একটা সময় পর্যন্ত দেশের মানুষ কলমিলতার মতো নিজের দেশেই পালিয়েছে। যারা ঢাকার মানুষ, তারা ঢাকা ছেড়ে গেছে গ্রামে। গ্রামের মানুষেরা নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে। যারা রাজশাহীর মানুষ, তাদের কাছে মনে হয়েছে রাজশাহী ছাড়া অন্য যে-কোনো জায়গা বোধহয় নিরাপদ। এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় যাওয়া। নিরাপদ আশ্রয়ের অনুসন্ধান।
জুন মাসের মাঝামাঝি যখন রাজাকার বাহিনী ভালোমতোই তৈরি হয়ে গেছে, তখন শুরু হলো Exodus, দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে যাত্ৰা। শত শত মানুষ বর্ডার পাড়ি দেয়া শুরু করল। তাদের কাছে মনে হলো, কোনোরকমে নিজ দেশের সীমানার বাইরে যেতে পারলেই প্ৰাণে বেঁচে যাওয়া হবে। আহারে কী কষ্টের সেই যাত্ৰা!
ফয়জুর রহমান সাহেবের অসহায় পরিবারও সেই যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হলো। তারাও বর্ডার পার হয়ে কোলকাতার দিকে যাবে। যাবার ব্যবস্থা একটাই–নদীপথে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাওয়া। অনেকেই যাবে। অনেকের যাত্রা আবার মাঝখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারা ধরা পড়ছে সুন্দরবনের জলদস্যুদের হাতে।
পাকিস্তানি মিলিটারিও এই যাত্রাপথের খবর পেয়ে গেছে। তাদের গানবোট নিয়মিত নদীপথ টহল দিচ্ছে। নৌকাভর্তি মানুষ দেখা মাত্ৰই গানবোট থেকে কামান দাগছে।
আয়েশা বেগম এই পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়ে নিয়ে সুন্দরবন পাড়ি দিতে রাজি হলেন না। তাঁর প্রধান চিন্তা তীর দুই ছেলেকে নিয়ে। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, যেকোনো দিন রাজাকার দল নিয়ে মিলিটারি বাড়ি ঘেরাও করে ছেলে দুটিকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। তিনি যে বাড়িতে আশ্ৰয় নিয়েছেন, সেই বাড়ির প্রধান ব্যক্তিটির সঙ্গে পবামর্শ করে ছেলে দুজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। এই গল্পটি বরং আমরা আয়েশা বেগমের বড় ছেলের জবানিতেই শুনি–
পিরোজপুর শহর থেকে পনেরো-ষোলো মাইল দূরের অজ পাড়া গা। নদীর পাশে ছোট্ট গ্রাম। নদীর নাম মনে নেই–বলেশ্বর বা রূপসা হতে পারে। নদী যেমন সুন্দর, গ্রামটা তার চেয়েও সুন্দর। নারিকেল আর সুপারি গাছ দিয়ে অতি যত্নে কেউ যেন এই গ্রাম সাজিয়ে দিয়েছে। ভরা বর্ষা— থৈ থৈ করছে নদী। জ্যোৎস্নারাতে আলোর ফুল ঝরে ঝরে পড়ে। কিছু ফুল আটকে যায় গাছের পাতায়। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নদৃশ্যের মতো। এই স্বপ্নদৃশ্যে আমি আমার মা এবং ভাইবোনদের নিয়ে বাস করছি। আমাদের মধ্যে কোনো স্বপ্ন নেই।
মা ক্ৰমাগত কাঁদছেন। কারণ খবর পাওয়া গেছে, পাক মিলিটারি আমার বাবাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই না, তারা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই জাফর ইকবালকে। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ৰ। দুজনই রাইফেল নিয়ে প্রচুর ছোটাছুটি করেছি। ভেবেছি, পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলে মিলিটারিদের আটকে দেয়া যাবে। বাস্তবে তা হয় নি। পাক আমির গানবোট বিনাবাধায় পিরোজপুরের হুলারহাটে ভিড়েছে। তাদের একটি দল মার্চ করে ঢুকেছে পিরোজপুর শহরে। শুরু হয়েছে ধ্বংস এবং হত্যার উৎসব।
আমরা তখন পলাতক। প্ৰথমে যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বিপদজনক মানুষ হিসেবে আমাদের কোথাও জায়গা হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত আশ্ৰয় দিলেন গোয়ারেখার জনৈক মাওলানা। তিনি সর্ষিনার পীর সাহেবের ভক্ত খাদেম। মনেপ্ৰাণে পাকিস্তানি। পাকিস্তান যাতে টিকে যায়, সেই দোয়া তিনি প্রতি নামাজেই করছেন। তারপরেও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মাকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন, জোর গলায় বলছেন–কোনো ভয় নাই। মিলিটারি আপনার ছেলেদের ধরতে পারবে না। উপরে আছেন আল্লাহপাক, নিচে আমি। আমাকে গুলি না করে তারা আপনার ছেলেদের গুলি করতে পারবে না।
মা তার কথায় খুব ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ আশেপাশে মিলিটারি অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলিয়ে দিচ্ছে। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। এইসব হত্যাকাণ্ডের খবর আবার মাওলানা সাহেব নিজেই নিয়ে আসছেন এবং আমাদের সবাইকে একত্র করে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছেন।
আজ কাউখালিতে বিশটা মানুষ লাইন করে দাঁড়া করছে। ব্রাশ ফায়ার। সব শেষ।
আজ দুইটা মানুষরে খেজ্বর গাছে তুলে বলল— জয় বাংলা বোল। তার পরেই ঠাস ঠাস গুলি।
আজি কুড়াল দিয়ে এক কোপ দিয়ে হিন্দু কম্পাউন্ডারের কল্লা আলাদা করে ফেলেছে।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার সময় মাওলানা সাহেবের মুখে এক ধরনের আনন্দময় আভাও দেখতে পাই। আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পাবি না। ভদ্রলোক নিতান্তই ভালোমানুষ। তিনি শুধু যে আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন তাই না, কয়েকজন হিন্দু যুবককেও আশ্রয় দিয়েছেন।
হিন্দুদের জন্যে তখন সব পথ বন্ধ। হিন্দু জানলেই দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ নেই–গুলি। হিন্দু পরিবারগুলি বাড়ি-ঘর ছেড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। বর্ষাকালে সাপ-খোপ। ভর্তি জঙ্গল। দিন-রাত বৃষ্টি পড়ছে। বর্ণনার অতীত সব দৃশ্য। এরা পালিয়ে সীমান্ত অতি ক্রম করতেও পারছে না। যেতে হবে সুন্দরবন হয়ে। নদীতে ঘুরছে মিলিটারি গানবোট। সাহায্য করবার জন্য মুক্তিবাহিনী তখনো শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারে নি।
আমরা আমার নিজের দেশের অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রামে আটকা পড়ে গেছি। পালিয়ে যেতে চাচ্ছি। অন্য একটি দেশে। চারপাশে মৃত্যু ঘোরাফেরা করছে। তীব্ৰ আতঙ্কে কাটছে আমাদের দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী।
এইরকম সময়ে গোয়ারেখার মাওলানা সাহেব চিন্তিত মুখে মাকে বললেন, আপনার ছেলে দুটাকে সরিয়ে দেয়া দরকার। আর দেরি করা যায় না।
মা চমকে উঠে বললেন, কেন?
অবস্থা ভালো দেখতেছি না।
ভালো দেখতেছেন না কেন?
জোয়ান ছেলেপুলে সব ধরে ধরে মেরে ফেলতেছে।
ওদের কোথায় সরিয়ে দিতে চান?
এমন জায়গায় সরাব যে মিলিটারি কোনো সন্ধান পাবে।
এমন জায়গা কি আছে?
অবশ্যই আছে। ওদের রেখে আসব সর্ষিনা পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। ওরা মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকবে। দরকার হলে ওদের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেব–জামাতে ছওম ক্লাসে।
মা বললেন, আপনার হাতে আমি ছেলে দুটাকে তুলে দিলাম। আপনি যা ভালো মনে করেন…।
আমরা দুভাই লুঙি-পাঞ্জাবি পারলাম। মাথায় দিলাম গোল বেতের টুপি। রওনা হলাম সর্ষিনা। যেতে হবে নৌকায়। পথ মোটেই নিরাপদ না। মিলিটারির গানবোট চলাচল করছে। আতঙ্কে অস্থির হয়ে যাত্ৰা। এই নৌকা ভ্ৰমণ মনে হচ্ছে কোনোদিন শেষ হবে না। ইঞ্জিনের বিজবিজ শব্দ হতেই অতি দ্রুত নৌকা কোনো খাড়িতে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মাঝে মাওলানা সাহেব বলেন, বাবারা ডাইনে তাকাবা না। আমরা ডাইনে তাকাই না, কারণ তখন ডানে গলিত মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে।
সর্ষিনার পীর সাহেবের আস্তানা চমৎকার। জায়গাটা নদীর তীরে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মাদ্রাসার ছাত্রদের থাকার জন্যে বিশাল হোস্টেল। পাড়া গা মতো জায়গায় বিরাট কর্মযজ্ঞ। আর হবে নাই বা কেন! পাকিস্তানের সব রাষ্ট্রপ্রধানই এখানে এসেছেন। কিছু সময় কাটিয়েছেন।
আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে সর্ষিনা পৌঁছলাম বিকেলে। মাদ্রাসার ছাত্ররা দুধে রুটি ছিঁড়ে চিনি মাখিয়ে খেতে দিল। গপগপ করে খেলাম। তাদের যে মিলিটারিরা কিছুই বলছে না–এ জন্যে তাদের মধ্যে আনন্দ ও উল্লাসের সীমা নেই। তাদের কাছেই জানলাম, পিরোজপুরের সঙ্গে সর্ষিনার পীর সাহেবের সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। ক্যাপ্টেন সাহেব দিনের মধ্যে তিন-চার বার টেলিফোন করেন। অপারেশনে যাবার আগে পীর সাহেবের দোয়া নিয়ে যান। আমরা দুভাই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে এসেছি শুনে তারা যথেষ্ট আনন্দ প্ৰকাশ করল। আমরা আমাদের পরিচয় প্ৰকাশ করলাম না।
সঙ্গের মাওলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দুজনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশিরভাগ কথার জবাবই দিচ্ছেন; উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কী কথা যেন বলা হলো; পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশোদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও।
মাওলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দুভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ঙ্কর রেগে বললেন–না, না। এদের কেন এখানে এনেছ?
মাওলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কী কথাবার্তা তার হয়েছে। তিনি কিছুই ভেঙে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। খোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল, দেহেন দেহেন। তোকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে; এমন কোনো দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে বিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দুটির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ। সার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত-আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাতভর্তি লাল কাচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে হয়তো পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
এখন আমরা বাস করছি স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দেশে সবচে সম্মানিত, সবচে বড় পদকটির নাম–স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরী, রনদা প্ৰসাদ সাহা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই পদক পেয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ননছর পর, মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম–স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে সর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।
হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?