৪৩. সকালবেলা দুমদুম করে কে দরজা ঠেলছে

সকালবেলা দুমদুম করে কে দরজা ঠেলছে। দরজা খুলে ভূতনাথ দেখলে-বংশী।

—কাল আপনি কত রাত্তিরে এলেন শালাবাবু, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার পায়ে ব্যথা ধরে গেল।…একি আপনার চোখ যে লাল হয়ে রয়েছে, ঘুম হয়নি বুঝি?

ঘরের কোণে এটো বাসনগুলো এক হাতে তুলে নিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলে বংশী। বললে—কাল বড় ভাবনায় পড়েছিলাম আজ্ঞে, আদালতের শমন এসেছিল, ছোটবাবুর কাছে নিয়ে গেলাম, ছোটবাবু পড়ে বললে-মেজবাবুর কাছে নিয়ে যা-তা এক হাতে সব কাজ তো করতে হয়, সব কাজ সেরে মরতে-মরতে গেলাম সেই গরাণহাটায় গিয়ে দেখালাম মেজবাবুকে—মেজবাবুর কী মেজাজ কী বলবো, বলে—আমার দেখার কি দরকার, বাড়ি আমি ছেড়ে দিয়েছি, ওরা যা ইচ্ছে করুক-বাড়ি আমার চাইনে।

আমি বললাম—ছোটবাবু যে আপনার কাছে আনতে বললে হুজুর?

মেজবাবু বললে—তা আমার কাছে এনে কী হবে? আমি কি বাড়িতে বাস করি?

মেজবাবুর পায়ে হাত দিয়ে বললাম—তা ছোটবাবুর তো এই অবস্থা, এখন কেমন করে বাড়ি ছাড়ে?…বিবেচনাটা দেখুন একবার মেজবাবুর।

ভূতনাথ জ্ঞিজ্ঞেস করলে—তারপর?

–তারপর গেলাম সেই পাথুরেঘাটায়। ছুটুকবাবু তো ননীলালবাবুর বন্ধু ছিল, ননীবাবুকে এক কালে কত আসতে দেখেছি। এ-বাড়িতে। ছুটুকবাবুর কথায় যদি ননীবাবু কিছু করে, তা গিয়ে দেখা হলো না-ছুটুকবাবু কাজে বেরিয়ে গিয়েছে।

—কী কাজ? ছুটুকবাবু আবার কি কাজ করছে আজকাল?

বংশী বললে—আমি তার কি খবর রাখি কিছু? ওদের সরকারই বলেছে ছুটুকবাবু নাকি উকিল হয়েছে, আদালতে যায় রোজ।

—ছুটুকবাবু উকিল হয়েছে? শেষকালে কি উকিল হলো নাকি?

বংশী বললে—তাই আপনাকে খুঁজছিলাম আজ্ঞে, আপনি যদি ছুটুকবাবুকে গিয়ে ধরেন, তো ননীবাবুকে বলে মামলা তুলে নেয়। মামলা হলে বড়বাড়ির বাবুদের মামে, তা বাবুরা তো সবাই বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, শুধু ছোটবাবু আর ছটম আছে, কী করে বাড়ি ছাড়ে হুজুর, শরীরের যা অবস্থা তাতে কোথায়ই বা যাবে, এখনও ধরে বসিয়ে মুখে তুলে খাওয়াতে হয় যে!

ভূতনাথ চুপ করে রইল। খানিক পরে বললে—আমি যে কাল দেশে যাচ্ছি রে!

—দেশে? দেশ-এর কথা শুনে বংশীও অবাক হয়ে গিয়েছে। শালাবাবুও দেশ-এ যাবে।—দেশ-এ যে কেউ নেই বলেছিলেন?

—তবু যাবো একবার দেশে, পুরোনো বাড়িটা তো আছে, এতদিনে হয় তো জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছে, হয় তত বাঘ এসে উঠেছে ভিটেয়।

বংশী ভয়ে চোখ বড়-বড় করে রইল। বললে—এ-সময়ে আপনি গেলে চলবে কী করে শালাবাবু, দু’দিন পরে গেলে চলে না?

—না। মামলা কবে?

বংশী বললে-কাল।

ভূতনাথ চুপ করে রইল।

বংশী আবার বললে–কাল না হয় না-ই গেলেন শালাবাবু।

ভূতনাথ এবারও চুপ করে রইল। কী-ই বা সে করতে পারে!

বংশী আবার বললে—আমি কিন্তু আপনার কথা বলেছি ছোটবাবুকে।

—ছোটবাবুকে? কেন?

—আজ্ঞে, ছোটবাবু বড় মুষড়ে পড়েছে, আমি কাল ছুটুকবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে বললাম—কিছু ভাববেন না ছোটবাবু, শালাবাবু লেখাপড়ি জানা লোক, সব তিনি করবেন। তা আপনি একবার যাবেন আজ দেখা করতে ছোটবাবুর সঙ্গে?

–ছোটবাবুর সঙ্গে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, দোষ কী, যে-বিপদে পড়েছেন, আমরা না দেখলে কে দেখবে বলুন তো!

ভূতনাথের তেমন ইচ্ছে ছিল না। তবু বললে—তা চল।

বংশী বললে—আপনি একটু সবুর করুন, আমি সকড়ি বাসন ক’টা রেখে আসি।

আজো মনে আছে দুপুরবেলার বড়বাড়ির সেই বিগত-শ্রী চেহারা দেখে চোখে জল এসেছিল সেদিন। ছাদের ওপর অসংখ্য পায়রা এসে বাসা করেছে। কে তাদের খেতে দেয়, কে তাদের দেখাশুনো করে কে জানে। একদিন এই পায়রা নিয়েই কত মামলা হয়ে গিয়েছে ঠনঠনের ছেনি দত্তর সঙ্গে। কত পয়সা খরচ হয়েছে এদের খাওয়াতে, পুষতে। ভৈরববাবু ভালো শিস দিতে পারতো! সেই শিস শুনে কলকাতার আকাশে মেজবাবুর পায়রা একদিন বুক ফুলিয়ে উড়েছে।

সমস্ত বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। বাড়িটা তিন ভাগে ভাগ হচ্ছিলো। ভালো করে ভাগ হওয়ার আগেই সবাই আলাদাআলাদা হয়ে গেল। পাঁচিলগুলো পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি। বালির কাজ হয়নি শেষ পর্যন্ত। ইটের ফাঁকে-ফাঁকে শ্যাওলা গজিয়েছে। কতরকম বুনো গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ফাটলে-ফাটলে। কতরকম ফুল ফুটেছে গাছগুলোতে। বিচিত্র বুনো ফুল। হলদে, লাল, নীল। রান্নাবাড়ির এটো কাটা এসে জমে পাঁচিলের কোণে। বংশী একা সব ঝাঁট দিতে পারে না।

একটা চিল হয় তো নির্মেঘ আকাশে গোল হয়ে ওড়ে। মাঝেমাঝে কর্কশ ডাক ছাড়ে। সে-শব্দ এখান থেকে শোনা যায়। তারপর কখন বেলা পড়ে আসে, ছায়াটা আস্তে-আস্তে বড় হয়, আর তারপর এক সময় রোদের শেষ আভাটুকু পর্যন্ত মুছে যায় পৃথিবী থেকে। তখন শশী ডাক্তারের গাড়িটা এসে হয় তো লাগে গাড়িবারান্দার নিচে। শশী ডাক্তার লাঠিতে ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় ওপরে। বংশী পেছন-পেছন ওষুধের বাক্সটা বয়ে নিয়ে যায় সঙ্গে-সঙ্গে।

আজো মনে আছে ছোটবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে ভূতনাথ সেদিন খুব চমকে উঠেছিল। প্রথমে ইচ্ছেই ছিল না ভূতনাথের। কখনও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা তো বলেনি ছোটবাবুর সঙ্গে। কিন্তু বংশীর পীড়াপীড়িতে আর না বলতে পারেনি।

বংশী বলেছিল—আপনি বলবেন শালাবাবু যে, আপনি সব ব্যবস্থা করবেন—কোর্টে-কাছারিতে ঘোরাঘুরি আপনিই করবেন, ছোটবাবু যেন কিছু না ভাবেন।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু আমি যে দেশে যাচ্ছি কাল?

—সে কথা আর বলবেন না হুজুরকে, মনে বড় কষ্ট পাবেন।

ভূতনাথ বললে-আমাকে কি চেনেন ছোটবাবু?

—চেনেন না, কিন্তু আমি বলেছি আপনার কথা, বলেছি যে মাস্টারবাবুর শালা, এ-বাড়িতে অনেকদিন আছেন। শুনে চুপ করে রইলেন, বেশি তো কথা বলেন না আজ্ঞে, বেশি কথা কোনোদিনই বলতেন না, এদানি তা-ও ছেড়ে দিয়েছেন। চুপ-চাপ বসে চোখ বুজে কেবল ভাবেন, কী যে মাথা-মুণ্ডু ভাবেন কে জানে?

ঘরের সামনে গিয়ে প্রথমে বংশীই এগিয়ে গেল। ভেতরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে হাতছানি দিয়ে একবার ডাকলে ভূতনাথকে।

ভূতনাথ সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতির দাঁতের কাজ করা একটা পালঙ। মোটা পুরু গদীর ওপর বিছানা পাতা। সামনে শ্বেতপাথরের ছোট টেবিলের ওপর ওষুধের শিশি-বোতল। পাথরের খল-নুড়ি। ঘরময় একটা বিষণ্ণতা। অনেকদিন ওষুধ আর অসুখের গন্ধ জয়ে-জমে ঘরের হাওয়া যেন বিষিয়ে উঠেছে। ঘরে ঢোকবার মুখে একটা তীব্র কটু গন্ধ নাকে লাগে। দেয়ালের পঙ্খের কাজ-করা ফুল লতাপাতাগুলো পর্যন্ত ধোঁয়া লেগে কালো হয়ে গিয়েছে।

ছোটকর্তার গায়ে মলমলের পাঞ্জাবী একটা। কিন্তু ভাঁজেভঁজে আগেকার সে-বাহার নেই আর। ময়লা হয়ে গিয়েছে পরে-পরে। অনেকদিন দাড়ি কামানো হয়নি। দেয়ালের গায়ে বালিশের ওপর হেলান দিয়ে বসেছিলেন ছোটকর্তা। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে কী যেন ভাবছিলেন।

ভূতনাথ যেতেই বংশী বললে—এই যে শালাবাবু এসেছেন— যার কথা বলছিলাম ছোটবাবু।

ছোটকর্তা ঘাড় ফেরালেন।

ভূতনাথ দুটো হাত জোড় করে নমস্কার করলে।

ভূতনাথের মনে হলো—সেই ছোটবাবু, যার সামনে বেরোতে ভয় করত। কী বিরাট চেহারা ছিল। রাশভারী মানুষ। বংশীকে মারতে-মারতে একদিন প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন। কেমন যেন মায়া হলো ভূতনাথের। অনেকদিন আগেকার একটা বটগাছের কথা মনে পড়লো ভূতনাথের। মঙ্গলচণ্ডীতলার পাশে একটা বিরাট বটগাছ ছিল ফতেপুরে। চার-পাঁচ পুরুষের গাছ। ডালপালা বেড়ে-বেড়ে সমস্ত বারোয়ারিতলাটা একেবারে ছেয়ে ফেলেছিল। একদিন ঝড়ের রাত্রে সেই গাছটা হুড়মুড় করে পড়ে গেল। গাঁ শুদ্ধ লোক ভোরবেলা ভিড় করে দেখতে গেল। বিরাট গাছ প্রায় এক কাঠা জমি উপড়ে নিয়ে পড়েছে। কাছে গিয়ে কিন্তু সবাই অবাক হয়ে গিয়েছে। গাছ নয় তো বিরাট বনস্পতি বললেই চলে।

তারক স্যাকরা একটা কুড়ল নিয়ে কোপ মারতে যাচ্ছিলো।

নন্দজ্যাঠা থামিয়ে দিলে। বললে—খবরদার–

ভূষণকাকাও বললে—কেউ কাটতে পারবে না—মা মঙ্গলচণ্ডীর গাছ।

মল্লিকদের তারাপদ বললেও গাছ নদীতে ফেলে আসাই ভালো কাকা।

নন্দজ্যাঠা প্রবীণ লোক। বললে—না, যেমন আছে তেমনি থাক। মায়ের গাছ, মা যা ইচ্ছে করবেন তাই হবে।

মঙ্গলচণ্ডীর কী ইচ্ছে হলো কে জানে! সেই গাছ সেখানেই পড়ে রইল। লোকে মায়ের পূজো দিতে এসে ভাঙা গুড়িটাতেও সিঁদুর লাগিয়ে দিয়ে যায়। ষষ্ঠীপূজোর দিন দলে-দলে মেয়েরা আসে। পূজো দেয় মাকে। আর জল ঢালে গুড়িটার ওপর। কতকাল এমনি করে কেটে যায়। ফাটলের গর্ততে ক্রমে মাটি জমে তার ওপর আগাছা জন্মালো। সেই আগাছাই বড়-বড় হয়ে একদিন ঢেকে দিলে সমস্ত গুড়িটাকে। চড়কের মেলার সময় সেখানটা ঘিরে জলসত্র হতো। আবার মেলার শেষে অন্ধকার রাত্রিতে কেউ মঙ্গলচণ্ডীর পূজো দিতে এসে গুড়িটাকেও প্রণাম করে যেতে। কিন্তু ভূতনাথের বড় ভয় করতোগুড়িটাকে দেখলে। মনে হতো ওখানে যত রাজ্যের সাপ-খোপ যেন বাসা বেঁধে আছে!

কিন্তু মনে আছে বহুদিন পরে যেবার বাঘের উপদ্রবের ভয়ে জঙ্গল কাটার হিড়িক পড়লো ফতেপুরে, দেখা গেল, সে-বটগাছের চিহ্নও নেই। কবে মাটি হয়ে সব শেষ হয়ে গিয়েছে, শুধু বড়-বড় গাছ সেই জায়গায় জন্মে এতদিন আড়াল করে রেখেছিল সেটাকে।

ছোটবাবুর দিকে চেয়ে দেখতে-দেখতে সেই কথাই ভূতনাথের মনে পড়লো প্রথমে।

বংশী বললে—শালাবাবু রয়েছেন, আদালতে যাওয়া, তদ্বিরতদারক করা, সবই করবেন উনি। আপনি ভেবে-ভেবে শরীর খারাপ করবেন না আজ্ঞে।

ছোটবাবু শুনে কিছু বললেন না। শুধু মুখ দিয়ে শব্দ করলেন–হুম।

কী গম্ভীর সে শব্দ। মনে হলো যেন সঙ্গে-সঙ্গে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসও পড়লো তার।

বেরিয়ে এসে বংশী বললে—দেখলেন তো শালাবাবু, কী মানুষ কী হয়েছে!

ভূতনাথ কিন্তু কিছুই শোনেনি। শুধু দেখেছে ছোটকর্তাকে। আর মনে পড়েছে ফতেপুরের সেই বটগাছটার কথা। একদিন কত পাখী আশ্রয় নিয়েছিল তার ডালে-ডালে। বর্ষাকালে কত রকম পাখী আসতে ফল খেতে। তারপর যখন টলে পড়লে তখনও যেন সজীব। গাছে আগাছায় ভরে যখন জায়গাটা আবার ঢেকে গেল, তখনও যেন ভূতনাথ বটগাছটার কথা ভুলতে পারেনি।

বংশী বলেছিল—ছোটমা আপনার ওপর খুব রাগ করেছেন আজ্ঞে।

-কেন রে?

বংশী বললে—আপনি বলেছিলেন, বরানগরে নাকি একদিন নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে।

ভূতনাথ থমকে দাঁড়ালো একবার। বললে—আজ আর যাবো না রে, দেশ থেকে ফিরে একদিন নিয়ে যাবে, বলিস ছোটমাকে। বংশী বললে-কিন্তু ছুটুকবাবুর কাছে একবার যাবেন না?

 

দুপুরবেলা ছুটুকবাবু কোর্টে যায়। কোর্ট থেকে ফিরতে রাত হয় নিশ্চয়ই। ছুটুকবাবুর একটা চিঠি নিয়ে গেলে হয় তো কাজ হতে পারে। ম্যানেজারের কাছে শোনা ছিল সেদিন। এলগিন রোড-এর বাড়িতে কেউ থাকে না আজকাল। ননীলালের শাশুড়ী থাকেন পটলডাঙায়। তাকে যদি কোনো রকমে ধরা যায় তবে কাজ হতে পারে।

ভালোই হয়েছে। ভূতনাথের একবার মনে হয়-হয় তো ভালোই হয়েছে। এরও হয় তো প্রয়োজন ছিল। যখন দক্ষিণ দিক থেকে ঝাপটা এসে জানালা-দরজায় লাগে, একটা অদ্ভুত শব্দ হয় বাতাসের। থর-থর করে কেঁপে ওঠে সমস্ত। মনে হয়, বদরিকাবাবু যেন আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। ভূতনাথ দুই হাত দিয়ে কান দুটো বন্ধ করে। বড় কষ্ট হয় শুনতে। বদরিকাবাবুর হাসিতে যেন পৈশাচিক একরকম উল্লাস আছে। মনে হয়, ও শুনতে না পেলেই যেন ভালো। এক-একদিন আর সহ্য হয় না। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে ভূতনাথ। দোকানপাট আলো লোকজন দেখে সব আবার ভুলে যেতে চেষ্টা করে।

তবু পটলডাঙায় ননীলালের বাড়ির সামনে গিয়ে কেমন সঙ্কোচ হতে লাগলো। কাল দেশে চলে যাবে ভূতনাথ। আজকে একবার শেষ চেষ্টা করা দরকার।

এ-বাড়িতে ননীলালের সঙ্গে আগে অনেকবার এসেছে। কিন্তু ননীলাল ছাড়া আর কারো সঙ্গে তো পরিচয় নেই তার। কাকে ডাকবে, কার কাছে আবেদন-নিবেদন জানাবে তার।

ছুটুকবাবুর কাছেও গিয়েছিল ভূতনাথ। এমন চেহারা দেখবে ছুটুকবাবুর ভাবতে পারা যায় নি। কালো কোট গায়ে। পুরোপুরি উকিলের পোক। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলো।

—এই যে ভূতনাথবাবু, রেওয়াজ কেমন চলেছে আজকাল? ছুটুকবাবুর গালে যেন আরো মাংস লেগেছে। পা-ও ভারী হয়ে গিয়েছে। হাঁটতে কষ্ট হয় বেশ।

এসে ধপাস করে বসে পড়লে চৌকির ওপর। সব শুনে বললে–সে হলে তো খুব ভালোই হতো—কিন্তু হচ্ছে কী করে?

ভূতনাথ বললে—ননীলালকে যদি একটা চিঠি লিখে দেন আপনি, তা হলে সে আর ‘না’ করতে পারবে না।

–ননীলাল!

ভূতনাথ বললে—ননীলালই তো মালিক—সে বললে সব হবে।

ছুটুকবাবু বলে—কিন্তু ননীলাল তত আর কলকাতায় নেই এখন, সে তত বাইরে।

—তা সেখানেই একটা চিঠি লিখে দিন।

ছুটুকবাবু কী যেন ভাবলে একবার। তারপর বললে-মামলা তো কাল। ওদিকে চিঠি যেতে এক মাস, আর আসতেও এক মাস—সে কি এখেনে? দু’ মাসের আগে তো আর তার উত্তর আসছে না।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু ননীলাল আসছে না কেন?

ছুটুকবাবু বললে—সে তত আর ফিরে আসবে না, জানেন না বুঝি?

—ফিরে আসবে না, সে কী?

–না, সে সেখানে মেম বিয়ে করে সুখে-স্বচ্ছন্দে আছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে, সে আর আসবে না-এখানে খবরও দিয়েছে। সেখানেও ব্যবস-ট্যাবসা শুরু করে দিয়েছে নাকি শুনেছি। তুখোড় ছেলে, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিল ওর আদর্শ-বর্ণে-বর্ণে সব তাকেই ফলো করছে।

ভূতনাথ কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে রইল খানিকক্ষণ। কোথায় সেই কেষ্টগঞ্জের ডাক্তারের ছেলে ননীলাল! তার সেই চিঠিখানা বোধহয় এখনও আছে ভূতনাথের টিনের বাক্সে। শেষ পর্যন্ত যে ননীলালের এমন পরিণতি হবে, কে জানতো! অবাক লাগে ভাবতে! এখানেই তো সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকতে পারতো। অত বড় বাড়ি করেছিল এলগিন রোড-এ। অনু জুট মিল। অত কয়লার খনি। অত লোক-জন, অত আয়, অত খাতির। এতেও বুঝি তৃপ্তি হলো না তার। ননীলালদের বুঝি কিছুতেই তৃপ্তি নেই।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—ওর এখানকার কারবার কে দেখছে। তাহলে?

—ওর শালারা, চালু করে দিয়েছিল ননীলাল, এখন চলবে না কেন? না-চলবার কী আছে?

কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যায় কে বলতে পারে। ননীলালের খবর শুনে ঠিক অবিমিশ্র আনন্দ যেন হয় না। কোথায় যেন একটু বেদনা লুকিয়ে থাকে। ঠিক প্রকাশ করে বলা যায় না কেন অমন হয়। অথচ ননীলালের এ-গৌরবে ভূতনাথের তত আনন্দ হবারই কথা!

ছুটুকবাবুর কাছ থেকে কোনো সাহায্যের আভাষ না পেয়ে ভূতনাথ নিজেই এসে পটলডাঙার বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েছে। বাড়িটার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে দেখলে। কোথাও কারো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দারোয়ানকে ডেকে বললে—বাড়িতে বাবুরা আছে?

–কোন্ বাবু? ছোটবাবু না বড়বাবু?

—যে-কোনো বাবু।

দারোয়ান বললে—এই কাগজটাতে নাম-ঠিকানা লিখে দিন, ভেতরে নিয়ে গিয়ে দেখাবো বাবুদের।

কাগজে ভূতনাথ নিজের নাম আর বড়বাড়ির ঠিকানা লিখে দিলে।

দারোয়ান কাগজ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ভূতনাথকে। মনে হলো—বৌঠানের জন্যেই এই চেষ্টা। নইলে বড়বাড়ির জন্যে ভূতনাথের কীসের মাথাব্যথা। আজ যদি মামলার ফলে বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়, কোথায় যাবে বৌঠান! অথচ আশ্চর্য, বৌঠান বোধহয় সে-কথা একবার ভাবেও না। বংশীর কাছে শুনেছে আজো নাকি তেমনি তেতলার ঘরখানার মধ্যে পালঙে বসে বৌঠান যশোদাদুলালের পূজো দেয়, আলতা পরে, ঘুমোয়, চিন্তার সঙ্গে গল্প করে আর একটা-একটা করে গয়না তুলে দেয় বংশীর হাতে।

বংশী বললে—সমস্ত সিন্দুক প্রায় খালি হয়ে গিয়েছে শালাবাবু!

ভূতনাথ বলেছিল—তুই কেন এনে দিস বংশী?

বংশী বলে-ভুবন স্যাকরা তো সন্দেহ করে আমাকে, জানেন, ভাবে বুঝি চোরাই মাল। সেদিন আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছিলো হুজুর। আমি বললাম—চোরাইমাল যদি হবে তো রোজ-রোজ এত চুরি করবে কোখেকে?

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—এখন কতখানি করে খায় রোজ?

বংশী বলে—বাড়ছে হুজুর, দিন-দিনই নেশা বাড়ছে যে, এখন সকালে একবোতল আনি, দেখি বিকেলের মধ্যে সেটা শেষ হয়ে গিয়েছে—আবার আজকাল দামী-দামী মদ আনতে বলেন—আমি প্রথম-প্রথম আনতুম না আজ্ঞে, কিন্তু বুঝতে পারি, বড় কষ্ট হয় ছোটমা’র, না-খেলে শরীর খারাপ হয়, কিছু খেতে পারে না, ঝিমোয় সারাদিন-ঝিম মেরে থাকেন। আমার নিজেরই তখন কষ্ট হয়, ভারী নেশা করে ফেলেছেন—ছোটমার’ই বা কী দোষ।

বংশী আবার বলে—সেজখুড়ি গজগজ করে সারাদিন, বলেখাবে না যদি কেউ তো রান্না কিসের জন্যে—এত ভাত নষ্ট হলে গেরস্থের অকল্যণ হয় যে। তা নেই-নেই যে এত—তার মধ্যেও কত কী যে রান্না হয় কী বলবোছোটবাবুর মুখের কাছে সব দিতে হবে, তেতো, ভাজা, ডালনা, ডাল, ঝোল, অম্বল, সেই আগেকার মতন—দেখছেন তো, কিন্তু মুখে পুরেই বলে—থুঃ থুঃ।

অথচ দেখুন, মুদির দোকানে দেনা হয়েছে। সেদিন তাগাদা করছিল। দু’মাস হয়ে গিয়েছে, এখনও শোধ হলো না, ওরা বলবেই তো–ছোটমাকে বললেই—সিন্দুক খুলে একটা কিছু-না–কিছু গয়না বার করে দিয়ে বলেদিগে যা শোধ করে।

ননীলালের বাড়ির সামনে তা প্রায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হলো।

দারোয়ান এক সময়ে ফিরে এসে বললে—দেখা হবে না। বাবুদের সময় হবে না এখন।

ভূতনাথ কী বলবে যেন ভেবে পেলে না। তারপর জিজ্ঞেস করলে-বাবুরা বাড়িতে আছেন?

দারোয়ান বললে—আছে, লেকিন মোলকাত হবে না।

হবে না তো হবে না। বড়লোকদের বাড়িতে নিয়মই আলাদা। হয় তত বসে গল্প করছে নয় তো শুয়ে আছে। দেখা করলে কী এমন অসুবিধে হতো! দুটো মাত্র কথা। কতটুকু সময়ই বা লাগতো। কিন্তু দরকার নেই। যাদের সময়ের অত দাম, একদিন তারাই আবার সময় কাটাবার পথ খুঁজে পাবে না। একদিন চৌধুরীবাবুদেরই কী হাঁক-ডাক কম ছিল! সবাই তটস্থ। কোথায় গেল সব। দেখতে-দেখতে, কপুরের মতো উবে গেল তো! সুবিনয়বাবু বলতেন-ভোগই মৃত্যু, ত্যাগই হচ্ছে জীবন-তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথাঃ, ত্যাগ করে ভোগ করতে শেখা এ ভারতবর্ষের নিজস্ব উপলব্ধি—এ আর কোনো দেশে খুঁজে পাবে না ভূতনাথবাবু। কিন্তু ননীলাল কি চৌধুরীবাবুরা কেউ তো সেকথা মানে নি। আর ব্ৰজরাখালের কথাই তো আলাদা।

রাস্তায় বেরিয়ে সেদিন হঠাৎ বহুদিন বাদে প্রকাশ ময়রার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কাঁধে নতুন গামছা। দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। চেহারাটাও যেন ভালো হয়েছে।

ভূতনাথকে দেখেই বললে-পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই।

ভূতনাথ বললে-তুমি এত রাত্রে কোথায় প্রকাশ?

—আর ঠাকুরমশাই, ব্যবসাই বলুন, চাকরিই বলুন, কিছুই পোষালো না, শেষকালে সেই ঘটকালি নিয়েই আছি এখন। কাল আপনাদের দেশে যাচ্ছি, একটা বিয়ে আছে, যাবেন নাকি?

ভূতনাথের কেমন যেন একটা প্রশ্ন উঠলো মনের ভেতর।

-আচ্ছা, প্রকাশ তুমি তো এ-পর্যন্ত অনেক বিয়ে দিয়েছে, কী বলে?

—তা দিয়েছি ঠাকুরমশাই, এই খাতাখানা খুললে পাকা হিসেব বলতে পারি আপনাকে।

হিসেব দেখতে সেদিন চায়নি ভূতনাথ। হির্সেবের দরকারও ছিল না তার। শুধু বলেছিল–ছোট-ঘোট ছেলেমেয়ের বিয়ে কখনও দিয়েছো তুমি?

-আজ্ঞে হ্যাঁ, এই তো সেদিন, শ্রাবণ মাসে বেগমপুরের বিধু গাঙ্গুলীর ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলাম—মাত্র দু বছর বয়েস।

—দু’ বছর?

প্রকাশ দাস গল্প পেলে আর থামতে চায় না। বলে-দু’ বছর তো ভালো আপনার, দু’মাস বয়েসে বিয়ে দিয়েছি।

–দু’ মাস বয়েস কনের?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, দু মাস মাত্তোর—বাড়জে মশাই বলছিলেন, আমার দু’বছরের ছেলের জন্যে একটা পাত্রী দেখে দিতে পারে। প্রেকাশ? আমি বললাম—প্রেকাশের হাতে সব রকম পাত্তোর পাবেন বাড়জ্জে মশাই। তা তাই খুঁজে দিলাম, বাড়জ্জে মশাই খুব খুশি। খুব আয়োজন করেছিল আজ্ঞে, তিন রকমের মিষ্টি, চার রকমের মাছ, দু রকমের ডাল, পাকা ফলার, কাঁচা ফলার —সব রকম ব্যবস্থা ছিল। বাড়জ্জে মশায়কে চেনেন না আপনি–আপনাদেরই জেলার লোক তো?

প্রকাশ ময়রা সেই বিয়েরই গল্প করতে লাগলো। বলে–তবে শুনুন ব্যাপারটা—ভারী এক মজার কাণ্ডবলরামপুরের কালী মুখুজ্জের দুই মেয়ে ছিল, জানেন?

–বলরামপুর? বলরামপুর চেনো নাকি? ভূতনাথ সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছে।

-খুব চিনি। বলরামপুরের কালী মুখুজ্জের ছোট মেয়ের বিয়ে দিলাম আমি—তারই কাণ্ড তো বলছি।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—বলরামপুরের রামহরি ভট্টাচার্যের নাম শুনেছো?

–রামহরি ভট্টাচার্যি? দাঁড়ান, খাতা খুলতে হবে বলে সত্যি-সত্যিই খাতা খুলতে গেল প্রকাশ।

ভূতনাথ বললে—না, না, খাতা খুলতে হবে না এখন, তার বংশের কেউ আছে এখন জানো?

প্রকাশ বলে—খাতা না দেখে সে কি বলতে পারি ঠাকুরমশাই, আর এ-খাতায় যদি না থাকে তো অন্য খাতা দেখতে হবে, বংশতালিকা না রাখলে চলবে কেন আমাদের, যে-ব্যবসার যা নিয়ম, এ-খাতাতে আপনারও পূর্বপুরুষের নাম-ধাম মিলে যেতে পারে, তেমন করে খাতা রাখতে পারলে কত উপকার দেয়, এই দেখুন না, কালী মুখুজ্জের মেয়ের মাত্তর দু’মাস বয়েস সবে, বললেন—পাত্তোর খুঁজে দিতে হবে—কুলীন পাত্তোর—পারবে?

আমি বললাম—এ আর বেশি কথা কি—তা তিনি একটা টাকা দিলেন রাহা-খরচা।

–দু’ মাসের কনে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, প্ৰেথম মেয়ের বিয়ে নিয়ে এক কাণ্ড হয়ে গিয়েছিল কিনা—মেয়ের যখন পাঁচ বছর বয়েস সেই সময় চুরি হয়ে গিয়েছিল মেয়ে—এক ভঙ্গ কুলীন চুরি করে নিয়ে গিয়ে তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল কিনা—সেই ভয়েই এই মেয়েরও বয়েস বাড়বার আগেই বিয়ে দিচ্ছেন।

একাশ বেশ জমিয়ে গল্প বলতে পারে। কিন্তু রাত হয়ে গিয়েছে। বড়বাড়িতে ফিরতে হবে। এতক্ষণ হয় তো বংশী অপেক্ষা করে-করে শুয়ে পড়েছে। ভাত ঢাকা আছে চোরকুইরিতে। গেট-এর চাবি খুলে অন্ধকারে ঢুকতে হবে। আজকাল ও-বাড়িকে বাইরে থেকে যেন অন্ধকার ভূতের বাড়ি মনে হয়। কিন্তু একবার চোরকুরির ভেতর ঢুকতে পারলে আর কিছু মনে থাকবে না। আজকাল সমস্ত মনটা জুড়ে বসে আছে জবা। জবাকে নিজের ঘরের মধ্যে কল্পনা করে নিয়ে অনেক সম্ভব-অসম্ভব ঘটনা ঘটানো যায়। মনে করে নেওয়া যায়—সেই জবা তার এই চোরকুইরিতে এসেছে। এসে হয় তো তারই বিছানায় বসেছে। এক সময়ের মনিব, আজ তার স্ত্রী—ভাবতেও যেন শিউরে ওঠে সমস্ত শরীর। কতদিন কতভাবে কত অপ্রিয় কথা বলেছে। পাড়াগেঁয়ে বলে কত ঠাট্টা করেছে তাকে। জবার ছোঁয়া হাতের রান্না পর্যন্ত কখনও খায়নি ভূতনাথ। অথচ…

অন্ধকার রাত্রে মনে হয় যেন জবার শাড়ির খসখস শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। যেন জবার চুলের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভাসছে।

তারপর সত্যি-সত্যিই ভূতনাথ চোরকুঠুরির শক্ত তক্তপোশটার ওপর চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করে। সমস্ত রাত্রিটা একরকম অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কাটে। মাথার মধ্যে সমস্ত যেন গোলমাল হয়ে যায়। মনে হয় সমস্ত ঘটনাটা যেন স্বপ্ন। স্বপ্নের মতো অবিশ্বাস্য, অসম্ভব, অলৌকিক।

পরদিন বংশীও অবাক হয়ে গিয়েছে। বংশী বলে—এ কি, আপনি যে বললেন আজ দেশে যাবেন?

ভূতনাথ বললে-যাওয়া আর হলো কই? মামলার দিন পড়লো কাল। ছুটুকবাবুর কাছে গিয়েছিলাম—সমস্ত দিন তাইতেই নষ্ট হলো।

-কী হলো মামলার?

ভূতনাথ বলে—আমি কেঁদে গিয়ে পড়লাম ছুটুকবাবুর কাছে, বললাম আপনি ‘দিন’ নিয়ে নিন, নইলে বড়বাড়িরই বদনাম, যদি ওরা পুলিশ-পেয়াদা দিয়ে বাড়ি দখল করে সে কি তখন ভালো হবে?

–দিন পড়লে কবে?

ভূতনাথ বললে—সে আবার একমাস পরে শুনানি হবে, তখন যা হয় ভাবা যাবে। এখন তো চিঠি লিখে দেওয়া হয়েছে ননীলালের কাছে, ছুটুকবাবু পুরানো বন্ধু, এ-কথাটা কি আর রাখবে না তার। কত টাকাকড়ি নিয়েছে এককালে ছুটুকবাবুর কাছে, মনে আছে তার নিশ্চয়ই।

বংশী বললে—যাই, খবরটা একবার দিয়ে আসি ছোটবাবুকে ঝপ করে, বড় ভাবছিলেন ক’দিন আজ্ঞে।

—কিছু বলেন নাকি?

-না, বলেন না কিছু, কেবল আকাশের দিকে চেয়ে চুপ করে ভাবেন সারাদিন, আমি তো বুঝতে পারি সব—শুনলে খুশি হবেন খুব।

—আর ছোটমা, ছোটমা ভাবছেন না?

বংশী বলে—ছোটমা’র ওসব ভাবনা নেই শালাবাবু, ছোটমা’র কেবল ঠাকুরপুজো আর ওই…

-মদ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, এখন আর কামাই দেন না আজ্ঞে, যতদিন যাচ্ছে তত বাড়ছে যেন, কেন যে এমন দশা হলো, ভগমান জানে।

ভূতনাথও আর যেন ভেবে ঠিক করতে পারে না। কেন এমন হয়। তবু সুবিনয়বাবুর কথাগুলো বারবার মনে পড়ে—তিনি বলতেননিজেকে ছোট বলে ভাবছি বলেই, ছোট চিন্তায়, ছোট বাসনায়, মৃত্যুর বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকছি বলেই হয় তত জীবনের অমৃতরূপ প্রত্যক্ষ হচ্ছে না। তাই বুঝি শরীরে দীপ্তি নেই, মনে নিষ্ঠা নেই, কাজে ব্যবস্থা নেই, চরিত্রে শক্তি নেই। জগৎজোড়া নিয়মের সঙ্গে, শৃঙ্খলার সঙ্গে সৌন্দর্যের সঙ্গে মিল হচ্ছে না কারো। মনে হয়—তাই বুঝি মৃত্যুকেই চরম ভয় বলে মনে করি, ক্ষতিকেই চরম বিপদ বলে ধারণা করি। শ্রম বাঁচিয়ে চলি, নিন্দা বাঁচিয়ে চলি কিন্তু সত্যকে বাঁচিয়ে চলি না, ধর্মকে বাঁচিয়ে চলি না, আত্মার সম্মান বাঁচিয়ে চলি না। অথচ চোখের সামনে ব্ৰজরাখালকে দেখেছে, সুবিনয়বাবুকে দেখেছে—তবু তাদের মতন প্রাণমন খুলে কেন বলতে পারে না—আমি ধ্বংসকে স্বীকার করবে না, এই মৃত্যুকে মানবব না—আমি অমৃতকে চাই—নমস্তেহস্তু!

সেদিন রূপচাঁদবাবু জিজ্ঞেস করছিলেন—ওদিকে আর গিয়েছিলেন নাকি, সুবিনয়বাবুর বাড়ি? জবা-মা কেমন আছে?

ভূতনাথ বললে—দু’তিন দিন যাইনি—তবে ভালোই আছেন।

রূপচাঁদবাবু বললেন—আমি যাবো-যাবে করেও যেতে পারছি, কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, কোনো অসুবিধে হলে আমায় বলবেন, লজ্জা করবেন না যেন জবা-মা’র হয় তো বলতে লজ্জা হতে পারে।

সেদিন সরকারবাবু বললে—আসুন, আসুন ভূতনাথবাবু, কী কপালই করে এসেছিলেন—একেবারে দশাসই কপাল মশাই।

—কেন, কী হলো?

–আর কী হবে, নিন, এখানে সই করুন।

—এ কী?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, এবার থেকে ওভারসিয়ারদের খাতায় আপনার নাম উঠেছে। বলেছিলাম না আপনাকে, আপনি কি আর বেশি দিন বিলবাবু থাকবেন? তা এমন কপাল দেখলেও আনন্দ হয়, মশাই! বাবুর নিজের হুকুম—দেখছেন কি, সই করুন।

বারো টাকা থেকে একেবারে কুড়ি টাকা। সমস্ত শরীরে কেমন রোমাঞ্চ হয় ভূতনাথের। সরকারবাবু বললে–কালীঘাটে গিয়ে মায়ের পূজো দিয়ে আসবেন আগে, ওই বিপিনবাবু, বিজয়বাবু আজ তিন বচ্ছর বিলবাবুই রয়ে গেলেন, একটি পয়সা মাইনে বাড়লো না আর আপনার তো পোয়াবারো।

সরকারবাবুর কথাগুলো ঠিক নিছক উল্লাস প্রকাশ নয়। তবু সব সহ্য করাই ভালো।

ভূতনাথ বললে—আমার সেই ছুটির দরখাস্তখানার কী হলো?

—ছুটি তো আপনার হয়ে গিয়েছে, সাত দিনের তো—কবে থেকে যাচ্ছেন? আপনার হলে গিয়ে সবই স্পেশ্যাল ব্যাপার আপনার ছুটি আটকায় কে, বলুন?

ইদ্রিসও খুব খুশি হয়েছে। বলে—তা হোক ওভারসিয়ারবাবু, এবার যেন আর আপনার দস্তুরি ছাড়বেন না তা বলে-ইঞ্জিনিয়ার বাবুরা পর্যন্ত নেয়, আর আপনার নিলেই দোষ। বলে—মাসে যদি পাঁচ টাকাও হয় তো বছরে কত হলো ইয়ে হিসেব করুন।

ভূতনাথ বলে—চাকরিটা থাকলেই বাঁচি ইদ্রিস, কত কষ্টের চাকরি তা তুমি জানবে কী করে!

অথচ এই কলকাতায় আসবার জন্যে একদিন ছোটবেলায় মিত্তিরদের টিপ-চালতে গাছের ডগায় উঠেছিল ভূতনাথ। কিন্তু সেই স্বপ্নের কলকাতার সঙ্গে তার চোখে-দেখা কলকাতা কি মিলেছে। হয় তো মিলেছে কিম্বা হয় তো মেলেনি। কিন্তু মনে হয় এখানে না এলে সে বুঝি মানুষের মহাযাত্রার মিছিল এমন স্পষ্ট করে দেখতে পেত না। সেই ব্রাহ্মসমাজ, সেই ভারত-সভা, সেই উনবিংশ শতাব্দীর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দিয়ে আজ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে মহাযাত্রা শুরু হয়েছে তার পরিচয় পেতো না। জানতে পেতো না কেমন করে ধীরে-ধীরে মানসলোকের সঙ্গে মর্তলোকের সমন্বয় সাধন হয়। কেমন করে সনাতন শাশ্বত ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আজ ভূতনাথ জানতে পেরেছে মানুষেমানুষে কোনো বিচ্ছেদ নেই। সমস্ত মানুষ এক জাত। তাই একের পাপের শাস্তি অন্যকে গ্রহণ করতে হয়, প্রবলের উৎপীড়ন দুর্বলকে সহ্য করতে হয়। একজনের পাপের ফল সকলকে ভাগ করে নিতে হয়। অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে-হৃদয়ে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে অভিন্ন। এ-ও কি কম শিক্ষা। তাই সুবিনয়বাবু বলতেন—’বিশ্বানি দুরিতানি পরাসুব’। বিশ্বপাপ মার্জনা করো। আজও ভূতনাথ তাই তার মেসের ঘরটার মধ্যে ভাঙা তক্তপোশের ওপর শুয়ে প্রার্থনা জানায়—যে-দেবতা সকল মানুষের দুঃখ গ্রহণ করেছেন, যার বেদনার অন্ত নেই, যার ভালোবাসারও অন্ত নেই, তার ভালোবাসার বেদনা যেন সমস্ত মানব সন্তান মিলে গ্রহণ করি। তাই তো মনে হয় যেখানে প্রেম সব চেয়ে গভীর, আঘাত বুঝি সেইখানেই সব চেয়ে নিষ্ঠুর হয়ে বাজে। যার হৃদয় কোমল, তাকেই সমস্ত বেদনা বইতে হবে। যাদের গায়ে পুলিশের লাঠি লাগে তাদের বেদনা তত কঠিন নয়, কিন্তু ঘরের কোণের পটেশ্বরী বৌঠানের আঘাতই যেন সব চেয়ে করুণ, সব চেয়ে কঠিন। শহরে না এলে কি এমন করে এই পরম সত্যকে কখনো জানতে পারতো ভূতনাথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *