আযান ও আযানের বিধিবদ্ধতা প্রসঙ্গে
ইবন ইসহাক বলেন, ঃ রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় স্থিত হলেন এবং মুহাজির ও নেতৃস্থানীয় আনসারগণ যখন তাঁর পাশে সমবেত হলেন এবং ইসলাম যখন দৃঢ়তা-স্থিরতা লাভ করলো, তখন নামায কাইম হল, রোযা ও যাকাত ফরয করা হলো, হুদুদ তথা শরীআতের দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হলো, হালাল-হারামের বিধান জারী করা হলো এবং ইসলাম তাদের মধ্যে সুদৃঢ় আসন করে নিল। আর আনসাররা ছিলেন সেই গোত্র, যারা পূর্ব থেকেই মদীনায় বসবাস করতেন এবং ঈমান আনয়ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন কোন রকম আহবান ছাড়াই নামাযের সময় হলে লোকেরা তার নিকট সমবেত হতো। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) ভাবলেন, ইয়াহুদীদের শিঙা বা বিউগলের মতো তিনিও কিছু একটা বানাবেন, যা দিয়ে ইয়াহুদীরা তাদের লোকজনকে তাদের প্রার্থনার দিকে ডাকে। পরে তিনি এটা অপসন্দ করেন। এরপর তিনি নাকুস (তৈয়ার করার) নির্দেশ দিলেন, যাতে তার আওয়াজ দ্বারা লোকজনকে— মুসলমানদেরকে নামাযের জন্য ডাকা যায়। তারা যখন এসব চিন্তা-ভাবনা করছিলেন এমন সময় বিলহারিস ইবন খাযরাজের অন্যতম সদস্য আবদুল্লাহ ইবন যায়দ ইবন ছালাবা ইবন আবদ রাব্বিহী স্বপ্নযোগে সালাতের জন্য আহবানের ধরন দেখতে পান। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলেন ঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আজ রাত্রে আমার নিকট একজন আগন্তুক আগমন করে। লোকটির গায়ে দুটাে সবুজ বস্ত্র। তার হাতে ছিল নাকুস। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি কি এ নাকুস বিক্রয় করবে? লোকটি বললো : এটা দিয়ে তুমি কী করবে? আমি বললাম, এ দিয়ে আমি (লোকজনকে) নামাযের জন্য আহবান জানাবো। লোকটি বললোঃ আমি কি তোমাকে এর চেয়েও উত্তম বস্তুর সন্ধান দেব? আমি বললাম, তা কি? সে বললো, (তা এই যে,) তুমি বলবে :
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার
আশাহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ আশাহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ
হাইয়্যা আলাল ফালাহ হাইয়্যা আলাল ফালাহ
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, : আল্লাহ চাহে তো এটা সত্য স্বপ্ন। তুমি বিলালের পাশে দাড়াও এবং আযানের বাক্যগুলো শিখিয়ে দাও, যাতে করে সে, এ বাক্যগুলো দ্বারা আযান দেয়। কারণ, সে তোমার চেয়ে উচ্চকণ্ঠ। বিলাল এ বাক্যগুলো দ্বারা আযান দিলে উমর ইবন খাত্তাব গৃহ থেকেই তা শুনতে পান। তিনি চাদর টানতে টানতে ঘর থেকে বের হয়ে রাসূলের প্রতি ছুটে এসে বললেন, : ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! সে পবিত্র সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তিনি যা স্বপ্নে দেখেছেন, অনুরূপ আমিও দেখেছি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহর।
আবদুল্লাহ ইবন যায়দ ইবন ছালাবা ইবন আবদ রাব্বিহী তাঁর পিতা সূত্রে আমার নিকট এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আবু দাউদ, তিরমিয়ী, ইবন মাজাহ এবং ইবন খুযায়মা বিভিন্ন সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং তিরমিয়ী ইবন খুযায়মা প্রমুখ হাদীছটি সহীহ তথা বিশুদ্ধ ও নিতুল বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম আবু দাউদের মতে তাঁকে ইকামােতও শিক্ষা দেয়া হয়।
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার আশাহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ
হাইয়্যা আলাস সালাহ
হাইয়্যা আলাল ফালাহ
কান্দ কামাতিম সালাহ
কাদি কামাতিম সালাহ
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ!
ইবন সালামা সূত্রে ইবন ইসহাক থেকে পূর্বোক্তের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এরপর তিনি
বলেন, : আবু উবায়দা বলেছেন যে, আবু বকর আল-হাকামী আমাকে জানান যে, আবদুল্লাহ ইবন যায়দ আল-আনসারী এ প্রসঙ্গে বলেন :
আযানের জন্য মহান আল্লাহ যুল-জালাল ওয়াল ইকরামের অশেষ শুকরিয়া।
হঠাৎ আমার নিকট আগমন করে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদদাতা, যিনি আমার নিকট সুসংবাদ নিয়ে আসেন, তিনি কতই না উত্তম!
একের পর এক তিন রজনী তিনি আগমন করেন সে সংবাদ নিয়ে এবং যখনই তিনি আগমন করেছেন আমার মর্যাদা বৃদ্ধিই করেছেন।
আমি বলি এ কবিতামালা তো বিস্ময়কর। এ কবিতার দাবী এই যে, তিনি তিন রজনী স্বপ্নে দেখেন, পরে তিনি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবহিত করেছেন। আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
ইমাম আহমদ মুহাম্মদ ইবন ইসহাক সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, যুহরী সাঈদ ইবন মুসাইয়াব আবদুল্লাহ ইবন যায়দ সূত্রে ইবন ইসহাকের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম ইবন তায়মী সূত্রে; তবে তিনি এ কবিতাটি উল্লেখ করেননি। ইমাম ইবন মাজা খালিদ ইবন আবদুল্লাহ আল-ওয়াসিতী সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন যে, নামাযের আয়োজনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীগণের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তৃতীদের মধ্যে কেউ কেউ সিঙা বা বিউগলের উল্লেখ করলে ইয়াহুদীদের প্রতীক হওয়ার কারণে রাসূল (সা) তা পসন্দ করেননি। এরপর নাকুস-এর কথা উঠলে নাসারার কারণে রাসূল (সা) তা-ও না-পসন্দ করেন। ঐ রাত্রে আবদুল্লাহ ইবন যায়দ নামক জনৈক আনসার এবং উমর ইবন খাত্তাব (রা) স্বপ্নে আযান” দেখতে পান। উক্ত রাত্রেই সে আনসারী ব্যক্তিটি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে তার স্বপ্ন সম্পর্কে অবহিত করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বিলালকে নির্দেশ দেন (এবং বিলাল সে মতে)
আযান দেন। যুহরী বলেন, ভোরের নামাযের আহবানে বিলাল যোগ করেন : আসসালাতু খায়রুম মিনান নাওম (ঘুম থেকে নামায উত্তম) দু’বার। রাসূলুল্লাহ (সা) তা বহাল রাখলেন।
তখন উমর (রা) বললেন, : ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি যেমন স্বপ্নে দেখেছেন, অনুরূপ আমিও স্বপ্ন দেখেছি। তবে তিনি আমার চেয়ে অগ্রগামী। “কিতাবুল আহকাম আল-কাবীর’ গ্রন্থে আযান অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ! আল্লাহর প্রতিই রয়েছে আস্থা
ও ভরসা।
অবশ্য সুহায়লী বাযযার সূত্রে আলী ইবন আবু তালিব থেকে ইসরা বা মি’রাজের হাদীছে উল্লেখ করেন। তাতে উল্লেখ আছে যে, তখন পর্দার অন্তরাল থেকে একজন ফেরেশতা বের হয়ে এসে এ আযান দেন এবং যখনই এক একটা বাক্য উচ্চারণ করেন, তখনই আল্লাহ তার সত্যতা অনুমোদন করেন। তারপর ফেরেশতা মুহাম্মদ (সা)-এর পবিত্ৰ হাত ধরে তাকে আগে বাড়িয়ে দেন এবং তিনি আসমানবাসীদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করেন। তাদের মধ্যে আদম (আ) এবং নূহ (আ:)-ও ছিলেন। এরপর সুহায়লী বলেন, ইসরা তথা মি’রাজের হাদীছের সঙ্গে সামঞ্জস্যের কারণে এ হাদীছটি সহীহ হতে পারে বলে আমি মনে করি। তবে তার ধারণা অনুযায়ী হাদীছটি সহীহ নয়, বরং মুনকার তথা বাতিল। জারূদিয়া ১ ফির্কার আদি পুরুষ আবুল জারূদ যিয়াদ ইবন মুনযির এককভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এ ব্যক্তি অভিযুক্তদের অন্যতম। তিনি মি’রাজ রজনীতে এ আযান শুনে থাকলে অবশ্যই হিজরতের পর নামাযের দিকে ডাকার জন্য এর নির্দেশ দিতেন। আল্লাহই ভাল জানেন।
ইবন উমায়রকে বলতে শুনেছি : নবী করীম (সা) এবং সাহাবীগণ নামাযে সমবেত হওয়ার ব্যাপারে নাকুস ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ করেন। এ সময় উমর ইবন খাত্তাব নাকুসের জন্য দু’টি কাষ্ঠ ক্ৰয়েরও ইচ্ছা করেন। এ সময় এক রাত্ৰিতে উমর (রা) স্বপ্নে দেখেন নাকুস বানাবে না, বরং নামাযের জন্য আযান দেবে। তখন উমর (রা) স্বপ্ন সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ)-কে অবহিত করার জন্য তাঁর নিকট যান। এ সময় নবী করীম (সা)-এর নিকট এ সম্পর্কে ওহী নাযিল হল। এমন সময় বিলালের আযান শুনে উমর ঘাবড়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এ সম্পর্কে অবহিত করা হলে তিনি বললেন, : এ সম্পর্কে ইতোমধ্যেই ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। এ
১. ইসফারাইনী “আল ফারক বাইনাল ফিরাক’ গ্রন্থের ২২ পৃষ্ঠায় বলেনঃ জারূদিয়া ফির্কা যায়দিয়া ফির্কার
অন্যতম উপদল। এরা আবুল জারূদ নামে পরিচিত মুনয্যির ইবন আমর-এর অনুসারী। হযরত আলী (রা)-এর পক্ষে বায়আত না করার কারণে এরা সাহাবীদেরকে কাফির বলে মনে করে। তারা বলে যে, নবী (সা) হযরত আলী (রা)-এর নাম না নিয়ে তাঁর ইমামত তথা নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রতীক্ষিত ইমামের ব্যাপারে এ দলটি আবার অনেক উপদল বা ফির্কায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে একদল নির্দিষ্ট করে কোন একজন ইমামের অপেক্ষায় থাকে না। আবার একদল মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন হাসান ইবন হাসান ইবন আলী ইবন আবু তালিবের অপেক্ষায় আছে। একদল অপেক্ষায় আছে তালিকানের সঙ্গী মুহাম্মদ ইবন কাসিমের; আবার একদল অপেক্ষায় আছে কুফায় বিদ্রোহ সৃষ্টিকারী মুহাম্মদ ইবন উমরের }
থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আবদুল্লাহ ইবন যায়দ ইবন আবদ রাব্বিহী (স্বপ্নে) যা দেখেছিলেন তার সমর্থনে ওহী নাযিল হয়েছিল–যেমনটি কেউ কেউ স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন।
ইবন ইসহাক বলেন : মুহাম্মদ ইবন জাফর সূত্রে বনু নাজারের জনৈক মহিলা মারফত আমি জানতে পেরেছি যে, ঐ মহিলা বলেনঃ মসজিদের নিকটে আমার ঘরটি ছিল সবচেয়ে উঁচু। এ ঘরের ছাদে উঠে বিলাল প্রতিদিন ভোরে আযান দিতেন। শেষ রাত্রে তিনি এসে ঘরের ছাদে বসে। ফজরের অপেক্ষায় থাকতেন। ফজরের সময় হয়েছে দেখতে পেয়ে তিনি দাঁড়িয়ে দুআ করতেন :
“হে আল্লাহ! আমি তোমার প্রশংসা করছি এবং কুরায়শের ব্যাপারে তোমার নিকট সাহায্য কামনা করছি— যাতে তারা তোমার দীন কাইম করে।” মহিলা বলেন, : (এ দু’আ করার পর) তিনি আযান দিতেন। নাজ্জারী মহিলা আল্লাহর কসম করে বলেন? কোন রাতেই তিনি এ দুআটি বাদ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। ইমাম আবু দাউদ এ হাদীছটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন।