1 of 2

৪৪. বেয়ারাকে কিছু বলতে হয়নি

বেয়ারাকে কিছু বলতে হয়নি। বোস সাহেবের বউকে সে চেনে। নিঃশব্দে এসে এক পট কফি আর দুটো কাপ সমেত ট্রে টেবিলে রেখে কফি ঢেলে দিল। দুটো করে চিনির কিউব, গরম দুধ।

কফিটা আনমনে চামচে নাড়তে নাড়তে মণিদীপা বলে, বাইরে বৃষ্টি নামল।

হবে। বৃষ্টির সিজনই তো এটা।

তা জানি। আপনি আমার সব কথাতেই জবাব দেন কেন বলুন তো!

দিতে নেই বুঝি? বসের ওয়াইফ বলে?

মণিদীপা ক্রুদ্ধ চোখে তাকায়। তারপর সামান্য চড়া গলায় বলে, আপনি আমাকে কখনও সিরিয়াসলি নেন না! না?

আপনার ব্যাপারে আমি এবং আমরা সবাই খুব সিরিয়াস।

আমরাটা আবার কে?

আমি বা বোস সাহেব, অর্থাৎ জনগণ আর কী।

আজ আমার ইয়ারকি ভাল লাগছে না। আই হ্যাভ লস্ট এ ফ্রেন্ড, ইউ নো!

শুধু ফ্রেন্ড নয় মিসেস বোস। স্নিগ্ধদেব ছিলেন আপনার আইডিয়া, আপনার ড্রিম, আপনার নেতা। কিন্তু লসটা আপনার একার নয়। আমারও, অর্থাৎ জনগণেরও। আমি তো ভাবতাম, উনিশশো নব্বই সালে স্নিগ্ধদেবই হবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

একটু আগেই আপনি স্নিগ্ধদেব সম্পর্কে খুব সিরিয়াস ছিলেন। আবার এক্ষুনি লাইট হয়ে গেলেন! আপনার পার্সোনালিটি এত ফ্লাকচুয়েট করে কেন বলুন তো?

করে?

নিশ্চয়ই করে।

দীপনাথ মুখখানা আঁশটে করে বলে, আমার পপুলারিটির পারদ নেমে যাচ্ছে দেখছি।

মণিদীপা আর-একবার সিগারেটের প্যাকেটের ঢাকনা খুলেও থামল। ভ্রু কুঁচকে বলল, আপনি হয়তো জানেন না, যাদের পার্সোনালিটি থাকে না তারাও পপুলার হতে পারে। পার্সোনালিটি নেই বলেই তারা অন্যের যে-কোনও কথায় অনায়াসে সায় দিয়ে যায়, অন্যের হয়ে খামোখা খাটে, চাটুকারিতা করে, খোশামোদ করে। ওভাবেও পপুলারিটি গেন করা সম্ভব। আপনি যেমন ভাবে করেছেন।

বহুকাল পর আবার কান-মাথা গরম হল দীপনাথের। মণিদীপার মার কোন দিক থেকে আসবে তা সে জানত না। খুব গভীরে আহত হয় দীপনাথ। আহত হয়, তার কারণ মণিদীপা খুব মিথ্যে বলেনি। কখনও কখনও তো সত্যিকারেরই চাটুকার, খোশামুদে। নিজের মতামত, ইচ্ছে-অনিচ্ছে প্রকাশে ভীরু।

ক্লিষ্ট মুখ তুলে দীপনাথ বলে, জনগণের কি কোনও পার্সোনালিটি থাকে?

মণিদীপা জয়ের গন্ধ পেয়ে একটু ঝুঁকে তীব্র স্বরে বলে, আপনি যে জনগণেরই একজন সেটা সৎভাবে একবারও বিশ্বাস করেন কি? জনগণের কেউই তা করে না। তারা ভাবে, আমি ছাড়া আর সবাই জনগণ, সাধারণ অ্যাভারেজ। যেদিন আপনি নিজেকে সত্যিই সাধারণ মানুষদের একজন ভাবতে পারবেন সেদিন লোকে আপনাকে অসাধারণ বলে স্বীকার করবে।

দীপনাথ মনে মনে তারিফ করল। এটাও নিখুঁত মার। সে পুনর্বার আহত।

তবে প্রত্যাঘাতের জন্য ব্যস্ত হল না দীপনাথ। নরম চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি কি আমার বিবেক, কাউন্টার-ইগো? যাত্রাদলের বিবেকের মতো এসে মাঝে মাঝে জীবনের সত্যগুলিকে চিনিয়ে দিয়ে যান!

মণিদীপার প্লেটে কাপ রাখার শব্দটা একটু জোরালো শোনাল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, টাকাটা দিন!

দীপনাথ কথা বাড়াতে সাহস করল না। টাকাটা টেবিলের ওপর নিঃশব্দে রাখল।

ভ্রু কুঁচকে মণিদীপা বলে, কোনও ভাউচারে সই করতে হবে না?

দীপনাথ মাথা নাড়ল, না।

অফিসের টাকা দিতে ভাউচার লাগে না?

লাগে। কিন্তু অত কথায় কাজ কী?

মণিদীপা ঠোঁট ওলটাল, কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর চটপটে পায়ে বেরিয়ে গেল একটিও কথা না বলে।

সারা অফিসটাই ফাঁকা, নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

দীপনাথ কিছুক্ষণ সামনে চেয়ে রইল। এ কথা সত্য, তার ব্যক্তিত্বের তেমন জোর নেই, না আছে স্বাধীন মত প্রকাশের সাহস। প্রায় সকলেই তাকে পছন্দ করে বটে, কিন্তু কেউই তাকে খুব ইম্পর্ট্যান্ট মনে করে না। শুধু এই সেদিন, মেজোবউদি বলেছিল, দীপনাথকে তার প্রয়োজন। ঠিক ওরকমভাবে দীপনাথকে আর-একজনও গুরুত্ব দিয়েছিল। সে হল বোস সাহেব। বাংগালোরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি।

কিন্তু এসব কথা ভেবে কী হবে? সে যা, সে ঠিক তাই। কেউ তো তাকে শেখায়নি কী করে ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে হয়। কেউ তো তাকে হাতে ধরে শেখায়নি জীবনযাপনের পদ্ধতি। আজ তার মনে হয়, যেভাবে ছেলেবেলায় তাকে এক দুই বা অ আ ক খ শেখানো হয়েছিল, ঠিক তেমনি করে আজ এই জীবনযাপনের পাঠ কেউ শিখিয়ে দিলে বড় ভাল হত।

 

আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। বাইরে ঝুম হয়ে এল বৃষ্টি। দীপনাথ আবার কাগজপত্র টেনে বসে বকেয়া কাজ সেরে রাখতে লাগল। মাঝে মাঝে অন্যমনস্কতা এল, ক্লান্তি লাগল, হাই উঠল। তবু ঠায় রাত পৌনে আটটা পর্যন্ত টেবিলে রইল সে।

তারপর বোরাকে ডেকে অফিস বন্ধ করতে বলে ধীরে ধীরে নেমে এল নীচে। বৃষ্টির জোর কমে এসেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ইদানীং অফিসপাড়াটা রাতের দিকে খুব নিরাপদ নয়। নির্জন রাস্তায় একা মানুষকে পেলে একদল ছেলেছোকরা প্রায়ই চুরি ছিনতাই করে। তাই ঘড়িটা খুলে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল দীপনাথ।

চারদিকে দেখে রাস্তায় নেমে কয়েক পা হাঁটতেই পি করে একটা হর্নের শব্দ। দীপনাথ বেখেয়ালে ফিরে তাকাল। তাকিয়েই একটু চমকে উঠল।

কালো ছোট গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে মণিদীপা বসে আছে না! একটা সিগারেটের আগুন একটু ধিইয়ে উঠেই মিইয়ে গেল।

দীপনাথ এগিয়ে জানালায় ঝুঁকে বলে, কাজটা ভাল করেননি। এ পাড়াটা এত রাতে খুব বিপজ্জনক। সঙ্গে অতগুলো টাকা রয়েছে।

আই ক্যান লুক আফটার মিসেল।

ওটা বৃথা অহংকারের কথা মিসেস বোস। এই দেশে কোনও সক্ষম পুরুষও নিজের সিকিউরিটির গ্যারান্টি দিতে পারে না, মেয়েরা তো কোন ছার!

আপনি গাড়িতে উঠুন। পৌঁছে দিচ্ছি।

ও বাবা! আমি থাকি শেয়ালদার কাছে। সেখানে রোজ খুব সাংঘাতিক রকমের জ্যাম হয়। অবলা মেয়েমানুষ আপনি, গিয়ে মুশকিলে পড়বেন।

নাইনটিনথ সেঞ্চুরির ভাষায় কথা বলবেন না তো! আপনার সঙ্গে আমার একটা জরুরি দরকার আছে। উঠুন।

অপেক্ষাই যদি করলেন তা হলে তো ওপরেই বসে থাকতে পারতেন।

পারতাম। কিন্তু অত কথায় কাজ কী?

দীপনাথ ঢোক গিলে সামনের সিটে মণিদীপার পাশে উঠে বসল।

গাড়ি ছেড়ে মণিদীপা দাঁতে দাঁত পিষে বলে, আমি অবলা? না আপনি অবলা?

আমিই বোধ হয়। যাক সে কথা। কী বলছিলেন?

মণিদীপা মোটেই দীপনাথের আস্তানার দিকে গাড়ি ঘোরাল না। সোজা এসপ্ল্যানেডের দিকে যেতে যেতে বলল, আই ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট দি মানি।

দীপনাথ ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মৃদু স্বরে বলে, কিছু গোলমাল নেই মিসেস বোস। পরিষ্কার হোয়াইট মানি।

সে কথা নয়। টাকাটা কার?

তার মানে?

টাকাটা নিয়ে চলে আসতে আসতে আমি ভাবছিলাম মিস্টার বোসের অ্যাবসেন্সে তার অফিসের অ্যাকাউন্ট থেকে আর-কেউ টাকা তুলতে পারে কি না। ভেবে মনে হল, তা সম্ভব নয়। আমি অবশ্য আইনকানুন জানি না, তবু মনে হল। তাই ভাবলুম, এ টাকাটা কার? আপনার নয় তো!

আরে না। বোস সাহেবেরই টাকা। অফিসের আইন যেমন আছে তেমনি ফাঁকও আছে।

এ ক্ষেত্রে আমার অন্য রকম সন্দেহ হচ্ছে। ইউ আর জাস্ট হ্যাভিং পিটি অন মি।

মোটেই নয় মিসেস বোস।

আবার মিসেস বোস?

জিবে এসে যায়, কী করব?

ইউ আর এ স্লেভ।–মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে মণিদীপা বলে।

তা-ই তো। একটু আগেই জানতে পারলাম যে আমি ব্যক্তিত্বহীনও।

আর আমিও জানতে পারলাম যে, আমি আপনার কাউন্টার-ইগো।

তাতে রাগ করেছেন?

না তো! বরং শুনে আমার পরম আহ্লাদ হয়েছে। আর বলব না।

মণিদীপা একবার ঘুরে তাকাল। চোখ হাসছে, মুখ হাসছে। সত্যিকারের আনন্দ দেখলেই বোঝা যায়। বলল, টাকাটা আপনার! আই অ্যাম সিয়োর।

সন্দেহ থাকলে কাল আমাদের অ্যাকাউন্ট্যান্টকে ফোনে জিজ্ঞেস করে দেখবেন।

তাতে লাভ নেই। আমি ফোন করার আগে আপনি অ্যাকাউন্ট্যান্টকে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখবেন।

আপনি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত।

সন্দেহের পিছনে কারণ আছে।

বোস সাহেবেরই টাকা। আমি তো জানি, আপনি স্বামীর অর্জিত টাকা ছাড়া অন্য টাকা ছোঁবেন। ইউ আর এ লয়াল ওয়াইফ।

এটা আবার কোন দেশি ইয়ারকি?

ইয়ারকি নয়।

ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট ধরে মণিদীপা গাড়িখানা আস্তে চালিয়ে ময়দানে এসে পড়ে। তারপর হুঁ হু করে চালাতে থাকে। কিছুক্ষণ কথা বলে না মণিদীপ। দীপনাথও চুপ করে থাকে। যদিও সে জানে, মণিদীপা তাকে কোথাও পোঁছে দিচ্ছে না। শুধু নিয়ে যাচ্ছে। কোথায়, তা হয়তো মণিদীপাও জানে না।

খুব মৃদু স্বরে, প্রায় নিজেকে শুনিয়ে দীপনাথ বলে, আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে…।

মৃদু হলেও মণিদীপা বোধহয় শোনে। মুখ না ঘুরিয়েই বলে, আমি কিন্তু সুন্দরী নই।

আপনি দারুণ সুন্দরী। কে বলে সুন্দরী নন?

হলেও আই ডোন্ট কেয়ার। সুন্দর ব্যাপারটাই স্কিন ডীপ!

তা হবে। আমি শুধু সত্যি কথাটা জানিয়ে দিলাম।

মণিদীপা আবার বহুক্ষণ জবাব দিল না। ময়দানের অন্ধকার চিরে ভেজা রাস্তায় চোখে ধাঁধা লাগিয়ে ছুটে আসছে গাড়ি। বৃষ্টির চিকন কাচে আলোর রেণু ছড়িয়ে পড়ছে। হেডলাইট ঘিরে অপ্রাকৃত আলোর বলয়। একরকম মন্দ লাগে না দীপনাথের। বিদেশি এক সেন্ট ছোট গাড়ির মধ্যে ভারী ঘন হয়ে এক মায়ার সৃষ্টি কবেছে। এত সুন্দর সব গন্ধ মাখে মণিদীপা!

এক-একবার গাড়ির অন্ধকার অভ্যন্তরে চলমান গাড়ির আলো এসে পড়ে, আর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মণিদীপার মুখ। এখন মণিদীপার মূখে একটু আগেকার সেই ঝলমলে হাসির কোনও রেশ নেই।

মণিদীপা একবারও আর ফিরে তাকায় না তার দিকে। শুধু একবার বলে, আপনার মাথার চুলে বৃষ্টির জল লেগে আছে। গ্লাভস কমপার্টমেন্টে একটা পরিষ্কার ঝাড়ন আছে। মুছে নিন।

দরকার নেই। আপনা থেকেই শুকিয়ে যাবে।

আর কোনও কথা হল না অনেকক্ষণ।

দীপনাথ ভেবেছিল, মণিদীপা নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটেই নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কিন্তু তা নয়। খিদিরপুরের ঘিঞ্জি ও নোংবা পাড়ায় একটা দু’নম্বরি চেহারার রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাড় করিয়ে মণিদীপা নামল। বলল, আসুন।

এখানে কোথায়?— বলতে বলতে দীপনাথ সন্দিহান ভাবভঙ্গি করে নামে।

গাড়ি লক করে মণিদীপা খুবই অভ্যস্ত পায়ে রেস্টুরেন্টে ঢোকে। পিছনে দীপনাথ।

ম্যাড়ম্যাড়ে হলুদ রঙের এবড়ো-খেবড়ো দেয়ালের লম্বা সরু একখানা ঘর। ঢোকার মুখেই মস্ত উনে শিক কাবাব সেঁকা হচ্ছে। কাচা পেঁয়াজ এবং মশলাদার রান্নার খুব চড়া গন্ধ। তন্দুরে রুটি হচ্ছে। ভিড় বেশি নেই। যারা এনামেলের প্লেট থেকে রগরগে মাংসের কাই মেখে মাংসের টুকরোয় জড়িয়ে হালুম হালুম খাচ্ছে তারা নিঃসন্দেহেই খালাসি শ্রেণির লোক। এদের জাত-টাত নেই। সব একাকার, একরকম। দরিদ্র, লোভী, ক্ষুধার্ত, হিংস্র এবং ক্রুদ্ধ। সেই সঙ্গে ওপরতলার লোক সম্পর্কে সন্দিহান, দ্বিধাগ্রস্ত এবং ভিতু। চোর-চোখে একটা আধবুড়ো পাঠানি চেহারার কালোলোক দু’জনকে খুব দেখছিল।

মণিদীপা অবশ্য খুবই সহজভাবে গিয়ে একটা টেবিলের দখল নেয়। কাঠের ময়লা আবরণহীন টেবিল। ভেজা স্যাতস্যাতে ভাব। মণিদীপা একটা রুমালে মুখ থেকে সামান্য বৃষ্টির ফেঁটা মুছে বলে, আমি মাঝে মাঝেই এখানে ডিনার সেরে যাই।

কেন?

এমনি। ভাল লাগে।

পাবলিক রিলেশন?

আই লাইক দিজ মেন। আই লাইক দিস এনভিরনমেন্ট।

দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

রেস্টুরেন্টটা খালাসি মার্কা হলেও খাবার খুব খারাপ নয়। রুটি আর চাপ মুখে দিয়ে সেটা টের পায় দীপনাথ। একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, মাংসটা কিসের?

গোরু নয়। খাসি।

গোরু কি না তা জিজ্ঞেস করিনি।

মণিদীপা মৃদু শ্লেষের হাসি হেসে বলে, আমার প্রেজুডিস নেই, কিন্তু আপনার তো থাকতে পারে।

দীপনাথের তেমন খিদে ছিল না। শ্লথভাবে গ্রাসটা মুখে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, আমার আছে। এ দেশের গোরুর মাংস খুব হাইজিনিক না হওয়ারই কথা।

এ দেশের কিছুই হাইজিনিক নয়। কিন্তু তাতে কী? গরিবরা তো বেঁচে আছে।

আপনি দেশের সব গরিবকে নিয়ে ভাবেন, শুধু একজন গরিব ছাড়া।

সে কে? আপনি?

মাথা নেড়ে দীপনাথ বলে, না। বোস সাহেব।

বোস সাহেব গরিব নাকি?

দীপনাথ আবার মাথা নেড়ে বলে, অ্যাপারেন্টলি নয়। কিন্তু আজ ওঁর ব্যাংকে ফোন করে যা জানলাম তাতে মনে হয় বোস সাহেব মানিটারিলি খুব ভাল অবস্থায় নেই।

উদাসভাবে মণিদীপা বলে, তার আমি কী করব?

কিছুই নয়। শুধু একজন গরিবের কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।

মণিদীপাও তার খাবার নাড়াচাড়া করছিল মাত্র। ওইভাবে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ রুমালে হাত মুছে উঠে পড়ল।

চলুন।

আবার কোথায়?

আঃ, অত প্রশ্ন করেন কেন?

মণিদীপার ভিতরকার ছটফটানি খুব স্পষ্ট টের পাচ্ছিল দীপনাথ। কিসের কামড় তা বুঝতে পারছিল না অবশ্য।

মণিদীপা আবার গাড়ি ছাড়ল। এবার নাক বরাবর সোজা এসে থামল নিজের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে। দীপনাথ নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়ল।

মণিদীপা ঘরে ঢুকে ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে ফেলে ডাইনিং হলে গিয়ে ঢুকল। দীপনাথ বসে রইল বাইরের ঘরের সোফায়। শুনতে পেল মণিদীপা দিল্লিতে ট্রাংক কল বুক করছে পাশের ঘরে।

তারপর খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা। তার মধ্যেই রাঁধুনি কফি দিয়ে গেছে, দীপনাথ একটা পুরনো ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের সিকি ভাগ ছবি মুগ্ধ চোখে দেখে ফেলেছে, ‘

এ সময়ে ঘরোয়া ছাপা শাড়ি পরে মণিদীপা এসে সামনে বসল। বলল, আপনাকে একটু বসতে হবে। আমি দিল্লিতে বোস সাহেবকে কনট্যাক্ট করছি। অন্তত ততক্ষণ।

হঠাৎ গরিবকে মনে পড়ল যে!

আই ওয়ান্ট টু টিচ হিম এ লেসন।

ও বাবা! টেলিফোনেও ঝগড়া করবেন নাকি?

আমরা ঝগড়া-টগড়া করি না। নো শাউটিং বাট উই হ্যাভ আওয়ার ওয়ে অফ কমিউনিকেশন।

দীপনাথ মৃদু হাসে। মণিদীপা ভারী ছেলেমানুষ।

দিল্লির লাইন পেতে খুব একটা দেরি হয় না। টেলিফোন বেজে উঠতেই ছুটে যায় মণিদীপা। দীপনাথও নিঃশব্দে উঠে গিয়ে মণিদীপার পাশে দাঁড়াল।

মণিদীপা বোস সাহেবকে ফোনে ধরতে পেরেছে। একতরফা মণিদীপারই কথা শুনতে পাচ্ছিল দীপনাথ; শোনো, আমি মণি বলছি। আই অ্যাম সরি, ব্যাংকে টাকাগুলো সব তুলতে হয়েছে। আমার হাতে আর একদম টাকা নেই। …না, হারায়নি। তুমি এলে সব বলব। …আঃ, শোনো না! দেয়ার ইজ। এ সিরিয়াস ম্যাটার। আমি তোমার অফিস থেকে টাকা অ্যাডভান্স চেয়েছিলাম।… কী বললে? … হ্যাঁ, মিস্টার চ্যাটার্জির কাছেই। …আঁ? টাকাটা চাইতেই উনি দিয়ে দিলেন। কিন্তু বুঝতে পারছি না হাউ ইজ ইট পসিবল। … বলল। …বলছি তো সিরিয়াস ট্রাবলে না পড়লে অফিসে জানাতাম না। তুমি এলে সব বলব। ফোনে কি বলা যায!… ইজ ইট অলরাইট দেন?… ওঁকে আমি বাসায় ধরে এনেছি।

কিছু বলবে?… আচ্ছা, ছাড়ছি।

দীপনাথ নিঃশব্দে সরে এসে সোফায় বসে।

মণিদীপা যখন পরদা সরিয়ে বাইরের ঘরে এল তখন তার ভ্রু কোঁচকানো। মুখ গম্ভীর।

দীপনাথ মৃদু স্বরে বলে, কথা বললেন?

ইউ আর এ লায়ার।

কেন?

ও টাকা বোস সাহেবের নয়।

তাতে কী? টাকার গায়ে তো নাম লেখা থাকে না।

কিন্তু আপনিই না একটু আগে বলছিলেন, আমি অন্যের টাকা ছুঁতে ঘেন্না পাই!

দীপনাথ আন্তরিক দুঃখের গলায় বলে, আপনাকে শান্ত করার জন্য বলেছি। ওটা নিয়ে ভাববেন। স্টিল নাউ আই ও ইউ ফিফটি পয়সা।

বলতে বলতে দীপনাথ তার মানিব্যাগ বের করে একটা আধুলি সেন্টার টেবিলে রাখল। বলল, কুইটস।

নো কুইটস। আপনি আমাদের কাছে হাজার টাকা পান।

বলতে বলতে মণিদীপা তার এলো চুলগুলো একটা গার্ডারে আটকে সামনে বসল।

দীপনাথ মৃদু স্বরে বলল, এ সব প্রসঙ্গ থাক।

মণিদীপা মৃদু হেসে বলে, উড ইউ বিলিভ? আমি কিন্তু সত্যিই অন্যের টাকা ছুঁতে ঘেন্না পাই। আমি বোস সাহেব ছাড়া ম্যারেড লাইফে অন্য কারও টাকা নেওয়ার কথা ভাবতেই পারিনি। আপনার টাকাটা তাই ফেরত দিতাম। কিন্তু বোস সাহেব অ্যাপ্রুভ করেছে বলে নিচ্ছি।

দীপনাথের বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ ঠেলাঠেলি করতে থাকে। এতদিনে! অবশেষে। “হুররে” বলে তার চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। সেই সঙ্গে একটা বিরহের জ্বালাও খামচে ধরে বুক। হরষে বিষাদ কথাটা বহুবার পেয়েছে। আজই প্রথম হরষে বিষাদ কাকে বলে তা বুঝল।

পরিপূর্ণ চোখে মণিদীপার দিকে চেয়ে দীপনাথ বলে, আজ তা হলে চলি মণিদীপা।

মণিদীপা একটু অবাক হয়ে বলে, তা হলে বোল ফুটল?

ফুটল। আজ জেনে গেলাম আপনি সুখী হবেন। আপনি মানে আপনারা।

মণিদীপা উঠে পিছনে আসতে আসতে বলে, একজিটটা একটু ড্রামাটিক হয়ে যাচ্ছে না কি?

হোক, হোক। জীবনে একটু নাটক থাকা ভাল।

ইয়ারকি হচ্ছে? বসুন, এখানে ডিনার খেয়ে যাবেন।

ডিনার খাওয়ালেন যে দোকানে! মনে নেই?

সে কি খাওয়া বলে?

তা হোক। আজ আর-একটা ভোজে দিল খুশ হয়ে আছে। অন্য ভোজের দরকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *