দেশ থেকে লন্ডনে যাওয়ার সময় অলি কোনো ক্লান্তি বা অস্বস্তি বোধ করেনি। কিন্তু এত বড় আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সে জেট-ল্যাগে ভুগতে লাগলো। সর্বাঙ্গে নিদারুণ অবসাদ, ঘুমে চোখ টেনে আসছে। নতুন জায়গায় এসে লোকজনের সঙ্গে কথা বলবে কী, সে তাকাতেই পারছে না ভালো করে, অথচ প্লেনে তার এক ফোঁটাও ঘুম আসেনি। শর্মিলা তার অবস্থা বুঝতে পেরে ব্রুকলিনের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে সেই সন্ধেবেলাতেই তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। এই সময় আহারে রুচি থাকে না, তাই খাওয়ার জন্যও জোর করলো না।
অলির ঘুম ভাঙালো খুব ভোরে। প্রথমে তার মনেই পড়লো না যে সে কোথায়। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখলো একটি সম্পূর্ণ অচেনা ঘর। তার পাশেই একটি মেয়ে শুয়ে আছে। এ কে? ঝুঁকে মুখখানা দেখার পর মনে পড়লো, এর নাম শর্মিলা, কাল প্লেন থেকে নেমেই এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। শর্মিলা ঘুমিয়ে আছে পাশ ফিরে, মুখখানা দেখলেই বোঝা যায় সে খুব উপভোগ করছে এই ভোরবেলার ঘুম। সে গোলাপি রঙের আধা স্বচ্ছ বেশ সুন্দর কুঁচি দেওয়া ম্যাক্সি পরে আছে, শর্মিলার গায়ের রং শ্যামলা। নইলে তাকে মেমসাহেব মনে করা যেতে পারতো।
মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরখানা দেখতে লাগলো অলি। ওয়ালপেপারের ওপর নানারকম। পোস্টার ও খবরের কাগজের ছবি সাঁটা। রবীন্দ্রনাথ, চে গুয়েভারা, শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী, আর কয়েকটি ছবি অলি চিনতে পারলো না। একখানা বড় রঙিন ছবিতে গ্রাম্যদৃশ্য, মাথায় ধানের আঁটি নিয়ে যাচ্ছে এক জোড়া নারী ও পুরুষ, তাদের মুখের হাসি দেখলেই বাঙালী বলে বোঝা যায়। এটা কি বাবলুদার ঘর? অলির মনেই পড়লো না যে তার বাবুলদা নিউ ইয়র্কে থাকে না। বাবলুদা কোথায়, পাশের ঘরে?
সন্তর্পণে খাট থেকে নেমে অলি প্রথমে যে দরজাটা খুললো, তার বাইরে কমন প্যাসেজ। ঘরের মধ্যে বিপরীত দিকের দরজাটি বাথরুমের, পাশেরটি রান্নাঘরের। আর কোনো ঘর নেই। তাহলে বাবলুদা তাকে এখানে রাত্তিরে ফেলে রেখে কোথায় চলে গেছে?
নিজের শাড়িটা দেখে অলি আরও অবাক হলো। এই হাফ সিল্কের পাড়হীন হলুদ শাড়ি তো তার নয়! নিজের শাড়ি ছেড়ে এই শাড়ি সে পরলো কখন? সে কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, অন্য কেউ পরিয়ে দিয়েছে? এই কথাটা ভাবতেই লজ্জায় অলির কর্ণমূল রক্তিম ও উষ্ণ হয়ে উঠলো। দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো রয়েছে তার সুটকেসটা, সেটার চাবি খোলা হয়নি।
তারপর আস্তে আস্তে অলির মনে পড়লো। নেশাগ্রস্তের মতন অলির গত বিকেলের পরের সব স্মৃতি ঝাঁপসা হয়ে গেছে, অথচ অলি মোটেই নেশা করেনি, প্লেনে সেই ইজিপসিয়ান ভদ্রলোকের দেওয়া রেড ওয়াইন সামান্য একটু ঠোঁটে স্পর্শ করেছিল মাত্র, তাতে মোটেই নেশা হতে পারে না। তবু তার একটা আচ্ছন্নের ভাব এসেছিল। এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসার সময় গাড়িতে কারা কারা যেন ছিল, বাবলুদা কথা বলছিল খুব কম। তারপর একটা ঘরে আসা। হলো, সেটা এই ঘরটাই? আশ্চর্য, অলি কি তখন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখেনি? হ্যাঁ, অলি সুটকেস খোলার চাবি খুঁজে পাচ্ছিল না, কিছুতেই পায়নি, চাবিটা কি হারিয়ে গেল? সুটকেসের চাবি তো তার হ্যাণ্ডব্যাগের মধ্যে ছিল না, লণ্ডনে বিশাখাদের বাড়ি ছাড়ার আগে সে। এই সুটকেসে চাবি লাগিয়েছে, তা হলে? প্লেনের মধ্যেই চাবিটা হারিয়ে গেল?
সুটকেস খুলতে পারেনি বলেই শর্মিলা তাকে কাল রাতে ব্যবহার করার জন্য একটা শাড়ি দিয়েছিল। অলি নিজেই বাথরুমে গিয়ে পোশাক বদল করেছে, তার মনে পড়েছে। বাথরুমের দরজাটা আবার খুলে অলি দেখলো শাওয়ার স্ক্রিনের ওপর তার শাড়িটা ঝুলছে, বাথরুমটাও এখন চেনা লাগছে। শর্মিলা ওয়ার্ডরোব থেকে তার শাড়ি বার করে দিয়েছিল, শর্মিলা কি এখানেই থাকে? অথচ টেবিলের ওপর ছড়ানো কয়েকটি বইতে একটি মুসলমানের নাম লেখা। তুতুলদির মতন, এই শর্মিলাও কোনো মুসলমানকে বিয়ে করেছে? না, তাহলে শর্মিলা বাবলুদার কে? না, না, তা হতেই পারে না।
দ্বিতীয় যে হ্যাণ্ডব্যাগটা অলি সঙ্গে এনেছে, সেটাও রয়েছে টেবিলের ওপর। অলি ব্যাগটা খুলে একেবারে উল্টে দিয়ে চাবি খুঁজতে লাগলো। না, চাবিটা সত্যিই নেই। সুটকেসের তালা ভাঙতে হবে। শর্মিলা মেয়েটি কত ভালো, সামান্য আলাপেই তাকে নিজের শাড়ি ব্যবহার। করতে দিয়েছে। শর্মিলার ব্যবহারের মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা আছে, সেটাও মনে পড়লো অলির। সে অবশ্য মনে মনে কল্পনা করেছিল, এয়ারপোর্টে বাবলুদা একা থাকবে।
হ্যাণ্ডব্যাগে অলি তার টুথব্রাশ ও পেস্ট পেয়ে গেল। দ্রুত দাঁত মেজে ফেলার পরেই তার চা তেষ্টা ও খিদের উদ্রেক হলো একসঙ্গে। মনে হয় যেন কতদিন সে কিছু খায়নি। খিদের সঙ্গে পয়সার সম্পর্ক, এবার তার মনে পড়ে গেল তার কাছে টাকা পয়সা কিছুই নেই। সে ট্রাভলার্স চেক পর্যন্ত খুইয়েছে। অবশ্য এখন রাস্তায় বেরিয়ে পয়সা দিয়ে খাবার কেনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, সে তো এখানকার কিছুই চেনে না। অলি এখনও নিউ ইয়র্কের কিছুই দেখেনি। এই ঘরটাই অ্যামেরিকা।
সে একটা জানলার পর্দা সরিয়ে দিল। এই ঘরখানা বেশ উঁচুতে, ছ’ সাততলা হবে বোধ হয়। অলি কখনো এত উঁচু বাড়িতে থাকেনি, লণ্ডনে বিশাখাদের বাড়িটা বেসমেন্ট নিয়ে দোতলা, রিডিং-এ তার বান্ধবীর বাড়িটাও সেরকমই ছিল। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে সামনের বাগান, বেশ বড় কম্পাউন্ড, তার পরে বৃষ্টিভেজা কালো রাস্তা, এখনও বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তার দু’ ধারে অনেক গাড়ি পার্ক করা। লন্ডনের সঙ্গে যেটুকু পার্থক্য চোখে পড়ছে, তা হলো কাছাকাছি বাড়িগুলো সবই বড় বড়, রাস্তার গাড়ি গুলোও বেশ বড় আকারের। কাল এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে কে যেন বলছিল, তারা ব্রুকলিনে যাচ্ছে। নিউ ইয়র্কের সঙ্গে ব্রুকলিনের যে কী তফাত, তা অলি ঠিক জানে না। বিখ্যাত ব্রুকলিন ব্রীজ তো নিউ ইয়র্কেই, তাই না?
অলির সত্যিই খিদে পেয়েছে। রান্না ঘরে একটা ফ্রিজ আছে। এদেশে প্রত্যেক বাড়িতেই ফ্রিজে নানারকম খাবার-দাবার থাকে, দুধ, আইসক্রিম তো থাকবেই। তা বলে অলি কি একটা অচেনা বাড়ির ফ্রিজ খুলে কিছু খেতে পারে? ছেলেরা হলে পারতো। শর্মিলা জেগে উঠুক, তারপর দেখা যাবে।
বাথরুমে গিয়ে অলি খুব তাড়াতাড়ি, যেন এখুনি প্লেন ধরতে হবে এরকম ব্যস্ততায়, শর্মিলার শাড়িটা ছেড়ে নিজের পুরোনো শাড়িটাই পরে নিল। প্লেনে আসার জন্য তার শাড়ি তো ময়লা হয়নি, এটা পরেই রাত্তিরে স্বচ্ছন্দে শোওয়া যেত, কেন বদলাতে হলো কে জানে! অন্যের জিনিস ব্যবহার করলে অলির খুব অস্বস্তি হয়।
বাথরুমের দরজাটার পেছন জোড়া লম্বা আয়না। এই বাথরুমে ঢুকলেই নিজেকে না দেখে উপায় নেই। নিজের মুখের দিকে তাকাতেই কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে এলো অলির চোখ দিয়ে। অলি আর সামলাতে পারলো না, বেশ বুক খালি করে সে কাঁদলো নিঃশব্দে। তার কষ্ট হচ্ছে খুব, তবু কিসের জন্য এই কান্না তা সে জানে না।
বাবার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। শেষের দিকে বাবাই তাঁকে বেশি বেশি উৎসাহ দেখিয়ে এখানে পাঠালেন। কিন্তু বাবার কি সত্যিই ইচ্ছে ছিল? বিমানবিহারী চেয়েছিলেন যে, তাঁর পুত্রসন্তান নেই, তাঁর বড় মেয়ে অলিই তাঁর ব্যবসাপত্তর দেখবে। অলি প্রকাশনা ব্যবসার অনেকটাই বুঝে নিয়েছে, ঠিক দু’ বছর এখানে কাটিয়েই সে ফিরে যাবে। বাবা কি দু বছর অপেক্ষা করতে পারবেন না? দমদমে শেষ মুহূর্তে বাবার মুখখানায় যেন একটা গম্ভীর হতাশার ছাপ পড়েছিল। কেন? বাবা কি বাবলুদা সম্পর্কে আগেই কিছু জানতে পেরেছিলেন?
বাবলুদা তার সঙ্গে একবারও নিভৃতে কিছু বলার চেষ্টা করেনি, তার হাতখানাও ছোঁয়নি। কেমন যেন আলগা আলগা ভাব। লন্ডনের আবহাওয়া, সেখানে কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এইসব জিজ্ঞেস করলো, কলকাতায় তার প্রিয়জনদের কথা এ পর্যন্ত সে জানতে চাইলো না। অথচ এই বাবলুদাই আঘাত পাবে ভেবে কতকগুলো কঠিন সত্যকে মোহময় মিথ্যের সাজ পরিয়ে এনেছে অলি!
শর্মিলা নামের মেয়েটির সঙ্গে বাবলুদার কী সম্পর্ক তা আর বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না। কাল যে গাড়ি চালাচ্ছিল, তার নাম কী যেন, সিদ্ধার্থ? হ্যাঁ সিদ্ধার্থ, তার সঙ্গে শর্মিলা যেভাবে কথা বলছিল, তারচেয়ে বাবলুদার সঙ্গে কথা বলছিল একেবারে সম্পূর্ণ অন্য সুরে। সে সুর শুনলেই বোঝা যায়। পুরুষরা না বুঝুক, মেয়েরা বোঝে। বাবলুদার সঙ্গে শর্মিলার কথার মধ্যে আছে একটা বিশ্বাসের অধিকারবোধ।
অলি চোখের জল মুছে ফেললো। শর্মিলার ওপর সে একটুও রাগ করতে পারছে না। শর্মিলার মধ্যে সে কোন কপটতা দেখেনি। শর্মিলার ব্যবহারের সারল্য কিছুতেই অভিনয় হতে পারে না। শর্মিলা তার সম্পর্কে কিছু জানে না।
বাবলুদার সঙ্গে অলির চাক্ষুষ দেখা হয়নি প্রায় তিন বছর। দীর্ঘ বিচ্ছেদ। অথচ অলি একদিনের জন্যও বাবলুদার সঙ্গে তার কোনো দূরত্ব অনুভব করেনি। শিলিগুড়িতে লেকচারারের চাকরি নিয়ে যাবার পর বাবলুদা তো আর কলকাতাতে ফিরতেই পারলো না। সেই শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ডে শেষ দেখা। বাবলুদা কিংবা অলি কেউ তো ইচ্ছে করে এই দূরত্ব রচনা করেনি, এর মধ্যে ছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন। সেই জন্যই বাবলুদার ওপর তার কখনো তেমন রাগ বা অভিমান হয়নি। সে জানতো, তার আর বাবলুদার মধ্যে কখনো ভুল বোঝাবুঝি হবে না। অলি অপর কোনো পুরুষের মুখে সুতি শুনলেই হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে এসেছে, সে পুরুষটি নাছোড়বান্দা ধরনের হলে তার ধারেকাছেই আর যায়নি। অলি তো জানতো সে অতীন মজুমদারের বাকদত্তা। দু’ জনের মধ্যে একবারও সেরকম কিছু কথা হয়নি, তবু অব্যক্ত কথা দেওয়া ছিল। নিউ ইয়র্কে পা দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই অলি বুঝেছিল, বাবলুদা অনেক দূরে সরে গেছে, বাবলুদার ওপর তার আর বিশ্বাসের কোনো জোর নেই। এই উপলব্ধির আঘাত সহ্য করতে না পেরেই কি অলি ঘুমের মধ্যে আত্মগোপন করতে চেয়েছিল? ঘুম যে এসেছিল, তাও সত্যি। এতই কষ্ট হয়েছিল যে কষ্টের কোনো বোধ ছিল না।
অলির কাছে যদি কিছু টাকা পয়সা থাকতো, তা হলে এই ভোরেই সে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়তে পারতো। হয়তো এই অচেনা বিদেশ-বিভূঁইয়ে পথ হারাতে কয়েকবার, তাতেই বা কী। এমন ক্ষতি হতো, শেষপর্যন্ত ঠেকতে ঠেকতে সে ঠিকই পৌঁছে যেত মেরিল্যান্ডে।
সেখানে তার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট থাকবে নিশ্চয়ই। পিটার মেয়ার নামে বৃদ্ধ অধ্যাপক যিনি ওখানে অলির মেন্টর, যিনি কয়েকখানি উপন্যাসও লিখেছেন, একখানি উপন্যাসের জন্য পুলিৎজার প্রাইজও পেয়েছেন, তাঁর সঙ্গে অলির চিঠিপত্রে এমনই আলাপ হয়ে গেছে যে মনে হয় যেন অনেকদিনের চেনা। লন্ডন থেকে তাঁর সঙ্গে টেলিফোনেও কথা হয়েছে, তিনি বাকি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। কিন্তু একটাও পয়সা হাতে না নিয়ে অলি রাস্তায় বেরুবে কী করে? তার পারিবারিক শিক্ষাতেই যে এটা অকল্পনীয়। সে কি পথে নেমে পথের মানুষের দয়া চাইতে পারে? লন্ডনের ট্রেনের ছিনতাইবাজদের ওপর অলির নতুন করে রাগ হলো। ঠিক ঐদিন তারা কি অন্য কারুর হ্যাণ্ডব্যাগ কেড়ে নিতে পারতো না?
অলিকে একজন অচেনা মানুষের ঘরে রেখে বাবলুদা কোথায় চলে গেছে কে জানে! বাবলুদা আসবার আগেই, শর্মিলা যদি জেগে ওঠে, তা হলে অলি শর্মিলার কাছ থেকেই কিছু ডলার ধার চাইতে পারে।
শর্মিলা কখন উঠবে? লন্ডনে সে বিশাখাকে দেখেছে, ছুটির দিনে দশটা পর্যন্ত ঘুমোয়। শর্মিলার শুয়ে থাকার ভাবভঙ্গিও সেরকম। ঘড়িতে এখন পৌনে সাতটা। অলি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে শর্মিলার বিছানার পাশে দাঁড়ালো, নারী হিসেবে সে দেখতে লাগলো আর একজন নারীকে। শর্মিলার শরীরের গড়নে তেমন আহামরি কিছু নেই, রোগাটে লম্বা চেহারা, এরা প্রায় সব সময় মোজা পরে বলে পায়ের পাতা মসৃণ, গোড়ালি একটুও ফাটা নয়, বেশ সরু কোমর, হাতের আঙুলগুলো সুন্দর, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে, ছোট চিবুক, ঠোঁটের ভঙ্গিতে সতোর স্পষ্ট চিহ্ন, চুল কেটে ফেললেও চুলের খুব গোছ। শর্মিলার গা থেকে চাপা একটা পারফিউমের গন্ধ আসছে, পারফিউমের ব্যাপারে ওর রুচি আছে। শোওয়ার ধরনটাও সংযত, কেউ হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকলে দেখতে বিশ্রী লাগে। এই নিশ্চিন্তে নিদ্রিতা মেয়েটি এখন বাবলুদার খুব আপন।
অলি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ঠিক করলো, শর্মিলার কাছে সে কিছুতেই হার স্বীকার করবে না।
নৈকট্যের একটা উষ্ণতা আছে, দৃষ্টির একটা তরঙ্গ আছে, একজন আর একজনকে লক্ষ করলে তার মধ্যে একটা আহ্বান এসে যায়। অলি শর্মিলার গায়ে হাত ছোঁয়ায়নি, তবু শর্মিলা এই অসময়ে জেগে উঠে চোখ মেলে তাকালো। ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি এর মধ্যেই উঠে পড়েছো,? রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়েছিল?
অলি মাথা নাড়লো।
শর্মিলা কি তার চেয়ে বয়েসে বড়? হলেও এক দু’ বছরের বেশি নয়। শর্মিলা তাকে তুমি বলতে শুরু করেছে। অলিও ওকে তুমি বলবে।
শর্মিলা উঠে বসে দু হাতে চোখ ঘষতে লাগলো। তারপর মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে মাথায় একটু ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম তাড়িয়ে বললো, তুমি কাল ঘুমের মধ্যেও ছটফট করছিলে। আমার এক একবার ভয় করছিল, ভাবছিলুম তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কি না। জেট-ল্যাগের পর অনেকের ঘুম পায়, কিন্তু তোমার মতন এতটা ঘুমোতে আর কারুকে দেখিনি। এখন ফিট লাগছে?
অলি আবার মাথা নাড়লো।
শর্মিলা খাট থেকে নেমে বললো, চা-কফি কিছু খাওনি নিশ্চয়ই। নতুন জায়গা, কোথায় কী আছে, তা তুমি কী করেই বা জানবে! আমিও এখানে পরশুদিনই মোটে এসেছি। এটা সিদ্ধার্থর এক বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্ট, ভদ্রলোকের কী দারুণ বাংলা গানের রেকর্ডের কালেকশান!
গ্যাস জ্বালিয়ে তার ওপরে জল গরম করার কেটলি চাপিয়ে এসে শর্মিলা বললো, কাল রাত্তিরে খুব মজা হয়েছিল। তুমি তো সাত তাড়াতাড়ি এখানে ঘুমিয়ে পড়লে, অলমোস্ট নড় আউট, তারপর আমরা এইটথ ফ্লোরে সিদ্ধার্থর ঘরে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলুম। তারপর কথা উঠলো, কে কোথায় শোবে। ওপরে সিদ্ধার্থর সঙ্গে সুজান বলে এক বান্ধবী আছে, ওদের সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। বাবলুকে বলা হলো এই ঘরে এসে সোফায় শুয়ে পড়তে, তাতে ও রাজি নয়। দুটি মেয়ের সঙ্গে এক ঘরে ও কিছুতেই শোবে না। কাল বাবলু বড় বেশি ড্রিংক করে ফেলেছিল, তুমি জানো না বোধ হয়, একবার ও জেদ ধরে কোনো ব্যাপারে না বললে কিছুতেই আর ওকে দিয়ে হ্যাঁ বলানো যায় না। আমার কোনো প্রবলেম ছিল না, এই ব্লুমিংটনেই আমার চেনা একটি মেয়ে থাকে, আমি তার কাছে চলে যেতে পারতুম, কিন্তু অত রাতে আমাকে যেতে দেবে না। সুজান তখন অফার দিল, সে এসে এই ঘরে শোবে, এই খাটটা বেশ বড়, তিনজনে কুলিয়ে যেত, বাবলু তা হলে সিদ্ধার্থর সঙ্গে শুতে পারে। বাবলুর তাতেও আপত্তি, সুজান কেন স্যাক্রিফাইস করবে! একটা রাত্তিরের ব্যাপার, এতে স্যাক্রিফাইসের কী আছে বলো? আমি বাবলুর মাথায় এক গেলাশ জল ঢেলে দিলুম, তাও ওর নেশা কাটে না!
কাবার্ড খুলে একটা বিস্কিটের প্যাকেট এনে শর্মিলা বললো, এটা খেয়ে দ্যাখো, বেশ মজার। বিস্কিটের মধ্যে বেকন মেশানো আছে। তুমি সব মাংস-টাংস খাও তো?
অলি মাথা নেড়ে দুটি তিনকোণা, পাতলা বিস্কিট তুলে মুখে দিল, তার ভালোই লাগলো। খিদে পেয়েছে বলে সে তুলে নিল আরও কয়েকটা।
শর্মিলা অলির মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?
অলি বললো, একটু একটু।
শর্মিলা বললো, তোমার এমন সুন্দর মুখখানা বড় শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে। জানো, আমিও এখানে আসবার পর প্রথম প্রথম কী ভীষণ মন খারাপ লাগতো, যখন-তখন কেঁদে ফেলতুম, ইচ্ছে হতো তক্ষুনি ফিরে যাই।
কাল রাত্তিরের ঘটনাটা শর্মিলা অসমাপ্ত রেখেছে। বাবলুদা শেষণর্যন্ত কোথায় শুতে গেল তা জানা হলো না।
শর্মিলা আবার বললো, এদেশের ছেলেমেয়েরা বাড়ি ছেড়ে পৃথিবীর কত দূর দূর দেশে চলে যায়, সেখানে দু তিন বছর পড়ে থাকে। কিছু গ্রাহ্য করে না! আমরা আসলে ফ্যামিলির প্রতি বেশি অ্যাটাচড়। তোমার বাড়িতে কে কে আছে, অলি? . গল্পে গল্পে কফি তৈরি হয়ে গেল। শর্মিলা দুধ-চিনি ছাড়া কালো কফি খায়। অলি এখনো। কফিতে অভ্যস্ত হয়নি, তাদের বাড়িতে শুধু চায়েরই চল ছিল।
রেকর্ড প্লেয়ারে ফিরোজা বেগমের নজরুল গীতি চালিয়ে দিয়ে জানলার কাছে গিয়ে শর্মিলা বললো, বৃষ্টি পড়ছে। আজ সোমবার হলেও ছুটি। ছেলেরা সহজে ঘুম থেকে উঠবে না। আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিই, কী বলো? মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তোমার খিদে পেয়েছে।
ফ্রিজ খুলে দুধ, ডিম, স্যালামি বার করতে করতে শর্মিলা বললো, কাল বাবলু আর আমি গ্রসারি স্টোর থেকে এসব বাজার করে এনেছি। এখানে দু একদিন থাকবো। তোমারও নিউ ইয়র্ক শহরটা দেখা হয়ে যাবে। ঐ যে দ্যাখো কাবার্ডে পাঁউরুটি আছে, তুমি ব্রাউন ব্রেড খেয়েছো আগে? খেয়ে দ্যাখো, অন্য রকম টেস্ট। তুমি টোস্টারে দুটো করে পীস্ চাপিয়ে দাও, আমি ডিমটা তৈরি করে ফেলি। তুমি ডিমের পোচ খাবে, না বয়েলড়? আমি ওয়াটার পোচ পছন্দ করি।
অলি বললো, আমি এখানে কয়েকদিন থাকবো কী করে? আমাকে আজই মেরিল্যাণ্ডে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করতে হবে।
আজ কী করে জয়েন করবে? আজ সারা অ্যামেরিকা ছুটি। তোমার রেজিস্ট্রেশানের তারিখ কবে? এখনও নতুন সেমেস্টার শুরু হয়নি, সময় আছে, তোমার কোনো চিন্তা নেই, আমরা সব ব্যবস্থা করে দেবো। আমরা তোমায় মেরিল্যান্ড পৌঁছে দিয়ে আসবো।
যে প্রফেশারের আণ্ডারে আমি কাজ করবো, তিনি বলেছিলেন, এখানে পৌঁছেই তাঁকে একটা ফোন করতে।
আজ ফোন করতে গেলে তো বাড়িতে ফোন করতে হবে। বাড়ির নাম্বার আছে তোমার। কাছে?
আছে বোধ হয়, চিঠিতে, সুটকেসের মধ্যে।
তোমার সুটকেসের তো চাবিই খুঁজে পেলে না। ঠিক আছে, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নেহাত খুব বিপদে না পড়লে ছুটির দিনে কারুর বাড়িতে এত সকালে কেউ ফোন করে না।
অলি নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। তার কাছে একটা ডলারও নেই, একটা নতুন দেশে সে এসেছে শূন্য হাতে। বাবলুদা একবারও সেই হাতটা ছোঁয়নি।
দরজায় একটা বেল বাজতেই শর্মিলা অলির দিকে তাকালো। দু’জনেরই ধারণা হলো, অতীন এসেছে। শর্মিলা প্যানে ডিমের পোচ ভাজতে শুরু করেছে, সে অলিকে ইঙ্গিত করলো। দরজা খুলে দিতে।
কেন বুকটা কাঁপছে অলির? সত্যি যেন তার ভয় করছে। বাবলুদাকে ভয়? কিংবা অলি ভয় পায় কোনো নাটকীয় পরিস্থিতিকে।
দরজা খুলে সে দেখলো সম্পূর্ণ অপরিচিত একজোড়া ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাকে। মহিলাটি শাড়ি পরা। তারা দু’জন শর্মিলাকে দেখে আরও বেশি অবাক। ভদ্রলোকটি অস্ফুট স্বরে বললেন, উই হ্যাভ কাম টু মীট ইউসুফ।
অলি বলল, হি ইজ নট হিয়ার।
ভদ্রলোক আবার বললেন, ইউসুফ। তারপর দরজার গায়ে অ্যাপার্টমেন্ট নাম্বারটা আবার দেখে নিয়ে বললেন, ইউসুফ আলি, উই আর ফ্রেন্ডস অফ ইউসুফ আলি।
এরপর কী বলতে হবে অলি জানে না। সে শর্মিলাকে ডাকলো। শর্মিলা এখনও নাইট ড্রেসটা বদলায়নি, সেটা পরেই সচ্ছলভাবে এগিয়ে এসে বললো, ইউসুফ আলি ইজ নট হিয়ার। হি হ্যাঁজ গন টু ইন্ডিয়া, নো, পাকিস্তান, নো, নো, বাংলাদেশ!
দু পক্ষই বাঙালী, তবু কেউ বাংলা বলতে পারছে না। দম্পতিটি চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে শর্মিলা হেসে বললো, আমি ইউসুফ আলি সম্পর্কে কিছুই জানি না। ইউসুফের ঘরে আমাদের মতন দুটি মেয়েকে দেখে ওদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে! ওদের বোধ হয় ভেতরে এসে বসবার ইচ্ছে ছিল, বৃষ্টির মধ্যে এসেছে……।
অলি ভাবলো, তাকে একটা অচেনা জায়গায় রেখে বাবলুদা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এখনো বাবলুদা তার বাবা-মায়ের কথা, মানিকদা-কৌশিকদের কথাও জানতে চাইলো না।
টোস্টের ওপর স্যালামি, শশা আর কোলম্যানস মাস্টার্ড দিয়ে স্যান্ডুইচ বানিয়ে ফেললো শর্মিলা। বড় বড় দুটো গেলাস ভর্তি দুধ নিল। অলিকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি দুধ ভালোবাসো তো? দুধের সত্যিকারের স্বাদ যে কী রকম, তা এদেশে এসেই ঠিক বোঝা যায়।
অলি দুধ ভালোবাসে, লন্ডনের দুধ খেয়েই সে শর্মিলার কথার সত্যতা বুঝেছে। গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে তার এখানকার দুধ আরও বেশি ভালো লাগলো।
এবার বেজে উঠলো টেলিফোন। খাওয়ার টেবিলে যেখানে অলি বসে আছে, ফোনটা তার কাছেই। শর্মিলা বললো, তুমি ধরো।
অলি বললো, আমি তো কিছুই বলতে পারবো না।
শর্মিলা বললো, এটা নিশ্চয়ই বাবলুর কল। তুমি কথা বলো না!
তবু অলি ফোন ধরলো না, শর্মিলাকেই উঠতে হলো। এবারেও অতীন নয়, শর্মিলা ইংরিজিতে কথা বলছে। শুয়ে থাকার সময় বোঝা যায়নি, এখন অলি দেখলো, শর্মিলার বুকের গড়ন খুব সুন্দর আর একটু হাসলেই তার সারা মুখখানা ঝলমল করে।
অলি আবার মনে মনে ভাবলো, সে কিছুতেই শর্মিলার কাছে হেরে যাবে না। সে শর্মিলাব মনে সামান্য দুঃখও দিতে চায় না।
শর্মিলা রিসিভার নামিয়ে এসে বললো, ওপর থেকে সুজান ফোন করেছিল, আমাদের ব্রেকফাস্ট খেতে ডাকছিল। আমরা একটু পরে ওপরে যাবো. কী বলো।
স্টোভের ওপর হুইশলিং কেটলটা শব্দ করে উঠলো, জল গরম হয়ে গেছে। শর্মিলা আবার কফি বানাতে যাচ্ছিল, অলি বললো, আমি এবারে একটু চা খাবো। চা নেই?
শর্মিলা বললো, আমরা চা কিনিনি। কিন্তু এই ইউসুফ আলির স্টকে দু’ তিন রকম চা আছে, একটু নিলে কোনো দোষ নেই, কী বলল? ও তো দেশ থেকে ফেরার সময় ভালো চা আনবেই।
পটে চা ভিজিয়ে, টি-কোজি দিয়ে তা ঢেকে দিয়ে শর্মিলা বললো, এখনো বাবলুর পাত্তা নেই, দেখলে? সাড়ে আটটা বেজে গেল। ওপরে সিদ্ধার্থ পর্যন্ত জেগে গেছে।
বাবলুদা কোথায়?
সে নাকি এই কাছেই যামিনী মুখার্জি বলে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে শুতে গেছে। কী পাগলামি বলো তো! আমাদের এই ঘরটায় সচ্ছন্দে তিনজনে ঘুমোতে পারতুম না?
আমরা যে এখানে আছি, এর জন্য ভাড়া লাগবে না?
নাঃ! ছুটিতে কেউ গেলে অন্যদের এমনি ব্যবহার করতে দিয়ে যায়। এখানে সবাই করে। ঐ যে ওর কয়েকটা টবের গাছ আছে, তাতে জল দেওয়াও হবে। ফ্রিজ-ট্রিজগুলো অনেকদিন ব্যবহার না করলে খারাপ হয়ে যায়। তোমার বাবলুদা জানো তো এক একদিন দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ঘুমোয়। কেমব্রিজে ও একটা অ্যাটিকের ঘরে একা থাকে, ডাকবার কেউ নেই, এক একদিন আমি গিয়ে ওকে জাগাই। কফি বানিয়ে একদিন ওর মুখের কাছে এনে ধরি। একদিন ওর কানের ফুটোয় জল ঢেলে দিয়েছিলুম, বাবলু এমন চিৎকার করে লাফিয়ে উঠেছিল।
দরজা বন্ধ থাকে না?
আমার কাছে একটা চাবি থাকে ওর অ্যাপার্টমেন্টের।
তোমাদের কবে বিয়ে হয়েছে?
মুখ তুলে, অবাক হয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে শর্মিলা বললো, বিয়ে? আমাদের বিয়ে হয়েছে কে বললো?
অলি দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বললো, কলকাতায় বাবলুদার বন্ধুদের মধ্যে গুজব দাঁড়িয়েছে যে ওর গোপনে বিয়ে হয়ে গেছে!
শর্মিলা খানিকটা রক্তিম হয়ে বললো, পড়াশুনো এখনো শেষ হয়নি, এর মধ্যেই বিয়ে…আমরা বিয়ের কথা এখনো কেউ ভাবিনি!
অলি একই রকম হাসি ঠোঁটে রেখে বললো, এই গুজবটা প্রতাপকাকার কানেও গেছে। প্রতাপকাকা আমাকে আসবার আগে বললেন, ছেলেটা সত্যিই বিয়ে করেছে কিনা, তুই গিয়েই আমাদের জানাবি। যদি বিয়েই করতে চায় সে, আমাদের লিখবে না কেন? আমরা কি আপত্তি করতাম? সত্যি জানো শর্মিলাদি, প্রতাপকাকা আর কাকিমা চমৎকার মানুষ। আমি চিঠি লিখে দেবো, পাত্রী আমার খুব পছন্দ হয়েছে। যেমন গুণী মেয়ে, তেমনি দেখতেও খুব সুন্দর।
শর্মিলা বললো, অ্যাই, তুমি আমার গুণের কী পরিচয় পেলে? আর আমাকে দেখতে মোটেই কেউ সুন্দর বলে না। আমার মাসিরা বললো, আমাদের বংশে এরকম একটা কালো মেয়ে কোথা থেকে এলো?
তুমি-তুমি হচ্ছো তন্বী শ্যামা, শিখরিদশনা…।
যাঃ! অলি, তুমিই খুব সুন্দর। এখানকার বাঙালী ছেলেরা তোমাকে দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবে।
ওরে বাবা, আমার আর প্রেমের দরকার নেই।
ওরে বাবা কেন? এর মধ্যেই প্রেম হয়ে গেছে নাকি?
অলি হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর তাকিয়ে রইলো শূন্য দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে। শর্মিলা কাপ প্লেটগুলো নিয়ে উঠে গেল ধুয়ে রাখতে। একটু পরে ফিরে এসে দেখলো অলি তখনও একই ভাবে বসে আছে।
অলির কাঁধে হাত রেখে খুব নরমভাবে শর্মিলা বললো, এই, তুমি মুখখানা এমন মলিন করে ফেললে যে? আমি না জেনে কি তোমাকে কোনো আঘাত দিয়েছি?
অলি বললো, না। শর্মিলাদি, তোমাকে আমার খুব আপন মনে হচ্ছে, তাই তোমাকে বলছি। আমি বোধ হয় জোরজার করে এখানে চলে এসে একটা ভুলই করেছি। না আসাই উচিত ছিল। এখন বুঝতে পারছি, এয়ারপোর্টে পা দেবার পরই মনে হচ্ছিল, আমি ঠিক সহ্য করতে পারবো না।
শর্মিলা বললো, কেন, কী হয়েছে!
অলি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, দেশে আমার একজন খুব বন্ধু আছে। তার নাম শৌনক
সে আমাকে আসতে বারণ করেছিল। আমার বাবারও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু এক্ষুনি বিয়ে করে আমার সংসারী হতে ইচ্ছে হয়নি। অ্যামেরিকায় পড়তে আসার স্বপ্ন ছিল অনেকদিনের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এখানে আমার মন টিকবে না, অতদিন থাকতে পারবো না।
শর্মিলা বললো, দুটো বছর তো, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। প্রতি ছ’ মাস বেশ কষ্ট হবে, প্রত্যেকটা দিনই মনে হবে খুব লম্বা। তোমার সেই বন্ধু কী করেন?
অ্যাকটিভ পলিটিকস্ করে। বাবলুদা শুনলে চটে যাবে।–কেন, চটে যাবে কেন?
শৌনক সি পি এমের অ্যাকটিভ মেম্বার। বাবলুদাদের তো ওদের সঙ্গে খুব ঝগড়া। শুধু ঝগড়া নয়, শত্রতা; দেশে গেলে বাবলুদা বোধ হয় শৌনকের সঙ্গে কথাই বলবে না।
যাঃ! পলিটিক্যাল ইডিয়লজির ডিফারেন্স ব্যক্তিগত সম্পর্কের লেভেলে নিয়ে আসবে কেন?
তুমি শৌনকের ব্যাপারটা বাবলুদাকে প্রথমেই কিছু বলল না। আস্তে আস্তে কোনো একসময় বুঝিয়ে বলো। মানুষ হিসেবে শৌনক খুব খাঁটি।
দু জনে গল্প করতে করতে কাটিয়ে দিল আরও একঘণ্টা।
তারপর সিদ্ধার্থ, সুজান আর অতীন একসঙ্গে এলো এই ঘরে। অন্য বাড়ি থেকে ফিরে অতীন প্রথমেই এখানে আসেনি, ওপর থেকে সিদ্ধার্থদের ডেকে এনেছে। সিদ্ধার্থ শর্মিলাকে বকুনি দিয়ে বললো, অ্যাই, তুমি এখনো ঐ রাত্তিরের জামাটা পরে আছো? তৈরি হওনি! আজ একেবারে দেশের মতন বর্ষার ওয়েদার, লং ড্রাইভে বেরুবো। চলো চলো, চলো!
অতীন অলিকে জিজ্ঞেস করলো, ভালো করে ঘুমিয়ে নিয়েছো?
অলি হাসি মুখে বললো, হ্যাঁ। এখনো কিছুই দেখা হলো না, ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
অতীনের চোখ এখনো লালচে, মাথার চুল উস্কোখুস্কো। সে চঞ্চল চোখে একবার শর্মিলা আর একবার অলির দিকে তাকাচ্ছে। ফস করে সে একটা সিগারেট ধরালো।
শর্মিলা বাথরুমে গেল পোশাক বদলাতে। অলি এসে জানলা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়ালো। মনে মনে বললো, শৌনক, তোমাকে কেমন দেখতে? তুমি কি খুব লম্বা, না মাঝারি? তোমার দাড়ি আছে? তুমি সিগারেট খাও?
শৌনক, তোমাকে আমি একটু একটু করে গড়ে তুলবো। তুমি হবে আমার সৃষ্টি, আমার নিজস্ব। তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না!