৪৪. মামুন জাহানারাদের বাসায় এসে উঠল

ঝড় মাথায় করে মামুন জাহানারাদের বাসায় এসে উঠল। হলুস্থূল কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। চোখের সামনে একটা ইলেকট্রিসিটির পিলার ভেঙে পড়ল। এত পলকা ধরনের পিলার বানায় নাকি আজকাল? ধরক করে আগুন বেবী হয়ে বিকট শব্দ। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জাহানারাদের বাড়ির সামনের কাঠাল গাছের একটা ডাল ভেঙে টিনের চালে পড়ল। আগের বারের চেয়ে ও বিকট শব্দ হল। তারপর শুরু হল শিলাবৃষ্টি। গত পাঁচ বছরে ঢাকা শহরে এ রকম শিল পড়েনি।

জাহানারাদের ঘরে দরজা-জানালা সব বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজায ধাক্কাধাব্ধি করার পর ভেতর থেকে জাহানারা ভীতিগলা শোনা গেল কে?

আমি। আমি মামুন।

বিস্মিত জাহানারা দরজা খুলতে খুলতে বলল, আপনি এখানে কী করছেন? আসবার আর সময় পেলেন না?

এ রকম ঝড় হলে বুঝতে পারিনি। টর্নেডো-ফার্নেডো কিনা কে জানে।

টর্নেডো নয় কালবোশেখি। ভেতরে আসুন। দরজা বন্ধ করে দেব।

জাহানারাদের বাড়ির একটা অংশ টিনের চাল। শিলা বৃষ্টির কারণে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। একটা ঘরের জানালা খুলে গেছে। সেই জানালা আছড়ে পড়ছে বারবার। জাহানারা বলল, অন্ধকার বাদে থাকুন। আমি আগে ঘর সামলাই। মামুন কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে কী যেন বলল, শব্দের কারণে কিছু বোঝা গেল না। ভেতর থেকে জাহানারার মা চেঁচাচ্ছেন–কে এসেছে–কার সঙ্গে কথা বলছিস?

জাহানারা জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেল। মামুন এই রকম সময়ে চলে আসায় তার একটু লজ্জা লজা করছে। আবার ভালও লাগছে। ঘরে শুধু সে আর মা। অন্যরা ফুপুর বাসায় বেড়াতে গেছে। রাতে থেকে যাবে। এতক্ষণ ভয় ভয় করছিল এখন ভয়ট কমেছে।

জাহানারা কিছুক্ষণ পর আবার এসে ঢুকল। হাসিমুখে বলল, আমাদের ছাদে প্রচুর শিল পড়েছে। শিল কুড়াবেন?

মামুন অবাক হয়ে বলল, শিল কুড়াব কেন? শিল কি আম নাকি?

আমি শিল কুড়াতে যাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে আসুন তো! একা একা ভয় ভয় লাগছে।

শিল দিয়ে কি করবেন?

কিছু করব না। ছোটবেলায় কুড়াতাম এখন আবার ইচ্ছা করছে।

ঝড় কমুক।

ঝড় কমেছে। শুধু বাতাস দিচ্ছে। আসুন তাড়াতাড়ি, এত অনুরোধ করতে পারব না।

মামুন উঠে দাঁড়াল। আশ্চর্যাকাণ্ড উঠে দাঁড়ানোমাত্র জাহানারা বলল, থাক থাক এমনি বলছিলাম। ঠাট্ট করছিলাম। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ঠাট্টা করতে ভাল লাগে।

তাই নাকি? আমি অবশ্যি জানতাম না। আমি ভেবেছি আপনি বুঝি সত্যি সত্যি.

আমাকে কি আপনার কচি খুকি বলে মনে হয়?

না তা না। তবে আমার বড়রা অনেক সময় ছোটদের মত আচরণ করি।

তা অবশ্যি করি। এখন কি আপনি বড়দের মত একটা আচরণ করবেন? আপনাকে একটা টেলিফোন নম্বর দিচ্ছি। ঐ নম্বরে টেলিফোন করে খোঁজ নিয়ে আসবেন মীরারা ভাল আছে কিনা। মা চিন্তা করছেন। কোন একটা দোকানে বা ফামেসিতে টেলিফোন পাবেন।

নম্বরটা বলুন।

খুব সহজ নম্বর ৪৪২৩৪৫ মনে থাকবে না কাগজে লিখে দেব?

মনে থাকবে।

টেলিফোন করে আসুন তারপর চা খাবেন। নাকি আজও ঐ দিনের মত ভাত খেতে চান?

মামুন বিস্ময় বোধ করছে। জাহানারা কথা বলার ভঙ্গি তার স্বভাবের সঙ্গে মিশ খাচ্ছে না। বড় বেশি তরল গলায় কথা বলছে।

আজ খাবার কিন্তু ঐ দিনের চেয়েও খারাপ। ডিমের তরকারি এবং আলু ভাজা। খেতে পারবেন?

পারব।

জাহানারা হেসে ফেলল। তার হাসিটা খুব সুন্দর। যার হাসি সুন্দর তার কান্না নাকি কুশ্ৰী। জাহানারা কাঁদলে কেমন দেখাবে কে জানে। জাহানারা বলল, এ রকম মুখ গম্ভীর করে কী ভাবছেন?

মামুন বলল, কিছু ভাবছি না। আপনার জন্যে সামান্য একটা উপহার এনেছি। গল্পের বই। আপনার জন্মদিনের উপহার হিসেবে।

জাহানারা অবাক হলে বলল, আজ আমার জন্মদিন আপনাকে কে বলল?

মীরা বলেছিল। গতবার যখন এসেছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না। আজ হচ্ছে ওর জন্মদিন। ফুপু এই উপলক্ষে তাকে দাওয়াত করেছেন। গল্পের বইয়ে কী আপনি আমার নাম লিখেছেন?

জি না।

তাহলে এটা তাকেই দিন। এখন যান টেলিফোন করে আসুন। নম্বরটা মনে আছে?

জি আছে–৪৪২৩৪৫

আপনার স্মৃতিশক্তি তো চমৎকার।

মামুনের স্মৃতিশক্তি মনে হচ্ছে তেমন ভাল নয়। পানিতে ভিজে, কাদায় মাখামাখি হয়ে সে যখন টেলিফোনের একটা ব্যবস্থা করল তখন দেখা গেল নম্বর মনে নেই। ২৩ এবং ৪৫-এ গণ্ডগোল। কোনটা আগে কোনটা পেছনে কিছু মনে নেই। সব তালগোল পাকিয়ে গেছে।

 

হাসিনার শরীরটা আজ অন্য দিকে চেয়ে অনেক ভাল। ঝড়বৃষ্টির সময় ছোটাছুটি করে দরজাজানালা বন্ধ করেছেন। অন্য সময় অল্প একটু হাঁটাহাঁটিতেই হাঁপ ধরে যেত। আজ তেমন হচ্ছে না। বরং অনেক দিন পর ঝড়বৃষ্টিটা তাঁর ভালই লাগল।

এখন আর তেমন ভাল লাগছে না। জাহানারা ছেলেটির সঙ্গে খুকিদের গলায় কথা বলছিল। কেন বলছিল? জাহানারা এ রকম করে কখনো কথা বলে না। ছেলেটির সম্পর্কে তার মনে কি আছে তা পরিষ্কার জানা উচিত। জিজ্ঞেস করতে যেন কেমন বাধো বাধো লাগে। মীরা হলে এতক্ষণে হড়বড় করে সব বলে ফেলত।

জাহানারা।

বল মা।

ঐ ছেলে চলে গেছে?

হুঁ আবার আসবে। টেলিফোনে মীরার খোঁজ নেবে তারপর আসবে।

ও।

রাতে এখানে খাবে মা। চট করে কিছু কী করা যায়?

হাসিনা একবার ভাবলেন–বলবেন, রাতে খাবে কেন?

তিনি তা বলতে পারলেন না। শীতল গলায় বললেন, দেখ কিছু আছে কিনা।

রাতে খাবে বলে কি তুমি বিরক্ত হচ্ছে নাকি মা?

না। বিরক্ত হব কেন? ঢাকা শহরে কি এই ছেলের কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে?

কেন বল তো?

না। এমনি। একটু খোঁজখবর করতাম।

কিসের খোজখবর?

হাসিনা জবাব দিলেন না। জাহানারা সহজ গলায় বলল, তুমি যা ভাবিছ সে সব কিছু না মা।

সে সব কিছু হলেই বা ক্ষতি কী?

হাসিনা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে রাগ ছিল, অভিমান ছিল, বিষাদ ছিল এবং কিছু পরিমাণে মিনতিও ছিল। জাহানারা একটি নিঃশ্বাস ফেলল।

হাসিনা নরম স্বরে বললেন–ছেলেটা ভাল। আমার পছন্দ হয়েছে।

জাহানারা বলল, পছন্দ হলে কী করতে হবে? জাহানারা গলার স্বরে রাজ্যের বিরক্তি। হাসিনা অবাক হলেন। এর রকম তো হবার কথা না। তার ধারণা জাহানারাও ছেলেটিকে পছন্দ করে। এই পছন্দ সাধারণ পছন্দেরও বেশি। তাহলে কি তার ধারণা ভুল। ভুল তো হবার কথা না। এই সব ব্যাপারে মারা সচরাচর ভুল করেন না। তিনিও করেননি। ছেলেটি যে কবার এসেছে জাহানারার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে কথা বলেছে কিশোরীদের তরল গলায়। শব্দ করে হোসেছে। এসব কিসের লক্ষণ তা তিনি জানেন। তাহলে জাহানারা এমন করছে কেন? অন্য কোনো গোপন রহস্য আছে কি? তার জানতে ইচ্ছে করে। তবে জানতে ইচ্ছা করলেও লাভ নেই। জাহানারা মুখ খুলবে না। মুখ তালাবন্ধ করে রাখবে। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা জবাব দেবে। সেই জবাব থেকে কিছু বোঝা যাবে না।

হাসিনা ক্ষীণ স্বরে বললেন, জাহানারা তুই আমার পাশে বস তো। জাহানারা সহজ গলায় বলল, পাশেই তো বসে আছি মা।

হাসিনা পাশ ফিরে মেয়ের কোলে একটা হাত রাখলেন। কোমল স্বরে বললেন, ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ। ঠাণ্ডা ছেলে। আজকাল এ রকম দেখা যায় না।

আজকাল বুঝি ছেলেরা সব গরম হয়ে গেছে?

তুই এমন রেগে যাচ্ছিস কেন রে মা? রেগে যাবার মতো কিছু বলেছি? ছেলেটাকে ভাল লেগেছে এইটা শুধু বললাম। এতে দোষের কী হল?

না দোষের কিছুই হয়নি। আমি রাগ করিনি। একজনকে ভাল বলবে তাতে আমি রাগ করব। কেন?

আমরা আগের কালের মানুষ। এ কালের কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝি নারে মা।

জাহানারা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। মার রোগশীর্ণ হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। তারপর খুবই নিচু গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বর বলল, ছেলেটাকে নিয়ে তুমি যা ভাবতে শুরু করেছ তা না ভাবলেই ভাল হয় মা। মামুন সাহেবের বিয়ে ঠিক হয়েছে আছে। কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হবে।

হাসিনা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হবে তাহলে এখানে এসে বসে থাকে কেন? এটা কি ধরনের ভদ্রতা?

বিয়ে হচ্ছে বলে সে এ বাড়িতে আসবে না। এমন তো কোন কথা নেই মা।

হাসিনার চোখে পানি এসে গেল। তিনি সেই লুকুবার কোনো চেষ্টা করলেন না। তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন জাহানারার সঙ্গে এই ছেলেটির বিয়ে হবে। সংসারের ভিত পাকা হবে।

জাহানারা বলল, চা খাবে নাকি মা?

না।

শরীর খারাপ লাগছে?

উঁহু।

তুমি এমন ভেঙে পড়ছি কেন? এই ছেলে ছাড়া কি ছেলে নেই? মেয়ের বিয়ে দিতে চাও দেবে। আমি তো কখনো না বলিনি। এক’দিন শাড়ি গয়না পরে বরের বাড়িতেই চলে যাব। তখন হায় হায় করবে।

হাসিনা জবাব দিলেন না। মেয়ের কোল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পাশ ফিরলেন। জাহানারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে এখন আর ইচ্ছা করছে না।

জাহানারা রান্নাঘরে চলে গেল। রান্না করতে ইচ্ছা করছে না। শুরু করতে হবে। এর থেকে উক্ত নেই।

মার জন্যে তার বেশ খারাপ লাগছে। এই মহিলার ভাগ্যটাই এ রকম। দু’দিন পর পর শুধু আশাভঙ্গ হয়। বছর দুই আগে একবার হল। চমৎকার ছেলে। ফর্সা লম্বা, হাসি-খুশি। এমন একটা ছেলে যে, দেখলেই পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। বিয়ের সব ঠিক ঠাক। ছেলের এক মামা পাথর বসানো একটা আংটি দিয়ে জাহানারার মুখ দেখে গেলেন।

বিয়ের দিন-তারিখ হল, ১৭ কার্তিক। বিয়েটা হল না। কেন হল না সে এক রহস্য। তারা হঠাৎ জানাল একটু সমস্যা হয়েছে। কী সমস্যা কিছুই বলল না। কি লজ্জা কি অপমান লাল পাথর বসান আংটি জাহানারা খুলে ট্রাংকের নিচে লুকিয়ে রাখল। একবার ভেবেছিল নর্দমায় ফেলে দেবে। ফেলতে পারেনি। আংটিটাি হাতে নিলেই ফর্সা, লম্বা, কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটির ছবি মনে আছে। শত অপমানের মধ্যে কেন জানি ভাল লাগে।

কত দিন কত জনের সঙ্গে দেখা হয় এই ছেলেটির সঙ্গে কখনো দেখা হয় না। জাহানারা ঠিক করে রেখেছে। যদি কখনো দেখা হয় তাহলে সে হাসিমুখে এগিয়ে যাবে। খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলবে কী কেমন আছেন? চিনতে পারছেন আমাকে?

জাহানারা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। আর ঠিক তখন ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনা ঘটল। বা পায়ের ওপর কেতলি উল্টে পড়ল। কেতলি ভর্তি ফুটন্ত পানি। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝলসে গেল। জাহানারা কোন শব্দ করল না। দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করল।

রাতে প্রচণ্ড জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে মনে হল যেন লম্বা, ফর্সা, কোকড়ানো চুলের ছেলেটি তার পায়ের কাছে বসে আছে। বিরক্ত গলায় বলছে, তুমি এত অসাবধান কেন? পা সম্পূর্ণ ঝলসে গেছে আর তুমি একজন ডাক্তার পর্যন্ত দেখালে না? এ রকম ছেলেমানুষী করার কোন অর্থ হয়? ইস কী অবস্থা হয়েছে পায়ের।

জাহানারা বলল, ছিঃ, তুমি পায়ে হাত দিচ্ছ কেন?

পায়ে হাত দিলে কী হয়?

লজ্জা লাগে।

এত লজ্জা লাগার দরকার নেই।

জ্বরের ঘোরে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ফর্সা, লম্বা, কোকড়ান চুলের ছেলেটিকে এক সময় মামুন বলে মনে হতে থাকে।

জাহানারার বড় ভাল লাগে। তার বলতে ইচ্ছে করে, তুমি এত দূরে বসে আছে কেন? ব্যথায় মরে যাচ্ছি। আর তোমার একটু মায়া লাগছে না? আরো কাছে আসা। দেখ তো জ্বর আর বাড়ল কিনা। কপালে হাত দিলে কোন পাপ হবে না।

দুর্ঘটনা শুরুতে যত সামান্য মনে হয়েছিল দেখা গেল তা মোটেই সামান্য নয়। পা ফুলে উঠল। দুদিনের মাথায় ঘা বিষিয়ে গেল। তৃতীয় দিনের দিন ভর্তি করতে হল হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তাররা ঘা দেখে চমকে উঠলেন।

এক রাতে আধো ঘুম আধা জাগরণের মধ্যে জাহানারা শুনল বুড়ো মতো একজন ডাক্তার বলছেন–আর একটা দিন দেখব তারপর এম্পুট করে ফেলব। গ্যাংগ্রিনের সূচনা।

জাহানারা চেঁচিয়ে বলতে চাইল–দয়া করুন, আমার পা কাটবেন না। বলতে পারল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। সমস্ত শরীরে ভয়াবহ ক্লান্তি পায়ে কোন ব্যথা নেই। মাথায় ভোতা যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার ধরনটাও অদ্ভুত। তেমন যে নেশা লেগে যায়।

মনে হয় থাকুক না। আর শুধু ঘুমুতে ইচ্ছা করে। শরীরের প্রতিটি কোষ আলাদা আলাদা ভাবে ঘুমুতে চায়।

এগার দিনের দিন জাহানারা পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পেল। তার বিছানার পাশে মামুন বস আছে। ঘরে অনেক লোক। মা আছেন, মীরপুরের বড়খালা আছেন। বড়খালার ছেলে যে আর্মির অফিসার সেও আছে। জাহানারা বলল, আমার পা কেটে বাদ দিয়েছে তাই না?

মামুন বলল, না।

জাহানারার বিশ্বাস হল না। অথচ বিশ্বাস না হবার কানো নেই ঐ তো রোগা রোগা পায়ের পাতা দু’টি দেখা যাচ্ছে। মামুন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এত সুন্দর লাগছে কেন মামুনকে? কি সুন্দর তাকে লাগছে। সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে এত সুন্দর লাগে। জাহানারা চোখ বন্ধ করল। আবার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে তলিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে শুনল, মামুন বলছে খালা আর ভয় নেই। আপনারা বাসায় যান। বিশ্রাম করুন। আমি আছি।

আহ কী চমৎকার শব্দ–আমি আছি। আমি আছির মত সুন্দর আর কোন শব্দ কী বাংলা ভাষায় আছে? না নেই।

জাহানারা সুস্থ হবার পনের দিনের মাথায় মামুনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। হাসিনা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ করে যতটা হৈচৈ করবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন তার কিছুই করতে পারলেন না। একটা কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত ভাড়া করা গেল না। আলো দিয়ে বাড়ি সাজানো হল না। মেয়েকে নতুন একসেট গয়নাও দিতে পারলেন না। তবু তার মনে কোন অপূর্ণতা রইল না। দীর্ঘদিন পর গভীর আনন্দ বোধ করলেন। তাঁর ভাড়া বাড়ির প্যালাস্তারা ওঠা কুদর্শন একটা কোঠায় বাসর হবে। মেয়েরা ছোটাছুটি করে গর সাজাচ্ছে। এক ফাঁকে সেই ঘরও তিনি দেখে এলেন। অপূর্ব লাগল। চোখ ভিজে উঠল।

কি সুন্দর লাগছে জাহানারাকে। তাঁর এই কালো মেয়ের মধ্যে এত রূপ কোথায় লুকিয়ে ছিল? নাকি তার এই মেয়ে রূপবতীই ছিল শুধু তার চোখে পড়েনি? হাসিনার চোখ বারবার ভিজে উঠতে লাগল। তার বড় বোন তার হাত ধরে মেয়ের সামনে থেকে তাকে সরিয়ে নিলেন। রাগী গলায় বললেন, আনন্দের দিনে এ রকম কাঁদে কেউ। কাঁদতে কাঁদতে তুই দেখি চোখে ঘা করে ফেলবি।

বাসর রাতে ঘোর বর্ষণ। পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মত বৃষ্টি। খুব আনন্দ করছে সবাই। পাড়ার মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজে হৈচৈ করছে। এ ওকে ধরে কাদা পানিতে মাখামাখি করছে। অকারণে হাসছে। হাসিনা ঘর অঙ্গদকার করে একা একা তার ঘরে শুয়ে আছেন। সমস্ত দিনের উত্তেজনায় তার হাঁপানীর টান প্রবল হয়েছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। হোক কষ্ট আরো কষ্ট হোক। শুধু মেয়েটা সুখী হোক। আজ রাত হোক তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম রাত।

হাসিনার কেন জানি গা ছমছম করতে লাগল। মনে হচ্ছে অন্ধকার ঘরে কে যেন এসে ঢুকেছে। নিঃশব্দে হাঁটছে। উৎসবের দিনে মৃত আত্মীয়-স্বজনরা এসে উপস্থিত হন। তাই নিয়ম। তাঁরাই কি এসেছেন? জাহানারার বাবা তো আসবেই। কে বলবে এই মুহূর্তে এই ঘরেই হয়ত সে আছে। মেয়েকে দেখে ফিরে যাবার মুহুর্তে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে এসেছে। হাসিনা কাতর গলায় বললেন, কে? কে ওখানে?

কোনো জবাব পাওয়া গেল না। কিন্তু হাসিনার মনে হল কেউ-একজন এসে যেন তার পাশে বসল। শব্দহীন স্বরে বলল, আমি। চিনতে পারছি না হাসু?

পারছি। পারব না কেন?

অনেক দিন তো হয়ে গেল, ভয় হচ্ছিল হয়ত চিনতে পারবে না।

হাসিনা ধরা গলায় বললেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।

খুব ভাল করছে। একা একা অনেক কষ্ট করলে হাসু।

হাসিনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি পাশে ছিলে না। এইটাই একমাত্র কষ্ট। এছাড়া অন্য কোন কষ্ট-কষ্টই না। তুমি কেমন আছ?

রাত বাড়ছে। ঝড়বৃষ্টির চমৎকার একটি রাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *