চতুঃশ্চত্বারিংশ অধ্যায় – শিব-বিবাহ
মার্কণ্ডেয় বলিলেন–গিরিজা, শম্ভু বাক্য শ্রবণ করিয়া হৃষ্ট-চিত্তে বিবেচনা করিলেন, মনোহর পতি পাইয়াছি। ১
অনন্তর কালী, যেরূপে শঙ্কর শুনিতে পান এবং শুনিয়া উৎসুক হন, সেই ভাবে সখী দ্বারা বলাইলেন। ২
সজ্জনেরা মৰ্যাদানুসরণ করিয়া কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে হর, মৰ্যাদা-অনুসারে আমার পাণিগ্রহণ করুন। ৩
কন্যা পিতৃদত্তাই হইয়া থাকে, তপোদত্তা কখনও হয় না; যদি আমি তপোদত্তাই হইয়া থাকি, তাহা হইলেও পিতা আমাকে প্রদান করিবেন। ৪
তবে পিতা হিমালয়ের নিকট, প্রার্থনা করিয়া বৈবাহিক বিধিমতে হর আমার পাণিগ্রহণ করুন। ৫।
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–এই কথা বলিয়া কালী লজ্জাপরবশ-চিত্তে শীঘ্র মৌনভাব অবলম্বন করিলেন, হরও সেই বাক্য সত্য ও হিতকর এবং যোগ্য বলিয়া গ্রহণ করিলেন। ৬।
তাহার পর শম্ভু, গণের সহিত সেই গঙ্গাবতরণ সানুতে পূর্বের ন্যায় বাস করিতে লাগিলেন। ৭
কালী সখীগণের সহিত পিতার গৃহে গমন করিলেন; লজ্জাবশত সতী গুরুজনের মুখপানেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে পারিলেন না। ৮
ইহার মধ্যে চন্দ্রশেখর, কালীর প্রার্থনার জন্য মরীচি প্রভৃতি সপ্ত মুনিকে চিন্তা করিলেন। ৯
মদনারি হর চিন্তা করিবামাত্রই মুনিগণ আকৃষ্ট বস্তুর ন্যায় হর-সমীপে তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হইলেন। ১০
শম্ভু, মুনিগণকে প্রদীপ্ত সন্তাপাগ্নির ন্যায় দেখিলেন, তাহার পর বসিষ্ট সমীপে তৎপত্নী অরুন্ধতীকে দেখিলেন। ১১
মুনি-সমীপে অরুন্ধতীকে দেখিয়া বিবেচনা করিলেন, মুনিরাও দারপরিগ্রহ ধর্ম পরিত্যাগ করেন না। ১২ ব
তাহার পর স্মরণাকৃষ্ট মুনিগণ বৃষধ্বজকে বিধিমতে পূজা করত হর্ষ-গদগদ চিত্তে এইরূপ প্রিয় বাক্য বলিলেন! ১৩
ঋষিগণ বলিলেন,–চন্দ্র-সদৃশ চন্দ্রখণ্ডের দ্বারা শোভিত এবং অভ্যন্তরে প্রজ্ঞা দ্বারা বিশেষরূপে চিন্তিত সেই শুদ্ধরূপ অদ্য প্রত্যক্ষভাবে দৃষ্ট হইতেছেন। এটি মুনিগণের বহু অদৃষ্টফল। ১৪
প্রজ্ঞাতন্ত্র এবং ধ্যানতন্ত্র সম্মুখে উপস্থিত ধ্যানীদিগের নিরন্তর ধ্যেয় স্বয়ং প্রকাশমান, যাহার অগ্রভাগ দর্শন করিয়া নেত্রের সহিত দর্শক পরিত্রাণ পায়। সেই সূৰ্য্যতুল্যদর্শন, তেজের স্থান, সকলের পক্ষে নিত্য শম্ভুদেহ–ভক্তি এবং স্তুতিপূর্বক নমস্কার করি। ১৫-১৬
যে কলারূপে আদিভাগ স্থিত হইয়া প্রকাশ করিতেছেন; যাহাকে হর, শক্তি দ্বারা ললাটে ধারণ করিতেছেন; তিনি আমাদের প্রথমতঃ সুসিদ্ধির নিমিত্ত হউন। ১৭
যিনি সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, এই গুণত্রিতয়ের দ্বারা জগতের প্রধান পুরুষ, সেই হর, আমাদের প্রতি প্রসন্ন হউন। ১৮
এইরূপ স্তব করিয়া বিনয়াধার মুনিগণ বলিলেন, আপনি আমাদিগকে কি জন্য স্মরণ করিয়াছেন, তাহা বলুন। ১৯
তাহার পর শঙ্কর মুনিদিগের বাক্য শ্রবণ করিয়া কিঞ্চিৎ ম্মিতভাবে সেই সমস্ত মুনিগণের প্রত্যেককে বলিলেন। ২০
জগতের হিতের জন্য, নিজের সুখ ভোগের নিমিত্ত এবং সন্তানবৃদ্ধির জন্য দার গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি। ২১
সেই বিষয়ে সম্প্রতি আপনাদের সাহায্য করিতে হইবে। আমার নিমিত্ত হিলালয়-সমীপে তৎসুতা কালীকে প্রার্থনা করিবেন। ২২
কালী, মহাতপস্যা করিয়া আমাকে পতি লাভ করিয়াছেন; কিন্তু বিধি ক্রমে তাহাকে গ্রহণ করিতে হইবে, অতএব গিরিসমীপে প্রার্থনা করুন। ২৩
আপনারা অত্যন্ত বাগ্মী, অতএব যেরূপে হিমালয় স্বয়ং কালীকে প্রদান করিবার নিমিত্ত উৎসাহিত হন, সেইরূপ যত্ন করুন। ২৪
মার্কণ্ডেয় বলিলেন, মুনিগণ হরকে সম্ভাষণ করিয়া গিরিভবনে গমন করিলেন এবং গিরিকর্তৃক পূজিত হইয়া তাহাকে বলিলেন। ২৫
যিনি চন্দ্রশেখর দেব, যিনি দেবতাদিগের শ্রেষ্ঠ, যিনি জগতের একমাত্র কর্তা, যাঁহাকে অভিশপ্ত ব্যক্তি জানিতে অক্ষম, যিনি প্রলয়কালে সমস্ত জগৎকে সংহার করেন যিনি ভক্তসমূহে ঐশ্বৰ্য্য দান এবং যিনি নানারূপে মনোহর। ২৬-২৭
তিনিই আপনার কন্যাকে ভাৰ্য্যাত্বে গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। যদি তাহাকে আপনার কন্যার যোগ বর বিবেচনা করেন, তাহা হইলে হে গিরিরাজ। সেই চন্দ্রশেখরের হস্তে কন্যা কালীকে সম্প্রদান করুন। ২৮
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–মুনিগণ এই কথা বলিলে, গিরিপতি চিরকাল হৃদয়ে জাগরূক সেই বর, দুহিতার প্রিয় জানিতে পারিয়া হৃদয় সেই পথেই ধাবমান হইল। ২৯-৩০
প্রকাশ্যভাবে মুনিগণকে বলিলেন, ভবাদৃশ মুনিশ্রেষ্ঠদিগের আগমনে আমি পবিত্র হইলাম এবং আমার মনে করিলেল, আপনাদের প্রার্থনা বশতই আমি হরকে সমর্পণ করিব। ৩১
পূর্বে শিবকে পতি হইবার জন্য কালী কঠোর তপস্যা করিয়াছে। এটি বিধাতার নিয়োগ, অতএব কোন ব্যক্তি অন্যথা করিতে সক্ষম হইবে? ৩২
আমার কন্যাকে হর ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তি প্রার্থনা করিতে পারে? হর যাহাকে গ্রহণ করিবেন, তাহাকে অন্য কেহ ইচ্ছা করিতে পারে না, কালীও হরকে মনের দ্বারা গ্রহণ করিয়াছে, অন্য কাহাকেও বাঞ্ছা করে না। ৩৩
এই কথা বলিয়া গিরি মেনকার সহিত শিবকে পাৰ্বতীদানে অঙ্গীকার করিলেন, মুনিগণ তাঁহার নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া, শিব-সমীপে গমন করিলেন। ৩৪।
হে দ্বিজগণ। মরীচ্যাদি ঋষিগণ গমন করিয়া, হিমালয় যাহা বলিয়াছেন তৎসমস্ত শিবকে বলিলেন। ৩৫
হে হর! হিমালয় আপনাকেই কন্যা দান করিবার নিমিত্ত স্বীকৃত হইয়াছেন। ৩৬
অতএব আপনার যাহা কর্তব্য তাহা করুন। ভগবন্! আমাদিগকে স্বস্থানে যাইতে অনুমতি করুন। ৩৭
হর, কাৰ্যসিদ্ধি হইয়াছে, জানিতে পারিয়া, হৃষ্টান্তঃকরণে তাহাদিগকে গমন করিতে অনুমতি করিলেন। ৩৮
তাহাদের উপযুক্ত মত কথা বলিয়া প্রত্যেককে ক্রমে ক্রমে বলিলেন, আপনারা কালীর বিবাহ সময়ে পূনর্বার আমার নিকট আগমন করিবেন। হর এই কথা বলিলে, মুনিগণ প্রতিশ্রুত হইয়া গমন করিলেন। ৩৯
তাহার পর গমনাগমন করিয়া পরস্পর পরস্পরের প্রিয় হইলেন এবং হরের আজ্ঞানুসারে গিরি, বিবাহের সময় নিরূপণ করিলেন। ৪০
বৈশাখ মাসে শুক্লপক্ষীয় পঞ্চমী তিথিতে বৃহস্পতিবারে উত্তরফলুনী নক্ষত্র যুক্ত চন্দ্র এবং ভরণী নক্ষত্রস্থিত সূৰ্য্য হইলে সেই দিন মরীচি প্রভৃতি মুনিগণ আগমন করিলেন। ৪১-৪২
হর, চিন্তা করিবামাত্র ব্রহ্মাদি দেবগণ, সমস্ত দিকৃপাল, মুনিগণ, শচীসহ ইন্দ্র, ব্ৰহ্মাণী আদি মাতৃগণ, ব্রহ্মপুত্র নারদমুনি–ইহারা তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হইলেন। ৪৩
এই সমস্ত পরিজনের সহিত সুর ও প্রমথাদিগণের সহিত আপ্যায়িত হইয়া, হর বিবাহ-বিধি অনুসারে গিরি-রাজপুত্রী কালীকে গ্রহণ করিলেন। ৪৪
গিরিজা ও শম্ভুর বিবাহ সময়ে শিব-অঙ্গস্থিত অষ্টটি সর্প স্বর্ণনিৰ্মিত অষ্ট অলঙ্কারস্বরূপ এবং মহাদেব দ্বিভুজ হইলেন। ৪৫
তাহার জটা সূচিক্কণ কেশরূপ হইল, শিরস্থিত চন্দ্র তেজঃপ্রভাবে অন্ত্যন্ত জ্বলিতে লাগিল এবং ললাটস্থিত নেত্র, মহামূল্য রত্নস্বরূপ হইল। ৪৬-৪৭
হে দ্বিজগণ! সেই ব্যাঘ্রচর্ম বিচিত্র-বসনরূপ ধারণ করিল। বিভূতিলেপ মলয়োদ্ভব সুগন্ধির স্বরূপ হইল, হর সেই সময়ে মনোহর রূপ ধারণ করত আশ্চৰ্য্যদর্শন হইলেন। ৪৮
তাহার পর দেবগণ গন্ধৰ্ব্বকুলের সহিত ও সিদ্ধ, বিদ্যাধর, উরগ প্রভৃতি সমস্ত প্রাণিবর্গ হরকে সেইরূপ দর্শন করিয়া অত্যন্ত বিস্মৃত হইল এবং হিমালয়, পুত্রগণ ও মেনকার সহিত অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন, তাহার জ্ঞাতিবর্গও হরের মনোহর রূপ দর্শন করিয়া আনন্দিত হইল। ৪১-৫১
ব্ৰহ্মা হরকে মনোহর দেখিয়া এই গান করিতে লাগিলেন, হে সুরগণ! যেহেতু ইহার ভস্মাদি সমস্তই মঙ্গলজনক হইয়াছে। তাহা হইলে এই জগতে মঙ্গলস্বরূপ ইহা হইতে অধিক মঙ্গলজনক আর কি আছে? ৫২
মহেশ্বরকে যে ব্যক্তি এইরূপ উমাযুক্তভাবে হৃদয়ে স্মরণ করে, তাহার সতত কল্যাণ-বৃদ্ধি হয় এবং বাঞ্ছিত বিষয়ের প্রাপ্তি হয়। ৫৩
আর মহামায়া যোগনিন্দ্রা জগৎ-প্রসবিনী কালী পূর্বে দাক্ষায়িণী হইয়া পরে গিরিসুতা হইয়াছেন। ৫৪
কালী স্বয়ং মহাদেবকে মোহিত করিবার নিমিত্ত সক্ষমা; তথাপি শিবা জগতের হিতের জন্য উগ্র তপশ্চরণ করিয়াছেন। ৫৫
এইরূপে কালী চন্দ্রশেখরকে মোহিত করিবে এবং হিমালয় তনয়া হইয়া শিবকে পুনৰ্বার পাইবে। এই সমস্ত কথা বলিয়া সতী দেহত্যাগ করিয়াছেন। ৫৬-৫৭
হে দ্বিজগণ। যে ব্যক্তি এইরূপ পূণ্য কালিকাচরিত কীর্তন করে, তাহাকে ব্যাধি ও মনঃপীড়ায় আক্রান্ত হইতে হয় না এবং দীর্ঘায়ু হয়। ৫৮
কল্যাণবর্ধক পবিত্র কালিকা-চরিত একবারমাত্র শ্রবণ করিয়াও শিবলোকে গতি হয়। ৫৯
শ্রাদ্ধকালে যে ব্যক্তি কালিকা-চরিত শ্রদ্ধাপূর্বক ব্রাহ্মণদিগকে শ্রবণ করায়, তাহার পিতা নিশ্চয় কৈবল্য প্রাপ্ত হন। ৬০
ব্রাহ্মণদিগের নিকট অথবা সভাগত হইয়া যে ব্যক্তি কালিকা-চরিত শ্রবণ কায়, সে স্থলে উমার সহিত হর স্বয়ং গমন করিয়া শ্রবণ করেন। ৬১
হে দ্বিজসত্তমগণ! সৰ্ব্ব-পাপ-প্রণাশন পুণ্যচরিত আপনাদিগকে বলিলাম, এক্ষণে আপনাদের যে বিষয়ে অভিরুচি হয়, তাহা জিজ্ঞাসা করুন। ৬২
চতুশ্চত্বারিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৪৪