1 of 2

৪৪. মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য বললেন

মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য বললেন, আর তিন দিন, বুঝলি মোহিনী, আর তিন দিন পর আমি উঠে দাঁড়াব শুধু না, দপদপয়ে হেঁটে বেড়াব। এই ডাক্তারটির ওপর আমার বেশ আস্থা হয়েছে। ওষুধেও কাজ হচ্ছে। এবারে তোকে নিয়ে আমি গঙ্গায় বজরা চেপে হাওয়া খেতে যাব।

মহারাজ পালঙ্কে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন, দুটি দাসী গরমজলে গামছা ভিজিয়ে মুছে দিচ্ছে তাঁর সর্বাঙ্গ, মাথার কাছে একটা রুপোর হুঁকো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনোমোহিনী। এই অবস্থাতেও মাঝে মাঝে তোমাকের ধোয়া না। টানলে মহারাজ স্বস্তি পান না।

মনোমোহিনী বলল, ডাক্তারবাবুটি বাজ ডাকার মতন গুম গুম করে কথা বলেন!

মহারাজ বললেন, হুঁ, তেজ আছে। তুই দেখিল কী করে?

মনোমোহিনী বলল, পাশের ঘর থেকে। বাবাঃ, দেখলেই পিলে চমকে যায়!

মহারাজ হাসতে হাসতে বললেন, সে কি রে, তোর পিলে হয়েছে নাকি? ছেলে হল না, আগেই পিলে হয়ে গেল।

দাসীটি মহারাজকে পরিষ্কার বস্ত্র পরিয়ে দিয়ে চলে গেল। মহারাজ আরাম করে তামাক টানতে টানতে হঠাৎ নাক ডাকতে শুরু করলেন, মনোমোহিনী হুঁকোটা সরিয়ে নিয়ে নিজেই একবার টান দিল।

খানিকবাদে একটা ঝন ঝন শব্দে তন্দ্ৰা টুটে গেল মহারাজের। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বললেন, ও কী, ও কী করলি রে?

কক্ষের এক পাশে একটা টেবিলের ওপর রয়েছে দুটি বড় ক্যামেরা ও একটি পিতলের তেপায়া স্ট্যান্ড। সেই সব নিয়ে মোহিনী ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে স্ট্যান্ডটা ফেলে দিয়েছে।

মহারাজ বললেন, হাত দিসনি, আমার ক্যামেরায় হাত দিসনি!

মনোমোহিনী বলল, আমি ছবি তুলব।

মহারাজ বললেন, আমি সেরে উঠি, তারপর তোকে শিখিয়ে দেব। ছবি তোলা কি সহজ নাকি? মনোমোহিনী বলল, তা হলে আমি এখন কী করব? মহারাজ বললেন, তুই তো বাংলা পড়তে পারিস। জানলার ধারে বসে বসে বই পড়।

মনোমোহিনী দু দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার সব সময় পড়তে ভালো লাগে না। আচ্ছা ওই যে শশীবাবু ছবি তোলেন, আমি ওঁর কাছে শিখতে পারি না?

এবার মহারাজ গম্ভীর হয়ে বললেন, সব সময় ছেলেমানুষী করবি না, মোহিনী! হুটহাট করে যেখানে সেখানে যাবি না!

মহারাজ বীরচন্দ্র পাশ ফিরে শুলেন।

ধমক খেয়েও দমল না মনোমোহিনী। সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আমি তা হলে কার সঙ্গে খেলব? আমার ভালো লাগছে না!

মহারাজ বীরচন্দ্ৰ পাশ ফিরে শুলেন।

মনোমোহিনী পাশের ঘরে গিয়ে আলনা থেকে জামা-কাপড় টেনে টেনে ছড়াতে লাগল মেঝেতে। একটা বই খামচে ছিঁড়ে ফেলল কয়েক পাতা। দেওয়ালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার একটি বাধানো ছবি রয়েছে, সে দিকে সে জিভ বার করে ভেংচি কাটল। তার শরীরে প্রথম যৌবনের চাঞ্চল্য, সারা দিন তার কোনও সঙ্গী নেই, কোনও কাজ নেই, এই অবস্থা তার অসহ্য লাগছে। মাত্র চার-পাঁচ খানা ঘরের অন্দর মহলে বন্দী হয়ে থাকতে সে কিছুতেই রাজি নয়।

মনোমোহিনী জানে, সে এখন ত্রিপুরার রাজ পরিবারের পাটরানী, বাইরের কোনও পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে নেই। তা বলে সারাদিন মুখ বুজে থাকতেও রাজি নয় সে। এখানে তার আপনজন বলতে রয়েছে একমাত্র কুমার সমরেন্দ্ৰচন্দ্ৰ, কিন্তু তারও ছবি তোলার খুব ঝোঁক, সে ফটোগ্রাফিক সোসাইটিতে যাওয়া-আসা শুরু করেছে, ক্যামেরা নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, মনোমোহিনী তার পাত্তা পায় না।

একটু পরে মনোমোহিনী অন্দরমহল ছেড়ে পা বাড়াল বাইরে। বারমহলের সঙ্গে যুক্ত বারান্দাটা পার হলেই একটা সিঁড়ি নেমে গেছে ডান দিকে। একতলায় অনেক ঘর খালি পড়ে আছে, তার মধ্যে কোণের একটি ঘর একেবারে বাইরের রাস্তার কাছাকাছি। এ বাড়ির সীমানা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, এই ঘরটির জানলায় দাঁড়ালে পথ চলতি মানুষ জন দেখা না গেলেও স্পষ্ট শোনা যায়। তাদের কথাবার্তা, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, টের পাওয়া যায় জীবনের স্রোত।

সেই দিকে যেতে যেতে মনোমোহিনী একটা গান শুনতে পেল। রাস্তায় কেউ গাইছে না, বাড়ির মধ্যেই, নারী কণ্ঠ। সেই গান অনুসরণ করে খানিকটা গিয়ে মনোমোহিনী একটি ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে খুলে ফেলল।

ঘরটি বেশ ছোট, একটু একটু অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে। এক পাশে একটি বিছানা পাতা, অন্য দিকে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে রাখা একটি ছোট্ট, বিঘৎ-পরিমাণের আয়না। সেই আয়নার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটি তরুণী চুল আঁচড়াচ্ছে। আর আপন মনে গান গাইছে। মনোমোহিনী একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই গান শুনিল।

সে খুবই বিস্মিত হয়েছে। ঘরখানি দেখে মনে হয়, দাস-দাসীরাই এখানে থাকে। কিন্তু রাজবাড়ির কোনও দাসী গান গাইবে, এ যে অসম্ভব ব্যাপার। রাজবাড়ির দাস-দাসীরা কখনও উঁচু গলায় কথা বলে না পর্যন্ত। সব সময় ছায়ার মতন নিঃশব্দ। কোনও কাজের জন্য ডাকা না হলে তারা চোখের সামনে ঘোরাঘুরিও করবে না। গানের তো প্রশ্নই ওঠে না। যে গান জানবে, সে দাসী-বাদীর কাজ করতে যাবে কেন?

মনোমোহিনী নিজে গাইতে না পারলেও বুঝল যে এ রীতিমতন তৈরি গলার গান। তরুণীটি তন্ময় হয়ে গাইছে, তার উপস্থিতি টের পায়নি। গানটি শেষ হলে সে জিজ্ঞেস করল, এই, তুই কে রে?

মুখ ফিরিয়েই তরুণীটি জড়োসড়ো হয়ে গেল। সে এই কিশোরী রানীকে চিনতে পেরেছে। গলায় আঁচল জড়িয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্ৰণাম জানিয়ে বলল, আমার নাম ভূমিসূতা।

এই ক’দিন মনোমোহিনী সারা বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু ভূমিসূতাকে সে আগে দেখেনি। এ মেয়েটি যে একজন দাসী, তা এখনও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। কলকাতা কি এমনই আজব শহর যে এখানকার দাসীরাও ভালো গান জানে?

সে জিজ্ঞেস করল, তুই কার বউ?

ভূমিসূতা দুদিকে মাথা নাড়ল।

মনোমোহিনী কোনও দাসীর ঘরের মধ্যে পা দেবে না, তাই সে হাতছানি দিয়ে বাইরে ডাকল ভূমিসূতাকে। ভালো করে দেখল। ভূমিসূতার ছিপছিপে শরীর মনোমোহিনীর তুলনায় বেশ লম্বা, চক্ষু দুটি যেন কাজলটানা। একে বেশ পছন্দ হল মনোমোহিনীর।

সে বলল, তোর নাম কী বললি রে ; ভূমির সুতো? সুতো কারুর নাম হয়?

ভূমিসূতা কুণ্ঠিতভাবে বলল, সূতো নয়, সূতা।

মনোমোহিনী তবু বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকিয়ে বলল, তুই কী গান গাইছিলি? শুনতে ভালো লাগছিল, কিন্তু কিছুই বোঝা যায়নি। আবার একটু বল তো!

ভূমিসূতা মৃদু গলায় শোনাল :

গগনে অব ঘন               মেহ দারুণ

সঘনে দামিনী ঝলকাই

কুলিশ-পাতন-       –       শরদ ঝন ঝন

পবন খরতর বলগই…

মনোমোহিনী বলল, গগন, গগন মানে আকাশ, তাই না; তারপর?

ভূমিসূতা বলল, মেহ হচ্ছে মেঘ, আর দামিনী মনে বিদ্যুৎ,…।

মনোমোহিনী বলল, বাঃ, দামিনী, দামিনী মানে বিদ্যুৎ? কী সুন্দর। এই, তুই আমাকে গান শেখাবি?

পাটরানীর অনুরোধ মানেই আদেশ। মনোমোহিনী অবশ্য ভূমিসূতার কোনওরকম উত্তর দেবার অপেক্ষাই করল না, তার হাত ধরে টানতে টানতে দৌড়ে চলে এল নিজের মহলে।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ওষুধের গুণে সত্যি আর দু-তিন দিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন মহারাজ বীরচন্দ্র। কলকাতায় আসার পর তিনি এই প্রথম সিঁড়ি দিয়ে নামলেন নীচে। কথা বললেন কর্মচারিদের সঙ্গে, বাগানে বেড়িয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেন।

মহারাজের একান্ত সচিব রাধারমণ কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিয়ে নিজের বাড়িতে গেছেন, মহারাজ শশিভূষণের সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। ছোটলাটের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎকারে যেতে হবে। কয়েকটি ইংরেজ কোম্পানি ত্রিপুরায় চা-বাগান শুরু করতে চায়, সেই সব কোম্পানির ধদের সঙ্গে আলোচনায় বসার দরকার। কলকাতার সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবার।

তারপর তিনি বললেন, শশীমাস্টার, আমার বয়েস হয়ে যাচ্ছে, শরীরে আর তেমন জুতি নেই। এখন আর ঘোড়া দাবড়াতে পারব না। আমার ছোটরানীকে নিয়ে কেল্লার মাঠে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াব বলেছিলাম, সেটা আর হবে না, বুঝলে। ঘোড়া কেনা-টেনার কথাও আর উচ্চারণ করো না। অন্য কিছু দিয়ে ছোটরানীকে ভোলাতে হবে। তুমি একটা বজরার ব্যবস্থা করো। গঙ্গাবক্ষে দু চারদিন ভেসে থাকব। এতবড় নদী তো মনোমোহিনী কখনও দেখেনি!

খানিকবাদে ওপরে উঠে এসে মহারাজ নিজের কক্ষে না ফিরে আর একটি কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়ালেন। ভেতরে গান শোনা যাচ্ছে, বেশ সুরেলা গলার গান। আর মাঝে মাঝে মনোমোহিনীর খিলখিল হাসির শব্দ। দরজা ঠেলে মহারাজ দেখলেন, মেঝেতে কার্পেটের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে মনোমোহিনী, আর একটি তরুণী আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গান গাইছে।

মনোমোহিনী মহারাজকে দেখে বলল, মহারাজ, এর নাম সুতো। আমি এর সঙ্গে সই পাতিয়েছি। ওর কাছে গান শিখছি। ভূমিসূতা ভক্তি ভরে মহারাজকে প্ৰণাম জানাল। মহারাজ তার মুখের দিকে দৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তাঁর ললাটে ভাঁজ পড়ল। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, একে আমি আগে দেখেছি। কোথায় দেখেছি? কোথায়? এই মেয়ে, তুই কি ত্রিপুরা থেকে এসেছিস • ভূমিসূতা বলল, না, মহারাজ। আমি কখনও ত্রিপুরায় যাইনি। মহারাজ বলল, কিন্তু আমি তোকে দেখেছি ঠিকই। তোর বাড়ি কোথায়? ভূমিসূতা বলল, আমার বাড়ি উড়িষ্যায় মহারাজ। উড়িষ্যা থেকে কলকাতায় এসেছি, আর কোথাও যাইনি। মহারাজ বীরচন্দ্রের ললাট তবু কুঞ্চিত হয়ে রইল, তিনি বললেন, তুই একটু উঠে দাঁড়া তো। ভূমিসূতা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েও চেয়ে রইল মাটির দিকে। মহারাজ বললেন, মুখ তোল, তাকা আমার দিকে।

আবার তিনি আপন মনে বললেন, ই, আমার ভুল হয় না। এই মেয়েকে আমি অবশ্যই আগে কোথাও দেখেছি। এই মুখ আমার চেনা।

ভূমিসূতা খুব বিচলিত বোধ করল। মহারাজ বারবার এ কথা বলছেন কেন। এ বাড়িতে আসার আগে সে ত্রিপুরার এই মহারাজের অস্তিত্বের কথাই জানত না। সে নিশ্চিত জানে, মহারাজের সঙ্গে তার আগে কখনও দেখা হয়নি।

মহারাজ ভেতরে এসে একটা কেদারায় বসে পড়ে বললেন, শুনি তো একখানা গান। আমার স্নানের সময় হয়েছে, বেশিক্ষণ বসব না।

ভূমিসূতা রাজার আদেশে গাইল :

মাধব, বহু মিনতি করি তোর

দেহি তুলসী তিল দেহ সমৰ্পলু

দয়া জনি ছোড়বি মোয়

গণইতে দোষ গুণ লেশ না পাওবি

যব তুহঁ করবি বিচার

তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহাওসি

জগ বাহির না মুই ছার…

মহারাজ এখনও ভুরু উঁচিয়ে আছেন। গানের সঙ্গে মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, বাঃ, বাঃ!

গান শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ গান তোকে কে শেখাল? এমন গান তো কারুকে গাইতে শুনি না।

ভূমিসূতা আবার মাটির দিকে চোখ রেখে বলল, আমার বাবা শিখিয়েছেন, মহারাজ!

মহারাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার ক্ষুধা বোধ হচ্ছে, বিকেলে ভালো করে আবার তোর গান শুনব। তোর সঙ্গে আমার আগে কোথায় দেখা হয়েছিল, তোর মনে নেই।

ভূমিসূতা দু দিকে মাথা নাড়ল।

দুপুরে দিবানিদ্রা দেবার পর বিকেলে মহারাজ আরও সুস্থ বোধ করলেন। দু খিলি পান ও কিছুক্ষণ তামাক খাওয়ার পর তিনি আজ একটু সাজগোজ করলেন। গায়ে জড়ালেন একটা রঙিন উড়ুনি, মাথায় পরলেন পাগড়ি। দোতলায় বারমহলেও একটি বৈঠকখানা সাজানো রয়েছে সোফা-কৌচ দিয়ে, সেখানে এসে বসে তিনি ডেকে পাঠালেন শশিভূষণকে।

শশিভূষণ এসে নমস্কার জানাতেই মহারাজ উৎফুল্ল স্বরে বললেন, ওহে শশী, বসো বসো! আমার ছোটরানী আজ একটি রত্ন আবিষ্কার করেছে। সে এই বাড়িতেই লুকিয়েছিল। তুমি তার কথা আগে আমায় বলনি তো?

শশিভূষণ বুঝতে না পেরে বললেন, লুকিয়েছিল!

মহারাজ বললেন, অবশ্যই। এই কদিন তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার নাম বলল, ভূমিসূতা। এমন নামও আমি আগে শুনিনি। মেয়েটি বেশ সুশ্ৰী, মুখখানি খাসা। অতি চমৎকার গান করে। কোকিলকণ্ঠী বলতে পারো!

শশিভূষণ চমকে উঠলেন। ভূমিসূতা মহারাজের অন্দরমহলে গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল। ওই মেয়েটি তাঁর নিজস্ব পরিচারিকা, তাকে মহারাজের সেবার জন্য নিযুক্ত করা হয়নি।

মহারাজ বললেন, সে নাকি উড়িষ্যার মেয়ে। তার বাবা তাকে গান শিখিয়েছে। উচ্চারণ মার্জিত, দাঁড়াবার ভঙ্গিটি দেখলেই বোঝা যায় ভদ্র ঘরের মেয়ে। একটি সুন্দরী, কোকিলকণ্ঠী, ভদ্র পরিবারের কন্যা এ বাড়িতে বাদী হয়ে আছে, এ কী রহস্য বল তো। ওহে শশী, তুমি কোনও কুলবধূকে ফুসলিয়ে এনে আমার বাড়িতে লুকিয়ে রাখনি তো?

মহারাজ হাসতে লাগলেন।

শশিভূষণ স্ত্রী-জাতির প্রতি অনাসক্ত, তাই তিনি ভূমিসূতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেননি। সে নিঃশব্দে ঘরের কাজ করে যায়, শশিভূষণের জন্য রান্না করে দেয়, বেশির ভাগ সময়েই আড়ালে থাকে। সে যে গান জানে, সে খবরও শশিভূষণ রাখেন না।

মহারাজ বললেন, কামিনীটিকে দেখেই আমার মনে হল, এই মুখ আমি আগে দেখেছি। ও কিছু বলে না। কিন্তু আমার চোখকে কি ফাঁকি দিতে পারবে। অনেকক্ষণ মনে পড়ছিল না। দুপুরে একঘুম দেবার পর মনে এসে গেল। তুমি আমাকে গত বছর তোমার তোলা কতকগুলি ফটোগ্রাফ দেখিয়েছিলে না? তার মধ্যে একটি ছবি দেখে আমি বলেছিলাম, এইটি অতি সুন্দর হয়েছে, এ ছবি প্রতিযোগিতায় পাঠানো যায়। সেটি ছিল ফুলবাগানে দাঁড়ানো এই মেয়েটির ছবি। ঠিক না?

শশিভূষণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মহারাজের এমন স্মৃতিশক্তি, এক বছর আগে দেখা একটা ফটোগ্রাফের মুখ মনে রেখেছেন?

মহারাজ গোঁফে তা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, এবারে স্পষ্ট করে খুলে বলো তো, তুমি কি এই গায়িকাটিকে বিবাহ করেছে কিংবা করতে চাও কিংবা তোমার নিজের করে রাখতে চাও?

শশিভূষণ বিব্রতভাবে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না মহারাজ, সেসব কিছুই না। ও একজন সাধারণ পরিচারিকা মাত্র। আমি ওর গান কখনও শুনিনি।

তারপর তিনি ভূমিসূতার পূর্ণ ইতিহাস সংক্ষেপে মহারাজকে জানালেন।

মহারাজ বললেন, বাঃ। বাঃ! তোমার দাদা যে উড়িষ্যা থেকে একটি রত্ন কুড়িয়ে পেয়েছেন হে! সেই রত্নকে কি অবহেলায় অন্ধকার ঘরে ফেলে রাখা চলে? তাকে কণ্ঠে ধারণ করতে হয়। তোমাদের বাঙালিদের কী যে অদ্ভুত সংস্কার বুঝি না। এত জাতপাতের বিচার, একটু পান থেকে চুন খসলেই জাত নষ্ট! বাঙালি হিন্দুরা হাজারে হাজারে মোছলমান হয়ে যাচ্ছে তো এই জাতপাতের অত্যাচার আর ছুঁতমার্গের জন্যই! রূপবতী, গুণবতী রমণীরত্নের আবার জাত কী? ও মেয়েটিকে তোমার অপছন্দ কিসের জন্য? তুমি যদি ওকে বিবাহ করতে চাও, আমি সব বন্দোবস্ত করে দেব।

শশিভূষণ বললেন, পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্ন নয় মহারাজ, জাতপাতের ব্যাপার নিয়ে আমি খুব যে মাথা ঘামাই তাও নয়। কিন্তু আমি বিবাহের কথা চিন্তা করি না। আমি ঝাড়া হাত-পা হয়ে বেশ আছি!

মহারাজ লঘুহাস্য করে বললেন, জিতেন্দ্ৰিয় পুরুষ! তুমি গান ভালবাসো না?

শশিভূষণ বললেন, এক মহাকবি বলেছেন, যে ব্যক্তি গান ভালোবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে।

মহারাজ বললেন, এই তো তোমার মতন মাস্টারদের দোষ। খালি অন্যদের কথা উদ্ধার করা!! কবিরা তো কত রকম কথাই বলে, তুমি নিজের কথা বলতে পারো না। আহো, বৈষ্ণবপদকর্তাদের গান, তার তুল্য জগতে আর কী আছে। সে যে রসের বারিধি! শ্ৰবণ জুড়োয়, প্ৰাণ জুড়োয়, বেশিদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে। ‘আজু রজনী হম ভাগে গমায়লুঁ / পেখলুঁ পিয়া মুখ চন্দা / জীবন যৌবন সফল করি মালু/ দশদিশ ভেল নিরদন্দা…

মহারাজ সুর করে গাইতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, অনেক দিন ধরে আমার সাধ কি জানো, শশী, রাত্তিরে যখন শুতে যাব, তখন আমার মাথার কাছে বসে একজন পদাবলি গান শোনাবে। গান শুনতে শুনতে সুখনিদ্রা, আহা! আমার রানীগুলোন কেউ তো গানের গা-ও জানে না। আমি শিখোতে গেলেও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। তবে হ্যাঁ, ছিল বটে। আমার বড় রানী ভানুমতী, কী মিষ্টি গানের গলা, কতরকম মণিপুরি গান জানত, কত গুণ ছিল তার, সে আমাকে অকালে ছেড়ে চলে গেল! ভুল বুঝেছে সে, তার ছেলে সমরকে কি আমি হেলাফেলা করেছি?

অকস্মাৎ পুরনো কথা মনে পড়ায় শোকাভিভূত হয়ে মহারাজ বীরচন্দ্র দু হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন। কিন্তু এই শোক দীর্ঘস্থায়ী হল না, পুকুরের জলে তরঙ্গের মতন অচিরে মিলিয়ে গেল।

হাত সরিয়ে তিনি ব্যগ্রভাবে বললেন, এই মেয়েটি, এই যে ভূমিসূতা, ওকে আমি ত্রিপুরায় নিয়ে যাব। আমার ছোটরানীর সঙ্গে ওর ভাব হয়েছে, বেশ ভালোই হয়েছে, তার সঙ্গে সে থাকবে, রাত্রে আমার শিয়রে এসে গান শোনাবে। যাও তো শশী, মেয়েটিকে এখানে ডেকে আনো, ভালো করে তার গান শুনি।

শশিভূষণ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, মহারাজের শেষের আদেশটি শুনতে পেলেন না।

মহারাজ আবার বললেন, কালই তাকে দু জোড়া ভালো শাড়ি কিনে দিও। কাল থেকে সে ভেতর মহলে থাকবে।

শশিভূষণ উঠে পড়লেন। মহারাজের কথাগুলি তাঁর মনঃপূত হল না। তাঁর মেজদাদা ভূমিসূতাকে নিয়ে এসেছেন। পুরী থেকে, মেজবউঠানের আদিখ্যেতা করে ওকে এ বাড়িতে পাঠাবার কী দরকার ছিল? যে-কোনও একটি পরিচারিকা হলেই তো শশিভূষণের চলে যেত! মহারাজ ভূমিসূতাকে ত্রিপুরায় নিয়ে যেতে চাইছেন, এতে যদি মেজদাদা-মেজবউঠান আপত্তি করেন। তখন এক ফ্যাসাদ হবে। আর ওই মেয়েটিকেও বলিহারি, সে হ্যালার মতন মহারাজের অন্দরমহলে গিয়েছিল কেন? সেখানে তো তার যাবার কথা নয়। সে মহারাজের নজরে পড়েছে, এবারে তার ভাগ্য খুলে যাবে, এ রকমই বুঝি মতলব ছিল ওর মনে? মহারাজ অবশ্য ওকে বিয়ে করবেন না, রক্ষিতা হয়ে থাকবে, সেও তো দাসীত্ব থেকে অনেকখানি পদোন্নতি। কিন্তু তাঁর দাদা-বউঠান ওকে ছাড়তে না চাইলে সে ঝঞাট কে সামলাবে? মহারাজ একবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর কি অন্যথা হয়?

নিজের ঘরে এসে শশিভূষণ গম্ভীরভাবে ডাকলেন, ভূমিসূতা, ভূমিসূতা!

একতলা থেকে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে ভূমিসূতা দাঁড়াল দরজার কাছে। শশিভূষণ অপ্রসন্ন মুখে চেয়ে রইলেন তার দিকে। একটা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া নীল রঙের শাড়ি পরা, তার কোথাও কোথাও পিঁজে গেছে, এক জায়গায় ভুষোকালির দাগ। খোলা চুল পিঠের ওপর ছড়ানো।

শশিভূষণ নীরস গলায় বললেন, তোমার এর থেকে আর ভালো কোনও কাপড় নেই? একটা পরিষ্কার কাপড় পরে এসো। ওপরতলার বৈঠকখানায় মহারাজ বসে আছেন, তোমাকে ডাকছেন গান শোনাবার জন্য।

শশিভূষণের সঙ্গে ভূমিসূতার সরাসরি বেশি কথা হয়নি কখনও, তাঁর এরকম কণ্ঠস্বরও সে শোনেনি আগে। সে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইল।

শশিভূষণ আবার ধমক দিয়ে বললেন, দেরি করছ, কেন? এক্ষুনি কাপড় বদলে এসো। মহারাজ কতক্ষণ বসে থাকবেন?

ভূমিসূতা বলল, আমি যাব না। শশিভূষণ ভুরু কুঁচকে বললেন, যাবে না মানে? মহারাজ ডেকেছেন, তুমি যাবে না?

ভূমিসূতা বলল, আমি বাঈজীদের মতন বৈঠকখানা ঘরে বসে গান গাইতে পারব না! না, না, আমি ওসব পারব না।

শশিভূষণ আরও জোর ধমকের সুরে বললেন, যাবে না মানে? তা হলে তুমি লোভী বেড়ালীর মতন মহারাজের অন্দরমহলে সেঁধিয়েছিলে কেন? মহারাজের সামনে গান গেয়ে তাঁর মন ভুলিয়েছ, এখন এসব কী নচ্ছারপনা হচ্ছে? মহারাজ তার শোবার ঘরে বসে গান শুনবেন না বৈঠকখানায়, সেটা তিনি ঠিক করবেন। যাও, শিগগির গিয়ে কাপড় বদলে এসো। ভূমিসূতা পরিপূর্ণ চোখে শশিভূষণের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল, না, আমি যাব না!

শশিভূষণ খুবই বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ হয়ে থাকলেও এখন বিস্মিত হতে বাধ্য হলেন। এ মেয়ে পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলে। কোনও ঝি-চাকর যে তার মনিবের আদেশের উত্তরে এমন স্পর্ধার সঙ্গে না বলতে পারে, তা যেন অবিশ্বাস্য। এ মেয়ে সাধারণ দাসীর মতন নয় তা ঠিকই, ভদ্র ঘরে জন্ম, গান জানে, কিন্তু অনাথিনী এবং আশ্রিতা তো বটে, তবু এমন জোর পেল কোথা থেকে?

শশিভূষণ মহারাজের স্বভাব জানেন। তিনি ভালো মানুষ ধরনের হলেও জেদি। তিনি বৈঠকখানা ঘরে বসে গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে এই মেয়েটির গান শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন, এখন যদি তাঁকে বলা হয় যে গায়িকাটি আসতে রাজি মেয়েটি যদি যেতে না চায়, তা হলে তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে কী করে? জোর করে কি কারুকে দিয়ে গান গাওয়ানো যায়? একটি মেয়েকে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া শশিভূষণের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

তিনি এবারে খানিকটা মিনতির সুরে বললেন, বৈঠকখানায় মহারাজ ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি একা ওঁকে গান শোনাবে, তাতে তোমার আপত্তি কিসের? একবারটি চল-

শশিভূষণের সঙ্কটের কথা বুঝতে পেরেই যেন ভূমিসূতা ঈষৎ হেসে বলল, আপনি মহারাজকে গিয়ে জানিয়ে দিন যে আমার হঠাৎ অসুখ করেছে। দেহটা ভালো নেই, পেটে যাতনা হচ্ছে। আমি নীচে গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকব।

ভূমিসূতা আর দাঁড়াল না। নম্র পায়ে চলে গেল সিঁড়ির দিকে। শশিভূষণ দেখতে পেলেন তার দু পায়ের পাতায় আলতার ঝিলিক। তাঁর ছেলেবেলায় শোনা একটি মেয়েলি ছড়া মনে পড়ল। এলাটিং বেলাটিং সই লো/কী খবর আইল? /রাজা একটি বালিকা চাইল/কোন বালিকা চাইল? /এই বালিকা চাইল/নিয়ে যাও, নিয়ে যাও বালিকাকে / নিয়ে যাও নিয়ে যাও বালিকাকে…

রাজা এখন কোনও বালিকাকে চান, তখন কি আর তাকে আটকে রাখা যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *