৪২
ঘুমের মধ্যেই চয়ন একটা হেঁচকির শব্দ শুনতে পেয়েছিল। একটা বা দুটো। দু’দিন হল সে ঘন-ঘন অজ্ঞান হচ্ছে। শরীর বড্ড দুর্বল। হেঁচকির শব্দে তার একটু সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে সে উঠতে পারেনি। বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়ে ঘুমিয়ে ছিল অতল ঘুমে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। মা চলে গেছে। পাখি ফুরুৎ। শুধু কয়েকখানা হাড়ের অবয়ব পড়ে আছে বিছানায়। মুখখানা হাঁ। তার সামনে মাছি উড়ছে।
চয়নের প্রথমে কোনও শোক হল না। বরং ভয় হল। এখন যে অনেক ঝামেলা। লোক ডাকো, সৎকার করো, শ্রাদ্ধ করা। চয়নের শরীর আজ এত কল সইতে পারবে কি? চয়ন মায়ের নাড়ি দেখল, খাস দেখল। এত বড় একটা ঘটনা ঘটল কত ঘটনাহীনভাবে।
চয়ন মায়ের মৃত্যু নিয়ে প্রথমেই কোনও হই-চই করল না। তার মনে হল, এক কাপ চা দ্রুত খেয়ে নেওয়া দরকার। নইলে সে কিছুতেই কিছু পেরে উঠবে না। কিন্তু চা করতে গিয়ে দেখল তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। চা করা অসম্ভব।
সে বেরোলো। গলির মধ্যে একটা দোকান আছে। সেখানে বসে শান্তভাবে পর পর দু কাপ আগুন-গরম চা খেয়ে নিল সে। তারপর বাড়ি ফিরে খুব সন্তর্পণে দোতলায় উঠল।
দাদা!
অয়ন দরদালানের এক চিলতে জায়গায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। কাগজটা সরিয়ে তাকে দেখে বলল, কী?
এবার নিচে আয়।
অয়ন তটস্থ হয়ে বলল, হয়ে গেছে নাকি?
মনে হচ্ছে।
কখন?
টের পাইনি। সকালে উঠে দেখছি মারা গেছে।
অয়ন একটু স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর বলল, যা, যাচ্ছি। ছুঁয়ে বসে থাক। সেটাই নাকি নিয়ম।
চয়ন নিচে নেমে এল। ঘরে ঢুকে মায়ের বিছানার একপাশে বসল। তাদের ঘরটা এমনিতেই চুপচাপ। এখন যেন পাথরের স্তব্ধতা। অয়ন এল, বউদি এল। নতুন আর একটি ঝি রেখেছে ওরা। সে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনল।
তারপর এল পাড়া-প্রতিবেশী কয়েকজন। মৃত্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নিত্যনৈমিত্তিক, তবু প্রতিটি মৃত্যুই মানুষকে কিছু বলতে চায়। কোনও একটি সত্যের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে চুপ করে থাকে। মৃত্যুর কোনও উচ্চারণ নেই, তবু অস্ফুট কিছু নীরবে বলেও যায়।
ডাক্তার একবার নাড়িটা ধরেই ছেড়ে দিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। বললেন, এতদিন বাঁচবে বলে আশা করিনি। তোমাদের ভাগ্য ভাল। কিছুই তো ছিল না শরীরে!
তারা দুই ভাই নয়, কিন্তু বউদি বেশ কাঁদছিল। চোখভরা জল। একটু ফোঁপানি। খুবই সময়োপযোগী কান্না। তবে বিশ্বাসযোগ্য নয় একেবারেই। তা হোক, মায়ের জন্য একজন কেউ কাঁদছে—এটা চয়নের খারাপ লাগল না।
চয়ন কাঁদছে না, তার কারণ, তার কান্না আসছে না। জ্ঞানবয়সে সে কখনও কেঁদেছে বলে মনেই পড়ে না তার। বিরল সৌভাগ্যই বলতে হবে, বউদি একবার তার কাছাকাছি এসে কাঁধে হাত রাখল। কান্নাভেজা গলায় বলল, কী খারাপ লাগছে বলো তো!
চয়ন সন্তাপ মেশানো গলায় বলল, হ্যাঁ।
পাড়ার ছেলেদের ডাকতে হয় না। চলে আসে। গায়ে গেঞ্জি, কোমরে গামছা, মুখে একটা ক্যাজুয়াল ভাব।
মৃতদেহ ফেলে রাখার মানেই হয় না। তাদের আত্মীয়স্বজন কিছু আছে বটে, কিন্তু কে গিয়ে খবর দেবে? আর তারা আসবে কিনা তারই বা ঠিক কী?
চয়ন শুধু বলল, দিদিকে জানানো দরকার।
অয়ন বলে, আমাদের দরকার? না তার? গত বছরখানেকের মধ্যেও তো সে আসেনি।
চয়ন মুখ নামিয়ে নিল। বাস্তবিকই তাই। দিদির একটা ভয় ছিল, অয়ন চয়নের ঝগড়া পাকিয়ে উঠলে চয়ন আর মা গিয়ে তার ঘাড়ে ভর করতে পারে। ভয়টার কথা বলেছে দিদি নিজের মুখেই।
পন্টু পাড়ায় একটা ক্লাব করেছে। পরোপকারী ক্লাব। সে এসে বলল, কী দাদা, ঘাটখরচা দিতে পারবেন তো! না পারলে বলুন, আমাদের সৎকার ফান্ড থেকে দিয়ে দিচ্ছি।
এই পন্টুর সঙ্গে ফাটাফাটি ঝগড়ার কথা ভোলেনি অয়ন। সে গম্ভীর মুখে বলল, ঘাটখরচা আমরাই দেবো।
খাট এল, ফুল এল, ম্যাটাডর এল। মায়ের জন্য আজ কত আয়োজন!
বউদি জিজ্ঞেস করল, চা খাবে চয়ন?
চা?
খাও। তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে। শ্মশানবন্ধুদেরও দিতে হবে। সকালেই তো সব চলে এসেছে।
চয়ন চা খেল। এত ডামাডোলেও বুঝতে পারছিল, তার দাদা বেশ ভাল কোয়ালিটির চা খায়।
একটা কর্তব্যবোধ খোঁচা দিচ্ছিল চয়নকে। দিদিকে না জানানো ঠিক হবে না। তারা মোটে তিন ভাই-বোন। দিদি একটু গা বাঁচিয়ে থাকে বটে, কিন্তু খবর না দিলে পরে অশান্তি হবে। চয়ন অশান্তিকে ভয় পায়।
একটা পুরোনো ডায়েরিতে দিদির পাশের বাড়ির ফোন নম্বর পাওয়া গেল। খবরটা টেলিফোনেই দিয়ে দিল পন্টু। ফলে, অপেক্ষা করতে হল কিছুক্ষণ।
দিদি এল। আলুথালু হয়ে মায়ের বুকের ওপর পড়ে কাঁদল। সঙ্গে দুই ছেলেমেয়ে। তারা কিছু হতভম্ব। জামাইবাবু ভারিক্কী গম্ভীর মানুষ। মুখচোখে শোক ফুটিয়ে রাখছিলেন।
এ সবই কূট চোখে লক্ষ করছিল চয়ন। লক্ষ করাই তার স্বভাব। তার হবি।
চয়ন! এখন তোর কী হবে বল তো ভাই! বলে দিদি একদফা তাকেও জড়িয়ে ধরে কাঁদল।
চয়নের বড় অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে।
দিদি অয়নের প্রতিও শোকপ্রকাশ করল। কাঁদল।
ফলে একটু দেরিতেই বেরোলো মা। ম্যাটাডর ভ্যানে একটি তুচ্ছ মৃতদেহ ভোঁ-ভোঁ করে শ্মশানমুখো যখন ছুটছে তখন কলকাতার রাস্তায় ঘাটে অফিসের ভিড়। মৃত্যুর মতো মহান ঘটনাও কলকাতার ব্যস্ততার কাছে তুচ্ছ। মৃত্যু কত অর্থহীন, কত গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে ডবলডেকার, বাস, ট্যাক্সির ব্যস্ত রাস্তায়।
মা একদম ঝামেলা করল না। শ্মশানে দাহ করার উনুন চট করে পাওয়া গেল। দাহ মিটে গেল মাত্র একঘণ্টায়। শুকনো শরীরটা নিজেই যেন ইন্ধন হয়ে উঠেছিল।
বাড়িতে ফেরার পর অয়ন ডেকে বলল, ক’টা দিন ওপরেই হবিষ্যি করিস।
কৃতজ্ঞতায় নুয়ে সে বলল, আচ্ছা।
ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক। তোর শরীর ভাল নয়। তোর বউদি সাগু ভিজিয়ে রেখেছে। খাওয়ার সময় ডাকবে।
আচ্ছা।
একা ঘরে ভয়-টয় পাবি না তো?
না। ভয় কিসের?
না, ভয় নয়। তবে ঘরে এসে এক সুগভীর ক্লান্তি ও শূন্যতাকে অনুভব করছিল চয়ন। এই শূন্যতাই কি শোক? শোক কেমন তা তো সে জানেও না ভাল করে। বিছানাটা এখনও পাতাই রয়েছে। শুধু চাদরটা নেই। আজ থেকে সে চৌকিতে শুতে পারবে। আজ থেকে তার আর কোনও বাড়তি কাজ রইল না। আজ থেকে নিশ্চিন্ত। এবং একা।
সে চুপ করে কিছুক্ষণ মায়ের বিছানাটায় নাঙ্গা তোশকের ওপরেই সটান হয়ে শুয়ে রইল। সে কি সুখী? না দুঃখী? না নির্বিকার? মাতৃবিয়োগের মতো বৃহৎ ঘটনার পরও কেন উথাল-পাথাল লাগছে না তার?
ওপর থেকে বউদি ডাকছিল।
চয়নের বিছানা ছেড়ে উঠতে কষ্ট হল। দরজার কাছে এসে ওপরের দিকে চেয়ে বলল, কী বলছো?
আগুন আর লোহা ছুঁয়ে ঘরে যেতে হয়। নিমু যাচ্ছে নিচে লোহা আর আগুন নিয়ে। তারপর চান করো। ধড়া পরতে হবে।
ধর্মের সঙ্গে, শাস্ত্রাচারের সঙ্গে কোনও যোগ নেই চয়নের। তবু সে যন্ত্রের মতো কাজগুলো করে গেল। স্নানের পর শরীরটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছিল তার। সারাদিন কিছু খায়নি বলে শরীরটা বড্ড দুর্বল।
বউদি এক কাপ চা নিয়ে এল। ঘরে ঢুকে বলল, চা খেয়ে একটু বাদে ওপরে এসো।
সাগ্রহে চায়ের কাপ হাত বাড়িয়ে নিল চয়ন। এখন যেন ঠিক এই জিনিসটুকুরই প্রতীক্ষা ছিল তার। বলল, যাবো বউদি। একটু জিরিয়ে নিই।
নাও। তোমার তো রোগা শরীর, তার ওপর কত ধকল গেল আজ। একবার ভেবেছিলুম তোমাকে শ্মশানে যেতে বারণ করব। মুখাগ্নি তো তোমার দাদারই করার কথা।
তা হোক বউদি। মার জন্য তো আর কোনওদিন কিছু করতে হবে না। এই একটা দিন, কষ্ট কিছু নয়।
বউদি কোনওদিনই সুন্দরী ছিল না। এখনও নয়। তবে এখন কেন জানে না চয়নের কাছে বউদির মুখশ্রী খারাপ দেখাল না। এলো চুল পিঠময় ছড়িয়ে আছে। একটু শ্যামলা রং। মুখখানা গোলপানা। কোথাও বোধ হয় একটু শ্ৰী ছিল কখনও। এখনও রেশটা আছে।
বউদি জানালার তাকটায় একটু বসে বলল, বনুর কাণ্ডটা দেখলে? মা মারা গেছে, কিন্তু এল যেন পাড়া-প্রতিবেশীর মতো। হুশ করে এল, হাউমাউ করে একটু কাঁদল, শ্মশানযাত্রীরা রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে চলে গেল। বলল, ছেলেমেয়ের নাকি পড়া আছে।
বনু তার দিদির ডাকনাম। কারও কাছ থেকেই কোনও প্রত্যাশা নেই বলে মানুষকে একটু নিরপেক্ষভাবে বুঝতে পারে চয়ন। দিদি আসলে এ সংসারের সঙ্গে একদম জড়াতে চায় না নিজেকে। চয়ন যতদূর জানে, দিদির সংসারটি বেশ সুখের। টাকাকড়ি আছে, ভরা সংসার। ওইটুকুর মধ্যেই দিদি নির্ঝঞ্ঝটে থাকতে চায়। মা বা ভাই তার কাছে দূরের ও বাইরের লোক।
চয়ন জবাব দিল না দেখে বউদি বলল, তোমাদের হবিষ্যির জন্য কত দিয়ে গেছে জানো? মাত্র দশটি টাকা।
চয়ন মাথা নত করে বলে, কীই-বা আর হবে বলে!
কথাটার কোনও মানে হয় না। বউদি অবশ্য কথাটার মানে খুঁজল না, নিজের মনেই বলল, টাকা তো ওর কাছে কেউ চায়নি। কিছু না দিলেও তো পারত। আরও একটা কাণ্ড করেছে। তোমরা রওনা হওয়ার পর এ ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র হাঁটকে দেখে গেছে।
কেন?
বোধ হয় সোনাদানার সন্ধানে ছিল।
আমাদের ঘরে সোনাদানা কোত্থেকে আসবে?
সে ও-ই জানে। কী খুঁজেছে জানি না। তবে ঢুকেছিল।
চয়ন ম্লান হেসে বলে, যা ছিল কবে বিক্রি হয়ে গেছে।
আমি তো তোমার চোখে খারাপই চয়ন, কিন্তু বোধ হয় বনুর মতো নই।
চয়ন সভয়ে বলল, খারাপ কেন হবে বউদি? খারাপ তো ভাবি না।
বউদি ধরাগলায় বলে, খারাপ তো আর এমনি হইনি। পরিস্থিতির চাপেই হয়েছি। আমাদের সংসারের ব্যাপারে বাইরের লোক নাক গলাতে এসেছিল বলেই তো এত অশান্তি। তুমিই বলল।
চয়ন ম্লান মুখে বসে রইল। সে তো আর বলতে পারে না, পাড়ার ছেলেদের নিয়ে পন্টু সেদিন। হামলা না করলে তাকে সেদিন মা-সহ এ বাড়ি থেকে বের করেই দিচ্ছিল দাদা আর বউদি।
বউদি বলল, চা খাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
চয়ন চায়ের তেমন স্বাদ পেল না। এই যে বউদি ঘরে এসেছে, তার মনে হচ্ছে এর পিছনেও একটা উদ্দেশ্য আছে। সে এখন একা। এবং অসহায়। মা থাকতে যে খুব একটা সহায় হত তা নয়। তবে মা ছিল বলেই দাদা বউদির হয়তো একটু চক্ষুলজ্জা ছিল। পাড়ার ছেলেদের ভয়ও ছিল। কিন্তু এখন চয়নের আর কোনও আড়াল নেই, বর্ম নেই।
বউদি হঠাৎ খুব করুণ গলায় বলল, তুমি খুব একা হয়ে গেলে, না চয়ন?
চয়ন মুখ নিচু করে বলল, হ্যাঁ। খুব ফাঁকা লাগছে।
আমাদের তবু সংসার-টংসার আছে। তোমার তো তা নেই।
চয়ন মাথা নেড়ে কথাটা সমর্থন করল। কিন্তু তার বুক দুরদুর করছে। এ সব হল কোনও অপ্রিয় প্রস্তাবের ভূমিকা। এর পর কিছু একটা আসছে। আজ মা মারা গেছে, আজই হয়তো বলবে। না কিছু। কিন্তু গেয়ে রাখল। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করার মতো ভুল আর দাদা-বউদি করবে না। তবে এখন প্রতিরোধহীন চয়নকে কথার ফাঁদে ভুলিয়ে ঠিকই বের করে দেবে একদিন।
বউদি বসেই রইল। গেল না। চয়ন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। একসময়ে, দাদার বিয়ের ঠিক পর পরই, বউদির সঙ্গে কত ভাব হয়ে গিয়েছিল চয়নের! একসঙ্গে বসে গল্প করা, সিনেমায় যাওয়া, বাপের বাড়ি যেতে সঙ্গী হওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়া অবধি। তারপর ধীরে ধীরে সম্পর্কের নকশা পাল্টে গেল। সেটা হল, দাদা তার বাড়িওলার কাছ থেকে বাড়িটা কিনে নেওয়ার পর থেকেই।
চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছো না চয়ন?
করছি।
তোমার তো শুনি অঙ্কে খুব মাথা।
চয়ন মৃদুস্বরে বলে, তাতে কিছু হয় না আজকাল।
শুধু টিউশানি করে কি চলবে?
খুব চেষ্টা করছি।
করো। তোমার জন্য আমরা সব সময়েই চিন্তা করি। একটু বিশ্রাম করে নাও। তারপর ওপরে এসো।
বউদি চলে যাওয়ার পর চয়ন চায়ের কাপ শেষ করে আবার চিৎপাত হয়ে শুল। ঘরটা আজ থেকে তার একার। সামনে বন্ধনহীন জীবন। তার কি ভাল লাগছে? না খারাপ? কামুর। আউটসাইডার উপন্যাসের নায়কেরও কি এরকম ভাবান্তরহীনতাই ছিল?
চূড়ান্ত ক্লান্তিতেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল চয়ন। দাদাদের ঝি এসে ডেকে তুলল। চোখ চেয়ে চয়ন দেখল, ঘুমের মধ্যে সে খুব কেঁদেছে। চোখের কোলে জল। বুকটা ভার।
সে বলল, আমি খাবো না। বউদিকে বললা গিয়ে আমার বড্ড বমি-বমি করছে। খেতে পারব না।
ঝি মাথা নেড়ে চলে গেল।
সারা রাত অকাতরে ঘুমোলো চয়ন। যেন আজ একটা অনির্দিষ্ট ছুটি পেয়েছে। কিরকম ছুটি, কেন ছুটি, তা সে বুঝতে পারল না।
বউদি আবার চা নিয়ে এল সকালবেলায়, চয়ন, আজ তোমার শরীর কেমন?
বড় দুর্বল লাগছে।
আজ তাহলে আর বেরিও না। হবিষ্যি খাবে তো? রাঁধছি কিন্তু।
কিছু তো খেতেই হবে। রাঁধে।
তোমার দাদা বলছিল, এ ঘরটার অনেকদিন কলি ফেরানো হয়নি। একটু মেরামতিরও দরকার।
চয়ন চারদিকে তার শিথিল চোখ একবার ঘুরিয়ে দেখে নিল। ঘরটার অবস্থা চূড়ান্ত শ্রীহীন। প্রচুর ঝুল জমে সিলিংটা প্রায় কালো হয়ে এসেছে। দেয়ালের চাপড়া যে কত জায়গায় খসে পড়েছে তার হিসেব নেই। জানালা দরজার অবস্থাও খুব খারাপ। পাল্লাগুলোর কাঠ ক্ষয়ে গেছে অনেকটা করে।
চয়ন নিরাসক্ত গলায় বলে, মেরামত আর রং করলে ঘরটা ভালই হবে। বউদি, তোমরা কি আমাকে আর এখানে থাকতে দেবে?
বউদি একটু অবাক হয়ে বলে, কেন বলো তো!
চয়ন ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলে, না, মানে, এখন তো মা নেই। একটা ঘর আটকে আমি পড়ে থাকব। তোমাদের অসুবিধে হবে না?
বউদি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমরা ভাবছিলাম, নিচের তলাটা ভাড়া দিয়ে দেবো। যদি দিইও তুমি জলে পড়বে না। ছাদে একটা চিলেকোঠা তো আছেই। থাকতে পারবে না সেখানে?
চয়ন হাঁফ ছাড়ল। চিলেকোঠা! সেও তার কাছে স্বর্গ। চিলেকোঠার পাকা ছাদ নেই, অ্যাসবেস্টস। একটু গরম হবে। তা হোক, একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় তো। কলকাতার বাড়ি ভাড়া যেখানে উঠেছে চয়নের মতো লোকের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া শক্ত। কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়ে চয়ন বলল, খুব পারব বউদি। খুব পারব।
আরও কয়েকবার আনমনে সে ‘খুব পারব’ কথাটা উচ্চারণ করল।
বউদি বলল, ওপরে অ্যাসবেস্টস হলেও ঘরটা কিন্তু ভালই।
জানি বউদি। একসময়ে ওই ঘরে আমি পড়তে যেতাম।
হ্যাঁ, তুমি তো জানোই। সংসারের খরচ যা বেড়েছে, নিচের তলাটা ভাড়া না দিলে চলছে না। তোমার দাদা অফিস থেকে অনেক টাকা লোন নিয়েছিল, মাইনে থেকে কেটে নিচ্ছে।
হ্যাঁ বউদি, ভাড়া দেওয়াই ভাল।
বউদি একটু হাসল, এর আগেও অনেকে ভাড়া নিতে এসেছে, কিন্তু এ ঘরটা দেওয়া হবে না জেনে ফিরে গেছে। পুরো একতলাটা হলে ভাড়াটাও ভাল পাওয়া যাবে। তুমি কিছু মনে কোরো না কিন্তু।
চয়ন কৃতজ্ঞতায় মরে যেতে যেতে বলল, না বউদি, কিছু মনে করার নেই। চিলেকোঠায় আলো-হাওয়া আছে। আমার ভালই হবে। তবে আর একটা কথা বলব?
বলো না কেন? লজ্জা কিসের?
টিউশানি করে আমি যা পাই তা খুব খারাপ নয়। মা চলে যাওয়ায় আমার খরচ কমেও গেল। আমার কাছ থেকে ভাড়া হিসেবে কিছু কিছু নেবে?
কী যে বলো!
কিন্তু বউদির গলায় একটা আনন্দের চাপা ভাবও শুনতে পায় চয়ন।
চয়ন মিনতির স্বরে বলল, না বউদি, আমার কোনও কষ্ট হবে না। সামান্য কিছু দিতে আমার কষ্ট হবে না।
আচ্ছা, সে পরে ভেবে দেখা যাবে। কাল থেকে খাওনি, তোমার শরীর ওইজন্যই দুর্বল লাগছে। কিন্তু এমন সব নিয়ম। এক কাজ করো, সাগু ভেজানো দু’গাল খেয়ে নাও। খাবে? তাহলে পাঠিয়ে দিই।
দাও। আমি একটু টিউশনির বাড়ি যাবো। খবর দেওয়া নেই তো!
পারবে?
পারব বউদি।
বউদি চলে গেল। একটু বাদে কলা, নারকেল কোরা আর চিনি দিয়ে মাখা বাটি ভরা সাগু দিয়ে গেল। চয়ন পেট ভরে খেল। তারপর বেরোলো। ঘরে বসে থেকে লাভ নেই। একজন লাগবে। তার চেয়ে পড়াতে বসলে মনটা ভাল থাকবে।
আজকের দিনটা কেমন যেন। রোদ হাওয়ায় হালকা একটা দিন। মনটা ফুরফুর করে পতাকার মতো। অনেক ওপরে উঠে নড়ে। মন থেকে একটা ভার নেমে গেছে আজ। দাদা-বউদি এখনই। তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে না। আপাতত সে রয়ে গেল। চিলেকোঠা তো কী হয়েছে?
সারাটা দিন আজ হালকা পায়ে নেচে নেচে বেরিয়ে গেল। বিকেলে মোহিনীদের বাড়ি।
মোহিনী অবাক হয়ে বলে, এ কী চয়নদা? কী হল?
মা চলে গেলেন।
ওমা! তা আপনি আজ এলেন কেন?
ঘরে ভাল লাগছিল না।
বসুন, বসুন। মাকে ডাকি।
মোহিনীর মা এসে দাঁড়ালেন।
ইস্, কবে হল চয়ন?
কাল সকালে।
এখন কী হবে?
চয়ন ম্লান হাসল, মা একরকম বেঁচেও মরেই ছিল।
তা হলেও তো মা!
চয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কেন কে জানে, এখন তার মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে।
রিয়া বলল, দাদা-বউদির সঙ্গে তো তোমার সম্পর্ক ভাল নয়। মায়ের ব্যাপারে দাদা সাহায্য করেছে তো!
করেছে।
রিয়া একটা শ্বাস ফেলে বলল, যাক। কিন্তু এখন কী করবে চয়ন? ও বাড়িতে থাকতে পারবে?
পারব। বউদি বলেছে, থাকতে দেবে।
বলো কী! এ তো খুব ভাল কথা।
আজ্ঞে।
কিছু খাবে? তোমার তো অশৌচ, এখন অনেক রেস্ট্রিকশন। তোমাকে বরং এক গ্লাস ফ্রুট জুস দিই। মোহিনী বাবা বিলেত থেকে কমলালেবুর রস এনেছিল। খাও। আর কিছু খাবে? সন্দেশ?
না। আর কিছু নয়।
ঠিক আছে। পড়াবে নাকি?
পড়াতেই এসেছি। আমার কষ্ট হবে না।
পড়াও তাহলে।
রিয়া চলে যাওয়ার পর মোহিনী বলল, চয়নদা, আপনার কান্না পাচ্ছে না?
না। কী জানো, মা চলে যাওয়ায় কেমন যেন ভারমুক্ত লাগছে।
সে কী চয়নদা!
বলছি তো। আমার শোকের চেয়েও যেন বেশী মনে হচ্ছে ফ্রিডম। মায়ের জন্য সারাক্ষণ উদ্বেগ ছিল, অশান্তি ছিল। রাঁধতে হত, খাইয়ে দিতে হত। সব সময় মনটা পড়ে থাকত ঘরে। গিয়ে মাকে বাঁচা দেখতে পাবো তো!
আপনার খুব কষ্ট ছিল, চয়নদা, না?
খুব কষ্ট। যখন ভাবি, আমার জন্য তো মা এর চেয়ে অনেক বেশী কষ্ট করেছে তখন নিজেকে খুব অকৃতজ্ঞ মনে হয়। আমি বোধহয় খুব হৃদয়হীন, না মোহিনী?
তা কেন চয়নদা? আপনি তো খুব নরম মনের মানুষ।
গরিবের মন বলে কিছু থাকে না। কতগুলো দারিদ্র্য আছে এতই খারাপ যে, মানুষকে নষ্ট করে দেয়।
আমার বাবাও খুব গরিব ছিল। ভীষণ গরিব। কিন্তু বাবা কখনও হার মানেনি।
তোমার বাবার কথা জানি মোহিনী। আমারও ওরকম হতে ইচ্ছে করে।
মোহিনী একটু হাসল। বলল, কিন্তু বাবা কখনও তার দারিদ্রের গল্প করে না।