মেদিনীপুর থেকে রাজনারায়ণ বসু এক পত্র লিখলেন তাঁর বন্ধুকে : মহাকবিরা যে কত অসম্ভব জায়গা থেকেই জন্মায়! স্বৰ্গ থেকে বেদব্যাস হঠাৎ নেমে এলে কতই না চমকিত হতেন আজ! যে-ব্যক্তির গায়ে সব সময় বীয়ারের গন্ধ, গোরু-শুয়োর-মুর্গীর মতন নিষিদ্ধ খাদ্য ছাড়া অন্য কিছু যার মুখে রোচে না, যার অঙ্গে সর্বসময় সাহেবী পোশাক, যে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষাকে এতই ভালোবাসে যে নিজের দেশের ভাষা সম্পর্কে সব সময় ঘৃণায় নিন্দামন্দ করে, সেই ব্যক্তিই কিনা হঠাৎ হয়ে গেল এক প্রথম শ্রেণীর হিন্দু কবি! সে এমনই স্বর্গীয় সৌন্দর্যময় বিষয় নিয়ে লিখলো, যে-সব বিষয় নিয়ে মুনি-ঋষিরা ইঙ্গুদি গাছের ছায়ায় বসে আলোচনা করতে করতে ধন্য হয়ে যান!
কী ব্যাপার, মধু, এই অধঃপতিত দেশের কবিতাকে জাতে তুলবার জন্য, তুই এমন প্রতিদানহীন কাজের ভার গ্রহণ করলি যে? ইংরাজীতে লিখলে, ইংরাজী পত্রের সম্পাদনা করলে তোর কত সুনাম হতো!…বোধ হয় উপরওয়ালার অভিপ্রায়ই অন্য রকম। যা হোক, এই যে কাজ তুই করলি, তার জন্য একটা পুরস্কার তুই পাবি অন্তত-অমরত্ব।
মধুসূদন উত্তর দিলেন, কী করে জানলে, ভায়া, যে রেভারেণ্ড ডক্টর বেদব্যাস গোমাংস খেতেন না আর ছিলিপ ছিলিপ করে ব্র্যাণ্ডিতে চুমুক দিতেন না? তুই জেনে রাখ, রাজ, রাশিয়ার সমস্ত রাজকীয় ধন রত্ন তুচ্ছ করেও আমি নিজের দেশের কবিতার সংস্কারের কাজে লেগে থাকবো!
মধুসূদন এখন অহংকার এবং অত্যুৎসাহে যেন ফেটে পড়ছেন। দেশের শিক্ষিত সমাজে তাঁর নামে জয়-জয়কার। যাতে হাত দিচ্ছেন, তাতেই সোনা ফলছে।
বাংলা ভাষায় অমিত্ৰাক্ষর ছন্দ হয় কি না এই নিয়ে তর্কাতর্কির পর লিখে ফেললেন, তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য। বিদ্বানপ্রবর রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর সম্পাদিত বিবিধার্থ সংগ্রহে খণ্ডে খণ্ডে তা প্ৰকাশ করলেন। সেই কাব্য পাঠ করে যেন বিদ্যুৎস্পষ্ট হলেন রসিক পঞ্চজন। বাংলা ভাষাতে এমন উচ্চাঙ্গের কাব্য সম্ভব? শব্দ সংস্থাপনের গুণে একই সঙ্গে এতে মিলে আছে গাম্ভীর্য আর মাধুর্য।
এ হেন নির্জন স্থানে দেব পুরন্দর,
কেন গো বসিয়া আজি, কহ পদ্মাসনা
বীণাপানি! কবি, দেবি, তব পদাম্বুজে
নমিয়া জিজ্ঞাসে তোমা, কহ, দয়াময়ি।
ছন্দ ও ভাব সম্পূর্ণ নতুন, অনাস্বাদিতপূর্ব। আর এ সব লিখেছে কি না হ্যাট-কোট পরা এক ট্যাঁস-ফরিঙ্গি। আদালতের দোভাষীর কণ্ঠ প্রাচীন আর্য সভ্যতার মনোরম চিত্র সংবলিত এমন মধুর সঙ্গীত!
একই সঙ্গে নাটক রচনায় হাত দিলেন মধুসূদন। অর্থের বিনিময়ে বেলগাছিয়ার রাজাদের জন্য তাঁকে রত্নাবলী নাটকের ইংরেজী অনুবাদ করে দিতে হয়েছে বটে কিন্তু পদে পদে বিতৃষ্ণায় তাঁর মন ভরে গিয়েছিল। এই নাকি নাটক! যেমন কাঁচা ভাব, তেমনই নীরস ভাষা। রাজারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নাটক অভিনয়ের আয়োজন করেছেন, অনেক ভালো নাটক তাঁদের পাওয়া উচিত।
মধুসূদন নিজেই কলম ধরলেন, শুরু হলো শৰ্মিষ্ঠা। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী বাল্যকালেই কিছু জানা ছিল, মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে প্রথম দিকে খেয়াল বশে সংস্কৃত চৰ্চা করতে গিয়ে আবার ঐ দুটি মহাকাব্য পড়া হয়ে যায় মধুসূদনের। দেবযানী-শৰ্মিষ্ঠার কলহ-কাহিনীর মধ্যে শর্মিষ্ঠাকেই বেশী পছন্দ হয়েছিল তাঁর। এই রাজনন্দিনী শৰ্মিষ্ঠাকে নিয়েই নাটক গড়ে তুলতে লাগলেন।
দু-এক পাতা লেখেন আর পড়েন মধুসূদন, সারা ঘরে ঘুরতে ঘুরতে উচ্চকণ্ঠে পঙক্তিগুলি উচ্চারণ করেন। মনের মধ্যে একটা দ্বিধা থেকে যায়। কবিতা লেখা হয় আপন খেয়ালে অথবা আবেগের বশে, কিন্তু নাটকের কিছু নিয়ম কানুন আছে। এটা ঠিক নাটক হচ্ছে তো? কারুর কাছ থেকে একটু পরামর্শ পেতে বাসনা হয়। আসলে পরামর্শ নয়, মধুসূদন চান তাৎক্ষণিক উচ্চ প্ৰশংসা। পাঠ করা মাত্রই কেউ। ধন্য ধন্য করলে তাঁর প্রতিভার স্ফূর্তি হয়। কিন্তু সে রকম কেউ নেই। সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে এই যে চির অনুরক্ত বন্ধু গৌরদাস বসাক এখন কলকাতায় নেই, চাকুরি উপলক্ষে তাঁকে যেতে হয়েছে বালেশ্বরে।
গৌরদাসের সঙ্গে চিঠিপত্রের যোগাযোগ আছে নিয়মিত। এক চিঠিতে গৌরদাস লিখলেন, সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য তুই নাটকটি একবার রামনারায়ণ তর্করত্নকে দেখালে পারিস! নাট্যকার হিসেবে ওঁর প্রভূত খ্যাতি, নাটকের রীতিনীতি ঠিক হয়েছে কিনা, উনিই বুঝবেন!
কিছুটা দ্বিধা করে তারপর মধুসূদন রাজি হলেন। কিছুটা অন্তত যাচাই না করেই সম্পূৰ্ণ নাটকটি বেলগাছিয়ার রাজাদের হস্তে দিলে তারপর সবাই যদি হাসাহাসি করে? যদি বলে, এ তো নাটক নয়, এ যে গৰ্ভস্রাব!
পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নকে ডেকে পাঠালেন মধুসূদন। তিনি এলেন না। গোমাংসভোজী ফিরিঙ্গির বাড়িতে পদার্পণ করেন না তিনি। তবু মধুসূদন লোক মারফৎ শৰ্মিষ্ঠা নাটকের পাণ্ডুলিপির কিয়দংশ পাঠিয়ে দিলেন তর্করাত্নের কাছে। সঙ্গে এক পত্র লিখে অনুরোধ জানালেন যে, মহাশয় যদি এই নাট্যরচনার ব্যাকরণগত অশুদ্ধি সংশোধন করিয়া দেন, তাহা হইলে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হইব। এজন্য যৎকিঞ্চিৎ দক্ষিণা প্ৰদানেও সম্মত রহিলাম।
পাণ্ডুলিপি-বাহক ফিরে এসে জানালো যে, সে ভুল করে কাগজের পুলিন্দাটি পণ্ডিত মহাশয়ের হাতে দিতে গেলে তিনি আৎকে উঠেছিলেন একেবারে। সেটি মাটিতে রাখার পর তিনি তার ওপর গঙ্গাজলের ছিটা দিয়ে শুদ্ধ করে নেন আগে। তারপর কয়েকটি পৃষ্ঠা উল্টে দেখে দু-চার দিবস পর মন্তব্য জানাবেন বলেছেন।
এর পর বেলগাছিয়ার রাজবাড়িতে একদিন নাটুকে রামনারায়ণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মধুসূদনের। বক্ষ একটু দুর দূর করতে লাগলো তাঁর। ইনি কী বলবেন কে জানে? নাটুকে রামনারায়ণের মন্তব্যের মূল্য আছে, অন্তত রাজাদের কাছে তো আছেই।
রামনারায়ণ শ্লেষ হাস্যে বললেন, মহাশয়, গঙ্গাজল দিয়া শুদ্ধ করেই লইলেই বা কী হয়, এখনো আপনার নাটকে যে ম্লেচ্ছ গন্ধ ভুর ভুর করে। ব্যাকরণাশুদ্ধির কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু এ রচনায় সংস্কৃত নাটকের রীতি তো কিছুই মান্য করেন নাই! নান্দী পাঠ কই, সূত্রধর কই? একেবারে বিদেশী ভাব। এ যে সাহেবের লেখা বলে প্ৰতীয়মান হয়! যদি বলেন, তো আগাগোড়া ঢেলে সাজায়ে দি।
মধুসূদন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, মহাশয়ের অত পরিশ্রম করবার প্রয়োজন নেই কো! পাণ্ডুলিপি ফিরত পেলে কৃতাৰ্থ হই!
ক্ৰোধে মধুসূদনের শরীর জ্বলে যেতে লাগলো। টিকিধারীটা বলে কি! তাঁর নাটক ঢেলে সাজাবে? অন্যের কলম ধার করে তাঁর নাটক দাঁড়াবে! কোনো প্রয়োজন নেই। উত্থান বা পতন যাই হোক, তাঁকে নিজের রচনা নিয়েই দাঁড়াবার চেষ্টা করতে হবে। বিদেশী ভাব, থাকলেই বা বিদেশী ভাব, সাহিত্য কি কখনো দেশ কালের ওপর নির্ভর করে? শেক্সপীয়রের রচনা তবে আমরা উপভোগ করি কী ভাবে? মুরের কবিতায় প্রাচ্য তত্ত্ব আছে, সেজন্য কেউ কি তাঁকে নিন্দে করে? বাইরনের কবিতায় এসিয়াটিক ভাব আছে, সেজন্য কি বাইরনকে ইংরেজদের কম ভাল লাগে? কালাইলের গদ্যে তো জামনি প্রভাব!
মধুসূদন ঠিক করলেন, তিনি নিজের সামর্থেই রাস্কেল পণ্ডিতগুলিকে হতচকিত করে দেবেন। ওদের লেখনী পর্যন্ত স্তব্ধ করিয়ে দেবেন তিনি।
শৰ্মিষ্ঠা নাটক রচনা সমাপ্ত হলে মধুসূদন সেটি পাঠিয়ে দিলেন রাজা ঈশ্বরচন্দ্ৰ সিংহের কাছে। রামনারায়ণ তর্করত্নের সঙ্গে মধুসূদনের বিসম্বাদের কথা আগেই রাজাদের কানে গেছে। তবু নাটকটির দোষগুণ বিচারের জন্য কোনো প্ৰাজ্ঞ ব্যক্তির মতামত গ্ৰহণ করা প্ৰয়োজন। বিশেষত এই নাটক মঞ্চে অভিনীত হলে দোষ ত্রুটি সকলের কানে লাগবে। তাঁদের সভাপণ্ডিত দেশবরেণ্য আলঙ্কারিক তর্কবাগীশের কাছে নাটকটি পাঠিয়ে দিয়ে অনুরোধ জানালেন যে, যে-সব স্থল আপত্তিকর কিংবা দোষজনক, সে-সব জায়গায় দাগ দিয়ে দিতে।
নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে রীতিমতন একটি সভা ডাকা হলো শর্মিষ্ঠা নাটক আলোচনার জন্য। মধুসূদন এবং প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশও উপস্থিত। তর্কবাগীশের হস্তে শৰ্মিষ্ঠার পাণ্ডুলিপি, ওষ্ঠে মৃদু মৃদু হাস্য। সে হাস্যে শ্লেষের বদলে যেন মেহের ভোবই বেশী। তর্কবাগীশ বয়েসে যথেষ্ট প্রাচীন, মধুসূদনের প্রায় দ্বিগুণ, জীবনে কখনো সেলাই করা বস্ত্ৰ পরিধান করেন না। ঠেঙো ধুতির ওপর গায়ে একটি মুগার চাদর। মধুসূদন তাঁর দিকে সরাসরি চেয়ে রইলেন, আজ আর তাঁর সংশয়ের লেশমাত্র নেই।
তর্কবাগীশ বললেন, বাপুহে, তোমার এই নাটকটি অনেকে অতি উত্তম বলবে, আবার এতে দোষেরও অবধি নেই।
রাজা ঈশ্বরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আপত্তিকর জায়গাগুলোতে দাগ দিয়েচেন?
তর্কবাগীশ ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, না, দেইনি। ভুলের সংখ্যা অসংখ্য, তাহলে পুরোটাই দাগাতে হয়, কিছুই বাকি থাকে না।
সভাপণ্ডিতের উদ্দেশে রাজা বললেন, পোনমোয়াই, আপনার কতা তো ঠিক বুজতে পাচ্চিনি, কেমন যেন প্ৰহেলিকা মনে হচ্চে। একবার বলচেন, অনেকে অতি উত্তম বলবে, আবার বলচেন, পুরোটাই ভুলে ভরা!
প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের ওষ্ঠে সেই মৃদু হাস্য লেগেই আছে। তিনি বললেন, আমি যে চোখ দিয়ে দেখছি, সে রকম চোখ এ দেশে আর গোটা দু তিন লোকের আছে। আমরা কিছুদিনের মধ্যেই ফতে হয়ে যাবো, তখন এই সব বইই চলবে, বাহবা বাহবা পড়ে যাবে!
মধুসূদন উঠে দাঁড়িয়ে সগর্বে বললেন, পণ্ডিত মহাশয়, আপনি ঠিকই বুঝেচেন, আপনাদের যুগ শেষ। আমি বাঙ্গালা কাব্য জগতে নতুন যুগ প্রবর্তন করবো। এই শৰ্মিষ্ঠা আমার দুহিতা সমা। এই নাটকটি রচনার কারণ দেকিয়ে আমি কবিতাকারে একটি প্রস্তাবনা লিকিচি। আপনাদের অনুমতি হলে সেটি এখেনে পড়ে শোনাতে পারি।
রাজা ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, অবশ্যই পড়ুন!
তর্কবাগীশ বললেন, হাঁ বাবা, পড়ো, শুনি।
মধুসূদন একটু অস্বস্তির সঙ্গে একবার এদিক ওদিক তাকালেন। তাঁর বদলে অন্য কেউ পড়ে দিলে আরও ভালো হতো। তাঁর বাংলা উচ্চারণ ভালো নয়। কণ্ঠস্বরও চমকানো। সবচেয়ে ভালো হতো, যদি অভিনেতা কেশব গাঙ্গুলী এটা পড়তেন, কিন্তু কেশববাবু এ সভাস্থলে উপস্থিত নেই। সকলে উদগ্ৰীবভাবে অপেক্ষা করছে বলে শেষ পর্যন্ত ভরসা করে মধুসূদন নিজেই পড়তে লাগলেন।
মরি হয়, কোথা সে সুখের সময়,
যে সময় দেশময় নাট্যরস সবিশেষ ছিল রসময়।
শুন গো ভারতভূমি কত নিদ্রা যাবে তুমি
আর নিদ্রা উচিত না হয়।
উঠ ত্যজ ঘুমঘোর হইল, হইল ভোর
দিনকার প্রাচীতে উদয়।
কোথায় বাল্মীকি, ব্যাস কোথা তব কালিদাস
কোথা ভবভূতি মহোদয়।
অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্ৰাণে নাহি সয়!
সুধারস অনাদরে, বিষবারি পান করে
তাহে হয় তনু, মনঃ ক্ষয়।
মধু বলে জাগো মাগো বিভু স্থানে এই মাগো
সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয়।
মধুসূদনের পাঠ সাঙ্গ হওয়া মাত্র সভাসদরা বিলেতি কায়দায় চটাপট শব্দে করতালি ধ্বনি করে উঠলো। কেউ কেউ বললো, ব্রাভো, ব্রাভো। কেউ কেউ আহ আহ শব্দ করলো।
প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ ধীরে ধীরে হেঁটে এলেন মধুসূদনের কাছে। নিজ পরিবারের কোনো অনুজের সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, বাপু, তুমি যে-টি পাঠ করলে, সেটি সঠিক কবিতা কিনা বলতে পারি না। কয়েক স্থলে মাত্রা স্বলন হয়েছে, লঘু স্বর গুরু স্বর মানোনি, তবু এ রচনা শুনে প্ৰাণে বড় আরাম হলো। নাম প্রেমচাঁদ, অন্তরে আমার প্রেস রস রয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাল্যকাল থেকেই ব্যাকরণ আর ন্যায়শাস্ত্ৰ পাঠ করে মাথা তাতেই ঠাসা, সেগুলো ভুলতে পারি না।
তারপর মধুসূদনের মস্তকে বৃদ্ধ তাঁর কম্পিত দক্ষিণ হস্ত রেখে বললেন, আশীর্বাদ করি, তুমি সার্থক হও। বঙ্গবাসীর রুচি সংস্কার কার্যে ব্ৰতী থাকো!
বেলগাছিয়া মঞ্চে মহা সমারোহে অভিনীত হলো শর্মিষ্ঠা নাটক। দর্শকরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করলো এমনটি আর কেউ কখনো দেখেনি। বাংলার লাট বাহাদুর স্যার জন পিটার গ্র্যান্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং আরও অনেক হোমড়া চোমড়া রাজপুরুষ এসেছিলেন, মধুসূদন তাঁদের জন্য শর্মিষ্ঠার ইংরেজী অনুবাদ করে রেখেছিলেন আগেই। সাহেবরাও মুগ্ধ। অনেকেই বলতে লাগলেন, বাংলায় এটিই প্ৰথম সার্থক নাটক।
কাজের নেশা পেয়ে বসেছে মধুসূদনকে। শৰ্মিষ্ঠা মহড়ার সময় পাইকপাড়ার রাজারা একদিন কথাপ্রসঙ্গে বললেন, হাস্যরসাত্মক নাটক আমাদের তেমন নেই, অথচ মঞ্চে হাসি তামাসাই জমে ভালো। মাইকেল, আপনি একখানা নাটক ট্রাই করুন না এবার!
একখানা নয়, ঝটপট পর পর দুখানা প্ৰহসন লিখে ফেললেন মধুসূদন। একেই কি বলে সভ্যতা? আর বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ। কিছুদিন আগেও পুরো একটি বাক্য বাংলায় বলতে পারতেন না যে ব্যক্তি, প্রহসনের কথ্য ভাষায় তাঁর দক্ষতা দেখে সকলে দ্বিতীয়বার স্তম্ভিত হলো। এবং এত দ্রুত নাটক রচনা করতেও আর কারুকে দেখা যায় না। এ যেন এক জাদুকর!
প্ৰহসন দুটির পরই মধুসূদন আবার লিখতে বসলেন পদ্মাবতী নাটক। এবার কাহিনীর সারাংশ নিলেন গ্ৰীক পুরাণ থেকে। তাঁর রচনায় বিদেশী প্রভাবের কথা এদেশে অনেকে কানাঘুষো করে। এবার তিনি দেখিয়ে দেবেন, সরাসরি বিদেশী কাহিনী নিয়েই স্বদেশী নাটক রচনা করা সম্ভব কিনা।
পদ্মাবতী লিখতে লিখতেই মধুসূদনের আবার মন উচাটন হলো। এ তিনি কোন পথে চলেছেন? নাটক মানেই তো গদ্য। বাল্যকাল থেকেই তিনি গদ্যের উৎপাত অপছন্দ করেন। কাব্যের সরোবরে অবগাহন করাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশী আনন্দের। নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পেতে তাঁকে কি শুধু গদ্য-নাটকই লিখে যেতে হবে!
পদ্মাবতী রচনা অর্ধপথে থেমে রইলো। তিনি আবার ফিরে যাবেন কবিতায়। তিনি এমন কাব্য রচনা করবেন যা বাংলায় কেউ কখনো চিন্তাও করেনি। কিন্তু কোন বিষয় নিয়ে লিখবেন, তা ঠিক করতে পারছেন না। কয়েকদিন এই রকম অস্থিরতায় কাটলো। আর অস্থিরতার সময় তাঁর বীয়ার পানও বেড়ে যায়।
মধুসূদনের নাট্য রচনার সাফল্যে তাঁর ছাত্র বয়েসের বন্ধুরা সবাই পুলকিত। চাকুরি উপলক্ষে অনেকে দূর দূরান্তরে ছড়িয়ে আছে, তারা চিঠি লিখে অভিনন্দন জানায়। কলকাতায় যারা থাকে, তারা অনেকে দেখা করতে আসে। মাদ্রাজ থেকে ফেরার পর পুলিস আদালতে সামান্য চাকুরি নিয়ে মধুসূদন যখন দীন অবস্থায় বৎসরের পর বৎসর কাটাচ্ছিলেন, তখন একমাত্র গৌরদাস বসাক ছাড়া বন্ধুরা কেউ আর তাঁর কুশল সংবাদ নিত না। এখন বন্ধুরা আবার ফিরে আসায় মধুসূদন অভিমান করেন না, বরং তাঁর আত্মম্ভরিতায় সুড়সুড়ি লাগে। দরাজ হস্তে আপ্যায়ন করেন। তিনি, কখনো টাকা পয়সা না থাকলে বন্ধুদের থেকে ঋণ গ্ৰহণ করে তাদেরই খাওয়ান।
রাজনারায়ণ আর গৌরদাস দুজনেই বড়দিনের ছুটি উপলক্ষে কলকাতায় এসেছেন। মধুর বাড়িতে প্ৰায় নিত্য আসেন তাঁরা। খোসা গল্পে ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়।
একদিন গৌরদাস এসে বললেন, জানিস মধু, আমাদের গঙ্গা ফিরে এয়েচে অ্যাতদিন বাদে।
মধুসূদন জিজ্ঞেস করলেন, গঙ্গা? কোন গঙ্গা?
গৌরদাস বললেন, সেই যে রে, গঙ্গানারায়ণ, আমাদের সঙ্গে পড়তো, সিংগীদের বাড়ির ছেলে, খুব লাজুক, ইনট্রোভোট টাইপের—
মধুসূদনের মনে পড়লো না। অন্তত সতেরো বছর গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি, মনে না পড়ারই কথা। তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করে রইলেন।
গৌরদাস বললেন, সে বড় অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। আমার সঙ্গে বেশী দেকা হতো না বটে কিন্তু রাজনারায়ণের সঙ্গে খানিকটা যোগাযোগ ছেল গঙ্গানারায়ণের! বছর পাঁচেক আগে জমিদারি তদারক করতে গিয়ে গঙ্গানারায়ণ উধাও হয়ে যায়, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি, সবাই ধরে নিয়েচিল যে সে মরেই গ্যাচে, তার শ্রাদ্ধশান্তিও হয়ে গেসলো। সেই গঙ্গা আবার ফিরে এয়েচে! তাজ্জব ব্যাপার!
মধুসূদন বললেন, তাজ্জব না তাজ্জব! এ যে দেকচি এক নতুন নাটকের বিষয়! একদিন নিয়ে আয় তো তাকে।
গঙ্গানারায়ণ নিদারুণ আহত অবস্থায় কৃষ্ণনগর জেলে বন্দী ছিল। সংবাদ পেয়ে নবীনকুমার কয়েকজন কর্মচারী ও উকিল সঙ্গে নিয়ে সেখানে চলে যায়। প্রচুর অর্থব্যয় ও তদারকি করে জ্যেষ্ঠ ভ্ৰাতাকে সে জামিনে মুক্ত করে। চিকিৎসায় গঙ্গানারায়ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে কিন্তু তার সারা শরীরে প্ৰহারের দাগ মিলিয়ে যায়নি। তার নামে মামলা চলছে এখনো।
কলকাতায় এসে গঙ্গানারায়ণ প্রথমেই যোগাযোগ করেছে হরিশ মুখুজ্যের সঙ্গে। গঙ্গানারায়ণের নাম ইতিমধ্যেই হরিশের কাছে পরিচিত। তাঁর মফস্বল সংবাদদাতাগণ গঙ্গানারায়ণ সম্পর্কে নানা তথ্য জানিয়েছে। নদীয়া যশোহরের চাষীদের কাছে গঙ্গানারায়ণ একজন প্রবাদ-পুরুষ। গঙ্গানারায়ণ যে পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে, তা এখনো কেউ বিশ্বাস করে না। তাদের ধারণা এখনো যেখানে যত বিষ্ণু মান জ্বলছে, তার মূল গঙ্গানারায়ণ। তার নাম করে স্থানীয় নেতারা আরও বিদ্রোহের উস্কানি দেয়।
গঙ্গানারায়ণ হরিশকে যতই বোঝাবার চেষ্টা করে যে এসবই গল্প কথা, কিছুই সত্যি নয়, হরিশ ততই হাসেন। তিনি বলেন, সত্য হোক, মিথ্যা হোক, লোকে বিশ্বাস তো করে। সেটাই তো বড় কত। আপনি নীলচাষীদের বুকে ভরসা এনে দিয়েচেন।
গঙ্গানারায়ণ বলে, কিন্তু লাঠি-বন্দুক নিয়ে নীলকর সাহেবদের সঙ্গে লড়াই করলে কি আর পার পাওয়া যাবে? আইনের সুযোগ নিয়ে দাবি আদায় করতে হবে চাষীদের।
হরিশ বলে, আইনের সুযোগ তো নিতেই হবে। তা ছাড়াও দু-চারটে নীলকর সাহেবকে যদি চাষীরা ঠ্যাঙাতে পারে তো ঠ্যাঙাক না। দু-দশটা নীলকুঠী জ্বলুক।
প্রতিদিন দলে দলে চাষী গ্রামাঞ্চল থেকে আসতে শুরু করেছে হরিশের বাড়িতে। তারা কাঁদতে কাঁদতে তাদের দুঃখ দুৰ্দশার কথা জানায়। হরিশ তাদের ধমকে বলে, ব্যাটারা কাঁদিস কেন? লড়! লড়তে পারিস না? কেঁদে কেঁদেই তো জন্ম-জন্মান্তর গেল।
কৌশল হিসেবে প্রত্যেক চাষীকে দিয়ে নীলকরদের নামে মামলা ঠুকতে লাগলেন হরিশ। তিনি নিজেই দরখাস্তের মুসাবিদা করে দেন। নিজেই ওদের হয়ে দিয়ে দেন কোর্ট ফি। এমন কি চাষীদের কলকাতায় খাওয়া থাকার ব্যয়ভারও হরিশই বহন করেন।
গঙ্গানারায়ণ হরিশের এই কাজে সাহায্য করতে প্ৰবৃত্ত হলো। প্রতিদিন সকাল থেকে সে হরিশের সঙ্গে থাকে। সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ পর অবশ্য আর হরিশকে পাওয়া যায় না, তখন তাঁর সুরাপান ও আমোদ ফুর্তি চাই। হরিশ পরিশ্রম করেন অসুরের মতন, আবার তাঁর প্রমোদও সেই রকম।
হরিশ অবশ্য পইপই করে বলে দিয়েছেন, গঙ্গানারায়ণ যেন কোনোক্রমেই শহরে আসা চাষীদের কাছে আত্মপরিচয় না দেয়। গঙ্গানারায়ণের নামে মফস্বলে যে মীথ চলছে, তা চলুক।
একদিন গঙ্গানারায়ণকে মধুসূদনের বাড়িতে নিয়ে এলেন গৌরদাস। চেহারা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে গঙ্গানারায়ণের, এখন তার পোশাক অতি সাধারণ, একটি ধুতি ও উত্তরীয় ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করে না গঙ্গানারায়ণ, তবু তাকে দেখে মুহূর্তের মধ্যে চিনতে পারলেন মধুসূদন। বাল্যবন্ধুরা কখনো কি বদলায়!
গঙ্গানারায়ণকে আলিঙ্গন করে মধুসূদন বললেন, বাই জোভা, এ যে আমাদের সে গোবেচারা গঙ্গা, আমাদের হিন্দু কলেজের সাইলেন্ট ফিলজফার!
এতদিন পর মধুসূদনকে দেখে গঙ্গানারায়ণের চক্ষে জল এসে গেল। তার মনের অভ্যন্তরে মধুর জন্য সব সময়ই একটি বিশিষ্ট স্থান ছিল।
মধুসূদন বললেন, গঙ্গা, আমিও অনেকটা তোরই মতন, প্রডিগ্যাল সান হয়ে কলকেতায় ফিরেচিলুম! তুই ছিলিস জমিদারের সন্তান, এখুন যে সাধুসন্ন্যোসীর মতন দেকাচে তোকে।
কিছুক্ষণ আবেগ বিনিময়ের পর ওরা শান্ত হয়ে বসলো। সেলিব্রেট করার জন্য এক বোতল শ্যাম্পেন খুলে ফেললেন মধুসূদন। গঙ্গানারায়ণ কোনোদিনও ওসব স্পর্শ করে না। আজ রাজনারায়ণ উপস্থিত, তিনিও সুরাপান পরিত্যাগ করেছেন।
রাজনারায়ণ বললেন, তুই জানিস, মধু, গঙ্গানারায়ণ বনে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে দল গড়েছেল। বন্দুক নিয়ে নীলকরদের সঙ্গে লড়েচে। সে এক রোমহর্ষক ব্যাপার! ভাবাই যায় না, আমাদের সেই গঙ্গা, এত বড় হীরো।
গঙ্গানারায়ণ লজ্জা পেয়ে বললো, না, না, সেরকম কিচু নয়। তবে ভাই নীলচাষীদের দুর্দশা আমি নিজের চক্ষে দেকিচি। গ্রামে গ্রামে যে কী তাণ্ডব চলচে তা তোমরা ভাবতে পার্বে না!
মধুসূদন উৎসাহিত হয়ে বললেন, শুনি তো তোর এক্সপিরিয়েন্স, বেশ একটু গুচিয়ে বিশদ করে বল।
রাজনারায়ণ বললেন, কিচু কিচু আমাদেরও কানে আসে। হরিশ মুকুজ্যের কাগচেও পড়চি—
গঙ্গানারায়ণ বললো, হরিশ মুখুজ্যে চাষীদের জন্য মস্ত কাজ কচ্চেন। তিনি নমস্য।
মধুসূদন বললেন, শুনিচি লোকটা আমারই দরের একজন ড্রাঙ্কার্ড। তা মাতাল হলেও যে নমস্য হয়, সে কতা তোরা স্বীকার পেলি তো?
গৌরদাস বললেন, আহা, গঙ্গানারায়ণের অভিজ্ঞতাগুলোই শোনা যাক না—
কথাবার্তা কিছুক্ষণ চলাবার পর সেখানে উপস্থিত হলো একজন আগন্তুক। গল্পের মাঝখানে অচেনা লোক এসে পড়ায় ওরা বিরক্তই হলো একটু। মধুসূদন জিজ্ঞাসু চোখে লোকটির দিকে তাকালেন। লোকটি বয়েসে ওদের চেয়ে ছোট, বৎসর তিরিশেকের হবে, সরকারী আমলার মতন পরিচ্ছদ। সে মধুসূদনের দিকে চেয়ে বললো, আপনিই বোধ করি মাইকেল? দেকেই চিনিচি! আপনাদের আসরে কি আমি একটু আসন গ্ৰহণ কক্তে পারি?
মধুসূদন বললেন, আমরা এক বিশেষ আলোচনায় এনগেজড আছি। আপনার আগমনের উদ্দেশটা বলবেন কী?
লোকটি বললো, শুধু আপনার দর্শন লাভ। কয়েক মাস ধরেই আপনাকে দেকবার বাসনা আমার মনে বলবতী হয়েচে। অবশ্য আর একটা নিবেদনও আচে। আপনি সাম্প্রতিক বঙ্গের বিশিষ্ট কবি। নাট্যকার হিসেবেও আপনার শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত, শৰ্মিষ্ঠা নাটক বড়ই অপূর্ব, মনোহর! বেছে বেছে আপনার মতন এক খ্ৰীষ্টধর্মীয়ের লেখনীতেই স্বয়ং মা সরস্বতী ভর করেচেন, এ বড় বিস্ময়ের কথা। আপনাকে দেকে চক্ষু সার্থক কত্তে এসেচি। আপনি আমার শ্রদ্ধার অভিবাদন লউন।
প্রশংসা শুনলে একটুও অস্বস্তি বোধ করেন না মধুসূদন। এ সব কিছুই যেন তাঁর প্রাপ্য। এইভাবে কথাগুলি শুনলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, মহাশয়ের কী করা হয়? মহাশয়ের নাম?
লোকটি বললো, আমি সরকারের ডাক বিভাগে কর্ম করি। অধমের নাম শ্ৰীদীনবন্ধু মিত্র।