৪৪. কৃষ্ণভামিনীর মিতেনীর শ্বশুরালয়

হাটখোলায় কৃষ্ণভামিনীর মিতেনীর শ্বশুরালয়টি তেমন বুনিয়াদী নয়। মাত্র দু পুরুষে ধনী। অনেকেই এখনও বলে যে জগাই মল্লিক নাকি চিত্তেশ্বরীর মন্দিরের সামনে বসে ফুটকড়াই বেচিতো। জগাই মল্লিকের আদি নিবাস ছিল পেনেটিতে। বৃদ্ধ বয়সে দেবী চিত্তেশ্বরী তাঁকে স্বপ্নে গুপ্তধনের সন্ধান দেন এবং তিনি এক পানা পুকুরের মাঝখানে ড়ুব দিয়ে এক সোনার ঘড়া ভর্তি মোহর পেয়ে যান। অবশ্য কেউ কেউ অন্য কাহিনীও বলে। এক ডাকাইত নাকি সেপাইদের তাড়া খেয়ে জগাই মল্লিকের বসতবাটিতে এসে রাত্রে আশ্রয় নেয়। পরদিন সকালেই সে ডাকাইতকে সেপাইয়ের বদলে ধরে ফেলে মারাত্মক বিসূচিকা রোগে এবং সন্ধের আগেই সে মারা যায়। রাতারাতি সেই শবদেহ দাহ করে জগাই মল্লিক সে দস্যুর ধনরত্ন নিয়ে পেনোটি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নেন। কলকাতায়। প্রথম পক্ষের স্ত্রী-পুত্রদেরও পরিত্যাগ করে তিনি দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন। এখানে। এই দ্বিতীয় কাহিনীর সত্যাসত্য ঠিক নিধারণ করা যায় না। তবে কলকাতার অধিকাংশ ধনীরই ভাগ্য পরিবর্তনের ব্যাপারে দু রকম কাহিনী প্রচলিত থাকে। সে যাই হোক, জগাই মল্লিকের তিন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ চিত্তপ্ৰসাদ বাণিজ্য ব্যাপারে নিদারুণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে অগাধ ধনসম্পদ উপাৰ্জন করেন এবং তিনিই হাটখোলায় এই প্ৰাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণ করেছেন।

চিত্তপ্ৰসাদ দীর্ঘজীবী হননি এবং আকস্মিক মৃত্যুর ফলে বিষয়াদির সুচারু ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি। ভ্ৰাতৃবৎসল চিত্তপ্ৰসাদ সমুদয় সম্পত্তি তিন ভাইয়ের নামেই রেখেছিলেন, কনিষ্ঠ ভ্রাতা চণ্ডিকাপ্রসাদ তখন না-লায়েক বিধায় মধ্যম ভ্ৰাতা কালীপ্রসাদই অগ্রজের মৃত্যুর পর ট্রাস্টের অছি হয়। অতি বৃদ্ধ জগাই মল্লিক এখনো জীবিত, তাঁর সঠিক বয়সের হিসাব কেউ জানে না, তবে তিনি নিজে এক সময় বলতেন যে, যে সময় নবাব সিরাজদৌল্লার ফৌজের সঙ্গে ক্লাইভ সাহেব লড়াই দিয়েছিলেন পলাশীর মাঠে, সেই বৎসর তাঁর জন্ম। সেই হিসাব সঠিক ধরলে জগাই মল্লিকের বয়স এখন ছিয়ানব্বই তো বটেই। গত দশ বৎসর ধরে তিনি সম্পূর্ণ বধির এবং সম্পূর্ণ দন্তহীন হওয়ায় কথা যা বলেন তার কিছুই বোঝা যায় না। তাঁর হাঁটা চলার ক্ষমতা অবশ্য এখনো নষ্ট হয়নি। কয়েক বৎসর আগেও তিনি প্ৰত্যহ অপরাহ্ন পদব্রজে একবার চিত্তেশ্বরীর মন্দিরে গিয়ে প্ৰণাম করে আসতেন, এখন তাঁকে পালকিতে করে ঘুরিয়ে আনা হয়।

সম্পত্তি পরিচালনার ভার হাতে পেয়ে কালীপ্রসাদের মতিগতি সম্পূর্ণ পালটে যায়। দাদার অধীনে তিনি স্বল্পভাষী ও কর্মঠ মানুষ ছিলেন, তাঁর কোনো পৃথক ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়নি, স্বাধীন হবার পর তিনি ব্যবসায়-বাণিজ্যের চেয়েও নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের দিকে বেশী মন দিলেন। কালীপ্রসাদ সমাজে ঘোরাফেরা করে বুঝেছিলেন, অথোপার্জন বা বড় বড় অট্টালিকা হাঁকড়ানোই বড় কথা নয়, তার চেয়েও বড় কথা কৌলিন্য। লোকে কথায় কথায় এখনো বলে, ফুটকড়াই বেচা জগা মল্লিকের ছেলেরা এখন দুটো পয়সার মুখ দেখেচে! কেউ কেউ একথা কালীপ্রসাদের মুখের সামনে বলতেও দ্বিধা করে না।

কালীপ্রসাদ কলকাতার পথেঘাটে টাকা ছড়াতে লাগলেন। আমোদ আহ্লাদ কাকে বলে তিনি দেখিয়ে দিতে চান। পয়সা প্রচুর রোজগার করা গেছে। দু-তিন পুরুষ ধরে খোলামকুচির মতন ছিটোলেও ফুরোবে না, কিন্তু সুনাম অর্জন করতে হবে এই এক পুরুষেই। লোকে যাতে জগাই মল্লিকের কথা একেবারেই ভুলে গিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, হ্যাঁ, বাবু তো বাবু, হাটখোলার কালী মল্লিক! দান-ধ্যানে কালীপ্রসাদ মল্লিক দরাজ দিল, কোথাও ইস্কুল কলেজ খোলা হোক, কালীপ্রসাদ মল্লিকের কাছে সাহায্য চাইতে এসে তারা কখনো বিমুখ হয় না। কালীপ্রসাদ আগে জিজ্ঞেস করেন, অমুক কত দিয়েছে, আর অমুক, আর তমুক? তারপর সর্বোচ্চ দাতার চেয়ে অন্তত এক টাকা বেশী ধরে তিনি সগর্বে বলেন, লিখে নাও! খাজাঞ্চির কাচে যাও, এখুনি টাকা মিলবে, আমার সব নগদানগদি কারবার, ফতোবাবুদের মতন আমি শুধু প্রমিজ করি না। কারুর কন্যাদায়, কারুর বাপের শ্ৰাদ্ধ, একবার কালীপ্রসাদ মল্লিকের কাছে এলেই হলো। আবার চড়কের সময় ছাতুবাবুদের মাঠে ম্যারাপ বেঁধে এক সঙ্গে একশো মেয়েমানুষ দিয়ে খ্যামটা নাচানো, এমনটি আগে কেউ পেরেছে! কী গান জন্মেছিল সেবার, ফণীর মাথার মণি চুরি কল্লি, বুঝি বিদেশে বিঘোরে পরাণ হারালি—এখনো লোকের কানে লেগে আছে।

 

কালীপ্রসাদের ছোট ভাই চণ্ডিকাপ্রসাদও মধ্যমাগ্রাজের দৃষ্টান্তই অনুসরণ করছে সম্পূৰ্ণ মনপ্ৰাণ দিয়ে। এর আবার ইংরেজী কেতা ভাল লাগে না, নবাবী কায়দার দিকে বেশী ঝোঁক। সর্বদা এক বিচিত্র পোশাক পরে থাকেন। লক্ষেী ফ্যাসানের চুড়িদার পায়জামা, রামজামা, কোমরে দোপাট্টা আর পায়ে জড়ির চপ্পল। মাথার টুপিটি একদিকে এমনই হেলিয়ে পরা থাকে যে বাবুর ডান কান আছে কিনা তাতে হঠাৎ সন্দেহ জাগে। এ ছাড়া তাঁর হাতে থাকে সব সময়ই একটি টকটকে লাল রঙের রুমাল। এবং প্যাঁজ-রসুনের গন্ধ এর পছন্দ বলে যবনী তয়ফাওয়ালীর বাড়িতেই এর বেশী যাতায়াত।

চণ্ডিকাপ্ৰসাদ গোড়া থেকেই বিষয়কর্ম কিছু শেখেননি, তাঁর মেজদাদা তাঁকে সেদিকে ভিড়তেও দেননি। চণ্ডিকাপ্রসাদ মাসে হাতখরচ বাবদ যা পান, তাতে একটি তালুক কেনা যায়। কালীপ্রসাদ ছোট ভাইয়ের কোনো সাধেই বাদ সাধেন না, তাঁর মনোগত অভিপ্ৰায়টি যেন এই, দুভাই মিলে বাপের নামটি মুছে ফেলা হোক, কেউ যেন তাঁদের আর জগাই মল্লিকের ব্যাটা বলে সম্বোধন না করে। স্বনামে যার পরিচয় হয় না, সে আবার একটা মানুষ? ঠেঙো ধুতি, নিমে পরা সাতকেলে বুড়ো জগাই মল্লিককে বাপ বলে পরিচয় দিতে দু ভাইয়েরই লজ্জা হয়। জগাই মল্লিক লোকসমক্ষে বেরোক এটাও ওঁরা কেউ চান না, কিন্তু বৃদ্ধ একবার করে চিত্তেশ্বরীকে প্ৰণাম করতে যাবেনই।

অঘোরনাথ এ গৃহে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ। তাঁর পিতা কিংবা পিতামহ কেউই রূপবান নন, জগাই মল্লিকের দোকানদারের মতন চেহারা তাঁর পুত্ররাও পেয়েছে। কিন্তু অঘোরনাথ মাতৃমুখী সন্তান। সে দীর্ঘকায়, সুঠাম, গৌরবণ, মুখশ্ৰী সুন্দর। অঘোরনাথের মা চিত্তপ্ৰসাদের তৃতীয়পক্ষ। প্রথম দুপক্ষের কোনো পুত্রসন্তান না হওয়ায় গরীব ঘরের এই রূপসী কন্যাটিকে বিবাহ করে এনেছিলেন চিত্তপ্ৰসাদ। অঘোরনাথ তার মায়ের একমাত্ৰ সন্তান, আবাল্য মাতৃছায়ায় লালিত। তাই খুড়ামশাইদের বিলাসী জীবনের প্রভাব পড়েনি তার ওপর। পড়াশুনোয় আগ্রহ খুব, হিন্দু কলেজের ছাত্র হিসেবেও সুনাম কিনেছিল। যথারীতি ছাত্রাবস্থাতেই তার বিবাহ হয়, কিন্তু অল্পকালের মধ্যে প্ৰথমা পত্নীর মৃত্যুর পরই তার মনে প্ৰবল ধর্মভাব দেখা দেয়। সে নিয়মিত জোড়াসাঁকোর দেবেন। ঠাকুরের বাড়ি যাতায়াত শুরু করে। তারপর সে ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণের জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়েও তার জননীর প্রতিবন্ধকে সংকল্প সিদ্ধ করতে পারলো না। মা তার দ্বিতীয় বিবাহ দিলেন হুড়োহুড়ি করে এবং পিতৃ-সম্পত্তি বুঝে নেবার জন্য এস্টেটের কাজে লাগিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু কোনোটিরই সুফল ফললো না। অঘোরনাথ মনোরোগী হয়ে গেল।

 

নবীনকুমার কৃষ্ণভামিনীকে নিয়ে হাটখোলার মল্লিক বাড়িতে আসার কিছুক্ষণ পরেই বুঝলো, তার না আসাই উচিত ছিল এখানে। কুসুমকুমারীর সঙ্গে তার পুতুলখেলা অসমাপ্ত রয়ে গেছে। সে এসেছে সেই টানে। তার বাবার আমলের সবচেয়ে সুদৃশ্য জুড়িগাড়িটি নিয়ে সে এসেছে, সে আশা করেছিল দেউড়ির সামনেই এ বাড়ির কর্তারা সার বেঁধে অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। নবীনকুমার বংশ-মযদি সম্পর্কে অতি সচেতন, সে রামকমল সিংহের সন্তান, যে রামকমল সিংহ ছিলেন কলকাতার আট-দশজন প্ৰধান ধনীদের অন্যতম। জোড়াসাঁকোর সিংহবাড়ির নাম সবাই এক ডাকে চেনে। সেই সিংহদের সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী এখন একমাত্র নবীনকুমার। তার স্ত্রী কৃষ্ণভামিনীও সামান্য নয়, বাগবাজারের সুবিখ্যাত বসু পরিবারের কন্যা।

দেউড়ির সামনে অভ্যর্থনার জন্য কেউ নেই। জুড়িগাড়ির পিছনে যে দুজন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আসে, তারাই তড়াক করে নেমে দরজা খুলে দিল। পুতুল খেলার সরঞ্জাম ভরা একটি কাশ্মীরী বাক্স বগলে নিয়ে নবীনকুমার নেমে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকালো। একজন দ্বারবান শুধু অলসভাবে চেয়ে আছে এদিকে। নবীনকুমারের সন্দেহ হলো, তা হলে কি তারিখ ভুল হলো? না, আজই তো শনিবার, কুসুমকুমারী জানে না তাদের আসবার কথা?

একগলা ঘোমটা দেওয়া একজন দাসী স্থানীয়া স্ত্রীলোক শুধু এগিয়ে এসে বললো, ভিতরে আসুন, নতুন বৌঠান আপনকারদের জন্য অপিক্ষে করে আচেন।

কৃষ্ণভামিনীও নেমে পড়েছে ততক্ষণে। তারও মুখে ঘোমটা, এমন একটা জমকালো ভারী শাড়ি পরে এসেছে সে যে ঠিক মতন সামলাতে না পারলে যখন তখন হোঁচটি খেয়ে পড়তে পারে। দাসীটি তাকে ধরে ধরে নিয়ে চললো।

দেউড়ি থেকে মোরাম বিছানো খানিকটা পথ গম্ভীরভাবে হেঁটে নবীনকুমার উঠে এলো বারান্দায়। সেখানে দুজন ভৃত্য দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাদের ব্যবহারে কোনো ব্যস্ততা নেই, তাদের উভয়েরই দৃষ্টি অতি ধূর্ত ধরনের। যেন সেই মুহূর্তে তারা কিছু একটা ষড়যন্ত্র করছিল, নবীনকুমারকে দেখে থেমে গেল। একটি ঘরের খুব ভারী কাঠের দরজা ঠেলে খুলে তাদের একজন বললো, এখানে বসুন।

নবীনকুমার ও কৃষ্ণভামিনী দুজনেই সে ঘরে ঢুকলো। তার অন্য দিকে আর একটি দরজা আছে, সেটি খোলা। দাসীটি কিছু না বলে কৃষ্ণভামিনীর হাত ধরে সেই দরজা দিয়ে ভিতর দিকে চলে গেল।

ঘরটিতে এলোমেলোভাবে অনেকগুলি গদি মোড়া চেয়ার ছড়ানো, একপাশে একটি বড় চৌকির ওপর ফরাস পাতা। চারটি দেয়ালে ঝুলছে চারখানি কোনো শীতের দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। খুব সম্ভবত ছবিগুলি কোনো নিলাম থেকে এক লটে কেনা।

নবীনকুমার তার ধুতির ফুলকোঁচাটি সাবধানে একটু তুলে একটি চেয়ারে বসলো। তারপর কামিজের জেব থেকে সোনার গার্ড চেন দেওয়া মেকাবি ঘড়িটি বার করে সময় দেখলে। ঠিক ছটা বাজে এখন এবং নবীনকুমারের ঘড়ির সমর্থনেই যেন গুপুস গুপুস করে ছবার শব্দ পাওয়া গোল কেল্লার তোপের। ঠিক ছাঁটার সময়েই তো নবীনকুমারের সস্ত্রীক আসার কথা ছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘরে কেউ এলো না। আর। স্বভাব-চঞ্চল নবীনকুমার বেশীক্ষণ এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে পারে না। সে হাঁটু দোলাতে লাগলো ঘন ঘন, বিরক্তিতে তার ভুরু কুঞ্চিত হয়ে গেছে। সে ভাবতে লাগলো, এ বাড়ির কেউ কি কোনো সহবৎ জানে না নাকি? সামান্য উমেদারের মতন তাকে বার-বাড়ির একটা ঠেঙো ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অনাত্মীয় বা কাজ-সম্বন্ধী লোকদের তবু লোকে বৈঠকখানায় বসাতে পারে। কিন্তু নবীনকুমাররা হলো এ বাড়ির বধূর বাপের বাড়ির সম্পর্কের, অর্থাৎ কুটুম, এমন কুটুমদের দ্বিতলের মজলিস কক্ষে বসানোই প্রথা। নবীনকুমার বাল্যকাল থেকে এমনই দেখে এসেছে। সে আশা করেছিল, কুসুমকুমারী এবং তার স্বামীর নিশ্চয়ই একটা আলাদা মহল আছে। এ বাড়িতে, সেখানেই নিয়ে যাওয়া হবে তাকে।

 

একটুক্ষণের মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠলো নবীনকুমার। ভৃত্য দুটিকে ডাকবার জন্য সে দু-একবার গলা খাঁকারি দিল, তবু তাদের আসবার নাম নেই। তখন সে উঠে গিয়ে বাইরের দিকের দরজাটি দিয়ে মুখ বাড়ালো। ভৃত্য দুটি কাছেই বসে আছে, এ ওর গা ঠেলা ঠেলি করে কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে।

নবীনকুমার একহাতে কোঁচাটি, কাঠের বাক্সটি সামলে ধরে অন্য হাত কোমরে রেখে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলো, এই, তোদের বাবু কোথায়?

একজন ভৃত্য মুখ তুলে বললো, কোন বাবু? আপনি কার কতা জিগ্যেস কচ্চেন?

আর একজন বললো, মেজোবাবু কখোন ফিরবেন জানি না। আর ছোটবাবু আজও ফিত্তে পারেন, কালও ফিত্তে পারেন, আবার ফিত্তে নাও পারেন।

নবীনকুমারদের বাড়ির কোনো ভৃত্য এমনভাবে বসে বসে কথা বলে না। বাবুদের সঙ্গে।

নবীনকুমার বললো, অঘোরনাথবাবুর কথা জিজ্ঞেস কচ্চি।

এবার ভৃত্যদ্বয় পরস্পরের মুখ তাকাতাকি করলো। তারপর একজন মুচকি হেসে বললো, তিনি তো। ওপরেই আচেন।

নবীনকুমার বললো, তেনাকে একবার খপর দাও। বলোগে, নবীনকুমার সিংহ এশ্চেন।

সেই ভৃত্যটি বললো, আজ্ঞে তেনাকে খপর দেবার এক্তিয়ার আমাদের নেই।

বলেই সে চিক করে থুতু ত্যাগ করলো বারান্দার নীচে।

নবীনকুমারদের বাড়ির কোনো ভৃত্য এমন অবাধ্য বেয়াড়াপনা করলে দিবাকরকে দিয়ে চাবকে তার পিঠের ছাল তুলে দেওয়া হতো। এ নেহাত অন্যের বাড়ি।

রাগে গসগস করে নবীনকুমার ফিরে এলো ঘরের মধ্যে। পরীক্ষণেই তার একটি কথা মনে পড়লো। তারা আজকে তাদের পুতুল-ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে, খালি হাতে তো কুটুমবাড়িতে আসা যায় না, তাই দু পর্যাত তত্ত্ব আনা হয়েছে। সেগুলি রয়ে গেছে জুড়ি গাড়ির মধ্যেই।

আবার সে ফিরে এসে ভৃত্য দুটিকে উদ্দেশ্য করে বললো, গাড়িতে তত্ত্ব রয়েচে, কারুকে বলো নামাবার ব্যবস্থা কত্তে।

ভৃত্য দুটি অমনি তড়াক করে ছুটে গেল এবং নিজেরাই পরাত দুটি নামিয়ে হই হই করে চলে গেল বাড়ির মধ্যে, যেন জন্মে। তারা তত্ত্ব দেখেনি।

নবীনকুমার ঘরটির মধ্যে পায়চারি করতে লাগলো মুখ নীচু করে। এখুনি তার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কৃষ্ণভামিনীকে খবর পাঠানো যাবে কী করে? মিতেনীর স্বামী অঘোরনাথ বাড়িতে থেকেও যে একবারও তার সঙ্গে দেখা করতে এলো না, এই চিন্তাই তাকে সবচেয়ে বেশী পীড়া দিচ্ছে।

নবীনকুমার একবার গিয়ে অন্দর মহলের দরজায় উঁকি দিল। ভেতরে মস্ত বড় একটা উঠোন, সেখানে নানা রকম কাপড়চোপড় ছড়ানো, মনে হয় যেন ওপর থেকে উড়ে উড়ে পড়ছে। এ বাড়ির মতন একটা অপরিচ্ছন্ন বাড়ি নবীনকুমার আগে কখনো দেখেনি। বাইরে থেকে মনে হয় অট্টালিকাটি রীতিমতন বিশাল এবং তেমন পুরোনোও নয়, কিন্তু সদর থেকেই অযত্নের চিহ্ন, যেখানে সেখানে আবর্জনা জমে আছে। ঘরের আসবাবগুলি যে মূল্যবান তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত ঝাড়াই সাফাই হয় না। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, অথচ নীচতলায় আলো জ্বালবার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

এবার অন্য দুজন ভৃত্য একটি বড় পাথরের থালা ভর্তি নানাবিধ ফল ও মিষ্টদ্রব্য এবং এক গেলাস সরবত এনে একটি টিপয়ের ওপর রাখলে।

খাবার দেখেই গা জ্বলে উঠলো নবীনকুমারের। সে একা একা খাবে? আজ পর্যন্ত কখনো কেউ সাধাসাধি না করলে সে কোনো খাদ্য মুখেই তোলেনি।

সে ক্রোধ চাপা কণ্ঠে বললো, এ সবের প্রয়োজন নেই, নিয়ে যা।

একজন ভৃত্য বললো, নতুন বৌঠান আপনায় একটু মিষ্টি মুখ কত্তে বল্লেন।

নবীনকুমার বললো, ওপরে খপর দে, আমি এবার যাবো!

ভৃত্য দুটি বিনা বাক্যব্যয়ে ভেতরে চলে গেল। আবার বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে কারুর কোনো সাড়া শব্দ নেই।

এবার নবীনকুমার বেরিয়ে এলো বারান্দায়। এই এক ঘরে অসহ্য অবস্থায় বসে থাকার বদলে সে নিজের গাড়ির মধ্যে বসে অপেক্ষা করবে। বরং। কিংবা তার একজন ভৃত্যকে পাঠাবে কৃষ্ণভামিনীকে কবর দেবার জন্য।

নবীনকুমার বাইরে বেরিয়ে আসতেই গেটের সামনে প্ৰথমে একটি পালকি, তারপর একটি ফেটিং গাড়ি এসে থামলো।

পালকি-বেহারিরা পালকি নামিয়ে রেখে ভেতর থেকে ধরে ধরে বার করলো জগাই মল্লিককে। চোখ দুটি ঘোলাটে রঙের, শত কুঞ্চিত চামড়ায় মোড়া কয়েকখানি হাড়, দু পাশের দুই বেহারির কাঁধে হাত রেখে জগাই মল্লিক ঠিক শিশুর মতন দুলে দুলে হাঁটতে লাগলো। নবীনকুমার এ রকম চলন্ত মনুষ্যকঙ্কাল আগে দেখেনি। জগাই মল্লিকের গাল দুটি অনবরত নড়ছে, যেন অতি ব্যস্ত হয়ে তিনি কিছু চিবুচ্ছেন।

ফেটিং গাড়িটি থামা মাত্র সেই প্রথম দেখা ভৃত্য দুটি ভোজবাজির মতন তৎক্ষণাৎ এসে উদয় হলো দেউড়ির কাছে। গাড়ির ভেতর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো, মেদো! যেদো!

ভৃত্য দুটি বললো, এই যে হুজুর।

গাড়ি থেকে নামলেন এ বাড়ির ছোটবাবু চণ্ডিকাপ্ৰসাদ মল্লিক। মদের নেশায় একেবারে টপভুজঙ্গ হয়ে আছেন, পোশাকের নানা স্থানে পানের পিকের দাগ। তিনি দু-পা হেঁটেই বোঁ করে ঘুরে গেলেন একবার। তারপর পপাত ধরণীতল হবার আগে ভৃত্য দুটি ঝটিতি ধরে ফেললো তাঁকে।

চণ্ডিকাপ্ৰসাদ এ রকম অসময়ে কখনো বাড়ি ফেরেন না। তিনি দ্বিপ্রহর থেকে শ্যাম্পেন টানা শুরু করেন, এখন সবে তো কলির সন্ধে। নিশ্চিত কোনো জরুরী কারণে তাঁর নগদ টাকার প্রয়োজন হয়েছে—একমাত্র এই টানেই তাঁকে দু-একদিন অন্তর বাড়ি আসতে হয়।

চণ্ডিকাপ্ৰসাদ সব কথাই বলেন জোরে জোরে। ভৃত্যদের হুকুম করলেন, ব্যাটারা ভালো করে ধর না। আমাকে, পায় জোর পাচ্ছিনি! তারপরই তারস্বরে জুড়ে দিলেন একটা গান।

মাত্ৰ হাত পাঁচেক তফাতে বিভিন্ন ভূত্যেরা পিতা ও পুত্ৰকে ধরে ধরে এগিয়ে নিয়ে চললো। এর মধ্যে, চণ্ডিকাপ্ৰসাদ বার বার টলে পড়ে যাবার উপক্রম হলেও তাঁর গতিই খানিকটা দ্রুত, কারণ তাঁর ফেরার তাড়া আছে। সুতরাং তিনি ধরে ফেললেন জগাই মল্লিককে।

 

পিতা পুত্ৰ তাকালেন পরস্পরের দিকে। কেউ কারুকে প্রথমে চিনতে পারলেন না সম্ভবত।

চণ্ডিকাপ্রসাদ ভুরু কুঁচকে দৃষ্টিতে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে বললেন, তুমি কে বাওয়া? আঁ?

জগাই মল্লিকের থুতনিটা ধরে উঁচু করে দেখে অট্টহাস্য করে উঠলেন চণ্ডিকাপ্ৰসাদ। হাসির চোটে যেন তাঁর দম ফেটে যাবে।

সেই রকম হাসতে হাসতেই বললেন, অ, তুমি আমার বাওয়া? আমার নিজের বাওয়া! তুমি এখনো বেঁচে আচো বাওয়া? যেদিনই আসি দেখি তুমি বেঁচে রয়েচো, এ কেমন ধারা ব্যাভার তোমার মাইরি। দু-একদিন তো মরে গ্যালেও পারো!

জগাই মল্লিকের গাল আরও জোরে জোরে নড়তে লাগলো, আর ঠোঁট দিয়ে শব্দ হতে লাগলো, ম-ম-ম-ম-ম!

চণ্ডিকাপ্ৰসাদ পিতার কেশহীন মাথায় একটি ছোট চাঁটি মেরে আবার বললো, তা বাঁচো বাওয়া, বাঁচো! আমরা সব্বাই মরে ফেীত হয়ে যাই, তারপরেও তুমি বেঁচে থাকো! কত ধুমধাম করে তোমার ছেরাদ করবো ভেবে রেকেচিলুম, তা তোমার প্রাণে সইলো না। হারামজাদা, আমাদের একটু হাত খুলে ছোরাদ কত্তেও দেবে না। তবে কি নিজের ছোরাদ তুমি কিপুনের মতন নিজেই করবে? অ্যাঁ?

পালকি-বেহারিরা জগাই মল্লিককে আগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই চণ্ডিকাপ্ৰসাদ তাদের একজনের কাঁধ খামচে ধরে বললেন, অ্যাই, ও, চোপ। আমি আমার বাওয়ার সঙ্গে কথা বলচি, তাতে তোর বাওয়ার কী? চলে যাচ্চিস যে! জুতো মেরে মুখ ছিঁড়ে দোবো।

সত্যি সত্যি নীচু হয়ে পা থেকে জুতো খুলতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন চণ্ডিকাপ্ৰসাদ। সেই অবস্থাতেই গড়িয়ে গিয়ে পিতার পা জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমার অধম সন্তান, বাওয়া, তোমার ছেরাদটিও করতে পাল্লমনি গো! ওফ!

এবার কান্না। যাই হোক এর মধ্যেই ভৃত্যদের তৎপরতায় পিতা-পুত্রকে বিযুক্ত করা হলো, পালকি-বেহারারা জগাই মল্লিককে নিয়ে গেল ভেতরে। চণ্ডিকাপ্ৰসাদকে তুলে দাঁড় করানো হলো, তিনিও অবিলম্বেই বাবার কথা ভুলে গিয়ে গান ধরলেন, পরেরো মনেরো ভাবো বুঝিতে কি পারে প—রে!

হাত-পা ছুঁড়ে গান গাইতে গাইতে তিনি উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। নবীনকুমার তাড়াতাড়ি একটি থামের আড়ালে সরে গেল।

চণ্ডিকাপ্ৰসাদ তাকে এক নজর দেখে ফিক করে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার কে গা? ধিনি কাত্তিকের মতন চ্যায়রা!

নবীনকুমার এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে রইলো। চণ্ডিকাপ্ৰসাদ তাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে আবার জড়ানো গলায় গান গাইতে গাইতে বাড়ির মধ্যে চলে গেলেন।

পাশ দিয়ে যাবার সময় চণ্ডিকাপ্ৰসাদের গা থেকে যে বিকট গন্ধ ভেসে এলো তাতেই নবীনকুমারের নাড়িতুড়ি উলটে আসার উপক্রম। এ রকম দৃশ্য নবীনকুমারের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। নবীনকুমার তার পিতাকে অতি অল্প বয়েসে দেখেছে। রামকমল সিংহ বাড়িতে কোনো দিন এমন বেলেল্লা করেননি, শেষের দিকে তিনি প্রায় গৃহেই থাকতেন না বলতে গেলে। গঙ্গানারায়ণের আমলে সিংহ বাড়িতে কোনোদিন মদ্যপান করেনি কেউ। নবীনকুমারের কলেজের সহপাঠীরা কেউ কেউ এই বয়েসেই সুরাপান করে, ও সম্পর্কে নবীনকুমারেরও সামান্য একটু কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল সবে মাত্র। কিন্তু মাতাল চণ্ডিকাপ্ৰসাদকে দেখে মদের ওপর তার একটা দারুণ ঘৃণা জন্মে গেল, এবং সেইখানে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে সে মনে মনে শপথ নিলো যে, জীবনে সে কখনো সুরাপান করবে না।

নবীনকুমার গাড়ির মধ্যে বসে অপেক্ষা করার আরও প্ৰায় আধঘণ্টা পরে এলো কৃষ্ণভামিনী। তৎক্ষণাৎ গাড়ি ছাড়তে হুকুম দেওয়া হলো। পথের মধ্যে কোন রকম গোল করা ঠিক হবে না, নবীনকুমার বাড়ি ফিরেই কৃষ্ণভামিনীকে আচ্ছাসে মার লাগাবে, এই মনে করে গুম হয়ে রইলো।

কৃষ্ণভামিনীই ফিসফিস করে বললো, ওগো, আমার মিতেনীর দুঃখ দেকালে পাতারেরও বুক ফেটে যাবে! ওর বাপ মা কী দেকে বে দিলে, ওর সোয়ামী যে পাগল!

নবীনকুমার বললো, পাগল না শেয়ানা। একবার নীচে নামতে পারলেন না, অসভ্য, ইতর।

কৃষ্ণভামিনী বললো, হাঁগো, সত্যি পাগল! কোথথাও বেরোয় না, শুধু একটা ঠাকুরের পটের সামনে বসে থাকে আর বিলকিচ ছিলকিচ কতা বলে, নয়তো একদম চুম মেরে থাকে। এই যে আমি এতক্ষণ রইলুম, একটা কতা বলেনি। মাঝে মাঝে অজ্ঞেন হয়ে যায়! এই এক মাস হলো বেশী বাড়াবাড়ি হয়েচে! আমার মিতেনী কেঁদে ভাসাচ্চে গো, কেঁদে ভাসাচ্চে!

নবীনকুমার বললো, আমাদের ছেলে-বউ এনেচে?

কৃষ্ণভামিনী বললো, না। সে কতা আর পাড়তে পারলুম কাঁই! ওপরে গিয়ে দেকি, এই তো অবস্তা। মিতেনীর শাশুড়িও কাঁদচে, মিতেনীও কাঁদচে!

নবীনকুমার বললো, যত ইচ্ছে কাঁদুক, ওদের সঙ্গে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। ছেলে-বউয়ের আর আশা করো না! ওটা উনপাঁজুরেদের বাড়ি, আমাদের মতন লোকের এখেনে আসা যাওয়া চলে না!

কৃষ্ণভামিনী বললো, কিন্তু মিতেনী যে অনেক করে বললে, আমার হাত ধরে কতা আদায় করে নিলে। ওর শাশুড়ি এখুন ওকে কোতাও যেতে দেবে না, তাই আমি যদি আসি।

নবীনকুমার কঠোর স্বরে বললো, না!

কৃষ্ণভামিনীকে অবশ্য আর কোনোদিন আসতে হলো না হাটখোলায়। এর দশদিনের মধ্যেই শুরু হলো তার ভেদ বমি, বড় বড় ডাক্তার বদ্যিরাও তাকে দেড়দিনের বেশী ধরে রাখতে পারলো না, পুতুল খেলা ও স্বামী সোহাগের মায়া কাটিয়ে টুপ করে মরে গেল কৃষ্ণভামিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *