বাবার আমল থেকে রয়েছে চাবুকটা। মালখানগরের কত দামি দামি জিনিসই তো হারিয়ে গেছে, কিন্তু এই চাবুকটা কলকাতায় প্রতাপ কতবার বাড়ি বদল করেছেন। এই চাবুকটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে। মুণ্ডুটা পেতলের, পাকানো পাকানো চামড়ায় ছাতা ধরে গেলেও জীর্ণ হয়নি। একেবারে। বহুকাল আগে পুরী বেড়াতে গিয়ে ভবদেব মজুমদার এটা কিনেছিলেন। এখন প্রতাপদের বসবার ঘরে ঝোলানো থাকে।
বাবার হাতে কখনো এই চাবুকের মার খেতে হয়নি প্রতাপকে, কিন্তু তিনি বাবলকে মেরেছেন। বোধহয় একবারই। কানু মার খেয়েছে দুতিনবার। কলেজে ভর্তি হবার পর বাবলু একদিন মমতাকে বলেছিল, বসবার ঘরে এটা ঝুলিয়ে রাখার কী মানে হয়, মা? এটা কি একটা ডেকরেশান? বাবার যা মেজাজ, আবার কোন দিন কাকে মেরে বসবে, তার ঠিক নেই। চাবুকটা তখন সরিয়ে ফেলা হয়েছিল বটে, এখানে সেখানে পড়ে থাকত, ঐ পেতলের মুণ্ডুটার জন্যই একেবারে ফেলে দেওয়া হয়নি, বাড়ির ঠিকে ঝি একদিন সেটাকে তুলে আবার টাঙিয়ে দিয়েছিল পুরোনো জায়গায়। এখন ওটা এমনই দেয়ালের অঙ্গ হয়ে গেছে যে চোখেই পড়ে না।
মমতা ঘরে ঢুকে দেখলেন, প্রতাপ সেই চাবুকটা দেয়াল থেকে নামিয়ে চুপ করে বসে আছেন। চেয়ারটা ভাঙা, সারানো হয়ে উঠছে না, জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে, পেছন দিকে ভুল করে হেলান দিতে গেলেই উলেট পড়ে যায়। সামনের টেবিলটারও একটা পায়া বদলানো দরকার। প্রতাপ মাটির দিকে স্থিরভাবে চেয়ে রয়েছেন, অর্থাৎ তাঁর মন এখানে নেই।
চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রেখে মমতা বললেন, হাকিম সাহেব এখন কার বিচার করছেন? আসামী খুব কড়া শাস্তি পাবে মনে হচ্ছে?
প্রতাপ একটু চমকে মুখ তুললেন। বেদনা ও রাগ পরিষ্কার আলাদাভাবে ফুটে আছে। তিনি কোনো কথা বললেন না। সকালের ডাকে আসা একটা পোস্ট কার্ড পড়ে আছে প্রতাপের সামনে। মমতা বুঝলেন, ঐ চিঠিখানাই তাঁর স্বামীর মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে। আজকাল কোনো চিঠিতেই ভালো খবর আসে না।
মমতা চিঠিটা তুলতে যেতেই প্রতাপ তাড়াতাড়ি সেখানা হাতে নিয়ে নিলেন। মমতা আগেই দেখে নিয়েছেন চিঠিখানা বিদেশ থেকে আসেনি। সেই জন্যই তেমন কিছু উদ্বিগ্ন না হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে লিখেছে? আমায় পড়তে দেবে না?
প্রতাপ মমতার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, না! তোমার এখন পড়ার দরকার নেই। আমাকে আগে একটু চিন্তা করতে দাও!
মমতা তার অবুঝ স্বামীটির মেজাজের কথা ভালোই জানেন। এখন প্রতাপের সঙ্গে নরম সুরে কথা বললে তিনি আরও পেয়ে বসবেন, হুঙ্কার দিয়ে চ্যাঁচামেচি করে ব্যক্তিত্ব ফলাবেন। এখন আর স্বামীকে ঘাঁটাতে চাইলেন না মমতা, তাঁর রান্না ঘরে কাজ আছে।
তিনি বললেন, চা-টা খেয়ে নাও, তারপর আজ তোমাকে অলিদের বাড়ি যেতে হবে মনে আছে?
একটু পরে মুন্নি রান্না ঘরে এসে ফিসফিস করে বললো, মা, বাবার কী হয়েছে? বাইরের ঘরে বাবা চুপ করে বসে আছে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে! আমি ডাকতেও সাড়া দিল না।
প্রতাপের চোখে জল, এটা প্রায় একটা বাঘের ঘাস খাওয়ার মতন ঘটনা। মমতা বিচলিত হয়ে তাড়াতাড়ি উনুন থেকে কড়াইটা নামিয়ে রেখে, আঁচলে হাত মুছে চলে এলেন বাইরের ঘরে। প্রতাপ সেই ভাঙা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন পাথরের মূর্তির মতন, হাতে চাবুকটা। ৩৫৮
ধরা এবং সত্যিই তাঁর চোখে জল। প্রতাপ রাগারাগি করলে মমতা ভয় পান না, কিন্তু তাঁর এরকম দুর্বলতা দেখলে ঘাবড়ে যান। শরীর খারাপ হয়নি তো? নিজের অসুখ-বিসুখের ব্যাপারে প্রতাপ দারুণ চাপা, কক্ষনো কিছু বলতে চান না।
মমতা স্বামীর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, কী হলো তোমার? আবার বুক ব্যথা করছে?
প্রতাপ দু দিকে মাথা নেড়ে বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন। তারপর মমতা ও মুন্নির দিকে তাকিয়ে মুন্নিকেই জিজ্ঞেস করলেন, টুনটুনি কোথায় রে?
পড়াশুনোয় মাথা নেই বলে টুনটুনিকে টাইপ রাইটিং শেখার জন্য একটা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। সকালবেলা সে গড়িয়াহাট বাজারের কাছে সেই স্কুলে চলে যায়। কোনোদিনই সে ঠিক সময়ে ফেরে না।
প্রতাপ বললেন, মুন্নি, তুই গিয়ে টুনটুনিকে ডেকে আনতে পারবি?
মন্নি বললো, এখন অত দরে কী করে যাবো? আমার যে কলেজ আছে। টুনটুনি এসে পড়বে এগারোটা–সাড়ে এগারোটার মধ্যে। কী হয়েছে, বাবা, ওকে হঠাৎ ডাকতে হবে কেন?
আদেশ নয়, ধরা গলায় অনুরোধের সুরে প্রতাপ মেয়েকে বললেন, কলেজে দেরি করে যাস, একবার যা, টুনটুনিকে ডেকে নিয়ে আয়।
মমতা বললেন, দেওঘর থেকে কোনো খবর এসেছে? চিঠিটা আমাকে পড়তে দিলে না কেন?
প্রতাপ বললেন, এরকম চিঠি পড়াও পাপ। মমো, ছোড়দি মারা গেছে। মমতা কেঁপে উঠলেন। টুনটুনিকে ডাকতে পাঠাবার কথা শুনেই মমতা তার পিতৃবিয়োগের খবরের আশঙ্কা করেছিলেন। বিশ্বনাথ গুহের যে-কোনো দুসংবাদ আসা আশ্চর্য কিছু না। কিন্তু শান্তি ঠাকুরঝি? তার অসুস্থতার কথাও বিশ্বনাথ জানাননি।
চিঠিখানা সত্যিই বিচিত্র।
মাই ডিয়ার প্রতাপ,
তোমাকে একটা সুসংবাদ দেই। আমাদের নিয়ে তোমাকে আর কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে। তোমার ছোড়দি শান্তি গত শনিবার অকস্মাৎ সন্ন্যাস রোগে সকলের মায়া কাটাইয়া পরপারে চলে গেছে। আমার প্রতি অবশ্য শেষদিকে তাহার কোনো মায়া ছিলও না। এতদিন পরে সে যথার্থ শান্তি পাবে। ইতিমধ্যে সংসার চালানো অসম্ভব হওয়ায় বাড়িখানি বিক্রয় করিয়া দিয়াছি। তোমার স্মরণে আছে নিশ্চয় যে তোমার মাতা ঠাকুরানী এই বাড়ি তোমার ছোড়দিকেই ওয়ারিশ করিয়া দিয়াছিলেন। শান্তির জীবিতাবস্থায়, তার সম্মতিতেই বাড়ি বিক্রয় হয়। আমি অবশিষ্ট জীবন কাশীধামে কাটাবো ঠিক করিয়াছি। ধার শোধেই অনেক টাকা ব্যয় হইয়া গেল। এক হাজার টাকা মানি অর্ডার যোগে তোমার নামে পাঠাইলাম, টুনটুনির বিবাহের জন্য রাখিয়া দিও। বিদায়, ব্রাদার, বিদায়। সকলই ঈশ্বরের ইচ্ছা। এ জীবনে ঈশ্বর আমাদের দয়া করলেন না। ইতি তোমার ওস্তাদজী (প্রাক্তন) বিশ্বনাথ গুহ।
টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মেরে প্রতাপ বললেন, খুনী! লোকটা ছোড়দিকে মেরে ফেলেছে!
উল্টোদিকের চেয়ারে বসে পড়ে মমতা বিবর্ণ মুখে বললেন, ছোড়দি? ছোড়দি চলে গেল! কতগুলো কথা মুখে উচ্চারণ করা যায় না, তবু মনে আসে। ক্ষয়কাশের রোগী বিশ্বনাথ গুহকে অনেকদিন ধরেই খরচের খাতায় ধরে রাখা হয়েছিল। এমনকি মমতা এমন কথাও মাঝে। মাঝে ভেবেছেন যে, বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর শান্তিকে কলকাতার বাড়িতেই এনে রাখতে হবে। কিছুদিন আগে সুপ্রীতির কী সাংঘাতিক অসুখ গেল, শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হলো একটা কিডনি, শরীর একেবারে রক্তশূন্য, সাত বোতল রক্ত দিতে হয়েছিল, তবু তো তিনি বেঁচে ফিরে এলেন। বিশ্বনাথ বেঁচে রইলেন, সুপ্রীতি রইলেন আর মরতে হলো শান্তিকে। নিয়তির কী আশ্চর্য কৌতুক।
প্রতাপ আর সুপ্রীতির তুলনায় শান্তি বরাবরই একটা নিষ্প্রভ জীবন কাটিয়ে গেলেন। কোনোদিন তিনি জোরে কথা বলেননি, অন্য কারুর ওপর নিজস্ব মতামত খাটাতে পারেননি। মমতার সব সময়ই শান্তিকে মনে হত তাঁর শাশুড়ির ছায়া। মা-বাবার প্রিয় মেয়ে ছিলেন শান্তি। বিয়ের পরেও তাঁকে বাপের বাড়ি ছাড়তে হয়নি, তাঁর গান-পাগল স্বামী বছরে একবার দুবার দেখা করে যেতেন, সেটাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট সুখের ছিল। দেশের বাড়ি ছেড়ে দেওঘরে যেতে হলো বলেই সেই নিশ্চিন্ত জীবন তছনছ হয়ে গেল।
প্রতাপ ফাটা ফাটা গলায় বললেন, বাড়ি বিক্রি করেছে। আমাদের না জানিয়ে বাড়ি বিক্রি করেছে, তারপর বউকে মেরেছে। ঐ চশমখোরটা সব পারে!
মমতা বললেন, আস্তে। অত চেঁচিয়ো না। দিদিকে ধীরেসুস্থে খবরটা দিতে হবে।
প্রতাপ একটুখানি গলা নামিয়ে বললেন, আমি আজই দেওঘরে গিয়ে ওকে ধরবো। কাশীতে গেলেও পার পাবে না!
মমতা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, চিঠিটার তারিখ পাঁচ দিন আগের, সোমবার, ছোড়দি চলে গেছেন আরও দু দিন আগে। আমাদের কি অশৌচ হবে?
প্রতাপ নিদারুণ বিস্মিতভাবে বললেন, ছোড়দি মারা গেছে, আমাদের অশৌচ মানতে হবে না? এটা আবার জিজ্ঞেস করছো?
শোকের মধ্যে নানা রকম ছোটখাটো কথাও মনে আসে। সকালেই প্রতাপ বাজার থেকে মাগুর মাছ এনেছেন, একটু আগে মমতা সেই মাছ কুটে কড়াইতে চাপিয়েছিলেন। দামী মাছ, ফেলে দিতে হবে। আজও তো এ বাড়িতে ফ্রিজ কেনা হলো না। প্রতাপ যদি চিঠিটা পাবার সঙ্গে সঙ্গে মমতাকে জানাতেন, তাহলেও ঐ জিওল মাছ না কুটে বাঁচিয়ে রাখা যেত কয়েক দিন। মমতার ধারণা, বোন মারা গেলে তিনদিনের বেশী অশৌচ থাকে না।
শুধু শুধু খরচের বোঝা বাড়াবার কোনো মানে হয় না। মমতা বললেন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে, তুমি আর দেওঘর গিয়ে কী করবে? টুনটুনিকে দিয়ে এখানেই শ্রাদ্ধ করাও।
প্রতাপ আবার ক্ষেপে উঠে বললেন, যাবো না মানে? ঐ মাতাল, জোচ্চোরটাকে আমি পালাতে দেবো ভেবেছো? ওর টি বি কক্ষনো হয়নি, কিচ্ছু হয়নি, টি বি হলে এতদিন কেউ বাঁচে? আমাদের ঠকিয়েছে, সাধারণ কাশির অসুখ, ঐ জন্যই ডাক্তার দেখাতে চাইতো না। আমার ছোড়দিকে কত কষ্ট দিয়েছে। আমি আজই বিকেলের ট্রেনে গিয়ে ওকে ধরবো!
মমতা চুপ করে সব শুনলেন, তারপর দৃঢ়ভাবে বললেন, না, তুমি যাবে না!
মমতা আবার চলে গেলেন রান্না ঘরে। অশৌচ যখন মানতেই হবে, তখন বাড়িতে আমিষের গন্ধ থাকাও ঠিক নয়। সুপ্রীতি এখনও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। এখন সব কিছু সামলাতে হবে তো মমতাকেই।
মায়ের পেটের বোন শান্তির জন্য প্রতাপ আর সুপ্রীতির যতটা শোক হবে, মমতা ততোটা বোধ করবেন না, এটা স্বাভাবিক। কতটুকু বা দেখেছেন শান্তিকে, মমতা তো কখনো একটানা বেশীদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকেননি। তবু মুখচোরা, ব্যক্তিত্বহীনা, নিপাট ভালোমানুষ শান্তির জন্য মমতার কষ্ট হতে লাগলো। শেষের ক’টা বছর কী যাতনাই না ভোগ করতে হলো ওকে!
এমনকি বিশ্বনাথের জন্যও কষ্ট বোধ করলেন মমতা। টি বি হোক বা না হোক, মুখ দিয়ে রক্ত তো পড়তোই, আর ঐ কাশির অসুখটার জন্যই বিশ্বনাথের গানের গলা একেবারে নষ্ট হয়ে। গেল। বিশ্বনাথের ধারণা, গুরুর অভিশাপেই এরকম হয়েছে, তিনি ছাত্রছাত্রীদের গান শিখিয়ে পয়সা নিতেন। কিন্তু পয়সা উপার্জনের আর কোনো পন্থাও তো বিশ্বনাথের জানা ছিল না। গায়ক মানুষের কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে গেলে আর কী থাকে! দিলখোলা, বেপরোয়া সেই মানুষটার কী পরিণতি! দেওঘরের ঐ বাড়ি বিক্রি করাই বা কী এমন অপরাধ হয়েছে? প্রতাপ নিজেই কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ঐ বাড়ি উদ্ধারের কোনো আশা নেই। কয়েকটি গুণ্ডাগোছের ভাড়াটে একতলাটা দখল করে রেখেছে, তারা এক পয়সাও ভাড়া দেয় না, তাদের উঠিয়ে দেবারও কোনো উপায় নেই। ঐ বাড়ি কেনার খদ্দের যে পাওয়া গেছে তাই-ই যথেষ্ট, হয়তো যৎসামান্য দাম ধরে দিয়েছে।
অসুস্থ শরীর নিয়ে বিশ্বনাথ কোথায় একা একা ঘুরবেন? কলকাতায় এসে যাতে প্রতাপদের ঘাড়ের বোঝা হতে না হয়, তাই বিশ্বনাথ ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলেন জনারণ্যে, এটাও বুঝতে পারলেন মমতা। বিশ্বনাথের জন্য দুঃখ হলো মমতার, আবার কৃতজ্ঞতাও বোধ করলেন। বিশ্বনাথকে এ বাড়িতে রাখা খুবই কষ্টকর হতো!
এই সব চিন্তার ফাঁকে ফাঁকেও মমতার মনে পড়তে লাগলো বাবলুর কথা। ছেলেটা অনেকদিন চিঠি লেখে না। অলি পৌঁছেই চিঠি দেবে বলেছিল, তাও তো এলো না। আমেরিকার রাস্তায় নাকি যখন-তখন অ্যাকসিডেন্ট হয়। কয়েকদিন আগেই কাগজে একটা। খবর বেরিয়েছে যে, নিউইয়র্কে একটি বাঙালী ছাত্র আত্মহত্যা করেছে, বন্ধ ঘরের মধ্যে তিন দিন তার লাশ পড়েছিল, কেউ টের পায়নি। এসব ভাবলেই বুক কাঁপে।
সুপ্রীতিকে শান্তির মৃত্যু-সংবাদ জানাবার ভার মমতাকেই নিতে হল। সুপ্রীতি বিষম কোনো আঘাত কিংবা শোকের উচ্ছাস দেখালেন না। শরীর দুর্বল হলে মানুষের আবেগও কমে যায়। সুপ্রীতি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমার আগেই চলে গেল! মায়ের কাছে গেছে, মা ওকে ডেকে নিয়েছে, ওখানেই শান্তি ভালো থাকবে!
সুপ্রীতি আরও বললেন, তুতুল বাবলুকে এ খবর এখন লিখো না, মমো। প্রবাসে অশৌচ মানতে হয় না। টুনটুনির কোমরে একটা লোহার চাবি বেঁধে দিও।
টুনটুনিকে খুঁজতে গিয়ে পেল না মুন্নি। টাইপিং স্কুলে এসে একটা খারাপ খবর শুনলো মুন্নি। টুনটুনি এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল বটে, কিন্তু গত এক মাসের মধ্যে সে একদিনও আসেনি। ইনস্ট্রাক্টরকে সে বলেছে যে, তার টাইপ শিখতে ভালো লাগে না। তা হলে রোজ সকালে টাইপ শেখার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ‘টুনটুনি কোথায় যায়? এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না।
এখন টুনটুনিকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবে কী করে মুন্নি? আসল কথাটা শুনলে বাবা রেগে যাবে, অথচ কী মিথ্যে কথাই বা বলা যায়? দেওঘরের খবরটা সে জেনে এসেছে। শান্তি পিসিকে তার ভালো করে মনেই নেই, কিন্তু টুনটুনি তো তার মাকে হারালো। মা বাবার কথা বেশি বলেই না টুনটুনি, যদি বা কখনো প্রসঙ্গ ওঠে তখন বাবার প্রতি অসম্ভব একটা রাগের ভাব টুনটুনির কথায় ফুটে বেরোয়। কিসের জন্য রাগ কে জানে।
টাইপিং স্কুল থেকে টুনটুনির এগারোটায় ফেরার কথা, অতক্ষণ তা হলে মুন্নিকে অন্য কোথাও কাটিয়ে যেতে হয়। মহা মুশকিলের ব্যাপার। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে মুন্নির এক বান্ধবীর বাড়ি আছে, কিন্তু সে নিশ্চয়ই এখন কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।
গোলপার্কের মোড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে মুন্নি একটা ল্যান্ড মাস্টার গাড়ির সামনে পড়ে গেল। গাড়িটা তাকে দেখেই ব্রেক কষেছে। একজন মোটাসোটা লোক গলা বাড়িয়ে বললো, অ্যাই মুন্নি, কোথায় যাচ্ছিস? খানিকটা এগিয়ে দেবো!
চিনতে কয়েক পলক অসুবিধে হলো মুন্নির। কানুকাকা! এই কানুকাকা ন’মাসে ছ’মাসে তাদের বাড়িতে আসে, কিন্তু দিন দিনই মোটা হচ্ছে বলে প্রত্যেকবারই অন্য রকম মনে হয়। এখন গাল দুটো একেবারে বাতাবী লেবুর মতন।
বড়বাজারে একটা কাপড়ের দোকানের অর্ধেক মালিক এই কানুকাকা। প্রত্যেক বছর মাকে আর পিসিমণিকে ভালো শাড়ি দেয়। কিন্তু বাবাকে কিছু দেয় না। বড়বাজারে যারা ব্যবসা করে, তাদের বুঝি মোটা হওয়াই নিয়ম।
কানুর মুখভর্তি পান, সে রাস্তায় পিক ফেলে বললো, বড়দি কেমন আছে রে?
তখন মুন্নির মনে পড়ে গেল। শান্তিপিসিও তো কানুকাকার দিদি হয়। সুতরাং, আজকের গুরুতর খবরটি কানুকাকাকে জানানো উচিত। সে জিজ্ঞেস করলো, দেওঘরের শান্তিপিসির কথা তোমার মনে আছে, কানুকাকা?
কানু বললো, কেন মনে থাকবে না? কী হয়েছে ছোড়দির?
খবরটা শুনে কানু বেশ বিহ্বল হয়ে গেল। তারপর অস্ফুটভাবে বললো, বিশ্বনাথ-জামাইবাবু। আমার কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা ধার নিয়েছিল, সে কি আর শোধ দেবে?
পেছন থেকে অন্য গাড়ি হর্ন দিচ্ছে, কানুর গাড়িটা বেয়াড়াভাবে দাঁড় করানো, বুড়ো ড্রাইভার গাড়িটা সাইড করলো। কানু নেমে পড়ে বিষাদাচ্ছন্ন গলায় বললো, মালখানগরের মজুমদার বংশের আর একজন চলে গেল! ছোড়দি বড় ভালো মানুষ ছিল, রে। জানিস মুন্নি, গত বছর। তোর কাকিমা আর হোল ফ্যামিলি নিয়ে আমি দেওঘরে গেছিলাম। বাহান্ন বিঘাতে বাড়ি ভাড়া করে ছিলাম এক মাস। বিরাট প্যালেশিয়াল বিল্ডিং, ঐ বিশ্বনাথ-জামাইবাবুই ঠিক করে দিয়েছিলেন। তখনই দেখি যে ছোড়দির খুব অ্যানিমিয়া, আমি দৈনিক এক সের দুধের ব্যবস্থা করে দিলাম, কিন্তু ছোড়দি সেই দুধ নিজে না খেয়ে জামাইবাবুকেই খাইয়ে দিত! আমি যখন ছোট ছিলাম, দেশের বাড়িতে ছোড়দি আমাকে দুধ-মুড়ি-পাটালি গুড় মেখে কতদিন খেতে দিয়েছে। সেই ছোড়দি…! ওঠ মুন্নি, গাড়িতে ওঠ, তাদের বাসায় গিয়ে সকলের সাথে দেখা করে আসি!
কানু এসে পড়ায় মমতার সুবিধেই হলো। কানু উদ্যোগী, কর্মী পুরুষ। বিশ্বনাথ গুহ শান্তির শ্রাদ্ধের কিছু ব্যবস্থা করেছেন কি না তা জানাননি, নিয়ম রক্ষার জন্য এ বাড়িতেই একটা ছোটখাটো শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান হলো। পুরুত ডাকা, জিনিসপত্রের জোগাড়যন্ত্র করা, সে সব দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়ে নিল কানু।
যথেষ্ট টাকা-পয়সা করেছে কানু, নিজের বাড়ি ও গাড়ি আছে, তবু তার একটাই ক্ষোভ, সে তার সেজদার কাছ থেকে নিজের প্রাপ্য মর্যাদা আদায় করতে পারলো না। প্রতাপ এখনও কানুকে বিশেষ গ্রাহ্যই করেন না। আগের মতন বকুনি-দাবড়ানি দেন না বটে, কিন্তু কথাও বিশেষ বলেন না, হু-হাঁ করে কোনো মতে এড়িয়ে যান। কানুর এখন শ্বশুর বাড়ির বেশ বড় একটা গোষ্ঠী আছে, ব্যবসার জগতের পরিচিতমণ্ডলী আছে, তবু যেন, একদা যে পরিবার থেকে সে প্রায় বিতাড়িত হয়েছিল, সেখানে এসে ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তি না দেখাতে পারলে যেন তার সুখ হয় না। তাই সে এ বাড়িতে ঘুরে ফিরে আসে।
তিন-চারদিনের মধ্যেই শান্তির প্রসঙ্গ একেবারে চুকেবুকে গেল। দেওঘরে সকলে মিলে সুখের দিনের একটা গ্রুপ ফটোগ্রাফ তোরঙ্গ থেকে বার করে মমতা বাঁধাতে দিলেন, ঐ ছবিতেও শান্তি সকলের আড়ালে পড়ে গেছেন, কোনোক্রমে মুখটা শুধু একটুখানি দেখা যায়।
সপ্তাহখানেক পরে এক রাত্তিরে মমতা হালকা মেজাজে প্রতাপকে জিজ্ঞেস করলেন, সেদিন জামাইবাবুর পোস্টকার্ডটা আসবার পর তুমি দেয়াল থেকে চাবুকটা পেড়ে হাতে নিয়ে বসেছিলে কেন বলো তো? কাকে মারবে ভেবেছিলে? যমকে?
প্রতাপ কোনো উত্তর দিলেন না। মুখ নীচু করে সিগারেট টানতে লাগলেন। মমতা কাছে এসে তাঁর স্বামীর গেঞ্জিপরা চওড়া কাঁধে হাত রেখে আবার জিজ্ঞেস করলেন, বলো না, কাকে মারবে ভেবেছিলে? যমের বদলে বিশ্বনাথ গুহকে নাকি? তিনি রইলেন। ৩৬২
দেওঘরে না কাশীতে, আর তুমি কলকাতায় বসে তাঁকে মারবার জন্য চাবুক তুললে? লোকে যে কেন তোমাকে পাগল বলে না, তাই ভাবি!
প্রতাপ বললেন, তুমি তা হলে আমাকে পাগলই ভাবো?
মমতা বললেন, ভাববো না? এক এক সময় যা কাণ্ড করো! শোনো, এবারে ঐ চাবুকটা ফেলে দাও! বসবার ঘরে কেউ চাবুক সাজিয়ে রাখে না। সেদিন কানু হাসতে হাসতে বলছিল, সেজদা ওটা কাকে মারবার জন্য রেখেছে? এ প্রতাপ বললেন, এটা যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে! ওটা আমাদের বংশের একটা চিহ্ন।
মমতা বললেন, আহা হা, কী এমন চিহ্ন! তোমার মায়ের আনা ভালো ভালো কাঁসার বাসনগুলো তো সব দেওঘরেই পড়ে রইলো। আমি দুটো থালা আনতে চেয়েছিলাম, তুমি তাও আনতে দাওনি।
প্রতাপ বললেন, ওরকম মোটাসোটা কাঁসার থালা আজকাল আর কে ব্যবহার করে? আনলেও তো বাক্সে ভরে রাখতে।
মমতা বললেন, তবু স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে থেকে যেত। ঐ রকম চাবুক বুঝি কেউ ব্যবহার করে আজকাল?
প্রতাপ বললেন, সেদিন চাবুকটা কেন হাতে নিয়েছিলাম জানো? ওটা সত্যি সত্যি ব্যবহার করি বা না করি, কিন্তু প্রয়োজন হলে ব্যবহার করার ইচ্ছেটা যেন চলে না যায়! সেই ইচ্ছেটা চলে যাওয়াই হচ্ছে চূড়ান্ত কমপ্রোমাইজ। সে রকম কমপ্রোমাইজের জীবন আমার দ্বারা হবে। না, বুঝলে! তা তুমি আমাকে পাগলই বলো, আর যাই-ই বলো!
মমতা স্বামীর মাথার চুল মুঠো করে ধরে সকৌতুকে বললেন, পাগল, আমার বদ্ধ পাগল! বাইরের লোকের সামনে আর বেশী পাগলামি করতে যেও না, এ বয়েসে মানায় না।
অনেকদিন পর বিছানায় শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হলো, প্রণয় হলো, তারপর মমতা তাঁর স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
কয়েকদিন পর প্রতাপ সত্যিই পাগলের মতন দাপাদাপি শুরু করে দিলেন ঘরের মধ্যে। মমতা কিছুতেই তাঁকে ধরে রাখতে পারেন না।
গতকালই টুনটুনি মমতার কাছে স্বীকার করেছে যে, সে গর্ভবতী। তাদের প্রাক্তন বাড়িওয়ালার ছেলে পরেশই তার প্রেমিক। তবে পরেশ তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু পরেশের বাবাও কিছুদিন আগেই মারা গেছেন, এখনও তার কালাশৌচ কাটেনি, তাই আনুষ্ঠানিক বিয়ে হবে না, পরেশের বন্ধুরা গোপনে রেজিষ্ট্রি বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। আজ সেই বিয়ে, সন্ধের পর পরেশ আর টুনটুনি আসবে এ বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম করতে। টুনটুনি আপাতত এ বাড়িতেই থাকবে, এক বছর পরে পরেশ তার স্ত্রীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে।
টুনটুনির যে একটা হিল্লে হয়ে গেল, এতে সকলের খুশী হবারই কথা। তবু প্রতাপ রাগে ফেটে পড়লেন। সমস্ত ব্যাপারটাই প্রতাপের কাছে অত্যন্ত অপবিত্র মনে হচ্ছে। টুনটুনির মায়ের মৃত্যুর এক মাসও পূর্ণ হয়নি, এর মধ্যেই সে কুমারীত্ব নষ্ট করলো? মমতা বোঝালেন যে টুনটুনির ঐ ব্যাপারটা কয়েক মাস আগেই শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই, এর সঙ্গে মায়ের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতাপ বললেন, বিয়ে করবে ঐ স্কাউন্ট্রেল পরেশটাকে? ওকে গলায় দড়ি দিতে বলো! ওকে বাড়ি থেকে দূর করে দাও, আমি কোনোদিন আর ওর মুখ দেখতে চাই না!
প্রতাপের বাহুতে হাত রেখে মমতা বললেন, এ সব তোমার পাগলামির কথা! আজকাল মেনে নিতে হয়। মেনে না নিলেই অশান্তি বাড়ে। ভুল করুক বা যাই-ই করুক, মেয়েটা যখন একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে, তখন যার সঙ্গে ঐ সব ব্যাপার, সেই-ই যে ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, সেটাই তো ওর মহাভাগ্যের ব্যাপার। না হলে ও মেয়ের কি আর কারুর সঙ্গে বিয়ে। হতো কখনো? এখন তুমি আর মাথা গরম করো না!
প্রতাপ বললেন, তোমার মনে নেই, আমাদের কালীঘাটের বাড়িতে এসে ঐ পরেশ কত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে গিয়েছিল। আমাকে মুখের ওপর শাসিয়েছিল। মাঝ রাতে বোমা ছুঁড়ে ছিল! সেই হারামজাদাকে আমরা জামাই করে বাড়িতে বরণ করে নেবো? আমাদের কি মান-সম্মান বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই? গরিব হয়ে গেছি বলে…আসুক ও এ বাড়িতে, আমি চাবুক পেটা করে ওর পিঠের চামড়া তুলে নেবো!
মমতা দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে শান্ত গলায় বললেন, না, তুমি চাবুক মারবে না। কারুকেই চাবুক মারবে না। অবস্থার গতিকে পুরোনো অনেক কথা ভুলে যেতেই হয়।
এর পরেও মমতা অনেকক্ষণ ধরে প্রতাপকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, প্রতাপের মেজাজ উত্তরোত্তর চড়তে লাগলো। পরেশের নামটাই তিনি সহ্য করতে পারছেন না। এই বিয়েটাও তিনি স্বীকার করতে চান না। তাঁর মতে, ঐ গোপনে বিয়ে করাটরা একেবারে বাজে কথা! রেজিস্ট্রি বিয়েরও কোনো দাম নেই। টুনটুনিকে এ বাড়িতেই ফেলে রাখবে, পরেশ কোনোদিনই তার এই বউকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে না। ওরা অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে, ওদের পরিবারে ছেলের বিয়ে দিয়ে শুধু বউ আনা হয় না, এক কাঁড়ি টাকা আর সোনাদানাও আনে! মমতা বললেন, এক বছর অন্তত অপেক্ষা করে তা দেখা যাক। তারপর পরেশের মতিগতি সত্যি খারাপ দেখলে আইনের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। তার বদলে পরেশকে এখন চাবুক মারলে তো কোনো কিছুরই সুরাহা হবে না।
অবুঝ প্রতাপের প্রতি মমতা তাঁর শেষ অস্ত্রটি নিক্ষেপ করলেন। তিনি বললেন, বেশ, এতই যদি তোমার জেদ, তুমি যদি আমার কথা মোটেই শুনতে না চাও, তা হলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করো। টুনটুনিকে, পরেশকে মারধোর করো, পাড়ার লোক এসে জমুক বাড়িতে, যা খুশী হোক! মুন্নিকে নিয়ে আমি বিকেলবেলাই চলে যাবো আমার ছোট বোনের কাছে। তুমি যেন আমাদের আর কোনো দিন ডাকতে যেও না!
সন্ধের একটু পরে এলো টুনটুনিরা। পরেশ একা আসেনি, সঙ্গে তিনজন বন্ধুকে নিয়ে। এসেছে। রেজিষ্ট্রি বিয়ে হলেও টুনটুনিকে ওরা কিনে দিয়েছে একটা লাল বেনারসী শাড়ি, মাথায় অর্ধেক ঘোমটা দেওয়া, সিঁথিতে সিঁদুর পরা টুনটুনিকে দেখাচ্ছে একেবারে অন্য রকম।
মমতা আগেই মিষ্টি আনিয়ে রেখেছিলেন, মন্নি সবাইকে পরিবেশন করলো। বেশ একটা আনন্দ-হুল্লোড়ের পরিবেশ হলো। বিয়ের কনের মতনই লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে আছে টুনটুনি, পরেশের এক বন্ধু পর পর তিনখানি গজল গান শোনালো।
পরেশই এক সময় মমতাকে জিজ্ঞেস করলো, কাকিমা, কাকাবাবু নেই বাড়িতে?
অসুস্থ শরীর নিয়ে সুপ্রীতিও একবার এ ঘরে এসে সকলের প্রণাম নিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রতাপ আসেননি। নিজের ঘরে তিনি উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়।
মুন্নি মিথ্যে কথা বলতে যাচ্ছিল, মমতা তাকে বাধা দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আছেন বাড়িতে। স্নান করছিলেন, তোমরা বসো, আমি ডেকে আনছি।
শয়নকক্ষে এসে দুষ্ট ছেলেকে কড়া শাসনের ভঙ্গিতে মমতা বললেন, এই শেষবারের মতন তোমাকে বলছি, তুমি একবার ওঘরে আসবে কি না?
প্রতাপ বিছানা থেকে উঠে এসে অতিশয় কাতরভাবে বললেন, আমাকে কি যেতেই হবে? কেন আমাকে এসবের মধ্যে জড়াচ্ছো?
মমতা বললেন, মুখটা মুছে নাও, একটা গেঞ্জি পরো।
প্রতাপকে দেখে সবাই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালো। থেমে গেল গজল গান। পরেশ এগিয়ে এসে একেবারে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে প্রতাপের পায়ের ধুলো নিয়ে বিগলিতভাবে বললো, কাকাবাবু, বাবা মারা গেছেন শুনেছেন তো? আজ থেকে আপনি আমার বাবার মতন হলেন…
এই ছেলে মাত্র কয়েক মাস আগে বোমা মেরে কালীঘাটের বাড়ি থেকে তাঁদের তাড়িয়েছিল, সেই সময় প্রতাপ দারুণ বিপত্তির মধ্যে পড়েছিলেন, এখন তার মুখে এই রকম কথা শুনলে ঠাস করে চড় কষাতে ইচ্ছে করে না? আসলে পরেশ প্রতিশোধ নিতে এসেছে, সে দেখিয়ে দিল, এ বাড়ির একটি মেয়েকে নিয়ে সে যেমন খুশী খেলা খেলতে পারে। একটা কাগজে সই করা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে বলেই তার সাত খুন মাপ? প্রতাপের মনে হলো, এই বিয়েতে তাঁর বাবার অপমান, মায়ের অপমান, ছোড়দির অপমান। তাঁর নিজের অপমান তো বটেই।
প্রতাপ দেয়ালের দিকে তাকালেন। মমতা চাবুকটা সরিয়ে ফেলেছেন। ময়লা দেয়ালে। চাবুকটার জায়গায় একটা ফর্সা, লম্বা দাগ। সত্যি সত্যি চাবুক না মারলেও চাবুক ব্যবহার করার ইচ্ছেটা যেন চলে না যায়। প্রতাপ ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে অদৃশ্য চাবুক ধরে রইলেন।
মমতার সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হলো। মমতা ইঙ্গিতে বলছেন–নতুন বর-বধূকে আশীবাদ করতে। প্রতাপ একবার ভাবলেন বলে উঠবেন, যথেষ্ট আদিখ্যেতা হয়েছে, এবার বিদায় হও! পরক্ষণেই তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। তার ঘাড় ব্যথা করছে। হাতের মুঠো খুলে তিনি করতল রাখলেন পরেশের মাথার সিকি ইঞ্চি উঁচুতে, আশীর্বাদের ভঙ্গিতে। তিনি ওর শরীর স্পর্শ করলেন না।