1 of 2

৪৩. শ্রাবণ মাসে যখন তখন বর্ষা নামে

শ্রাবণ মাসে যখন তখন বর্ষা নামে। ফুলে ফেঁপে উঠেছে পদ্মা ও গোরাই নদী। অনেক দিন পর পদ্মবোটটিকে আগাপাশতলা মেরামত করিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে। বিশাল এই বজরাখানি একটি বিস্ময়কর দর্শনীয় বস্তু, যেন ধপধপে সাদা রঙের একটি অলৌকিক পাখি। ভেতরে রয়েছে দুটি বড় বড় কক্ষ, তাতে আরাম-বিলাসের কোনও উপকরণের অভাব নেই, মেঝেতে গালিচা পাতা, চেয়ার-টেবিল-পালঙ্ক দিয়ে সাজানো, এমনকী ঝাড়লণ্ঠন পর্যন্ত রয়েছে। ওপরের প্রশস্ত ছাদে এক পরিবারের বিশ-পঁচিশজন পর্যন্ত বসতে পারে।

এই বজরাটি তৈরি করিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। ঢাকার অভিজ্ঞ কারিগরদের হাতে গড়া এই শোভনসুন্দর বজরাটি দেখে অন্যান্য জমিদাররা ঈর্ষা বোধ করতেন। পরে দেবেন্দ্রনাথ এই বজরায় কলকাতা থেকে কাশী-এলাহাবাদ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। আকারে এত বড় হলেও বারোটা দাড় ফেলে এই বজরা চালানো যায় বেশ দ্রুত গতিতে। দেবেন্দ্রনাথ বহুদিন বাড়ি ছেড়ে এই বজরাতেই বাস করেছেন।

এখন বজরাটি বাঁধা থাকে পদ্মবক্ষে শিলাইদহের ঘাটে। রবি এটির নাম দিয়েছেন পদ্মাবোট। এখন আর এই বোটটি বেশি দূর যায় না। মাঝে মাঝে যখন লোকজনের উপদ্রব খুব বেড়ে যায়, লেখার জন্য নির্জনতার প্রয়োজনে রবি পদ্মাবোটকে কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে একা একা রাত্রিবাস করেন।

এবারে রবি শিলাইদহে এসেছেন পুরো পরিবার সঙ্গে নিয়ে। তার জন্য কুঠিবাড়িটিও সাফসুতরো করে কিছুটা অংশ বাড়ানো হয়েছে। এই বাড়িটি কিন্তু নদীর ধারে নয়, বেশ দূরে একেবারে ফাঁকা মাঠের মধ্যে। প্রাক্তন নীলকুঠিটি পদ্মার গ্রাসে বিলীন হয়ে যাবে, এই আশঙ্কায় সেখানকার বেশ কিছু দরজা-জানলা, কড়িবর্গা খুলে এনে নির্মিত হয়েছে, এই নতুন বাড়িটি। পদ্মার ভাঙন অবশ্য নীলকুঠির একেবারে প্রান্তে এসে রুদ্ধ হয়ে গেছে, তাই নীলকুঠির কঙ্কালটি এখনও দাড়িয়ে আছে সেখানে। নতুন বাড়িটি কাছারি বাড়ি থেকেও দূরে, অন্য দিকে খরসেদপুর গ্রাম অস্পষ্ট ভাবে দেখা যায়।

সবাই মিলে কুঠিবাড়িতেই ওঠা হয়েছে, রবিও সেখানেই থাকেন, আবার এক একদিন চলে আসেন পদ্মাবোটে। পরিবারের অন্য লোকজনদেরও এই বোটে আসা নিষিদ্ধ নয়। লেখা থামিয়ে এক এক সময় তিনি নিজেই ছেলেমেয়েদের ডাকেন। মাধুরী, রথী, রানী, মীরা আর শমী এই পাচটি ছেলেমেয়ে, এক ভ্রাতৃপুত্ৰ নীতীন্দ্রও সঙ্গে এসেছে। পরপর দুদিন একটানা বৃষ্টির পর আজকের সকালটি ঝলমল করছে রোদে, সবাই এসে বসেছে বজরার ছাদে, শুধু মৃণালিনী আসেননি। ছেলেমেয়েদের খুব শখ কুমির দেখার, পদ্মায় মাঝে মাঝেই বাজে-পোড়া গাছের মতন কুমির ভেসে ওঠে, আবার টুপ করে ডুবে যায়। শীতের সময় যখন নদীতে চড়া পড়ে, তখন দেখা যায় বালির অপর তিন চারটি কুমির এক সঙ্গে পাশাপাশি শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। পাশ দিয়ে কোনও বড় নৌকো গেলে তারা সর সর করে জলে নেমে যায়। দু’দিন আগেও গোরাই নদীর মোহনার কাছ থেকে কুমির একটা ছাগল ধরে নিয়ে গেছে, তাই নিয়ে স্থানীয় ছেলেরা খুব উত্তেজিত। কুমিরগুলোর আকার এত বড় বড় যে, তাদের ধরা কিংবা মারা সহজ নয়।

নীতীন্দ্র কৌতুক করছে খুড়তুতো ভাইবোনদের সঙ্গে। নদীতে কিছু একটা ভেসে যাচ্ছে, সেদিকে আঙুল তুলে বলছে, এই দ্যাখ, এই দ্যাখ কুমির! ছোটরা অমনি চোখ বড় বড় করে বলছে, কই, কই?

একটা চেয়ারে বসে রবি ডব্লু এইচ হাসানের লেখা ‘গ্রিন ম্যানসনস’ বইটি পড়ছেন ও মাঝে মাঝে চোখ তুলে সহাস্যে ছেলেমেয়েদের ঔৎসুক্য ও ব্যগ্রতা দেখছেন। তার পরনে শুভ্র ধুতি ও বেনিয়ান, পায়ে লাল রঙের রেশমি ঢটি।

একটু পরে নীতীন্দ্র বলল, রবি, এই রথীটা বড্ড ভিতু হয়েছে। জলের এত ভয়। আমি ওকে বলি, চল জলবোটে করে দুজনায় মিলে ওপারে গিয়ে কচ্ছপের ডিম খুঁজে আনি, তা ও যাবে না। ও খালি বলে, যদি নৌকো উল্টে যায়! এত ভয় পেলে চলে?

তিন মাস আগে উপনয়নের সময় ন্যাড়া হয়েছিল রথী। এখন তার মাথাটি কদম ফুলের মতন। সদ্য দশ বৎসর পেরিয়ে এগারোতে পা দেওয়া বালক সে, মুখখানি লজ্জা মাখানো।

রবি বই মুড়ে রেখে উঠে এসে রথীর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, সে কী রে, রথী, তুই জলকে এত ভয় পাস। এ তো জলেরই দেশ। সাতার শিখলে ভয় কেটে যাবে। বদন মিঞাকে বলে দেব, কাল থেকে তোকে সাতার শেখাবে।

রথী ছটফটিয়ে বলল, না, আমি সাঁতার শিখব না। কুমিরে কামড়াবে।

রবি হেসে বললেন, কুমির কোথায়, নিতু তোদের ভয় দেখাচ্ছে। মানুষজন দেখলে কুমির পালায়। গ্রামের সব ছেলেই তো সাতার শেখে।

রথী তবু বলল, না, আমি জলে নামতে পারব না।

রবি বললেন, জলে নামবি না?

তারপরেই, তিনি রথীকে দু’হাতে উচু করে তুলে ছুঁড়ে দিলেন নদীতে।

সবাই আঁতকে উঠল। ছোট্ট মীরা কেঁদে ফেলল ভ্যাঁ করে। কয়েকজন দাঁড়ি মাঝি নীচ থেকে ব্যস্তু হয়ে বলল, কী হল, কী হল, কেউ পড়ে গেল নাকি?

রবি হাত তুলে বললেন, কিছু হয়নি, আর কেউ জলে নামবে না।

জলের মধ্যে হাঁকুপাঁকু করছে রথী। একবার ডুকছে, একবার ভাসছে। সে চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করছে, শোনা যাচ্ছে না।

শমী জড়িয়ে ধরেছে রানীকে, মাধুরীলতা রবির হাত চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগল, বাবা, রথী ডুবে যাবে, রথী ডুবে যাবে!

রবি মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, দ্যাখ না, কিছু হবে না।

নীতীন্দ্র বলল, রবিকা, আর ও পারবে না। আমি জলে নামব?

এবার মনে হল থাকে স্রোতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

রবি নীতীন্দ্রকে থামিয়ে দিয়ে ঝটিতি নিজের পিরান খুলে ফেললেন, মালকোঁচা বাঁধলেন ধুতিতে, তারপর ঝাঁপ দিলেন জলে। সাঁতার কেটে রথীকে ধরে ফেলেও তক্ষুনি তাকে তুললেন না, এক একবার জলের ওপর ভাসিয়ে দিয়ে আবার ছেড়ে দিয়ে বললেন, হাত-পা এক সঙ্গে ছোড়ার চেষ্টা কর। আমার সঙ্গে সঙ্গে আয়—

প্রায় আধঘণ্টা জলে দাপাদাপি করে তারপর পাড়ে উঠলেন দু’জনে। রথীর পিঠে চাপড় মেরে বললেন, আর একদিন এ রকম করলেই তুই সাঁতার শিখে যাবি। তারপর আমার সঙ্গে নদী এপার-ওপার করবি তুই।

সত্যিই তাই, আর দুদিনের মধ্যেই রথী সাঁতার শিখে গেল, তারপর আর সে জল ছেড়ে উঠতেই চায় না। তাকে জোর করে টেনে তুলতে হয়।

চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে জ্যোতিদাদা ও নতুন বউঠানের সঙ্গে থাকবার সময় রবি গঙ্গায় যেমন রোজ সাঁতার দিতেন, এখানে আর তেমনটি হয় না। এখানে তাঁকে জমিদার সেজে থাকতে হয়। তবে তাঁর সাঁতার কৃতিত্বের কথা এখানেও অনেকেই জানে। কয়েক বছর আগে, রথী যখন আরও ছোট ছিল, তাকে সঙ্গে নিয়ে রবি একবার এসেছিলেন। একদিন এই রকমই বোটের ছাদে বসে সন্ধেবেলা বই পড়ছিলেন। বই পড়ার সময় পা দোলানো তার অভ্যেস, তার পায়ে কটকি চটি। হঠাৎ পা দোলানিতে এক পাটি চটি পড়ে গেল জলে। চটি জোড়া খুব পুরনো হলেও প্রিয়, অনেক পুরনো পোশাক, পুরনো জুতো পরলে বেশি আরাম লাগে। বোট তখন মাঝ নদীতে, জলে প্রবল স্রোত, চটিটা ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে, রবি কোনও কিছু চিন্তা না করেই জামাকাপড় পরা অবস্থাতেই লাফিয়ে পড়লেন জলে। বজরার অন্য কর্মচারীরা ভীত, সন্ত্রস্ত। কী এমন অমুল্য বস্তুর জন্য জমিদার মশাই নিজে ঝাপ দিয়েছেন এই খরস্রোতা পদ্মায়? খানিক বাদে রবি শহরে ফিরে এলেন, তার মুখে বিজয়ীর হাসি, হাতে সেই এক পাটি চটি!

এবারে রবি শুধু জমিদারি পরিদর্শন বা নিজের লেখার জনাই আসেননি। এবারে তার স্বামী ও পিতার ভূমিকাটাই প্রধান। মুণালিনী তার সঙ্গ পাবেন, ছেলেমেয়েদের তিনি নিজে লেখাপড়া শেখাবেন। ছেলেমেয়েদের তিনি কোনও স্কুলে ভর্তি করেননি। ইংরেজ প্রবর্তিত গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর তার একটুও ভক্তি নেই। নিজের যে স্বল্প ইস্কুল-জীবন, তার অভিজ্ঞতাও মধুর নয়। এ দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা সম্পূর্ণ নতুন শিক্ষাপ্রণালী দরকার। বলেন্দ্রর খুব উৎসাহ আছে, সে চায় শান্তিনিকেতনে একটা ব্ৰহ্মা-বিদ্যালয় স্থাপিত হোক, যেখানে ভারতের সনাতন আদর্শে শিক্ষা দেওয়া হবে। রবিও মাঝে মাঝে সেই কথা ভাবেন।

এক একদিন সকালে তিনি কুঠিবাড়িতে গিয়ে ডাকেন, বেলী, রথী, রানী, তোরা সব আয়। আমার সঙ্গে পড়বি। ছেলেমেয়েরা দৌড়ে এসে বাবাকে ঘিরে বসে। মীরা আর শমীএ টলটলে পায়ে এসে দাঁড়ায়। রবি শর্মীকে কোলে তুলে নেন, মীরা তার কাঁধে ভর দেয়। তারপর শুরু হয় গল্প।

রথীকে সাঁতার শেখানোর মতন, লেখাপড়ার ব্যাপারেও রবি ডাইরেক্ট মেথডে বিশ্বাস করেন। ছোটদের যে অজ-আম-ইট মুখস্থ করতে হবে, তার কী মানে আছে, একেবারে প্রথম থেকেই তাদের সাহিত্যরসে দীক্ষা দেওয়া উচিত। তিনি ওদের রামায়ণ-মহাভারতের গল্প বলেন, সেই গল্পে আকৃষ্ট হবার পর ওদের বঙ্কিম কিংবা মাইকেলের রচনা পড়ে শোনান। ছোটরা এসব বুঝবে না? না বুঝুক! শব্দ-ঝঞ্চারটাও কানে যাওয়া দরকার। শুনতে শুনতে তাদের মুখস্থ হবে, মুখস্থ হবার পর আস্তে আস্তে অর্থটাও হৃদয়ঙ্গম করবে। বড় মেয়ে মাধুরীলতা এরই মধ্যে সংস্কৃত শুনে একটু একটু বুঝতে পারে, তার বাংলা লেখার হাত আছে। রথীও বেশ মনোযোগী ছাত্র।

নিজে তো পড়াচ্ছেনই। এ ছাড়াও সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাল করে পড়াবার জন্য দু’জন শিক্ষক নিযুক্ত হল। শিবধন বিদ্যার্ণব নামে একজন শ্রীহট্টের টোলে পড়া পণ্ডিতকে পাওয়া গেল, যার সংস্কৃত উচ্চারণ বাঙালিদের মতন নয়, কাশীয় পণ্ডিতদের মতন বিশুদ্ধ। রবির ধারণ, ইংরিজি ভাষা কোনও ইংরেজের কাছেই শেখা উচিত। সৌভাগ্যক্রমে সেরকম মিলে গেল একজন। লরেন্স নামে এক বাউন্ডুলে ইংরেজ ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পড়েছে, মাত্র পঞ্চাশ টাকা বেতন ও থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে সে পড়াতে রাজি হয়ে গেল। লরেন্স লোকটি ভাল শিক্ষক তো বটেই, তা ছাড়া খুব আমুদে, ছোটদের সঙ্গে সে খুব সহজেই মিশতে পারে, খেলাধুলো করে, প্রাণ খুলে গান গায়। শুধু তার একটি দোষ আছে, সন্ধের পর সে নিজের ঘরে বসে মদ খাবেই এবং মাতাল হবে। লরেন্সের অন্যান্য অনেক গুণের জন্য তার এই দোষটি রবি মেনে নিয়েছেন। পার্শবর্তী জমিদার ও সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটদের আপ্যায়ন করার জন্য রবির কাছে যে মদের বোতলের স্টক থাকে, তার থেকে মাঝে মাঝে লরেন্সকেও বোতল দিতে হয়।

ছেলেমেয়ে এমন নিবিড়ভাবে বাবাকে আগে কখনও পায়নি। এতখানি খোলা প্রান্তর, এমন সজল আকাশ, কাছাকাছি দু’দুটো নদী, প্রকৃতির এই ক্রীড়াঙ্গনে তাদের শিক্ষার মধ্যে আনন্দের ভাগই বেশি। রবিও এই সাংসারিক ভূমিকা বেশ উপভোগ করছেন, কিন্তু সর্বক্ষণের জন্য নয়। তিনি মাত্র এক রোমান্টিক কবি, এই জগতের কাছে এক ব্যাকুল প্রণয়ী, সুন্দরকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষায় এক গোপন বিরহী। যখন তিনি কবিতা রচনা করেন, তখন তিনি কারুর পিতা নন, কারুর স্বামী নন, প্রজাদের জমিদার নন। তখন তিনি নিঃসঙ্গ।

রবির মাথার মধ্যে সব কাজের জন্য যেন সুশৃঙ্খল বিভাজন আছে। জমিদারি সেরেস্তার কাজকর্ম যখন দেখেন, তখন তাতে পুরোপুরি মন দেন। আয় বৃদ্ধির দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর আছে। আবার দরিদ্র প্রজাদের অভাব-অভিযোগ ও নালিশ তিনি সহৃদয়ভাবে শোনেন, সুবিচারের ত্রুটি রাখেন না। পুত্ৰকন্যাদের উজাড় করে দেন স্নেহ। মৃণালিনীর মনে যে ক্ষোভ জন্মেছিল, তা অনেকটা দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সবই করে যাচ্ছেন ঠিক মতন, কিন্তু অন্তঃসলিলা টান সব সময় কাগজ কলম নিয়ে নিভৃতে বসার সময়টার দিকে। প্রতিদিন কিছু না কিছু না লিখলে তার ভাল লাগে না। অক্ষর, শব্দ, ছন্দ, সুর এই নিয়ে যে জীবন, সেটাই যেন তার প্রকৃত জীবন। যে-কোন একটা লেখা শেষ হলেই ইচ্ছে করে কারুকে শোনাতে। শিলাইদহতে তো সে রকম কেউ নেই। তখন নির্দিষ্ট কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করে। কিংবা ইচ্ছে করে কলকাতায় ছুটে যেতে।

এখানে অতিথি আসারও অবশ্য বিরাম নেই। বলেন্দ্র ও সুরেন্দ্র প্রায়ই আসে। সুরেন তো রবিকাকাকে ছেড়ে থাকতেই পারে না, এক সপ্তাহ দু’সপ্তাহ অন্তর তার আসা চাই। বিবি আসে না। চিঠি লেখে না। আগে যেমন প্রায় প্রত্যেক দিন বিবি নিজে চিঠি লিখত, রবিকাকার কাছ থেকেও সে রকম চিঠি আশা করত, না পেলে অভিযোগ-অনুযোগ-অভিমান জানাত, রবিও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা চিঠিতে তাঁর সমস্ত অনুভূতির কথা বিবিকেই জানাতেন, তেমন আর নেই, সেই পর্বটি যেন চুকে যেতে বসেছে। বিবি এখন অন্য একজনকে সকালে চিঠি লেখে, আবার বিকেলে চিঠি লেখে, তার কাছ থেকে লম্বা লম্বা চিঠি পায়। রবি এই পত্র বিনিময়ের কথা আভাসে কিছুটা জেনেছেন।

ঠিক ঠিক বন্ধুদের সঙ্গ পেলে রবি উদ্দীপিত হয়ে ওঠেন, তার নতুন নতুন রচনার স্ফূর্তি আসে। তাদের অনুরোধ মতনও বিচ্ছিন্ন আঙ্গিকে লিখতে হয়। যেমন জগদীশ বোস এসেই বলেন, বন্ধু, আজ সন্ধেবেলা কিন্তু একটা গল্প শোনাতে হবে। নতুন গল্প চাই। এর ফলে রবির অনেক ছোটগল্প লেখা হয়ে যাচ্ছে। কাহিনীমূলক কবিতা শুনতেও ভালবাসেন জগদীশ, তাই রবির কলমেও এসে যাচ্ছে বিভিন্ন আখ্যান অবলম্বনে কবিতা। কিছুদিন আগে উড়িষ্যা যাবার সময় নৌকায় বসে এক ঝড়ের রাতে লিখেছিলেন, ‘দেবতার গ্রাস’, লেখার পরই মনে হয়েছিল এটা জগদীশকে শোনাতে হবে। তারপর লেখা হল ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’। এরকম আরও।

রবি বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহী। পদার্থবিজ্ঞানী জগদীশ সম্প্রতি জড় ও উদ্ভিদ সম্পর্কে ঝুঁকেছেন, কবি তাঁর কাছ থেকে এই সব বিষয়ে শুনতে চান। আর জগদীশ কলেজের ছুটি হলেই এখানে চলে আসেন সাহিত্য রস-তৃষ্ণা মেটাতে। রবির ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও তার বেশ ভাব হয়ে গেছে। বেশি রাত্রে পানাহারের সময়টুকু বাদে, অন্যান্য সময় সাহিত্যের আড্ডায় রবি ছেলেমেয়েদের দূরে সরিয়ে রাখেন না। ওরাও শুনুক, শিখুক, যতটা বুঝতে পারে বুঝুক। এখন সবটা না বুঝলেও পরবর্তী জীবনে এই সব কথা ওদের মনে পড়বে।

আসেন ঐতিহাসিক অক্ষয় মৈত্র, পেশায় তিনি উকিল, রাজশাহিত প্র্যাকটিস করেন। পুরনো বন্ধু লোকেন পালিত এখন রাজশাহির ড্রিস্ট্রিক্ট জজ, তিনি আসতে পারেন যখন তখন। কুষ্টিয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও আসার কোনও অসুবিধে নেই, হটিা পথে মাত্র মাইল পাচেক দূরত্ব।

প্রকৃতি যেখানে অকৃপণভাবে উদার, সেখানে মানুষের স্বভাব বোধহয় অনেকখানি বদলে যায়। অক্ষয় মৈত্র এখানে এসে ইতিহাসের বদলে রেশমের উৎপাদন সম্পর্কে মাথা ঘামান। তাঁর ধারণা হয়েছে, বাংলার গ্রামের মানুষের উন্নতির জন্য নতুন ধরনের চাষবাস দরকার। গুটিপোকার চাষ করে রেশম উৎপন্ন করতে পারলে অনেক লাভ করা যায়। পাগল সাহেব লরেন্সকে তিনি এই ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পেরেছেন। লরেন্স এখন এই চাষ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। কবি দ্বিজেন্দ্রলালের আবার উৎসাহ আলুর চাষ বিষয়ে। আলু একটি সদ্য প্রচলিত সব্জী, বিশেষ পাওয়া যায় না। তিনি এসেই বলেন, রবিবার, আপনার এখানে অনেক জায়গা পড়ে আছে, আপনি আলুর চাষ শুরু করুন না। আমি বিলেত থেকে শিখে এসেছি, আপনাকে ভাল জাতের আলুর বীজ এনে দেব।

কলকাতায় লেবরেটরিতে জড় পদার্থ, গাছপালার বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও শিলাইদহ এসে জগদীশচন্দ্র মেতে উঠেন কচ্ছপের ডিম খোঁজায়। এখানে কচ্ছপ প্রচুর, তারা নদী থেকে উঠে এসে উঁচু ডাঙায় বালি খুঁড়ে ডিম পেড়ে যায়। ঠাকুর বাড়ির লোকেরা কচ্ছপের মাংস কিংবা ডিম খেতে জানে না, কিন্তু জগনীশচন্দ্র পূর্ববঙ্গীয়, তিনি তো ভালবাসেনই, তিনি এ বাড়ির সবাইকে এই উত্তম খাদ্যের স্বাদে দীক্ষা দিলেন। রথীকে তিনি শিখিয়ে দিলেন কীভাবে কচ্ছপের ডিমের সন্ধান পেতে হয়। বিজ্ঞানী হিসেবে দেশবিদেশে যাঁর নাম ছড়িয়েছে, তিনি এখানে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে, খালি পায়ে, হাতে একটা খুরপি নিয়ে বালির মধ্যে ঘুরে বেড়ান। নদী থেকে কচ্ছপগুলো যখন উঠে আসে তখন বালির ওপর তাদের পায়ের ছাপ পড়ে। সেই ছাপ অনুসরণ করতে করতে গেলে এক জায়গায় দেখা যায়, সেই ছাপ থেমে গেছে। লোকচক্ষুর আড়াল দেবার জন্য কচ্ছপরা সেখানে গর্ত খোঁড়ে, সেই গর্তের মধ্যে ডিম পেড়ে আবার বালি চাপা দিয়ে দেয়। সারাদিন রোদের তাপে বালি উত্তপ্ত হয়ে থাকে, তাতেই আস্তে আস্তে ডিম ফোটে।

জগদীশ রথীকে নিয়ে বসে খুরপি দিয়ে বালি খুঁড়তে থাকেন। দুজন ডজন ডিম পাওয়া যায়। একদিন রথী ভয় পেয়ে গেল। ওরা মনোযোগ দিয়ে বালি খুঁড়ছে, এমন সময় পেছনে খসখস শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখল, দুটো শেয়াল এসে সরু চোখে তাকিয়ে আছে।

জগদীশ হেসে বললেন, ভয় পাসনি। আমরা যে-জন্য এসেছি, ওরাও সেই জন্য আসে। মানুষ আর কটা ডিম পায়, এই শেয়ালই কচ্ছপের ডিম বেশি চুরি করে। আমরা চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে এসেছি।

এক একদিন আরও উপরি লাভ হয়। ডিম খুঁজতে গিয়ে কচ্ছপ মাতাকেও দেখতে পাওয়া যায়। কচ্ছপের কামড় অতি ভয়ংকর, একবার আঙুল কামড়ে ধরলে মেঘ না ডাকলে নাকি ছাড়ে না। কিন্তু রথী এখন কচ্ছপ ধরায় এক্সপার্ট হয়ে গেছে। পেছন দিক থেকে কচ্ছপটাকে একবার উল্টে দিতে পারলেই সে একেবারে অসহায়। চিত হওয়া কচ্ছপ কিছুতেই আর উপুড় হতে পারে না, তখন অনায়াসেই তাকে বেধে ফেলা যায়।

ছোটদের সবচেয়ে বেশি আমোদ হয় নদিয়া থেকে জগদিন্দ্রনাথ এলে। কত বড় জমিদার, কত ঐশ্বর্য, সবাই তাঁকে বলে মহারাজ। নদিয়ায় যখন থাকেন কিংবা যখন কলকাতায় যান, তখন কত তার জাকজমক, অঙ্গে বহুমূল্য পোশাক, চার ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া চড়েন না। কিন্তু শিলাইদহে তিনি একেবারে অন্য মানুষ।

এখানে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ কিংবা দেহরক্ষী থাকে না, তিনি ছেলেমানুষের মন হইহই করেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সমানভাবে মেশেন, ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকো নিয়ে অনেক দূর চলে যান। তিনি যেমন গান-বাজনা ভালবাসেন, তেমনি তার গল্পের শেষ নেই।

নাটোরের মহারাজ বিখ্যাত ধনী, কিন্তু তিনি আসলে গরিবের ছেলে। এবং সে কথা স্বীকার করতেও জগদিন্দ্রের কোনও লজ্জা নেই। অপুত্রক বিধবা মহারানি এক দূর সম্পর্কের দরিদ্র আত্মীয়ের বাড়ি থেকে একটি সুদর্শন বালককে দত্তক নিয়েছিলেন। তারপর শুরু হয়েছিল সেই বালকের রাজকীয় শিক্ষা। যখন তখন হাসতে নেই। হাঁটার সময় চিবুক উঁচু রাখতে হবে। সাধারণ লোকের দিকে সোজাসুজি তাকাবে না। কর্মচারীদের কথার মাঝখানে মাঝখানে হাত তুলে থামিয়ে দিতে হবে। চাকর-বাকরদের নাম ধরে না ডেকে, এই কে আছে, বলতে হবে। ইংরিজি বলা শিখতে হবে সাহেবদের সঙ্গে। লেখাপড়া তো শিখতেই হবে, সেই সঙ্গে ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক চালনা; হতে হবে সঙ্গীতের সমঝদার, বাঈজিদের নাচের সময় তাল দিতে হবে ঠিক জায়গায়। খাওয়াদাওয়ারও স্বাধীনতা নেই। একদিন সেই রাজা-সাজা বালক সারাদিন ধরে লেখাপড়া, ঘোড়ায় চড়া, গান-বাজনার তালিম নিয়ে, ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সন্ধেবেলা। খবর পেয়ে রাজমাতা এসে ধাক্কা দিয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, এর মধ্যেই ঘুম? এখন খেতেও পাবি। না। মহারাজা হয়েছিস, এই সবে সন্ধে, এখন কী খাবি, রাজারাজড়ারা রাত তিনটের সময় খেয়ে ঘুমোতে যায়।

এই কাহিনা শোনাবার সময় রথীর দু কাঁধে হাত রেখে জগদিন্দ্র করুণভাবে বলেছিলেন, রথীরে, মহারাজা যেন কখখনো হতে যাস নে!

সাহিত্যপাঠ ও সঙ্গীতের আসর বসে সন্ধের পর। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন আসেন, তার হাসির গানের ভান্ডার অফুরন্তু, তিনিই সেদিন মাতিয়ে রাখেন, সেই সব দিনে রবি নিজে গান করেন না। অন্যান্য দিনে গল্প-কবিতা ও আড্ডার পর রবিকে গান গাইতেই হয়। পদ্মাবোটের ছাদে চাঁদের আলোয় সেই গানের লহরীতে বাতাস ভরে যায়। সঙ্গে কোনও বাদ্যযন্ত্র থাকে না, নাটোরের মহারাজ উপস্থিত থাকলে তিনি শুধু পাখোয়াজে সঙ্গত করেন। রবির ভরাট গলায় গান শোনার জন্য দুর দূর নৌকোর মাঝিরাও কাজ থামিয়ে দেয়।

জগদীশচন্দ্রের কয়েকটি প্রিয় গান আছে, সেগুলি শুনতে চান বারবার। রবি নতুন গানও শোনান মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ দিনই আগে থেকে ঠিক করা থাকে না, যে-গানটা মনে আসে, রবি সেটাই ধরে ফেলেন।

একদিন গাইছেন, ‘ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই।’ বেশ গেয়ে চলেছেন আপন মনে, হঠাৎ অন্তরায় এসে, ‘আমি আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া তোমারে পরানু বাস’ এ পর্যন্ত গেয়ে থেমে গেলেন। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসলেন মুখ তুলে।

সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে। জগদীশচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, থামালে কেন বন্ধু? বড় খাসা গান, বুকে ঘা দেয়।

রবি লাজুকভাবে বললেন, ভুলে গেছি।

জগদীশচন্দ্র বললেন, নিজে লিখেছ, তবু ভুলে গেছ?

রবি বললেন, কথা মনে আছে। কিন্তু সুরটা, আমি নিজেই বুঝতে পারছি, অন্তরায় অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।

জগদীশচন্দ্র বললেন, আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। সুরটা তো ভৈরবী!

রবি বললেন, অন্য সুরেও গেয়ে নিতে পারতুম। কম গান তো লেখা হল না। এখন সব সুর নিজের মনে থাকে না। এখন সুর বেঁধেই চট করে অন্য কারুকে শিখিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়।

তারপর রথীর দিকে চেয়ে বললেন, যা তো ও বাড়ি থেকে অমলাকে ডেকে নিয়ে আয়। ও জানে।

চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা এখানে এসে প্রায় থাকে। মৃণালিনীর সঙ্গে তার বেশ ভাব। চমৎকার তার গানের গলা, রবির কাছ থেকে সে অনেক গান তুলে নেয়। সে রাধেও ভাল। আজ বিশেষ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা বলে অমলা মৃণালিনীকে রান্নাঘরে সাহায্য করছে।

জগদীশচন্দ্র বললেন, অমলা আসুক, ততক্ষণ তুমি অন্য সুরটাই শোনাও না। দুটোই শুনব।

সপ্তাহান্তটা এখানে কাটিয়ে বন্ধুরা ফিরে যায় যার যার জায়গায়। তখন কয়েকটা দিন চলে একটানা কাজ, লেখাপড়া। ইদানীং রবির চিঠি লেখায় ভাটা পড়েছে। বিবিকে চিঠি লেখার তাগিদ নেই, অন্য কারুকে বিশেষ নিজে থেকে লেখেন না। তবে চিঠি পেলে প্রতিটি চিঠির উত্তর দেন। প্রভাত মুখুজ্যে প্রায়ই লেখে, সরলা ‘ভারতী’র রচনার জন্য তাড়া দেয়। কলকাতার বাড়িতে যে-সব চিঠিপত্র আসে, সেগুলি পাঠিয়ে দেওয়া হয় এখানে। রবির ভক্তর সংখ্যা বাড়ছে, অনেকে তার কোনও কোনও রচনায় বিমোহিত হয়ে স্তুতিপত্র লেখে, নিন্দেও করে কেউ কেউ।

একদিন একটি বিচিত্র চিঠি পেলেন। সম্বোধন আছে, ‘হে মানবশ্রেষ্ঠ’, কিন্তু তলায় কোনও স্বাক্ষর নেই। ঠিকানা নেই। গোটা গোটা হস্তাক্ষর, একটু মেয়েলি ধরনের, কোনও রমণীর লেখা বলেই রবির মনে হল, ‘আপনাকে আমি আমার জীবনবল্লভ রূপে বরণ করিয়াছি, কিন্তু কদাচ আপনার সম্মুখে যাইব না, আপনার নিকট কিছুই যাচ্ঞা করিব না’। এই ধরনের কথা কি কোনও পুরুষ লিখবে? দু’পৃষ্ঠার চিঠিটি দু তিনবার পড়লেন রবি, তিনি আত্মশ্লাঘা বোধ করলেন, কিন্তু উত্তর দেবার কোনও উপায় নেই বলে অস্বস্তি রয়ে গেল খুব।

তারপর থেকে ওই রকম অস্বাক্ষরিত, ঠিকানাবিহীন ও একই হাতের লেখা চিঠি আসতে লাগল মাঝে মাঝে। সব চিঠিই মধুর ভাবে ভরা। রবির বিভায় মুগ্ধ কেউ একজন দুর থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে তাঁর চরণে নিবেদন করতে চায়। উর দিতে না পারলেও চিঠিগুলি সযত্নে রেখে দেন রবি।

একদিন চিঠি এল জ্ঞানদানন্দিনীর কাছ থেকে। বিবির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

পঁচিশ বছর বয়েস হয়ে গেছে ইন্দিরার, হিন্দুসমাজ হলে এই অরক্ষণীয়া কন্যার জন্য তার বাবা-মাকে পতিত হতে হত। ব্রাহ্মদের মধ্যেও এতে বয়েসে কুমারী থাকা অভূতপূর্ব। পাত্রর নাম দেখে রবির খটকা লাগল। যোগেশ? যোগেশ আর প্রমথ দুই ভাইই এ বাড়িতে প্রায়ই যায়, রবি। লক্ষ্য করেছেন, ছোট ভাই প্রমথর সঙ্গেই বিবির সখ্য বেশি, পরস্পর ওরা পত্র বিনিময় করে, যা সখ্য ছাড়িয়ে প্রণয়েরই লক্ষ্মণ। জ্ঞানদানন্দিনী লিখেছেন, বিবি এই সম্বন্ধে রাজি হয়েছে, এখন তিনি রবির মতামত চান। বিবি যদি রাজি হয়, তা হলে রবির আপত্তি জানাবার কোনও কারণ নেই। পাত্র হিসেতে প্রমথর চেয়ে যোগেশ যোগাতর, প্রমথ উচ্চশিক্ষিত এবং সুক্ষ্ম রুচিসম্পন্ন হলেও যতটা বাক্যবাগীশ, ততটা কাজে বড় নয়, যোগেশ সার্থক ব্যারিস্টার।

এই বিবাহের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েও ভেস্তে গেল। দেনা-পাওনা, যৌতুক, সজ্জা-অলংকার প্রভৃতি বিষয়ে সব কিছু পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনীর একটি শর্ত যোগেশচন্দ্র মানল না। বিয়ের পরও কন্যাকে দূরে পাঠাতে চান না জ্ঞানদানন্দিনী, কন্যা-জামাতা তার বাড়িতেই থাকবে, অথবা তাঁর ঠিক করা কাছাকাছি কোনও গৃহে। স্বশুরবাড়িতে দেওর-ননদ ভাজ শাশুড়ির একগাদা ভিড়ের মধ্যে বিবি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। সাধারণ বাঙালি পরিবারের রীতিনীতিও সে জানে না। বালিগঞ্জে জ্ঞানদানন্দিনীর অত বড় বাড়ি, সেখানেই তো যোগেশ তার স্ত্রীকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে।

কিন্তু যোগেশ স্বাধীনচেতা পুরুষ। সন্ত্ৰীক সে কোথায় থাকবে, তা সে নিজে ঠিক করবে। স্বশুর-শাশুড়ির আশ্রিত হয়ে সে থাকতে যাবে কেন? বিয়ের সম্বন্ধই যে শুধু ভাঙল তা নয়, দুই পরিবারের মধ্যে একটা তিক্ততার সৃষ্টি হল। লজ্জায় অপমানে ইন্দিরা ছাদের কোণে গিয়ে কাঁদে।

এই সময় সরলা এল বিবির সঙ্গে দেখা করতে। নির্জনে নিয়ে গিয়ে খুব এক চোট বকুনি দিল। সে বলল, তুই কী রকম মেয়ে রে বিবি, তুই মন দিয়েছিস একজনকে, আর বিয়ে করতে যাচ্ছিলি আর একজনকে? প্রমথবাবুকে যে তুই ভালবাসিস, তা কি আমি জানি না? তুই কোন মুখে যোগেশবাবুকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলি?

সরলাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাঁদতে ইন্দিরা বলল, আমি কী করব সল্লি, মা যে বলেছিলেন, মায়ের অমতে কি আমরা কিছু করতে পারি?

সরলা বলল, মা বলেছেন বলেই তুই অন্যপূর্বা হবি? সেই একই বাড়িতে, যাকে ভালবাসিস সে হবে দেওর, স্বামীর সঙ্গে তুই চিরকাল বঞ্চনা করে কাটাবি ঠিক করছিলি? এ বিয়ে ভেঙেছে, খুব ভাল হয়েছে, আমি সবচেয়ে খুশি হয়েছি।

বিবি বলল, এখন সবাই আমাকেই দোষ দেবে। বিয়ে ভেঙ্গে গেল, আমার মায়ের অপমান হল কত।

সরলা বলল, যদি সৎ সাহস থাকে তো এখন সব কথা মেজমামিকে খুলে বল।

ইন্দিরা বলল, আমি পারব না। কোনও মেয়ে কি স্বামী হিসেবে বিশেষ কোনও পুরুষের নাম করতে পারে? আমাদের সমাজে তা চলে নাকি?

সরলা বলল, কেন চলবে না? আগে যা চলেনি, এমন অনেক কিছু এখন চালাতে হবে। তুই এত ইংরিজি-ফরাসি কাব্য পড়িস, একজন পরপুরুষকে ‘মন আমি’ বলে চিঠি লিখতে পারিস, আর এই প্রথা ভাঙতে পারিস না? ঠিক আছে, তুই না পারলে আমিই মেজমামিমাকে এই প্রস্তাব দিচ্ছি।

জ্ঞানদানন্দিনীর প্রমথকে জামাই হিসেবে পেতে আপত্তি নেই, কিন্তু তাঁর শর্ত মানতে হবে। প্রমথ ব্যর্থ প্রেমিকের মতন ভেবেছিল, ইন্দিরার সঙ্গে তার চিঠি লেখালেখি শেষ, এখন এই প্রাণেশ্বরীর মুখপানে চাইবার অধিকার থাকবে না, শুধু পায়ের দিকে তাকিয়ে বউদিদি বলে ডাকতে হবে, আর দুঃখবিলাসেই বাকি জীবন কাটবে। পরিবর্তিত প্রস্তাবে সে যেন হাতে স্বর্গ পেল। সে সব শর্তে রাজি।

কিন্তু ঘোর আপত্তি এল চেীধুরী পরিবার থেকে। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যে মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী ছিল, সেই মেয়েকেই বিয়ে করবে কনিষ্ঠ ভ্রাতা? ছি ছি ছি, সমাজে বলবে কী? প্রমথর বাড়ির সবাই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিল।

এদিকে জ্ঞানদানন্দিনী জেনে গেছেন যে তার মেয়ে মনে মনে প্রমথকে বরণ করে বসে আছে। এই বিয়ে সম্পন্ন না হলে ইন্দিরা আর কারুকে বিয়েই করবে না। সারাজীবন সে কুমারী হয়ে থাকবে!

ঘটনাচক্র সবই জানানো হচ্ছে রকিকে। তিনি আর মাথা ঘামাচ্ছেন না। সব কিছু এমনভাবে জট পাকিয়ে গেছে যে, এখন আর তিনি কী করবেন? বিবি তো নিজে থেকে রবিকে কিছু লেখেওনি।

একদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হঠাৎ এসে পৌছলেন শিলাইদহে। অনেককাল পরে। এক সময় তিনিই ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের প্রতিনিধি হিসেবে এখানকার জমিদার। তার প্রতিবার আগমনের সময় কত আড়ম্বর, কত উৎসব হত। দেবতার মতন রূপবান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অশ্বপৃষ্টে চেপে জমিদারি পরিদর্শন করতেন, বন্দুক নিয়ে যেতেন বাঘ শিকারে। তাকে দেখলেই প্রজারা অভিভূতভাবে মাথা নত করত। সেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে এই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কোনও মিলই নেই। জমিদারি পরিচালনার সব ক্ষমতা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। চেহারারও কী নিদারুণ পরিবর্তন হয়েছে! মুখের স্বর্ণাভ বর্ণ একেবারে স্নান, দু চোখে নেই ব্যক্তিত্বের দীপ্তি, অকাল বার্ধক্যে দীর্ঘ শরীরটা যেন খানিকটা ঝুকে গেছে।

প্রজারা দূরের কথা, সেরেস্তার অনেক পুরনো কর্মচারীও জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে চিনতে পারল না।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শিলাইদহে বেড়াতে আসেননি, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সেই পুরনো কালের মতন গান বাজনার চর্চা করতেও আসেননি। তিনি এসেছেন জ্ঞানদানন্দিনীর দূত হয়ে। এখন তিনি বছরের পর বছর মেজ বউঠানের পক্ষপুটের নীচে আশ্রয় নিয়েই আছেন। তার আর বিশেষ সামাজিক গতিবিধি নেই।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, রবি, এবার তো তোর হস্তক্ষেপ না করলেই নয়। এ বিয়ে না হলে মেজ বউঠান অপমানে কারুকে মুখ দেখাতে পারবেন না। যোগেশ প্রমথদের বড় ভাই আশু তোর বিশেষ বন্ধু, তাকে তুই একটু বুঝিয়ে বল, তিনি তোর কথা নিশ্চয়ই মানবেন। তুই একবার চল কলকাতায়।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে আগের মতন আর মন খুলে কথা বলতে পারেন না রবি, কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করেন। তাকে দেখে আবার নতুন বউঠানের কথা মনে পড়ছে। অনেক দিন নতুন বউঠানের উদ্দেশে কিছু লেখা হয়নি। নতুন বউঠান অলক্ষে কোথাও থেকে রবির ওপর নজর রাখছেন, এরকম একটা অস্পষ্ট বিশ্বাস তার এখনও রয়ে গেছে।

এই বিয়ের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে রবির মন ঠিক সায় দিচ্ছে না। যোগেশ যখন বিয়ে করতে চেয়েছিল, তখনই ইন্দিরা সব কিছু খুলে বলেনি কেন? জ্ঞানদানন্দিনীর শর্তে রাজি হয়ে গেলে এতদিনে যোগেশের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যেত, তারপর সারাজীবন কি ইন্দিরা দ্বিচারিণী হয়ে থাকত? এর পর প্রমথর সঙ্গে বিয়ে হলেও প্রমথর আত্মীয়-স্বজনরা ওদের কী চক্ষে দেখবে? আড়ালে ধিক্কার দেবে না? রবি নিজে এর আগে যোগেশের সঙ্গে বিবাহে সম্মতি দিয়েছিলেন, এখন আবার কী ভাবে প্রমথর নাম উত্থাপন করবেন!

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনেক অনুরোধেও রবি প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিতে রাজি হলেন না। তবে বন্ধু আশুতোষ চৌধুরীকে সব বিস্তারিতভাবে জানিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। কুড়ি পাতার দীর্ঘ চিঠি। সে চিঠি কলকাতায় পৌঁছার পর চৌধুরীদের কাছে পাঠাবার আগে ইন্দিরা পড়ে দেখল। সব তথ্য রবিকাকা ঠিক মতন জানেন না বলে সেও আরও কিছু জুড়ে দিল।

সে চিঠিতেও কোনও কাজ হল না। ওরা দৃঢ় সংকল্প করে বসে আছেন। চৌধুরী পরিবাৱে বধূ হিসেবে ইন্দিরাকে আর কিছুতেই গ্রহণ করা হবে না।

প্রমথ কয়েক মাস ধরে কোন বন্ধুর আতিথ্য ভোগ করছে ভাগলপুরে। চিঠিপত্রে জানছে সব কিছু। সে আর ইন্দিরাকে কিছুতেই ছাড়তে রাজি নয়। ইন্দিরা, ইন্দিরার মতন রমণীরত্নের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়, নিজের পরিবার তো অতি তুচ্ছ। ভাইদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিয়েও সে ইন্দিরাকে গ্রহণ করতে চায়।

শেষ পর্যন্ত জ্ঞানদানন্দিনীর জেদেরই চিত হল। তার মেয়েকে শ্বশুবাড়িতে গিয়ে এক গলা ঘোমটা টেনে হিন্দু পরিবারের দাসীর মতন ভাসুর-ভাজদের সেবা করতে হবে না। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মেয়ে বিলিতি আদব কায়দায় মানুষ, সে স্বাধীনভাবে সংসার করবে। প্রমথর নিজস্ব উপার্জন বিশেষ নেই, তাতে কী হয়েছে, তিনি খুব কাছাকাছি অঞ্চলে ওদের জন্য বাড়ি তৈরি করে দেবেন। যতদিন বাড়ি না হয়, ভাড়া বাড়িতে থাকবে, সে ভাড়া জোগাবেন তিনি, ওদের সংসারে কোনও অভাব রাখবেন না। ফাল্গুন মাসে বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *