আজ কাজের দিন, আজ আর কোনো খেলা নয়। গত রাত্রে প্রায় আড়াইটে পর্যন্ত আড়া চললেও সিদ্ধার্থ সকাল সাতটার মধ্যে মান পর্যন্ত সেরে নিয়েছে। নিজেই কফি বানিয়েছে জেগে উঠে, এরপর সে ব্রেক ফাস্ট সেরে নিয়েই দৌড়োবে।
গতকাল শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূর যাওয়া হয়েছিল, ফেরার পথে সিদ্ধার্থর বান্ধবী নেমে গেছে স্কারসডেলে, সেখানে তার এক বোন থাকে। সুতরাং রাত্তির বেলা অতীনের ঘুমোবার জায়গা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ টাই-এর গিট বাঁধছে, আয়নার মধ্যেই সে দেখলো অতীন। হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে আচ্ছন্নের মতন চেয়ে আছে।
সিদ্ধার্থ বললো, কী রে, তুই এর মধ্যে উঠে পড়লি? তুই তো আর অফিস যাচ্ছিস না!
অতীন জিজ্ঞেস করলো, কটা বাজে? আমাদের বাস ধরতে হবে না?
সিদ্ধার্থ বললো, নিউ ইয়র্ক থেকে বস্টনের বাস প্রতি ঘণ্টায় ছাড়ে। ব্যস্ত হবার কী আছে? আজকের দিনটা থেকে যা, রাত্তিরের বাসে যাবি!
অতীন বিছানা থেকে নেমে এসে বললো, না, না, আটটার বাস ধরতেই হবে। আর দেরি করা চলবে না।
সিদ্ধার্থ বললো, মেয়েরা এখনও ঘুমোচ্ছে। ওদের ডেকে তুলে রেডি করে তুই আটটার বাস ধরবি? পাগল নাকি? দশটার আগে কিছুতেই পারবি না, আই ক্যান বেট! আজ আর ইউনিভার্সিটি অ্যাটেন্ড করতে পারবি না, সো ফরগেট ইট। সারা দিনটা ঘুরে বেড়া, শর্মিলা গুগেনহাইম মিউজিয়াম দেখেনি বলছিল, দেখিয়ে নিয়ে আয়।
হঠাৎ কথা থামিয়ে সিদ্ধার্থ এক ঝলক থামলো। অতীনের দিকে ভুরু নাচিয়ে বললো, বেশ আছিস, অ্যাঁ? এবার দুটো মেয়েকে নিয়ে হারেম বানাবি?
অতীন কোনো কথা না বলে রান্নার জায়গায় এসে কফি বানাতে লাগলো।
সিদ্ধার্থ বললো, আমার জন্য দুটো ডিম ফ্রাই করে দে তো! কালকের খাবারের অনেক লেফট ওভার রয়ে গেছে ফ্রিজে, আজ আর দুপুরে তোরা রান্না-বান্না করিসনি।
টেবিলে এসে বসে টোস্টে দ্রত মাখন মাখাতে মাখাতে সিদ্ধার্থ বললো, আমি আজ টিউবে যাবো। তুই আজ ইচ্ছে করলে আমার গাড়িটা নিতে পারিস। মেয়ে দুটিকে শহর ঘুরিয়ে নিয়ে আয়!
সিদ্ধার্থর মেজাজ কখন যে কী রকম থাকবে তা বোঝা শক্ত। কাল বাইরে বেড়াবার সময় অতীন বেশ কয়েকবার মিনতি করেছিল তাকে একটু চালাতে দেবার জন্য। টানা হাইওয়ে, কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু অতীন নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে, তাই সিদ্ধার্থ কিছুতেই তার হাতে নিজের গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে দিতে রাজি নয়। সে বলেছিল, অত শখ কেন, চাঁদু? আগে নিজের পয়সায় গাড়ি কেন, তারপর যত ইচ্ছে অ্যাকসিডেন্ট করিস! আমার গাড়ি আমি অন্যের হাতে দিই না!
আজ সেই সিদ্ধার্থ নিজে থেকেই অতীনকে গাড়ি দিতে চাইছে, তাও শহরে চালাবার জন্য।
অতীন ভারী গলায় বললো, না, গাড়ি লাগবে না। একটু বাদে বাস-স্টেশনে চলে যাবো। আজ আর শহর ঘোরা-টোরা হবে না!
–হোয়াটস দা হারি, ম্যান! নীচে-ওপরে দু’ খানা অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি থেকে না বেরুতে চাস, একবার এ বিছানায়, আর একবার ও বিছানায়, হ্যাভ ফান!
আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে সপাটে সিদ্ধার্থর গালে একটা চড় কষালো অতীন। চিৎকার করে বললো, মুখ সামলে কথা বলবি!
সিদ্ধার্থর প্লেট থেকে একটা টোস্টের টুকরো ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। সিদ্ধার্থ মনোযোগ দিয়ে সেটা তুললো। তারপর আবার খাওয়া শুরু করলো।
একটু খানি চুপ করে থেকে অতীন বললো, সব সময় ঠাট্টা-ইয়ার্কি ভালো লাগে না!
সিদ্ধার্থ মুখ না তুলে বললো, গেট আউট অফ মাই হাউস, রাইট নাউ, লক স্টক অ্যান্ড ব্যারেল!
অতীন ঘুরে গিয়ে সিদ্ধার্থর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, আই অ্যাম সরি, সিদ্ধার্থ। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল।
–আই সে ক্লিয়ার আউট! অ্যান্ড টেক দোজ টু বেবীজ ইন ইয়োর আর্মস। নেভার সেট ফুট ইন মাই হাউজ এগেইন!
–আমি ক্ষমা চাইছি, সিদ্ধার্থ। আমরা দশটার বাসেই চলে যাবো, কথা দিচ্ছি।
–ক্ষমা? এতদিন বন্ধু ভেবে তোকে দুধকলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছি! আমাকে চড় মারলি, তোর এত সাহস! এক্ষুনি ঘুষি মেরে তোর নাক ভেঙে দিতে পারি। কিন্তু আমি ফিজিক্যাল ভায়োলেন্স পছন্দ করি না। বেরিয়ে যা, এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে দূর হয়ে যা!
–আচ্ছা যাচ্ছি। একটু পরেই
–একটু পরে না। এক্ষুনি! আমি আর তোর মুখ দেখতে চাই না। কোনোদিন আমাকে। টেলিফোনও করবি না। ঐ মেয়েদুটোকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই কর গিয়ে-…
–তোকে আর জ্বালাতন করবো না, সিদ্ধার্থ। আমি ক্ষমা পাবার যোগ্য নয়!
এবার সিদ্ধার্থ মুখ তুলে হো হো করে হেসে উঠলো। নিজের অভিনয়টা বেশ উপভোগ করে সে বললো, টি-ভি’র সোপগুলোতে এইরকম এক একটা দৃশ্য থাকে না? বন্ধুতে বন্ধুতে ভুল বোঝাবুঝি, তারপর থেকে তারা ঘোরতর শত্রু!
অতীন অনুতাপে ও লজ্জায় নির্বাক।
সিদ্ধার্থ বললো, আমার ডিম দুটো ভেজেছিস? দে! কী আমার বীরপুরুষ, বন্ধুকে চড় মেরে রাগ দেখানো হচ্ছে। ব্রেকফাস্টের আগে ভায়োলেন্স, ছি ছি, মোস্ট ডিটেস্টেবল বিহেভিয়ার। আমি বেশিক্ষণ চালাতে পারলুম না, হাসি পেয়ে গেল! কিন্তু সত্যি অতীন, তুই এই নতুন মেয়েটার সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করছিস, আমার খুব খারাপ লাগছে! মেয়েটা এতদূর থেকে এসেছে, একটা নতুন দেশ, তোকে ছাড়া আর কারুকে চেনে না, আর তুই তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলছিস না? তুই যে ওকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছিস, তা সবাই বুঝতে পারছে। এমন কি সুজান পর্যন্ত বলছিল, দেয়ার মাস্ট বী সামথিং রং…
অতীন বলো, হ্যাঁ, এবার অলিকে বলতে হবে!
–কী বলবি?
–শর্মিলার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ব্যাপারটা খুলে বলতে হবে। আমি শুধু ভাবছিলাম, ইস্ট থেকে ওয়েস্টে এলে মনটা অ্যাডযাস্ট করতে কয়েকদিন সময় লাগে, তাই কয়েকটা দিন কেটে গেলে–
–তার মানে তুই ওকে আরও কয়েকটা দিন মিথ্যে আশা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চাস। আমার মতে সেটা অন্যায়। দেখলে মনে হয়, মেয়েটি খুবই সরল, পিওর অ্যান্ড ডিভাইনাল বিউটিফুল, অ্যান্ড মোস্ট প্রবাবলি আ ভার্জিন!
–সেইটাই তো মুশকিল। অলি মিথ্যে কথা কাকে বলে তাই জানে না প্রায়। ওর সামনে আমিও কোনো মিথ্যে কথা বলতে পারবো না, প্রথমেই আমার দিক থেকে সত্যি কথাটা শুনলে ও কতটা আঘাত পাবে তার ঠিক নেই। সেইজন্যই আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারছি না।
–তুই একটা জিনিস বুঝতে পারছিস না, অতীন। ব্যাপারটা কিন্তু শর্মিলার পক্ষেও বেশ অপমানজনক। শর্মিলা তোর জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করেছে, আর তুই ওর নাকের সামনে একটি প্রেমিকা ঝুলিয়ে রাখবি, দ্যাট ইজ আটারলি রিডিকুলাস।
–আমার জায়গায় তুই পড়লে কী করতি, সিদ্ধার্থ?
–আমি হলে? আমি ঐ এয়ারপোর্টে অলি নামবার সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললুম, হে দেবী, দীর্ঘদিন তোমার অদর্শনে আমি আর একটি মেয়েকে ভালোবেসেছি, তার সঙ্গে ভুল করে দু-চারবার শুয়েও ফেলেছি, তুমি আমায় ক্ষমা করো। আজ থেকে তুমি আমার ভগিনী হয়ে গেলে। নহ প্রিয়া, নহ বধু, তুমি মম সুন্দরী ভগিনী
–আবার চ্যাংড়ামি করছিস, সিদ্ধার্থ?
–এই রে, আবার চড় কষাবি নাকি? বড় জোরে লেগেছিল কিন্তু। শোন, সিরিয়াসলি বলছি, তোর এখন উচিত, অন্তত একটা ঘণ্টা এই অলির সঙ্গে নিরিবিলিতে কাটানো। অন্যান্য টুকিটাকি কথা বল। তুই যদি ডিটারমিনড় থাকিস যে ওকে সত্যি কথাটাই বলতে চাস, তা হলে ঠিক এক সময় বেরিয়ে আসবে।–শর্মিলার সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়ে গেছে।
–তাই দেখছি! শর্মিলা তোর চেয়ে হাজারগুণ ভালো মেয়ে। একলা একলা এতদূর থেকে অলি এসেছে, ওর একটা তীব্র হোম সিকনেস হতেই পারে, সেটা বুঝতে পেরেই শর্মিলা ওকে নানা কথায় ভুলিয়ে রাখছে।
–শর্মিলার কাছ থেকে অলিকে আলাদা করাই যে যাচ্ছে না।
–বাজে কথা বলিস না! তুই চেষ্টা করলে বুঝি পারা যেত না। শোন, আমার বেশী সময় নেই, আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে। আমি শর্মিলাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি।
–তুই শর্মিলাকে কোথায় নিয়ে যাবি এখন? একটা কিছু প্লজিবল এক্সপ্লানেশান তে চাই!
–সেটা আমার মাথায় আছে। তুই চট করে শর্মিলাকে একবার ডেকে নিয়ে আয়।
–ওরা দু’জনে এক সঙ্গে ঘুমোচ্ছে। আমি ওখান থেকে একলা শর্মিলাকে কী করে ডেকে আনবো?
–সেটাও আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে? প্রেমে পড়লে লোকে বোকা হয়ে যায়, আর একসঙ্গে ডবল প্রেমে পড়লে তোর মতন যে একেবারে বুদ্ধ হয়ে যায়, সেটা আমার জানা ছিল না। ওহে কফি হাউসের অতীন মজুমদার, আয়নায় একবার মুখখানা দ্যাখো! অবিকল হুতোম প্যাঁচা!
খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে জুতো পরে নিয়ে সিদ্ধার্থ বললো, আমার সঙ্গে নীচে চুল।
অন্য অ্যাপার্টমেন্টটার দরজার সামনে গিয়ে সিদ্ধার্থ বললো, বেল দিলে কে এসে দরজা খুলবে, কার চান্স বেশী বল, অতীন?
অতীন বললো, ফিফটি ফিফটি চান্স!
সিদ্ধার্থ বললো, মোটেই না। বেল শুনে যদি অলি জেগেও ওঠে, তবু নতুন জায়গায় সে একা দরজা খুলবে না। শর্মিলাকে ডাকবে। ইউ ওয়ান্ট টু বেট?
অতীন বেলে আঙুল রাখলো।
সিদ্ধার্থর কথাই ঠিক, একটু পরে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো শর্মিলা। বিরাট হাই তুলতে গিয়ে মুখের সামনে হাত চাপা দিয়ে বললো, কী ব্যাপার, কটা বাজে?
অতীন বললো, এখনো ঘুমোচ্ছো? আমাদের ফিরতে হবে না?
শর্মিলা বললো, আমি মঙ্গলবার ছুটি নিয়ে এসেছি।
সিদ্ধার্থ বললো, শর্মিলা, তোমাদের আরও ঘুমোতে দেওয়া উচিত ছিল। এক্সট্রিমলি স্যরি, তোমাকে ডাকতে হলো। উইল ইউ ডু মি আ ফেভার?
শর্মিলা ঘুম মাখা বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো, ফেভার? কিসের ফেভার?
সিদ্ধার্থ বললো, আমাকে অফিস যাবার পথে একবার ব্যাঙ্কে যেতে হবে, বুঝলে? আমি একটা লোন নিচ্ছি, তাই গ্যারান্টর হিসেবে একজনকে সই করতে হবে। তুমি আমার গ্যারান্টর। হবে?
শর্মিলা ঈষৎ বিরক্তভাবে বললো, এই জন্য ঘুম ভাঙালে? কেন, বাবলু গ্যারান্টর হতে পারে
–অতীনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট একদম নতুন। ওকে দিয়ে ঠিক হবে না।
–দাও, ফর্মটা দাও, সই করে দিচ্ছি!
–ফর্ম আমার কাছে নেই। তাছাড়া গ্যারান্টরকে ইন পার্সন নিয়ে গেলে ভালো হয়। বেশিক্ষণ লাগবে না, যাস্ট আ ফমালিটি। তবে আমাকে কাজটা আজই করতে হবে। একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, প্লীজ। ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ো। চুল না আঁচড়ালে তোমায় কী সুন্দর দেখায়, শর্মিলা! এই ঘুম ঘুম চোখ, কোনোরকমে একটা শাড়ী জড়ানো, মোস্ট ক্যাজুয়াল ভঙ্গি, তাতেই তোমায় যা মানাবে না, ব্যাঙ্কের সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে।
–বাজে বকো না। আমায় দশ মিনিট টাইম দাও!
–ন মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড। অলির ঘুম ভাঙাবার দরকার নেই। তুমি বরং চাবিটা নিয়ে চলে এসো, নইলে ও ভুল করে বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেই কেলেংকারি। অতীন ততক্ষণে ব্রেকফাস্টের জন্য কিছু কিনে–টিনে আনুক।
সিদ্ধার্থ আবার ওপরে এসে বললো, আজ আমার সত্যি ব্যাঙ্কে কাজ আছে। অফিসের কাজ। সেই সঙ্গে আমার একটা লোন অ্যাপ্লিকেশনও করে দেবো। এভরিথিং রেগুলার। তুই ততক্ষণ আমাকে আর এক কাপ কফি খাওয়া।
মোটামুটি দশ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে এলো শর্মিলা। এরই মধ্যে সে চুল আঁচড়েছে, একটুখানি সাজগোজও করেছে। চাবিটা টেবিলের ওপর রেখে সে বললো, অলি ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসতে পারবো না?
সিদ্ধার্থ বললো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার বেশী লাগবে না। অতীন, তুই যা পাঁউরুটি-ফাঁউরুটি নিয়ে আয়।
অতীন বললো, তোরা এগো। আমি একটু পরে যাচ্ছি।
শর্মিলা আর অতীন লিফটের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। লিফটটা নীচে নামছে, আবার ওপরে আসতে মিনিট খানেক দেরি হবে। সিদ্ধার্থ জ্যাকেটের দু পকেট চাপড়ে বললো, ওঃ হো, লাইটারটা আনতে ভুলে গেছি। শর্মিলা, আমি এক্ষুনি আসছি!
দ্রত ঘরের মধ্যে ফিরে এসে সে অতীনের পশ্চাৎদেশে একখানা লাথি কষিয়ে বললো, টিট ফর ট্যাট, ইউ টেইক দ্যাট! শোন, এবার যদি বেগড়বাঁই করিস তা হলে ভালো হবে না কিন্তু! পরিষ্কার, সত্যি কথা বলবি, যা যা হয়েছিল, সব বলবি, একেবারে সেই জামসেদপুর থেকে! মেক আ ক্লিন ব্রেষ্ট অফ ইট! আমি ব্যাঙ্ক থেকে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে তোকে ঐ নীচের অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করবো। তুই যদি আমাকে তখনো অল ক্লিয়ার না দিতে পারিস, তা হলে আমি নিজেই শর্মিলার কাছে সব ফাঁস করে দেবো। আই মীন ইট!
দরজার কাছে চলে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ বললো, মেয়েটা যদি খুব কান্নাকাটি করে, তা হলে বড় জোর তাকে দু-একটা চুমু-টুমু খেয়ে সান্ত্বনা দিতে পারিস, এর বেশি কিছু করে ফেলিস না কিন্তু রাস্কেল!
দড়াম করে দরজাটা টেনে দিল সিদ্ধার্থ। অতীন একটা সিগারেট ধরিয়ে, স্থির দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে, নিথরভাবে বসে সেটা শেষ করলো।
তার মনে পড়ছে নীল-নীল জলের দৃশ্য। জলের কী সাঙ্ঘাতিক ওজন, তার বুক চেপে শেষ নিশ্বাস বার করে আনছিল প্রায়। কেন সে সেদিনই শেষ হয়ে গেল না? এ পৃথিবীতে তার বদলে তার দাদার মতন একজন ছেলের বেঁচে থাকার অনেক বেশী প্রয়োজন ছিল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতীন উঠে দাঁড়ালো। সিদ্ধার্থ ঠিকই বলেছে, অলিকে বলতেই হবে। সব কিছু, আর দেরি করাটা আরও বেশি অন্যায় হয়ে যাবে। শর্মিলার প্রতিও অন্যায়।
চাবিটা নিয়ে অতীন নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে। সিদ্ধার্থর বন্ধুটির ফ্ল্যাটে দরজায় চাবি লাগাতে যেতেই উল্টো দিকের দরজাটা খুলে গেল হঠাৎ। অতীন এমনভাবে চমকে কেঁপে উঠলো যেন সে চুরি করতে এসে ধরা পড়ে গেছে। একজন বয়স্কা মহিলা সারা মুখে রুজ-পাউডার মাখা, হাতে একটা শপিং ব্যাগ, অতীনের দিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না, সোজা এসে দাঁড়ালেন লিফটের সামনে, সঙ্গে সঙ্গে লিফট এসেও গেল, তিনি ঢুকে গেলেন তার গহুরে।
এরকম ভয় পাবার জন্য অতীনের নিজের গালে চড় মারার ইচ্ছে হলো। এটা অন্য দেশ। প্রায় একটা অন্য গৃহ। এখানে কে কখন কোন অ্যাপর্টমেন্টে আসছে, কে কোথায় কার সঙ্গে শুচ্ছে, তা নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে একটা কথাও উচ্চারণ করবে না। যার হাতে যখন চাবি, সেই তখন মালিক।
প্রায় নিঃশব্দে দরজাটা খুললো অতীন। বড় বিছানাটার এক কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে। আছে অলি। অতীন কি কখনো অলিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছে? তার মনে পড়ছে না। ভবানীপুরের বাড়ির তিনতলায় অলির নিজস্ব ঘরটায় কখনো কখনো ও শুয়ে শুয়ে পড়াশুনো করতো, অতীন হঠাৎ সেখানে ঢুকে পড়েছে কোনো দুপুরে, একদিন বোধহয় চোখ বোঁজাও ছিল, তবু সে দৃশ্য অন্যরকম। সেখানে সারা বাড়িতে লোক, এখানে দরজা বন্ধ করলেই আর গোটা পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগ নেই।
বিছানার কাছে গিয়ে কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো অতীন। দেয়াল থেকে রবীন্দ্রনাথ, চে গুয়েভারা, মৌলানা ভাসানী ব্যগ্রভাবে চেয়ে আছেন তার দিকে। মৃদু নিঃশ্বাসে ওঠা-পড়া করছে অলির বুক, তার শরীরটাই যেন একটা পাখির মতন।
খুব আস্তে অতীন দু বার ডাকলো, অলি, অলি!
অলির ঘুম ভাঙলো না। অতীনের তখন মনে হলো, একটু দূরে সরে গিয়ে কোনো একটা শব্দ করে অলিকে জাগানোই ভালো। হঠাৎ খুব কাছে অতীনকে দেখলে অলি ভয় পেয়ে যেতে পারে। খুব জোরে রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে দিলে কেমন হয়?
পরমুহূর্তেই অতীন সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে অলির একটা হাত মুঠো করে ধরে ডেকে উঠলো, অলি! অলি!
অলি এবার চোখ মেলে চাইলো। অতীনকে দেখেই তাড়াতাড়ি অন্য পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করলো, শর্মিলা কোথায়?
অতীন বললো, শর্মিলা একটু বাইরে গেছে।
অলি বললো, ওমা, আমায় ডাকলো না? আমি বুঝি বড় বেশী ঘুমিয়েছি? কটা বাজে এখন?
অলি নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো, অতীন সেটা শক্ত করে ধরে রেখে বললো, তুই কেমন আছিস, অলি!
অলি কোনো উত্তর না দিয়ে কয়েক পলক চুপ করে তাকিয়ে রইলো। অতীনের মনের মধ্যে একটা প্রবল ইচ্ছে করছে অলিকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। এই সেই অলি, তার একেবারে নিজস্ব, অলির ওপর সে কত অত্যাচার করেছে, অলির ঠোঁট কামড়ে রক্ত বার করে দিয়েছিল
একদিন, অলি সব সহ্য করেছে, তার ওপর ছিল অলির অসীম নির্ভরতা!
কিন্তু অতীন এটাও বুঝলো, অলিকে এখন জড়িয়ে ধরে আদর করা আর যায় না। সে শর্মিলাকেও অপমান করতে পারে না।
অলির সারা মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব ছড়িয়ে পড়লো। সে মুখ নীচু করে বললো, বাবলুদা, তুমি আমার ওপর খুব রেগে গেছো, তাই না? কলকাতা থেকে কেউ নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে তোমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে!
অতীন বললো, তার মানে? কেউ তো আমায় কিছু লেখেনি!
অলি বললো, এখানে পৌঁছোবার পর আমি তোমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে থাকছিলুম, তুমি বুঝতে পারোনি? সব সময় শর্মিলার পাশাপাশি থেকেছি, যাতে তোমার সঙ্গে একলা পড়ে যেতে না হয়। বাবলুদা, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তো?
অতীন এবার ভুরু তুলে বললো, কী বলছিস তুই? কী হয়েছে অলি?
অলি মুখ না তুলেই অপরাধিনীর মতন বললো, আমি আরও জোরজার করে অ্যামিরিকায় এলুম কেন জানো? শুধু তোমার জন্য! মানে, তোমার কাছে সব কথা খুলে বলবো, চিঠিতে লেখা যেত না, চিঠিতে বোঝানো যায় না।
অলির হাত ছেড়ে কার্পেটের ওপর বসে পড়ে অতীন সিগারেট খুঁজতে লাগলো। সে এখনো কিছুই বুঝতে পারছে না, কিংবা বুঝতে চাইছে না।
অলি বললো, তুমি অনেকদিন ছিলে না, আমি বড় একা হয়ে পড়েছিলুম, বাবলুদা। আমার তো আর কোনো বন্ধু ছিল না। বর্ষাও চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেল। একমাত্র পমপমের। সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল, পমপম জেলে যাবার পর, আর কেউ রইলো না! তখন একজন এলো, আমার পাশে দাঁড়ালো, আমার মনটা খুবই দুর্বল, তুমি তখন অ্যাবণ্ড করে আছো, তোমার হোয়্যার আবাউটস কেউ জানে না, এমনকি কৌশিকও জানে না বলেছিল, বাবলুদা, আমি তখন প্রায় ভেঙে পড়েছিলাম, সেই সময় একজন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, সেই হাত আমি ফেরাতে পারিনি।
অতীন তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, তোর সঙ্গে একজন কারুর ভাব হয়েছে? কে সে?
অলি বললো, তুমি তাকে দেখেছো, হয়তো হয়তো নামটা মনে নেই। তার নাম শৌনক ব্যানার্জি, পমপমের বাবার হয়ে ইলেকশন ক্যামপেন করেছিল।
–শৌনিক ব্যানার্জি? পমপমের বাবার হয়ে কাজ করেছিল, তার মানে সি পি এম?
–বাবলুদা, শুধু কোন পার্টির লোক, এই হিসেব করে কি মানুষের বিচার করা যায়? শৌনক খুব পরিচ্ছন্ন মানুষ, আমাকে সে খুব ভালো বোঝে। এত ভদ্র যে কোনোদিন ব্যবহারে কোনো রকম বেচাল কিছু, মানে, সত্যি কথা বলছি, তুমি রাগ করো না, বাবলুদা, তার সঙ্গে তোমার স্বভাবের অনেক দিক থেকে মিল আছে। সেই সময়টায় আমার মনের যা অবস্থা, শৌনক আমার পাশে এসে না দাঁড়ালে আমি বোধহয় পাগল হয়ে যেতুম! আমি দুর্বল বাবলুদা, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারিনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে?
ঘুম থেকে সদ্য জেগে উঠলেও অলির কণ্ঠস্বরে একটুও জড়তা নেই। শেীনকের চেহারাও তার কাছে স্পষ্ট। শুধু শৌনকের চোখ দুটো সে দেখতে পায় না। যেন একটা মাটির মূর্তিতে এখনো চক্ষু দান হয়নি। যেন একজন নবীন শিল্পীর গড়া প্রথম পূর্ণাঙ্গ মূর্তি, তাই এর প্রতি বিশেষ মায়া ও আসক্তি। সেইরকম আসক্তি নিয়েই সে শৌনক সম্পর্কে কথা বলে যেতে লাগলো। একটু একটু লজ্জায় তার মুখে লালচে আভা।
অতীনের সবঙ্গ রাগে জ্বলে উঠলো। নিশ্চিত কোনো মতলববাজ ছেলে অলির মতন একটা নরম মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার সুযোগ নিয়েছে। অলিকে পাওয়ার লোভ তো আছেই, অলির বাবার সম্পত্তি পাবার লোভও থাকতে পারে। ঐ সি পি এমের ছেলেগুলো এখন ভোটে বিশ্বাস করে, পাওয়ারে গিয়ে আখের গুছিয়ে নিতে চায়। সব কটা এখন কেরিয়ারিস্ট!
আবার কাছে এসে অন্যরকমভাবে অলির হাত চেপে ধরে অতীন কড়া গলায় বললো, কে ঐ শৌনক, তুই আমাকে সব খুলে বল তো! তোকে যদি কেউ ঠকাবার চেষ্টা করে, আমি তাকে শেষ করে দেবো!
অলি মুখ তুলে ফ্যাকাশে-ভাবে হেসে বললো, বাবলুদা, আমি যেমন তোমার অলি ছিলুম, চিরকাল সেইরকমই থাকবো। শুধু সম্পর্কটা একটা আলাদা হবে। আমি শৌনককে কথা দিয়ে ফেলেছি। তুমি ওর ওপর রাগ করো না! আমার ওপর যতখুশী রাগ করতে পারো।
অতীন বললো, সি পি এমের ছেলে, তার মানে কৌশিকদের সঙ্গে তুই কোনো সম্পর্ক রাখিসনি?
অলি বললো, ঠিক তার উল্টো। কৌশিক-পমপমদের সঙ্গে শৌনকের যতই মতবাদের তফাত থাকুক, তবু শৌনক ওদের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলে না। বরং ইনডাইরেক্টলি আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। শৌনক চায়, মানিকদা-কৌশিকদের মতন এককালের সিনসিয়ার ওয়াকারদের আবার দলে ফিরিয়ে আনতে। নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি ও ঘৃণা করে।
–অলি, আমি আগে এই শৌনক নামের ক্যারেকটারটিকে দেখতে চাই! আমি সি পি এমের ছেলেদের বিশ্বাস করি না। ওরা সরোজ দত্ত, সুশীতলদাকে দল থেকে কৌশিক এখন কোথায়?
–কৌশিক জেল ব্রেক করেছে, তা তুমি নিশ্চয়ই জানো। এত সাকসেসফুলি পালিয়েছে, যে এরকম নাকি ওখানকার হিষ্ট্রিতে কখনো হয়নি। কৌশিক এখনও পুরোপুরি অ্যাকটিভ।
–আর মানিকদা?
–অ্যাবসকন্ড করে আছেন। শৌনকেরই একটা চেনা বাড়িতে, মানিকদা অবশ্য সেটা জানেন না। মানিকদা তোমার কথা খুব বলেন।
অতীনের প্রশ্নগুলো শৌনককে ছেড়ে অন্যদিকে চলে যেতে অলি অনেকটা স্বাভাবিক বোধ করলো।
ঝনঝন করে বেজে উঠলো টেলিফোন। অতীন গিয়ে ধরতেই সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করলো, হ্যালো ওল্ড চ্যাপ, অল ক্লিয়ার?
ক্লান্ত, পরাজিত, বিমর্ষ সুরে অতীন বললো, হুঁ। অল ক্লিয়ার।