৪৩. পরিশিষ্ট – গুরুদেব রচিত মৌলানা জিয়াউদ্দিন কবিতা

পরিশিষ্ট

আমান উল্লা হৃতসিংহাসন উদ্ধার না করতে পেরে আফগানিস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ইতালির রাজা তাঁকে স্বরাজ্যে আশ্রয় দেন। মুইন-উস-সুলতানে ইরানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

আমান উল্লার হয়ে যে সেনাপতি ইংরেজের সঙ্গে আফগান স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন তাঁর নাম নাদির শাহ। তিনি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে ছিলেন। পরে পেশাওয়ার এসে সেখানকার ভারতীয় বণিকদের অর্থ সাহায্যে এবং আপন শৌর্যবীর্য দ্বারা কাবুল দখল করে বাদশাহ হন। বাচ্চাকে সঙ্গীন দিয়ে মারা হয়— পরে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়।

এ সব আমি খবরের কাগজে পড়েছি।

দেশে এসে জানতে পেলুম, আমার আত্মীয় কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য মরহুম মৌলবী আবদুল মতিন চৌধুরীর উম্মা দর্শনে ভারতসরকার স্যার ফ্রান্সিসকে আদেশ (বা অনুরোেধ) করেন আমাকে দেশে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে দেবার জন্য।

আমি কাবুল ছাড়ার কয়েক দিন পরেই ব্রিটিশ লিগেশন বহু অসহায় ভারতীয়কে কাবুলে ফেলে ভারতবর্ষ চলে আসেন।

এই ‘বীরত্বের’ জন্য স্যার ফ্রান্সিস অল্পদিন পরেই খেতাব ও প্রমোশন পেয়ে ইরাক বদলি হন।

মৌলানা জিয়াউদ্দিন ভারতবর্ষে ফিরে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপকের কর্মগ্রহণ করেন। তিনি বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন (ফার্সীতে লেখা ব্রজভাষার একখানা প্রাচীন ব্যাকরণ প্রকাশ তার অন্যতম,) এবং গুরুদেবের অনেক কবিতা উত্তম ফার্সীতে অনুবাদ করেন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তিনি অল্পবয়সে মারা যান। তার অকালমৃত্যু উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে শোকসভায় গুরুদেব আচার্যরূপে যা বলেন তার অনুলিপি প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্র রচনাবলীর চতুর্বিংশ খণ্ডে অনুলিপিটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। গুরুদেব রচিত মৌলানা জিয়াউদ্দিন কবিতাটি এখানে বিশ্বভারতীর অনুমতি অনুসারে ছাপানোটা যুক্তিযুক্ত মনে করলুম;

মৌলানা জিয়াউদ্দিন

কখনো কখনো কোনো অবসরে
নিকটে দাঁড়াতে এসে;
‘এই যে’ বলেই তাকাতেম মুখে
‘বোসো’ বলিতাম হেসে।
দু-চারটে হত সামান্য কথা
ঘরের প্রশ্ন কিছু,
গভীর হৃদয় নীরবে রহিত
হাসিতামাসার পিছু।
কত সে গভীর প্রেম সুনিবিড়
অকথিত কত বাণী,
চিরকাল-তরে গিয়েছ যখন
আজিকে সে-কথা জানি।
প্রতি দিবসের তুচ্ছ খেয়ালে
সামান্য যাওয়া-আসা,
সেটুকু হারালে কতখানি যায়
খুঁজে নাহি পাই ভাষা।
তব জীবনের বহু সাধনার
যে পণ্য ভার ভরি
মধ্যদিনের বাতাসে ভাসালে
তোমার নবীন তরী,
যেমনি তা হোক মনে জানি তার
এতটা মূল্য নাই।
যার বিনিময়ে পাবে তব স্মৃতি
আপন নিত্য ঠাঁই–
সেই কথা স্মরি বার বার আজ
লাগে ধিক্কার প্রাণে–
অজানা জনের পরম মূল্য
নাই কি গো কোনো খানে।
এ অবহেলার বেদনা বোঝাতে
কোথা হতে খুঁজে আনি
ছুরির আঘাত যেমন সহজ
তেমন সহজ বাণী।
কারো কবিত্ব, কারো বীরত্ব,
কারো অর্থের খ্যাতি–
কেহ-বা প্রজার সুহৃ সহায়,
কেহ-বা রাজার জ্ঞাতি–
তুমি আপনার বন্ধুজনেরে
মাধুর্যে দিতে সাড়া,
ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা
সকল খ্যাতির বাড়া।
ভরা আষাঢ়ের যে মালতীগুলি
আনন্দ মহিমায়
আপনার দান নিঃশেষ করি
ধূলায় মিলায়ে যায়–
আকাশে আকাশে বাতাসে তাহারা
আমাদের চারি পাশে
তোমার বিরহ ছড়ায়ে চলেছে
সৌরভ নিঃশ্বাসে।

(নবজাতক)

তামাম শুদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *