তেতাল্লিশ
‘আজ আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে আসছেন।’ মিষ্টি গলায় বলল একজন অফিসার। তার সাদা ইউনিফর্ম কলকাতা পুলিশের। জায়গাটা লালবাজার।
একটু আগে একটা খবরের কাগজ ওরা ওকে দিয়ে গিয়েছিল। তার প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে একজন বিখ্যাত নকশাল নেতার গ্রেপ্তারের খবর ছাপা আছে। অনেক চেষ্টার পর তাঁকে ধরা সম্ভব হয়েছে। ভদ্রলোক খুব অসুস্থ। নকশালবাড়ির আন্দোলন ওঁকে গ্রেপ্তারের পরই শেষ হয়ে গেল বলে পুলিশ আশা করছে। খবরটার সত্যতা সম্পর্কে অনিমেষ চিন্তা-ভাবনা করল না। কোনও বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তা করার ক্ষমতা সেই হাসপাতালেই সে হারিয়ে এসেছে। মুশকিল হল, পুলিশগুলো এই ব্যাপারটা বুঝছে না। কলকাতায় ওকে নিয়ে আসবার পর মহাদেবদার ঠিকানা জানার জন্যে ওরা ওকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেছে। নিজের পক্ষে লড়বার মতো সামান্য ক্ষমতা তার অবশিষ্ট নেই, এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে তার কষ্ট হয়।
অফিসারের কথাটা শোনার পর সে একটু অবাক হল। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে এ-খবর এরা এই প্রথম খুব ঘটা করে জানাল। কে আসছে? কলকাতায় যে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে তা কাউকেই তো সে জানাতে পারেনি। জানাতে গেলে পুলিশ তাকে নাজেহাল করত। মাধবীলতার কথা বারংবার তার মনে পড়েছে কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করেছে সে।
‘কে আসছে?’ অনিমেষ মাথা তুলল।
‘আপনার স্ত্রী!’
‘আমার স্ত্রী?’
‘হ্যাঁ, অবাক হচ্ছেন কেন? আপনি বিবাহিত নন?’
মাথা নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ। মাধবীলতা আসছে। এরা মাধবীলতার কথা জেনে গেছে? বুকের মধ্যে এক ধরনের ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। মাধবীলতা কেমন আছে এখন? কতদিন ওর কোনও খবর পায়নি সে। নাকি কোনও সূত্রে খবর পেয়ে মাধবীলতা নিজেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে! ইস, যদি কোনও সূত্রে ওকে নিষেধ করা যেত!
‘শুনুন, আপনাকে আমি অনুরোধ করছি আর চুপ করে থাকবেন না। মহাদেববাবুর খবর আপনি যা জানেন বলে দিন। আপনার স্ত্রী এখন অসুস্থ, আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে আমরা তাঁর ওপর চাপ দিই।’ অফিসারটি নরম মুখে বলল।
‘অসুস্থ?’
‘কী আশ্চর্য, আপনি জানেন না?’
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। মাধবীলতার অসুস্থতার খবর সে জানে না।
‘আপনি জানেন না তিনি সন্তানসম্ভবা?’ অফিসার হাসল।
একটা বরফের তীক্ষ্ণ ছুরি আচমকা অনিমেষের হৃৎিপণ্ডকে চেপে ধরল। কী বলছে লোকটা? সত্যি কথা? নাকি এদের অসংখ্য মিথ্যের মতো এটাও এক ভাঁওতা? মাধবীলতা মা হতে যাচ্ছে? অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। শান্তিনিকেতনের সেই রাতটা এখন অজস্র শুঁড়ওয়ালা অক্টোপাসের মতো তাকে জড়িয়ে ধরছিল। সেই রাত কি আজ মাধবীলতাকে—। অনিমেষ কিছু ভাবতে পারছিল না। সেই রাতের ঘটনার পর তার এক মুহূর্তও এই চিন্তা মাথায় আসেনি। কখনও ভাবেনি মাধবীলতা ওই এক মুহূর্তের উত্তেজনায় মা হয়ে যেতে পারে।
অফিসারটি মাধবীলতাকে তার স্ত্রী হিসেবে ভাবছে। অবশ্যই। কিন্তু এটা দু’জনের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সম্পূর্ণ আন্তরিকতার ভিত্তিতে তৈরি। আইন কিংবা সমাজ স্বীকৃতি দেবে না। তা ছাড়া সে মাধবীলতার পাশে ছিল না, কখনও পাশে আসতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা ছিল না বা নেই, তা হলে মাধবীলতা ঘটনাটিকে মেনে নিল কী করে। খুব স্বচ্ছন্দে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারত। কেন করল না?
অফিসারটি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ এখন একা। নির্জনে নিজেকে খুনি আসামির মতো মনে হচ্ছে তার। নিজের দুর্বলতার বোঝা মাধবীলতার কাঁধে চাপিয়ে সে নিশ্চিতভাবে এতকাল কাটিয়ে গেল। চিন্তাটা এতক্ষণ একমুখী ছিল, এবার তার অন্য কথা মনে পড়ল। মাধবীলতা কলকাতায় মেয়েদের হস্টেলে এসে উঠেছিল। তার বিয়ে হয়নি এ-কথা সবাই জানে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের পর যখন তার শরীরে মাতৃত্বের চিহ্ন ফুটে উঠল তখন কী করেছিল সে? হস্টেলে নিশ্চয়ই তাকে থাকতে দেয়নি। কোথায় আছে এখন মাধবীলতা? কুমারী মেয়ে মা হতে যাচ্ছে— ওর বাবা কখনওই তা মেনে নেবেন না। অনিমেষ ছটফট করতে লাগল।
একটু বাদে অফিসার ফিরে এল, ‘চলুন।’
অনিমেষ উঠল। এখন ওঠার সময় সমস্ত শরীর নড়বড় করে ওঠে। কোমরের হাড়ে ব্যথাগুলো খচখচ করে। হাঁটতে গেলে মাথায় টং টং করে লাগে। বাঁদিকে একটু হেলে লেংচে লেংচে হাঁটে অনিমেষ। অনেকটা পথ তাকে পার হয়ে আসতে হল। ওর পাশে হেঁটে এলেও অফিসার একবারও সাহায্যের কথা বলল না। কিন্তু অনিমেষ যখন জিরিয়ে নেবার জন্যে থামছিল তখন মৃদুস্বরে জানাচ্ছিল, ‘মহাদেববাবুর ঠিকানাটা বলে দিলেই তো সব গোলমাল মিটে যায়। এত কষ্ট করতে হয় না।’ অনিমেষ জবাব দেয়নি। আশেপাশের লোকজন, সবই পুলিশের লোক, এদিকে লক্ষই করছে না। এরকম ঘটনা রোজ ওরা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছিল।
দোতলায় উঠতে পারল না অনিমেষ। একজন সিপাই ওকে প্রায় পাঁজাকোলা করে ওপরে তুলে দিয়ে গেল। দুটো ঘর পেরিয়ে একটা বন্ধ দরজার সামনে অফিসারটি থামল। তারপর হেসে বলল, ‘আপনার স্ত্রী ভেতরে আছেন, আসুন।’
অনিমেষের হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হল। অফিসারের পেছনে পেছনে সে ঘরে ঢুকল। একটা সাধারণ আলো জ্বলছে কারণ ঘরটির কোনও জানলা চোখে পড়ছে না। সামনেই একটা চেয়ার, অনিমেষ তার হাতল ধরে দাঁড়াতেই মাধবীলতাকে দেখতে পেল। ঘরের আর-এক প্রান্তে একা বসে আছে সে। সেখানে অন্য কোনও চেয়ার নেই। এতবড় ঘরের দু’পাশে দুটো চেয়ার সাজানো— সেইটেই চোখে পড়ার মতো।
অনিমেষকে দেখেই মাধবীলতা উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং তার মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ আচমকা বেরিয়ে এল। অনিমেষ মাধবীলতাকে দেখল। একটা হাত মুখের ওপর চাপা, বিস্ফারিত। হ্যাঁ, শরীরের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতন। বিশেষ করে কোমরের নীচের স্ফীতি চোখে পড়ছে সহজেই। অনিমেষ কোনওরকমে উচ্চারণ করল, ‘লতা’!
মাধবীলতার কানে শব্দটা যেতেই যেন সংবিৎ ফিরে পেল। বিদ্যুতের মতো কাছে চলে এল সে ওই শরীর নিয়ে, ‘অনিমেষ, এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?’
অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করেও পারল না।
‘তুমি ভাল আছ অনি?’
এবার পেছনে মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। মেঝেতে কার্পেট পাতা, হাঁটাচলায় আওয়াজ হয় না। অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জনা চারেক মানুষ ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের গায়ে ইউনিফর্ম না-থাকলেও চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তারা পুলিশ। অফিসারটি এবার এগিয়ে এলেন, ‘অনেকদিন বাদে আপনাদের দেখা হল, তাই না? অবশ্য অনিমেষবাবু যদি নিজে আপনার কথা আমাদের জানাতেন তা হলে অনেক আগেই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারতাম। অনেক কষ্টে আপনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে হয়েছে মাধবীলতা দেবী। তবে দেরি হল বলে আফশোস করে লাভ নেই, বেটার লেট দ্যান নেভার। আপনার এ অবস্থায় অনিমেষবাবু আপনাকে ছেড়ে আছেন কী করে তাই বুঝতে পারছি না।’
মাধবীলতার গলার স্বর পালটে গেল, ‘আপনারা ধরে রেখেছেন বলেই ওকে এখানে থাকতে হচ্ছে, জেনেশুনে এরকম কথা বলছেন কেন?’
‘ঠিক কথা। আমরা ধরে রেখেছি ক’টি মাস মাত্র। তার আগে উনি আপনার ত্রিসীমানায় ঘেঁষেননি স্বইচ্ছায়। আমরা ভেবেছিলাম উনি আপনাকে স্ত্রী হিসেবে ক্লেইম করবেন না, অবশ্য সেটা ভুল হয়েছে, উনি করেছেন। আপনি ভাগ্যবতী!’ অফিসার হাসল।
‘মানে?’
‘মাধবীলতা দেবী, আপনার স্কুলে কিংবা আগে যে হস্টেলে থাকতেন সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে আপনার মিত্র হবার কোনও নোটিফিকেশন নেই। কবে আপনাদের বিয়ে হল সে-খবর কারও জানা নেই। অথচ আপনার শরীর বলছে আপনি মা হতে যাচ্ছেন। ব্যাপারটি যদি বৈধ না-হয় তা হলে—।’
অনিমেষ চাপা গলায় কথা বলল, ‘কেন বাজে কথা বলছেন, মাধবীলতা আমার স্ত্রী, এ কথা আগেও বলেছি।’
‘গুড। সে-কথাই আমি বলতে চাইছি। মুখের কথাই যথেষ্ট। আমরা কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না। আপনাকে এত কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে দায়িত্বজ্ঞানহীন হবেন না। আপনার স্ত্রীর, আপনার কথা মেনেই বলছি, আপনার স্ত্রীর কাছে এইসময় থাকা উচিত। আপনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।’
‘কীভাবে?’
‘আপনি জানেন মহাদেব একজন নটোরিয়াস লোক। তার ঠিকানা আপনি জানেন। জানি সেখানে সে এখন নাও থাকতে পারে তবু আমরা তার একটা ক্লু পেতে পারি। এটা আমার প্রস্তাব, আপনি যদি ঠিকানাটা বলেন আমরা এক্ষুনি আপনাকে ছেড়ে দেব এবং ব্যাপারটা কেউ জানতে পারবে না। আপনার কোনও ফেলো কমরেডরা টেরও পাবে না। এইসময় ওঁর সঙ্গে আপনার থাকা উচিত।’
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ‘আপনারা মিথ্যে চেষ্টা করছেন।’
‘তা হলে আপনি কোঅপারেশন করবেন না?’
‘যা ইচ্ছে ভাবুন।’
অফিসার বিরক্তিতে কাঁধ নাচাল। তারপর ছোট ছোট পা ফেলে মাধবীলতার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ‘আপনি কি ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?’
মাধবীলতা বলল, ‘ও যা ভাল মনে করছে তাই করছে।’
সঙ্গে সঙ্গে অফিসার বলে উঠল সামান্য গলা তুলে, ‘তা হলে আপনাকে অ্যারেস্ট করছি।’
অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, ‘কেন?’
‘আপনার সঙ্গে আঁতাতের জন্যে। দেশদ্রোহিতার জন্যে।’
‘দেশদ্রোহী?’
‘নাকি বিপ্লব? থুঃ। সাধারণ মানুষ আপনাদের নাম শুনলে ভয় পায়। একটা অর্গানাইজড ডাকাতের দল আপনারা। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রকে বিপন্ন করতে চেয়েছেন। অনিমেষবাবু, দিস ইজ লাস্ট টাইম, আপনার স্বপ্নের আন্দোলন ভেসে গেছে, যারা পারছে বিদেশে পালাচ্ছে, বেশিরভাগই ধরা দিচ্ছে, নেতারা জেলে— এখন আর আপনাদের অস্তিত্ব কিছু নেই। তাই বলছি, খামোকা জেদ করবেন না। মহাদেববাবুর ঠিকানাটা বলুন।’
অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। কী রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে, গালের হাড় উঁচু, শরীর ফ্যাকাশে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল দু’হাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে বুকের আড়ালে রাখতে। মাধবীলতা ওর দিকে তাকাতেই সে দু’চোখে যেন ইচ্ছেটাকেই বোঝাতে লাগল। সে কোনওরকমে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় আছ এখন?’
‘দেখুন, কী চমৎকার দায়িত্বজ্ঞান! আপনি কোথায় আছেন সে খবর আপনার স্বামী রাখেন না, অবশ্য আপনার স্বামী যদি হন! কী হল চুপ করে আছেন যে?’
অনিমেষের মাথায় গনগনে আগুন ছড়িয়ে পড়ল, ‘এই যে, আপনি যা বলার আমাকে বলুন।’
‘শাট আপ, চেঁচাবেন না।— আপনি চুপ করে আছেন কেন?’
‘আমার কথা বলতে ঘেন্না করছে!’
অনিমেষ দেখল অফিসারের ডান হাত চাবুকের মতো বাতাস কেটে মাধবীলতার গালে আছড়ে পড়ল। লোকটা মাধবীলতাকে চড় মারল! নিজের শরীরের কথা খেয়ালে থাকল না অনিমেষের, প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল অফিসারটির ওপর। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সে নিজেকে শূন্যে ভাসতে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে একটা প্রচণ্ড আঘাত অনুভব করল সে। ব্যথাটা এমন মারাত্মক যে ককিয়ে উঠে নিঃসাড়ে মেঝেতে পড়ে থাকল। ওকে টেনে তোলা হল। তারপর টানতে টানতে চেয়ারে বসিয়ে কতগুলো বেল্ট দিয়ে এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হল যাতে সামান্য নড়াচড়া না করতে পারে। কোমরের তলায় শরীরের অবশিষ্ট অঙ্গগুলোর অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল না অনিমেষ। এতক্ষণ মাথার ভেতরটা চৈত্রের আকাশ হয়ে ছিল, এবার একটু একটু করে চিন্তা করার ক্ষমতা ফিরে আসতেই সে মাধবীলতার দিকে তাকাল। সে কি ঠিক দেখছে? নিজের চোখকে বিশ্বাস করা শক্ত, অনিমেষ একবার জোরে চোখ বন্ধ করে আবার স্বচ্ছ হবার চেষ্টা করল। মাধবীলতার মাথা নীচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দুটো হাত উঁচু করে দুটো লোহার বালার সঙ্গে বাঁধা। বালা দুটো ওপরের কড়িকাঠে ফাঁস দেওয়া একটা দড়ির সঙ্গে নেমে এসেছে। দুটো হাত ওপরে টানটান থাকায় ওর শাড়ির আঁচল খসে পড়েছে। সন্তানের আবাসস্থল এখন কুৎসিত দেখাচ্ছে। মাধবীলতার চিবুক শক্ত, দাঁতে ঠোঁট চেপে আছে সে।
‘এই শুয়োরের দল, সাবধান বলছি, ওকে ছেড়ে দাও।’ অনিমেষের চিৎকার শুনে দাঁত বের করে হাসল লোকগুলো।
মাধবীলতার সামনে এখন অফিসার ছাড়া আর-একজন দাঁড়িয়ে। রোগা, লম্বা, মুখের দিকে তাকালে বিশ্বাস করা যায় দু’হাতে দুটো শিশুর গলা টিপতে পারে হেসে হেসে। লোকটি বলল, ‘মা জননী, আমার নও, পেটের বাচ্চাটার, এবার দিগম্বরী হও, দর্শন করি।’
অনিমেষ পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। কোমরের তলায় কোনও সাড় নেই, দু’হাত বাঁধা, পেছনের লোক চেয়ার ধরে রাখায় সে একটু নড়াতেও পারল না।
মাধবীলতা ধীরে ধীরে মুখ তুলল, ‘আপনারা কী চান?’
অফিসার একটু নড়ল, তার গলায় অদ্ভুত পেলবতা, ‘সামান্যই, ওকে বলুন ঠিকানাটা জানাতে। এসব ঝামেলা কার ভাল লাগে বলুন!’
‘আমার ওপর অত্যাচার করছেন কী অধিকারে?’
‘যে অধিকারে ওরা মানুষ খুন করে, পুলিশের গলা কাটে! যে অধিকারে বিয়ে না-করেও আপনার শরীরে এরা সন্তান দেয়—।’
হঠাৎ অনিমেষের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল মাধবীলতা, ‘শোনো, আমি মরে গেলেও তুমি এদের কিছু বোলো না। আমার জন্যে তুমি হেরে যেয়ো না, লক্ষ্মীটি!’
লম্বা লোকটা হা হা করে হাসতেই অফিসার চোখ টিপে তাকে ইঙ্গিত করল। সে হাত বাড়িয়ে মাধবীলতার পড়ে থাকা আঁচল কুড়িয়ে নিল। তারপর মিউজিক্যাল চেয়ারের ভঙ্গিতে পাক খেতে লাগল হেলে দুলে। শাড়ি খুলে আসছে মাধবীলতার শরীর থেকে লোকটা ছড়া আওড়াচ্ছে, ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ চলছে চলবে।’ অনিমেষ আর তাকাতে পারছিল না। কিন্তু পেছন থেকে ওর মুখ দু’হাতে চেপে তুলে ধরল, ‘সামনে তাকাও!’
অনিমেষ বাধ্য হয়ে দেখল। দেখেই শেষবার শক্তি ব্যবহার করে নিষ্ফল হল। না, সে হেরে গেল। নিজেকে একটা অপদার্থ নির্জীব ক্লীব মেন হতে লাগল ওর। এখন মাধবীলতার শরীরে শাড়ি নেই। দাঁতে দাঁত চেপে মাধবীলতা মাথা পেছনে হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষের মুখ লোকটার হাতে ধরা, সে চোখ বন্ধ করতেই আচমকা কপালে তীব্র জ্বলুনি বোধ করল। চিৎকার করতেই লোকটা একটা চুরুট ওর সামনে নাচাতে লাগল। অনিমেষের কপাল জ্বলে যাচ্ছিল। লোকটা বলল, ‘চোখ বন্ধ রাখলে চলবে না। দেখতে হবে— সব দেখতে হবে।’
এইসময় লম্বা রোগা লোকটা এগিয়ে এসে চুরুটটা নিয়ে মাধবীলতার কাছে ফিরে গেল। অফিসার এবার অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী মশাই, বলবেন, না দেখবেন?’
অনিমেষ উত্তর দিল না। সে বুঝতে পারছিল তার কাছ থেকে কিছু শুনতে না-পাওয়া পর্যন্ত ওরা মাধবীলতার ওপর অত্যাচার চালাবে। এখন পর্যন্ত যা হয়েছে তা সহ্য করা যে-কোনও মেয়ের পক্ষেই কষ্টকর। শুধু তার জন্যেই মাধবীলতাকে এই জঘন্য অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। একজন সন্তানসম্ভবা মহিলার পক্ষে এই অত্যাচার মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এরা তা জেনেও করছে। অথচ মাধবীলতা একটুও মুখ খুলছে না। সে এখন কী করবে? চোখের ওপর এই অত্যাচার দেখতে আর পারছে না সে। মহাদেবদা এখন আলিপুরদুয়ারে আছেন কিনা সে জানে না। যদি খবরটা দিয়েই দেয় তা হলেও মহাদেবদার ক্ষতি নাও হতে পারে। কিন্তু মাধবীলতা বেঁচে যাবে। একপলক চিন্তাটা মাথায় আসতেই সে ঠোঁট খুলেছিল। অফিসার তার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎ মাধবীলতার আর্তনাদ শুনতে পেল সে। লম্বা লোকটা মাধবীলতার কোমরে চুরুটটা চেপে ধরেছে। কিন্তু আর্তনাদ যন্ত্রণার হলেও মাধবীলতার গলা অনিমেষকে কাঁপিয়ে দিল, ‘তুমি কিছু বোলো না গো, আমার জন্যে তুমি ছোট হয়ো না— আঃ, আ—!’
অনিমেষ মুখ বন্ধ করার আগে একদলা থুতু মাটিতে ফেলল। পেছনের লোকটা তখুনি একটা অশ্লীল গালাগাল দিয়ে সজোরে ওর মাথায় আঘাত করল, ‘সামনে তাকাও, চোখ বন্ধ করলে মুশকিলে পড়বে।’
অফিসার এবার এগিয়ে এল ওর দিকে, ‘থুতু ফেলা হচ্ছে? এখনও বিষদাঁত ভাঙেনি না! শেষবার বলছি, কথা বলুন। আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না আপনাদের আর কোনও চান্সই নেই। আন্দোলন ফান্দোলন দেওয়ালে দেওয়ালে শুরু হয়ে সেখানেই থেমে গেছে। সাধারণ মানুষ চাইছে না আপনাদের, সবাই বুঝে গেছে এটা সি আই-এর টাকায় একরকমের ধান্দাবাজি। আপনাকে আমি স্বচ্ছন্দে মেরে ফেলতে পারি, কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। নাউ ডিসাইড!’
অনিমেষ কথা বলল না, কথা বলার শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। সে চোখ খুলে রাখতে বাধ্য হচ্ছিল কিন্তু দৃষ্টি এখন প্রায় সাদা। মাঝে মাঝে মাধবীলতার শরীর যিশুখ্রিস্টের আদল নিচ্ছে, নিয়েই আবার ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
অফিসারের গলা কানে এল, ‘দেখুন, এই ভদ্রলোক আপনাকে ভালবাসেন না। আপনার শরীরে সন্তান এনে দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। সামান্য একটা কথা বলে দিলে আপনাকে আমরা ছেড়ে দেব জেনেও উনি মুখ বন্ধ করে আছেন। তার মানে, আপনার ওপর অত্যাচার হলেও এঁর কিছুই এসে যায় না। এঁর আসল চেহারা চিনে নিন। আপনার কি এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, আমরা ওপরের দড়ি গুটিয়ে নিচ্ছি। তা নিলে আপনার শরীর মাটি ছেড়ে ওপরে উঠে যাবে, এইরকম শরীরে সেটা বেশ ডেঞ্জারাস হবে, কী বলেন? হয়তো একটা অ্যাবরশন হয়েও যেতে পারে। ইন দ্যাট কেস, ইটস বেটার ফর আস। ইনি যদি আপনার সন্তানের বাবা হন তা হলে তার জন্ম হলে স্বাধীন ভারতবর্ষের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।’
মাধবীলতা কোনও কথা বলল না। কথাগুলো অনিমেষের মাথায় ছিন্নভিন্ন হয়ে ঢুকে একসময় জোড়া লাগতেই সে চিৎকার করে উঠল। শেষবার সব বাঁধন ছিঁড়ে সে মাধবীলতার কাছে পৌঁছোবার জন্যে মরিয়া হল। কিন্তু এক পা-ও নড়তে পারল না সে। কিন্তু পেছনের লোকটির অসহিষ্ণু হাত তার চেতনাকে মুছিয়ে দিল। তলিয়ে যাওয়ার আগে অফিসারটির আক্ষেপ শুনতে পেল সে, ‘আঃ, এ সময় তোমাকে মারতে কে বলল? ও অজ্ঞান হয়ে থাকলে আজ আর কোনও কাজ হবে!’
জেলখানায় অনিমেষের সঙ্গে মাধবীলতাকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মাধবীলতা যে এছেসে তা অনিমেষের জানার কথা নয়। কিন্তু এখন পশ্চিমবাংলার জেলগুলো নকশাল ছেলেতে ভরে গেছে। সবার বিরুদ্ধে একরকমের অভিযোগ নয় এবং সবাই এক ধরনের ব্যবহার পায় না। ফলে বাইরের খবর ভেতরে আসছিল নানান পথে। অনিমেষ জানল, মাধবীলতা তিন-চার দিন এসে ফিরে গেছে। আত্মীয় বন্ধুরা দেখা করতে এলে নির্দিষ্ট দিনে কয়েদিদের একটি বিশেষ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় সাক্ষাৎকার ঘটে। মুখোমুখি নয়, এই জেলে একটা জালের আড়াল রাখা হয়। পুলিশ বসে থাকে সামনে। তবে বিশেষ কয়েকজনের ক্ষেত্রে এই অনুমতি দেওয়া হয়নি, অনিমেষ তাদের একজন।
ক্রমশ এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে পড়ছে অনিমেষ। কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না। মাধবীলতা এসেছিল এই খবর পেয়ে তার এক ধরনের উত্তেজনা হয়েছিল। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল ওকে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের কথা ভেবে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অনেক হল, মেয়েটার ওপর আর বোঝা চাপাতে চায় না সে। মাধবীলতা দেখা করতে এসেছিল মানে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। বুকের ভেতর একটা জানার বাসনা তীব্র হয়, মাধবীলতার সন্তান সুস্থভাবে হয়েছে কি? হলে তাকে নিয়ে সে কোথায় আছে? কেমন আছে? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরাধবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার কোনও অধিকার নেই এসব জানতে চাওয়ার। সে এই জীবনে কোনওদিন মেয়েটাকে আশ্রয় দিতে পারবে না যখন তখন—! চুপচাপ শুয়ে বসে দিন কাটে অনিমেষের ছোট্ট সেলে। তার সঙ্গী ওরা খুব সুন্দর নির্বাচন করেছে। প্রেসিডেন্সিতে পড়ত ছেলেটি। সুন্দর চেহারা। কিন্তু কথা বলতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না। খাবার খাইয়ে দিতে হয়। পুলিশ ওর শরীর থেকে সমস্ত কেড়ে নিয়েছে। এই ঘরের দেওয়াল ছাদ দরজার মতোই ছেলেটির অস্তিত্ব তার কাছে। এ বরং ভাল। এরকম কাঠের মানুষ বলেই তাকে বিরক্ত হতে হয় না। সপ্তাহে একদিন ওর মা আসেন। তখন একে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় সাক্ষাতের জন্যে। ভদ্রমহিলা কাঁদেন আর ছেলেকে খাওয়ান। ছেলে কিছু টের পায় না— কাঠের পুতুলের যেমন বোধশক্তি থাকে না।
অনিমেষের কথা জেলের সবাই জেনে গেছে। বস্তুত ওদের সেলটা এখন এই জেলের বন্দিদের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশি অত্যাচারের পরিণাম হিসেবে এই সেলের দু’জন বন্দি সম্পর্কে অনেকেরই মমতা। একজন পৃথিবীতে থেকেও চিরকালের জন্যে মুছে গেছে আর-একজনের মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। কোমরের তলা থেকে শরীরের বাকি অংশ আর কাজ করছে না। মুখে একরাশ দাড়ি, চুল খোঁচা খোঁচা, দু’হাতে ভর করে লেংচে লেংচে এগোতে হয়। ক্রমশ পা দুটো সরু হয়ে আসছে। জেলখানায় ডাক্তার আছে কিন্তু চিকিৎসার তৎপরতা নেই। অনিমেষ বুঝতে পারে সে আর কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এর ওপর মাথায় এক ধরনের যন্ত্রণা মাঝে মাঝে তীব্র হয়ে ওঠে। সেই অপারেশনের পর থেকেই এটা একটু একটু করে বাড়ছে। তখন চিন্তাশক্তি লন্ডভন্ড হয়ে যায় তার। এইভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। অথচ আত্মহত্যা করার কথা ভাবলে কীরকম কাপুরুষ মনে হয় নিজেকে। কিন্তু দু’হাতের ওপর ভর করে ব্যাঙের মতো থপ থপ করে মেঝেতে লাফিয়ে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত তাকে অবসাদ এনে দেয়। নিজের অর্ধেক শরীরটাকে টেনে আনার পরিশ্রমে হাঁপিয়ে পড়ে সে। এর চেয়ে তার সঙ্গী ছেলেটির অবস্থায় যদি সে থাকত তা হলে অনেক ভাল হত। সম্পূর্ণ বোধশক্তিহীন হলে পৃথিবীর কোনও কষ্টই আর কষ্ট মনে হত না।
জেলখানায় বসে অনিমেষ খবর পেল মহাদেবদা নিহত হয়েছেন। উত্তরবাংলা থেকে কলকাতায় এসে বেলেঘাটার এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এ-খবর ফাঁস হয়ে যায়। মাঝরাতে পুলিশ তাঁকে বন্দি করে। খবরটা এইরকম, তাঁকে ভ্যানের মধ্যেই মেরে ফেলা হয়। আবার এও শোনা যাচ্ছে, গড়ের মাঠে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়। হতবুদ্ধি হয়ে তিনি যখন এগোচ্ছিলেন তখন পেছন থেকে গুলি করে তাঁকে মেরে ফেলা হয়। বেশ দেরিতে পাওয়া খবর, কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারল মহাদেবদার মৃত্যুর জন্যেই পুলিশ তার ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।
এখনও নাকি পুলিশ বনাম নকশালদের সংঘর্ষ চলছে। ডেবরা, গোপীবল্লভপুর কিংবা বরানগর সিঁথির নাম শোনা যাচ্ছে। এ সবই বিক্ষিপ্ত ঘটনা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ভারতবর্ষে এই আন্দোলন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যাঁরা গলাকাটা আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁদের পুলিশ হয় হত্যা করেছে নয় করছে। আর যাঁরা এ তত্ত্বে বিশ্বাসী নন তাঁদের বিভিন্ন জেলে ছুড়ে ফেলছে। এরকম ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কোনও পরিবর্তন হয়নি। প্রতি সপ্তাহে হিন্দি ছবি মুক্তি পাচ্ছে এবং লোকে তাই দেখার জন্যে স্বচ্ছন্দে লাইন দিচ্ছে।
অনিমেষ বুঝতে পারছে বিরাট ভুল হয়ে গেছে। নিজেদের প্রস্তুত না-করে, দেশের মানুষকে সঙ্গী না-করে শুধুমাত্র বুক-ভরা উত্তেজনা এবং বিদেশি স্লোগানকে পাথেয় করে তারা সত্যিই হঠকারিতা করে ফেলেছে। সে এখনও মনে করে এ-দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কাছ থেকে কোনও কিছু আশা করার নেই। এই রাজনৈতিক কাঠামোয় তারা শুধু একটা লেবেল-আঁটা পার্টিমাত্র। সেই দলে না-থেকে সে ঠিক কাজই কেরছে। কিন্তু তার পালটা পথ বেছে নিয়ে তারা যেভাবে এগিয়েছিল সেটাও গোলকধাঁধায় শেষ হল। প্রতিটি প্রদেশের মানুষের মানসিকতা জীবনযাত্রা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এদের প্রত্যেককে একটা সুতোয় বাঁধতে পারা আকাশকুসুম কল্পনা। এসব তথ্য নতুন নয়, আগেও জানা ছিল। কিন্তু উত্তেজনা মানুষকে অন্ধ করে। তখন মনে হয়েছিল প্রয়োজন বুঝতে পারলেই মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে তাদের সঙ্গী হবে। ব্যর্থ তারাই, কারণ দেশের মানুষকে তারা বোঝাতে পারেনি।
অবসাদ আর অবসাদ। নিজের শরীরের দিকে তাকালে অবসাদে আচ্ছন্ন হতে হয়, নিজের দেশের দিকে তাকালেও একই অবস্থা। অনিমেষের মাঝে মাঝে তাই মনে হচ্ছে তার সঙ্গে ভারতবর্ষের কোনও পার্থক্য নেই। এভাবে লেংচে লেংচে পাছা ঘষটানি দিয়ে চলছে দেশটা। তাকে দাঁড় করাবার কোনও ওষুধ কারও জানা নেই, আবার এই মুহূর্তে সে মরবেও না। এই জেলের নকশালপন্থী ছেলেদের অনেকেই তার মতন বিমর্ষ। কিন্তু কেউ কেউ এখনও খুব সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা করে। তবে যত দিন যাচ্ছে তত ওরা ওকে এড়িয়ে থাকছে। তার শরীরের এই অবস্থায় সে যে কোনও সাহায্যে আসতে পারবে না একথা ওরা বুঝেই তার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। তা ছাড়া নকশালবাড়িকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়েছিল তার ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে এরা আলোচনা করতে ইচ্ছুক নয়।
মাসের পর মাস চুপচাপ চলে যাচ্ছে। খুব কম ছেলের নামে কোর্টে কেস উঠেছে। বেশিরভাগই থাকছে বিনা বিচারে। নাম পালটে পালটে স্বচ্ছন্দে রাখতে পারছে জেল কর্তৃপক্ষ। সেই প্রথম দিকে অনিমেষকে একবার কোর্টে তোলা হয়েছিল। কোনও কথা বলতে দেওয়া হয়নি, সে সুযোগও ছিল না। আটচল্লিশ ঘণ্টার বেশি কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখার আইন নেই। কিন্তু এ-দেশে একটা আইন করলেই তার একশোটা ফাঁক রাখা হয়। তাই একবার কোর্টের মুখ দেখে অনন্তকাল এখানে বাস করতে হতে পারে।
তা ছাড়া এ ব্যাপারে অনিমেষের নিজস্ব কোনও তাড়াহুড়ো নেই। এই সেল থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যাবে? যে মুখ প্রথমেই মনে পড়ে তা মাধবীলতার। মাধবীলতার কথা ভাবলেই এখন তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটা তীব্র অপরাধবোধ তাকে সারাক্ষণ বল্লমের মতো খুঁচিয়ে মারে। সে অতীতের ঘটনাগুলোকে খুঁটিয়ে ভেবেছে অনেকবার। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে মাধবীলতা কী দেখে তাকে ভালবেসেছিল? অনিমেষ কোনও স্থির জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই জেনেও সে এককথায় নিজের নিরাপদ আবাস ছেড়ে হস্টেলে উঠে এল। অনিমেষ যখন প্রতিদিন ঘটনার আবর্তে পাক খাচ্ছে তখন মাধবীলতা স্থির হয়ে তার অপেক্ষায় ছিল। সামনে কোনও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই, অতীতটাকে নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে এভাবে থাকতে মেয়েরাই পারে। শান্তিনিকেতনের সেই রাতে অনিমেষ কি একটুও সংযত হতে পারত না? চিরকালের জন্য মাধবীলতাকে সে অগ্নিকুণ্ডে ঠেলে দিল! এবং সবশেষে অনিমেষের কাছ থেকে খবর আদায় করতে পুলিশ সেই মাধবীলতার ওপরই অত্যাচার করেছে কিন্তু মাধবীলতা মুখ খোলেনি। ভালবাসা হয় সমানে সমানে। কিন্তু অনিমেষ বুঝতে পারছিল সে প্রতিটি স্তরে মাধবীলতার কাছে হেরে যাচ্ছে। এখন একটা দীর্ঘ দৌড় প্রতিযোগিতায় মাধবীলতা তাকে ছাড়িয়ে এত দূরে এগিয়ে গেছে যে তার পক্ষে আর ওকে ধরা সম্ভব নয়। মাধবীলতার কোনও খবর সে এখন জানে না। স্কুলের চাকরি আছে কি না, সন্তান স্বচ্ছন্দে ভূমিষ্ঠ হয়েছে কি না, তাকে নিয়ে সে এখন কোথায় আছে, কীভাবে আছে তা জানতে পারছে না সে। এই সামাজিক ব্যবস্থায় একটি কুমারী মেয়ে হঠাৎ মা হয়ে গেছে এই খবর সবাই কীভাবে নেবে তা জানা কথা। অনিমেষ সারা পৃথিবীর সামনে চিৎকার করে বলতে পারে যে মাধবীলতা তার স্ত্রী। কিন্তু যতক্ষণ না তাতে আইনের ছাপ পড়ছে ততক্ষণ মাধবীলতা কী করে লড়াই করছে? আর-একটা চিন্তা আজকাল অনিমেষকে উত্তেজিত করছে। সে বাবা হয়ে গেল! তার রক্তের সৃষ্টি এখন পৃথিবীর বুকে। সে ছেলে কি মেয়ে তা জানা নেই এবং সে সুস্থভাবে জন্মেছিল কিনা তাও অজানা কিন্তু মায়ের পেট থেকে সে নিশ্চয়ই অনুভব করেছে তার বাবার জন্যে তার মাকে কীভাবে অপমানিত হতে হয়েছে। এতটা দায় যে মেয়ে মুখ বুজে বয়ে চলেছে আজ জেল থেকে বেরিয়ে বাকি জীবনটার পাথর তার ওপর চাপিয়ে তাকে মেরে ফেলতে চায় না অনিমেষ। সেই কারণে তার কোনও তাড়াহুড়ো নেই, এখান থেকে বের হবার। জলপাইগুড়িতে গিয়ে বাবা এবং ছোটমায়ের সামনে এই অবস্থায় যাওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। বাবা বিলাপ করবেন। তাঁর সব আশা নির্মূল করে যে ছেলে নকশাল হয়েছে তাকে হয়তো তিনি ভৎসনা করতে পারেন কিন্তু তাকে সেই কারণে পঙ্গু দেখলে তাঁর আক্ষেপ অসহনীয় হয়ে উঠবে। না, নিজের দায় কারও ওপর চাপিয়ে দেবে না সে। কিন্তু এরা যদি তাকে ছেড়ে দেয়, যদিও সে সম্ভাবনা নেই, তবু, তা হলে সে কোথায় যাবে?
জেলে বসে অনিমেষ টের পায়নি কিছু। একদিন আচমকা চারধারে পাগলাঘণ্টি বাজতে লাগল। অনিমেষ শুয়ে ছিল। শব্দ শুনে কোনওরকমে হামা দিয়ে দিয়ে সে দরজার ফাঁকে চোখ রাখল। বাইরে মানুষ পাগলের মতো ছুটছে। বোমা পড়ছে ওপাশে। ছেলেরা দৌড়োচ্ছে গেটের দিকে। এখান থেকে সামনের পুকুরটা দেখা যায়। অনিমেষ দেখল তিন-চারটে পুলিশ দৌড়ে সেই পুকুরে ঝাঁপ দিল। তারপর ডুব দিয়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে হাস্যকরভাবে। মৃত্যুভয় এখন ওদের চোখে মুখে। অনিমেষের মাথায় একটা চিন্তা চলকে উঠল। তা হলে কি বিপ্লব শুরু হয়ে গেল? জেল ভেঙে বন্দিদের উদ্ধার করা হচ্ছে? ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল অনিমেষ। বাইরে তখন চেঁচামেচি, সবাই অকস্মাৎ ছাড়া পাওয়ার রাস্তাটা যেন আবিষ্কার করে ফেলেছে। অনিমেষ চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল সমানে যে যাচ্ছে তাকেই। ওদের সেলে তালা দেওয়া থাকে না, বোধহয় পঙ্গু বলে তালা খরচ করতে চায় না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাইরে থেকে আটকানো থাকে দরজাটা। অনিমেষের ডাক কারও কানে যাচ্ছে না। অথচ এইরকম একটা মহান সময়ে সে যোগ দিতে পারছে না এই কষ্ট অনিমেষকে পাগল করে তুলছিল। বারংবার দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সে। নিজের শরীরের কথা এই মুহূর্তে তার মাথায় ছিল না, তাকে ছেড়ে দিলে ওই গেট অবধি পৌঁছোতে হয়তো তার এক ঘণ্টা লেগে যেতে পারে— এই বোধ কাজ করছিল না।
হঠাৎ গুলির শব্দ কানে এল। পরপর কয়েক রাউন্ড এবং খুবই কাছে। কয়েকটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল। এবং আচমকা বাইরের ছুটোছুটি থেমে গেল। যারা রাস্তা পার হতে পারেনি তারা যেন কে আগে সেলে পৌঁছাতে পারবে এইভাবে ফিরে আসতে লাগল। এখন আর বোমার শব্দ শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু গুলি চলছে মাঝে মাঝে। তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল। একটুও আওয়াজ নেই কোথাও। পুকুরে যে পুলিশগুলো ডুবছিল আর ভাসছিল তারা ক্রমশ মাটিতে উঠে এল। ইউনিফর্ম সম্পূর্ণ সিক্ত কিন্তু হঠাৎ তাদের চেহারা যেন পালটে গেল। প্রচণ্ড ক্রোধে তারা ছুটে গেল অফিস ঘরের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সামনের লনটা পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেল।
দরজায় সেঁটে থাকা অনিমেষ ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ল। না, এটা কোনও বিপ্লব নয়, বিক্ষিপ্তভাবে জেল ভেঙে পালাতে চাইছিল কিছু ছেলে। কিন্তু কোথায় পালাতে চাইছিল? এই জেলের বাইরে যে ভারতবর্ষ সেটা কি এই জেলের চেয়ে নিরাপদ! সেখানে কি ওদের কেউ চিরকাল আশ্রয় দেবে? সারা দেশ যেখানে শীতল হয়ে রয়েছে সেখানে কয়েকটা কাঠকয়লার আগুনের কী মূল্য আছে!
এখন সেলে সেলে চিৎকার চলছে। পুলিশরা দল বেঁধে প্রতিটি সেলে ঢুকে বদলা নিচ্ছে। বন্দিদের যন্ত্রণায় এখন জেলের প্রতিটি দেওয়াল কাঁপছে। সামনের বারান্দায় বুটের শব্দ হল। তিনজন এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। একজন বলল, ‘না, এরা বের হয়নি। তা ছাড়া একজন ফিজিক্যালি হ্যান্ডিক্যাপ্ড আর একজন পাগল।’
দ্বিতীয়জন থুতু ফেলল, ‘সো হোয়াট? এরা সব এক রক্তের। আজ কাউকে স্পেয়ার করব না।’
শব্দ করে দরজা খুলে গেল। দরজা খুললেই অনিমেষের সঙ্গী, হাঁ করে খাওয়ার অভ্যেসটুকু তার হয়েছে। কুঁকড়ে পড়ে থাকা অনিমেষ দেখল একটা লাঠি ছেলেটিকে নির্মমভাবে আঘাত করল। অন্য দুটো তার দিকে এগিয়ে আসছে।