মেছুয়াবাজার থেকে ব্যান্ড পার্টি ভাড়া করে এনেছেন শশিভূষণ। বাড়ির সামনের লোহার গেট ফুলমালা দিয়ে সাজানো। ভেতরে সুরকি ঢালা পথের দু পাশে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে জনাদশেক কর্মচারী। সমস্ত বাড়িটি ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করা হয়েছে। সবাই প্রস্তুত।
জুড়িগাড়িটি দ্বারেব সামনে এসে থামতেই বেজে উঠল কেটল ড্রাম ও ভেঁপু। “হি ইজ আ জলি গুড ফেলো’ গানটির সুর। শশিভূষণ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে দু হাত যুক্ত করে বললেন, স্বাগতম, মহারাজ, স্বাগতম।
গাড়ি থেকে প্রথমে নামলেন মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য, তাঁর পোশাক কিন্তু রাজোচিত নয়। ধুতির ওপর ফতুয়া, তার ওপর একটি মুগার চাদর জড়ানো। নগ্ন মস্তক। সাজপোশাকের ব্যাপারে মহারাজ নিয়মকানুন মানেন না। তাঁর মুখমণ্ডলে দীর্ঘ পথযাত্রার ক্লান্তি। তিনি বাড়িটি এবং সংলগ্ন উদ্যানের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দুবার মাথা নাড়লেন। তারপর গাড়ির মধ্যে হাত বাড়িয়ে বললেন, আয়! মহারাজের হাত ধরে এবারে নামল পাটরানী মনোমোহিনী, সোনার জরি বসানো অতিশয় দামি শাড়ি পরা, মুখ ঘোমটার একেবারে ঢাকা। ভেতরের পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলেন দুজনে, কর্মচারীরা উচ্চকণ্ঠে প্ৰণাম জানাতে লাগল, ইংরেজি বাজনা বাজতেই লাগল।
অন্য একটি ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলেন হারাজের সচিব রাধারমণ ঘোষ এবং কুমার সমরেন্দ্ৰচন্দ্ৰ।
বাড়ির ভেতরে একটি বসবার ঘরে কয়েকটি তাকিয়া মখমলের চাদর দিয়ে ঢাকা। সস্ত্রীক মহারাজ সেই ঘরে প্রবেশ করার পর শশিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, মহারাজ, এখুনি কি নিজের মহলে যাবেন, না এখানে একটু বসে বিশ্রাম করবেন?
মনোমোহিনী মুখের ঘোমটা একেবারে সরিয়ে ফেলে বলল, আমি জল খাব, আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে।
সেই ঘরেই জলের পাত্র, কয়েকটি রুপোর গেলাস ও কিছু মিষ্টান্ন রাখা আছে। একজন ভৃত্য ট্রে-তে করে সেসব নিয়ে এল কাছে। মনোমোহিনী ঢক ঢক করে জল খেয়ে ফেলল দু গেলাস।
মহারাজ বা হাতখানা বাড়িয়ে রইলেন পাশে। তাঁর দিকে জলের গেলাস এগিয়ে দেওয়া হতে তিনি মাথা নাড়লেন। তিনি জলপান করতে চান না। তিনি শশিভূষণের দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বললেন, কই? মহারাজ যে কী চাইছেন, তা বুঝতে পারলেন না। শশিভূষণ। তিনি বিব্রত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। মহারাজ মুচকি হেসে বললেন, মাস্টার, তোমার ব্যবস্থাপনা তো বেশ ভালোই দেখছি। কিন্তু একটু ক্ৰটি হয়ে গেছে যে!
এই সময় ঘোষমশাই ঘরে এসে বললেন, কই হে শশী, হুঁকোবরাদর রাখোনি? মহারাজ অনেকক্ষণ তামাক খাননি! এইবার শশিভূষণ তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। মহারাজ যে তামাক ছাড়া বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না, সে কথাটা তাঁর মনেই ছিল না। তৎক্ষণাৎ তামাকের ব্যবস্থার জন্য ছোটাছুটি পড়ে গেল।
মনোমোহিনী উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলা, আমার ঘর কোনটা?
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় রাজরানীসুলভ ব্রীড়া ত্যাগ করে সে তরতর করে উঠতে লাগল, মাটিতে গড়াতে লাগল তার আঁচল। এখনও সে প্রমাণ আকারের শাড়ি সামলাতে পারে না। শুধু নিজের মহল নয়, সারা বাড়িটাই ঘুরে দেখল সে। আবার নীচের ঘরে এসে বলল, ঘোড়া কোথায়? বাগানে তো ঘোড়া নেই!
শশিভূষণ মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ কয়েকটি ঘোড়া দেখা হয়েছে, মহারাজ। আপনি আগে পছন্দ করবেন, তাই এখনও কেনা হয়নি।
মহারাজ বললেন, বেশ। আপাতত দু একদিনের মধ্যে প্রয়োজনও নেই। দিন দু-এক আমি বিশ্রাম নেব। তবিয়ত বিশেষ ভালো নেই হে!
একটুক্ষণ তামাক টানার পর তিনি ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে থমকে গেলেন। তাঁর মুখ কুঁচকে গেল।
ঘোষমশাই জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, মহারাজ!
মহারাজ জোরে জোরে দুবার নিশ্বাস টেনে বললেন, হঠাৎ হঠাৎ পেটে একটা ব্যথা হয়। ওখানকার ডাক্তার-বদ্যিরা তো কিছুই করতে পারল না। এখানে ভালো ডাক্তার জোগাড় করো।
শশিভূষণ বললেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করবেন। মহারাজ বললেন, সেটা আবার কী বস্তু? শুনিনি কখনও।
শশিভূষণ বললেন, আজ্ঞে, নতুন ধরনের চিকিৎসা। খুব ভালো কাজ হয়। তা হলে আমি ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে ডাকতে পারি। সবাই বলে, তিনি ধন্বন্তরি।
ঘোষমশাই বললেন, হ্যাঁ, মহেন্দ্রলাল সরকারকেই ডেকে আনাে, উনি তো অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি দুটোই জানেন!
মহারাজ বীরচন্দ্র বললেন, আর ঠাকুরবাড়ির সেই ছোকরা কবিটি, কী নাম যেন, হ্যাঁ, রবীন্দ্রবাবু, তুমি যার খুব সুখ্যাতি কর, তাকে একবার খবর দিও, যদি আসে। ডাক্তারের ওষুধে যদি কাজ না হয়, ওর কাব্যপাঠ শুনে হয়তো রোগ সারতে পারে!
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে মহারাজের যে বেশ কষ্ট হচ্ছে তা বোঝা গেলেও তিনি রসিকতা করতে লাগলেন নানারকম।
এ বাড়ির দুটি মহল পৃথক করা, দোতলার একটি ঝুলন্ত বারান্দায় সংযোগ। সেই বারান্দার প্রান্তে এসে অন্যরা থেমে গেল, অন্দরমহলে কর্মচারিরা কেউ যাবে না। পুরুষ ভৃত্যও কেউ নেই। সেখানে, রয়েছে তিনটি দাসী।
মহারাজ শশিভূষণকে বললেন, আমার পেটের ব্যথা শুনে যেন আমাকে কাঁচকলা-সিঙ্গি মাছের ঝোল খাইয়ো না। রুগীর খাদ্য আমার পেটে সয় না। কলকাতায় এসেছি, ইলিশ মাছ খাব না, তা কি হয়? বাগবাজারের ঘাট থেকে ইলিশ আনিও। আর নবীন ময়রার রসগোল্লা।
কুমার সমরেন্দ্র এবং রাধারমণ ঘোষের ঘর বার মহলে। শশিভূষণ তাদের আলাদা আলাদা ঘর দেখিয়ে দিলেন। রাধারমণের তখুনি বিশ্রাম নেবার কোনও ইচ্ছে নেই। তিনি এসে বসলেন শশিভূষণের ঘরে।
নিজের বাড়ি থেকে শশিভূষণ তাঁর পালঙ্ক ও কিছু আসবাব আনিয়েছেন। তাঁর ঘরটি বেশ বড়, পাশে একটি প্রশস্ত বারান্দা, সেখানে বসার ব্যবস্থা আছে। রাধারমণ একটা বেতের চেয়ারে বসে বললেন, ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় আসার যা ধকল, তাতে অনেকখানি আয়ু খরচ হয়ে যায়। এইজন্যই আমি আসতে চাই না। তুমি মহারাজকে নাচিয়েছ, তাই আসতেই হল। তা শশী, এতবড় বাড়ি ভাড়া নিয়েছ, গুচ্ছের কর্মচারি রেখেছ, এর তো খরচ কম নয়! এই খরচ জোগাবে কে?
শশিভূষণ হাসি মুখে বললেন, আপনি জোগাবেন!
রাধারমণ বললেন, রাজকোষ তো ঢনঢন, টাকা জোগাড় করতে করতে আমার প্রাণ বেরিয়ে যায়। ইংরেজরা ব্যবসা করার নামে ত্রিপুরায় ঢুকতে চাইছে. টাকার লোক দেখায়, তাদেরও সামলাতে হয়। মহারাজেরও ইচ্ছে, ইংরেজদের বিভিন্ন পাহাড় ইজারা দেওয়া হোক, আমি কিন্তু ইংরেজদের হুড়হুড় করে ঢুকে পড়তে দিতে চাই না, এজন্য মন্ত্রীমশাই তো আমার ওপর অসন্তুষ্ট। কিন্তু জান তো, ব্যবসার জন্য হোক আর যে জন্যই হোক, যেখানে ইংরেজ, সেখানেই রাজনীতি! ত্রিপুরার মুকুটটির ওপরেই ওদের নজর।
শশিভূষণ গম্ভীরভাবে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। ইংরেজদের প্রশ্রয় দেবেন না। এদের নাম-নীতি বলে নেই।
রাধারমণ বললেন, তুমি খুব ইংরেজবিরোধী জানি। কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, ইংরেজ রাজত্বে বসবাস করবে না বলেই তুমি ত্রিপুরায় চলে গিয়েছিলে। তাহলে আবার কলকাতায় ফিরে এলে কেন?
– ইংরেজ রাজত্বে তো আসিনি! স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের প্রতিনিধি হয়ে এখানে আছি। মনে করুন, এটা একটা দূতাবাস।
– বল কী হে! তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তো কম নয়! দূতাবাস না ছাই! আমি যা বুঝেছি, ইংরেজ সরকার আস্তে আস্তে আমাদের মহারাজকে ওদের হাতের একটা পুতুল বানাবে। তা রোধ করার সাধ্য আমাদের নেই। থাকা ওসব কথা। আমার জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি ছিলে মাস্টার, এখন স্বেচ্ছায় হয়ে গেলে মহারাজের কলকাতার আস্তানার গোমস্তা। এ কাজ তোমার পছন্দ হল কেন?
– ঘোষমশাই, এটা শুধু মহারাজের আস্তানা নয়। আমি দেখেছি, কলকাতার মানুষ অনেকেই ত্রিপুরা সম্পর্কে কিছু জানে না। আমি ত্রিপুরাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি ঠিক করেছি, এখানে মাঝে মাঝে ছোটখাটো উৎসবের ব্যবস্থা করব। ত্রিপুরার শিল্প, সেখানকার নাচ-গান, হাতের কাজ এখানকার মানুষ দেখবে, ত্রিপুরা সম্পর্কে জানবে।
– সেই সব উৎসবের খরচ জোগাবে কে?
– আপনার খালি টাকার চিন্তা! এমন কিছু খরচ লাগবে না।
– চিনি জোগাবেন চিন্তামণি, অ্যাঁ? তোমার এখানে চায়ের ব্যবস্থা আছে? একটু চা খাওয়াবে নাকি?
শশিভূষণ হাঁক দিয়ে চায়ের কথা বলে দিলেন। তারপর দুটি চুরুট এনে একটি এগিয়ে দিলেন রাধারমণের দিকে। রাধারমণ বললেন, ধূমপান আমি ছেড়ে দিয়েছি। চাকরিটাও এখন ছাড়তে ইচ্ছে হয়। ভাবছি নবদ্বীপে গিয়ে থাকব। শশিভূষণ বললেন, সেখানে গিয়ে বোষ্টম হয়ে মালা জপ করবেন। সে আপনার দ্বারা হবে না! মহারাজেরও আপনাকে ছাড়া চলবে না।
রাধারমণ বললেন, চুরুট দেখে মনে পড়ল কৈলাস সিংহীর কথা। তার সঙ্গে দেখাটেখা হয়? সে তো শুনেছি আদি ব্ৰাহ্মসমাজে গিয়ে জুটেছে, দেবেন ঠাকুরের আশ্রয়ে আছে।
শশিভূষণ বললেন, না, দেখা হয় না। তাঁর লেখাটেখা দেখি।
— তাকে যেন হুট করে এখানে আসতে দিও না। তাকে দেখলেই মহারাজের মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।
— না, না, তিনি এখানে আসবেন কেন?
— কবি রবিবাবুকে যদি এখানে ডাকো, তা হলে তাঁর লেজুড় হয়ে কৈলাস চলে আসতে পারে। মহারাজকে খুঁচিয়ে সে আনন্দ পায়।
ভূমিসূতা এই সময় দুটি কাপে চা নিয়ে এল। নীল ডুরে শাড়ি পরা, ঘোমটায় অনেকখানি ঢাকা মুখ, তাকে সাধারণ পরিচারিকাই মনে হবে, কিন্তু তার দু পায়ে আলতার রেখা, চলার সময় তার পায়ের লাল ঝিলিক চোখে পড়ে।
চায়ের কাপ দুটি ওঁদের সামনে রেখে ফিরে যেতে যেতেও সে দরজার কাছে থেমে গেল, আঁচল দিয়ে সে একটি আলমারির কাচের কাল্পনিক ধুলো মুছতে লাগল, কেননা সে হঠাৎ ভরতের নাম শুনতে পেয়েছে।
রাধারমণ জিজ্ঞেস করলেন, আর সেই ছেলেটির কী খবর? পড়াশুনো করছে সে, না গোল্লায় গেছে?
শশিভূষণ বললেন, ভরত? সে এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে, ভালো ছাত্র। লেখাপড়ার দিকে তার বরাবরের ঝোঁক।
রাধারমণ ভূমিসূতার আলতা মাখা পায়ের দিকে চেয়ে রইলেন। শশিভূষণও অনুভব করলেন, তাদের কথার সময় ঘরের মধ্যে অন্য কারুর উপস্থিতি অবাঞ্ছিত। তিনি বললেন, ও মেয়ে, তুমি পরে এসে কাপ দুটি নিয়ে যেও। এখন যাও।
ভূমিসূতা দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
শশিভূষণ বললেন, আমি এমন ব্যবস্থা করেছি, যাতে মহারাজের ত্রিসীমানাতেও ভরত কখনও আসবে না। আমার সঙ্গে তার কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগও নেই।
রাধারমণ বললেন, একে সামান্য কাছুয়ার ছেলে, তায় হারিয়ে যাওয়াটা অতি তুচ্ছ ব্যাপার। কারুর মনে রাখার কথা নয়। কিন্তু এখনও তার প্রসঙ্গ ওঠে, সেটাই ছেলেটার দুর্ভাগ্য। আমি খোঁজখবর জেনেছি, ছেলেটি কোনও দোষ করেনি। আমাদের ছোটরানীর সঙ্গে তার কোনও নিবিড় যোগাযোগ ছিল না। বিয়ের আগে মনোমোহিনী বালিকাসুলভ চাপল্যে ভরতের সঙ্গে কৌতুক করত, তাকে ভয় দেখাত। অতি নিরীহ ব্যাপার। কিন্তু কেউ একজন মহারাজের কানে তুলেছিল যে ওই ভরত মনোমোহিনীকে বিয়ে করতে চায়। তাতেই চটে উঠে মহারাজ বলেছিলেন, ওকে সরিয়ে দাও। এ কথার মানে কী হয়, তা তো জানোই। মহারাজের ধারণা, ওর মুণ্ডু কেটে জঙ্গলে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই কানভারি করা লোকটি ভরতকে আরও নির্মম শাস্তি দিতে গিয়েই গোলমাল পাকিয়েছে। সে যাই হোক, মুশকিল হয়েছে কী, মনোমোহিনী তো কিছুই জানে না। সে মাঝে মাঝে সরল কৌতূহলে জিজ্ঞেস করে, ভরত কোথায়। তাকে দেখি না কেন? আর ওই নাম শুনলেই মহারাজ তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন।
শশিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, সেই লোকটি কে? তার নাম জানতে পারেননি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাধারমণ বললেন, তাও জেনেছি। জানলেও তাকে শান্তি দেবার কোনও উপায় নেই। শশিভূষণ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, আমাকে বলুন তার নাম। আমি নিজে তাকে শান্তি দেব। রাধারমণ বুকে শশিভূষণের কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, শান্ত হও, বৎস, শান্ত হও। রাজনীতিতে ওরকম দু একটা মুণ্ডু গড়াগড়ি যায়ই মাঝে মাঝে। যদি কখনও সময় আসে, সে ব্যক্তিটিরও মুণ্ডু মাটিতে গড়াবে!
বিকেলবেলায় শশিভূষণ গেলেন মহেন্দ্রলাল সরকারের চেম্বারে। অনেক রোগী অপেক্ষায় বসে আছে, কিন্তু ডাক্তারবাবু অনুপস্থিত। ডাক্তার হিসেবে মহেন্দ্রলালের এখন দারুণ চাহিদা, কিন্তু তিনি এখন মেতে আছেন বিজ্ঞান নিয়ে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান পরিষদে এখন নিয়মিত বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়। দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা এসে সেখানে বক্তৃতা দেন, শুনতে আসে অনেকে, মহেন্দ্রলাল নিজে সব সময় সেখানে উপস্থিত থাকেন। এদিকে রোগীরা ফিরে যায়।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শশিভূষণের একটা ভয়ের কথা মনে পড়ল। মহেন্দ্রলাল সরকার মেজাজী মানুষ, টাকা পয়সার দিকে ঝোঁক নেই, রাজামহারাজার কথা শুনেও হয়তো অবজ্ঞায় ঠোঁট ওল্টাবেন। এদিকে মহারাজ বীরচন্দ্রের কাছে শশিভূষণ এই ডাক্তারের নাম বলে ফেলেছেন, এখন ইনি যদি যেতে না চান, তাহলে মহারাজ নিশ্চিত রুষ্ট হবেন। যে ভাবেই হোক, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে রাজি করাতেই হবে।
মহেন্দ্রলাল এলেন প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে, শশিভূষণ প্রথমে কোনও কথাই বললেন না। একে একে অন্য রোগীরা বিদায় নিতে লাগল। সব শেষে শশিভূষণ মহেন্দ্রলালের ঘরে ঢুকে বললেন, নমস্কার, কেমন আছেন?
শশিভূষণের ধারণা ছিল মহেন্দ্রলাল তাঁকে চিনতে পারবেন। এক সময় তিনি নিয়মিত আসতেন, মহেন্দ্রলালের সঙ্গে তাঁর বেশ হৃদ্যতা জন্মেছিল। কিন্তু মহেন্দ্রলাল নমস্কারের উত্তর না দিয়ে বললেন, আমার হাতে বেশি সময় নেই। ধানাই পানাই না করে রোগের লক্ষণগুলি শুধু বলুন।
শশিভূষণ বললেন, আজ্ঞে, নিজের চিকিৎসা করাতে আসিনি। আমার নাম শশিভূষণ সিংহ, আপনার কাছে এসেছি একটি বিশেষ প্রয়োজনে।
মহেন্দ্রলাল এবার সরাসরি তাকিয়ে বললেন, শশিভূষণ, ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ত্রিপুরা, ত্রিপুরা, তোমার তো মাথার ব্যামো হয়েছিল, তাই না? আবার কিছু গোলমাল শুরু হয়েছে নাকি?
শশিভূষণ বললেন, আজ্ঞে না। আপনার চিকিৎসায় খুবই ভালো আছি। আর কোনওদিন কোনও উপসর্গ দেখা দেয়নি। মহেন্দ্রলাল বললেন, বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই? শুধু ওষুধে তো এত ভালো ফল হয় না।
শশিভূষণ বললেন, আজ্ঞে না, এখনও করে উঠতে পারিনি। মহেন্দ্রলাল বললেন, অত। আর আপনি-আজ্ঞে করতে হবে না বসো। তুমি হঠাৎ এসে হাজির হলে, এ তো ভারি মজার ব্যাপার। দুতিনদিন আগেই আমি তোমার কথা ভাবছিলাম। তুমি নাটুকে গিরিশ ঘোষকে চোন?
শশিভূষণ বললেন, তাঁর মতন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম কে না শুনেছে। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় নেই।
মহেন্দ্রলাল বললেন, গিরিশ আমাকে একটা বড় আশ্চর্যর কথা শুনিয়েছে। তোমার সঙ্গে অদ্ভুত মিল। সাড়ে সাতটার সময় গিরিশের এখানে আসার কথা আছে। এক্ষনি এসে পড়বে, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তুমি জানো কি না জানি না, এক সময়ই এই গিরিশ ছিল মহা নাস্তিক। বেন্থাম, মিল, কান্ট পড়েছে, যুক্তি দিয়ে বিচার করতে চাইত সব কিছু। এখন সে খুব কালী ভক্ত হয়েছে, প্রায়ই মা-মা করে। এর কারণ কী জন। একবার সে খুব কঠিন রোগে পড়েছিল। রোগের জ্বালা বড় জ্বালা, অনেকেরই মনের জোর কমে যায়। অনেক ওষুধ খেয়েও কোনও ফল হয়নি, তাই গিরিশ তারকেশ্বরের মন্দিরে হত্যে দিতে গিয়েছিল।
শশিভূষণ বললেন, এতখানি পরিবর্তন।
মহেন্দ্রলাল বললেন, হয়, হয়, মানুষের হয়। আসল কথাটা শোনো। তারকেশ্বরে গিয়ে কিছু লাভ হয়নি। তারপর হঠাৎ একদিন স্বপ্নে সে তার মাকে দেখতে পেল। গিরিশ অবশ্য বলে, সেটা স্বপ্ন নয়। সে সত্যি মাকে দেখেছে, তার কথা শুনেছে, তার স্পর্শ পেয়েছে। মা এসে যে ওষুধের কথা বলে দিলেন, তাতেই তার রোগ সেরে গেল! ঠিক তোমার মতন ব্যাপার না?
শশিভূষণ দুবার মাথা ঝোঁকালেন।
মহেন্দ্রলাল বললেন, তা হলে কি ধরে নিতে হবে, মরা মানুষ মাঝে মাঝে ফিরে আসে? কোনও কোনও মা ছেলের কাছে এসে অসুখের ওষুধ বাতলে দেন। মরার পর মায়েরা সবাই ডাক্তার হয়ে যান? অ্যাঁ? কী বল হে?
শশিভূষণ মৃদু গলায় বললেন, না, তা হতে পারে না। মরা মানুষ ফেরে না। পরে আমি বুঝেছি, ওটা ছিল আমার স্বপ্ন। অসুস্থ অবস্থায় স্বপ্নটা খুব তীব্ৰ মনে হয়েছিল।
মহেন্দ্রলাল বললেন, অটো সাজেসশান! তখন আমি তোমার ভুল ভাঙাইনি। তুমি অসহায় অবস্থায় পড়ে নিজেই মাতৃমূর্তি তৈরি করেছিলো।
তারপর হঠাৎ হা-হা করে হেসে উঠে মহেন্দ্রলাল বললেন, কিন্তু মায়েরা বারবার আসে না। তা হলে আমাদের মতন ডাক্তারদের ভাত মারা যেত। গিরিশ আবার অসুখ বাধিয়েছে, এখন মায়ের বদলে সে এই ডাক্তারের কাছেই আসে!
একটু পরেই প্রসেনিয়ামের পাশ থেকে মঞ্চে নায়কের প্রবেশের মতন দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে মধ্যে ঢুকে পড়লেন গিরিশচন্দ্ৰ। চক্ষু লাল, টলটলায়মান শরীর, মুখ দিয়ে ভুর ভুর করে বেরুচ্ছে গন্ধ। উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ওহে ডাক্তার, কী এলেবেলে ওষুধ দাও, অ্যাঁ? রোগ সারে না। পরশু আবার পেট ব্যথায় অজ্ঞান হবার মতন অবস্থা।
মহেন্দ্রলাল বললেন, তুমি বোতল বোতল মদ ওড়াবে, আমার ছোট ছোট হোমিওপ্যাথিক গুলির সাধ্য নেই তোমার রোগ সারাবার। কতবার তো তোমাকে বলছি!
গিরিশ বললেন, একটু না খেলে যে ব্যথা কমে না। যখন ওষুধে কাজ হয় না, তখন একটু খেলে কষ্ট দূর হয়।
মহেন্দ্রলাল বললেন, একটু! তা হলে বেশি কাকে বলে? মদ খেলে তোমার ব্যথা সাময়িকভাবে কমলেও রোগটা বাড়বে। গিরিশ বলল, তুমি মদ মন্দ করছি কেন? আমি সুরা পান করি না, সুধা খাই জয় কালী বলে! মা, মা! মহেন্দ্রলাল বললেন, চারদিকে তো দেখছি কালীর নামে লোকে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের গরল পান করছে, আর তুমি বলছি সুধা! হেঃ!
গিরিশ টেবিলে এক চাপড় মেরে বললেন, তোমার অত কথায় দরকার কী হে | ডাক্তারকে ফিস দেব, ডাক্তার ওষুধ দেবে, ব্যাস! মহেন্দ্রলাল ধমকে বললেন, আমাকে তেমন ডাক্তার পাওনি। আমাকে হাজার টাকা ফিস দিলেও আমি সব রুগী দেখি না! গিরিশ এবার ফুরফুর করে হাসতে লাগলেন। দুষ্টু ছেলের মতন দু দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, দেবে না, আমাকে ওষুধ দেবে না, ডাক্তার!
মহেন্দ্রলাল বললেন, দেব! তোমাকে দুটি শর্ত মানতে হবে। তোমার মদের অভ্যেস আমি ছাড়াতে পারব না। কিন্তু আমার ওষুধ যে-কদিন খাবে, সেই কদিন অন্তত বোতলে হাত ছোঁয়াতে পারবে না। আর প্রতিদিন সকালে তোমার বাড়ি থেকে গঙ্গা পর্যন্ত হেঁটে যাবে, গোটাকতক ডুব দেবে।
গিরিশ বলল, বেশ। ডুব দেবার সময় যদি মন্ত্র পড়ি, তাতে তোমার আপত্তি নেই তো! তুমি তো আবার মন্ত্র-টন্ত্র কিছুই মানো না।
মহেন্দ্রলাল বললেন, তা তুমি যা খুশি মন্ত্র পড় কিংবা শেকসপিয়ার আবৃত্তি কর, তাতে কিছু আসে যায় না। তোমার কিছু ব্যায়াম করা দরকার। তোমার নতুন প্লে-টা তো খুব জমেছে শুনছি। কবে যাব?
গিরিশ বললেন, এই শনিবারেই এসো। বক্স রিজার্ভ করে রেখে দেব।
মহেন্দ্রলাল এবার শশিভূষণের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এও আমার সঙ্গে যাবে। একে দেখে রেখো। এই
শশিভূষণ তোমার স্বপ্নতুতো ভাই!