জুম্মাঘরে কুদুস মৌলবির মিলাদ পড়াবার পর মাঝিদের হাতে হাতে বাতাসা। এর ওপর তহসেন দারোগা টাউন থেকে নিয়ে এসেছে ঘিয়ে-ভাজা জিলাপি। মিলাদে এতো এতো তবাররক পেয়ে মুখ ভরে সেসব চিবোতে চিবোতে মাঝিরা বিলের ধার ধরে দাঁড়ায় সার করে। বুধা মাঝি কেরামত আলির তিন বছর আগের গানটা ধরলে সবাই খুব হৈ চৈ করে। ওঠে এবং বুধার ভুলভাল কথার সঙ্গে কেউ কেউ বেসুরো গলা মেলায়। মুখ ভার শুধু আবিতনের বাপের। ধরা গলায় সে আক্ষেপ করে, হামার লাতিটা এটি মরিছিলো গো! ও মুনসি, আপনে তার জন্যে দোয়া করেন। মিলাদের শেষে অবশ্য তমিজের বাপের জন্যে কুদুস মৌলবি দোয়া করেছে, আবিতনের ছেলের কথাটা তাকে কেউ মনে করিয়ে দেয় নি। এখন সে হাত তুলে পরওয়ার দিগারের দরবারে মাসুম শিশুটির জন্যে দোয়া করে। তবে ঐ স্মৃতি ঘটতে মাঝিদের উৎসাহ নাই। এমন কি চোরাবালির ধারে তমিজের বাপের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম জালটা ফেলার জন্যে কালাম মাঝির প্রস্তাবটিও অগ্রাহ্য করে তারই ছেলে তহসেন, না না। আজ ওখানে যাবার দরকার কী? ইটখোলায় একটা ঝামেলা করে লাভ নাই।
তবে ফকিরের ঘাটে কালাম মাঝি প্রথম জালটা ফেলায় তমিজকে দিয়ে, হাজার হলেও কোন বাপের বেটা সেটা দেখা লাগে। আবার বাঘাড় মাঝির লাতির বেটা তো, এর পরদাদার দোয়া লিয়া কাম শুরু করলে বরকত হবি।
বৈশাখ মাসে তমিজের হাতে কৈ জাল দেখে অনেকেই ঠাট্টা করছিলো। বিলে পানি কম, এখন ওই জাল দিয়ে সে করবেটা কী। কিন্তু বাঘাড় মাঝির ওয়ারিশের হাতে ওই জালে ঠিকই ধরা পড়ে বারোটা কৈ মাছ, তার নয়টাই পাকা কৈ। সেগুলোর লালচে আভা লাগে তমিজের কালো গালে।
অবশ্য তার জালে মাছ পড়তে পড়তে আবিতনের বাপের তৌড়া জালে ধরা পড়েছে। রুই কাতলের মাঝারি আকারের কয়েকটা বাচ্চা। বেশিরভাগ মাঝির জালে কিছু না কিছু মাছ উঠলোই। যাদের তেমন কিছুই ওঠে না, তারা পলো দিয়ে, বড়শি দিয়ে পুঁটি, খলসে, ট্যাংরা, এমন কি ছোটো পাবদা পর্যন্ত ধরে। পাকুড়গাছশূন্য পাকুড়তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছিলো মাঝিরা। কিন্তু তহসেন তাদের থামিয়ে দেয়, আজ ওদিকটা থাক।
দুপুরবেলা শেষ হতে না হতে কালাম মাঝির ভাগ্নে বুধা মাঝি সবাইকে বলে, এখন তোমরা থামো গো। আর মাছ ধরা হবি না। কালাম মাঝির বাড়ির ঘাটে নতুন আমগাছের নিচে কয়েকটা কলাপাতা পেতে বুধা জোরে হাঁক দেয়, এটি সোগলি মাছ দিয়া যাও। যা ধরিছো তার ছয় আনা করা মাছ ঢালো।
মাছ ধরার উৎসাহে মাঝিরা এই আহ্বান কানে তোলে না। কিন্তু বুধার ডাকটি বারবার শুনে এবং তাতে হুকুমের স্বর পেয়ে সেদিকে তাদের মন দিতেই হয়। মাছ ধরলো, এখন আবার মাছ দিতে হবে কাকে?
আবিতনের বাপ বুধাকে ওংকা চিক্কুর পাড়িস কিসক রে? জিগ্যেস করে নিজেই খুব জোরে চিৎকার করে।
কালাম মাঝি এতোক্ষণ এদের সঙ্গেই ছিলো। একটু আগে সে বাড়ির ভেতরে গিয়েছিলো। এখন ফিরে এসে বলে, বাপু, আজ মাঝিগোরে বিল ফেরত পাবার পয়লা দিন। খাজনা টাজনা কিছু লাগবি না। মাছ যা ধরিছো তার ছয় আনা, না হয় চার আনা, কিছু না হলে অন্তত দুই আনা ভাগ হামাক দিয়া যাও।
তিন বছর আগে এই বিলে মণ্ডলের অধিকার অগ্রাহ্য করে জাল ফেলার কথা মনে পড়ে আবিতনের বাপের। নাতির জন্যে তার শোক খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা কারো কাছে আমল না পাওয়ায় সে শোধ নিতে চায় এইভাবে, শালা মাঝিগোরে আবার খাজনা দেওয়া কী? মাঝির আবার খাজনা লিবি কেটা রে?
নুলা ভিকুর পাঁচটা ট্যাংরার দুটোই যদি দিতে হয় তো তার আর থাকে কী? সে নিম সমর্থন করে আবিতনের বাপকে, খাজনা কিসের গো? কালাম মিয়া না কলো, মাঝিগোরে। বিল মাঝিরাই মাছ ধরবি? তো এখনো মণ্ডলেক পয়সা দিয়া মাছ ধরা লাগবি?
ফকিরের ঘাটে শ্যাওড়া গাছের নিচে জমায়েত মাঝিদের সবাই এই নিয়ে চঁচামেচি শুরু করলে ঠিক কে কোনটা বলছে বোঝো কঠিন হয়ে পড়ে।
মণ্ডল বিল পত্তন লিছিলো লায়েবেক ঘুষ দিয়া। শালা লায়েব তো শুনি ভাগিছে। কিসের লায়েব, কিসের পত্তন?
লায়েব? আরে পাকিস্তানে জমিদারিই থাকিচ্ছে না। কিসের জমিদার? তার আবার পত্তন দেওয়ার ক্ষমতা আছে নাকি?
পাকিস্তানেত আবার জমিদার আর লায়েবেক পোঁছে কেটা?
এর মধ্যে চলে আসে তহসেন দারোগা। লুঙিপরা আর খালি পায়ে থাকলেও তার হাতে ঘড়ি, সাদা শার্টের পকেটে সিগ্রেটের প্যাকেট। গলা এতোটুকু উঁচু না করে সবাইকে সে বোঝায়, বাবা এই বিল ইজারা নিয়েছে। বিলের মালিকানা–
কালাম মাঝি তাড়াতাড়ি তাকে থামায়, রাখো, হামি কই। শোনো, বিল তো হামি ইজারা লিছি। দস্তুরমতো টাকাপয়সা খরচ করা ইজারা লিছি এই বৈশাখ মাস থ্যাকা। মণ্ডলের কবজা থ্যাকা বিল খালাস করতে হামার খরচ তো কম হয় নাই বাপু। হামাক খাজনা না দিলে হামার চলবি ক্যাংকা করা?
আবিতনের বাপ বলে, সেই পয়সা না হয় আমরা সোগলি মিল্যা তুল্যা দেই। তো খাজনা চাও কিসক? খাজনা হলে তো এই বিলেত জাল ফেলালেই টাকা দেওয়া লাগবি। না কী?
তহসেন এবার এদের মূখতায় বিরক্ত হয়, অতো কথা কিসের? বিল তো বাবা ইজারা নিয়েছে। রীতিমতো দুই বছরের টাকা জমা দিয়ে ইজারা নেওয়া হলো। এখন খাজনা না দিয়ে বাবা কাউকে মাছ ধরতে দেবে কেন?
তহসেনের কথায় কালাম মাঝির অস্বস্তি হলেও ছেলের ন্যায্য কথা সে অনুমোদন। করে। তবে তহসেনের দারোগাগিরি এখানে করাটা ঠিক নয়। মাঝির জাত বড়ো তঁাদোড়। কোন কথায় যে কী করে বসে তার ঠিক নাই। তমিজকে হাত করলে সেই বরং সবাইকে বুঝিয়ে বলতে পারবে। তাকে একটু সরিয়ে নিয়ে কালাম মাঝি ফিসফিস করে বলে, তমিজ, দেখ তো ভাই ইগলান কী কচ্ছে? তুই একটু ভালো করা বুঝায়া দে না বাপু!
তমিজ মাঝিদের বোঝাবে কী, সে তো নিজইে ধন্দে পড়েছে। মণ্ডলের ইজারার মেয়াদ শেষ, এখন এই বৈশাখ থেকে বিল তো ফিরে আসবে মাঝিদের হাতে। তা হলে খাজনা দিতে হবে কাকে? সে জিগ্যেস করে, বিল তো মাঝিগোরে হাতেত ফির্যা আসিছে। না কী?
আসে নাই? আসে নাই? কালাম মাঝি গলা চড়ায়, হামি মাঝি লই? হামার বাপদাদা চোদ্দ পুরুষ মাঝি আছিলো না? তোরা মাঝি লোস? তোরা হামার রক্তের আত্মীয় লোস? তা হামার নামে বিল পত্তন লিছি। তা হলে বিল কি মাঝির কাছে আসলো না?
বাপকে থামিয়ে তহসেন বলে, সম্পত্তি তো কারো না কারো নামেই থাকতে হয়। তো বাবা এটা দুই বছরের জন্যে কিনে নিয়েছে। সামনের বার আপনারা কেউ নেবেন। এখন যে মাছ ধরলেন তার সামান্য একটা ভাগ এখানে দিয়ে যান। এর পর থেকে মাছ ধরতে হলে খাজনা দিয়ে জাল ফেলবেন। একটু তাড়াতাড়ি করেন। খালি খালি ঝামেলা করে লাভ কী?
তার শুদ্ধ কথা ও বলার ভঙ্গিতে মাঝিরা একটু থমকে যায়। কয়েক মিনিট কেউ কথা বলে না। তহসেন হাতের ছাতাটা খুললো। আবিতনের বাপ হঠাৎ সামনে এসে তার খলুই উপুড় করে দেয় কলাপাতার ওপর। কালাম মাঝি বলে, বামাক মাছ দাও কিসক? তোমার ভাগ তুমি লিয়া যাও। আবিতনের বাপ শোনে না, হনহন করে চলে যায় নিজের বাড়ির দিকে। কালাম মাঝি ফের ডাকে, ও আবিতনের বাপ। আবিতনের বাপ ফিরে তাকায় না। আরো দুই তিনজন মাঝি মাছের ভাগ দিয়ে গেলেও হঠাৎ ঝড়ের আভাস পেয়ে কিংবা এর সুযোগ নিয়ে খলুই ও জাল নিয়ে আর সবাই হাঁটা দেয় নিজের নিজের ঘরের দিকে। ছোটো ছেলেদের সবাই হঠাৎ করে দৌড় দেয়, তাদের অন্তত দুইজন আছাড় খেয়ে পড়লে খলুইয়ের মাছ পড়ে যায় মাটিতে। তমিজ কী করবে, মাছ ঢেলে দেবে কি-না, এই নিয়ে দোনোমননা করতে করতে ঝড় শুরু হয়ে যায়, সেও ছুট দেয় নিজের ঘরের দিকে।
এর মধ্যে ঝড় শুরু হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। কালাম মাঝির ঘরের বারান্দা থেকে তহসেনের চিৎকার শোনা যায়, বুধা, কে কে মাছ দিয়ে গেলো সেই হিসাব রাখলি না কেন? পরে যখনি কেউ মাছ ধরতে আসে, হিসাব করে আজকের পাওনা আদায় করা হবে
কুলসুমের ঘরে মাটির একটা হাঁড়িতে কৈ মাছগুলো পনিতে জিইয়ে রাখতে রাখতে তমিজ বলে, কাল শলুক দিয়া নাউ দিয়া পাক করো। পাকা কৈ!
এর মধ্যে ঝড়ের পর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সোঁদা সোঁদা গন্ধে মাথা ভরে যায়, এই গন্ধে আবার খিদেও লাগে। কিন্তু এখন তমিজের যাওয়া দরকার হুরমতুল্লার জমিতে। এমন সুন্দর বৃষ্টি হলো, এখনো সন্ধ্যা হয় নাই, মোষের দিঘির ঢালে জমিটায় একটা চাষ দেওয়া যায়।
কুলসুম বলে, এখন আবার জমিত যাবা? ভাত খায়া যাও।
বিলে যাবার আগে ঘরে বসে কড়কড়া ভাত খেয়েই বেরিয়েছিলো, গরম ভাতের লোভে তমিজ ফের বসে পড়ে।
খেয়ে উঠে মাটির হাঁড়ি থেকে বেছে বেছে পাঁচটা মাছ খলুইতে তুলে তমিজ রওয়ানা হলে কুলসুম বলে, মাছ কয়টা কুটি লেও?
পাঁচটা মাছ কালাম মাঝিক খাজনা দেওয়া লাগবি। বলেই সে মিথ্যা কথাটা শোধরায়, কিসের খাজনা? অর বাপের সম্পত্তি নাকি? খাজনা দেওয়া লাগবি কিসক? এইসব ঝাঝালো কথা বলে বলে তমিজ খাজনা না দেওয়ার সিন্ধান্তটি পাকা করে। তারপর বলে, দেখি, পরামাণিক বুড়া একদিন কৈ মাছ খাওয়ার হাউস করিছিলো। লাজুক খুশিতে সারা মুখ তার হালকা কালো আলোতে চুবিয়ে নিয়ে তমিজ বেরিয়ে পড়ে।