৪৪. কল্যাণীয়াসু নীলু

নীলগঞ্জ থেকে সোভাহানের চিঠি এসেছে। দীর্ঘ চিঠি। নীলুর কাছে লেখা। চিঠি পড়ে নীলু হাসবে না। কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এই লোকটির নির্বুদ্ধিতার কোনো সীমা নেই। একটা মানুষ এতটা নির্বোধ হয় কেন? গুটিগুটি হরফে লিখেছে–

কল্যাণীয়াসু নীলু/

আশা করি সবাইকে নিয়ে তুমি তোমার স্বভাবমতো ভালো আছ। কদিন থেকেই ভাবছি। এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে তোমাকে লিখব। বাবলুপ্রসঙ্গে যাতে কোনো দুশ্চিন্তা করতে না পার।

বাবলু ভালো আছে এবং বলা যেতে পারে সুখে আছে। গ্রাম তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে। খোলা মাঠ, নদী, বনজঙ্গল এসব তো সে কখনো দেখে নি। সে দেখেছে মানুষ-মানুষের মধ্যে যে-সব খারাপ ব্যাপার আছে, সেইসব। মানুষের বাইরেও যে আরেকটি সুন্দর শান্ত জগৎ আছে, তা সে জানত না। এখন জানল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে। বনের ভেতর থেকেও কয়েক বার তাকে লোক পাঠিয়ে খুঁজে আনতে হয়েছে। ও তার নিজের একটি পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে। সেই পৃথিবী থেকে তাকে সরিয়ে আনতে মন চাচ্ছে না। আমি তাকে এখানের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি।

আমি জানি তুমি আমার নির্বুদ্ধিতায় হাসছ। আমি সামনে থাকলে হয়তো খুব কড়া-কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিতে, তবু তুমি একটু ভাবলেই বুঝবে, আমি যা করছি তার ফল শুভ হবার সম্ভাবনা আছে। আমি নিজেও এখানে থেকে গেলাম। নীলগঞ্জ স্কুলে একটা মাস্টারি জুটে গেছে। সুখী নীলগঞ্জের যে-কাজ শুরু হয়েছিল, তা শেষ করা যায়। কিনা তাও দেখছি। দূর থেকে যে-কাজটি অসম্ভব বলে মনে হত, এখন তেমন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

মজার ব্যাপার কী জানি, নীলগঞ্জের লোকজন কেন জানি আমাকে বেশ পছন্দ করছে। আমাকে আড়ালে ডাকে পাগলা মাস্টার। যদিও পাগলামির কিছুই আমি করছি না। নামটা আমার পছন্দ হয়েছে, কারণ এরা কবির মামাকেও পাগলা মাস্টার ডাকত। যে-কোনোভাবেই হোক, গ্রামের মানুষদের উপর আমি কিছুটা প্রভাব ফেলেছি বলে মনে হয়। গত শুক্রবারে বড়ো রকমের একটা গ্ৰাম্য বিবাদ হল। সবাই দল বেধে এল আমার কাছে। আমি যেন একটা মীমাংসা করে দিই। আমি যা বলব, তাই নাকি তারা শুনবে। আমার কী মনে হয়, জান? আমার মনে হয় ওরা আমার মধ্যে কবির মামার ছায়া দেখতে চায়। কিন্তু এত বড়ো যোগ্যতা কি আমার আছে? আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র মানুষ।

তোমরা কবির মামার কুলখানিতে কেন এলে না বল তো? শওকত পরপর দুদিন স্টেশনে কাটাল। কখন তোমরা আসা। এসে কস্টেই পড় কি না। তোমরা না-আসায় তার কষ্ট দেখে আমি কষ্ট পেয়েছি। চলে এসো না এক বার। দেখে যাও আমরা কেমন আছি। পিকনিক করতেও তো মানুষ আসে।

কবির মামা প্রসঙ্গে মজার কথা শোন। মাঝে-মাঝে দূর-দূর থেকে লোকজন আসে পীর সাহেবের কবর জিয়ারত করতে। পীর কে বুঝতে পারিছ তো? কবির মামা। কী মুশকিল বল দেখি এক জন নাস্তিক মানুষকে এরা মনে হয়। পীর বানিয়ে ছাড়বেই। দূর-দূর গ্রামের লোকজন মোমবাতি আগরবাতি। এইসব দিয়ে যায়। আজ থেকে পাঁচ বছর পর যদি দেখ, এখানে বিরাট মাজার শরিফ বসে গেছে, উরস হচ্ছে, এবং আমি সেই মাজার শরিফের প্রধান খাদেম-তাহলে অবাক হয়ো না। এদেশে সবই সম্ভব।

আচ্ছা নীলু, তোমার শরীর ভালো আছে তো? কোনো কারণে তোমার মনটন খারাপ না তো? পরশু রাতে স্বপ্নে দেখলাম, তুমি মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। স্বপ্ন স্বপ্নই। তবু কেমন যেন লাগছে। তুমি ভালো আছে এই খবর জানিও, যদি সময় পাও। যা ব্যস্ত থাক, সময় পাওয়ার কথা নয়। বিশাল এই চিঠি ফেদে নিজেই বিব্রত বোধ করছি। কিছু মনে করেন। ভালো থাক।

তোমার দুলাভাই সোভাহান।

পুনশ্চঃ বাবলুর আর একটি শিল্পকর্ম পাঠালাম। দুমাথাওয়ালা ছাগল।

নীলু তার দুলাভাইয়ের চিঠি বেশ কয়েক বার পড়ল। প্রথম পড়বার সময় লোকটিকে যতটা নির্বোধি মনে হচ্ছিল, এখন ততটা মনে হচ্ছে না। হয়তো— বা খুব গুছিয়ে লেখা চিঠির কারণে। এই লোকটি যে এত গুছিয়ে লিখতে পারে তা নীলু জানত না। চিঠির ভেতর খুব সহজ-সরল একটা ভঙ্গি ঢুকে গেছে। অথচ এই মানুষটির জীবন খুব সহজ-সরল নয়।

কোনো রকম আদর্শবাদ, মহৎ চিন্তা, উচ্চস্তরের ভাবালুতা নীলু তার মধ্যে কখনো দেখে নি। এই লোক হঠাৎ বদলে গিয়ে গ্রাম উন্নয়ন শুরু করবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। হয়তো দু দিন পরই দেখা যাবে গ্রাম আর তার ভালো লাগছে না। সব ছেড়েছুঁড়ে আবার অন্য কোথাও চলে যাবে। যাবার আগে বাবলুকে এ বাড়িতে ফেলে যাবে। মাস দুই পর চোরের মতো আসবে। দীন ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে থাকবে। তার কাপড়ের ব্যাগে থাকবে বাবলুর জন্যে আনা কোনো সস্তা খেলনা। অক্ষম বাবার ভালবাসা সেই খেলনায় থাকবে, কিন্তু তা বাবলুর মনোহরণ করবে না। আজকাল শিশুরাও সস্তা খেলনা এবং দামী খেলনার তফাতটা ভালোই বোঝে। Ꮡ

সন্ধ্যায় নীলুশফিককে চিঠি পড়তে দিল। শফিক হাই তুলে বলল, এত লম্বা চিঠি আমি পড়তে পারব না। বিষয়বস্তু কী আমাকে বল।

বিষয়বস্তু কিছু নেই। পড় না। কতক্ষণ আর লাগবে!

শফিক চিঠি শেষ করে আশ্চর্য হয়েই বলল, সুন্দর চিঠি তো।

নীলু বলল, কোন জিনিসটা সুন্দর?

ঘরোয়া ভঙ্গিটা। মনে হয়। ভদ্রলোক যেন গল্প করছেন। তোমরা এক কাজ কর না কেন—ঘুরে আস নীলগঞ্জ থেকে। কয়েকটা দিন কাটিয়ে আস।

নীলু বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?

টুনির ভালো লাগবে। গ্রামে গিয়ে নদী, বন, এইসব দেখবে। বেচারি এক-একা থাকে।

সত্যি যেতে বলছ?

হ্যাঁ, যাও। আমিও টলম্যানকে বলে দেখি, যদি ছুটি পাই। সম্ভাবনা অবশ্যি কম, তবু দু-একদিনের জন্যে হয়তো ছাড়বে।

সত্যি-সত্যি তুমি যাবে?

হ্যাঁ, মানে চেষ্টা করব। বিদেশে ছুটির দিনগুলিতে সবাই বাইরে-টাইরে যায়। আমাদের তো এসব বালাই নেই। কাল আমি টলম্যানের সঙ্গে কথা বলে দেখব, ব্যাটাকে ভেজানো যায় কি না।

হঠাৎ তোমার এত উৎসাহের কারণ ঠিক বুঝতে পারছি না।

তেমন জোরাল কোনো কারণ নেই। যেতে ইচ্ছা করছে। তুমি বাবা-মার সঙ্গেও কথা বল। ওঁরা যদি যেতে চান।

মনোয়ারা নীলগঞ্জে যাবার কথায় বেশ বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির কারণ স্পষ্ট নয়। তিনি শুকনো গলায় বললেন, এইসব এখন বাদ দাও। আম-কাঁঠালের সিজনে গেলেই হবে।

টুনির আব্ৰাসবাইকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।

দল বেঁধে গেলে থাকবে কোথায় শুনি? শীতের দিন। এতগুলি মানুষের লেপ-কাঁথা কে দেবে? হুঁট করে একটা কিছু করলেই তো হয় না।

শীতের লেপ-কাঁথা সঙ্গে করে নিয়ে গেলে হয় না, মা?

যদি হয় তাহলে সঙ্গে করে নিয়ে যাও! মুখ দিয়ে এক বার যখন বের করেছ, তখন তো এটা করবেই। যাও, নিওমোনিয়া বাধিয়ে আসে।

হোসেন সাহেব যাবার ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দেখালেন। মনোয়ারার অনাগ্রহ যেমন চোখে লাগে, তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহও তেমনি চোখে লাগে। তিনি নানান রকম লিষ্ট করতে লাগলেন। সময়ে-অসময়ে নীলুর সঙ্গে বসে পরামর্শ-এ হারিকেন নিতে হবে, বুঝলে বৌমা। এটা খুবই দরকার।

ওখানে নিশ্চয়ই হারিকেন আছে, বাবা।

তা তো আছেই। হয়তো একটা, বড়জোর দুটা। এতগুলি মানুষ আমরা যাচ্ছি। দুটা হারিকেনে আমাদের কী হবে বল? টর্চ লাইট নিতে হবে, মোমবাতি নিতে হবে। একটা কেরোসিনের চুলাও নেওয়া দরকার। ধরা চট করে এক কাপ চা খাবার দরকার হল, কোথায় পাবে? সেখানে তো আর গ্যাসের চুলা নেই। কী বল মা?

তা তো বটেই।

তুমি জহির আর শাহানাকেও বল। ওদেরকে নিয়ে যাই।

জ্বি, তাদেরও বলব। টুনির বাবার ছুটি হয়। কিনা এখনও বুঝতে পারছি না। ছুটি হলেই বলব।

না-না, তুমি মা আগে থেকেই বল।

শাহানা বেড়াতে যাবার কথায় ঠোঁট উল্টে বলল, তোমাদের ব্যাপার তোমরা যাও, আমাকে টানছ কেন?

নীলু বিস্মিত হয়ে বলার, আমাদের ব্যাপার মানে? তুমি কি আমাদের কেউ নাও?

না ভাবী। আমি তোমাদের কেউ না।

ও, তাই নাকি? আমি অবশ্যি এটা আগে জানতাম না। এখন জানলাম। না হয় তুমি বাইরের গেস্ট হিসেবেই আমাদের সঙ্গে চল। বাইরের গেস্টও কিছু যাচ্ছে।

বাইরের কে যাচ্ছে?

আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ে বীণা।

আনিস ভাই যাচ্ছে না?

না।

দুনিয়াসুদ্ধ লোককে তোমরা নিচ্ছ, তাকে নিচ্ছ না কেন? সে কী দোষ করল? বলেছিলে তাকে?

নীলু গম্ভীর মুখে বলল, না।

বল নি কেন? এটা তো ভাবী সাধারণ ভদ্রতা। একবাড়িতে থাকে, দিনরাত এটা-ওটা ফরমাস খেটে দেয়। আর…

শাহানা কথা শেষ করল না। নীলুর কঠিন চোখের সামনে থতমত খেয়ে গেল। নীলু কড়া গলায় বলল, ঐ চিন্তা এখনও মাথায় নিয়ে ঘুরছ?

শাহানা টেনে–টেনে বলল, কোন চিন্তা?

তুমি ভালোই জান, কোন চিন্তা। অনেক তো হল শাহানা, আর কেন?

তুমি কী বলছি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না ভাবী। আমি শুধু বলছি-ভদ্রতা করে হলেও তোমার উচিত ছিল আনিস ভাইকে বলা। সবাই যখন যাচ্ছে।

আনিস এ বাড়িতে এখন থাকে না। থাকলে নিশ্চয়ই বলতাম।

আনিস ভাই তাহলে থাকে কোথায়?

আমি জানি না।

সে কী কথা ভাবী, তুমি জান না কেন?

আমাকে কিছু বলে যায় নি, কাজেই আমি জানি না।

শাহানাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। নীলুর বিরক্তির সীমা রইল না। এসব কী শুরু করেছে। শাহানা?

আনিসকে নিয়ে বাড়াবাড়িটাই তার অসহ্য লাগছে। নীলুর কেন জানি মনে হচ্ছে, এই বাড়াবাড়ি খানিকটা লোক দেখানো।

নীলু বলল, আমি এখন উঠব। শাহানা, তুমি জহিরকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে গেলে আমাদের ভালো লাগত।

শুধু তোমাদের ভালো লাগলে তো হবে না, আমারও ভালো লাগতে হবে। আমার ভালো লাগবে না।

কী করে ভালো লাগবে না?

জানি না। কী করে বুঝলাম।

নীলুউঠে দাঁড়াল। শাহানার এখানে এসে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। অনেক রকম ঝামেলা করে আসা। অফিস থেকে এই কারণে তাকে ছুটি নিতে হয়েছে। ভেবেছিল প্রথম আসবে শাহানাদের বাড়ি, সেখানে থেকে যাবে শারমিনদের বাড়িতে। কিন্তু এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। নীলু অবাক হয়ে লক্ষ করল, শাহানা দোতলা থেকে নিচে নামল না। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে ভাবী, পরে দেখা হবে। সময় পেলে আবার এস। অবশ্যি যদি তোমার ইচ্ছা করে।

গেটের কাছে জহিরের গাড়ি। ড্রাইভার বলল, আপনি এসেছেন শুনে স্যার পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেখানে–যেখানে যাবেন, নিয়ে যাব। নীলু বলল, আমার গাড়ি লাগবে না, রিকশা নিয়ে চলে যাব।

স্যার তাহলে খুব রাগ করবেন। আপা আসেন।

বাসায় ফিরে দেখে বসার ঘরে আনিস। জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। নীলু কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছা করছে খুব কড়া-কড়া কিছু কথা

ভাবী, ভালো আছেন?

হ্যাঁ, ভালো।

আমার নামে কি কোনো চিঠি এসেছে ভাবী?

না, কোনো চিঠিফিঠি আসে নি।

যদি আসে একটু রেখে দেবেন, আমি এসে নিয়ে যাব।

ঠিক আছে, রাখব।

ভাবী, আপনার কি শরীর খারাপ?

শরীর ঠিকই আছে। তুমি এখন যাও। আমি শুয়ে থাকব। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।

আনিস ইতস্তত করে বলল, ভাবী, আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবেন–শ দুই?

নীলু ঠাণ্ডা গলায় বলল, এখন আমার কাছে টাকা পয়সা নেই।

আনিস চলে গেল। সে প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছে। ঘর থেকে বেরুবার সময় দরজায় একটা ধাক্কা খেল। হাঁটতে গিয়ে লক্ষ করল। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। সে ভেবেই পেল না, নীলু ভাবীর মতো মানুষ তার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার কেন করলেন? তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলাতে না-পারলে টপটপ করে চোখ থেকে পানি পড়বে। রাস্তার লোকেরা হী করে তাকিয়ে থাকবে। রাস্তায় নামবার আগে যে করেই হোক নিজেকে সামলাতে হবে। সে নিঃশব্দে ছাদে উঠে গেল।

ছাদে তার নিজের ঘরটির দরজা খোলা। সুন্দর পর্দা ঝুলছে। কে থাকে এখানে? আনিস কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। বীণা, গভীর মনোযোগে পড়ছে। পিঠময় খোলা চুল। চেয়ারে পা তুলে কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসা। আর ঘরটি কী সুন্দর সাজিয়েছে।

এই বীণা।

বীণা চমকে উঠল।

আরো আনিস ভাই, আপনি কোথা থেকে?

আকাশ থেকে।

আসুন, ভেতরে আসুন তো।

আনিস ভেতরে ঢুকল। বীণা বলল, আপনার ঘরের দখল নিয়ে নিয়েছি।

তাই তো দেখছি।

নিরিবিলি। পড়াশোনার জন্যে এটা করলাম। আপনাকে তাড়িয়েছিও এই কারণে।

ভালো করেছ।

উপায় ছিল না, কারণ আমাকে খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে। সারা জীবন ফার্স্ট সেকেণ্ড হতে হবে। কেন বলুন তো?

বলতে পারছি না।

কারণ আমি এমন এক জন পুরুষকে বিয়ে করব যার কাজ হবে দিন-রাত ঘরে বসে থাকা। কাজেই চাকরি-টা করি করে এই লোককে খাওয়াতে হবে। তার জন্যেই আমার খুব ভালো রেজাল্ট দরকার। যেন পাস করলেই চাকরি হয়ে যায়। বুঝতে পাছেন?

পারছি।

এখন বলুন তো, আমি কেমন মেয়ে?

তুমি খুব জেদী মেয়ে।

ঠিক বলেছেন। আর আপনি হচ্ছেন একজন ভ্যাবদা পুরুষ। এখন বলুন, এ বাড়িতে কেন এসেছেন?

এমনি এসেছি।

না, এমনি না। নিশ্চয়ই কোনো কাজে এসেছেন।

নীলু ভাবীর কাছে এসেছিলাম।

কেন?

আমার কিছু টাকার দরকার হল, মানে ইয়ে…

পেয়েছেন টাকা?

না, ওর হাত খালি।

কত টাকা দরকার?

তোমার ব্যস্ত হতে হবে না, আমি ব্যবস্থা করব।

আহ, যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলুন—কত টাকা দরকার?

শ দুই।

বসুন। এখানে, আমি নিয়ে আসছি। খবরদার পালাবেন না।

বীণা নিচে নেমে গেল। মা-বাবা দু জনের কেউই বাসায় নেই। এক খালা আছেন, ষ্টিল আলমিরার চাবি তাঁর কাছে নেই। লতিফা তোষকের নিচে ভাংতি টাকা পয়সা রাখেন, সেখানে দুটি ময়লা ন্যাতন্যাতে পাঁচ টাকার নোট ছাড়া কিছুই নেই। বীণা খালিহাতেই উপরে উঠে এল। ক্ষীণ স্বরে বলল, আনিস ভাই, আপনি কোথায় থাকেন ঠিকানাটা লিখে যান, আমি সন্ধ্যার আগেই টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করব।

তুমি শুধু—শুধু ব্যস্ত হচ্ছে বীণা।

আমি যা বলছি করুন–এই নিন। কাগজ-কলম। পরিষ্কার করে। ঠিকানা লিখুন। আমি চা বানিয়ে আনছি, চা খেয়ে তারপর যাবেন।

বীণা আবার নিচে নেমে গেল।

 

সন্ধেবেলায় আনিসের বিস্ময়ের সীমা রইল না।

তার কেন জানি মনে হচ্ছিল, বীণা এ-রকম কিছু করে বসতে পারে। সত্যি সত্যি করলেও তাই। নিজেই এসে উপস্থিত। নোংরা ঘর। চারপাশের নোনাধরা দেয়াল, আস্তর উঠে-উঠে আসছে। দীনহীন পরিবেশের কিছুই মেয়েটিকে প্রভাবিত করল না। কিংবা হয়তো করেছে, সে তা বুঝতে দিচ্ছে না। সে আনিসের চৌকিতে বসে আছে বেশ সহজ ভঙ্গিতে, যেন এটাই তার ঘরবাড়ি। কথাও বলছে সহজ স্বরে।

পাশের চৌকিটায় কে থাকেন?

আমার রুমমেট।

উনি এখন নেই?

না। অফিস শেষ করে টিউশ্যনিতে যান, ফিরতে ফিরতে দশটা—এগারটা दge।

আপনারা কি নিজেরাই রান্না করেন-হাঁড়ি-পাতিল দেখছি।

হ্যাঁ, নিজেরাই করি। খরচ কম পড়ে।

রান করেন কে?

বেশির ভাগ সময় আমিই করি। আমার অবসর বেশি।

আজ কী রান্না করলেন?

এখনো কিছু করিনি।

আজকের রান্নাটা আমি করে দিই?

আনিস আঁৎকে উঠে বলল, কী বলছি এসব! তুমি কি রান্না করবে?

আপনার কি ধারণা, আমি রান্না জানি না?

জানবে না কেন? নিশ্চয়ই জোন। কোনো রকম ঝামেলা না-করে তুমি চুপচাপ বসে থাক তো।

আমি কিন্তু এখানে অনেকক্ষণ থাকব।

অনেকক্ষণ থাকব মানে?

অনেকক্ষণ থাকব মানেও জানেন না? বাংলা ভুলে গেছেন নাকি?

আনিস কী বলবে, কী করবে ভেবে পেল না। এই মেয়েটা তাকে মনে হচ্ছে সত্যি-সত্যি বিপদে ফেলবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পাশের ঘরগুলির বোর্ডাররা বারবার উঁকিঝুকি দিচ্ছে। আনিস হারিকেন ধরাল। বীণা অবাক হয়ে বলল, হারিকেন কেন, আপনাদের ইলেকট্রিসিটি নেই?

ছিল। বাড়িওয়ালা এক বছর যাবত ইলেকট্রিসিটির বিল দিচ্ছে না, লাইন কেটে দিয়েছে।

বাড়িওয়ালাও মনে হয় আপনাদের মত গরিব।

আসলেই তাই। এই এতটুকু বাড়ি, এর সাত জন শরিক। শরিকে-শরিকে বিবাদ লেগেই আছে। বিবাদ মানে কঠিন বিবাদ। মারামারি হচ্ছে ভালোভাবে। পরশু এক জন আরেক জনকে রামদা নিয়ে তাড়া করেছিল।

বলেন কি?

আজও হয়তো করবে।

করে করুক। এই ঘরে না চুকলেই হল।

রাত দশটা বেজে গেছে। বীণা ফিরছে না। বীণার বাবা থানায় ডাইরি করতে গিয়েছেন। ওসি সাহেব চোখ মটকে জিজ্ঞেস করেছেন, মেয়ের কোন লভ—টভ আছে নাকি? তিনি শুকনো গলায় বলেছেন, আমার মেয়ে ঐ রকম না।

আগে ভালো করে খোঁজ নিন। মেয়ের ট্রাংক, সুটকেস এসব খুলে দেখুন চিঠিপত্র পান। কিনা। তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের জিজ্ঞাসাবাদ করুন। ওরা এইসব ভালো জানবে। টাকা পয়সা কিছু নিয়ে গেছে?

তার মার কাছ থেকে পাঁচ শ টাকা নিয়ে গিয়েছিল। নিউ মার্কেট থেকে কী-একটা বই কিনবে। টেক্সটবুক।

ঐটা ফালতু কথা। যাওয়ার ভাড়া নিয়ে গেছে। সপ্তাহে এ-রকম তিন-চারটা কেইস আমরা ডিল করি। মেয়ে পালিয়ে যায়। পেয়ারের লোকের সঙ্গে। সস্তার একটা হোটেলে উঠে ফুর্তি করে।

এইসব কী বলছেন। আপনি?

সত্যি কথা বলছি রে ভাই। তাও তো সবটা বলছিনা। রেখেঢেকে বলছি। মাঝে মাঝে কী হয় জানেন? ছেলে মেয়েটাকে ভুজুখভাজৎ দিয়ে বের করে নেয়। একটা হোটেলে নিয়ে তোলে। সেই হোটেলে আগে থেকেই তার বন্ধুবান্ধব অপেক্ষা করছে। তারপর মছাবটা বুঝতে পারছেন তো? এইসব হারামজাদাদের ধরতেও পারি না। মেয়ে বা মেয়ের আত্মীয়স্বজন কেউ কেইস করে না। সম্মানহানির ভয়। মানে ইজতের ভয়। মেয়ের আবার বিয়ে দেয়ার প্রশ্ন আছে।

ভাই, আপনি এসব কী বলছেন?

যা বলছি সত্য বলছি। একটা শব্দও মিথ্যা না। যান, বাড়ি যান। যা করতে বললাম করেন। চিঠি পড়ে কোনো নাম-ঠিকানা পেলে আমাদের খবর দেবেন-টাইট দিয়ে দেব।

তিনি বাড়ি ফিরলেন ঘোরের মধ্যে। কয়েক বার এমন হল, যেন রিকশা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন। শরীর দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে। তাঁর ধারণা হল, হাট অ্যাটাক হয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের সময় নাকি খুব ঘাম হয়।

কী করে বাড়ি পৌঁছলেন তিনি নিজেই জানেন না।

বারান্দার একটা মোড়াতে আনিস বসে আছে। বাড়ির ভেতর বেশ কিছু লোকজন। এদের গোলমাল ছাপিয়েও লতিফার গলা ছেড়ে কান্না শোনা যাচ্ছে। তিনি কাঁপা গলায় আনিসকে বললেন, এখনও পাওয়া যায় নি? আনিস বিব্রত স্বরে বলল, বীণার কথা বলছেন তো? ওকে নিয়ে এসেছি।

নিয়ে এসেছ? কোথায় ছিল সে?

ইয়ে, মানে আমার ওখানে একটা বিশেষ প্রয়োজনে–বিশেষ প্রয়োজনে তোমার কাছে? শুয়োরের বাচ্চা, তুমি মানুষ চেন না? জুতিয়ে আমি তোমার দাঁত খুলে ফেলব, বেইমান, নিমকহারাম-

তিনি সত্যি সত্যি তাঁর স্যাণ্ডেল খুলে ফেললেন। হৈচৈ শুনে ভেতরের বাড়ির সবাই বেরিয়ে এল। লতিফা এসে স্বামীর হাত ধরে প্রায় টেনে হিচড়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। হিসহিস করে বললেন, কেলেঙ্কারি। আর বাড়িও না। যা হবার হয়েছে। এই রাতেই মেয়ের আমি বিয়ে দেব।

কী বলছ এসব? কার সাথে বিয়ে দেবে? এই হারামজাদাটার সঙ্গেই দেব, উপায় কী? এত রাত পর্যন্ত এক সঙ্গে ছিল। কিনা, কী হয়েছে কে জানে। আগুন আর ঘি।

তিনি হতভম্ব হয়ে হয়ে পড়লেন। লতিফা কাঁদতে-কাঁদতেই বললেন, দাঁড়িয়ে থেক না। কাজীর জোগাড় দেখা।

মাথাটা তোমার খারাপ হয়ে গেল নাকি? ঐ হারামজাদাকে আমি জেলের ভাত খাওয়াব। জুতাপেটা করব।

লতিফা কঠিন স্বরে বললেন, আমি কোনো কথা শুনব না। আজ রাতেই বিয়ে হবে। মেয়ে কি না কি করে এসেছে, আমার গা ঘিনঘিন করছে। বমি এসে যাচ্ছে।

সত্যি তিনি হাড়হড় করে একগাদা বমি করলেন।

রাত বারটা পঁয়ত্ৰিশ মিনিটে আনিসের বিয়ে হয়ে গেল। লতিফা ট্রাকে তুলে রাখা তাঁর নিজের বিয়ের শাড়িতে বৌ সাজালেন। শফিকের একটা ধোয়া পাঞ্জাবি আনিসকে পরানো হল। পাঞ্জাবি একটু বড়ো হল। কাঁধের বুল অনেকখানি নেমে গেল, তবু সেই মাপে বড়ো ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবিতে অপূর্ব দেখাল আনিসকে। লতিফারাও এক সময় মনে হল, ছেলেটার চেহারা তো ভালোই। সুন্দরই তো লাগছে। মেয়ে জামাই খারাপ কেউ বলবে না।

শুধু বীণার বাবা কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ করলেন না। অন্ধকার বারান্দায় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে রইলেন। হোসেন সাহেব গেলেন কথাবার্তা বলে তাঁর মন ভালো করে দিতে। বিভিন্ন দিকে তিনি চেষ্টা করলেন। সব শেষে অত্যাশ্চর্য ওষুধ পালসেটিলা নিয়ে কথা বলা শুরু করতেই বীণার বাবা বললেন, এত ফালতু কথা বলেন কেন? ভ্যাজার-ভাঁজর করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছেন। যান, বাড়িতে গিয়ে ঘুমান।

চিলেকোঠার ঘরে তাড়াহুড়া করে বাসর সাজান হয়েছে। আশপাশের বাড়ির মেয়েরা এসে জুটেছে। এদের আনন্দের কোনো শেষ নেই। সমস্ত ছাদ জুড়ে ছোটা-ছুটি। একটি রেডিওগ্রাম আনা হয়েছে ছাদে। বিশাল দুটি স্পিকারে তারস্বরে গান হচ্ছে। সন্ধ্যা কিন্নরকণ্ঠে গাইছেন-ও বাক বাক বাকুম বাকুম পায়রা। অপূর্ব সুরধ্বনিতে শীতের বাতাসে যেন নেশা ধরে গেছে। আনিসের চোখ বারবার ভিজে উঠছে। সে ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। প্রায় শেষরাতের দিকে নীলু এসে বলল, আনিস, তোমার ঘরে যাও। বীণাকে আমরা নিয়ে আসছি।

আনিস কিছু বলল না। নীলু বলল, আজ আমি তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। কিছু মনে রেখো না ভাই। অন্য কারণ ছিল। আমি এমন খারাপ মেয়ে না, আনিস। আমি তোমাকে খুবই পছন্দ করি।

ভাবী, আমি তা জানি।

আজ যা হল, তোমার জন্য ভালো স্থল। বীণা একটি অসাধারণ মেয়ে। দেখবে, ও তোমার জীবনটাই বদলে দেবে।

তাও আমি জানি, ভাবী।

এস, ঘরে এস।

আপনার আঁচলে কী?

গোলাপী। টবের গাছ থেকে ছিঁড়ে এনেছি। ফুল ছাড়া কি বাসর হয়? তোমার খুব ভাগ্য ভালো। আজ অনেকগুলি গোলাপ একসঙ্গে ফুটেছে।

রাত প্ৰায় শেষ হয়ে এল। আনিস অপেক্ষা করছে। তাকে ঘিরে আছে গোলাপের সৌরভ। জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই না—ঘটে। এই ঘরে এমন একটি নাটক হবে, কে জানে!

আনিসের মাথা বিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসে যাচ্ছে।

বীণা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার ওপাশে। তার সঙ্গে বেশ কটি মেয়ে, সবাই চাপা হাসি হাসছে। বীণার মাথা নিচু। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে মাঝে-মাঝে কোপে-কোপে উঠছে। কাঁদছে নাকি মেয়েটা? কান্নার কী আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *