যদিও শ্রীলেখা সব সময়ই একজন আগন্তুকের প্রতীক্ষা করত, কিন্তু সূর্য যখন এল, তখন সে টের পায়নি। সে ঘুমিয়ে ছিল।
দরজায় দুম দুম আওয়াজ শুনে বাড়ির একজন বৃদ্ধ চাকর খুলে দিল দরজা। সূর্য হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে দেওয়াল ধরে হাঁপাতে লাগল। তার বুক থেকে তখন হাপরের মতন শব্দ হচ্ছে, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে–সে ঘর দেখতে পাচ্ছে না, মানুষ দেখতে পাচ্ছে না–সবকিছু ঘুরছে। সবকিছুতে রক্ত ছড়ানো, যোগানন্দের রক্ত। আঃ, কে হাতুড়ি পিটছে তার মাথায়! সূর্য তার মাথা এদিক-ওদিক সরিয়ে নিচ্ছে। আর একটুখানি সময় কেউ তাকে দেবে না?
বৃদ্ধ চাকর ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে গো বাবু? কে?
সূর্য মুখ ফিরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, দরজা বন্ধ করে দাও!
পরক্ষণেই আবার মাথা ঘুরে গেল সূর্যর। দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলাতে গিয়েও হাতের জোর পাচ্ছে না। একটু দূরেই একটা লম্বা সোফা–ওই পর্যন্ত সে পৌঁছোতে পারবে না? এ কী, তার হাতে রক্ত এল কোথা থেকে? দেওয়ালে রক্ত লেগে যাচ্ছে– এরা রাগ করবে। কী যেন লোকটির নাম? কার বাড়িতে সে এসেছে! আর একটু সময় কেউ তাকে দেবে না?
চোখ খুলে রক্তবর্ণ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সূর্য বলল, ওকে ডাকো।
কাকে? আপনি কাকে খুঁজছেন?
কী যেন নাম? কার যেন বাড়ি এটা? মাঠ-ঘাট পেরিয়ে কোন দিকে সে ছুটছিল? না, পৃথিবীতে রক্তের ঢেউ ছাড়া আর কিছু নেই।
দেওয়াল ছেড়ে সোফাটার দিকে এগোতে গিয়ে সূর্য ঝুপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। এবার বেশ ভালো লাগছে, ভারী আরাম, মাটি ভেদ করে সে যেন চলে যাচ্ছে অনেক অনেক নীচে, ঠান্ডা অন্ধকারে।
বুড়ো চাকর ভয় পেয়ে ডেকে আনল আর একজন চাকরকে। সে আবার রান্নার ঠাকুরকে ডাকল। তারপর খবর পাঠানো হল সরকারবাবুর কাছে। বাড়ির চাকরবাকর ও কর্মচারীদের একটি ছোটখাটো জনতা কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি করল সূর্যর দেহটা–তারপর তার হাতে রক্ত দেখে আঁতকে উঠল। এবার কর্তাদের খবর পাঠানো দরকার।
কর্তাদের মধ্যে প্রভাসকুমারই একমাত্র পুরুষমানুষ তখন বাড়িতে উপস্থিত। প্রভাসকুমারের বাবা তীর্থ থেকে এখনও ফেরেননি। আত্মীয়স্বজনরাও নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছেন–শিগগিরই দুর্গাপূজা উপলক্ষে সবাই আবার এ বাড়িতে এসে জড়ো হবেন।
প্রভাসকুমার তখন নিজের পাঠকক্ষে একখানি বই চোখের সামনে মেলে গভীর চিন্তামগ্ন। সরকারবাবু বাইরে থেকে ভয়ার্ত গলায় ডাকল।
প্রভাসকুমারের ভুরু কুঁচকে গেল। মুখ না-ফিরিয়েই বললেন, কাল সকালে এসো। এখন বিরক্ত কোরো না!
দাদাবাবু একবার নীচে আসতে হবে।
বলছি তো এখন বিরক্ত কোরো না।
সরকারবাবু দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ে তড়বড় করে একসঙ্গে অনেক কথা বলতে গেল।
প্রভাসকুমার বই মুড়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এত রাত্রে আমাকে বিরক্ত করার মানে কী?
প্রভাসকুমার তখন শোপেনহাওয়ার বিষয়ক মোহিতলাল মজুমদার রচিত কবিতা পাঠ করছিলেন। মাঝখানে এরকম বিঘ্ন ঘটায় তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। চটিটা পায়ে গলিয়ে বললেন, চলো, দেখি!
বারান্দা দিয়ে যাবার সময় শয়নকক্ষের দরজা ঠেলে একবার উঁকি দিলেন। আলো জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে শ্রীলেখা। বালিশময় চুল ছড়ানো। মশারির মধ্যে তাকে দেখাচ্ছে সুপ্ত রাজকন্যার মতন। আবার দরজা ভেজিয়ে চটি ফটফটিয়ে নীচে নেমে এলেন প্রভাসকুমার।
মাটিতে পাশ ফিরে শুয়ে আছে সূর্য। পা দু’খানা লম্বা করে ছড়ানো, হাত দু’খানা বুকের ওপর গুটিসুটি করা।
প্রভাসকুমার একনজর তাকে দেখে নিয়ে কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করল, এ কে?
কেউ কিছু জানে না।
এ ভেতরে এল কী করে?
বুড়ো চাকরটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার কোনও দোষ নেই, সে ভেবেছিল কর্তাবাবুদের কেউ ফিরে এসেছেন।
প্রভাসকুমার বললেন, এ তো অজ্ঞান হয়ে গেছি দেখছি। এর মুখেচোখে জল দাও।
সরকারবাবু বলল, দাদাবাবু, ওর হাতে রক্ত লেগে আছে দেখছি, পুলিশে খবর দেব?
পুলিশের নাম শুনেই প্রভাসকুমার মুখ বিকৃত করলেন। এই সুন্দর শান্ত রাত্রিতে কবিতার বই ফেলে উঠে এসে একটি রক্তাক্ত অপরিচিত মানুষ দেখাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট–এর ওপর পুলিশের দৃশ্য সহ্য করা তার পক্ষে এখন অসহ্য। তিনি পুনরায় মৃদু গলায় বললেন, আগে ওর মুখেচোখে জল দাও।
এক বালতি জল এনে ছিটিয়ে দেওয়া হতে লাগল সূর্যর মুখে। কাপড় বাঁচাবার জন্য প্রভাসকুমার একটু সরে দাঁড়ালেন। প্রভাসকুমার ধপধপে ধুতি ও ফরসা বেনিয়ান পরে আছেন–তাঁকে দেখলে সব সময়ই বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয়, পৃথিবীতে এত ধুলোবালি ময়লা বাঁচিয়ে তিনি থাকেন কী করে?
জলের ঝাঁপটায় সূর্য চোখ খুলল একবার, অন্য দিকে পাশ ফিরল। ঠিক যে কাতর ভাবে তা নয়, বিরক্তিসূচক উঃ আঃ শব্দ করল আস্তে আস্তে।
প্রভাসকুমার প্রশ্ন করলেন, তুমি কে?
সূর্যর চোখে এখনও পৃথিবীটার রং লাল, ছলাৎ ছলাৎ করে সে শুনতে পাচ্ছে রক্তের শব্দ। সে কি এখনও দৌড়োচ্ছ? আর যে দৌড়োনো যায় না, পায়ের শিরা ছিঁড়ে যাবে, বুক ফেটে হাওয়া বেরিয়ে আসবে।
সূর্য ঝাঁপসা গলায় বলল, ওকে ডাকুন।
কাকে? তুমি কাকে খুঁজছ?
সূর্য আবার চোখ বুজে ফেলল। এটা কার বাড়ি? তার কোথায় আসার কথা ছিল। সে যেন একটা গভীর দিঘির জলে ডুবে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, বার বার ভেসে ওঠার চেষ্টা করছে জোর করে, পারছে না।
প্রভাসকুমার বললেন, ও আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে।
একজন চাকর বলল, আবার জল চালাব?
প্রভাসকুমার নিচু হয়ে সূর্যর চোখের পাতা টেনে দেখলেন। কপালে হাত দিয়ে বললেন, গায়ে ভীষণ জ্বর। এত অল্প বয়স–
উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একে সোফাটার ওপর শুইয়ে রাখো আজ রাত্তিরটার মতন। দাদাবাবু, যদি চোরডাকাত হয়?
দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে।
প্রভাসকুমার ওপরে উঠে এসে আবার কাব্যগ্রন্থ খুলে বসলেন। মনটা চঞ্চল হয়ে গেছে। ঘন ঘন হাঁটু দোলাচ্ছেন। রাত্তিরবেলা তারই বাড়ির বৈঠকখানায় একটি অচেনা যুবকের চেতনাহীন দেহ বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাঁর চিন্তাকে আলোড়িত করে। এসব কী হচ্ছে চারদিকে? এত আগুন, রক্ত, চিৎকার, অত্যাচার। পৃথিবীতে কি কোনও দিন শান্তি আসবে না? ইংরেজরা বড় অদ্ভুত জাতসব সময় এত যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত, তবু ওই জাতের মধ্যে এমন ভালো ভালো কবি জন্মায় কী করে? তবে, বাল্মীকি না জন্মালে পৃথিবীতে আর কোনও কবিই জন্মাত না। লোকে জানতই না, কবিতা কাকে বলে! সবই তো ইন্ডিয়া থেকে শিখেছে! আমাদের পুষ্পক রথ, আমাদের নালিকাস্ত্র–এসব কতকাল আগের। নেহাত আজকের এই বস্তুতান্ত্রিক জগতে…
বাতি নিভিয়ে এ-ঘরের দরজা টেনে প্রভাসকুমার চলে এলেন শোবার ঘরে। শ্রীলেখাকে জাগালেন না। মশারি তুলে শ্রীলেখার শিয়রের পাশে বসে বিয়ের দিন বাসর ঘরে শ্রীলেখার দিকে যে রকম ভাবে তাকিয়ে ছিলেন ঠিক সেই একই দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। রূপ দেখে দেখে আর আশ মেটে না। এই চোখ, এই ভুরুর রেখা, হরিণীর মতন মসৃণ ত্বক–এসবের মধ্যেই কী এক জাদু আছে–নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকলেও তো ক্লান্তি বোধ হয় না কখনও।
প্রভাসকুমার শ্রীলেখার চুলের গুচ্ছ হাতে তুলে নিয়ে গন্ধ শুকলেন। সব রমণীর চুলেই কী রকম যেন একটা ঐতিহাসিক গন্ধ আছে। অ্যান্টনি ক্লিয়োপেট্রার চুলে নিশ্চয়ই ঠিক এই রকমই গন্ধ পেয়েছিল। আচমকা প্রভাসকুমারের মাথায় দুটি কবিতার লাইন এসে গেল:
এখন কি আমি অতীত কালের ভুলে
নাক ডুবায়েছি
ক্লিয়োপেট্রার চুলে?
প্রভাসকুমার খুব খুশি হয়ে উঠলেন। শুধু খুশি নয়, কবিতা রচনার সময় তার মনের মধ্যে একটা দিব্য আনন্দ দেখা দেয়। পরবর্তী লাইনটির কথা তিনি যখন চিন্তা করছেন, তখন শ্রীলেখা চোখ মেলে বলল, এখন ক’টা বাজে?
প্রভাসকুমার প্রসন্ন মুখে বললেন, অনেক রাত।
তুমি ঘুমোবে না?
তুমি ঘুমাও, আমি তোমাকে দেখি।
মশারির ভেতরে বোধহয় মশা ঢুকে গেছে।
কই না তো! তোমায় কামড়েছে?
কী জানি! পিন পিন করে একটা শব্দ হচ্ছিল কানের কাছে, তাই ঘুম ভেঙে গেল।
প্রভাসকুমার সন্তর্পণে স্ত্রীর কপালে হাত রেখে বললেন, তুমি চোখ বোজো, আমি তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা।
শ্রীলেখা, একটু পরে আবার যদি তোমাকে জাগিয়ে তুলি, তুমি রাগ করবে?
ও মা, রাগ করব কেন?
মানে, যদি ইচ্ছে হয়, মানে যদি—
আলো নিভিয়ে দেবে না?
রূপসুধা পান করতে করতে আলো নিভিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব প্রভাসকুমারের পছন্দ হয় না। কিন্তু স্ত্রীর কথা অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। মশারি থেকে বাইরে এলেন।
আলো নেভাবার সঙ্গে সঙ্গে জানলার বাইরের দৃশ্য দেখা গেল। প্রভাসকুমার দেখলেন তার বাড়ির বাইরের রাস্তা দিয়ে সার সার পুলিশের গাড়ি চলেছে। নিস্তব্ধ নিশীথে সেই মন্থরগতি গাড়ির শব্দ মনে আতঙ্ক জাগায়। প্রভাসকুমার ভয় পেয়ে গেলেন। গত কয়েক দিন ধরে এ-দিকে পুলিশের আনাগোনা কিছু কমেছিল–আজ রাত্তিরে আবার এই চাঞ্চল্যের কারণ বুঝতে তার দেরি হল না। তিনি দুই আর দুই-এ চারের হিসেব করে নিলেন। জানলার একটা পাল্লা ভেজিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন, আজ আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে।
শ্রীলেখা শুনতে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, কেন?
প্রভাসকুমারের পাতলা মুখোনি এখন বিবর্ণ। জানলার বাইরে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললেন, কোথা থেকে একটা ছেলে আজ আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।
শ্রীলেখা বিছানা থেকে নেমে তাড়াতাড়ি স্বামীর পাশে এসে জিজ্ঞেস করল, কে?
কী জানি! নামটাম বলতে পারছে না।
কী করে চুল?
চাকরবাকররা বুঝতে পারেনি।
নাম বলছে না?
বলার ক্ষমতা নেই। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
আমাদের বাড়িতে এল কেন?
দেখে তো চোরডাকাত মনে হল না। অল্প বয়স, সবে দাড়িগোঁফ উঠেছে।
পুলিশ ওকে খুঁজছে?
তা জানি না। ছেলেটার হাতে রক্ত লেগে ছিল।
শ্রীলেখা মুখ দিয়ে একটা ভয়ের শব্দ করল। প্রভাসকুমার হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, পুলিশ এলে আমি বলব, আমার কোনও দোষ নেই! একজন কেউ যদি আমার বৈঠকখানায় এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, আমি কি তাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতে বলব? কেউ তা পারে?
এখন সে আমাদের বাড়িতেই আছে?
নড়বার ক্ষমতা নেই, যাবে কী করে! পৃথিবীর কেউ কি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না?
এরপর বেশ কিছুক্ষণ স্বামী-স্ত্রী জানলার পাল্লার আড়াল থেকে তাকিয়ে রইল বাইরে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পুলিশের গাড়ি আনাগোনা করল রাস্তা দিয়ে।
শ্রীলেখা একসময় বলল, তোমার পিসেমশাইকে খবর পাঠাবে নাকি?
প্রভাসকুমার বললেন, পুলিশ আসুক আগে!
পুলিশ শেষ পর্যন্ত এল না বাড়ির মধ্যে। ধীর গতিতে গাড়িগুলো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একসময় চলে গেল। পুলিশের মতলব ঠিক বোঝা গেল না।
বিছানায় ফিরে এসে স্বামী-স্ত্রী কিছুক্ষণ উদ্বিগ্ন ভাবে আলোচনা করল। তারপর একসময় প্রভাসকুমার শ্রীলেখাকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লেন। নিজের স্বপ্নের জগতের বাইরে প্রভাসকুমার বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেন না।
শ্রীলেখা জেগে রইল আরও অনেকক্ষণ। তার বুকের মধ্যে মেল ট্রেনের মতন আওয়াজ হচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে কিছু ভাবতেও সাহস পাচ্ছে না। এক এক সময় হয় এ রকম, সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। কে এসেছে তাদের বাড়িতে? নিজের মনে মনেও নাম উচ্চারণ করতে পারছে না শ্রীলেখা, যদি সে না হয়? এ কি সম্ভব? শ্রীলেখা কি এখন আনন্দ করবে, না কাঁদবে?
একবার শ্রীলেখা ঘুমন্ত স্বামীর বাহুপাশ ছাড়িয়ে মশারির বাইরে বেরিয়ে এল বাথরুমে যাবার জন্য। দরজা খোলার পর তার গা ছমছম করতে লাগল। সারা বাড়ি অন্ধকার। কেউ আর জেগে নেই। নীচের তলায় একজন অজ্ঞাত আগন্তুক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। শ্রীলেখা কি একবার নীচে গিয়ে দেখে আসবে?
এক পা দু পা এগিয়েও শ্রীলেখা থমকে গেল। তার ভয় করছে। জীবনে সে কখনও এত ভয় পায়নি। যদি সে না হয়? যদি কোনও চোরডাকাত বা গুন্ডা–। না, শ্রীলেখার অত সাহস নেই। সে এই অন্ধকারে একা একা নীচে নেমে যেতে পারবে না।
ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীলেখা জেগে উঠল। তক্ষুনি তার মনে পড়ে গেল সবকিছু। দিনের প্রথম আলোয় তার আর কোনও সন্দেহই নেই। সে তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কে শুয়ে আছে নীচের ঘরে। তরতর করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। অন্য কারোকে না-ডেকেই। সে বসবার ঘরের দরজা খুলল।
সূর্য তখনও সোফায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। চেহারা অনেক বদলে গেছে তার। মুখে সরু দাড়ির রেখা, মাথার চুলে কতকাল চিরুনি পড়েনি–রোগা হয়ে গেছে অনেক, তবু তাকে চিনতে শ্রীলেখার একমুহূর্ত দেরি হল না। সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সূর্যর সামনে। এক মিনিট চুপ করে থেকে শুধু দেখল। সূর্যর উঁচু হয়ে ওঠা কণ্ঠার হাড়ে আঙুল বোলাল একবার। তারপর ওকে না জাগিয়ে শ্রীলেখা দ্রুত পায়ে আবার উঠে গেল ওপরে।
স্বামীর গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, এই শুনছ! শুনছ!
প্রভাসকুমার চোখ মেলে বললেন, কী?
কাল রাত্তিরে যে এসেছে–
কে এসেছে?
কাল রাত্তিরে! সেই যে তুমি—
হ্যাঁ হ্যাঁ, কী হয়েছে? পালিয়েছে?
না। আছে। ও আমার দাদা।
কী? তোমার আবার দাদা কোথা থেকে এল?
আমার পিসতুতো দাদা। সূর্যদা। তুমি ওকে দেখোনি। আমরা আগে যে পিসেমশাইয়ের বাড়িতে থাকতাম–
প্রভাসকুমার উঠে বসে চোখ কচলে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমার কোন পিসেমশাই? বড়বাবু? তাঁর ছেলে?
হ্যাঁ, আমার বিয়ের আগেই—
সেই যে সেই রোমান্টিক ক্যারেকটার? যে প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়? সে কি বোমা বানাবার দলে ভিড়েছে নাকি?
শ্রীলেখা একটু ইতস্তত করে বলল, জানি না!
প্রভাসকুমার হেসে বললেন, তোমার দাদা, তার মানে আমার শালা হল বড় কুটুম! তা একটু খবরটবর দিয়ে আসবে তো, কাল রাত্তিরে খাতির-যত্ন করতে পারিনি।
শ্রীলেখা ব্যাকুল ভাবে বলল, ওকে তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না। ও এমনিতে খুব ভালো।
প্রভাসকুমার স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বললেন, কাল রাত্তিরে যখন জানতাম না ওকে তোমার দাদা বলে, তখনও তো তাড়িয়ে দিইনি। মানুষের জীবনের দাম আছে আমার কাছে।
শ্রীলেখা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে গেল। চোখে জল এসে গেল তার। টলটলে চোখদুটো সে চেপে ধরল স্বামীর গায়ে।
প্রভাসকুমার বিছানা থেকে নেমে বললেন, ওর তো গায়ে খুব জ্বর দেখেছিলাম। দানুকাকাকে খবর পাঠাতে হবে।
ও কি বাইরের ঘরে থাকবে?
পাগল নাকি? ওখান থেকে সরাতে হবে। ছোটকাকার ঘরে রাখবে? ছোটকাকার তো আসতে অনেক দেরি আছে। তা ছাড়া পুলিশ টুলিশ যদি আসে–
প্রভাসকুমারের তদারকিতে তিন জন লোক মিলে সূর্যকে ধরাধরি করে নিয়ে এল তিনতলার একটি ঘরে। সূর্য চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুধু। তার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কথাও বলছে না।
বিছানায় শুইয়ে দেবার পর সূর্য আবার পাশ ফিরে ঘুমোতে চাইল। প্রভাসকুমার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি কষ্ট হচ্ছে খুব? কোথাও লেগেছে?
সূর্য উত্তর দিল না, আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু বাদে আর একবার জেগে ঘরখানার চারপাশে দেখে নিল, দেখে নিল দরজা ও জানলার অবস্থান। উঠে বসতে গিয়েও পারল না। সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
একটু বাদেই শ্রীলেখা এক গামলা গরম জল এনে বসল সূর্যর বিছানার পাশে। সেই জলে তোয়ালে ভিজিয়ে মুছে দিতে লাগল সূর্যর শরীর থেকে রক্তের দাগ এবং ধুলো কাদা। সেই আরামদায়ক উষ্ণ স্পর্শে সূর্য আবার চোখ খুলল। সামনেই শ্রীলেখার মুখখানা দেখে দু’এক পলক শুধু স্থির হয়ে রইল সে। তারপরই মুখ ফিরিয়ে নিল অন্য। দিকে।
শ্রীলেখা ডাকল, এই সূর্যদা—
সূর্য উত্তর দিল না।
শ্রীলেখা আবার বলল, এই সূর্যদা, তোমার কী হয়েছে?
সূর্য তখনও চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। লাল রঙের একটা ঝাঁপসা পরদা–এখন মাকড়সার জালের মতন সূক্ষ্ম হলেও চোখের সামনে দুলছে। শ্রীলেখার ডাক অবশ্য স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছে। এই বোধও তার ফিরে এসেছে যে, সে শুয়ে আছে নরম বিছানায়, এটা শ্রীলেখার শ্বশুরবাড়ি–এর নাম নিরাপদ আশ্রয়।
শ্রীলেখা তার মুখখানা সূর্যর মুখের কাছে এনে বলল, তোমার খিদে পায়নি? কিছু খাবে? কী খেতে ইচ্ছে করছে?
হঠাৎ সূর্যর মনে পড়ল, যোগানন্দ বলেছিল, তোর বোনের বাড়িতে গিয়ে পেট ভরে খাব।
কতক্ষণ আগে? ঠিক যেন দু’-এক মিনিট আগেই যোগানন্দ বলেছে এই কথা। খেতে খুব ভালোবাসত মানুষটা।
সূর্য আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রীতিমতন শব্দ করে কান্না, কান্নার ঝেকে তার সমস্ত শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
শ্রীলেখা প্রথম কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সূর্যকে যে সে কখনও কাঁদতে দেখেনি–তাই-ই নয়, সূর্যর যে চরিত্র সে দেখেছে–তাতে এ রকম কান্নার কথা কল্পনাই করা যায় না। একজন তেজি রুক্ষ পুরুষ অসহায়ের মতন কঁদছে। যেন সে তার সারা জীবনের জমানো কান্না একসঙ্গে কেঁদে নিচ্ছে।
শ্রীলেখা জোর করে সূর্যর মুখখানা নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে কী? আমাকে বলো তো!
শ্রীলেখার নিজের চোখেও জল এসে গেছে। এত কান্না দেখলে কি কেউ স্থির থাকতে পারে। সূর্য নিজেকে সামলাতে পারছে না। কান্না থামাতে গেলে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে তার।
শ্রীলেখা ভিজে তোয়ালে দিয়ে তার চোখ মুছে দিতে লাগল। খানিকটা বাদে সূর্য সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে গেল। চোখ বুজে রইল চিত হয়ে। শ্রীলেখা তখনও প্রশ্ন করছে, কী হয়েছে, আমাকে বলবে না?
সূর্য চোখ না খুলেই বলল, আমি কেন এখানে এলাম? আমার আসা উচিত নয়।
কেন?
আমার আসা উচিত হয়নি।
তুমি আমার দিকে তাকাবে না?
আমি এখানে এসে ভুল করেছি।
আমি জানতাম তুমি আসবেই।
না, আমারই মরে যাওয়ার কথা ছিল। আমি কেন মরলাম না!
তুমি কিছুতেই মরতে পারো না। তুমি টের পাওনি, আমি সব সময় মনে মনে তোমার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম। তুমি যেখানেই থাকো, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার সঙ্গে আবার দেখা না হলে আমি সমস্ত পৃথিবীর ওপর একটা নিদারুণ অভিমান নিয়ে চলে যেতাম।
শ্রীলেখা আমি কারওর যোগ্য নই।
তুমি আর কথা বোলো না এখন। তোমার গায়ে খুব জ্বর। ডাক্তারকে খবর পাঠানো হয়েছে।
এসব কিছুই পাওয়ার অধিকার আমার নেই।
সূর্যদা, লক্ষ্মীটি, একটু চুপ করে শুয়ে থাকো।
গরম জলে ভেজানো তোয়ালে দিয়ে শ্রীলেখা নিঃশব্দে সূর্যর শরীর পরিষ্কার করে দিতে লাগল। সূর্য আর কোনও বাধা দিল না, সূর্যর গায়ের জামাটা তুলতেই শ্রীলেখা দেখতে পেল তার কোমরে গোঁজা রিভলবার। ঝট করে সেটা সে খুলে নিল। একসময় এটা তার কাছেই রাখা ছিল। এখন থেকে আবার তার কাছেই থাকবে। আর কোনও দিন ফেরত দেবে না।