ত্রিচত্বারিংশ অধ্যায় – শিবের প্রসন্নতা
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–অনন্তর দেবমুনি কামচারী নারদ, শক্রের নিয়োগ বশত হিমালয় মন্দিরে গমন করিলেন। ১
গিরিভবনে উপস্থিত হইবামাত্র অচল-রাজ তাঁহাকে পূজাদি সৎকার করিলেন, তারপর মুনি অচল-রাজকে পরিত্যাগ করিয়া নির্জনে কালীর সমীপে গমন করিলেন। ২
জ্ঞানশালিনী কালীকে প্রবোধ-বাক্য দ্বারা সান্ত্বনা করিয়া সমস্ত জগতের হিতকর বাক্য বলিতে লাগিলেন। ৩
নারদ বলিলেন, দেবি কালি! আমার বাক্য শ্রবণ করিয়া, সত্য বলিয়া ধারণা করুন; আপনি মহাদেবকে তপস্যা ব্যতীত আরাধনা করিয়াছেন। ৪
অতএব সেই জন্য তিনি আপনার প্রতি অনুরক্ত হইয়াও আপনাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। ৫
মহাদেব, আপনাকে ভিন্ন অন্য কাহাকেও গ্রহণ করিবেন না এবং আপনিও মহেশ্বর ভিন্ন কাহাকেও পতিপদে বরণ করিবেন না। ৬
অতএব আপনি তপস্যাতে রত হইয়া মহাদেবকে আরাধনা করুন। আপনি তপশ্চরণের দ্বারা সংস্কৃত হইলে শিব আপনাকে গ্রহণ করিবেন। ৭।
হে সুভগে! সেই তপস্যার অঙ্গভূত মন্ত্র শ্রবণ করুন, এই মন্ত্রবলে আরাধিত মহেশ্বর প্রত্যক্ষভাবে শীঘ্র দর্শন দেন। হে গিরিজে! “ওঁ নমঃ শিবায়” এই ষড়ক্ষরমন্ত্র, শঙ্করপ্রিয়; নিয়ম প্রতিপালন করিয়া ইহা শঙ্কররূপ চিন্তা করত জপ করুন, তাহা হইলেই হর সন্তোষ হইবেন। ৮-৯
নারদ এই কথা বলিলে কালী তপশ্চরণ কৰ্তব্য মনে করিলেন এবং নারদ বাক্য অত্যন্ত হিতকর বিবেচনা করিলেন। ১০
নারদ কালীকে তপস্যার জন্য উপদেশ করিয়া ত্রিদশভবনে গমন করিলেন কালীও ব্ৰত কার্যে নিশ্চিত বুদ্ধি হইলেন। ১১
নারদমুনি গমন করিলে কালী, মাতা মেনকাকে নিজের–হর-সহ মিলনেচ্ছায় তপঃপ্রবৃত্তি বিশেষরূপে বলিলেন। ১২
কালী বলিলেন, মাতঃ! মহাদেবকে পাইবার নিমিত্ত তপস্যা করিতে গমন করিব; অতএব আপনি অদ্য তপস্যার জন্য তপোবনে গমন করিতে অনুমতি করুন এবং আমার এই তপশ্চরণের ইচ্ছা পিতার নিকট শীঘ্র বলুন। আমাকে শিব বিরহানল–যত বিলম্ব হইতেছে, ততই দগ্ধ করিতেছে। ১৩-১৪
মেনকা, কালীর এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া শোকাকুল-চিত্তে নিজ তনয়াকে আলিঙ্গন করত বলিলেন, বল্লভে! তোমার তপস্যাতে প্রয়োজন নাই। ১৫
তুমি অত্যন্ত কোমলাঙ্গী; অতএব পুত্রি! তুমি সম্পূর্ণরূপ তপস্যা করিলে অত্যন্ত কর্কশ হইয়া পড়িবে। মুনিদিগের শরীর তপস্যাসহ, কিন্তু তোমার শরীরে সে কষ্ট কিছুতেই সহ্য হইবে না; পুত্রি! তোমার বনবাস অবলম্বন করা শত্ৰুদিগেরও অভিলষিত নহে। ১৬-১৭
তাহা হইলে তুমি বনবাস-সাধ্য তপস্যা পরিত্যাগ করত নিজের সাধ্যানুরূপ উপযুক্ত তপশ্চরণ কর। ১৮
মার্কণ্ডেয় বলিলেন, গিরিজা, মাতার বাক্য শ্রবণ করিয়া দুঃখিতান্তঃকরণে তপোযত্নের অনুকূল বাক্য বলিলেন। ১৯
আমাকে নিষেধ করবেন না, আমি তপস্যার জন্য অন্য তপোবনে নিশ্চয় যাইব; আপনি যদি অনুমোদন নাই করেন, তাহা হইলে প্রচ্ছন্নভাবে যাইব। ২০
মেনকা বলিলেন, ব্ৰহ্মা বিষ্ণু শিবাদি দেবগণ গৃহেই সৰ্ব্বদা অবস্থান করিতেছেন, তাহা হইলে গৃহেতে সেই ঈপ্সিত দেবতাকে অর্চনা কর। ২১
স্ত্রীগণের স্বামী ভিন্ন বনগমন আমি কখনও শুনি নাই; অতএব পুত্রি! তুমি তপস্যার জন্য তপোবনে যাত্ৰা করিও না। ২২
যেহেতু তপোধন-গমনোদ্যত তনয়াকে “উ মা” এই সম্বোধন করিয়া মেনকা নিষেধ করিলেন, সেই জন্য তাহার উমা নাম হইল। ২৩
তাহার পর গিরিজা মাতার অভিপ্রায় বুঝিয়া সখীগণদ্বারা পিতাকে তপস্যার উদ্যোগ জানাইলেন। ২৪
গিরিপতি দুহিতার তপস্যার উদ্যম জানিয়া বিশেষ হৃষ্ট না হইয়াও অনুমোদন করিলেন। ২৫
পিতার অনুমতি গ্রহণ করিয়া যে স্থানে মহাদেব মদনকে ভস্ম করিয়াছিলেন, সেই স্থানে গঙ্গাবতরণে গমন করিলেন। ২৬
কালী হিমবৎপ্রস্থ গঙ্গাবতরণ-প্রদেশ হর-শূন্য দেখিলেন এবং যে স্থানে শম্ভু, ধ্যানস্থ ছিলেন, সেই স্থানে গিরিসুতা বিরহাৰ্দিত-চিত্তে ক্ষণকাল অবস্থান করিয়া ‘হা হর!’ এই শব্দে অত্যন্ত রোদন করিতে লাগিলেন; চিন্তা, শোক ও দুঃখে নিতান্ত পীড়িতা হইয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন। ২৭-২৯
তাহার পর ক্ষণকাল বিলাপ করিয়া, কমলেক্ষণা কালী, সেই সময়ে পূর্ব বৃত্তান্ত স্মরণ করত হৃদয়স্থিত হর-সম্বন্ধীয় মোহ প্রাপ্ত হইলেন। ৩০
তাহার পর কিছু সময় গত হইলে কালী সেই ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া মোহ সম্বরণ করিলেন। হিমালয়-সূতা নিয়ম প্রতিপালনের নিমিত্ত দীক্ষিত হইয়াছিলেন। ৩১
তাহার প্রথম নিয়ম-ফলভোজন দ্বারা নিষ্পন্ন হইল। তৎপরে গিরিজা, শম্ভু-সম্বন্ধে চিন্তা ও শম্ভুর নাম জপই পঞ্চ তপে কৰ্তব্য মনে করিয়া যজ্ঞীয় শুষ্ক কাষ্ঠদ্বারা চারিদিকে চারিভাগ করত তাহাতে অগ্নি স্থাপন করিলেন এবং সূৰ্য্যদ্বারা পঞ্চাগ্নি পূর্ণ হইল। ৩২-৩৩
নিজ আসনের একহস্ত পরিমাণ দূরে চারিদিকে চারি ভাগে বৈশ্বানর-যজ্ঞ দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত করিলেন, গ্রীষ্মকালে তাহার মধ্যে বহুবস্ত্র-বেষ্টিত হইয়া নিরন্তর উৰ্দ্ধমুখে সুৰ্যকিরণ অবলোকন করত অবস্থান করিতেন এবং শীতকালে তোয়মধ্যে অবস্থান করিয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন। ৩৪-৩৫
প্রথম ফলাহারে, দ্বিতীয়তঃ তোয়াহারে, তৃতীয়তঃ স্বয়ংপতিত বৃক্ষ-পত্র ভোজন করিয়া, ক্ৰমে পতিত পত্র পরিত্যাগ করিয়া নিরাহারেই তপশ্চরণ করিতে লাগিলেন। ৩৬-৩৭
দেবী, আহারে পত্ৰ পৰ্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছিলেন বলিয়া দেবগণ তাহার নাম ‘অপর্ণা’ রাখিলেন। ৩৮
হিমালয়সুতা কোন সময়ে পঞ্চতপ অবলম্বন করিয়া, কোন সময়ে জলে প্রবেশ করিয়া, কোন সময়ে এক পদাবলম্বনে স্থিত হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। ৩১
ষড়ক্ষর মন্ত্র জপ করত বহুকাল তপস্যা করিলেন। তিনি চীর বল্কলদ্বারা আবদ্ধা এবং জটাধারিণী ছিলেন। ৪০
কৃশাঙ্গী কালী চিন্তাবিষয়ে অত্যন্ত সক্ষমা হইয়া মুনিদিগকে পরাজয় করিলেন। তপস্যাতে আসক্ত ব্যক্তিকে শঙ্কর স্বয়ং রক্ষা করিয়া থাকেন এবং তাহাদের সহিত আনন্দিতচিত্তে আপ্যায়িত করেন ও ভয়ে রক্ষা করেন। ৪১
তপোবনে তপস্যারতা কালীর শঙ্করকে চিন্তা করিতে করিতে তিন সহস্র বৎসর অতীত হইল। ৪১
তাহার পর অষ্টাদশ সহস্র বৎসর অতীত হইলে ব্রহ্মা আগমন করত দৈব বিধি-অনুসারে তাহার সংস্কার করিলেন, তৎপরেই দেবী হরের গ্রহণযোগ্যা হইলেন। ৪৩
তাহার পর যেস্থানে মহাদেব অষ্টাদশ বৎসর তপস্যা করিয়াছেন, সেইস্থানে ক্ষণকাল অবস্থান করত ভামিনী কালী চিন্তা করিতে লাগিলেন। ৪৪
আমি নিয়ম-রতা হইয়া তপস্যা করিতেছি, তাহা বোধ হয় মহাদেব জানিতে পারেন নাই, যেহেতু বহুকাল তপোরতা হইয়াও তাহার বিদিত হইতে পারিলাম না। ৪৫
গিরীশ ইহলোকে নাই, এই যে মুনিগণ বলিয়া থাকেন, তাহা কি সত্য? কিন্তু দেবগণ বলিয়া থাকেন, শিব সৰ্ব্বজ্ঞ সৰ্ব্বগ দেব। ৪৬
যদি তিনি সর্বজ্ঞ, সৰ্ব্বগ, সৰ্ব্বলোকের আত্মস্বরূপ সৰ্ব্বহৃদয়গত সৰ্ব্ব ঐশ্বৰ্যপ্রদ, সৰ্বভাবন দেব হন এবং আমার মাতা মেনকা যদি সতী হন ও আমি যদি অন্যে অনুরক্ত না হইয়া বৃষধ্বজেই অনুরক্তা হইয়া থাকি, তাহ হইলে শঙ্কর আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। ৪৭-৪৮
যদি নারদমুখনিঃসৃত এই ষড়ক্ষর মন্ত্র হয় এবং আমি যদি ভক্তি পূর্বক জপ করিয়া থাকি, তাহা হইলে হর আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। ৪৯
যদি আমি তপস্যা করিয়া থাকি এবং হর যদি সত্য আরাধিত হইয়া থাকেন, যদি তপস্যা সত্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে হর প্রসন্ন হউন। ৫০
মার্কণ্ডেয় বললেন,–কালী এইরূপ চিন্তা করত জটাবল্কল-বদ্ধা দীনবেশে অধোমুখী হইয়া হরের পূর্বের আবাসস্থলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ৫১
সেই সময়ে কোন এক ব্রাহ্মণ, কালীসমীপে উপস্থিত হইলেন, তিনি ব্রহ্ম চৰ্যব্রতাবলম্বী; তাহার কৃষ্ণাজিন উত্তরীয়, হস্তে দণ্ডকমণ্ডলু। ৫২
শরীর স্বর্ণের ন্যায় গৌর, ব্রহ্মার শোভার ন্যায় প্রদীপ্ত দেহ-ভাগ, বিস্তৃত জটা-কলাপে শোভিত; শম্ভু এই ব্রাহ্মণরূপধারী। ৫৩
ব্রাহ্মণ-রূপী শম্ভু–প্রথমত কালীসমীপে উপস্থিত হইয়া প্রত্যক্ষভাবে অনুরাগ জানিবার জন্য এবং তাহার বাক্য শ্রবণ করিবার নিমিত্ত বাগ্মী গিরিজাকে বিচিত্র বাক্যের দ্বারা জিজ্ঞাসা করিলেন। ৫৪-৫৫
ব্রাহ্মণ বলিলেন,–তুমি কে? এবং কাহার কন্যা? কি জন্যই বা প্রযতাত্মা মুনিদিগের দুর্ধর্ষ তপশ্চরণ করিতেছ? ৫৬
তুমি বালাও নহ এবং বৃদ্ধাও নহ–অতি শোভাশালিনী তরুণী; সম্প্রতি পতি ভিন্ন কি জন্য এই তপস্যা করিতেছ? ৫৭
ভদ্রে! তুমি কাহারও কি সহচারিণী তপস্বিনী? তোমার তপস্বী কি অন্য স্থানে পুষ্পাদি অহরণ করিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছেন? ৫৮
যদি তোমার গোপনীয় না হয়, তাহা হইলে সমস্ত বিষয় সম্পূর্ণরূপে আমার নিকট বল। ৫১
যদি তোমার হৃদয়ে দুঃখের কোন কারণ থাকে, তাহা হইলে বল, তাহার নিরাকরণ করিবার নিমিত্ত আমি সমর্থ হইব। ৬০
ব্রাহ্মণ এই কথা বলিলে গিরিজা তাহার উত্তর প্রদানের নিমিত্ত নিজ সখী বিজয়াকে নয়ন-সঙ্কেতে নিয়োগ করিলেন। ৬১
বিজয়া, কালীর বাক্যানুসারে গিরিজার মুখপানে দৃষ্টি রাখিয়া ব্রাহ্মণকে সত্য বাক্যে উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। ৬২
হে দ্বিজোত্তম। ইনি গিরিরাজের তনয়া, ইহার নাম কালী; এবং পার্বতী নামও ইহার খ্যাত আছে। ৬৩।
ইহাকে কেহ পরিণয় করে নাই, বৃষধ্বজ শঙ্করকে পতিপদে বরণ করিতে বাঞ্ছা করিয়া তীব্র তপশ্চরণ করিতেছেন। ৬৪
ভবানী কালী তিন সহস্র বৎসর অতীত হইল তপস্যা করিতেছেন, কিন্তু শঙ্কর অদ্য পর্যন্তও গিরি-সুতাকে গ্রহণ করিলেন না। ৬৫
তাপসগণ ও দেবগণ বলিয়া থাকেন; শঙ্করদেব গিরিশ সৰ্বগত এবং সৰ্ব্বজ্ঞ। ৬৬
তাহা হইলে ইহাকে কি তিনি জানিতে পারিলেন না? অদ্য এই চিন্তা পরবশ হইয়া নিতান্ত দুঃখিতা হইতেছেন। ৬৭
অতএব হে সুব্রত। আমাদের সখী প্রার্থনা না করিলেও অনুগ্রহপূর্বক আপনি ইহার প্রতি দয়া করুন; এবং সখীকে শঙ্করের সহিত সঙ্গতা করুন। ৬৮
এই বাক্য শ্রবণ করিয়া ব্রহ্মচারী দ্বিজ, কিঞ্চিৎ হাস্যপূর্বক পার্বতীকে এই কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। ৬৯
ব্রাহ্মণ বলিলেন,–আমার দর্শন কখনও বিফল হয় না, আমি শিবকে আনিতে পারি, কিন্তু একটি কথা বলিতেছি, তাহা নিশ্চয়রূপে শ্রবণ কর। ৭০
আমি মহাদেবকে জানি, তাহার বিষয় বলিতেছি শ্রবণ কর; মহাদেবের বাহন বৃষ, অঙ্গে নিরন্তর ভূতি লেপন করে এবং জটাধারী, তাহার ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান এবং গজচৰ্ম্ম উত্তরীয়। ৭১
নর-কপালধারী-সর্পসমূহের দ্বারা সৰ্ব্বগাত্রে বেষ্টিত এবং বিষবেগে দগ্ধ গলদেশে অক্ষমালা; সে বিরূপাক্ষ এবং ভয়ঙ্কর। ৭২
তাহার জন্মের কোন নিশ্চয় নাই; সে সর্বদা গৃহভোগত্যাগী, জ্ঞাতি ও বান্ধবাদি-শূন্য, তাহার ভোজনব্যাপার ও ভোজনীয় দ্রব্যের কোন সংস্রব নাই। তিনি নিরন্তর শ্মশানবাসী, সৎসঙ্গবর্জিত। ৭৩-৭৪
নিরন্তর গর্জনকারী বিকট ভূতগণের মধ্যে তাহার সৰ্ব্বদা বাস। ৭৫
সে শৃঙ্গারাদি-রসশূন্য ও ভাৰ্য্যাপুরহিত, অতএব কি জন্য তুমি তাহাকে পতিত্বে বরণ করিতে ইচ্ছা করিতেছ? ৭৬
আমি পূৰ্বে শুনিয়াছি; সে একটি কাৰ্য্য করিয়াছে, তাহা বলিতেছি; যদি তোমাদের অভিরুচি হয় তাহা হইলে গ্রহণ করিবে। ৭৭
পূর্বে দক্ষকন্যা সাধ্বী সতী, দৈববশতঃ সম্ভোগবর্জিত বৃষধ্বজকে পতিত্বে বরণ বরিয়াছিলেন। ৭৮
‘কপালীর জায়া’ এই বলিয়া দক্ষ, কন্যাকে পরিত্যাগ করেন এবং যজ্ঞভাগ শিবকে প্রদান করিলেন না। ৭৯
সতী সেই অপমানে অত্যন্ত শোকাকুল হইয়া নিজের প্রিয় প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন এবং হরকেও পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। ৮০
তুমি স্ত্রীদিগের মধ্যে রত্নস্বরূপা এবং তোমার পিতা সমস্ত পৰ্বতের রাজা, তাহার সমক্ষে এইরূপ পতিকে কিজন্য উগ্র তপস্যার দ্বারা বরণ করিতেছ? ৮১
দেবেন্দ্র, কুবের, পবন, অগ্নি, কি অন্য সুরগণ অথবা স্বৰ্গবৈদ্য অশ্বিনীকুমার, বিদ্যাধর, গন্ধৰ্ব্ব, নাগ, মনুষ্য–ইহার মধ্যে রূপ ও নবযৌবনসম্পন্ন যে কেহ হয়, প্রশস্ত-কুলোদ্ভব সেই শ্রীমান ব্যক্তিই তোমার পতির যোগ্য। ৮২-৮৪
যাহার সহিত তুমি বহুরত্বপূর্ণ সুবিস্তৃত মাল্যসমূহ-সংযুক্ত ধূপচূর্ণের দ্বারা সুবাসিত স্বর্ণখচিত আভরণ-সংযুক্ত বিস্তৃত মনোহর সুবর্ণবিভূষিত সুন্দর প্রাসাদ মধ্যে শয্যাতলে সুখভোগে রত হইতে পারি, সেই পতিই তোমার উপযুক্ত। ৮৫-৮৬
হে সুভগে! যদি ইহা জানিয়াও শঙ্করকে বাঞ্ছা কর, তাহা হইলে তোমার তপস্যার প্রয়োজন নাই; আমি তোমাকে হর সহ সঙ্গতা করিব। ৮৭
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–কালী ব্রাহ্মণের সেই অপ্রিয় বাক্য শ্রবণ করিয়া কোপান্বিতচিত্তে ব্রাহ্মণকে পরিমিত ও সত্যবাক্য বলিলেন। ৮৮
কালী বলিলেন,–হে দ্বিজনন্দন! আপনি হরকে বিশেষ না জানিয়া এরূপ বলিতেছেন, তাঁহার বাহ্যভাব দর্শন করিয়াছেন, তাহাই বলিতেছেন। ৮৯
ইন্দ্র, ব্ৰহ্মা প্রভৃতি দেবগণ, যাহার ভাব জানিতে অক্ষম, আপনি শিও বিপ্রতনয় হইয়া কি তাহার ভাব জানিতে পারিবেন? ৯০
আপনি হরকে না দেখিয়া কোন নীচ ব্যক্তির মুখে এই কুৎসিত বাক্য শ্রবণ করিয়া এরূপ বলিতেছেন। ৯১
সেই মহাদেব হইতে শ্রেষ্ঠ পতিকে আমি বাঞ্ছা করি না; অন্যের বাক্য শ্রবণ করিতে ইচ্ছাও করি না; হরসঙ্গমই নিরন্তর বাঞ্ছা করি। ৯২
গিরিজা বিপ্রকে এই কথা বলিয়া সখীর মুখ অবলোকন করত সংশয়িত চিত্তে বলিতে লাগিলেন। ৯৩
আমি এই স্থানে মহৎ চিন্তাপূর্বক তপস্যা দ্বারা হরকে আরাধনা করিতেছি, কিন্তু সেই আরাধ্য মহাদেবকে আমার সমক্ষে এই বিপ্রপুত্র নিন্দাবাক্য বলিতেছেন, অতএব ইহাকে স্তুতিবাক্য দ্বারা এখান হইতে দূর করি। ৯৪
আমি পিতার মুখে পূৰ্বে শ্রবণ করিয়াছি, মহাত্মাদিগের নিন্দা যে করে, এবং যে তাহা শ্রবণ করে, উভয়ের অপরাধই সমান হয়। ৯৫
তাহা হইলে উহাকে এখান হইতে অপনয়ন করাই ভাল, অতএব তুমি বিপ্রকে নিষেধ কর। ১৬
কালী, সখীকে এই কথা বলিয়া শিব-নিন্দা-শ্রবণজনিত অপরাধ মার্জনের জন্য শম্ভু-সঙ্গত-চিত্তে হরকে স্তব করিতে লাগিলেন। ১৭
কালী বলিলেন, কারণত্রয়ের হেতু জিতেন্দ্রিয় শিবকে আমি প্রণাম করি। হে পরমেশ্বর! আপনিই একমাত্ৰগতি, অতএব আপনাকেই আত্মা উৎসর্গ করিতেছি। ৯৮
হৃদগত উৎকৃষ্ট জ্ঞানশালী প্রপঞ্চহীন হিরণ্যবাহুকে আমি সাদরে প্রণিপাত করিতেছি এবং নারায়ণ-পদ্ম-সম্ভূত প্রধান বীজস্বরূপ জগতের হিতসাধক গিরিশকে আমি নমস্কার করিতেছি। ৯৯
দ্বিজ, পুনৰ্বার অপ্রিয় শিবনিন্দাবাক্য তাহাকে কিঞ্চিৎ বলিতে লাগিলেন; কালিকে উদ্দেশ্য করিয়া দ্বিজ, কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেছেন বুঝিতে পারিয়া গিরিসুতা সখীকে বলিলেন। ১০০
এই দ্বিজ উগ্র হরকে না জানিয়া তাহাকে নিন্দা করিবার উদ্দেশ্যে কিছু বলিতে উপক্ৰম করিতেছে, প্রাণ-বিনাশক হর-নিন্দা কিছুতেই আমি শুনিতে পারিব না। ১০১
সখি! যত দূরে গমন করিলে এই দ্বিজ-বাক্য শুনিতে না পাই, আমি তত দূরে গমন করিয়া অবস্থান করিতে ইচ্ছা করি। ১০২
এই কথা বলিয়া হিমালয়সুতা হঠাৎ গাত্রোত্থান করত দ্বিজকে পরিত্যাগ করিয়া সখীর সহিত প্রস্থান করিলেন। ১০৩।
অনন্তর শম্ভু নিজরূপ ধারণ করত, কালী তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছে দেখিয়া সহাস্যন্তঃকরণে তাহার পশ্চাৎভাগে গমন করিলেন এবং বলিলেন। ১০৪
অয়ি শঙ্করি! কালি! আমিই মহাদেব, আমি সেই হর, এখন আমার সম্ভাষণ করিতেছ না কেন? তুমি সম্মুখিনী হও, আমাকে আশ্বাস প্রদান কর। ১০৫
এই কথা বলিয়া মহাদেব কালীর অগ্রভাগে যাইয়া হস্ত প্রসারণ করত তাহার গতিরোধ করিলেন। ১০৬
গিরি-সূতা শম্ভুর মুখ নিরীক্ষণ করিয়া তাহার ভয়ে চকিতের ন্যায় হঠাৎ অধোমুখী হইলেন। ১০৭
অত্যন্ত লজ্জা ও প্রীতিতে সে সময়ে তিনি জড়ের ন্যায় হইয়া পড়িয়া রহিলেন। ভামিনী, বলিবার ইচ্ছা থাকিলেও কিছু বলিবার নিমিত্ত সক্ষম হইলেন না। ১০৮
হে দ্বিজোত্তমগণ। মনোরথ সিদ্ধ হইয়াছে বলিয়া তাহার শরীর যেরূপ সুধা-পুর্ণ হয়, সেইরূপ আনন্দপূর্ণ হইল। ১০৯
অষ্টাদশ সহস্র বৎসর পর্যন্ত যে সমস্ত তপঃক্লেশ পাইয়াছেন, তৎক্ষণাৎ সমস্ত পরিত্যাগ করত আনন্দিত হইলেন। ১১০
বৃষধ্বজ, কালীকে সেইরূপ দেখিয়া প্রণয়বশতঃ গাত্রস্থ ভস্মরূপ কাম দ্বারা মোহিত হইলেন। ১১১
অনন্তর, বিরহোদ্রিক্ত বৃষধ্বজ কালীকে প্রাপ্ত হইয়া সম্বোধন করত হর্ষোৎফুল্লচিত্তে কিঞ্চিৎ চতুরতাযুক্ত বাক্য বলিলেন। ১১২
হে সুন্দরি! তুমি আমাকে কিছুই বলিতেছ না, তবে কি তপঃক্লেশ স্মরণ করিয়া আমার প্রতি ক্ৰোধ করিয়া রহিয়াছ। ১১৩
হে সুভগে। আমিও তোমা বিহনে পরিতাপ ভোগ করিতেছি; আমার নিয়মের নিমিত্ত তুমি তপস্যা আরম্ভ করিয়াছিলে, সেই জন্য তোমার সহিত অনুরক্ত হই না। ১১৪
তাহার পর প্রিয়ে! তপোবলে তুমি সংস্কার-সম্পন্না হইলে তোমাতে অনুরক্ত হইয়াছি। আমি যে নিয়ম করিয়াছিলাম, তপস্যার জন্য তাহা অতীত হইয়াছে, তুমিও তপস্যা দ্বারা সংস্কৃতা হইয়াছ। ১১৫-১১৬
সচ্চিন্তা, জপ এবং তীব্র তপস্যা-রূপ মহৎ মূল্য দ্বারা আমি তোমার ক্রীতদাস হইয়াছি। ১১৭
অতএব তোমার অঙ্গ-সংস্কার, জটাসমূহের সংস্কার ও গাত্র হইতে বল্কল মুক্ত করিয়া মনোহর বস্ত্র নিবেশ করিতে, হার, নূপুর, কেয়ূর, গুজাদি পরিধান করাইতে–শীঘ্র নিয়োগ করিয়া আমাতে স্নেহ প্রকাশ কর। ১১৮-১৯
আমার নেত্রানলে দগ্ধ মদন ভস্মরূপে আমার অঙ্গেই বাস করিতেছেন; সে যেন প্রতিকার করিবার নিমিত্তই তোমার সমক্ষে আমাকে দগ্ধ করিতেছে। ১২০
অগ্নি মনোহারিণি। তোমার অঙ্গরূপ অমৃত দান করিয়া সেই অগ্নি-সদৃশ কাম হইতে আমাকে উদ্ধার কর। দয়িতে! আমার প্রতি প্রসন্ন হও। ১২১
ত্ৰিচত্বারিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৪৩