1 of 2

৪৪. প্রভাসকুমারদের পরিবারটি

প্রভাসকুমারদের পরিবারটি খড়গপুরে বেশ প্রতিপত্তিশালী। ওঁরা এখানকার পুরনো বাসিন্দা, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে রয়েছে বড় ডাক্তার, উকিল, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান এবং পুলিশের একজন বড় কর্তা। সুতরাং সূর্যকে নিয়ে খুব বেগ পেতে হল না। এ-অঞ্চলের সমস্ত বাড়ি তল্লাশি করার সময় পুলিশ দুবার এসেছে এবাড়িতে, কিন্তু সারা বাড়ি সার্চ করেনি, বাইরে থেকে কথাবার্তা বলে চলে গেছে। প্রভাসকুমারের এক কাকা খুব গোপনে এসে সূর্যর চিকিৎসা করে যাচ্ছেন।

সূর্য একেবারে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। তার ছ’ ফিট এক ইঞ্চি দেহটা এখন একেবারে অস্থিসর্বস্ব। কোটরে বসা চোখদুটো জ্বলজ্বল করে। তার জ্বর কমে গেছে, বুকের ব্যথাও অনেক কম, তবু মাঝে মাঝে হেঁচকি ওঠার মতন হয়, তখন মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে। ভেতরের কলকবজার যে কী গণ্ডগোল হয়েছে, তা পরীক্ষা করার জন্য তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল, কিন্তু সে প্রশ্নই আপাতত ওঠে না। নিছক অদম্য জীবনীশক্তির জোরেই সূর্য আস্তে আস্তে সেরে উঠছে।

যতক্ষণ জেগে থাকে, তখনও সূর্য প্রায় কথা বলতেই চায় না। শ্রীলেখার সঙ্গেও একটা-দুটোর বেশি কথা বলে না। হয় চোখ বুজে শুয়ে থাকে, অথবা বই পড়ে। শ্রীলেখা। তাকে কিছু বই দিয়েছিল প্রভাসকুমারের ঘরে বইয়ের অভাব নেই–সূর্য তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই পড়তে চাইল। সূর্যর শিয়রের কাছে স্তৃপ করা বই।

বাংলা বই সূর্য আগে বিশেষ কিছু পড়েনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষা বুঝতে তার প্রথম প্রথম অসুবিধে হয়। তবু ধৈর্য ধরে প্রত্যেকটি পাতা দু’বার-তিনবার করে পড়ে। গল্পগুচ্ছের বেশ কয়েকটি গল্প ও ‘পূরবী’র কবিতা পড়ে আনন্দ পেল সে। কিন্তু তার রবীন্দ্রচর্চা বেশিদূর এগোল না। প্রভাসকুমার সূর্যর বই পড়ার আগ্রহ দেখে নিজে থেকেই তাকে অন্যান্য কয়েকটি বইয়ের সঙ্গে ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসখানি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে বইখানা পড়তে পড়তে সূর্য অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করল এবং ছুঁড়ে ফেলে দিল খাটের নীচে। সে আর এই লেখকের কোনও বই পড়তে চায় না।

প্রভাসকুমার প্রথম থেকেই সূর্য সম্পর্কে খুব কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। মানব চরিত্রের রহস্য উদঘাটন ব্যাপারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ আছে। এই ছেলেটি তার চোখে রহস্যময়। এত অল্প বয়সি অথচ এ রকম গম্ভীর ও চাপা স্বভাবের ছেলে তিনি কখনও দেখেননি। এর মুখ দেখলেই বোঝা যায়, এর মনের মধ্যে সব সময় নানা রকম চিন্তার প্রবাহ চলেছে, অথচ সেই সব চিন্তার কথা পৃথিবীর আর কোনও দ্বিতীয় প্রাণীকে জানাতে সে আগ্রহী নয়। মানুষ এমন একাকীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে কী করে? নিজের জন্য ওর কখন কী দরকার সে কথা কক্ষনও জানায় না, কক্ষনও ব্যথার কথা বা অসুখের কথা বলে না, খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে কোনও বাছবিচার বা লোভ নেই। এত কম বয়সে এই সংযম। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শিখল কবে? অথচ মুখোনি কচি ছেলেমানুষিতে ভরা। নিজের চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই হয়তো প্রভাসকুমার এই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করে ফেললেন।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সূর্যর বিছানা থেকে অল্প দূরে চেয়ার নিয়ে বসে প্রভাসকুমার জিজ্ঞেস করলেন, আজ কেমন আছ, বড়কুটুম?

সুর্য মুখ ফিরিয়ে বলল, ভালো।

তোমার চোখদুটো ক’দিন ধরে বড় লালচে ছিল, আজ অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

সূর্য হাতের তালু দিয়ে চোখ কচলাল।

প্রভাসকুমার আবার বললেন, কাল রাত্তিরে খুব বৃষ্টি হয়েছিল, টের পেয়েছিলে?

হুঁ।

আজ আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। তুমি কি উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসবে? তুলে দেব?

না, ঠিক আছে।

উঠে বোসো না–বাইরেটা দেখতে পাবে। ভালো লাগবে।

প্রভাসকুমারের সাহায্য না নিয়ে সূর্য নিজেই একটু উঁচু হয়ে উঠে বসল। প্রভাসকুমার জানলাগুলো খুলে দিলেন। জানলার কাছে পঁড়িয়েই বললেন, শহরের অবস্থা এখন অনেক শান্ত। দোকানপাট সব খুলেছে। আচ্ছা, সেদিন যে এখানে একটি ছেলে খুন হয়েছিল, সে কি তোমার চেনা?

সূর্য সংক্ষিপ্ত ভাবে বলল, আমরা একসঙ্গে ছিলাম।

আঃ, ছি ছি ছি, এই রকম ভাবে কেউ প্রাণ দেয়? পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়েছিলে?

না, আমরা দুজনে সাধারণ ভাবেই হেঁটে আসছিলাম। হঠাৎ একটা ভুল হয়ে গেল।

তা হলে তুমিও সে-দিন মরে যেতে পারতে?

হয়তো। একটু হলেই মরে যেতে পারতাম, অথচ মরলাম না–এই ফিলিংটা কী রকম?

আমার শরীর সুস্থ থাকলে সেটা ভালো করে বুঝতে পারতাম।

আমি মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখেছি কিন্তু কখনও মৃত্যুকে খুব কাছাকাছি দেখিনি– কখনও বড় রকমের অসুখও হয়নি আমার। রবীন্দ্রনাথও যে লিখেছেন, ‘মরণ রে উঁহু মম শ্যাম সমান’–সেটা কি নিজের মৃত্যুবোধ নিয়ে, না অন্য কারওর মৃত্যু দেখে? নিজে কি তখন মৃত্যুর সামনাসামনি গিয়েছিলেন? অবশ্য, অনুভূতির জগতে মৃত্যুর একটা উপস্থিতি সব সময়েই টের পাওয়া যায়। মানুষ বাঁচতে ভালোবাসে বলেই মৃত্যুর কথা এত বেশি ভাবে! তাই না?

সূর্য চুপ করে রইল।

প্রভাসকুমার চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন। তারপর আন্তরিক ভাবে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, সূর্যবাবু, আমাকে একটা কথার উত্তর দিতে পারো? মানুষের প্রাণ তার নিজের কাছে সবচেয়ে প্রিয়, তবু কেন অনেক মানুষ প্রাণ তুচ্ছ করে কোনও কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে?

প্রভাসকুমার সূর্যর চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন, তাকে উত্তর দিতেই হবে। সূর্য আস্তে আস্তে বলল, আমি তো সব মানুষের কথা জানি না। আমি শুধু নিজের কথা জানি।

তোমার নিজের কথাই বলো তো। যে-কোনও সময়েই মরে যেতে পারতে? তা জেনেও…তুমি কি মরতে চাও?

না।

তা হলে?

আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে আমি শেষ পর্যন্ত মরব না।

এ রকম বিশ্বাস থাকার কোনও মানে হয়? এটা তো গোঁয়ারতুমি!

আমি মরে গেলেও কোনও ক্ষতি ছিল না।

অন্য কারওর কোনও ক্ষতি না থাক, তোমার তো ছিল। জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি–

আমি তা ভাবিনি।

আচ্ছা, আর একটা কথা। এটারও আমি কোনও উত্তর খুঁজে পাই না। আমাদের দেশে প্রায় আটত্রিশ কোটি মানুষ। এদের মধ্যে মাত্র কয়েকশো জন তোমাদের মতন এ রকম প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আটত্রিশ কোটির মধ্যে শুধু এই কয়েকশো জনের মধ্যেই এ রকম প্রেরণা জাগল কী করে? কে এদের মাথার দিব্যি দিয়েছে? এটা একটা বড় প্রশ্ন নয়?

কারোকে না কারোকে তো এগিয়ে আসতেই হবে।

সেটা না হয় মানলাম। কিন্তু আটত্রিশ কোটির মধ্যে তোমাদের মতন শুধু ক’জনের মধ্যেই এই চিন্তাটা জাগল কী করে? এর ব্যাকগ্রাউন্ড কী? তোমার বয়সি তো আরও কত ছেলে আছে, খাচ্ছেদাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে! লক্ষ লক্ষ লোক যে সম্পর্কে কিছু ভাবে না–হঠাৎ এক এক জন আলাদা হয়ে যায়। এর ব্যাখ্যা কী?

আমি জানি না।

তুমিও এদের মধ্যে একজন। তুমি এটা ভেবে দেখোনি?

এ দেশের আটত্রিশ কোটি লোকই তো আর কবিতা লেখে না। শুধু আপনার মতন কয়েকশো জন লোকই লেখে। এর ব্যাখা কী?

প্রভাসকুমার চমকে উঠলেন। চিন্তিত ভাবে বললেন, ঠিক, এ রকম ভাবে তো ভেবে দেখিনি। কবিতা লেখার মতন এটাও একটা ইনসপিরেশান বলতে চাও? এটা একটা মুট পয়েন্ট, আমি স্বীকার করতে বাধ্য। হু, ইনসপিরেশান! ইনসপিরেশান ছাড়া কোনও বড় কাজ হয় না। তবে কবিতা লেখার চেয়েও প্রাণ দেওয়া অনেক শক্তসুতরাং তোমাদের ইনসপিরেশান নিশ্চয়ই খুব তীব্র।

আমি ইনসপিরেশান মানি না।

বিস্মিত হয়ে প্রভাসকুমার বললেন, মানো না! তুমি তো নিজেই বললে, যে চোজেন ফিউ এসব কাজে–

আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম ছিল। আমি হঠাৎ এমন কয়েক জন লোকের কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিলাম, যাঁরা এই ধরনের কাজে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের দেখে আমার ভালো লেগেছিল, আমি তাদের শ্রদ্ধা করতাম। সুতরাং তাদের দলে মিশে কাজ করতে আমার ভালো লাগত। আমার কাছে এটা ভালো লাগা না লাগার প্রশ্ন।

তোমার সঙ্গে হঠাৎ ওদের যোগাযোগ হয়েছিল?

হ্যাঁ।

হঠাৎ হঠাৎ অনেকের সঙ্গেই অনেকের দেখা হয়। সবাইকে তো আর ভালো লাগে! তোমার মধ্যে এর বীজ আগে থেকে ছিলই।

হতে পারে?

ডু ইউ রিগ্রেট নাই?

নেভার!

এই ভালো লাগা না লাগার ব্যাপারটাই সবচেয়ে বড়। অনেক মানুষ, অধিকাংশ মানুষই, যা ভালো লাগে, তার জন্য অন্য সবকিছু ছাড়তে পারে না। যত সব মানুষ সমাজ সংসার সব মেনে ঘর গেরস্থালি করছে তাদের সবারই কি এটা ভালো লাগে? তাদের অন্য কিছু করার সাহস নেই। তোমার বা আমার মতো লোক আমরা অন্য সবকিছু ছাড়তে পেরেছি। তুমি লড়াই করতে গেছ, আমি আর কিছু না করে কবিতা লিখছি। অন্যেরা এটা ভালো চোখে দেখে না–আসলে তারা ভয় পায় কিংবা হিংসে করে।

আমি কবিতা বুঝতে পারি না।

আমি বোমা-পিস্তলের লড়াই বুঝতে পারি না। কিন্তু তুমি যে আমার বাড়িতে এসেছ, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছি–এটা আমার সৌভাগ্য। আমার বিয়ের সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি–

লেবুর রস ও নুন মেশানো বার্লির বাটি হাতে নিয়ে শ্রীলেখা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সূর্যকে এত কথা বলতে দেখে সে একটু অবাক হয়েছিল, কারণ সে নিজে এ ক’দিনে অনেক চেষ্টা করেও সূর্যর মুখ থেকে কোনও কথা বার করতে পারেনি। কিন্তু সে এখন এগিয়ে এসে স্বামীকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল, তুমি ওকে দিয়ে কথা বলাচ্ছ কেন? ডাক্তারকাকা বারণ করেছেন না?

প্রভাসকুমার থতমত খেয়ে বললেন, আহা, দিনের-পর-দিন কথা না বলে কি মানুষ থাকতে পারে?

থাক, যথেষ্ট হয়েছে। এটা খেয়ে নিয়ে এখন ঘুমোক।

শ্রীলেখা সূর্যর মুখের সামনে বাটিটা ধরল। প্রভাসকুমার ব্যস্ত হয়ে বললেন, বুকের কাছে তোয়ালেটা জড়িয়ে দাও। পড়ে যায় যদি।

নিজেই এসে তোয়ালেটা জড়িয়ে দিলেন। স্বামী-স্ত্রী যত্ন করে খাওয়াতে লাগল ওকে। সূর্য সুবোধ বালকের মতো তাড়াতাড়ি এক চুমুকে শেষ করে ফেলল বার্লিটুকু। মুখের স্বাদ বদলাবার জন্য শ্রীলেখা এলাচ এনেছে, তার কয়েকটা দানা মুখে দিয়ে সূর্য চোখ বুজল। শ্রীলেখা যত্ন করে চাদর টেনে দিল তার গায়ে। সূর্যর মুখে যাতে রোদ না পড়ে সেই জন্য প্রভাসকুমার ভেজিয়ে দিলেন জানলার একটা পাল্লা। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন।

আস্তে আস্তে সূর্যর শরীরের জোর ফিরে আসছে, সে এখন নিজে নিজেই বিছানা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে একটু একটু ঘোরে, জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েও সে তার ভবিষ্যত দেখতে পায় না। চারখানা সাদা দেওয়ালের মধ্যে সে বেশ কয়েক দিন আটকে আছে। সাদা দেওয়াল কোনও কথার উত্তর দেয় না। এখন জানলার বাইরে তাকিয়েও সে প্রকৃতি দেখতে চায় না, সে বাইরের জগৎ থেকে কোনও ডাকের জন্য অপেক্ষা করে। সে জানে না, এরপর সে কী করবে। এই ক’মাসে তার ধারণা ছিল, একটা কোথাও পৌঁছোতে হবে। এখন আর তার সামনে কোনও রাস্তা নেই। সূর্য স্থির চোখে রোদে ঝকমক রেললাইনের দিকে চেয়ে থাকে।

প্রভাসকুমার বড়বাবুকে টেলিগ্রাম করেছিলেন সূর্যকে না জানিয়ে। কোনও উত্তর আসেনি। শ্রীলেখা কিছু দিন আগে তার মায়ের কাছ থেকে চিঠিতে জেনেছিল যে বড়বাবু কয়েক দিনের জন্য কোথায় যেন বেড়াতে গেছেন।

প্রভাসকুমারের ইচ্ছে, সূর্যকে বিদেশে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হোক। বিদেশে কোথাও দু-চার বছর থাকলে পুলিশের কোপ কমে যাবে–ইতিমধ্যে সূর্য পড়াশুনোও চালাতে পারবে। সন্দেহজনক কার্যকলাপে লিপ্ত লোকদের বেঁচে থাকার এইটাই সহজ রাস্তা। যুদ্ধের জন্য প্যাসেঞ্জার লাইনগুলিই বন্ধ হয়ে গেছে, তবু কোনও রকমে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভারত মহাসাগর এখনও মোটামুটি নিরুপদ্রব আছে।

সূর্য এই প্রস্তাব শুনে হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলেনি। শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে থেকেছে। সে কোনও কিছুতেই উৎসাহ বোধ করে না। যোগানন্দর মৃত্যু তার বুকের মধ্যে খুব জোর নাড়া দিয়ে গেছে।

সূর্যকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল তিনতলার একটা ঘরে। এ-দিন দেখা গেল একতলার সিঁড়ির কাছে সে দেওয়াল ধরে হাঁপাচ্ছে। তখনও সিঁড়িভাঙার সামর্থ্য তার। হয়নি। শ্রীলেখা তাকে দেখতে পেয়ে দারুণ অবাক হয়ে বলল, এ কী, কোথায় যাচ্ছ?

চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখ করে সূর্য বলল, একটু বাগানে বেড়াতে যাচ্ছিলাম।

বাগানে? এই সন্ধেবেলা? বাঃ, আমাকে বলোনি কেন? তুমি একলা একলা এতখানি সিঁড়ি ভেঙে নামলে? চলো, ঘরে চলো, এখন আর তোমাকে বাগানে যেতে হবে না, হিম পড়ছে।

সূর্য আর আপত্তি করল না, শান্ত ছেলের মতন ফিরে গেল শ্রীলেখার সঙ্গে।

পরদিন সন্ধ্যাবেলা সূর্য একলা একলা বাগানের গেট পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, একজন চাকর দেখতে পেয়ে খবর দিল প্রভাসকুমারকে। প্রভাসকুমার নিজেই দৌড়ে এসে তার হাত চেপে ধরে বলল, এ কী, কোথায় যাচ্ছ সূর্যবাবু?

সূর্য নিষ্প্রাণ গলায় বলল, কোথাও না।

একলা একলা এতদূর চলে এসেছ? ডাক্তার তোমাকে ঘর থেকেই বেরোতে বারণ করেছেন।

এমনিই একটু ঘুরে আসছিলাম।

এই সময়? তোমার কিছু দরকার টরকার আছে? কিছু কিনে আনতে হবে? আমাকে বলোনি কেন? শোনো, যদি সিগারেট টিগারেট খাও তো–

না কিছু না।

আরও দু’বার সূর্য এবাড়ি থেকে কারোকে কিছু না বলে চলে যাবার চেষ্টা করেছিল, দু’বারই ধরা পড়ে যায়। শ্রীলেখা পাখির মতন তীক্ষ্ণ চোখে তার ওপর নজর রেখেছে। ধরা পড়ার পর সূর্য আর কোনও উচ্চবাচ্য করে না, নিরীহ ভাবে ফিরে আসে। তার এই ব্যবহারের কোনও মানে বোঝা যায় না।

বাড়িতে আস্তে আস্তে মানুষজন আসতে শুরু করেছে। আর দিন দশেক বাদেই দুর্গা পূজা। এ বাড়িতে খুব ধুমধাম করে দুর্গা পূজা হয়। শ্রীলেখা তাই একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, সব সময় সূর্যর কাছে আসতে পারে না–কিন্তু সেবা শুশ্রষার কোনও ত্রুটি নেই।

সে-দিন রাত সাড়ে ন’টার সময় সূর্যর ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল শ্রীলেখা। সূর্য চোখ বুজে শুয়ে আছে। শ্রীলেখা তার শিয়রের পাশে বসে চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বলল, তুমি ঘুমিয়েছ?

সূর্য চোখ না মেলেই বলল, না।

এর মধ্যেই বাড়ির অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। শহরও এখন প্রায় অর্ধসুপ্ত। ঝমঝমিয়ে একটা মেল ট্রেন চলে গেল এইমাত্র। ট্রেন যাবার সময় মনে হয় যেন এই বাড়িটা কাপে। মনে হয় শুধু, আসলে কঁপে।

শ্রীলেখা আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার শরীর আজ কেমন?

ভালো।

তোমার কী হয়েছে বলো তো?

কিছু হয়নি।

তুমি চলে যেতে চাইছ কেন?

আমার আর ভালো লাগছে না।

কেন ভালো লাগছে না? তোমার কিছু অসুবিধে হচ্ছে?

না, সে-সব কিছু নয়।

শ্রীলেখার চুলগুলো খোলা, কালো রঙের শাড়ি পরে আছে। মুখখানা অনেকটা ঝুঁকিয়ে বলল, সূর্যদা, লক্ষ্মীটি, আমার দিকে একবার তাকাও। আমার সঙ্গে একটু কথাও বলবে না? তোমার কী হয়েছে সত্যি করে বলো তো?

সূর্য মুখ তুলে শ্রীলেখার দিকে তাকাল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর চিবুক উঁচু করে শূন্যে চোখ মেলে বলল, আমি এ রকম ভাবে তোর এখানে আসতে চাইনি।

শ্রীলেখা ব্যাকুল ভাবে বলল, সূর্যদা, সত্যি করে বলো তো, তোমাকে এ বাড়িতে কেউ কিছু বলেছে?

না। কে কী বলবে? প্রভাসবাবু খুব ভালো লোক। ওঁকে আমার ভালো লাগে। সেসব কিছু নয়। এই অসুখটা আমাকে বড় কাবু করে ফেলেছিল। এই রকম একা একা শুয়ে থাকা আমার পোষায় না।

সূর্য বিছানায় উঠে বসে বলল, এখন আমি অনায়াসে হাঁটা-চলা করতে পারি।

শ্রীলেখা সূর্যর দু’কঁধ চেপে ধরে বলল, সূর্যদা, তুমি কি আমার ওপর এখনও রেগে আছ?

না তো!

তুমি আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে চাও না কেন?

বাঃ রাগ করব কেন, রাগের কী আছে?

এটাও রাগের কথা।

না রে।

সত্যি করে বলল, আমার চোখের দিকে চেয়ে বলো।

সত্যি কথাই বলছি। একসময় ভীষণ একটা রাগ ছিল, ভেবেছিলাম, তোর সংসারের সবকিছু ভেঙেচুরে দেব। তোকে কিছুতেই শান্তি দেব না! কিন্তু অনেক রাস্তা ঘুরে ঘুরে এলাম তো। আসতে আসতে রাগ কমে গেছে। এখন বুঝতে পারি, আমি মিথ্যেই রাগ করেছিলাম। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে মানুষ অনেক কিছুই শেখে। তখন বোঝা যায় বেঁচে থাকা কাকে বলে। আমার এখন গায়ে জোর নেই, তাই বুঝতে পারছি, গায়ের জোরে কিছুই সত্যিকারের পাওয়া যায় না।

তোমার শরীর আবার শিগগিরই ভালো হয়ে যাবে।

তখন আবার আগের মতন ভুল করব না।

আমি কিন্তু জানতাম, তুমি একদিন না একদিন আমার কাছে আসবেই।

এরকম অসহায় অবস্থায় না-আসাই উচিত ছিল।

তোমাকে কেউ অসহায় মনে করে না। তোমাকে দেখলে সবাই একটু একটু ভয় পায়।

কাল সারা রাত আমার ঘুম আসেনি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, আমার একটা কিছু করা দরকার।

কাল আমারও বার বার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, তুমি জেগে আছ। একবার ভেবেছিলাম তোমার কাছে চলে আসি–

এলি না কেন?

অন্য কেউ হলে হয়তো আসতাম। তুমি বলেই আসতে পারলাম না। কয়েক মাস ওর এক মামাতো ভাই এখানে এসে খুব অসুখে পড়েছিল–আমি সারা রাত ধরে তার পাশে থেকেছি। আর তুমি আমার দাদা, তোমার কাছে তো আসতেই পারি। কিন্তু কেন যে আমার ভীষণ লজ্জা হল।

আজ এখন কত রাত?

খুব বেশি রাত হয়নি।

সূর্য নিজের কাধ থেকে শ্রীলেখার হাত সরিয়ে দিয়ে আস্তে শুয়ে পড়ল আবার। মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে, তুই এখন যা।

শ্রীলেখা গেল না। একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর সূর্যর গালে আঙুল ছুঁইয়ে খুব নরম, প্রায় অশ্রুত গলায় বলল, সূর্যদা, তুমি আর আমাকে একটুও ভালোবাসো না, না?

কী জানি!

আমি জানি, তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না। আমারই দোষ।

কেন?

আমার বিয়ের পর প্রথম প্রথম আমার খুব কষ্ট হত। সেই সঙ্গে ভয়ও ছিল। আমি ভয় পেতাম, কোনদিন তুমি এখানে এসে হাজির হবে, চাচামেচি করবে, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে। সে রকম একটা কিছু হলে আমি কোথায় যেতাম, কী যে করতাম– কিছুই ভেবে পাইনি। কিন্তু তুমি এলে না। এক সপ্তাহ, দু’সপ্তাহ, এক মাস, দু’ মাস– তুমি এলে না, এলে না। তখন আমার কী হল জানো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম, ভীষণ ভাবে প্রতীক্ষাসব সময় যেন তোমাকে দেখতে পেতাম। আমি জানতাম তুমি আসবেই, আমার প্রতীক্ষাই তোমাকে টেনে আনবে। একদিন আমাদের বাগানের আতাগাছে একটা পাখি বসে ইস্টকুটুম, ইস্টকুটুম বলে ডাকতে লাগল। ওই পাখি ডাকলে নাকি বাড়িতে অতিথি আসে। সেদিন আমি সারা দিন আর অনেক রাত পর্যন্ত গেটের দিকে চেয়ে বসে ছিলাম।

শ্রীলেখা সূর্যর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ।

তারপর শ্রীলেখা জিজ্ঞেস করল, তোমার বুকে আজ একবারও ব্যথা হয়েছিল?

সূর্য বলল, না। এখন খুব ভালো লাগছে।

সত্যি ভালো লাগছে?

ভীষণ, ভীষণ ভালো লাগছে। তোকে বোঝাতে পারব না।

এ কথা বলা সত্ত্বেও সূর্য শ্রীলেখার হাত সরিয়ে দিল। নেমে পড়ল বিছানা থেকে। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে তাকাল বাইরের পৃথিবীর দিকে। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। দূরের গাছগুলোকে ধূসর বর্ণ দেখায়, মনে হয় অন্য কোনও গ্রহ।

সূর্য সেই দিকেই মুখ ফিরিয়ে বলল, আমি অনেক কিছু জানি না, অনেক কিছুই শিখিনি। আগে জানতাম না, পৃথিবীতে কত রকম ভালোলাগা আছে। কিন্তু আমি কি এসব পাবার যোগ্য?

শ্রীলেখা বলল, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা লাগিয়ো না।

তুই, এবার শুতে যা।

যাচ্ছি, তুমি আগে শুয়ে পড়ো। আমি তোমার বুকে হাত বুলিয়ে দিই– সূর্য জানলার কাছ থেকে সরে গেল। অন্ধকারে তার মুখ এখন আর দেখা যায় না। অদৃশ্য মানুষের মতন সে ধমকের সুরে বলল, তোকে চলে যেতে বলছি না! আমার কি মাথার ঠিক আছে? এত সুখ কি আমার সহ্য হয়? আমি আর কিছু ভাঙতে চাই না। আমাকে এখান থেকে চলে যেতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *