ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
দেবেন্দ্র-ভবনে ঠাকুর কীর্তনানন্দে ও সমাধিমন্দিরে
এইবার খোল-করতাল লইয়া সংকীর্তন হইতেছে। কীর্তনিয়া গাহিতেছেন:
কি দেখিলাম রে, কেশব ভারতীর কুটিরে,
অপরূপ জ্যোতিঃ, শ্রীগৌরাঙ্গ মূরতি,
দুনয়নে প্রেম বহে শতধারে।
গৌর মত্তমাতঙ্গের প্রায়, প্রেমাবেশে নাচে গায়,
কভু ধরাতে লুঠায়, নয়নজলে ভাসে রে,
কাঁদে আর বলে হরি, স্বর্গ-মর্ত্য ভেদ করি, সিংহরবে রে,
আবার দন্তে তৃণ লয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে,
দাস্য মুক্তি যাচেন দ্বারে দ্বারে ৷৷
কিবা মুড়ায়ে চাঁচর কেশ, ধরেছেন যোগীর বেশ,
দেখে ভক্তি প্রেমাবেশ, প্রাণ কেঁদে উঠে রে।
জীবের দুঃখে কাতর হয়ে, এলেন সর্বস্ব ত্যজিয়ে,
প্রেম বিলাতে রে,
প্রেমদাসের বাঞ্ছা মনে, শ্রীচৈতন্যচরণে,
দাস হয়ে বেড়াই দ্বারে দ্বারে ৷৷
ঠাকুর গান শুনিতে শুনিতে ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। কীর্তনীয়া শ্রীকৃষ্ণবিরহবিধুরা ব্রজগোপীর অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।
ব্রজগোপী মাধবীকুঞ্জে মাধবের অন্বেষণ করিতেছেন —
রে মাধবী! আমার মাধব দে!
(দে দে দে, মাধব দে!)
আমার মাধব আমায় দে, দিয়ে বিনামূল্যে কিনে নে।
মীনের জীবন, জীবন যেমন, আমার জীবন মাধব তেমন।
(তুই লুকাইয়ে রেখেছিস, ও মাধবী!)
(অবলা সরলা পেয়ে!) (আমি বাঁচি না, বাঁচি না)
(মাধবী, ও মাধবী, মাধব বিনে) (মাধব অদর্শনে)।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাঝে মাঝে আখর দিতেছেন, —
(সে মথুরা কতদূর! যেখানে আমার প্রাণবল্লভ!)
ঠাকুর সমাধিস্থ! স্পন্দহীন দেহ! অনেকক্ষণ স্থির রহিয়াছেন।
ঠাকুর কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ; কিন্তু এখনও ভাবাবিষ্ট। এই অবস্থায় ভক্তদের কথা বলিতেছেন। মাঝে মাঝে মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ) — মা! তাকে টেনে নিও, আমি আর ভাবতে পারি না! (মাস্টারের প্রতি) তোমার সম্বন্ধী — তার দিকে একটু মন আছে।
(গিরিশের প্রতি) — “তুমি গালাগাল, খারাপ কথা, অনেক বল; তা হউক ওসব বেরিয়ে যাওয়াই ভাল। বদরক্ত রোগ কারু কারুর আছে। যত বেরিয়ে যায় ততই ভাল।
“উপাধি নাশের সময়ই শব্দ হয়। কাঠ পোড়াবার সময় চড়চড় শব্দ করে। সব পুড়ে গেলে আর শব্দ থাকে না।
“তুমি দিন দিন শুদ্ধ হবে। তোমার দিন দিন খুব উন্নতি হবে। লোকে দেখে অবাক্ হবে। আমি বেশি আসতে পারবো না, — তা হউক, তোমার এমনিই হবে।”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব আবার ঘনীভূত হইতেছে। আবার মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন, “মা! যে ভাল আছে তাকে ভাল করতে যাওয়া কি বাহাদুরি? মা! মরাকে মেরে কি হবে? যে খাড়া হয়ে রয়েছে তাকে মারলে তবে তো তোমার মহিমা!”
ঠাকুর কিঞ্চিৎ স্থির হইয়া হঠাৎ একটু উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন — “আমি দক্ষিণেশ্বর থেকে এসেছি। যাচ্ছি গো মা!”
যেন একটি ছোট ছেলে দূর হইতে মার ডাক শুনিয়া উত্তর দিতেছে! ঠাকুর আবার নিস্পন্দ দেহ, সমাধিস্থ বসিয়া আছেন। ভক্তেরা অনিমেষলোচনে নিঃশব্দে দেখিতেছেন।
ঠাকুর ভাবে আবার বলছেন, “আমি লুচি আর খাব না।”
পাড়া হইতে দুই-একটি গোস্বামী আসিয়াছিলেন — তাঁহারা উঠিয়া গেলেন।