলল, রটিয়ে দিচ্ছে, আর সব কামেলি মেয়ে-বউরা পাড়ায় পাড়ায় কর্ত্রীদের কাছে গল্প রটাচ্ছে। কর্ত্রীরা শুনছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। বলছেন, ‘এ বাড়াবাড়ি, একটা ছেলে কী মরল, কেন মরল, বউটাকে কেন শাস্তি দিচ্ছে।’ কিন্তু কেউ খোঁজখবর করছে না। নাগরিক রুচি ও শিক্ষা। নাগরিক সংস্কার। নাগরিক বিশ্বাস। পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ো না। আগুন লাগলেও না। ওতে ব্যক্তিগত জীবনযাপন ব্যাহত হয়। কিন্তু আর্তনাদ যদি চার দেওয়ালে আটকে না থাকে, যদি বেরিয়ে আসে রাস্তায় তবে তা আর পারিবারিক থাকে না, ব্যক্তিগত থাকে না, সামাজিক হয়ে যায়। কিন্তু সমাজ বোবা-কালা-অন্ধ। তার অসাড় চেতনা জাগে না। নির্লিপ্ত মানুষ অত্যাচারের শব্দ শুনতে শুনতে অন্ন মুখে তোলে। পাশের বাড়ির ছেলেটাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। আহা! ওর মা কী করে বাঁচবে গো—বলতে বলতে অন্ন মুখে তোলে। বলতে বলতে নিজের ছেলের জন্মদিন পালন করে শাঁখ বাজিয়ে। পাশের বাড়িতে তরুণী বধূর কান্না শোনা যায়। শিল্পী মানুষ, গুণী মানুষ চোখ বন্ধ করে সেতারে মারোয়া লাগান। আর লক্ষ্মী জিনিকে কামারহাটির পীরবাবার থানে নিয়ে যান। সংসারের কল্যাণে, ছেলের কল্যাণে সাধক সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যান। সন্ন্যাসী রক্তলাল চোখে গম্ভীর মুখে বলেন—‘হুম— বশীকরণ চাই—এ রকম কেস কত করেছি—এমন মন্ত্র দেব, ছেলের পায়ে লুটোবে।’ তিনি ছক কাটেন। আঁক কাটেন। জিনির চোখ পরীক্ষা করেন। চুল দেখেন। জিনি ভয় পায়। কাতরায়। উদ্বেগে কাঁপে। সেই মুহূর্তে এমনকী শাশুড়িকেও বড় আপন লাগে তার।

সন্ন্যাসী বলতে থাকেন—নারী চিত্রিণী, নারী তরুণী, হেমন্তে তরুণী ভোগ্যা, সদ্ভাবে আরব্ধ গাঢ়, উদ্ভট মৈথুনে হৃষ্টা, রাত্রির প্রথম প্রহরে তুমি স্বামীতে গমন করবে, মোচার রসের সঙ্গে জাতিফল ও পান ভক্ষণ করবে।

সন্ন্যাসী জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা বৃদ্ধি করে জিনির চোখের সামনে ঘোরাতে থাকেন। ভুল উচ্চারণে মন্ত্র পাঠ করেন। জিনি সেই উচ্চারণ অশুদ্ধতা উপলব্ধি করে কিন্তু শুনে যায় প্রতিরোধহীন—

তৎক্ষণং দীয়তে চন্দ্রো মোহমায়াতি কামিনী।

শয়নে বা প্রসঙ্গে বা পিবা।

জিনির চোখের সামনে থেকে সারা পৃথিবী উধাও হয়ে যায়। সন্ন্যাসী তাকে একটি ছোট পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। পিঁড়িটি ঘুরতে থাকে। জিনি তাকায়। একটি ঘূর্ণায়মান আলোকচক্র তার চেতনাকে সামগ্রিক অধিকার করে। সে শুধু শুনতে পায়—

যঃ সূর্য্যেণ পিবেচ্চন্দ্রং স ভবেম্মকরধ্বজঃ।

শিবলিঙ্গতে শক্ত্যা প্রসঙ্গে দক্ষিণেহপি বা।

তৎণাদ্দাপয়েদ্ যস্তু মোহয়েৎ কামিনীশতম্।

তার জ্ঞান লুপ্ত হতে থাকে। সে সমস্ত বিস্মৃত হয়ে যায়। ঘুমে জাগরণে ভয়ঙ্কর আলো তাকে তাড়া করে ফেরে। শিঞ্জিনী নামের সহজ সরল কবিতা-পাগল মেয়ে ক্রমে উন্মাদিনী হয়ে যায়। বিকাশ বিপর্যস্ত বোধ করেন। জিনির মা ফোন করেন—জিনি—

লক্ষ্মী বলেন—জিনি অসুস্থ। শুয়ে আছে।

—কী হয়েছে?

—তেমন কিছু না। শুয়ে আছে।

—ফোন ধরতেও পারবে না?

লক্ষ্মী রিসিভার নামিয়ে রাখছেন।

জিনির বড়দাদা, মেজদাদা, ছোড়দাদা ফোন করছেন—

—জিনি কই, জিনি—

জিনির সাড়া নেই। দেবাশিস ফোন ধরে না। বিকাশ ফোন ধরেন না। তাঁরা পিসিকে খবর দেন। অধ্যাপিকা পিসি ছুটতে ছুটতে আসেন। এতদিন আসেননি, ফোনে খোঁজ নিয়েছেন, অনূঢ়া অধ্যাপিকা পিসি নববিবাহিতা ভাইঝির সংসারে আসতে লজ্জা পেতেন। এবার এলেন। প্রত্যেকের শীতল ব্যবহার। জিনি শুয়ে আছে। অস্থিসার। পিসি বললেন—কী রে?

আলোর ফাঁদ সরে যাচ্ছে জিনির চোখের সামনে থেকে, বলছে—ও আমাকে খুব ভালবাসে পিসি। তোমরা ভয় পেয়ো না।

সে আবার উচ্চারণ করে—Here’s the smell of the blood still; all the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand. O, O, O.

—কী বলছিস জিনি?

—ভালবাসে! খুব ভালবাসে!

—কে?

—ও। আমাকে বলেছে, অন্য একটা বাড়িতে নিয়ে যাবে।

—কে নিয়ে যাবে? কোথায়?

জিনি উত্তর দেয় না। শূন্য হয়ে যায়। বোবা হয়ে থাকে। লক্ষ্মী পিসিকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে যান। প্রচুর চা-জলখাবার সাজিয়ে জিনির চরিত্র সম্পর্কিত কটুবাক্য পরিবেশন করেন। পিসির গলা বন্ধ হয়ে যায়। চোখে জল আসে। ভাইঝির শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। ফোন করেন—তোমরা তাড়াতাড়ি এসো। আমার ভাল ঠেকছে না।

তখন, শিবতোষ ডাক্তারের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ে দেবাশিস। ডাক্তার তাকে মসৃণ কন্ডোমের সন্ধান দিয়েছিলেন। এখন স্ত্রীকে সুস্থ করার ওষুধের সন্ধানও দিয়ে ফেলেন একরকম। সাধারণ এম বি বি এস ডাক্তার। দারুণ ব্যস্ত কেন-না এলাকায় ডাক্তার অপ্রতুল। তিনি রোগিণীকে না দেখে ওষুধ মনস্থ করেন। ব্যবস্থাপত্র না করে একটা চিরকুটে ওষুধের নাম লিখে দিতে দিতে বলেন—ওভারডোজ যেন না হয়। সাবধান।

ব্রজগোপাল ওষুধের নাম পড়েন। প্রশ্ন করেন—কে খাবে?

—আপনার বউমা।

—বউমা?

ব্রজগোপাল ভ্রূ কুঁচকে ভাবছেন। পরেশবাবুর ছেলেকে জড়িয়ে নানা কথা আলোচনা হচ্ছে বিকাশের বউমাকে নিয়ে। বিকাশকে তিনি কোনও প্রশ্ন করেননি। ইদানীং তাঁর আসাও কমে গেছে। শুনেছেন, মেয়েটি পাগল। তাকে দেখে ব্রজগোপালের তা মনে হয়নি। তিনি ভাবেন, কে জানে, মানুষকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না। তিনি ওষুধ বার করে দেন। এ ওষুধের জন্য অতিরিক্ত অনুমতিপত্র করাতে হয়। ব্রজগোপালের সে কাগজপত্র নেই। তবু, দেবাশিস পুরনো বন্ধুর ছেলে, প্রতিবেশীর ছেলে, ব্রজগোপালের ছেলের বন্ধু, তিনি নিশ্চিন্ত মনে ওষুধ দিয়ে বলেন—ডাক্তার কে? প্রেসক্রিপশন কোথায়?

—শিবতোষদা দিয়েছেন।

—অ।

আবারও নিশ্চিন্ত বোধ করেন ব্রজগোপাল। শিবতোষ পাড়ার ছেলে। পাড়ার ডাক্তার।

দেবাশিস ওষুধ নিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবে—ওভারডোজ যেন না হয়।

বাড়ি ফিরে মাকে ওষুধ দেখায় সে। বলে—ভাল হয়ে যাবে। শিবদা বলল। তবে ওষুধটা কড়া। ওভারডোজ যেন না হয়।

লক্ষ্মী ছেলের দিকে তাকান। বলেন—ক’দিন ছুটি নে। বাড়িতে থাক। নিজে ওষুধ খাওয়া বউকে। দেখিস্, ওভারডোজ না হয়।

এবং ওভারডোজ হয়ে যায়। দেবাশিস ছুটি নেওয়া সত্ত্বেও নিজে সতর্কভাবে ওষধ খাওয়ানো সত্ত্বেও ওভারডোজ হয়ে যেতে থাকে। অন্ধর মা দেখতে পায়—বউদিমণি কীরকম নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকছে আজকাল। নড়ে না। কথা বলে না। শুধু চোখ চেয়ে থাকে। চোখের পাতাও পড়ে না। বউদিমণিকে ডাক দিয়ে দু’টি কথা বলার ইচ্ছা হয় তার, কিন্তু দেবাশিস সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো আগলে রাখে জিনিকে। এবং সে দেখতে পায়, এক সন্ধ্যায় উদ্‌ভ্রান্ত দুই দাদা ও পিসি এ বাড়িতে উপস্থিত হলেন। আদরের বোনকে দেখে বড়দাদার বুকে ব্যথা করতে লাগল। তিনি মেঝেতে বসে পড়লেন। মেজদাদা দেখলেন জিনি প্রায় জীবন্মৃত হয়ে আছে। দেবাশিস ও লক্ষ্মী সবিনয়ে জানালেন—জিনির চরিত্রলক্ষণ ভাল ছিল না। পাগলামি ও বিকৃতি দুই-ই দেখা দিয়েছিল। তাকে শান্ত করার জন্য, ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার। মেজদাদা ট্যাক্সি ডাকেন। দুই ভাই ও পিসি মিলে ধরাধরি করে নার্সিংহোমে নিয়ে যান। লক্ষ্মী, বিকাশ বা দেবাশিস এই নিয়ে যাওয়া কালে সঙ্গী হন না কেউ। ডাক্তার গম্ভীর হয়ে যান। তৎপর চেষ্টা করেন তিনি। তারপর জীবনের ডাক্তার মাথা নাড়েন। কিছু করার নেই। সমস্ত আধুনিক প্রচেষ্টা ও পর্যাপ্ত প্রার্থনা এড়িয়ে মরে যায় জিনি৷

বড়দাদা থানায় ছুটে যান। বোনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের করেন। মেজদাদা পার্টি অফিসে ছুটে যান। পিসি করুণ মিনতি করেন। তৃণাঙ্কুর ও নীলিমার বাড়ির তলায় পার্টি অফিসে গোলমাল বেঁধে যায়। আনিসুজ্জামান, নীলোফা, নীলিমা ও তৃণাঙ্কুর নেমে আসেন। পিসি তৃণাঙ্কুরকে দেখে কাঁদেন। তৃণাঙ্কুর তাঁরই কলেজের অধ্যাপক, এখানে থাকেন, তিনি জানতেন না। সি পি এম নেতা শ্যামাকান্ত ক্ষেপে ওঠেন। তাঁর সহকর্মীরা গর্জে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ধিক্কার দিতে দিতে বিকাশের বাড়ি ঘেরাও করে পাড়ার লোক। ব্রজগোপাল আপনি বাঁচতে আরও লোক খেপিয়ে দেন। বলেন—শিবতোষ ডাক্তারই জিনিকে মেরে ফেলার ওষুধ দিয়েছে। এবং জানাতে ভোলেন না—সে ওষুধ তাঁর কাছে চাওয়া হয়েছিল। তিনি দেবার অক্ষমতা জানিয়েছেন। তোক শিবতোষের বাড়ি ঘেরাও করে। মল্লিনাথ ডাক্তারের মতো সদাশিব নয় বলে শিবতোষের জনপ্রিয়তাও নেই। তাঁর বাড়িঘরে নির্মম ভাঙচুর হয়। গণপ্রহারে বিধ্বস্ত হন শিবতোষ। তাঁর নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। সারা মাথুরের গড়, সারা ফটিকবিল বস্তির মানুষ, উদ্বাস্তু কলোনির সব, ভদ্রজনবেশে খুনি দেখতে ছুটে আসে বিকাশের বাড়ির কাছে। জিনি মরে গিয়ে করুণ ঝরায়। মানুষকে প্রতিবাদী করে।

প্রতিবাদী মানুষ পুলিশের কাছে বধূহত্যাকারীকে গ্রেফতারের আর্জি জানায়। মূল দরজা বন্ধ করে লক্ষ্মী ক্রমাগত বিকাশকে বলেন—ফোন করো। মিনিস্টারকে ফোন করো।

বিকাশ কোনও কথা না বলে ছোটছেলের ঘরে চলে যান। কাচ ভেঙে যাওয়া ছবিটি বার করে বলেন—অন্যায় করেছি, না? পাপ করেছি, না? পাপের শাস্তি নিলে তুই আমাকে ক্ষমা করবি তো ছোটখোকা?

ছেলের কপালে চুম্বন করে বেরিয়ে আসেন বিকাশ। দরজার ছিটকিনি খুলে দেন। সামনে পুলিশ। ওরাই দেবার্চনকে হত্যা করেছে। ওদের কাছে সরাসরি যেতে পারবেন না বলে বিকাশ প্রণবেশকে নিয়ে থানার সামনে থেকে চলে এসেছিলেন একদিন। ওদের সঙ্গে মুখোমুখি হবেন না বলে মাদকাসক্ত ছেলেদের ধরিয়ে দেবার জন্য ফোন করে খবর দিয়েছিলেন তিনি, তারা সব ছাড়া পেয়ে মাদক ছেড়ে মদ সেবন করে এখন। আর বিকাশ পুলিশের মুখোমুখি হন শেষ পর্যন্ত। বলেন—চলুন।

একে একে বেরিয়ে আসেন লক্ষ্মী আর দেবাশিস। যে-চিৎকার চাপা দেবার জন্য জিনির মুখে তোয়ালে বাঁধা হত আর জোরে জোরে বাজিয়ে দেওয়া হত রবীন্দ্রসঙ্গীত, তার চেয়েও বড় চিৎকারে কান ফেটে যেতে থাকে তাঁদের। স্তব্ধ, ব্যথিত ও ঘেন্নায় কুঞ্চিত মুখে পাড়া-প্রতিবেশীর সামনে দিয়ে একে একে পুলিশের গাড়িতে ওঠেন এক মৃত নকশালের মা-বাবা-ভাই, তাঁরা বধূহত্যার দায়ে অভিযুক্ত।

৪৬

অনুপম, ভাইয়ের মৃত্যুর পরও যা পড়ার কথা ভাবেনি, তা-ই আজ খুলে বসেছে সন্ধে থেকে। শিঞ্জিনীর মৃত্যুর পর কোনও এক গূঢ় তাড়না তাকে টেনে এনেছে দেবোপমের ডায়রির কাছে। দুপুর থেকে বিদ্যুৎ নেই। সে মোম জ্বেলেছে। পড়ছে—ভাগ্যিস গিয়েছিলাম পুরী। ভাগ্যিস। তাই আমার ঘৃণা পূর্ণ হল। মৃত্যুর প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ হল। কী ভাল হল আমার? কতটা ভাল হল? সব ভাল। সব ভাল। যা হল সব। কে জানে! হয়তো এই ভালটুকুর জন্যই সে-দিন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ার পরও আমার ঘুম আসেনি। আমার জায়গায় দাদা হলে বলত—‘ঈশ্বরের ইচ্ছেই আমাকে জাগিয়ে রেখেছিল।’ কিন্তু আমার জন্য কোনও ঈশ্বর নেই। আমার সবটাই ঐশ্বর্যহীনতা। জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত কিছু ঘটনা পরম্পরা চলে যাচ্ছে আমার ওপর দিয়ে। স্পর্শ করছে আমাকে। আর আমি তার বিষ নিচ্ছি। কেউ কেউ বিষ নিতে জন্মায়। এই পৃথিবীতে এই গরলপায়ীদের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। আমারও নেই। কোনও অর্থও হয় না বেঁচে থাকার। আমি শুধু বিস্ময়ের সঙ্গে ঘটনা পরম্পরার কথা ভাবি। যদি শেষ দৃশ্যটা আগে দেখে ফেলতাম আর জিনির অপূর্ব চোখ দু’টি ওই দৃশ্য দেখার পর আমার কাছে অমৃত নিয়ে আসত, তবে, হয়তো মৃত্যুর প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে পড়তাম আমি। আর মৃত্যুর সঙ্গে তা চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা হত। আমার সমস্ত যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবার জন্য এতকাল একমনে আমি শুধু মৃত্যুকেই প্রার্থনা করেছি। দাদার কথামতো ঈশ্বর যদি সত্যিই কোথাও থাকেন, তবে তাঁর নামে শপথ করে বলি, শুধু যদি ওই চোখ দু’টি তিনি আমাকে দিতেন তবে আমার সমস্ত যন্ত্রণার বিনিময়ে কাম্য মৃত্যুকে, আমার আরাধ্য মৃত্যুকে, ফাঁকি দিতাম আমি। আমি বাঁচতে পারতাম। এই একপক্ষে ভাল যে আমাকে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত বদলাতে হল না। কে জানে, যদি সে আমার হত, তবে হয়তো আমার জীবনের বিষ তাকেও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিত!…

দু’হাতে মুখ ঢাকল অনুপম। ভাবতে লাগল মনে মনে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের কাছে মাথা কুটতে লাগল—‘ঈশ্বর! ওদের মধ্যে তো এতটুকু বিষ ছিল না! তবু ওদের মৃত্যুর মধ্যে ঢুকে পড়ল অমোঘ অনিবার্য বিষ!’ তার কান দু’টি আমূল উষ্ণ হল। শ্বাস বন্ধ হয়ে এল বুকের তলায়। সে পড়তে লাগল—যদি ধরেই নিই, শবরী বোস বাধ্য ছিল অরুণ সেনের কাছে যেতে, যদি ধরেই নিই আমার জন্ম রচিত হওয়ার বেলায় শবরী বোস ইচ্ছে-অনিচ্ছে প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি, তবে তার মাতৃমূর্তিতে দাগ কিছু কম পড়ে। আমারও যন্ত্রণায় একটু প্রলেপ লাগে এই ভেবে যে মানুষ অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু কোনও এক আসন্ন প্রত্যুষে আমি যদি আমার চিরযৌবনা মাকে নগ্ন দেখি, যদি দেখি তাঁর ঠোঁট শুষে নিচ্ছে আমারই সুহৃদ, সহপাঠী, আমারই বন্ধু অরূপ বিশ্বাসের ঠোঁট—যদি, দেখি এক অসংলগ্ন আলিঙ্গন ও সঙ্গমের দৃশ্য যা বিকৃত, অবৈধ, অপ্রাকৃতিক, যা শুধুমাত্র বিশ্রী বিকট কামনার উৎসার ঘটায় এ পৃথিবীতে, যার জন্য প্রায়-বৃদ্ধা আমার মা যৌনতা ঘটিয়ে গেলেন পুত্ৰতুল্য পুরুষের সঙ্গে— তবে পৃথিবীর একজনও কি বলবে আমার জীবনের প্রতি ঘৃণার ষোলকলা পূর্ণ হল না! সুতরাং আমি পূর্ণ। আমার দৃষ্টি পূর্ণ। আমার এতকালের বেঁচে থাকা পূর্ণ এবং সার্থক। এই সার্থকতার অপেক্ষাতেই এতকাল আমার মৃত্যু হয়নি। কিন্তু—কিন্তু— আমি কী করি! কী করব আমি! সমস্ত অবিশ্বাসের পর, সমস্ত নোংরা, বিশ্রী, বিচিত্র জীবনধর্মের পর, আজ মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতেও আমার শেষবারের মতো বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে। প্রথম আমার কারওকে বলতে ইচ্ছে করছে—আমাকে বাঁচাও। বাঁচতে দাও। আমাকে নিয়ে চলো এই পৃথিবীর এমন কোনও জায়গায় যেখানে যন্ত্রণা নেই…! বলতে ইচ্ছে করছে—আমাকে নেবে গো? নেবে? ওই বুকের মধ্যে একটুখানি নিয়ে আমায় ভালবাসবে গো…।

সে-দিন মরণ ব্রিজটা ভাল করে দেখে এসেছি। মরার জন্য ওর চেয়ে ভাল, নিরুপদ্রব, নিরিবিলি জায়গা আর সত্যিই নেই এখানে। অন্ধকারে যারা খুন হয় তাদের শরীর ওই জায়গায় ফেলে রেখে যায় চতুর খুনির দল। আর মৃত্যুর মুখোমুখি যারা হয়, স্বেচ্ছায় বা আচমকা, তারা জানে, ওই মরণ ব্রিজে ট্রেনের ধাতব চাকা বুক পিষে অবলীলায় চলে যায় আহ্লাদে সিটি দিতে দিতে। আমি জানি, আমি দুধ আনতে যাব, খাটালের গোরুগুলো প্রশান্ত মুখে আমার পাত্র ভরে দেবে। সেই দুধ খেয়ে আমার মা চিরযৌবনা, একটির পর একটি জড়িয়ে ধরবেন পুরুষ। তাঁদের বয়সের তফাতে কোনও সীমা-পরিসীমা থাকবে না। তাঁর দাঁত খসে যাবে, চুল সাদা হবে, গায়ের চামড়া লোল হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি কামনাময়ী থাকবেন, চিতায় ওঠার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর একটি শক্ত সবল পুরুষ প্রয়োজন হবে। আমি সে-দৃশ্য দেখার জন্য আর বেঁচে থাকতে চাই না। আমি আগ্রায় দেখেছিলাম আমার নগ্নিকা মা অরুণ সেনের শরীরে শরীর বিছিয়ে শুয়ে আছেন। আমি দেখেছি, পরেশ বোস মদ খেয়ে তাঁকে বেশ্যা বলার পরও তিনি মধ্যরাতে পরেশ বোসের বিছানায় শিৎকার রচনা করছেন। শেষ পর্যন্ত পুরীর সমুদ্ররাত্রে দেখলাম অরূপের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছেন তিনি। আর আমি কিছু দেখব না। আর আমি কিছু দেখতে চাই না।

আমি দুধ ভর্তি ঝকঝকে স্টিলের পাত্র নিয়ে উঠে আসবে মরণ ব্রিজের ওপর। তখন শুভ্র স্নিগ্ধ সকাল হতে থাকবে। লৌহবলয়ে আসবে একটা ট্রেন আর ড্রাইভার আমাকে দেখে সিটি বাজাবে কিন্তু থামবার অবকাশ পাবে না। আমি রেললাইনে শুয়ে পড়ব। আমার পেটের ওপর দিয়ে শান্তির মতো চলে যাবে গোটা একটা ট্রেন। আমি দুধের পাত্র আঁকড়ে ধরে থাকব। হয়তো পাত্রের ঢাকনা খুলে যাবে। আর আমার যন্ত্রণা, পাত্রের দুধ, গড়িয়ে গড়িয়ে মিশে যেতে থাকবে আমার রক্তের সঙ্গে। আমার শরীরের নীচের দিকটা ব্রিজ থেকে ঝুলতে থাকবে শূন্যে। আমি মারা যাব। এবং শেষ পর্যন্ত, দুধকে আর দুধ বলে চেনা যাবে না।

জিনি কি কোনওদিন জানতে পারবে—কেন মরলাম। কেন বাঁচলাম না! জানবে না। কিছুই জানবে না ও। জানবে না, শুধু চোখ দু’টি দিয়ে কতখানি বেঁচে থাকা ও দিতে পেরেছিল আমাকেই।

কিছু কথা রেখে যেতে চাই। জিনির জন্য। শুধুই জিনির জন্য। আমার তো নিজের কোনও কথা নেই। ভালবাসি—বলতেও শিখিনি। যে কবিতাটি, সামান্য সময়ের জন্য হলেও ওর চোখ দু’টি আমার চোখে রাখতে পেরেছিল—সেই কবিতাই হোক আমার শেষ কথা বলা।…

অনুপমের হৃদয় বিদীর্ণ হয়। মস্তিষ্ক ফেটে যেতে চায়। কিন্তু সে সংযম হারায় না। নিজের যন্ত্রণা নিজের মধ্যেই রাখতে চেয়ে দু’হাতে গলা টিপে ধরে। দু’হাতে চুল টানে। অস্থির পাগলপারা হয়। ছেঁড়া, ফাটা দেবোপমকে সে-ই প্রথম দেখেছিল। যেমন-যেমন লেখা আছে ডায়রিতে, তেমন-তেমনই হয়েছিল দেবোপমের। শুধু ব্যতিক্রমের মতো অল্প দূরে পড়েছিল মাথা-থ্যাঁতলানো ফুলরেণু। সে কি বুঝেছিল, দেবোপম মারা যাবে সে-দিনই, সেই সকালেই! দেবোপমের লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, তার মৃত্যুর অভিপ্রায় ফুলরেণুর কাছে গোপন ছিল না। দেবোপমকে বাঁচানোর জন্যই কি ফুলরেণু সকাল-সন্ধ্যা পাহারা দিয়েছিল মরণ ব্রিজ আর ঘুঁটে দেবার ছলে লক্ষ করেছিল দেবোপমকে। তাকে বাঁচাবার জন্য ছুটে এসেছিল যখন তখন কুঁজো অশক্ত শরীর আর সামলাতে পারেনি। ধাক্কা খেয়েছে ট্রেনে, আর চুরমার হয়ে গেছে। এত কিছু বলার জন্য, ব্যাখ্যা করার জন্য, কেউ আর নেই। অনুপম দুই চোখে হাত রাখল। হাত ভিজে গেল। চোখ মুছে সে ডায়রির পাতার দিকে স্থির হয়ে চেয়ে রইল আরও কিছুক্ষণ। পড়তে লাগল—

তুমি তো জানো না কিছু—না জানিলে,

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ করে;

যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে—

পথের পাতার মতো তুমিও তখন

আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?

অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন

সেদিন তোমার! …

অনুপম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। জীবনের প্রতি তীব্র টান তারও আলগা হতে থাকে। সমস্ত প্রশান্তি ভেঙে উঠে আসে ঘৃণা। সে টের পায়, দেবোপমের ডায়রি তাকে অধিকার করে আছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। একটু বাতাসের জন্য সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে নেমে আসে নীচে। অন্ধকারে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন শবরী। তাঁর আর ঘুম নেই। অনুপম করুণা বোধ করে। আস্তে ডাকে—মা!

শবরী ফিরে তাকান। তাঁর নিটোল মুখে আজও শোকের চিহ্ন পড়েনি। অনুপমের মনে হয়—এও এক অভিশাপ। এতখানি দুঃখে-শোকেও এ রকম নিটোল হয়ে থাকা। সে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। চুপ করে দেখতে থাকেন শবরী। তিনি কি দরজা বন্ধ করলেন? অনুপমের পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে না। সে নির্জন অন্ধকার রাস্তায় পা রাখে। হঠাৎ এই পৃথিবীতে নিজেকে খুব একা লাগে তার। দেবোপমের না-থাকাকে নতুন করে উপলব্ধি করে সে। নিজের অজান্তে অপরিকল্পিতভাবে এসে দাঁড়ায় দেবাশিসের বাড়ির সামনে। জিনি নেই। ঘুমিয়ে নেই। বেঁচে নেই। তার আত্মা কি এখনও ঘুরছে এ বাড়িতে? পুলিশের সিল করে দেওয়া দরজার প্রান্তে বসে পড়ে অনুপম। দেবোপম ও শিঞ্জিনীর জন্য বুক ভেঙে কাঁদতে থাকে বাকি রাত।

একসময় অন্ধকার ফিকে হল। লাল হয়ে এল আকাশ। হরিচরণ তার পরিচ্ছন্নতার সরঞ্জাম নিয়ে পাড়ায় পৌঁছল। তার মুখ প্রসন্ন হওয়ার কথা ছিল। মা সন্তোষীর কৃপায় সে একটি কন্যারত্ন লাভ করেছে। রামজির কৃপায় তার সংসারে কোনও অশান্তি নেই। হনুমানজির আশীর্বাদে নীরোগ ও স্বাস্থ্যবান আছে সন্তানেরা। কিন্তু হরিচরণের মুখে প্রসন্নতা নেই। সে ভাল আছে। কিন্তু তার চারপাশে যারা আছে তারা কেউ ভাল নেই। এই পাড়া, যাকে পরিচ্ছন্ন রাখবার পবিত্র কর্মটি সে সমাধা করে, তার গায়ে পায়ে বুকে শুধু কষ্ট। হরিচরণ আনমনে আলগোছে সমস্ত বাড়ির দিকে চোখ রাখে। কোথাও শান্তির প্রত্যুষ নামে না। তার দুঃখ হয়। কিন্তু তার দুঃখবোধে কারই বা কী উপকার হবে! ঈশ্বর তাকে দিয়ে যে পবিত্র কর্মটি করিয়ে নিচ্ছেন সেটি সমাধা করতে গিয়ে সে শুধু চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে পারে মাত্র। এবং দেখতে পায় বহু বিচিত্র মানুষ। বহু ঘটনা। দেখা বিনা আর কী-ই বা সে করতে পারে! কুঁজি ফুলরেণুর জন্যও তার কষ্ট হয়। কতদিন ওই ক্লাবের পাশে, রেললাইনের ঢালে বিশ্রাম নিতে নিতে গল্প করেছে তারা। কত বৈধ-অবৈধ দৃশ্য দেখেছে। দেখেছে কত ক্ষয় এবং অপব্যয়িত জীবন। রেললাইনেই ফুলরেণুর জীবন ছিল। ওখানেই মরণ হল তার।

আর অন্ধর মা, তারও জন্য হরিচরণের বুক টনটন করে। এত সৎ এত ভাল মানুষ—স্বামীটা কাজ থেকে বসে গেল। কিছুকাল আগেও সে রিকশা চালিয়ে ভাল আয় দিয়েছে। এখন রোগে-ভোগে বিছানায় পড়ে আছে। ক’দিন বাঁচে কে জানে। নিয়মিত সন্তোষী মা’র পুজো করে অন্ধর মা। তুলসীর মতোই। তুলসীর প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে। অন্ধর মা’রও কি হবে না? স্বামীর আরোগ্য প্রার্থনা করে অন্ধর মা। ছেলের জন্য দৃষ্টিশক্তিও কি প্রার্থনা করে না? হরিচরণ জানে না। তবে অন্ধর মা’র জায়গায় সে থাকলে নিশ্চয়ই প্রার্থনা করত।

ওই পরেশবাবু আর তাঁর বউয়ের জন্যও কষ্ট পায় হরিচরণ। এটা ঠিক যে পরেশবাবর বউ বাড়ির সামনেটা ময়লা করে রাখেন এবং তাঁদের নিয়ে বহু রটনা আছে এই পাড়ায়। কিন্তু তাই বলে তাঁদের পুত্রশোক মোটেই প্রার্থনীয় ছিল না। দেবোপম যে-দিন মারা যায় সে-দিন সকালে হরিচরণ অরুণ সেনের উঠোনের আবর্জনা পরিষ্কার করছিল। প্রচুর আসবাব তৈরি হচ্ছিল তাঁর বাড়িতে। তাই কাঠের ছাল ও গুঁড়ো জমে পাহাড় হয়ে ছিল। ওগুলো জ্বালানির কাজে দিব্যি ব্যবহার করা যায়। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বলে একটা বস্তাও এনেছিল হরিচরণ। সব কুড়িয়ে-কাচিয়ে যখন বস্তায় পুরছে তখনই সেই সাংঘাতিক সংবাদটি পরিবেশিত হয়। কোনওভাবে তা পৌঁছয় অরুণ সেনের কানে, কোনওভাবে পৌঁছয় পরেশ বোসের কানেও। অরুণ সেন খবর পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামছিলেন তখন আর পরেশ বোসের একটি ঝড়ো আবির্ভাব ঘটেছিল উঠোনের দরজায়। একটি উঠোন—যেখানে দেবোপম খেলা করেছিল শৈশবে—মাঝখানে রেখে দুইজন পুরুষ পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর এগিয়ে এসেছিলেন পরস্পরের দিকে। কে কাকে টেনে নিলেন বোঝা যায়নি। অরুণ সেনের প্রায়বৃদ্ধ কিন্তু দীর্ঘ সুন্দর শরীরের চওড়া বক্ষে মাথা রেখেছিলেন খর্বকায় মান্না দে সদৃশ পরেশ বোস। বহুক্ষণ দু’জনে স্তব্ধ হয়ে ছিলেন। স্থির। হরিচরণ কাঠের কুচির স্তূপে—যা কি-না দাহ্য সহজেই—দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল আর দুঃখ বোধ করছিল। সূর্য তখন অরুণ সেনের ছাদ ছাড়িয়ে উঠে পড়েছিলেন অনেকটা।

বিকাশের বাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল হরিচরণ। আর কোনওদিন এ বাড়িতে তাকে ঢুকতে হবে না। শুনতে হবে না লক্ষ্মীর ছিঃ ছিঃ—ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না ধ্বনি। লোকে বলাবলি করছে ওঁরা নাকি ছাড়া পেয়ে যাবেন। আগরতলা থেকে যে দাদারা এসেছেন শিঞ্জিনীর—তাঁদের একজনের কঠিন হৃদরোগ দেখা দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে বোনের শোকেই তিনিও হয়তো আর বাঁচবেন না। এবং ওই তরফের লড়াই থেমে যাবে। বিকাশরা তখন এ পাড়াতেই বসবাস করবেন? হয়তো নয়। পাড়ার ছেলেরা সব একজোট। বধূহত্যাকারী নোংরা পরিবারটিকে পাড়ায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। হরিচরণ সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে বিকাশের বাড়ির কাছে ভ্যান নামায় এবং দেখতে পায় অনুপম দুয়ারে বসে আছে। সে কোনও কথা বলে না। অনুপমও হরিচরণকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। তার পোশাকে ধুলো। চুলে ময়লা। কান্না জড়ানো রাতজাগা চোখ লাল। ফোলা। ক্লান্ত। সকাল হল। তাকে ফিরতে হবে। কোথায় ফিরবে সে? কোথায়? দেবোপমের ডায়রি তাকে চিরকালের জন্য নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। পরাজিতও করেছে বোধহয়। সেইসঙ্গে চির আশ্রয়হীন। সে উপলব্ধি করছে, সে আর কোনওদিন ভাল থাকবে না।

৪৭

তিনদিন খাওয়া ছিল না, ঘুম ছিল না অন্ধর মার। বস্তিতে সে প্রহার দেখেছে। কিন্তু হত্যা দেখেনি। তার বুক কান্নায় উপচে আসে। সে তো দেখেছে কত নিষ্ঠুর মারের পরও মেয়েটা বলত—‘ওরা আমাকে মেরে নিশ্চয়ই ফেলবে না, বলো!’ কত বিশ্বাস করত মেয়েটা। অথচ ফেলল তো, মেরে ফেলল তো! তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—‘তুমি কী দেখেছ?’ অন্ধর মা ধীরে ধীরে সব বলেছিল। বারবার বলেছিল। যেমন সে গল্প করত বস্তিতে এসে, তেমনই বলেছিল। সমস্ত প্রহারের কথা। লোকে বলছে, তাকে নাকি কোর্টে যেতে হবে। কথা বলতে হবে জজ সাহেবের সামনে। বলবে অন্ধর মা। সেইসব কথাই আবার বলে আসবে। অনেকে বলছে কোনও শাস্তিই ওদের হবে না। অন্ধর মা জানে, এখানে চোরের সাজা হয় না। খুনিরা ঘুরে বেড়ায়। আর যারা একটু ভাল কাজ করতে চায়, গরিবের হয়ে দু’কথা বলতে চায় তাদের ধরে ধরে জেলে পুরে দেওয়া হয়। গুলি করে মেরে ফেলে দেওয়া হয় পথে-ঘাটে। এ সব কথা মাস্টার আগে প্রায়ই বলত। অন্ধর মা জানে মাস্টার কখনও ভুল বলে না। শুধু একটি কথা ছাড়া। সে বলে—ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর কোথাও নেই। মানুষই সব। অন্ধর মা জানে, ঈশ্বর আছেন। ভগবান নেই তা হয় নাকি! তিনি না থাকলে এই দুনিয়া কেমন করেই-বা সৃষ্টি হল? সুতরাং মানুষের ন্যায়-অন্যায় বিচার-অবিচারের পরও তার শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে থাকেন ঈশ্বর। তাঁর আদালতে শেষ পর্যন্ত সকলের বিচার হবে এই ভরসায় আবার কাজ খুঁজতে বেরোয় সে। পাঁচ বাড়ির কাজ না হলে তার চলবে না। ঈশ্বরের কাছে সে যখন লক্ষ্মীদের শাস্তি প্রার্থনা করছিল তখন অন্ধ বলেছিল—ওরা রাত্রে ঘুমোতে পারবে না। ওদের হাতে সারাক্ষণ রক্ত লেগে থাকবে। চোখ বন্ধ করলেই ওরা দুঃস্বপ্ন দেখবে রক্ত, রক্ত, শুধু রক্ত। বারবার হাত ধুতে ছুটবে ফটিক বিলের মতো কোনও হ্রদে আর তার নীল-সবুজ জল লাল হয়ে যাবে। তবু ওদের হাতে রক্ত লেগে থাকবে।

অন্ধর মাও সেই ভরসায় আছে। রক্ত লেগে থাকবে। ওদের হাতে নিশ্চয়ই রক্ত লেগে থাকবে।

কালীতারা একটা কাজের কথা বলছিল। তার বাড়ির দিকেই হাঁটছিল অন্ধর মা। রাধিকার বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখল দুয়ারে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে কার্তিক। অন্ধর মা অবাক মেনে গেল। কালীতারার বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাবতে লাগল—আশ্চর্য। এসেছে লোকটা। অথচ এতদিন একটা খোঁজ নেয়নি। টাকা পাঠায় না। একলা অসহায় মেয়েটা দু’টো বাচ্চা নিয়ে কী করে সামলাল সে কথা একবার মনে হল না! ফের কী লজ্জায় সে আসে? তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। হয়তো, কার্তিক জানে, এই বস্তিতে এসে পড়লে মেয়েরা আর অসহায় থাকে না। তাদের কাজ জুটে যায়। আহার জুটে যায়। বিনিময়ে হারিয়ে যেতে থাকে স্বাস্থ্য। সৌন্দর্য। সম্মান।

অন্ধর মাকে দেখে দৌড়ে এসেছিল পলাশ। কিছুক্ষণ আগে সে স্কুল থেকে ফিরেছে। মা এখনও ফেরেনি। এ দিকে এতদিন পর বাবা উপস্থিত। সে বলল—মাসি আইজ কেমুন আসো?

—ভাল।

—কাজে কবে যাবা?

—কাল থিকা যামু।

—অন্ধ কই?

—হ্যায় মাস্টারের বাড়ি আসে। মাস্টারের শরীলডা খারাপ যাইতাসে হেই কুন কাল থিকা।

—বাবায় আসছে।

—দ্যাখলাম। তর মায় তো ফিরে নাই।

—না। বাবায় কয় মায় কই।

—তুই কী কইলি?

—কইলাম কাম করতে গ্যাসে। বাবায় কয়, তোর মা বেশ কামাচ্ছে না? আমি কিসু কই নাই।

—অ্যাতদিন আসে নাই ক্যান?

—কয়, কাম আসিল। শীতে কাঠের গোলায় অনেক কাম থাকে। ছুটি মিলে না।

অন্ধর মা পা বাড়ায়। পলাশ মাস্টারের বাড়ির দিকে যায়। ভিতরে ঢোকার আগে একবার বেলিদের বাড়িতে ঢুকে ভাইকে দেখে নেয়। ভাই বেশ আছে। ছেলেকে দেখাশুনো করার জন্য, রাধিকা অঞ্জলিকে দশটা করে টাকা দিচ্ছে। অঞ্জলি নিতে চায়নি। রাধিকা বলেছে—‘তোমরা এইটুক না করলে আমি তো কাম পাইতাম না। না খাইয়া মরতাম।’

এটুকু করার পরামর্শ রাধিকাকে তৃণাঙ্কুর দিয়েছেন। তাতে ফল ভালই হয়েছে।

পলাশ মাস্টারের বাড়ি পৌঁছে দেখল অন্ধ আর মাস্টার পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছে। সেও এক পাশে শুয়ে পড়ল। অন্ধ বলল—তোর বাবা এসেছে, না রে?

—হ্যাঁ। তুই কী করে জানলি?

—গন্ধ পেলাম।

মাস্টার বলছিল—মহেঞ্জোদারো নামে একটা সভ্যতা ছিল একসময়।

পলাশ এ বছর ইতিহাস বই পেয়েছে। মহেঞ্জোদারো পড়ছে। সে শুনতে লাগল। মাস্টার বলতে লাগল—অত বড় সভ্যতা, সেও ধ্বংস হয়ে গেল। কিছুই থাকে না। শেষ পর্যন্ত সব ধ্বংস হয়ে যায়।

অন্ধ বলল—আমরাও ধ্বংস হয়ে যাব, না মাস্টারকাকা?

—হয়তো হব।

—তোমার এই ডায়রি, এই এত কাগজ, বই—সব জলে ডুবে যাবে।

—জলে ডুবে যাবে? কে বলল?

—আমার মনে হয়। অনেক জল আসবে। আর আমাদের ঘরবাড়ি সব ডুবে যাবে।

মাস্টার চুপ করে থাকে। অন্ধ আবার বর্তমান ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি ও বুঝতে পারে? টের পায় জন্তুজানোয়ারদের মতো? রাধিকা বাড়ি ফিরছিল। মাস্টারের ঘরের দরজা খোলা দেখে দাঁড়াল একবার। পলাশ যদি থাকে বলবে ভাইকে নিয়ে আসতে। বাইরে থেকে ডাকল সে—পলাশ আছস? পলাশ?

পলাশ সাড়া দেয়—আছি মা।

—ভাইরে লইয়া আয় বাবা।

—যাই মা।

বাইরে বেরিয়ে আসে সে। প্রায় গোপন কথা বলার মতো ফিসফিস করে বলে—বাবায় আইসে।

রাধিকা প্রথমে যেন কথাটা ধরতে পারে না। বলে—ক্যাডায় আইসে?

—বাবায়।

রাধিকার বুক হিম হয়ে যায়। আসন্ন ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয় সে। তার মন ভাল নেই। নীলিমা প্রায় কথাই বলেন না তার সঙ্গে। তাতে কিছু না। সে তো ও বাড়িতে কাজ করতেই যায়। কিন্তু নীলিমা তৃণাঙ্কুরের সঙ্গেও প্রায় কথা বলেন না। তৃণাঙ্কুর মাঝে মাঝে দুঃখ করেন—‘মা, এতদিনেও আমাকে বুঝল না, জানো!’

রাধিকার নিজেকে অপরাধী লাগে। সেই কি এ সবের জন্য দায়ী নয়? একদিন কথাটা বলেছিল তৃণাঙ্কুরকে। তিনি বলেছিলেন—না। তুমি কেন দায়ী হবে? আমরা তো কোনও অন্যায় করিনি। ভালবাসা কি পাপ, বলো?

এত বড় কথা কেমন করে বলবে রাধিকা! সে তো এই একটি মাত্র কথা বুকে করেই বেঁচে থাকে।

তৃণাঙ্কুর বলেছিলেন—তোমার স্বামী তোমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমার স্ত্রী আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তুমি জানো, জানো, আমার মেয়ের সামনে ও অন্য পুরুষকে চুমু খেত?

রাধিকা চুপ করে ছিল। তৃণাঙ্কুর বলেছিলেন—আমরা দু’টি কষ্ট পাওয়া প্রাণ, পোড়া প্রাণ, যদি পরস্পরের বুকে মুখ রেখে একটু তৃপ্তি পাই, শান্তি পাই, সেটুকু মানুষ পেতে দেবে না কেন? আমাদের যারা কাছের, তারা কেন বাধা দেবে?

তবু রাধিকা ভেবেছিল, অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নেবে। তার তো বন্ধন নেই কোনও। আজকাল স্বপ্নও ধরা দেয় না আর। হয়তো স্বপ্ন দেখার অবসরই পায় না সে। কিন্তু তৃণাঙ্কুর করুণ বালকের মতো, কাতর হয়ে বলেছেন—আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। চলে যেয়ো না। যাবে না তো?…বন্ধন নেই। আবার আছে। ভাল করে হাঁটতে পারেন না মানুষটা। রোজ কলেজে যেতে পারেন না। নিজের কিছু করে নেবার ক্ষমতা নেই। ঘরকুনো, পড়ুয়া, অন্তর্মুখী, পরনির্ভরশীল মানুষ। নিজের বাবার সঙ্গে তৃণাঙ্কুরের মিল পায় রাধিকা। ওই অন্তর্মুখিনতা, ওই স্ত্রীসঙ্গ-বঞ্চিত নির্ভরশীল পৌরুষ, ওইরকম জোরে জোরে কাব্য পাঠ—ফলে বন্ধনহীন এ বন্ধনকে সে মনে মনে স্বীকার করে নেয় ক্রমে। নীলিমা না থাকলে কে দেখবে মানুষটাকে? একদিন রাধিকা বলেছিল—বিয়া করেন। তৃণাঙ্কুর মাথা নেড়েছিলেন—না। আর না। আমি জানি স্ত্রীকে সুখী করার মতো কোনও গুণই আমার নেই। যে আসবে অসুখী হয়ে ফিরে যাবে। কাছে টেনেছিলেন রাধিকাকে। বলেছিলেন—প্রেমিকা তুমি। বান্ধবী তুমি। স্ত্রীও তুমি। আর আমার কিছুই দরকার নেই।

তৃণাঙ্কুরের মধ্যে রাধিকা শমসেরকে কোথাও খুঁজে পায় না। তৃণাঙ্কুর নিজের মতো করে রাধিকার মধ্যে প্রবেশ করেন। আর রাধিকা বহুদিনের প্রয়াসে কার্তিক নামে লোকটাকে নিজের মধ্যে থেকে পুরোপুরি উপড়ে ফেলে দেয়। আজ, কার্তিকের আবির্ভাবে সে ক্রমশ কঠিন দেওয়াল তুলতে থাকে চারপাশে। কার্তিকের কথার জবাব দেয় না। কিন্তু কার্তিক নাছোড়। সে প্রথমেই শারীরিক আক্রমণ করে রাধিকাকে। আঁচল টেনে বুকের দিকে হাত বাড়ায়। ফিচেল হেসে বলে— আমার জিনিস, আমি হাতাব না? হাতাব না?

রাধিকা দাঁতে দাঁত চাপে। ফিসফিস করে বলে—ছাড়ো। পলাশ আইব। ছাড়ো।

—ছাড়ব না।

কার্তিক এগিয়ে আসে। তার বিড়ি খাওয়া মুখের থেকে তামাকের গন্ধ ছাপিয়ে উঠে আসে দাঁতের গোড়া পচে যাওয়া গন্ধ। রাধিকার গা গুলোয়। সে এক ধাক্কা দেয় কার্তিককে। ঘরে আলো জ্বলেনি। অন্ধকারে টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় টলে পড়ে রাধিকা। কার্তিক রাগে আক্রোশে ঝাঁপায়। লোভে রোষে ফালা-ফালা করতে চায় শরীর। অনেকদিনের রাগ তার। অনেক পাওনা। একটানে আদায় করতে চায়। মুখে বলে—খুব কামাস? অ্যাঁ? খুব কামাস? গা দিয়ে তেল চুকচুক করে ঝরে কেমন?

ভাইকে নিয়ে ফিরে আসছিল পলাশ। সঙ্গে অন্ধ আসছিল। রাধিকা আপ্রাণ চিৎকার করে— পলাশ! আয় বাবা।

পলাশের মাথায় খুন চেপে যায়। মুহূর্তে অনেকদিন আগে দেখা মধ্যরাত্রির উলঙ্গ কার্তিককে তার মনে পড়ে। সে ভাইকে অন্ধর কোলে দিয়ে ছুটে যায়। থান ইট তুলে কার্তিকের পিঠ লক্ষ করে ছুঁড়ে মারে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে মাটিতে খসে পড়ে কার্তিক। পিঠের হাড়গুলি বুঝি গুঁড়িয়ে গেল। ভঙ্গুর মেরুদণ্ড চুরমার। রাধিকা শাড়ি সামলায়। পলাশ দু’টি গনগনে চোখ তুলে শাসাতে থাকে—খুন কইরা ফালামু যদি আর একবার মা’র গায়ে হাত দ্যাও।

অন্ধ পলাশের ঘুমন্ত ভাইকে বুকে আঁকড়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। পলাশ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে—‘দে।’ অন্ধ ভাইকে দিয়ে দেয়। পলাশ বলে—আইজ আর আমি যামু না অন্ধ। তুই যা গিয়া।

অন্ধ জানে কেন পলাশ এল না। সে মাকে পাহারা দিতে চায়। হঠাৎ পলাশকে অনেক বড় মনে হয় অন্ধের। এবং এই দুনিয়ার পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয় মনে হয়। পাশাপাশি নিজেকে নগণ্য লাগে। নিষ্প্রয়োজন লাগে। নিজের অর্থহীন জন্মের জন্য নিজের ওপর ক্রুদ্ধ হয় সে৷ অন্ধকারে একবারও হোঁচট না খেয়ে সে মাস্টারের বাড়ির দিকে যায়। তবু না ভেবে পারে না, পলাশ তো আছে, এই পৃথিবীর জন্য, মায়ের জন্য, প্রতিরোধের জন্য, পলাশ তো আছে। সে মনে মনে, অজানার উদ্দেশে বলে—পলাশরা থাকুক। থেকে যাক চিরকাল।

৪৮

এপ্রিলের শুরুতে কলকাতার অফিসে যোগ দিয়েছিলেন প্রণবেশ। এখন মনে হচ্ছে, একপক্ষে ভাল ছিলেন ফারাক্কায়। নদীর জলের মতো জীবন ছিল ওখানে। উত্থান-পতনহীন, শান্ত, কাজে ঠাসা। শুধু ছেলের জন্যই ফিরে এসেছেন কলকাতায়। কিন্তু ভাল লাগে না। একটুও ভাল লাগে না। মাথুরের গড়কে আজকাল অভিশপ্ত মনে হয়। সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে এখন এখানে। দীর্ঘ পরিচিতি ভেঙে কে যে নাস্তিক্য টপকে শুরু করে দেবে তন্ত্রসাধনা, কে যে খুনি হয়ে উঠবে এবং চরম নিষ্ঠুরতায় রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে সদ্যোজাত শিশু, কে যে কোন গোপন দুঃখে রেললাইনে বুক পেতে দেবে আর কার স্ত্রী বিশ্বাস ভেঙে ছুটে যাবে অন্য জনেব দরজায়—তা কেউ বলতে পারে না। পরিবারের দেওয়াল ভাল থাকার উপকরণে সুসজ্জিত হলেও ভাল না-থাকা অস্থির বায়ু ঢুকে পড়বেই গৃহস্থীতে, আর চঞ্চল করে তুলবে সমস্ত স্থৈর্যকে। তবে, ভাল থাকবার জন্য, মানুষ যখন গৃহমধ্যে বদ্ধ না থেকে বাইরেকার হাওয়ায় আলোড়িত, তখন তাঁর সুস্থ মনুষ্যত্ব সম্পর্কেও আর সন্দেহ থাকে না।

মাথুরের গড় নাগরিক কমিটির সভা হল একদিন এর মধ্যে। সেই সভায়, বধূহত্যার অভিযোগে, বিকাশ ও তার পরিবারের প্রতি ধিক্কার দেওয়া হল। বিকাশ নিজেও ছিলেন এই কমিটির অন্যতম সদস্য। কোনও দিন তাঁর পক্ষে এ কথা কল্পনাও করা সম্ভব হয়নি যে নিজের কৃতকর্মের জন্য এই কমিটি দ্বারা ধিক্কৃত হবেন। যদিও ওই সভায় বিকাশ উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু সারা মাথুরের গড়ে তাঁর উপস্থিতি বড় বেশি স্পষ্ট।

ধিক্কার দেওয়ার বিষয়ে প্রণবেশের খুবই আপত্তি ছিল কারণ বিকাশ সত্যি অভিযুক্ত কি-না এ বিষয়ে কোর্টের রায় এখনও বেরোয়নি। কিন্তু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ধিক্কার আদালতের রায়ের পরোয়া করে না। গণবিচারে একটি বৃহৎ জায়গা নেয় আবেগ। এবং পক্ষপাত। প্রতিষ্ঠান আদালতের মতো অকাট্য যুক্তি ও আবেগবিহীন নিরপেক্ষতার তোয়াক্কা নেই এখানে। গণ-আদালতের দৃষ্টি সরল, যুক্তি সরল, আবেগ তুঙ্গী এবং বিচারকাল ক্ষণস্থায়ী। অভিযুক্তের প্রতি কোনও ন্যায়বিচার না হওয়ার আশঙ্কা এখানে থেকে যায় বরাবর। আবার, জনমানসের সরল চোখ হয়তো এমনও অন্তর্ভেদী হতে পারে যা সরাসরি সত্যে পৌঁছয়। সত্য ও সারল্য জোড়া বেলফলের মতোই, পাশাপাশি সুন্দর। তাই সংশয় কাটে না। এমনকী বিকাশ সম্পর্কেও প্রশ্ন থেকে যায় প্রণবেশের।

প্রণবেশ এখনও ভাবতে পারেন না, ওই অত্যাচারের মধ্যে, ওই নিষ্ঠুরতার মধ্যে, বিকাশ থাকতেও পারেন। নানা বিপর্যয়ে প্রণবেশ বারবার ওই মানুষটির কাছে ছুটে গেছেন। যখন ভাইয়ের জন্য উদ্বেগে ঘুম হত না, যখন থানা থেকে অত্যাচারিত হয়ে ফিরেছিলেন, যখন নীলাদ্রি মারা গেল, দেবার্চন মারা গেল—প্রণবেশ ও বিকাশ—দুই অসমবয়সী বন্ধু ও সমব্যথী—বারবার পরস্পরকে আঁকড়েছেন। প্রণবেশের ছেলে হারানোর সময় বিকাশই একমাত্র যিনি সারাক্ষণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রণবেশের সঙ্গে ছিলেন। সাধ্যমতো সঙ্গ ও সহায়তা দিয়েছিলেন। সারা পাড়া জুড়ে গাছ করতেন তিনি। পাড়ার মানুষদের সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে ভাবতেন। সম্প্রতি ফটিকবিল বস্তিতে নলকূপ বসানোর জন্য খুব চেষ্টা করছিলেন বিকাশ। সরকারের দায়িত্বশীল কর্মী হিসেবে এতকাল কাটিয়েছেন তিনি। প্রণবেশের মনে হয়—কোথাও কোনও ভুল হয়ে থাকবে। কিন্তু অন্ধর মা বলে যে মহিলাটি প্রণবেশের বাড়িতে নতুন কাজ করতে এসেছে তাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন জুঁই। প্রণবেশ শুনছিলেন। অন্ধর মা বিকাশের বাড়িতে কাজ করত। সে আনুপূর্বিক বর্ণনা দিয়েছে জুঁইয়ের কাছে। দিতে দিতে কেঁদেছে। বারবার বলেছে, বউটির ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। বড় ভাল ছিল সে। সুন্দর ছিল। কোথাও যায়নি। কারও সঙ্গে মেশেনি। অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। হ্যাঁ, তাকে মারা হত। নিষ্ঠুর মার। গান চালিয়ে তার চিৎকার আটকানো হত। বিকাশও কি শামিল ছিলেন এ সবে? জিজ্ঞাসা করেছিলেন প্রণবেশ। অন্ধর মা মুখ নিচু করে বলেছিল—না। তাইনরে মারতে দেখি নাই। তয় পোলায় আর বউয়ে মিল্যা মারে দেইখা বাইর যাইতেন গিয়া! কুনোদিন থামাইতেও দ্যাখলাম না, কিসু কইতেও না।

প্রণবেশ অবাক হয়েছে। স্ত্রী-পুত্র মিলে বউটিকে মারছে দেখেও নীরবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন বিকাশ—এ দৃশ্য কষ্টকল্পিত লাগছে। যদিও বিকাশ খুব প্রতিবাদী ছিলেন না। কিন্তু মেরুদণ্ডহীনও কি ছিলেন? প্রণবেশ মেলাতে পারেন না। বিকাশের কথা ভেবে কাজে মন বসে না তাঁর।

ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন প্রণবেশ। সিঁথির মোড়ে দুর্ভেদ্য জ্যামে দাঁড়িয়ে ছিল জিপটা। অফিসে যাওয়া-আসা করার জন্য জিপ পেয়েছেন তিনি। এই জিপগুলোর বাঁ-হাতে স্টিয়ারিং বলে তাঁকে ডানদিকে বসতে হয়েছিল। একটি চিৎকারে তাঁর চিন্তা ছিন্ন হল। তিনি এ দিক-ওদিক দেখলেন, শব্দটা বাঁদিক থেকে আসছে। ড্রাইভারের পাশ দিয়ে প্রণবেশ শব্দের উৎস খুঁজলেন। রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি পাগল। হাত-পা নেড়ে কী সব বলে যাচ্ছে। যাই বলুক, বলার মধ্যে গমক আছে। ছন্দ আছে। তার দীর্ঘ শরীর। রোগা হয়ে খানিকটা সামনে ঝুঁকে আছে। গালে দাড়ি, বড় বড় চুল মাথায়। পরনে আধময়লা পাঞ্জাবি আর প্রয়োজনের চেয়ে ছোট আধময়লা প্যান্ট। পায়ে হাওয়াই চটি। সে বলছে, তার দিকে মনঃসংযোগ করায় শুনতে পেলেন প্রণবেশ, — “…ওরা আপোসহীনতার কথা বলত। এই বামফ্রন্ট, বলত পুঁজিবাদের বিকাশের জন্যও যতটুকু অগ্রগতি দরকার ছিল তাও স্তব্ধ করে রেখেছে বড় বড় শিল্পপতি ও জমিদার গোষ্ঠী। বলত, আমরা অপেক্ষা করব না। বিপ্লবের পথে এগোনোই আমাদের লক্ষ্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা কী করল? বিপ্লব থেকে সরে দাঁড়াল সমঝোতায়। শিল্পপতি ও জমিদারদের সঙ্গে আপোস করল। এই বামফ্রন্ট, সাতষট্টিতে, মনে রাখবেন, মাত্র দশ বছর আগে সাতষট্টিতে একটি দলিল ছাপে যাতে চিনকে ওরা সমর্থন করেনি, আবার একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে—করেছেও। কেন এই পরস্পর বিরোধিতা? কারণ হল, ওদের উদ্দেশ্য ছিল, কমিউনিজমের মুখোশ পরে সাম্রাজ্যবাদের দালালি। ওই দলিলে সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করে ওরা একটি চমৎকার আড়াল দেয় এই বলে যে, যা সাম্রাজ্যবাদের অনুগমন ভাবা হচ্ছে তা আসলে দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্য … …”

জ্যাম ছেড়ে গেল। প্রণবেশের গাড়ি ছাড়িয়ে গেল পাগলটাকে। কিন্তু প্রণবেশ ভুলতে পারছেন না। খুব চেনা লাগছে ওকে! কোথায় দেখেছেন! এই রাস্তাঘাটেই কোথাও? কবে দেখেছেন? মাথার মধ্যে ছেলেটির মুখ তোলপাড় করতে থাকছে। অযত্ন আর শীর্ণতার আড়ালে ইতিহাস হয়ে যাওয়া সৌন্দর্য আর তীব্র ঝকঝকে দুটি চোখ। ছেলেটি … … ছেলেটি … … কৌশিক না? জামাল কৌশিক! প্রণবেশ সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর হৃৎস্পন্দন এত ভারী ও তীব্র হল যেন পুরো যন্ত্রটা পাঁজর কেটে বেরিয়ে আসবে। তিনি ভাবতে লাগলেন—কৌশিক! কতদিন পর! তখন নীলাদ্রির কাছে আসত। কতদিন নীলাদ্রি, দেবার্চন আর এ—এই কৌশিক নীলাদ্রির ঘরে বসে কথা বলেছে! সবাই যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন, কতদিন এই কৌশিক এক মুহূর্তের জন্য এসে দরজায় দাড়িয়ে দু’টি খবর দিয়ে গেছে। আঃ—আঃ—প্রণবেশের মাথার ভেতর যন্ত্রণায় ফুলে ওঠে। চাপ ফুসে ওঠে আর তাকে কর্তব্যসচেতনতা সম্পর্কে বিমূঢ় করে দেয়। কৌশিককে তিনি চিনতে পারলেন না? কৌশিককে? তাঁর মধ্যে নীলাদ্রির জন্য তোলপাড় হল। নীলাদ্রির জন্য ভালবাসা, নীলাদ্রির জন্য উদ্বেগ-স্মৃতি, নীলাদ্রির জন্য যন্ত্রণা তাঁকে জিপে বসে থাকাকালীনই আকুল ও অস্থির করে তুলল। তাঁর ইচ্ছে করল, এখুনি গাড়ি ঘুরিয়ে কৌশিকের কাছে পৌঁছতে। ইচ্ছে করল, তারুণ্যে অর্ধেক জীবন পার করে ফেলা ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ভাই রে—ও ভাই—বলে ডাকতে। কিন্তু ও তো পাগল! হোক, হোক পাগল। ভাই বলে কাছে টেনে নিলে পাগলের মধ্যেও সুস্থতার সঞ্চার হবে। নিশ্চয়ই হবে। প্রণবেশ মনে করেন, হয়তো এ বিষয়ে গভীর বিশ্বাস তাঁর—সমস্ত পাগলামি ও উন্মাদনার উৎস আসলে অপ্রেম। প্রেমহীনতা। ভালবাসা সমস্ত মানসিক অসুস্থতা ধুয়ে-মুছে দিতে পারে, প্রণবেশ দ্রুত পৌঁছে যেতে চান জামাল কৌশিকের কাছে, যা তাঁকে, একাংশে নীলাদ্রির কাছে পৌঁছে যাবার আকর্ষণ দেয়। দারুণ অনুপ্রাণিত করে সমস্ত ভাইকে যত্ন ঢেলে দিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অসম্ভব জ্যামের রাস্তায় গাড়ি ঘোরানো। তা ছাড়া … … তা ছাড়া … … কৌশিক পাগল, নকশাল করত, একলা একলা তার কাছে পৌঁছলে প্রণবেশ যদি জড়িয়ে পড়েন? কীসে জড়াবেন? কীসে? প্রণবেশ জানেন না। কিন্তু প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটিয়ে এ বার ভয় ঢুকতে থাকে ভেতরে। যেমন স্বচ্ছ পূত নদীজলে গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ। প্রণবেশ পীড়িত বোধ করেন। ধরা যাক, কৌশিকের কাছে পৌঁছলেন, ধরা যাক ওর কোনও বাড়িঘরে ওকে পৌঁছে দিলেন, কিন্তু যদি না থাকে। যদি বাড়ি না থাকে। যদি ও যেতে না চায়! প্রণবেশ ওর বাড়ি চেনেন না। কোনও সমাধান পান না তিনি। অস্থির লাগে। যন্ত্রণা হয়। পাশে একজনকে পাবার ইচ্ছেয় বনহুগলি পেরিয়ে তিনি আনিসুজ্জামানের কাছে যাবার কথা ভাবেন।

আনিসুজ্জামানের ফ্ল্যাটের নীচে গাড়ি রেখে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি টপকান তিনি। ভাবেন, ভাবতে থাকেন, কৌশিক কি সত্যি পাগল হয়ে গেছে? সত্যিই কি ও বুঝতে পারছে না রাস্তার ধারে এই বাতুল কথনের অপ্রয়োজনীয়তা? আনিসুজ্জামান কৌশিককে চিনতেন। বিকাশও চিনতেন। বিকাশ— প্রণবেশের কষ্ট উপচাতে থাকে। কৌশিকের জন্য হতে থাকা কষ্টে বিকাশের জন্য অনুভূত বেদনা যুক্ত হয়। আজ বিকাশ থাকলে প্রণবেশ সবার আগে তাঁরই কাছে যেতেন!

আনিসুজ্জামানের দরজায় বেল বাজান প্রণবেশ। দরজা খুলে যায়। হাতে কলম নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বোরখা পরা নীলোফা। প্রণবেশকে দেখে দরজা ছেড়ে সরে যায় সে। ঘরে এসে প্রণবেশ দেখেন—ডিভানে অনেকগুলি বই। একই বই সব। চেয়ারে বসে আছেন আনিসুজ্জামান। দরজার দিকে পিঠ। গভীর মনোযোগে দেখছিলেন কিছু। কে এল, কী বলল তাতে নজর নেই। প্রণবেশ পড়ছেন—দুর্গা : বাঙালির সংস্কৃতির দেবী। লেখকের জায়গায় আনিসুজ্জামানের নাম। বইয়ের প্রচ্ছদে পটচিত্রের রীতিতে লাল শাড়ি পরা মা দুর্গা। প্রণবেশ শুনেছিলেন আনিসুজ্জামান দুর্গা নিয়ে কাজ করছেন। এই তা হলে সেই বই! নীলোফা ডাকল— ভাইজান!

আনিসুজ্জামান ঘুরলেন। প্রণবেশকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। তাঁকে বসতে বললেন। তিনি অনুভব করেছেন প্রণবেশ স্বাভাবিক নেই। কিছুটা যেন চঞ্চল ও উদ্বিগ্ন। তা ছাড়াও, প্রয়োজন না থাকলে প্রণবেশ খুব একটা আসেননি তাঁর কাছে। তিনি কিছু জানতে চাইলেন না। প্রণবেশ নিজেই বলবেন তার প্রতীক্ষা করতে করতে একখানি বই দিলেন তাঁর হাতে। নীলোফা চা করবে বলে রান্নাঘরের দিকে গেল। এতক্ষণ কাকে কাকে বই পাঠানো হবে তার তালিকা করছিলেন আনিসুজ্জামান। তিনি বলছিলেন, নীলোফা লিখছিল। নীলোফার হাতের লেখা চমৎকার। মাঝে মাঝে সামান্য বানান ভুল হয় বটে, কিন্তু তার হাতের লেখার মধ্যে ছড়িয়ে আছে তার শিল্পবোধ, যা, সে স্কুলে না গেলেও থেমে থাকেনি, বরং প্রকাশিত হয়েছে কশিদা-কর্মে, গাছের যত্নে আর গৃহস্থালিতে, উন্নীত হয়েছে সেতারে। পৃথিবীকে মুখ দেখাবার উপায় নেই বলে এই পৃথিবীর মুখই সে খুঁজে নিতে চায় নিজস্ব সক্রিয়তায়। পৃথিবীকে বোঝার চেষ্টা করে, নিতে চায় রস, প্রাণ নিতে চায়, সবটা পায় না। সবটা বোঝে না। কিন্তু তার জন্য থেমেও যায় না একটুও। শুধু চেষ্টা করে। কতজন, কত সুস্থ জন, যাদের মুখ ঢাকার প্রয়োজন নেই, এই পৃথিবীতে যাদের অস্তিত্ব অবহেলিত হয়নি, তারা পৃথিবীর রস বুঝবার চেষ্টাটুকুও করে না। জানে না, টবের মাটিতে শিকড় চারিয়ে দিতে গাছের কষ্ট হয় কারণ সেখানে পর্যাপ্ত সম্ভার নেই যা তাদের যথাযথ বেড়ে ওঠার সহায়ক হবে। জানে না যে ওই শিকড়ের তলায়ও জন্মায় অজস্র কীট—আর তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা জীবনচক্র। তারা ভাবতেও চায় না। এই পৃথিবীর কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। তারা জানে আর ভাবে আর দেখে শুধু জন্ম মৃত্যু ভোগ রমণ ও যুদ্ধ—আর মরে যায়। অসার্থক বেঁচে থাকার মধ্যে দিয়ে পঞ্চভূতে নাচে। আর কয়েকজন, মাত্র কয়েকজন, এই মহাবিশ্বের রূপ-রসের ভাগ নিতে নিতে ভাবে কী বিশাল, কী বিচিত্র এই সৃষ্টি! জীবনের প্রান্তে গিয়ে তাদের এই বোধ হয়, কিছুই পাওয়া হল না, কিন্তু কণামাত্র যা পেলাম তাতেই বুঁদ হয়ে রইলাম।

প্রণবেশ বইটির দিকে তাকালেন অন্যমনস্কতায়। অন্যমনস্ক পাতা ওল্টালেন। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ। আনিসুজ্জামান বললেন—অফিস থেকে এলেন?

প্রণবেশ বললেন—হ্যাঁ, বাড়ি ফিরছিলাম। এমন একটা ঘটনা হল যে … …।

—কী হল? কোনও বিপদ?

—বিপদ কি-না জানি না। মনে হল, আপনাকেই বলা যায়। বলা উচিত। বিকাশদা থাকলে হয়তো ওঁর কাছেও যেতাম।

দু’জনেই নীরব হলেন বিকাশ প্রসঙ্গে। আনিসুজ্জামান নিজেও নানা প্রয়োজনে ছুটে গেছেন বিকাশের কাছে। প্রণবেশের মতো তাঁরও ভাবতে কষ্ট হয়েছে যে বিকাশ হত্যা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু এই সন্দেহকে সত্যি প্রমাণ করে দিতে চায় জিনির মুখ—যা আনিসুজ্জামান দেখেছেন অতি করুণ ও ক্লিষ্ট। একটি ঝলমলে প্রাণবন্ত মেয়ে কেন কয়েক মাসেই শিলাবৃষ্টিতে থেঁতলে যাওয়া ফুলের মতো হয়ে যাবে? আনিসুজ্জামানের রাগ হয় বিকাশের ওপর। মাথা জ্বলে। যদি ধরে নেওয়া যায় এই হত্যার ষড়যন্ত্রে তিনি লিপ্ত ছিলেন না তবু এ কথা মানা একেবারেই অসম্ভব যে মেয়েটিকে মারা ও দোষারোপ করার তুমুল কাণ্ডের সবটাই ঘটেছে বিকাশের অগোচরে।

আনিসুজ্জামানের চিন্তা ছিন্ন হল কারণ প্রণবেশ কথা বলছেন—আমার ভাই নীলাদ্রির বন্ধু ছিল, বিকাশদার ছোট ছেলে দেবার্চনের বন্ধু ছিল—জামাল কৌশিক—মনে আছে? আপনার কাছেও আসত!

—হ্যাঁ। কৌশিক। খুব উজ্জ্বল ছিল ছেলেটা। ওর তো বহুদিন খোঁজ নেই। পুলিশের গুলিতে … …

—হ্যাঁ, আমরাও ভেবেছিলাম নীলাদ্রি আর দেবার্চনের মতো ও-ও পুলিশের গুলিতে… কিন্তু তা নয়। কৌশিক আছে।

—কৌশিক! আছে! কোথায়? জেলে?

আনিসুজ্জামানের দু’চোখ বিস্ফারিত হয়। বুকের যন্ত্র দাপিয়ে ওঠে। কৌশিক— উজ্জ্বল সুন্দর সদাহাস্যময় প্রিয় কৌশিক—কত প্রাণ নিয়ে মাতিয়ে বেড়াত! স্বপ্ন দেখত!

—কৌশিক আছে। কিন্তু ভাল নেই অধ্যাপক।

—কী? কী হয়েছে ওর? কোনও অসুখ?

—না। তার চেয়েও খারাপ।

—তা হলে? পঙ্গু হয়ে যায়নি তো? সজলের মতো? কৃষ্ণেন্দুর মতো?

—না। ও পাগল হয়ে গেছে।

—পাগল! কী বলছেন!

—হ্যাঁ, এই মাত্র দেখে এলাম সিঁথিমোড়ে দাঁড়িয়ে সি পি এমকে গালাগালি করছে। অপরিষ্কার জামা-প্যান্ট। চুল উস্কোখুস্কো। রোগা। স্নান-খাওয়ার কোনও ঠিক নেই হয়তো।

—সে কি!

নীলোফা চা নিয়ে এল। দু’জনে চা পান করতে করতে সিদ্ধান্ত নিলেন, এখুনি একবার সিঁথিমোড়ে যাওয়া দরকার। কথা বলা দরকার ওর সঙ্গে।

দু’জনে বেরিয়ে পড়েন। নীলোফা সযত্নে গুছিয়ে রাখে বইপত্র আর অসমাপ্ত তালিকা। রাত্রের রান্নার প্রস্তুতি নেয়।

এ সময় সে একবার নীলিমার কাছে যেত। ইদানীং ইচ্ছে করে না আর। কীরকম পাল্টে যাচ্ছেন নীলিমা। আগের মতো আর গীতবিতান পড়েন না। সাহিত্য পড়েন না। গানও শোনেন আগের মতো। কথা বলতে গেলেই রাধিকা নামে কাজের মেয়েটির প্রসঙ্গ তোলেন— ‘এই দেখো না, আজ কী হল! বললাম, রাধিকা, মোচার বড়া করে ঝোল করো। বলে কি-না উনি তো মোচার ঘণ্টই বেশি পছন্দ করেন! সাহসটা ভাবো। আচ্ছা! এ সংসার আমার, না ওর? আমার ছেলে কী খায় না খায় আমি জানি না! ও জানে!’

নীলোফা অনেক কিছু টের পায়। নীলিমা এতদিনের ঋজু অভিমান ভুলে আজকাল প্রায়ই ও বোনের বাড়ি এ বোনের বাড়ি যেতে শুরু করেছেন। দুঃস্থ মহিলাদের নিয়ে একটি সমিতি তৈরির চেষ্টায় ছিলেন নীলিমা ও এ পাড়ার আরও কয়েকজন। সেই সমিতি গড়ার কাজেও খুব বেশি সময় দিচ্ছেন। ঘরে মন টেঁকে না নীলিমার। আবার বোনের বাড়িতে বা সমিতির কাজেও যে খুব আনন্দ পান তা নয়। খুবই অপ্রসন্নতা নিয়ে ফিরে আসেন। তবু তাঁর যাওয়া অব্যাহত আছে। নীলোফা নীলিমার বহুদিনের অবসরের সঙ্গী। সে তাঁকে বুঝতে পারে। নীলিমা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছেন। তাঁর নিরন্তর যুদ্ধ হতে থাকা জীবনে আবারও এসেছে এক নতুনতর যুদ্ধ যা তাঁর বিশ্বাস, নৈতিক বোধ, সংস্কার ও সংস্কার ভাঙার প্রবণতার মধ্যে বহুমুখী বিরোধ বাঁধিয়ে বসে আছে। নীলোফা ব্যাখ্যা জানে না। শুধু হৃদয় দিয়ে নীলিমার হৃদয় টের পায়। আর নীলিমার না-থাকার দিনগুলিতে নীলোফা উপলব্ধি করে বাস্তব। এবং সত্য। এই সত্য ঘন করার সাধ্য থাকে না সাধারণ মানুষের। রাধিকা তৃণাঙ্কুরকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। তৃণাঙ্কুরের বাথরুম ও আনিসুজ্জামানের বাথরুমের মাঝখানে একটি মাত্র দেওয়াল। নানা কাজে নীলোফা বাথরুমে গেলে শুনতে পায় বা শোনার ইচ্ছা তাকে টেনে নেয় এবং সে শোনে, রাধিকার গলা—আঃ! ছাড়েন। ভিজ্যা যামু। ছাড়েন। মাসিমায় আইয়া আমারে ভিজা দ্যাখলে কী কইবেন!

—উঁ উঁ উঁ মা জানে না কিছু? টের পায় না?

—হ। আমার রাইজ্যের কাম পইড়া আসে। আসেন, পিঠটা ঘৈষা দেই।

নীলিমা জানেন, বোঝেন, সবই টের পান। তবু বাড়ি ছেড়ে চলে যান— সে কি বিরক্তিতে? ঘৃণায়? নাকি কিছুটা সুযোগ দেবার জন্যও যাতে ছেলে আনন্দের বঞ্চনা কিছুটা মিটিয়ে নিতে পারে! নীলোফা বুঝতে পারে না। শুধু তার বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল করে। সে নীলিমার যন্ত্রণায় কষ্ট পায়, আবার, একই সঙ্গে, তৃণাঙ্কুর ও রাধিকাকে গভীর আবেগে সম্মান করে বসে। রাধিকাকে বেশ দেখতে। দুই বাচ্চার মা। তবু সুন্দর। তৃণাঙ্কুর রাধিকায় মজেছেন। রাধিকা, বস্তিবাসী, কাজের লোক, ঝি-শ্রেণীর, তবু মজেছেন নিটুট শরীরের আকাঙ্ক্ষায়। রাধিকার কিছু না থেকেও সব আছে। নীলোফার সব থেকেও কিছু নেই। সে রাধিকার প্রতি ঈর্ষা বোধ করে, কিংবা, হয়তো এই ঈর্ষা একরকম আত্মকরুণা—যা তাকে দগ্ধায় নিরন্তর। কী যেন ঝড় শরীরে তোলপাড় করে বেড়ায়। মনে পড়ে, সে যখন আনিসুজ্জামানের সঙ্গে রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার কথা বলেছিল আর আনিসুজ্জামান, মনিরুল ও আমিনা এ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তাদের বাড়িতে, ওই প্রথম, মণিরুলের মতের বিরুদ্ধে মেয়েদের মত উঠেছিল, সে-দিন গভীর রাত্রে সঞ্জিদা ভীত তিতিরের মতো মণিরুলকে বলেছিলেন— বলো, মেঠাকে তো বিশ্বাস করা যায়, বলো?

মনিরুল বলেছিলেন— হ্যাঁ। যায়।

সঞ্জিদা ॥ কিন্তু, তোমার মতের বিরুদ্ধে গিয়েছি আজ। এই প্রথম। কোনওদিন তো এমন হয়নি। একটু ভয় করছে গো। আমি কোনও অন্যায়, কোনও অধর্ম করছি না তো?

মনিরুল ॥ না, অন্যায় কী? ছেলেটা একা থাকবে না। এ একরকম ভালই হল।

সঞ্জিদা ॥ তবু। মেয়ে তো। বড় তো হয়েছে। চাচেরা ভাইবোন একসঙ্গে থাকবে।

মনিরুল ॥ এ পরিবারে চাচেরা ভাইবোন ভাইবোনই থাকে জানো তো!

সঞ্জিদা ॥ জানি। কিন্তু শুনেছি হিন্দুদের মধ্যেও অনেক সময় চাচেরা ভাইবোনে সম্পর্ক হয়ে যায়। আমি মেঠাকে বিশ্বাস করি। খুবই বিশ্বাস করি। ওর মতো ছেলে লাখে একটা। কিন্তু, তবু, ভয় করে। নীলোফা, শেষ পর্যন্ত, একটা মেয়ে তো!

মনিরুল ॥ উঃ! থামো তো! মেয়ে তো পাঠাচ্ছ কেন! আসলে তুমিও জানো, আমিও জানি— ও আর মেয়ে-ফেয়ে নেই। পুড়ে-ঝুড়ে ওর কি কিছু আছে? শোনো, নীলোফার মা, তুমি সারা জীবন যত পাপ করেছ তা ওই মেয়ের ওপর দিয়ে গেছে। কী কুৎসিত! হে আল্লা। আমার মেয়ে। কিন্তু আমারই ভাবতে ঘেন্না করে। বোরখা খুললে কোনও উন্মাদও ওর দিকে তাকাবে না।

সঞ্জিদা ॥ হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ। আমারই পাপ। না হলে আল্লা ওকে বাঁচিয়ে রাখবেন কেন? মেরে ফেললেন না কেন? ও তো কারও কোনও কাজে লাগবে না!

মনিরুল ॥ আহা-হা। তার জন্য ভেবো না। ও যাতে কাজে লাগে তার ব্যবস্থা তো তোমরাই করে দিলে! মেঠা বেচারা একা থাকত। হাত পুড়িয়ে খেত। ও মেঠার সেবা করবে। তবে হ্যাঁ। ওর সব খরচের ব্যবস্থা আমি করে যাব। মেঠা বলছে বটে বিয়ে-সাদি করবে না। যদি করে! তখন? নীলুর ভবিষ্যৎ কী? বেঁচে যখন আছে, কিছু দায় তো নিতেই হবে। কিন্তু যাচ্ছে যাক। চোখের সামনে সারা জীবন একটা জলজ্যান্ত পাপ ঘুরে বেড়াবে, এ আমার সহ্য হয় না। ওকে দেখলে, সত্যি বলছি, আমার কীরকম গা ঘিন ঘিন করে — বোরখার ওপর দিয়েও।

নীলোফা মনে রেখেছে। এই সব মনে রেখেছে। তার দগ্ধ শরীর নিয়ে আল্লার কাছে জানানো সব অভিযোগ কোনও গোপন অন্ধকারে ডুবে ছিল। বিকৃত মুখ ঢেকে চলার মধ্যেই তার স্বাভাবিকতা জন্মেছিল। কিন্তু তা আর স্বাভাবিক রইল না, অন্ধকারে রইল না যখন আনিসুজ্জামান নীলোফার ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে বমি করলেন। নীলোফার ঝিমিয়ে পড়া ক্ষত দগদগিয়ে উঠল। এ কষ্ট বশ্যতা মানে না। এ দুঃখের উপশম হয় না। নীলোফার মনে অভিযোগ নয়, অভিশাপ নয়— জন্ম নিল নিরভিমান প্রার্থনা। সে জানে, শ্বেতীর দাগ ধরে যাওয়া মুখ ও শরীর আনিসুজ্জামানের, আলো-ছায়ায় কেমন ভৌতিক লাগে, তাঁর পোশাকে কটু গন্ধ ছড়িয়ে যায়, কিন্তু ওই মুখ, ওই গন্ধ নীলোফার বমন উদ্রেক করে না।

টবিন রোড থেকে ধীরে ধীরে চলতে লাগল জিপ। মাথুরের গড় যাবার সময় পথের যে ধারে ছিলেন, এখন তার উল্টোদিকে আছেন প্রণবেশ। এ ধারেই কৌশিকের থাকার কথা। তবু দু’জনে দু’দিকে চোখ রেখেছেন। দু’জনেই উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন, যদি সে কোথাও চলে যায়! যদি ইতিমধ্যে কোনও বাসে উঠে পড়ে! যদি পুলিশ আবার পাকড়াও করে তাকে!

জ্যাম এখনও ছাড়েনি। বরং বেড়ে গেছে। টবিন রোড ও সিঁথিমোড়ের মাঝামাঝি জায়গায় এসে জিপ আর এগোতে পারছে না। ড্রাইভারকে সিঁথিমোড় অটোস্ট্যান্ডে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে নেমে পড়লেন প্রণবেশ আর আনিসুজ্জামান। দু’জনে মিলে পাগল খুঁজতে লাগলেন। কিংবা দু’জনে মিলে নকশাল খুঁজতে লাগলেন। কিংবা, প্রকৃত অর্থে একজন খুঁজলেন মৃত ভাইয়ের বন্ধুকে, অন্যজন প্রিয় ছাত্রবৎ স্নেহভাজনকে। এবং খুঁজে পেলেন। একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে সে তখন বলে যাচ্ছে— আপনারা ভিয়েতনামের কথা ভুলে যাবেন না। ওরা ওদের অস্ত্র নিজেরা তৈরি করেছিল। আজ কংগ্রেসকে সরিয়ে সি পি এম গদি দখল করেছে মানে যদি আপনারা মনে করেন এই কমিউনিস্ট সরকারের আগমনে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল, তবে শুনে রাখুন, এ বার আপনাদের মুখের ওপর নেমে আসবে চাবুকের অন্য পিঠ। কারণ, কমিউনিস্টের মুখোশে এরা সব সাম্রাজ্যবাদের দালাল। আসুন আমরা ওদের অস্ত্র কেড়ে নিই। ওদের মুখোশ খুলে দিই। আমাদের শ্রেণীশত্রু নিপাত যাক। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। …

আনিসুজ্জামান অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছেন কৌশিকের দিকে। তাঁর চোখে জল আসছে। শতাব্দীর শেষের ভাগে শতাব্দীর সেরা বিপ্লবের পরিণতি দেখছেন তিনি। পাগলটির হাত ধরছেন। বলছেন— কৌশিক—

কৌশিক হাত ছাড়িয়ে নিল না। তাকাল না। বলে চলল—… আপনারা ভুলে যাবেন না, নতুন বাম সরকারের সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন একটা ভাঁওতা। হ্যাঁ। মাত্র চার-পাঁচ বছর আগে এদের কী ভূমিকা ছিল আপনারা স্মরণ করুন… …

আনিসুজ্জামান কৌশিকের হাত ধরে ঝাঁকুনি দেন। বলেন—কৌশিক! এ দিকে দেখো। আমার দিকে দেখো। তুমি কোথায় ছিলে? এতদিন কোথায় ছিলে?

—কোথায় ছিল এই মার্কসীয় আনুগত্য যখন গলিতে গলিতে লাশের পাহাড় জমেছিল…

—কৌশিক—

কৌশিক থামে। তাকায়। বহু দূরদেশ থেকে আগত দু’টি অজানা চোখ স্থাপিত হয় আনিসুজ্জামান ও প্রণবেশের ওপর। সেখানে পরিচয়ের জ্যোতি এতটুকুও নেই। স্বীকৃতির আনন্দ নেই। সে হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে— এবার কি আপনারা উল্টো করে ঝোলাবার প্রক্রিয়া নিতে চান? হ্যাঁ, তলায় রাখুন একটি গরম তেলের কড়াই আর তাতে ঝলসে যাক আমাদের মস্তিষ্ক।

এবার প্রণবেশ এগিয়ে আসেন। হাত ধরেন কৌশিকের। বলেন— কৌশিক, আমি প্রণবদা, নীলাদ্রির দাদা। আমাকে চিনতে পারছ না?

কৌশিকের চোখ দু’টি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে এ বার। খুব সন্দেহের সঙ্গে চারপাশে তাকিয়ে সে ঝুঁকে প্রণবেশের কানে কানে বলে— সাবধান প্রণবদা। নীলাদ্রি যেন বাড়িতে না থাকে এখন।

আবার, অনেকদিন পর ভাইয়ের জন্য চোখে জল আসে প্রণবেশের। রুমালে চোখ মোছেন তিনি। আর কৌতূহলী মানুষ চারপাশে ভিড় করে। একজন বলে— পাগলটা সেই দুপুর থেকে বকছে। প্যান্ট খুলে পেচ্ছাপ-টেচ্ছাপও করল এখানে। ভদ্রলোকের মতো দেখতে দাদা। মাঝে মাঝে ইংরিজি বলছে। মারতেও পারছি না। চলে যেতে বললেও যাচ্ছে না।

—আপনাদের কেউ হয়?

—পাগল হল কী করে?

প্রণবেশ বলেন— আমার ভাই। হারিয়ে গিয়েছিল। কৌশিক, তুমি চলো আমাদের সঙ্গে। যাবে তো?

আনিসুজ্জামানও বলেন— এসো কৌশিক। চলো।

জামাল কৌশিক হাসে। হলুদ ছোপধরা দাঁত। মুখের বুনো গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে যায়। তাকে সদ্য ধ্যান-ভাঙা কৃশ বুদ্ধের মতো লাগে। বিস্মৃতির ও পার থেকে ফিরে আসা মানুষের মতো স্বাভাবিক গলায় সে বলে— ভাল আছেন, স্যর?

প্রণবেশ ডান হাত ধরেন। আনিসুজ্জামান বাঁ হাত। রাস্তা পেরুতে হয় না। জ্যাম কাটিয়ে প্রণবেশের জিপ এতক্ষণে মোড়ের কাছে আসার অবকাশ পেয়েছে। তাঁরা জিপে ওঠেন। জনতা দণ্ডায়মান থাকে জিপ বাঁক ঘুরে এগিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। সামনে না বসে কৌশিককে নিয়ে দু’জনেই পিছনে উঠেছেন এ বার। দু’জনেই চিন্তিত। বিবর্ণ। জানেন না কী হবে। কী করবেন। প্রণবেশ বলেন— ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব?

আনিসুজ্জামান কিছু বলার আগেই কৌশিক বলে—স্যর, ওরা কি আসে? আজ কি আসবে?

—কারা?

—মনোজ, সৌমিত্র।

আনিসুজ্জমান কৌশিকের চোখে চোখ রাখেন। তাঁর চোখ জ্বালা করে। তবু বলেন— ওরা আর আসবে না কৌশিক। যেমন নীলাদ্রি, দেবাৰ্চন, সত্যজিৎ— কেউই আর আসবে না।

কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে— তা হলে আর গিয়ে কী হবে? ওদের সঙ্গে অনেক কথা আছে আমার। জেলে অতনু সামন্তর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমরা প্রচুর পরিকল্পনা করেছি। অতনুদা বলেছেন আমাদের কর্মপদ্ধতি বদলাতে হবে। আবার প্রথম থেকে ঢেলে সাজাতে হবে সংগঠনের কাজ। আমি যাব না স্যর। আমি…

সে চলন্ত জিপ থেকে নামতে চায়। প্রণবেশ তার হাত ধরেন। বোঝাতে চান— কৌশিক। তুমি সবার দেখা পাবে। ক’দিন বিশ্রাম করো।

কৌশিক হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো এলিয়ে বসে। পা দু’টি সোজা করে হাত দিয়ে পায়ের পাতা ছোঁয়। বলে— বিশ্রাম? আচ্ছা।

সে চোখ বন্ধ করে। বুঝি-বা বিশ্রাম এখনই শুরু করতে চায়। হয়তো, সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকায় তার পা টনটন করছে।

আনিসুজ্জামান প্রণবেশকে বলেন— আপনার ছেলে ছোট। আপনি নিজে সারা দিন বাইরে থাকেন। বউদি কি পছন্দ করবেন ওকে নিয়ে যাওয়া?

প্রণবেশ অসহায়ভাবে মাথা নাড়েন। স্বীকার করেন—করবেন না। তিনি এ সবই ভাবছিলেন যে আনিসুজ্জামান কৌশিকের দায়িত্ব না নিলে তাঁরই ওকে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু জুঁই কিছুতেই মেনে নেবেন না।

আনিসুজ্জামান প্রণবেশের অবস্থা উপলব্ধি করেন। হঠাৎ নিজেকে তাঁর পরম স্বাধীন ও মুক্ত লাগে। তিনি বলেন— ও আমার বাড়িতেই থাক। পরশু থেকে আমার কলেজে ছুটি পড়বে। তখন অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপনি আসবেন। আমাদের ভেবে দেখতে হবে ওকে নিয়ে কী করা যায়!

প্রণবেশ বলেন— কীভাবে কী করি বলুন তো!

আনিসুজ্জামান ভাবিত থেকে বলেন— দেখি। হয়তো ওর বাড়ির কারওকে খুঁজব।

কৌশিক এখনও চোখ বন্ধ করে আছে। একেবারে চুপ। হয়তো কিছু ভাবছে। হয়তো ঘুমোচ্ছে।

প্রণবেশের জিপ আনিসুজ্জামানের ফ্ল্যাটের নীচে থামল। কৌশিক সি পি এম পার্টি অফিসের হোর্ডিংটার দিকে দেখল একবার। থুথু ফেলল। পার্টি অফিসে ছেলেরা এসে গেছে। প্রণবেশ ও আনিসুজ্জামান পার্টির কারওকে কিছু না বলে কৌশিককে নিয়ে ওপরে চলে গেলেন। তপন বলল— আরে এই পাগলটা আজ সিঁথির মোড়ে বক্তৃতা দিচ্ছিল। প্রণবদারা চিনেছেন তা হলে?

—কী বলছিল?

—তুই চিনিস নাকি?

—কী বলছিল পাগলটা?

—সে কি আর আমি শুনেছি?

—তা হলে বুঝলি কী করে, বক্তৃতা দিচ্ছিল?

—ওই শুনলাম আর-কি। আসলে জ্যাম ছিল তো! বাস আটকে গিয়েছিল। অনেকটাই শুনলাম। বলছিল— মাও সে তুঙ-এর কথা আপনারা ভুলবেন না। যুবশক্তির অপচয় করবেন না। মনে রাখুন— The world is yours, as well as ours, but in the last analysis, it is yours. You, young people, full of vigour and vitality, are in the bloom of life, like the Sun at eight or nine in the morning…

—শিক্ষিত পাগল বলতে হবে, মাও কপচাচ্ছে, কী বল? সুমন বলল— কিন্তু তপন, তোর এত বড় আংরেজি কথাটা শুনেই মনে থেকে গেল কী করে!

তপন হাসল। বলল— আসলে ওই পাগলটাকে আমিও চিনি। আমরা একসঙ্গে পড়তাম। ওই কথাগুলো প্রায়ই বলত ও। নকশাল করত। মাও মুখস্থ করে ফেলেছিল একেবারে। প্রায়ই বলত, অনুসন্ধান করতে হবে, বুঝলি, সঠিক অনুসন্ধান। এ বিষয়ে মাও কী বলেন জানিস?…আমাদের অনুসন্ধান কার্যের মূল পদ্ধতি হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর বিশ্লেষণ করা, আর চরম উদ্দেশ্য হবে তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধকে বোঝা, শ্ৰেণীশক্তির একটা সঠিক মূল্য নিরূপণ করা, এবং তারপর বিপ্লবী সংগ্রামে কোন কোন শ্রেণী মূল-শক্তি জোগাবে, কোন কোন শ্ৰেণীকে মিত্র বলে আমাদের কাছে টানতে হবে, আর কোন কোন শ্রেণীকে উচ্ছেদ করতে হবে, সেটা নির্ধারণ করে সংগ্রামের জন্য সঠিক কৌশল সূত্রবদ্ধ করা। এটাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

কোন কোন শ্রেণীর তথ্যানুসন্ধান করতে হবে? তারা হল নিম্নরূপ :

শিল্পে নিযুক্ত সর্বহারা

হস্তশিল্প কর্মী

ক্ষেতমজুর

গরিব কৃষক

শহুরে গরিব

ভবঘুরে সর্বহারা

হস্তশিল্পী

ছোট ব্যবসায়ী

মাঝারি কৃষক

ধনী কৃষক

জমিদার

ব্যবসায়ী বুর্জোয়া

শিল্পপতি বুর্জোয়া

সুমন চেঁচায়— গুরু! পায়ের ধুলো দাও গুরু। জিভে ঠেকাই। মাইরি। সন্দেহ হচ্ছে। তুমি নিজেও মাও-ফাও পড়েছ কি না।

তপন বলে— না রে। পড়িনি। শুনতে শুনতে হয়ে গেছে। তবে কি জানিস, সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে গেলে একটু পড়াশুনো করা দরকার।

—ছাড় তো। আসল কথা হল কাজ। পড়াশুনো তো করবে তাত্ত্বিক নেতারা। আমরাই যদি অত লেনিন-মাকর্স-মাও সে তুঙ-এর নামতা পড়ি তাহলে পলিটব্যুরো কী করবে? হ্যা—হ্যা— হ্যা। কিন্তু তুই যে বললি পাগলটা তোর চেনা, তো কথা বললি না কেন? পাগল দেখলি আর ফুটে গেলি বাওয়া?

তপন নিশ্বাস ফেলছে বড় করে। বলছে— খানিকটা তাই। পাগল হয়ে গেছে, আর কথা বলে কী হবে! হয়তো চিনতেই পারবে না। বললে বিশ্বাস করবি সুমন, আমার ছ’জন নকশাল বন্ধুর খবর পেয়েছি যারা পাগল হয়ে গেছে।

সুমন তির্যক হেসে সিগারেটে আগুন দিতে দিতে বলল— ধুস্ শালা। নকশাল মানেই তো পাগল। পাগল না হলে কেউ ক্ষুদিরাম হয়?

তপন বলল— কিন্তু নকশাল মানেই পাগল হতে পারে, তবে পাগল মানেই নকশাল নয়।

পার্টি অফিসে হাসির গমক উঠল। কেউ জানতে চাইল না কৌশিককে কেন আনা হয়েছে। তার জন্য কোনও সাহায্যের প্রয়োজন আছে কি না। তাকে রাস্তা থেকে আনিসুজ্জামানের বাড়িতেই বা তুলে আনা হল কেন! তারা জানতে চাইল না কারণ তারা পার্টির কাজে নিবেদিতপ্রাণ। নির্দেশের বাইরে তারা কেনই-বা একজন প্রাক্তন নকশাল সম্পর্কে কৌতুহলী হবে!

বেল বাজিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। নীলোফা দরজা খুলে দিয়েছিল। প্রণবেশের কথা তখন সে শুনতে পায়নি। দরজা খুলেই সে চমকে উঠল। বোরখা-ঢাকা মুখে কয়েকটি শব্দ ছিটকে উঠেছিল তার— এ কী! কৌশিক না!

৪৯

রাত্রে কৌশিক কোনও কথা বলেনি। কোনও গোলমালও করেনি। যা-যা তাকে করতে বলা হয়েছে, ভাল ছেলের মতো তাই করেছে সে। বসার ঘরের ডিভানে তার শোবার ব্যবস্থা হল। এবং সে, যেহেতু আনিসুজ্জামানের চেয়ে দীর্ঘকায়, সুতরাং, আনিসুজ্জামানের পোশাক তার হবে না বলে, প্রণবেশ সুপার মার্কেট থেকে কিনে এনে দিলেন এক জোড়া রেডিমেড পাজামা ও পাঞ্জাবি। একটি বাক্স সহ সাবান ও টুথব্রাশ। একটি তোয়ালে ও চিরুনি। দু’প্রস্থ ভেতরের প্যান্ট ও গেঞ্জি এবং একটি দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম। কারণ আনিসুজ্জামান দাড়ি-গোঁফ কাটেন না বলে এই গৃহে এটি দুর্লভ। যে কোনও সভ্য মানুষের, পরগৃহ বাসকালে, এই সবই নিতান্ত প্রয়োজন বলে প্রণবেশের মনে হল। তিনি ভাবতে লাগলেন, যদি এমন হত, নীলাদ্রি মারা যায়নি, আর জেল থেকে বেরিয়েছে, আত্মবিস্মৃত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন কোনও জায়গায়, ধরা যাক বহরমপুরে, যেখানে কেউ তাকে জানে না, অতএব দিনের পর দিন তার পরিধেয় ছিঁড়তে থাকবে। সে দাঁত মাজে না, স্নান করে না, তার চুলে জট পড়ে, গায়ে মাটি পড়ে, সে বক্তৃতা দেয়, লোকে ঢিল মারে। সে পালিয়ে বেড়ায়। আনমনা চলতে চলতে চুলকে নেয় গা হাত-পা, উকুন-ভর্তি মাথা। সে তৃষ্ণা ভোলেনি তাই রাস্তার কলে জল খায়। সে খিদে বোধ করে এবং পচা গলা ফেলে দেওয়া খাবার কুড়িয়ে খায় আঁস্তাকুড় থেকে এবং ভরপেট হলে শুয়ে পড়ে আবর্জনার পাশেই আর প্রস্তুত করে তার পাগল মস্তিষ্ককে পরবর্তী বক্তৃতার জন্য। যদি এমন হত—আর কে কৌশিক, কে নীলাদ্রি, কে দেবার্চন, কে সত্যজিৎ, কে তাদের বাবা-মা, কোন কলেজে তারা পড়ত, আর কোন পার্টি করত, কত অত্যাচার করা হয়েছে তাদের ওপর আর কারা এইসব অত্যাচার করেছে—সব চাপা পড়ে যেত আবর্জনার স্তূপে।

বাড়ি যাবার আগে প্রণবেশ কৌশিকের মাথায় হাত রাখেন। কৌশিক নির্বিকার। কিন্তু প্রণবেশের চোখে জল এসে যায়। কৌশিকের পিঠে হাত বুলিয়ে আনিসুজ্জামানের হাত দু’টি ধরে বিদায় নেন প্রণবেশ। তাঁর চোখে গভীর কৃতজ্ঞতা আনিসুজ্জামানের প্রতি। গভীর শ্রদ্ধাবোধ। আনিসুজ্জামান কত সহজে উপলব্ধি করেছেন প্রণবেশের সমস্যা এবং দায়িত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, এ দায় নেবার কোনও বাধ্যতা ছিল না তাঁর, তবু। কোনও কথা বলতে পারেন না প্রণবেশ। সহসা তার ধাঁধা লাগে। কোনটা ভাল, কোনটা? পাগলামি, না মৃত্যু!

বাড়ি ফিরে জুঁইকে কিছুই বলেন না তিনি। বলতে ইচ্ছে করে না। জুঁই নীলাদ্রিকে ভালবাসেননি কখনও। কৌশিককে পাওয়া গেছে আর প্রণবেশ তাতে জড়িয়ে পড়েছেন শুনলে জুঁই হয়তো বিচলিত ও বিরক্ত হবেন। অতএব প্রণবেশ, অন্য দিনেরই মত নিশ্চুপ থাকেন, একাগ্র থাকেন বইয়ের প্রতি। বাপ্পাকে পড়াতে ব্যস্ত ছিলেন জুঁই। প্রণবেশের দিকে নজর ছিল না। বাপ্পা ছাড়া অন্য কোনও দিকে নজর দেবার প্রয়োজনও জুঁই বোধ করেন না। প্রণবেশ এক ফাঁকে নীলাদ্রির ছবির কাছে দাঁড়ান। তাঁর মনে পড়ে—ছাদে যাবার সিঁড়ি দিয়ে বারবার উঠছে নীলু আর বলছে এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়।

—কী করছিস নীলু?

—সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক কষছি রে দাদা।

কোন সিঁড়ি যে ভাঙল নীলু, আর ভাঙতে গিয়ে কোথায় ছিটকে পড়ল! হঠাৎ জুঁই এসে দাঁড়ালেন পিছনে। বললেন—কী হয়েছে তোমার?

—কিছু না।

—এখানে দাঁড়িয়ে আছ? কোনও সাড়া নেই!

—এমনিই।

—জড়িয়েছ কিছুতে? অফিসে কিছু হয়েছে? কোনও ঝামেলা পাকিয়েছ?

—না।

প্রণবেশ বই তুলে নেন। জুঁই সমস্ত জড়ানো এড়াতে চান। বাপ্পা ছাড়া, বাপ্পার স্কুল, সাঁতার, ছবি আঁকা, পড়াশুনো আর ভবিষ্যৎ ছাড়া আর সব কিছুই জুঁইয়ের কাছে অদরকারি। মূল্যহীন। আর কিছু ভাবতেই চান না তিনি। বাপ্পা একটু বেশি সময় বাথরুমের দরজা বন্ধ রাখলেই তিনি দরজায় ধাক্কা মেরে চিৎকার করতে থাকেন—বাপ্পা। কী হল! সাড়া দিচ্ছ না কেন? দরজা খুলছ না কেন!

বাপ্পা বিরক্ত মুখে দরজা খুলে দেয়। হয়তো-বা তার স্নান হয়নি তখনও। জুঁই বিরক্ত বোধ করেন। প্রণবেশ এক দিন একান্তে জিজ্ঞেস করেছিলেন বাপ্পাকে—কী করিস অতক্ষণ? বাথরুমে?

—খেলি।

—কী খেলিস?

—জলের সঙ্গে খেলি।

—দরজা খুলে খেলবি।

—না! মা দেবে না।

—কেন দেবে না?

—দেবে না। তুমি জানো না। বলবে ঠাণ্ডা লাগবে। বুঝলে, সাঁতার কাটলে ঠাণ্ডা লাগে না। জল ঘাঁটলে লাগে।

মাঝে মাঝে বয়স্ক মানুষের মতো কথা বলে বাপ্পা, প্রণবেশের বুক টনটন করে। নীলাদ্রিও এ রকম ছিল। ঠিক এ রকম।

বইয়ে মন বসে না। শুধু পড়ার ভান করে যান প্রণবেশ। রাতের খাবার গলা দিয়ে নামতে চায় না। কিন্তু জুঁইকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে বা ধরা পড়ে যাবেন ভয়ে কোনওক্রমে খেয়ে নেন। আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি। অনেক দিন পর বাবা-মা’র কথা মনে পড়ে তাঁর। সন্ধ্যামাসিকে মনে পড়ে। ছোটবেলার কত কথা। চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে বালিশে পড়ে। জুঁই আসেন তখন। প্রণবেশের পাশে শুতে শুতে বলেন—কী হয়েছে তোমার? কেমন লাগছে!

মিথ্যে বলেন প্রণবেশ—মাথা ব্যথা করছে। আর কিছু নয়।

নীলোফা রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে। আনিসুজ্জামান তালিকা তৈরি করছেন। প্রকাশক তাঁকে দিয়েছেন মাত্র কুড়িটি বই। কিন্তু দেবার লোকের সংখ্যা ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। প্রণবেশকে দেওয়া বইখানা তিনি ফেলে গেছেন। আনিসুজ্জামান সেটি সরিয়ে রেখেছেন। কৌশিক বলছে— গান্ধিজিকে জাতির জনক কেন বলা হয় বলুন তো স্যর?

আনিসুজ্জামান তাকাচ্ছেন কৌশিকের দিকে। বলছেন—তিনি জাতিকে জাগিয়েছিলেন বলে। অনুপ্রাণিত করেছিলেন বলে।

—জাগিয়েছিলেন, না ঘুম পাড়িয়েছিলেন স্যর? গান্ধিজি এ দেশের সবচেয়ে বড় বুর্জোয়া। নাথুরাম ওঁকে না মারলে আমি মারতাম।

—শোনো কৌশিক—তোমার নিজস্ব মতামত থাকতে পারে বা পছন্দ-অপছন্দ, কিন্তু অন্য কারও দর্শন বা বিশ্বাস সম্পর্কে শ্রদ্ধা হারানো বাঞ্ছনীয় নয়।

—সোজা কথাটা সোজা করে বলতে আপনার এত কষ্ট কেন স্যর?

আনিসুজ্জামান প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাইছেন। নিজের একটি বই তুলে দিচ্ছেন কৌশিকের হাতে। ভুলতে চেষ্টা করছেন কৌশিক স্বাভাবিক নেই। তাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছেও না। দাড়ি কেটেছে সে। দাঁত মেজেছে। স্নান করে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে। ঝলমলে লাগছে তাকে এখন। প্রায় আগেরই মতো। সে যখন চুপ করে থাকছে তখন আর তাকে পাগল লাগছে না।

আনিসুজ্জামান জানেন শ্যামবাজারের দিকে কৌশিকের বাড়ি ছিল। কোথায় তাঁর জানা নেই। কয়েকবার বাড়ির প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। কৌশিক চুপ করে ছিল। তিনি ভাবছেন, নিরন্তর ভাবছেন, কোথায় ওর বাড়ির খোঁজ পাওয়া যায়।

কৌশিক বলছে—বইটা রাখুন স্যর। নেব না।

আনিসুজ্জামান বলছেন—কেন কৌশিক! এ বই আমি লিখেছি।

—কী হবে স্যর এ সব পড়ে! পোড়ামাটির দুর্গা, পটের দুর্গা, রামের দুর্গা, না রাবণের দুর্গা— এ সব পড়ে কী হবে! এখন প্রত্যেক ভারতীয়র মাথাপিছু জাতীয় ঋণ কত এ নিয়ে একটা বই আপনি লিখতে পারতেন স্যর।

—তুমি তো জানো কৌশিক, আমি অর্থনীতিবিদ নই।

—তাতে কী, স্যর! আপনি তো পুরাতাত্ত্বিকও নন্। তবু কেমন দুর্গা লিখে ফেললেন। আপনি বাজারে যান তো স্যর? যান তো?

—হ্যাঁ, যাই।

—জিনিসপত্রের দাম কীরকম বাড়ছে আপনি জানেন। সবাই আপনার মতো। বাজারে যায়। জিনিসের দাম বাড়ছে দেখে। মুখ ব্যাজার করে ফেরে আর বাড়িতে ফিরে চুল খামচায়। কী করে সংসার চালাবে জানে না। স্যর, ইদানীংকালের হিসেব বলতে পারব না। তবে ১৯৭০ সালে ওয়াঞ্চু কমিটি রিপোর্ট করেছিল ৭০০০ কোটি কালো টাকার নোট বাতিল করা জরুরি। কারণ এর জন্য কৃত্রিম অভাব তৈরি হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মূল্য বৃদ্ধি। ১৯৭৩-৭৪ সালে জিনিসের পাইকারি দাম বেড়েছিল শতকরা ২২.৭ ভাগ। খুচরা দাম বেড়েছিল শতকরা ৫২ ভাগ। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে কোনও কোনও জিনিসের দাম বেড়েছে শতকরা ৩০০ ভাগ। আর মাত্র একটা তথ্য দিই। ১৯৭৬-৭৭ সালে কেন্দ্রীয় পুলিশের জন্য খরচ হয়েছে ১৬৯ কোটি টাকা। ১৯৫০ সালে এই ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি, হ্যাঁ মাত্র ৩ কোটি টাকা। স্যর, এ সব জানার জন্য অর্থনীতি পড়ার দরকার নেই।

আনিসুজ্জামান বলেন—তোমার কথা মানছি কৌশিক। কিন্তু জনজীবনে অর্থনীতি নিয়ে ভাববার গুরুত্ব যেমন আছে, তেমনই সংস্কৃতি সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে ভাববারও গুরুত্ব আছে।

কৌশিক ডিভানে শুয়ে পড়ে। বলে—খিদে পেয়েছে স্যর।

নীলোফা টেবিল প্রস্তুত করে। তিনজনের খাবার সাজায়। বহুদিন পর আনিসুজ্জামানের বাড়িতে কেউ থাকছে। ভাল লাগছে নীলোফার। তিন-চার বছর আগেও কত ছাত্র প্রায় এসে এক-দু’রাত কাটিয়ে যেত। তাদের প্রত্যেকের দুঃসংবাদে কষ্ট পেয়েছে নীলোফা বা কারও আনন্দ-সংবাদে আনন্দ পেয়েছে আনিসুজ্জামানেরই মতো। এখন ছাত্ররা কেউ থাকতে আসে না।

কৌশিক যখন স্নানে গিয়েছিল তখন আনিসুজ্জামান তৃণাঙ্কুর ও নীলিমাকে কৌশিকের বৃত্তান্ত বলে এসেছিলেন। নীলিমা শুনে বলেছিলেন—যেমন বলছ তাতে ওকে আগে ডাক্তার দেখাও। ওর বাড়ির লোককে খুঁজতে গেলে পুলিশের সাহায্য না নিলে হবে বলে আমার মনে হয় না।

তৃণাঙ্কুর বললেন—কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেবে?

ভাবছেন আনিসুজ্জামান। সবই ভাবছেন। কৌশিকের মাথায় খুব বড় ধরনের গোলমাল এখনও বাঁধেনি। হয়তো এখনও চিকিৎসা করালে সেরে উঠবে। কিন্তু মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যাওয়া এখনও সমাজে সহজগ্রাহ্য নয়। কৌশিকের পরিবারের অনুমোদন ছাড়া এ কাজে আনিসুজ্জামান দ্বিধা বোধ করছেন। পুলিশের কাছে যাওয়াও কত দূর যুক্তিযুক্ত হবে কে জানে! কারণ কৌশিক এতদিন কোথায় ছিল তা সঠিকভাবে বলেনি। কিছুটা অনুমান করা যায়। সি পি এম ক্ষমতায় এসে এক ঝাঁক নকশাল বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। হয়তো কৌশিক তাদের মধ্যে একজন। কিংবা সে আদৌ ধরা পড়েনি। পালিয়ে বেড়িয়েছে এতকাল। এখন অবস্থা অনুকূল দেখে বেরিয়ে এসেছে। পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে সে।

হ্যাঁ। এটা ঠিক যে কাগজে বিজ্ঞাপন করা যায়। কারণ সব দিক দিয়ে বিচার করলে কৌশিকের বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে পাওয়াই প্রাথমিক কাজ। কিন্তু মনে মনে উদ্বেগ বোধ করেন তিনি। যদি ঘুম থেকে উঠে দেখেন কৌশিক নেই। যদি যে-কোনও দিন ও বেরিয়ে চলে যায় আর ওর আত্মীয়েরা খবর পেয়ে এসে দেখেন ও নেই! আনিসুজ্জামানের বুক কাঁপে। কিন্তু কৌশিক পালাবার চলে যাবার চেষ্টাও করে না একেবারে। সে ডিভানে শুয়ে ঘুমোয়। অসহায় শিশুর মতো। তাকে, ঘুমন্ত মুখে-চোখে পাগল দেখায় না একদম। পরিচ্ছন্ন করে কাটা দাড়ি আর সযত্ন গোঁফের রেখায় তাকে তরুণ ছাত্রের মতো দেখায় না। হঠাৎ চলে আসা এক ভদ্র শান্ত অতিথির মতোই সে ঘুমোয়। এবং সকালে আনিসুজ্জামানের কাছে কিছু সাদা পাতা চেয়ে নেয় সে। শূন্য পাতায়—কালি নেই, কলম নেই, তুলি নেই—শুধু আঙুলে সে লিখে চলেছে ইস্তাহার। মাঝে মাঝে চোখের সামনে তুলে ধরছে সেইসব আর ভরাট গলায় গাইছে

হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো

রুধিতে পারে কি কেউ

আমাদের মেরে ঠেকানো কি যায়

জনজোয়ারের ঢেউ

কমিউনিস্ট আমরা, আমরা কমিউনিস্ট

যারা খেটে খায়, আমরা তাদেরি

আমরা কমিউনিস্ট।

নীলোফা রান্না করতে করতে শুনছে। তারও, বারবার, ওই কথা আর সুর শুনতে শুনতে সমস্ত প্রক্রিয়া সমেত মস্তিষ্কবাহিত হয়ে চলে আসছে কন্ঠে। সেও গুন গুন করছে—কমিউনিস্ট আমরা, আমরা কমিউনিস্ট।

আনিসুজ্জামান প্রণবেশের সঙ্গে কথা বলছেন। প্রণবেশ কয়েকদিনের ছুটি নেবার কথা ভাবছেন। আনিসুজ্জামান কলেজ যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। ছুটির আগে আজই শেষ ক্লাশ। বেরোবার আগে নীলোফাকে বলছেন—ও তো সুস্থ নেই। তোর যদি একা ভয় করে, মাসিমার কাছে চলে যাস।

নীলোফা মাথা নাড়ছে। তৃণাঙ্কুর আর প্রণবেশ বেরিয়ে গেছেন। নীলোফা নিজের মতো কাজ করেছে এতক্ষণ। বেলা বাড়ছে। নীলোফা তাড়া দিচ্ছে কৌশিককে।

—স্নানে যাও। এই। স্নান করবে না?

নীলোফার ভয় করছে না। বরং কৌতুহল হচ্ছে। তার মধ্যে গভীর সংশয়। ও কি সত্যি পাগল? পাগলের চোখ অত শান্ত হয়? সে কৌশিকের মুখোমুখি বসছে। যেন-বা খেলার সঙ্গী পেয়েছে একজন। মেঝেয় জড়ো করা শূন্য সাদা ইস্তাহারের এ পারে বসে বলছে—আগে যখন আসতে ভাইজানের কাছে তখন তোমায় গাইতে শুনিনি কিন্তু। গাইবে আর একটা?

কৌশিক তাকাচ্ছে। দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে গাইছে—

থাক না হাজার অযুত বাধা

দীর্ঘ দূর যাত্রা কীসের ভয়, কীসের ভয়

সাহসী মোরা লাল ফৌজ এই

লাফিয়ে হই পার।

নীলোফা শুনছে। তাল দিচ্ছে। বলছে—বেশ গাও। খুব ভাল তোমার গলা। এ বার স্নানে যাও।

কৌশিক এক সাবলীল বালকের মতো বলছে—যাব। যদি একটা উত্তর দাও!

—কী?

—তোমার নাম কী?

—নীলু! নীলোফা!

—না।

—সে কী!

নীলোফা বোরখার আড়ালে রিনিঝিনি হাসে। বলতে থাকে—আমার নাম কী তবে?

—নীলুফার। তুমি আসলে নীলুফার। বা নীলোফার। মানে পদ্ম। নীলোফা কোনও পূর্ণ শব্দ নয়।

—তাই?

—হ্যাঁ, এটা অশুদ্ধি!

কৌশিক স্নানঘরের দিকে গমন করে। আর চুপ করে বসে থাকে নীলোফা। অশুদ্ধি! হয়তো! তার সমস্ত অস্তিত্বের মতো নামেও এক অশুদ্ধি ঢুকে আছে। হয়তো এ-ই ঠিক। এ-ই ভাল। সে-ও তো অশুদ্ধই একরকম। এবং নীলোফা না ভেবে পারে না—তার নাম নিয়ে ইতিপূর্বে এ ভাবে ভাবেনি কেউ!

ক্রমে তিনটি দুপুরের পর এসে যাচ্ছে একটি চতুর্থ দুপুর। ইতিমধ্যে প্রণবেশ ও আনিসুজ্জামান কিছুই করে উঠতে পারেননি। প্রণবেশ পুলিশের সাহায্য নিতে রাজি নন। পুলিশের কথা শুনেই আনিসুজ্জামানের হাত আঁকড়ে ধরেছেন তিনি— পুলিশ নয়। পুলিশের কাছে নয়। প্লিজ।

আনিসুজ্জামান, এই মাথুরের গড়ে আসা ইস্তক, সব পরিচিত মানুষের সমস্ত দুর্বলতা ধারণ করে আছেন। তিনি জানেন, প্রণবেশের হৃদয়ের গভীরে পুলিশ শব্দটি দগদগে ক্ষত হয়ে আছে। বারবার আলোচনা করছেন তাঁরা। বারবার ভাবছেন। কৌশিকের সামনে সব আলোচনা করা যেতে পারে না বলে তৃণাঙ্কুরের বাড়িতে বসে আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। স্থির হয়েছে, আরও কয়েকদিন চেষ্টা করে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। একদিন রাস্তায় তপন কথা বলেছিল আনিসুজ্জামানের সঙ্গে। কৌশিকের খোঁজ নিয়েছিল। কৌশিককে সে চেনে তা জানিয়েছিল কিন্তু তার বাড়ির খোঁজ দিতে পারেনি। একটি উপায় ভাবা হয়েছে আপাতত। কৌশিকের কলেজে গিয়ে পুরনো রেকর্ড থেকে যদি ওর ঠিকানা পাওয়া যায়! কিন্তু এ কথা আগে মনে আসেনি কারও। কলেজগুলিতে ছুটি পড়ে গেছে। যদিও তারই মধ্যে খোঁজ নেওয়া হবে বলে স্থির হয়েছে।

এ কথা বলা যাবে না যে কৌশিকের পূর্ণ বিস্মৃতি হয়েছে। হতে পারে সে পরিবারে ফিরতে চায় না। হতে পারে সে ঠিকানা ভুলে গেছে। গ্রীষ্মের পিচগলা দুপুরে ঠিকানার সন্ধানে ঘুরছেন আনিসুজ্জামান। সঙ্গে প্রণবেশ। আজও জুঁইকে জানাননি কিছু। নিয়ম করে অফিসের সময় স্নান করে খেয়ে বেরুচ্ছেন। জানিয়েছেন—গাড়ি আসবে না কিছুদিন। হঠাৎ যদি রাস্তায় কোথাও জুঁইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, প্রণবেশ কী বলবেন জানেন না।

আনিসুজ্জামান বলেছিলেন—বউদিকে জানাননি কেন?

প্রণবেশ বলেছেন—ও বুঝবে না। চেঁচামেচি করবে।

হয়তো। সংসার বোঝেন না আনিসুজ্জামান। এবং না বোঝার জন্য আবারও মনে মনে তৃপ্তি বোধ করেন তিনি। তাঁর স্ত্রী নেই। বন্ধন নেই। চেঁচামেচি বা কৈফিয়ৎ নেই। বিকাশের বাড়িতে গেলে মাঝে মাঝে লক্ষ্মীর শাসন ও চিৎকার কানে আসত। তৃণাঙ্কুরের স্ত্রী শর্মি যখন ছিলেন এ বাড়িতে তখনও চিৎকার শুনেছেন। বেপরোয়া অভিযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল জিনিসপত্র ছোঁড়াছুড়ি টের পেয়েছেন। এ ছাড়া কলেজের অধ্যাপকরা যে-যার গৃহিণীর মেজাজ ও চিৎকারের কাহিনী শোনান মাঝে মাঝে।

আনিসুজ্জামানের বসার ঘরের দেওয়ালে ছড়িয়ে যাচ্ছে শূন্য ইস্তাহার। অনেক লেখার পর কৌশিক সে-সব ঘরে সেঁটে দিচ্ছে। নীলোফা খুবই আপত্তি করেছিল কারণ এই ফ্ল্যাটের দেওয়াল, মেঝে, ঘরের কোণ থেকে বেসিন পর্যন্ত ঝকঝকে ও সুন্দর রাখার দায় ও শিল্পবোধ তারই ওপর বর্তায়। তাদের রিপন স্ট্রিটের বাড়ির মেঝেয় পুরু গালিচা পাতা থাকত। এবং তার তলায় ছ’ মাসের ময়লা ও ধুলো জমত যা বছরে দু’বার পরিষ্কৃত হত এবং নীলোফার তা পছন্দ ছিল না। ধুলো আবৃত করা গালিচাও তার পছন্দ নয়, যা, সে মনে করে, মাঝে মাঝে পাতা ভাল, তাতে প্রতিদিনের ঘরটিকে অন্য রকম দেখাতে পারে বটে এবং ধুলোও জমে না। আর এভাবেই সে দেখে এই দুনিয়া। তার ছোট দুনিয়া ওই সুপার মার্কেট, ওই বি টি রোড ও পি ডব্লু ডি রোডের সংযোগে তেমাথার মোড়ে দু’খানি পেট্রল পাম্প, ওই শ্যাওলাধরা ব্যাঙ্কের বাড়ি, যেখানে সে টাকা তুলতে ও জমাতে যায়। এই পাড়া, এই ফ্ল্যাট— সবই তার প্রতিদিনের, চিরদিনের এবং চিরনতুন। দিন বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে, ঋতু বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে, রোজকার এই সবই সে নতুন করে পায়। শীতের দুপুরে বারান্দার যে জায়গায় তেরছা আলো পড়ে, গ্রীষ্মেই সে জায়গার রূপ বদলে যায়। আর শরতে কেমন জাফরিকাটা রোদ্দুর! বাড়ির পিছনে ওই ঝাঁকড়া আমগাছ আর তার টবের গাছগুলিও এইসব বিচিত্র রোদ্দুর পেয়ে খুশি থাকে। এইসব পাওয়া, এইসব দেখাই তার প্রিয়।

রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে আসার পর সে এক অন্য নীলোফা। ওখানে গাছ নেই, রোদ্দুর নেই, বই নেই, গান নেই। ইচ্ছেমতো মার্কেট যাওয়া নেই। ওখানে শুধু নিয়ম, নিষেধ, শুধু বাচ্চা পালন, শুধু পাপ-পাপ, পুণ্য-পুণ্য। আনিসুজ্জামানের সঙ্গে থাকতে থাকতে নীলোফারও ধর্মাচরণে শৈথিল্য এসে গেছে। আল্লার কাছে সে প্রতিদিন প্রার্থনা জানায়। কিন্তু সেও তার নিজের মতো করে। তার সঙ্গে ছোটবেলা থেকে শিক্ষা করে আসা নিয়মকানুনের কোনও মিল নেই। নীলোফা যদি দগ্ধ ও বিকৃত না হত, যদি তার একটি স্থায়ী দুঃখের জায়গা না থাকত, তাহলে, হয়তো, সে প্রচলিত রীতিগুলো আঁকড়ে রাখার কথা ভাবত। কিন্তু কষ্ট তাকে নির্ভীক করেছে। তাই তার পাপের ভয়ও নেই।

এখানে আসার পর প্রথম প্রথম যখন তাকে নিতে প্রায়ই গাড়ি পাঠাতেন আমিনা, উৎসবের দিনগুলিতে সে রিপন স্ট্রিট চলে যেত, তখনও তার মনে থাকত সব। কিন্তু মনিরুল তৃতীয়বার নিকাহ করেছেন আর আমিনারও ইন্তেকাল হলে রিপন স্ট্রিটের বাড়ির হাওয়া বদলে গেছে। এখন, ও বাড়িতে, চাচেরা ভাই সব আলাদা-আলাদা। মাথুরের গড়ের এই ফ্ল্যাটের দেওয়ালগুলি প্রথম দিন থেকেই নীলোফার প্রিয় ছিল। এখন তা প্রিয়তর হয়েছে। আর সেই দেওয়ালে কৌশিক সাদা ইস্তাহার সাঁটছে। পোস্টার সাঁটছে। নীলোফার রাগ হচ্ছে। আনিসুজ্জামান বলছেন— থাক্। ও যা চায় করুক। পরে তোর দেওয়ালে আমি রং করিয়ে দেব।

নীলোফা কৌশিককে জিজ্ঞেস করছে— কী লিখেছ পোস্টারে?

কৌশিক বলছে— মাও সে তুঙ-এর একটা কথা।

—কী?

—If we tried to go on the offensive when the masses are not yet awakened, that would be adventurism…If we did not advance when the masses demand advance, that would be Right opportunism.

—যা বললে, তার এক বর্ণও যদি বুঝতাম!

—মাও সে তুঙ-এর নাম জানো? শুনেছ?

—হ্যাঁ।

—কী জানো?

—ওই যে চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। দেওয়ালে লিখতে তোমরা। আর লোকে আলোচনা করত।

—মানে?

—মানে, মাও সে তুঙ একজন চৈনিক ব্যক্তি, তোমরা যাকে পুজো করতে।

কৌশিক নীলোফার কাঁধ খামচে ধরে। চোখ দু’টি তার স্ফুলিঙ্গ হয়ে যায়। নীলোফাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলে— তোমার জিভ ছিঁড়ে নেব আমি যদি ওই বুর্জোয়া শব্দটা আর একবার ব্যবহার করো।

নীলোফা ভয় পায়। ব্যথাও পায়। কৌশিকের জ্বলন্ত চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে সে কাঠ হয়ে যেতে যেতে কৌশিকের কাঁধ খামচে রাখা হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে। কিন্তু কৌশিক উন্মাদ। ক্ষিপ্ত। সে বলে চলে—পুজো! আমরা পুজো করি! পুজোকে আমরা ঘেন্না করি। পুজো করে করে… বুঝলে, পুজো করে করে এই দেশটার সারা গায়ে পচন ধরে গেল। ধর্ম-ধর্ম ধর্ম! পূজা-পূজা! প্রার্থনা-প্রার্থনা! গুরু-ভাগ্য-মন্ত্র-পীর! সমস্ত দেশটাকে অক্ষম করে দিয়েছে এইসব! বুঝলে! অক্ষম! আর বলবে তুমি ওই শব্দটা! বলবে? বলবে?

—ছাড়ো! ছাড়ো! লাগছে!

নীলোফা ঝটকা দেবার চেষ্টা করে। এবং ঝাঁকুনিতে, ছটফটানিতে তার মুখ থেকে বোরখার আবরণ সরে যায়। এক ঝলকে নীলোফা সেটি ঢেকে নেবার চেষ্টা করে কিন্তু ওই অনুপলে, ওই ধাক্কায় সমস্ত পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায়। এমনকী কৌশিক নিজেও এক জড়বৎ পৃথিবীর মতো নির্বাক হয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে নীলোফার দিকে। নীলোকার কাঁধ থেকে তার হাত দু’টি খসে পড়ে। নিলোফা অপ্রস্তুত বোধ করে। কী করা উচিত না জেনে, না বুঝে ওঠার চেষ্টা করে। কৌশিক, এই ক’দিনে তার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত যে-স্বর, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও অনেক বেশি গভীর স্বরে বলে—দাঁড়াও।

নীলোফা অমোঘ আদেশের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ। কৌশিক তীব্র চোখে নীলোফাকে দেখতে দেখতে বলে— এই জন্যই? এই জন্যই তুমি এ রকম বোরখা পরে থাকো? বলো? বলছ না কেন?

নীলোফা ঘাড় নাড়ে। তার গলা শুকিয়ে গেছে। কৌশিককে সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে এখন। আবার কীরকম অপ্রতিরোধ্যভাবে ভালও লাগছে। সে বলছে—ঢাকো কেন? বলো? আমি ভাবতাম আনিসুজ্জামান স্যরের মতো মানুষের বাড়িতে এই গোঁড়ামি কেন! এখন বুঝতে পারছি। তুমি ঢাকো কেন? বলো?

নীলোফা কথা বলে না। কৌশিক বলে—তুমি যা, তুমি তাই। এ কথা মনে রাখো না কেন?

এতক্ষণে নীলোফা শান্ত কারুণ্যে বলে—সম্ভব নয়। কেউ সহ্য করতে পারে না যে।

কৌশিক হাঁটু মুড়ে নীলোফার মুখোমুখি বসে। দু’হাত দোয়া প্রার্থনার—অঞ্জলি দেবার ভঙ্গিতে প্রসারিত করে সামনে। তার চোখে আর তীব্রতা নেই। সমস্ত অস্তিত্বে কোমলতা ঢেলে সে বলে—সরাও। আড়াল সরাও।

—না। কিছুতেই না।

—আমি সহ্য করতে পারি নীলোফার। নিতে পারি।

—তবু।

—নিজেকে লুকিয়ো না। নীলোফার। তুমি পোড়া, এটা তোমার লজ্জা নয়। তোমার যন্ত্রণা দেখে-বুঝে যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, লজ্জা তাদের।

—না। আমি ঘৃণা সহ্য করতে পারি না। তুমি জানো না কৌশিক—কী দারুণ ঘৃণা আমি পাই…

—আমি ঘৃণা করি না। আমি ভালবাসি। সরাও নীলোফার। নিজেকে লুকিয়ো না।

নীলোফা পালাতে চায়। কৌশিক বলে— দ্যাখো, তোমার হাত ধরে আমি আটকাতে পারি। জোর করে আড়াল সরিয়ে দিতে পারি। তুমি আমাকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু আমি তা করব না। তুমি মেয়ে তো। আমাকে ভুল বুঝবে। তুমি নিজে থেকে সরাও। আমাকে দেখতে দাও।

নীলোফা যেন-বা স্বপ্নাবিষ্ট হয়। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। কৌশিকের উচ্চারণ— তা হতে পারে আদেশ, বা অনুরোধ, বা প্রার্থনা— তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ ভাবে কেউ কোনওদিন তাকে বলেনি। বলেনি, কেন ঢেকে রাখো! আবরণ সরাও! বলেনি, আমি দেখব। তোমাকে দেখব।

কৌশিক আবারও বলে— সরাও নীলোফার। আমি দেখব। তোমার মুখ আমাকে দেখতে দাও।

নীলোফা আর্তনাদ করে—না না। তুমি দেখবে না।

—কেন? নীলোফার?

নীলোফা দু’হাতে মুখ চাপা দেয়। তার শরীর দুমড়ে দলা পাকিয়ে আসে। যেন সে নিজেই নিজের গর্ভে প্রবেশ করবে এবার। কৌশিক আবার বলে— বলো, নীলোফার, কেন দেখব না আমি বলো।

—তুমি সহ্য করতে পারবে না।

—কেন? কেন?

—তোমার গা গুলোবে। বমি পাবে। তুমি পালাবে।

নীলোফা কাঁদে। কাঁদতে থাকে। উৎক্ষিপ্ত পাঁজর-ফাটা কান্নাকে আটকে রাখার প্রয়াসে তার গলা থেকে জান্তব শব্দ ছিটকোয়।

কৌশিক চঞ্চল হয়। বিচলিত হয়। আবেগে বলে—উঃ মাগো! দেখো। এ দিকে দেখো। আমি তো দেখেছি তোমার মুখ। এক ঝলক দেখেছি। আমি কি পালালাম বলো?

নীলোফা কান্নার দমকে কাঁপছে। বুঝি-বা আবেগেও। কী মধুর, কী আশ্চর্য সুরঋদ্ধ কৌশিকের স্বর। তার আর কথা নেই। প্রতিবাদ নেই। পলায়ন নেই। সে দু’চোখ বন্ধ রেখেছে আর টের পাচ্ছে কৌশিক তাঁর দুই কাঁধ স্পর্শ করছে। বলছে— আমাকে মুখ দেখাতে তোমার কোনও ধর্মীয় বাধা নেই তো নীলোফার? মুখ দেখানোর মধ্যে তুমি কোনও পাপ পাও না তো? দেখো, আমি তো ধর্ম মানি না। আমি জামাল কৌশিক, মানুষ ছাড়া কিছু জানি না আমি। নীলোফার!

নীলোফা মাথা নাড়ছে। কৌশিক বলছে— তা হলে আমি খুলি? খুলে দিই? তুমি কেন জানো না তুমি নীলুফার? সুন্দর সুগন্ধ সুবর্ণ পদ্ম! কেন তুমি বিশ্বাস করো না? উঁ? নীলু— নীলুফার? নীলোফার?

নীলোফা ভেঙে পড়ছে এ বার। সম্পূর্ণ ধ্বস্ত হয়ে বলছে— জানি না। আমি জানি না।

কৌশিক নীলোফার মুখের কাপড় সরিয়ে দিচ্ছে। একটি একটি করে খুলে ফেলছে বোরখার বোতাম। চোখ বন্ধ করে আছে নীলোফা আর তার দু’টি দগ্ধ, খসখসে, এবড়োখেবড়ো হয়ে যাওয়া, সাদা-কালো-খয়েরি ছোপ লাগা, গ্রীষ্মে ঊষর হয়ে যাওয়া ফাটা ফাটা মৃত্তিকার মতো মুখ দু’হাতে ধরে অনিমেষ দেখে নিচ্ছে কৌশিক।

গলা থেকে ভাঁজ ভাঁজ চামড়া উঠে গেছে চিবুকের তলে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুরই মতো। দুই কাঁধে পিণ্ড পিণ্ড দলাপাকানো ত্বক। শুধু অক্ষত মসৃণ কপাল ও চুলের প্রান্ত। কানের লতি দু’টি গলিত। দগ্ধ দোমড়ানো গাল বেয়ে টান পড়া চোখ থেকে আঁকাবাঁকা পথে নামছে অশ্রু। নীলোফা তির তির কাঁপছে। কৌশিক তার পিঠে হাত রেখে কাছে টানছে তাকে। সে আর সংযত নয়, স্ববশ নয়, উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ছে কৌশিকের কোলে। এত বছরের কষ্ট, অভিযোগ, অভিমান ও বেদনার ঢল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে কৌশিকের পাগল পোশাক। কৌশিক টেনে নিচ্ছে নীলোফাকে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পিঠে, কপালে, গালে। বলছে— খুব কষ্ট? উঁ! খুব কষ্ট? আর না। আর কষ্ট পায় না।

সে ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে নীলোফার চোখে। আর শুষে নিচ্ছে জল। আর ওই অশ্রুতে ভেজা ঠোঁট সে বুলিয়ে দিচ্ছে নীলোফার কপালে, গালে, কানে, গলায়। সেইসব, প্রখর গ্রীষ্মের পর, বর্ষার শান্তির মতো শুষে নিচ্ছে নীলোফা। কৌশিক তার ঠোঁট রাখছে সমস্ত দলা পাকানো মাংসপিণ্ডে। আঁচল সরিয়ে দিচ্ছে। একটি একটি করে খুলে ফেলছে ব্লাউজের হুক। পোড়া স্তনের গড়ন আর যথাবিধি নেই বলে অন্তর্বাস ব্যবহার করা সম্ভব হয় না নীলোফার পক্ষে। তাই ব্লাউজের নীচে বিস্তৃত আছে অনাবৃত বুক। পুড়ে গিয়ে টান ধরেছিল দুই স্তনের মধ্যবর্তী উপত্যকায়। ডাক্তারের ছুরি সেই টান কিছুটা উপশম করেছে। উপত্যকার দিকটি নিচু। নমিত। অন্যপাশে বিস্ফার। পোকা লাগা আম্রফলের মতো কিংবা দু’টি পেয়ারা বা পেঁপে—পোকা লেগে বাঁকা ও বিকৃত—এমনই গড়ন। এতটুকু নিটোল চামড়া নেই। যেন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে নিঃসৃত জ্বলন্ত গলন্ত লাভা গড়াতে গড়াতে নেমে গেছে অমিত ভূমণ্ডলে। আর এখন ঠাণ্ডা হয়ে জমে গেছে। কৌশিক মুখ রাখছে সেই কঠিন অমসৃণ উপত্যকায়। সেই বিকৃত স্তনশীর্ষে। নীলোফা ধরা দিচ্ছে। সাড়া দিচ্ছে। তার পুড়ে যাওয়া ত্বকের নীচে বহমান সমস্ত অনুভূতি জাগ্রত হয়ে উঠছে অনিবার্য পুষ্পদল বিকাশের মতো। যদিও সে জানে না তার ত্বক— এই ভাল লাগা, এই স্বর্গ, এই ফুল, এই ফলন্ত পৃথিবী, এই রঙে রঙে রাঙানো আকাশ অনুভূতি-বার্তাগুলি মস্তিষ্কে পৌঁছে দিতে সক্ষম কি না। তবু সে জাগছে। জেগে উঠছে। এক মানসিক নারী। কৌশিক নিজস্ব পুরুষ দিয়ে নারী জাগিয়ে তুলছে। তার সমস্ত বিশ্বাসের ইস্তাহারের সামনে সে গ্রহণ করছে এক নারীকে যার পৃথিবীর কাছে মুখ উন্মোচন করার উপায় নেই। যার প্রাণ দগ্ধ হয়নি। অনুভব দগ্ধ হয়নি। শুধু পোড়া শরীরের পাপে সে ক্লিষ্ট হয়ে আছে।

কৌশিক দুই হাতে জড়িয়ে নিচ্ছে পোড়া শরীরের দাগ। নীলোফার প্রথম বিদীর্ণ হওয়ার যন্ত্রণা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। লাগছে। খুব লাগছে। কিন্তু এ যন্ত্রণাও অপরূপ আনন্দ প্রতিভাত হয়ে উঠছে তার কাছে। সে চোখ খুলছে। বহুক্ষণ পর চোখ খুলছে। সারা ঘরে গ্রীষ্মের দুপুর ঝলসানো আলো। নীলোফা অনাবৃত হয়ে আছে। এই প্রথম সূর্য তার শরীর দেখার অধিকার পেয়েছে। এই প্রথম হাওয়া এসে ঝাঁপ দিচ্ছে সেখানে। আর নীলোফা দেখছে, তার শরীরের মধ্যে শরীর—পরম আনন্দে ঝলমল করছে পরিতৃপ্ত চাঁদ। তার গালে এক দিনের দাড়ি গাঢ় জ্যোৎস্নার মতো সবুজাভ হয়ে আছে। কপালে, নাকের ডগায়, নক্ষত্রের মতো স্বেদ বিন্দু বিন্দু নিটোল অপরিমেয়। যেন এক প্রকৃত পুরুষ, পরমা নারীকে জুড়ে ধ্যানস্থ আছে। সে বলছে— আমি তোমাকে দেখলাম। এই আমার ভারতবর্ষ। দগ্ধ। ঝলসানো। রিক্ত। আমি তোমাকে নিলাম। এই আমার দেশ। তোমার এ পোড়া শরীরের নীচে সব আছে। সব প্রাণ। সব প্রেম। সব অনুভূতি। তোমার প্রতিটি বিকৃত দলাপাকানো মাংসপিণ্ডকে আমি দেখলাম খরায় বন্যায় অন্ধকার কষ্টজর্জর শোষিত অস্তিত্ব। এসো। তোমাকে সুস্থ করে দিই। ও আমার দেশ। আমি তোমার। আমি এসেছি। আমি আসছি।

নীলফো পীরবাবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাল পরিপূর্ণ অকুণ্ঠায়। সে চেয়েছিল এমন পুরুষ— যে তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। আজ তার প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *