1 of 2

৪২. যারা লম্বা তালগাছের ওপরে

যারা লম্বা তালগাছের ওপরে উঠে রসের জন্য হাঁড়ি বেঁধে আসে, শুধু তারাই জানে তালগাছে ওঠার কষ্ট। পায়ে দড়ি বেঁধে, হাত দুখানি টিকটিকির থাবার মতন আঠালো করে উঠতে হয়–প্রথমে বেশ তরতর করেই ওঠা যায়, যত ওপরে ওঠে ততই হাত-পা ধরে আসে, পৃথিবী নীচের দিকে টানে। একেবারে শেষের দিকে, যখন আর মাত্র হাত তিনেক বাকি, তখন মনে হয় আর পারা যাবে না, এবার হাত এলিয়ে সরসর করে নীচে পড়ে যেতে হবে। মাত্র আর ওইটুকু, যার পরেই ওপরের ডাল ধরে কোমরে দড়ি বেঁধে বিশ্রাম পাওয়া যেতে পারে–সেই সব জেনেও ওইটুকু পথ পার হওয়া সবচেয়ে শক্ত। চলতি কথায় একেই বলে তালগাছের তিন হাত।

জেদ ও উত্তেজনার বশে অনেকখানি যাওয়া যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে ক’জন? শেষ মানে তো শুধু সাফল্য নয়, একটা বিশ্বাসের পরিণতিযা শুধু মন নয়। শরীর দিয়েও অনুভব করতে হয়। কত মোক্ষ-পাগল মানুষ চৌরাস্তায় এসে ভুল পথে গেছে। মরুভূমিতে মরুদ্যানের পাশেই অনেক অনেক নরকঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখা যায়। উত্তপ্ত বালির সমুদ্র পার হয়ে যারা আসে, তারা অনেকেই জলের দৃশ্য দেখে অতিরিক্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে, জলের কাছে আর পৌঁছোতে পারে না। শেষ মানেই সাফল্য নয়, বাস্তবতা নয়, নশ্বরতা-জয়ী এক বিশ্বাস।

সারা রাত ধরে হেঁটে এসে যোগানন্দ আর সূর্য ব্রাহ্ম মুহূর্তে দেখতে পেল খড়্গপুর শহর। নোংরা, ধুলোয়-ভরতি একটা রেললাইন তো শুধু নয়, যেন ওই অমরাবতী, ওখানে অপেক্ষা করে আছে স্বর্গসুখ। ভোরের নরম আলোয় সত্যিই যেন ওই শহর থেকে দিব্যজ্যোতি বেরোচ্ছে। ওখানে আছে আশ্রয়, ওখানে আছে মানুষ, ওখানে আছে। পরিচিত জীবন। জল যেমন জলের দিকে যায়, মানুষও মানুষকে ছাড়া বাঁচতে পারে না। গত কয়েক দিন ধরে ওরা দু’জন মানুষজন দেখলেই আত্মগোপন করছিল, এখন মনে হচ্ছে, কতক্ষণে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলবে।

এতক্ষণ সূর্যই যোগানন্দকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসছিল, যোগানন্দ ঘুমোতে চাইলেও ঘুমোতে দেয়নি, বিশ্রাম করতে দেয়নি–এখন সূর্য আর নিজেই পারছে না। দু’-তিন বার সে রাস্তায় থুবড়ে পড়েছে, আবার উঠেছে, যোগানন্দর সাহায্য নিতে চায়নি, এখন আর সে সামর্থ্যও নেই। এখন তাকে বাধ্য হয়ে যোগানন্দর কাঁধে ভর দিতে হয়েছে। যোগানন্দ তার বগলের তলায় হাত দিয়ে প্রায় হেঁচড়ে নিয়ে আসছে।

যোগানন্দও দারুণ পরিশ্রান্ত, খিদের জ্বালায় কাতর, সারা রাত ঘুম নেই–তবু যোগানন্দ বেশ উল্লাসের মধ্যে আছে। হাসিঠাট্টা, খিস্তিখেউড় করে নিজের সঙ্গে সে যেন বেশ একটা কৌতুকে মেতে উঠেছে। সূর্যকে উদ্দেশ্য করে সে যা বলছে, সূর্য তার কোনও উত্তর না দিলেও কিছু যায় আসে না। সূর্য হু হা ছাড়া কিছুই বলেনি। একটু বাদেই সূর্যর পা এলিয়ে গেল, হাঁটু দুমড়ে সে পড়ে যেতে লাগল। যোগানন্দ ঘুরে দাঁড়িয়ে শক্ত করে। সূর্যর কাধ চেপে ধরে বলল, এই অমর, ওঠ! কী করছিস কী? আর মোটে একটুখানি!

সূর্য ঘোর-লাগা মানুষের মতন আচ্ছন্ন গলায় বলল, হ্যাঁ, এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাচ্ছি আমি।

ওঠ, ওঠ, আর বড় জোর আধ মাইল। রেলওয়ে কোয়ার্টারে আমার একজন চেনা লোক আছে তার বাড়িতে গেলেই নরম বিছানা পাবি, গরম গরম চা–

সূর্য বলল, এই তো উঠছি।

ওঠার বদলে সূর্য মাটিতে শুয়ে পড়ল। যোগানন্দ তাকে একরকম টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে এল কাছাকাছি একটা কালভার্টের ওপর। নিজে সেখানে বসে সূর্যকে ভালো করে শুইয়ে দিল কোলের ওপর মাথা দিয়ে। দু-এক মিনিটের মধ্যেই সূর্য আবার গা ঝাড়া দিয়ে বলল, চলো!

যোগানন্দ বলল, একটুখানি বসা যাক। আর একটু আলো ফুটুক। আমরা যে বাড়িতে উঠব, সে-পাড়াতেই একটা দোকানে দারুণ জিলিপি ভাজে। আর কড়াইশুটির কচুরিও পাওয়া যায়। যা খাব না আজ, জন্মের মতন খেয়ে নেব শালা! কচুরি ও সঙ্গে ম্যাড্রাসি কফি।

সূর্য মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, থাকতে দেবে?

কেন দেবে না। আলবত দেবে। ও না দেয় ওর বাপ দেবে। ওর কাকা আমাদের স্টেটের নায়েব ছিল।

তার মানে?

যোগানন্দ হাসতে হাসতে বলল, ভুলে যাচ্ছিস কেন, আমি একটা জমিদারের ছেলে। এখনও রাস্তায়ঘাটে অনেক লোক আমাকে দেখে প্রণাম করে। পকেটে একটাও পয়সা থাকলে কী হয়–

নরম নীলচে রঙের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সবেমাত্র পূর্ব দিগন্ত লাল হল। সেই সূর্য ওঠার দিকে চোখ রাখলে মনে হয় এরই নাম আবির্ভাব! শ্রান্ত শরীরে এই ভোরের সূর্যকে খুব রমণীয় মনে হয়। অন্তত এই সময় এই সূর্য বিজ্ঞানসম্মত নয়, প্রবাদপুরাণের দেবতা।

সেপ্টেম্বরের শেষে বাতাস ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ভোরের হাওয়ায় স্পর্শে গায়ে একটু ছমছমানি লাগে। আকাশ পরিষ্কার, তকতকে নীল, বর্ষায় ধোওয়াধুয়ির পর গাছপালাগুলি সতেজ সবুজ। চারদিকে বেশ টাটকা রঙের সমারোহ।

যোগানন্দ বুক ভরে অনেকখানি নিশ্বাস টেনে নিয়ে আপন মনে বলল, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

সূর্য কোনও উত্তর দিল না। যোগানন্দ তাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বেশ জোরে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার আমরা ভালো ভাবে বাঁচব। চালাকি নাকি?

সূর্য চোখ বুজে নিথর ভাবে বসে আছে। যোগানন্দ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, বড় বড় করে কয়েক বার নিশ্বাস টান, দেখবি শরীরটা বেশ ভালো লাগবে।

আমি অনেকটা ঠিক হয়ে গেছি।

যোগানন্দ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল পূর্ব আকাশের দিকে। ডান হাত দিয়ে মুখখানা ক’বার কচলে নিল। অকস্মাৎ দেখা গেল যোগানন্দের দু’চোখে জল। এতক্ষণ সে এমন হাসি ঠাট্টার মধ্যে ছিল যে এখন এই অশ্রু সত্যিই অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়! সে আবার হাত দিয়ে চোখমুখ মুছে দূরের দিকে চেয়ে বলল,

এ নহে তো ঔদাসীন্য, নহে ক্লান্তি,
নহে বিস্মরণ,
ক্রুদ্ধ এ বিতৃষ্ণা তব মাধুর্যের প্রচণ্ড মরণ,
তোমার কটাক্ষ
দেয় তারি হিংস্র সাক্ষ্য
ঝলকে ঝলকে
পলকে পলকে,
বঙ্কিম নির্মম
মর্মভেদী তরবারি-সম।
তবে তাই হোক,
ফুৎকারে নিবায়ে দাও অতীতের অন্তিম
আলোক।

একটু থেমে যোগানন্দ বলল, এরপর কী যেন? মনে পড়ছে না। অমর, তোর মনে আছে?

সূর্য বলল, না।

তুই রবিবাবুর কবিতা পড়িসনি?

তেমন ভাবে পড়ার সুযোগ পাইনি।

যদি কালকেই তুই মরে যাস, তা হলে তুই টেরও পাবি না–জীবনে কী একটা– আনন্দের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলি। এই কবিতাটা আছে সানাই বইতে। আমিও অনেক দিন আর এসব বই পড়িনি। রবিবাবুর এক একটা কবিতা পড়ে মনে হয়, উনি এগুলো নিজের জন্য লেখেননি। আমাদের হয়ে আমাদের সব দুঃখের কথা উনি লিখে দিয়েছেন।

আর একটু বলুন না।

ঠিক মনে পড়ছে না। বোধহয় এই রকম:

চাহিব না ক্ষমা তব, করিব না দুর্বল মিনতি
পরুষ মরুর পথে তোক মোর অন্তহীন গতি,
অবজ্ঞা করিয়া পিপাসারে,
দলিয়া চরণ তলে ক্রুর বালুকারে।…
আজ তব নিঃশব্দ নীরস হাস্যবান
আমার ব্যথার কেন্দ্র করিছে সন্ধান
সেই লক্ষ্য তব
কিছুতেই মেনে নাহি লব,
বক্ষ মোর এড়ায়ে সে যাবে শূন্যতলে,
যেখানে উল্কার আলো জ্বলে
ক্ষণিক বর্ষণে
অশুভ দর্শনে।

যোগানন্দ আবার থেমে যেতেই সূর্য বলল, আরও একটু বলুন।

আর মনে নেই যে! শুনলে মনে হয় না, এ যেন ঠিক তোর কিংবা আমার মনের কথা?

দু’জনে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। যোগানন্দ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল চারদিকে। তার মুখখানা থমথমে। নিজের বুকের ওপর চাপড় মারছে আনমনে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বেশ তো ফিরে গিয়েছিলাম, সংসার টংসার সাজিয়ে বসেছিলাম-কেন যে তুই আমাকে বার করে আনলি!

সূর্য ওর মুখের দিকে তাকাতেই যোগানন্দ তাড়াতাড়ি বলল, আমি অনুতাপ করছি না। মোটেই অনুতাপ করছি না। তুই না গেলেও আমাকে বেরিয়ে পড়তে হতই একবার যখন ছোঁয়াচ লেগেছে–তখন কি আর ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে থাকতে পারতাম! যা করেছি সজ্ঞানেই করেছি। বেশ করেছি! এই রকম অবস্থায় আবার পড়লে হয়তো আবার ওই রকমই করতাম। কিন্তু এই রকম একটা শান্ত সকালবেলা মনে হয় না, যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি–এ সবই অর্থহীন? একটা ছোট বাড়িতে নিঝঞ্ঝাটে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার! এবার যদি কোনওক্রমে ঘরে ফিরতে পারি, তা হলে আর এ রাস্তায় বেরোব না।

সূর্য বলল, আপনি যদি সেই ডাকাতির সময় না যেতেন—

যোগানন্দ আপশোসের সুরে বলল, ওই তো আমার দোষ! আমার হাতে অনেক। ময়লা। আসলে কী জানিস, আমার মাথার ঠিক নেই। কিছু দিন বাদে বাদেই আমার সব হিসেবের গোলমাল হয়ে যায়।

যোগানন্দদা, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন মানে কী?

তোর তো এখনও জীবন শুরুই হয়নি, ওটা বুঝতে পারবি না।

আমি তো অনেক মানুষ দেখলাম।

নাঃ, কোনও লাভ নেই। তোর আর আমার মাথার ঠিক পেছনেই মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে, এসময় জীবন টিবন নিয়ে আলোচনা করার কোনও মানে হয় না।

দুজনেই চকিত মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল পেছনে। তারপর পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে শুকনো ভাবে হাসল। যোগানন্দ বলল, চল, যাওয়া যাক। তুই উঠতে পারবি তো?

চলুন।

সূর্য উঠতে যেতেই তার কোমরে গোঁজা রিভলবারটা খুলে বেরিয়ে এসে প্রথমে পড়ল কালভার্টের ওপরে, ঠং করে শব্দ হয়ে গড়িয়ে গেল নীচের নালায়। সূর্য ব্যগ্র ভাবে অত্যন্ত শরীর নুইয়ে সেটা তুলতে যেতেই যোগানন্দ তার ঘাড় ধরে তুলে এক ধমক দিয়ে বলল, কী করছিস কী? মাথা ঘুরে পড়ে যাবি যে!

ওটা তুলতে পারছি না।

যোগানন্দ রিভলবারটার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভাবে বলল, কী আর হবে ওটা তুলে। আমারটাও ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখি বরং। এখন তো এগুলো সঙ্গে রাখাই বিপদ।

দুর্বল শরীরে কয়েক বার নিশ্বাস নিয়ে সূর্য বলল, আমাদের লড়াই কি শেষ হয়ে গেছে?

যোগানন্দ এতক্ষণ পরে গলা ভরতি করে হা হা শব্দে হেসে উঠল। তারপর সূর্যর কাঁধ চাপড়ে বলল, তুই কি এর পরেও লড়াই করার স্বপ্ন দেখছিস? তুই যদি এরপর আর সাতটা দিনও বেঁচে থাকিস তা হলে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিস!

সূর্য অনুভূতিহীন গলায় বলল, আমি সহজে মরব না!

কেউ কি মরতে চায়? আমি কি মরতে চাই? ভেবেছিলাম তো এবার লড়াইতে পাপ চুকিয়ে দেব। কিন্তু পুলিশের গুলি খেয়ে মরার সাধ আর আমার নেই। আমি এবারেও ঠিক বেঁচে যাব কিন্তু তুই যা শরীরের অবস্থা করেছিস, ক’দিন থাকতে পারবি?

আমি শিগগিরই ভালো হয়ে উঠব।

তোর এত বাঁচার শখ কেন রে?

আমার অনেক কিছু এখনও বাকি আছে।

কী বাকি আছে?

সূর্য একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে বলল, অনেক কিছুই বাকি আছে। কিন্তু কাল থেকে মনে হচ্ছে, একজনের সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত আমার মৃত্যু হবে না। আমি তার সামনে গিয়ে বলব, আমি আর জোর করতে চাই না, তোমাকে কেড়ে নিতে চাই না, কিন্তু তুমি তোমার মনের মধ্যে আমার জন্য একটু জায়গা রেখো।

যোগানন্দ জিজ্ঞেস করল, সে কে?

আপনি চিনবেন না।

তোর এত কাঁচা বয়স, এরই মধ্যে প্রেমে ট্রেমে পড়লি কবে?

সেসব কিছু না। আচ্ছা, আপনি কি মরতে চান?

তোকে এ অবস্থায় ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না।

আমার হাতটা একটু ধরুন, রিভলবারটা তুলে আনি।

ওটা আর সঙ্গে না-রাখাই উচিত।

আমি ওটা না-নিয়ে যেতে পারব না।

ঠিক আছে, তুই দাঁড়া—

যোগানন্দ নীচে গিয়ে রিভলবারটা তুলে এনে সূর্যর হাতে ধরিয়ে দিল। এখন যোগানন্দর মুখের ভাব আবার বদলে গেছে। চিন্তার লেশমাত্র নেই। সূর্যর কাধ ধরে বলল, অমর, সোজা হয়ে দাঁড়া তো! এই তো, ঠিক আছে। শোন, আমরা দুজনেই খোলা রিভলবার হাতে নিয়ে শহরে ঢুকব। আমরা ফাঁইটার, শেষ পর্যন্ত আমরা ফাঁইট করে যাব। বখতিয়ার খিলজি নাকি সতেরো জন অশ্বারোহী নিয়ে বাংলা জয় করেছিলেন, আর আমরা দুজনে এই একটা শহর জয় করে ফেলতে পারব না? আমাদের সামনে কে দাঁড়াবে? রাজি আছিস?

উত্তর না দিয়ে সূর্য হাসল।

আমরা কারোকে পরোয়া করব না। তোর কাছে কার্তুজ ক’টা আছে?

ডজন তিনেক।

আমার কাছেও ওই রকমই আছে। লড়ে যাব শেষ পর্যন্ত। শেষ বুলেটটা রেখে দেব নিজের মাথার জন্য। শালা, এই কুকুর-বেড়ালের মতন পালিয়ে পালিয়ে থাকা আর ভালো লাগে না।

আমরা তো শহরেই যাচ্ছি।

হাঁ। কোনও শুয়ারের বাচ্চা ঝঞ্ঝাট করতে এলে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেব।

যেন এটা একটা রসিকতা, এই ভাবে কথাটা শেষ করে হাসল যোগানন্দ। নিজের রিভলবারটা বার করে চুমু খেল।

কাছেই একটা নিমগাছের পাতার আড়ালে অদৃশ্য থেকে একটা দোয়েলপাখি শিস দিচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে। যোগানন্দ পাখিটাকে উদ্দেশ্য করে এবার একটা পালটা শিস দিল। হালকা গলায় বলল, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে! চল!

শহরের তখনও ঘুম ভাঙেনি। রাস্তায় কদাচিৎ একটি-দুটি লোক। ম্যাড্রাসি কফির দোকানটা সদ্য খুলেছে বটে কিন্তু ওদের কফি খাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

রেলওয়ে স্টাফ কলোনির মধ্যে একটা কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে যোগানন্দ বেশ খোলা গলাতেই ডাকল, প্রবীরবাবু, প্রবীরবাবু!

দরজাটা একটু খুলতেই কোনও সুযোগ না দিয়ে ভেতরের লোকটিকে ঠেলে যোগানন্দ ঢুকে গেল ভেতরে। তারপর ডাকল, আয় অমর, ভেতরে আয়।

অল্প বয়সেই বুড়োটে হয়ে যাওয়া একজন লোক হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দু’জনের চেহারা ও বেশবাসের অবস্থা দেখে ওদের সম্পর্কে কোনও ভুল ধারণা করার অবকাশ নেই। তবু লোকটি বলল, কী হয়েছে?

যোগানন্দ বলল, দরজা বন্ধ করে দাও।

কী হয়েছে কী?

খুব বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। তুমি অনেক বার তোমার এখানে আসবার জন্য নেমন্তন্ন করেছিলে, আগে আসা হয়ে ওঠেনি। এখন এসেছি।

যোগানন্দর পারিবারিক নাম ছোটবাবু। লোকটি সেই নামেই ডেকে বললে, ছোটবাবু, আপনার কথা এখানে সবাই জানে।

কী জানে?

আপনারা দিলনগর থানায়—

কী করে জানল যে আমিই?

আপনার নামে পুলিশের হুলিয়া বেরিয়েছে। পোস্ট অফিসে কাগজ সেঁটে দিয়েছে। আমার এক ভাগ্নে পোস্ট অফিসে কাজ করে, সে দেখেছে।

তাতে কি আমার ছবি আছে?

না।

আমরা এখানে দু’দিন থাকব। এ আমার ছোটভাই।–মায়ের পেটের ভাই না হলেও আপন ভাই।

এখানে ভীষণ ধরপাকড় হচ্ছে। যে-কোনও পাড়া হঠাৎ ঘিরে ফেলে সার্চ হচ্ছে। পরশু দিন আমাদের এখানে সার্চ হয়ে গেছে, ধরে নিয়ে গেছে দু’জনকে।

একবার যখন সার্চ হয়ে গেছে আর হবে না।

তার কোনও মানে নেই। অনেক জায়গায় দু-তিন বার, যখন তখন—

আমরা মাত্র দুদিন থাকব। তোমার কাছে শিবাজল ট্যাবলেট আছে?

আজ্ঞে?

শিবাজল ট্যাবলেট আছে বাড়িতে? এই ছেলেটাকে এক্ষুনি কিছু ওষুধ খাওয়ানো দরকার।

ওষুধ তো নেই।

দোকান খুললেই ওষুধ আনতে হবে। তারপর একজন ডাক্তার।

কী হয়েছে এনার?

সেটা ডাক্তারই বলতে পারবে।

লোকটি হাত জোড় করে বলল, ছোটবাবু, আমি এখানে বউছেলে নিয়ে ঘর করি—

আমরা কোনও অসুবিধের সৃষ্টি করব না।

আপনি বুঝতে পারছেন না–যদি পুলিশের নজরে পড়ি—

যোগানন্দ হঠাৎ দপ করে রেগে উঠল। উত্তপ্ত চোখে বলল, আর যারা দেশের জন্য লড়াই করছে, তাদের কারওর মা নেই, বাবা নেই, বউ-ছেলেপুলে নেই, না? তাদের মায়েদের কষ্ট নেই, তাদের ছেলেমেয়েরা কাঁদে না? স্নেহ দয়া মায়া বুঝি তাদের জন্য নয়!

আমি ছাপোষা মানুষ–

আমাকে বেশি রাগিয়ো না। নেহাত বাধ্য হলে না হলে কি তোমার বাড়িতে আসতাম? এখন কি আমাদের ধুলোপায়ে বিদায় করতে চাও? নিমকহারাম!

ওকথা বলবেন না। আপনাদের বাড়ির নুন খেয়েছি এককালে। আপনারা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। কিন্তু যদি পুলিশ টের পায়, আপনাদের তো যা হবার হবেই, আমার চাকরি যাবে। তখন কোথায় দাঁড়াব বলতে পারেন।

পুলিশ টের পাবে কেন! প্রবীর, একটা কথা ঠিক করে বলল তো–পুলিশের সঙ্গে তোমার কোনও যোগাযোগ আছে? ইনফরমারের কাজ নিয়েছ নাকি? তোমাদের রেলের কিছু ওয়ার্কার স্যাবোটাজ করতে গিয়েছিল না?

আমি তখন ছুটিতে ছিলাম। পুলিশ দেখলেই আমি আঠারো হাত দূরে থাকি!

একটা সাত-আট বছরের ছেলে মুখে আঙুল দিয়ে ওদের দেখছিল। সূর্য ছেলেটির কাছে গিয়ে বলল, খোকা, তোমার নাম কী?

ছেলেটি কোনও উত্তর না দিয়ে ছুটে ভেতরে চলে গেল। তার থেকে একটু ছোট আর একটা ছেলে এসে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়াল।

যোগানন্দ প্রবীরকে ধমক দিয়ে বলল, যাই হোক, কোনও রকম এদিক-ওদিক করার চেষ্টা কোরো না। তা হলে সুবিধে হবে না। আমরা এখানে থাকতে এসেছি। এখানে থাকব যতক্ষণ–না সুবিধে মতন জায়গা পাই।

যেখানে ওদের থাকতে দেওয়া হল, সেটা বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের পড়বার ঘর। পাঁচটি ছেলেমেয়ে। তারা দূর থেকে উঁকি মেরে যাচ্ছে, ডাকলেও কাছে আসে না। সূর্য। দরজার কাছে গিয়ে তাদের ধরবার চেষ্টা করলেও ওরা পালিয়ে যায়।

যোগানন্দ বলল, বাচ্চাদের আমি ভালোই বাসি। কিন্তু এখন এই বাচ্চাদের দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। এখন এরাই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। ওরা এক্ষুনি গিয়ে পাড়ার অন্য বাচ্চাদের কাছে আমাদের সম্পর্কে গল্প করবে। তারা আবার তাদের মা বাবার কাছে বলবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের কথা এখানে সবাই জেনে যাবে। এই কলোনির মধ্যে একজন-দু’জন যে পুলিশের ইনফরমার আছে, সে সম্পর্কে আমি বাজি ফেলতে পারি।

সূর্য মাথা নাড়ল। যোগানন্দ ঠিকই বলছে। সেই জন্যই সে এতক্ষণ বাচ্চাগুলোর সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করছিল। দিন দশেক আগে তারা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল– সেখানে বাচ্চাদের জন্যই তাদের উপস্থিতির কথা ফাঁস হয়ে যায়।

যোগানন্দ বলল, তুই হাজার চেষ্টা করেও বাচ্চাদের আটকাতে পারবি না। ওদের বারণ করলে ওরা আরও বেশি করে বলবে। আগে জানতাম না এ বাড়িতে এতগুলো বাচ্চা। প্রবীর আমার চেয়েও এক বছরের ছোট–এর মধ্যেই পাঁচটা বাচ্চা পয়দা করে ফেলেছে কী করে জানব।

সূর্য বলল, ছোট মেয়েটাকে দেখতে ভারী সুন্দর। মুখটা সত্যিই সুন্দর। অন্য সময় হলে কত আদর করতাম, লজেঞ্জুস কিনে দিতাম– এখন ইচ্ছে করছে গলা টিপে মেরে ফেলি। হয়তো ওই মেয়েটার জন্যই আমরা ধরা পড়ব।

সূর্য হেসে বলল, সো সুইট ওয়াজ নেভার সো ফেটাল!

এক বাটি করে হালুয়া এবং দু’কাপ অতি বিস্বাদ চা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের জন্য। যোগানন্দ চোখের নিমেষে হালুয়াটুকু শেষ করে লোলুপ ভাবে তাকিয়ে রইল বাটিটার দিকে। বেচারা! ওর এত বড় শরীর ও প্রচণ্ড খিদের কাছে ওইটুকু হালুয়া কী! অনিচ্ছুক গৃহকর্তার বাড়িতে আতিথ্য নেওয়ার গ্লানি যে কী তা ওরা ভালো ভাবেই জানে। যোগানন্দর আরও মনে লাগছে এই জন্য যে তাদেরই একদা অনুগৃহীত প্রজার বাড়িতে। সে এসেছে–যে এর আগে বহু বার তাকে এ বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দেবার জন্য অনুরোধ করেছে–আজ সে পেট ভরে খেতেও দেবে না? যেন তারা কোনও ঘৃণিত প্রাণী। তারা এত লড়াই করল কার জন্য? এদের জন্য নয়? অপরিচিত লোকের বাড়িতে উঠলে সে হয়তো খাবারের জন্য জোর জুলুম করতে পারত কিন্তু চেনা লোকের কাছে। ভয় দেখিয়ে খাবার চাওয়া যায় না।

যোগানন্দ সবকটা জানলা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে ফেলল। রাগের মাথায় চেয়ারকে লাথি মেরে ফেলে দিল ঘরের কোণে। সূর্য টেবিলের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে–হ্যাঁত দুখানা বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। মুখখানা অসম্ভব বিবর্ণ।

যোগানন্দ তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিস?

না।

এখন ঘুমোস না। শরীর আরও খারাপ লাগবে। স্নানটান করে–এরা যদি ভাত খেতে দেয়, সেটা খেয়ে নিয়ে তারপর পালা করে ঘুম দিতে হবে। তুই আগে ঘুমিয়ে নিস। তার আগে কয়েকটা জরুরি কথা সেরে নেওয়া যাক। তোর এখানে কোন আত্মীয় থাকে বললি, তার বাড়িতে তোকে থাকতে দেবে?

তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে?

যদি পাওয়া যায়। থাকতে দেবে?

মনে তো হয়।

এখানে বেশি দিন থাকা যাবে না, বুঝলি! তা হলে তোকে সেখানে রেখে আমি কেটে পড়তাম।

আপনি কোথায় যাবেন?

বাংলাদেশ থেকে সরে পড়তেই হবে। তোর শরীরের অবস্থা খারাপ, তোর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু আমার তো এখানে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। দিনের-পর-দিন পারব না ঘরে বসে থাকতে বেরোলে ধরা পড়বই। ব্রিটিশদের ইনটেলিজেন্স ব্যবস্থা সাংঘাতিক। গোটা ভারতবর্ষে এতকালের মধ্যে রাসবিহারী বোস ছাড়া আর কেউ গ্রেফতার এড়াতে পেরেছে?

লোকের বাড়িতে এ রকম ভাবে জোর করে থাকার চেয়ে আমার জেলে যেতে খারাপ লাগবে না।

খুব আরামের জায়গা ভেবেছিস, তাই না? তোর যা লালটু চেহারাত শালা হোমো তোর বারোটা বাজিয়ে দেবে।

আমরা কি আজই এখান থেকে চলে যাব?

দেখি! এক হিসেবে পুলিশের হাতে এখন তুই ধরা পড়লে তোর পক্ষে ভালোই হত। জেলের হাসপাতালে চিকিৎসা হতে পারত। কিন্তু তার আগেই যদি পেঁদিয়ে শেষ করে। দেয়? ব্রজদাকে যে ভাবে মারল–

যোগানন্দ প্রবীরকে ডেকে পাঠাল। সে আসতেই জিজ্ঞেস করল, ওষুধ আনিয়েছ? প্রবীর শুকনো মুখে বলল, না, এখনও দোকান খোলেনি। দেখি, একটু পরে—

তোমার চেনা ডাক্তার আছে?

আমাদের তো রেল কোম্পানির ডাক্তার।

কাছাকাছি অন্য কোনও ডাক্তার নেই?

ছোটবাবু, ডাক্তার ডাকলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে না?

এ-ছেলেটি কি বিনা চিকিৎসায় মরবে নাকি?

ছোটবাবু, আপনিই ভেবে দেখুন আমি কী করতে পারি! কোনওক্রমে কথাটা ছড়ালে–

বাচ্চাগুলোকে আটকে রাখতে পারবে?

কী বললেন!

তোমার ছেলেমেয়েরা যাতে বাড়ি থেকে একদম না বেরোয়, সে ব্যবস্থা করতে পারবে? পারবে না, আমি জানি। অন্য বাড়ির ছেলেমেয়েরা এলে, তাদের তো আটকাতে পারবে না। যাকগে, তোমাদের এখানে ট্রেন ঠিক মতন চালু হয়েছে?

হ্যাঁ।

সব দিকে ট্রেন চলছে?

হ্যাঁ। আপনি কোথায় যাবেন?

একটুও দ্বিধা না করে যোগানন্দ বলল, আমাকে কলকাতায় যেতেই হবে। আমাকে নিরাপদে ট্রেনে তুলে দেবার দায়িত্ব তোমার। আর একটা কথা, তুমি প্রভাস লাহিড়ী বলে কারোকে চেন? খড়্গপুরেরই লোক।

না তো!

এখানকার স্থানীয় লোক, খুঁজে বার করতে পারবে না?

শুধু নাম শুনে কী করেন তিনি?

ও-সব জানি না। তবে, খুব ইম্পর্ট্যান্ট লোক। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখো। তোমার যে ভাগনে পোস্ট অফিসে কাজ করে, তাকে জিজ্ঞেস করো–রেডিয়োর লাইসেন্স বা টেলিফোন থাকতে পারে বাড়িতে। স্টেশনমাস্টারকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। খুঁজে বার করো। এ ছাড়া আমার কিছু টাকা ধার চাই। আমি তোমাকে হুন্ডি লিখে দিচ্ছি–তুমি আমার বাবাকে সেটা দেখালে টাকাটা ফেরত পেয়ে যাবে।

কলোনির এইসব বাড়িগুলির মধ্যে খানিকটা গ্রাম গ্রাম ভাব আছে। পাড়াপ্রতিবেশীরা সবাই সবার বাড়িতে যখন তখন যাওয়া-আসা করে–পরস্পরের খোঁজখবর নেয়। কার বাড়িতে কোন দিন কী রান্না হল তাও গোপন থাকে না।

সারা দিন ধরে প্রবীরের বাড়িতে যে কত লোক এল তার ঠিক নেই। স্ত্রীলোক, বৃদ্ধ, শিশু। ঘরের দরজা বন্ধ করে অন্ধকারের মধ্যে বেজার মুখে বসে রইল যোগানন্দ। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, এর থেকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়ানোও ভালো। অমর, চল, পাততাড়ি গুটোতে হবে আজই। এত সুখ কপালে সইছে না।

সন্ধ্যাবেলাতেই প্রবীর ভালো খবর নিয়ে এল। প্রভাস লাহিড়ীর সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রভাসকে অনেকে না চিনলেও তার বাবা জগদীশ লাহিড়ী অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন লোক, সবাই চেনে। ওদের মস্ত বড় বাড়ি–থাকার জায়গার কোনও অসুবিধে নেই।

খবরটা আনতে পেরে প্রবীর খুব নিশ্চিন্ত বোধ করছে। এবং সে ভাবটা লুকোবারও কোনও চেষ্টা নেই। ওরা কবে সেখানে যাবে সে প্রশ্নও করল না, বলল, আপনারা কিন্তু না খেয়ে যেতে পারবেন না। রান্না চেপে গেছে, বেশিক্ষণ লাগবে না।

যোগানন্দ বলল, আমরা রাত ন’টার আগে বেরোব না। আর প্রবীর, তুমি আমাদের সঙ্গে গিয়ে বাড়ি চিনিয়ে দিয়ে আসবে।

প্রবীর রীতিমতন ভয় পেয়ে বলল, রাত নটায়? এখনও এখানে রাত্তিরবেলা কেউ বেরোয় না।

যাদের নাইট ডিউটি থাকে?

তাদের বাধ্য হয়ে যেতেই হয়।

আমরাও বাধ্য হয়েই যাচ্ছি। কারফিউ তো আর নেই।

প্রবীরের বাড়িতে আসার পনেরো ঘণ্টা পরেই সে বাড়ি থেকে আবার বেরিয়ে পড়তে হল ওদের। যোগানন্দ প্রবীরকে জোর করে ধরে এনেছে–তার স্ত্রী পর্যন্ত এসে কাকুতিমিনতি করেছিল, যোগানন্দ ছাড়েনি। বাড়ি খোঁজার জন্য লোকজনকে জিজ্ঞাসা করা কিংবা রাস্তা হারিয়ে ঘুরে বেড়ানো কোনও কাজের কথা নয়।

প্রবীর একেবারে থরথর কঁপছে যাকে বলে। দু’পা গিয়েই থেমে পড়ে বলছে, এবার আমাকে ছেড়ে দিন, আপনারা যেতে পারবেন।

রাস্তায় রাস্তায় বেশ পুলিশের টহল আছে। ওরা সেগুলো এড়িয়ে যেতে পারল। ক্রমে শহরের এক প্রান্তে এসে পড়ল ওরা। এখানে বাড়িঘর কম, ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। মাঝে মাঝে।

প্রবীর পঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমাকে আর নিয়ে যাবেন না। এবার সহজেই চিনতে পারবেন। এই যে সোজা রাস্তা–প্রথম ডান দিকে বেঁকেই সেই বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি, সামনে বাগান আছে, গেট আছে–ও রকম বাড়ি ওখানে একটাই–চিনতে কোনও ভুল হবে না। বাড়ির সামনে লেখা আছে ‘লাহিড়ী লজ’।

যোগানন্দ বলল ঠিক আছে, তুমি যাও। সাবধানে যেয়ো। তুমি আমাদের অনেক উপকার করেছ। যদি বেঁচে থাকি, ফিরে এসে নিশ্চয়ই তোমার জন্য কিছু একটা করব।

প্রবীর চলে যেতেই যোগানন্দ বলল, আমরা দু’জনে রাস্তার দু’পাশ দিয়ে যাই। বেশ অন্ধকার অন্ধকার আছে। তুই পারবি তো?

সূর্য বলল, আজ আমার শরীরটা খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে যেন অসুখই নেই। ভালো করে চিকিৎসা করাবি। তোর বোনের বাড়িতে আমিও দিন দুয়েক থেকে যাব। ভালো করে একটু খাওয়াদাওয়া করা দরকার। যা শুনলাম, তোর বোনের শ্বশুর বেশ বড়লোক বড়লোকদের পুলিশ সহজে ঘাঁটায় না। তোর আপন বোন?

না।

আমাকে থাকতে দেবে তো?

আমাকে দিলে আপনাকেও নিশ্চয়ই দেবে।

প্রবীরকে ছেড়ে দেবার পর দু মিনিটও সময় যায়নি। হঠাৎ একটা বাড়ি থেকে সাইকেলে চেপে একটা লোক বেরিয়ে এল। লোকটি সাদাচামড়া, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কিংবা ইংরেজ। খুব সম্ভব লোকটি ওদের দুজনকে দেখতে পায়নি। ওরা রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়ালেই পারত। কিন্তু যোগানন্দ মাথার ঠিক রাখতে পারল না। সে চাপা গলায় বলল, পুলিশ, দৌড়ো।

বলার সঙ্গে সঙ্গে যোগান মাঠের মধ্যে নেমে দৌড়োতে গেল এবং আচমকা আছাড় খেয়ে পড়ল সশব্দে। তাতেই দৃষ্টি আকৃষ্ট হল লোকটির। সে সাইকেল থামিয়ে মাটিতে এক পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে নিরীহ ভাবেই জিজ্ঞেস করল, হেই, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং দেয়ার?

যোগানন্দ আর একটা ভুল করল। সে উত্তর দেবার বদলে গুলি চালাল। অতি ব্যস্ততার জন্য গুলিটা যে শুধু সাহেবটার শরীরের এক হাত দূর দিয়ে চলে গেল তাই-ই নয়, রাস্তার অন্য দিকে দাঁড়ানো সূর্যর গায়েও লাগত আর একটু হলে। সূর্য তৎক্ষণাৎ হুমড়ি খেয়ে রাস্তার পাশে পড়েই গড়াতে শুরু করেছে। সূর্য ফের উঠে দাঁড়াবার আগেই যা হবার হয়ে গেল।

গুলির শব্দ শুনেই সাহেবটিও সাইকেল সমেত রাস্তার ওপরে পড়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে উঠেই দৌড়োতে শুরু করেছে, সাইকেলটা হাতে ধরা, উঠতে পারেনি। যোগানন্দ রিভলবার হাতে তাড়া করে গেল ওকে, না-মেরে ছাড়বে না! হঠাৎ সাহেবটি পেছন ফিরে যোগানন্দর ঠিক মুখের ওপর গুলি করল। একটিমাত্র গুলি, যোগানন্দ পড়ে গেল মাটিতে। সূর্য তখন উঠে বসেছে। তার রিভলবার বার করতে করতেই সাহেবটি সাইকেলে উঠে পড়েছে। সূর্যর গুলিও তার গায়ে লাগল না। সূর্যও রিভলবার হাতে রাস্তার পাশে পাশে দৌড়ে যেতে লাগল, তার পরবর্তী দুটি গুলির মধ্যে একটি লাগল সাহেবের কাঁধে–তবু সে সাইকেল থামাল না–বেরিয়ে গেল বাঁই বাঁই করে। আর কিছুক্ষণ দৌড়ে নিরাশ হয়ে থেমে গেল সূর্য। ফিরে এল যোগানন্দর কাছে।

যোগানন্দ কোনও যন্ত্রণা পায়নি। তার মস্তক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, মৃত্যু তৎক্ষণাৎ। তার ঠোঁটের ভঙ্গিতে তখনও একটা রাগী ভাব। সূর্য যোগানন্দর নাকের কাছে হাত রাখল, বুকে হাত রাখল। এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে গেল যে এখনও সে ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছে না। এ সবই যেন অর্থহীন ঘটনা। একটু আগে যোগানন্দ এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, এখন পড়ে আছে তার লাশ। সূর্য এখন কী করবে? তার থেমে থাকার উপায় নেই।

সূর্যর মাথাটা ঘুলিয়ে গেল, সে আর কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। যোগানন্দর নিশ্চিত মৃত্যু হয়ে গেছে জেনেও সে দেহটাকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল যোগানন্দদা উঠুন, শিগগির উঠুন! কোনও সাড়া না পেয়ে সে অনবরত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আর কেউ আসছে না তো! অনিচ্ছা সত্ত্বেও সূর্যর মুখ দিয়ে বার বার হেঁচকি উঠছে। তারপর সে একবার যোগানন্দর দেহটা কাঁধে তুলে নেবার চেষ্টা করল, পারল না, দু’জনেই একসঙ্গে পড়ে গেল মাটিতে। তখন সূর্যর মৃত্যুভয় জাগল। যে মৃত্যুভয় অত্যন্ত স্বার্থপর।

সূর্য উঠেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। তাকে পৌঁছোতে হবে, তাকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছোতেই হবে। শরীরের কথা তার মনে নেই। যত জোরে সে ছুটতে পারে, তার থেকেও জোরে সে ছুটছে। লাহিড়ী লজের প্রধান গেট দিয়ে না-ঢুকে, বাগানের বেড়া ডিঙিয়ে ফুলগাছ পায়ে মাড়িয়ে সে দরজার কাছে এসে গতির ঝোঁক থামাল। দুম দুম করে দরজায় ঘা দিতে লাগল তারপর। সে আর দেরি করতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *