৪২. মানুষ আর মানুষ নেই

খবরটা এরকম, ‘অন্তঃসঙ্গে্বা স্ত্রী ভাত বেড়ে দিয়েছিল। খেতে বসে স্বামী দেখলো, ভাতে একটা চুল। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো স্বামী আকের শেখ। স্ত্রী জ্যোৎস্নাবিবিকে চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিল।’ মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে ঘটেছে ঘটনাটা। শুনে আমার কিছু চেনা লোক বললো, ‘মুসলমানরা মানুষ না। এরাই পারে এসব জঘন্য কাজ করতে।’ তাকে আমি আর তাপসী মালিকের ঘটনা স্মরণ না করিয়ে বরং সেদিনেরই আরেকটা খবর বললাম, ‘প্রেমিকা সুমনা বসু কথা শোনেনি, তাই তার গলায় ক্ষুর চালিয়েছে প্রেমিক অভিষেক চৌধুরী।’ চেনা সেই লোকদের আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ‘হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নয় এগুলো। এগুলো লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাপার। নারীকে পুরুষের দাসী এবং যৌনবস্তু ভাবার যে মানসিকতা, সেই মানসিকতার ব্যাপার। সব ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই নারীকে অপদস্থ করা, অবহেলা করা, এবং অপমান করার সবরকম পরিবেশ আছে।’

চেনা লোকগুলো চলে গেল। আমার কথার তারা কতটুকু বুঝলো কী বুঝলো জানি না। যদি বাসটিতে ওরা থাকতো, আমার বিশ্বাস, ওরাও আর সবার মতোই আচরণ করতো, নীরবে দেখতো সব, কিছু বলতো না। সেই বাসটির কথা বলছি, যে বাসে একটি মেয়েকে যৌন হেনস্থা করছিল দুটো ছেলে, দেখেও বাসের কেউই প্রতিবাদ করেনি, শুধু জগন্নাথ আর শুভেন্দু নামের দুজন প্রতিবাদ করতে এগিয়ে এলে দুটো ছেলের সঙ্গে বাসের চারটে ছেলে যোগ দিয়ে জগন্নাথদের বীভৎস ভাবে মারছিল। মার যখন খাচ্ছে, বাসের সবাই চুপ করে বসে ছিল। প্রতিবাদ করেনি। এমনকী তখনও প্রতিবাদ করেনি যখন চোখের সামনে দেখলো যে ছটি ছেলেকে বাস থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া হল এবং ভালো করেই বুঝলো যে নামিয়ে দিলে খারাপ ছেলেগুলো ভালোগুলোকে আরও নির্বিঘ্নে মারতে পারবে, এমনকী প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে।

যৌন হেনস্থাকে এই ভারতীয় উপমহাদেশেই ‘ইভ টিজিং’ বলা হয়। সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বা যৌন হেনস্থার মতো ভয়াবহ কুৎসিত জিনিসকে ‘ইভ টিজিং’ আখ্যা দিয়ে একে রোমান্টিসাইজ করার পেছনের কারণটি কি এর ভয়াবহতা কায়দা করে কমিয়ে দেওয়া নয়? রোমান্টিক জুটি আদম-ইভএর ইভকে তুলে এনে তার সঙ্গে টিজ বা খুনসুটি করাকে খুব মন্দ কিছু মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই, বরং শুনলে যে কারও মনে হবে দারুন রোমান্টিক। রোমান্টিক বলেই তো ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকার পেছনে লাগা, শিস দেওয়া, চোখ টেপা, বিরক্ত করা পুরুষগুলোকে রীতিমত হিরো হিসেবে দেখানো হয়, এবং নায়িকার সঙ্গে দিব্যি তাদের প্রেমও হয়ে যায় আর অচিরে দুজন হাত পা ছুড়ে নাচতে শুরু করে আর কোটি কোটি ভারতীয় দর্শকের হৃদয়ে অনাবিল শান্তির বর্ষণ শুরু হয়। এই ভারতবর্ষে যৌন হেনস্থা কী কারণে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে, শুনি? যে ছেলেরা যৌন হেনস্থা করছে, তারা তো একে ‘স্বাভাবিক’ জেনেই করছে, বাসভর্তি লোকেরা যখন প্রতিবাদ করে না, বরং দুচারজন এগিয়ে আসে যৌন হেনস্থাকারীর পাশে, তখন তো আরও তারা নিশ্চিত হয় যে, কাজটা তারা ভালো বই মন্দ করছে না। মুখ বুজে বসে থাকা যে একধরনের সমর্থন, তা যেমন হেনস্থাকারীরা জানে, তেমন মুখ বোজাগুলোও জানে।

ভদ্রলোকেরা বেশ অবাক বনছেন, বাসের কেউ কেন প্রতিবাদ করেনি! আমার বিশ্বাস প্রতিবাদ ওই বাসের পুরুষেরা করেনি, কারণ ছেলে দুটো ওই একলা মেয়েটিকে যখন হেনস্থা করছিল, ওরা খুব উপভোগ করছিল। উপভোগ করছিল বলে প্রতিবাদ করা হয়ে ওঠেনি। আর যে নারীরা প্রতিবাদ করেনি, তারা, খুব স্বাভাবিক যে নিজেরা হেনস্থা হওয়ার ভয়ে করেনি। এবং তারা হেনস্থা হলে বাসের ভেতর থেকে যে কোনও প্রতিবাদ হবে না, এ অনুমান করতে নিশ্চয়ই তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি।

হেনস্থার প্রতিবাদ যে করে, সে নির্বিবাদে মার খায়। তার মার খাওয়ার বিরুদ্ধেও কেউ কিছু বলে না। ‘সাহস হয় না’ তা আমি মানি না। দেশের লোক নানা কাজে ‘সাহস’ দেখাচ্ছে। দেদারসে দুর্নীতি করছে, সাহস হচ্ছে না? সোনাগাছিতে লাইন দিচ্ছে? সাহস না থাকলে দিতে পারে? পরস্ত্রীর ওপর মারের ভয় না করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সাহস নেই কে বলে? বাচ্চা মেয়েকে ফুসলিয়ে যৌন নির্যাতন করতে যে সাহসের দরকার হয়, সেটি তো আছে। আইনের চোখে অপরাধ জেনেও এই যে গৃহনিগ্রহ, নারী পাচার, গণধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, যৌন হেনস্থা দিনের পর দিন করে যাচ্ছে পুরুষেরা, তা কি সাহস ছাড়া আপনাতেই হয়ে যাচ্ছে নাকি? এই পশ্চিমবঙ্গে নারীনিগ্রহের হার অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। আর বাসে বসা প্রতিবাদ না করা লোকগুলোকে কী কারণে ভাবা হচ্ছে যে তারা বউ পেটায় না, যৌন নির্যাতন করে না, নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত নেই এবং যৌন হেনস্থাকে তারা অপরাধ বলে মনে করে? আমার তো বিশ্বাস তারা ওই দুটো ছেলের সঙ্গে তো মনে মনে যোগ দিয়েছেই, বাসের অপরিসর জায়গায় সংঘবদ্ধ যৌন হেনস্থা সম্ভব হয়নি বলে বরং মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে, এবং স্থান সংকুলান হলে হেনস্থা তো সাধ মিটিয়ে করতে পারতোই, আর, গণধর্ষণের আয়োজন হলে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করতে একেক জন হয়তো মরিয়াও হয়ে উঠতো।

‘সাহস নেই, ভীরু, ভীতু’, ইত্যাদি গালি দিয়ে বদমায়েশিকে আড়াল করা হয়। এইসব গালি অনেকটা মায়ের মুখের মধুমাখা আদরের মতো। ‘উফ আমার ছেলেটা কী যে ভীতু, ঘরে একা ঘুমোতে পারে না। আমার মেয়েটার তো সাহস বলতে কিছু নেই, রাস্তায় কিছুতেই একা বেরোতে চায় না।’ বা বন্ধুর সস্নেহ শাসনের মতো, ‘আবে স্লা, মালটা নিজে এসে ধরা দিল, আর তুই কি না টাচ অব্দি করলি না, ভীরু মাইরি।’ এইসব বিশেষণ মধুর বিশেষণ। সুতরাং মুখ বুজে থাকা বাসের লোকদের এত আদুরে বকুনি যারা দিচ্ছে, তাদেরই বরং মুখ বুজে থাকা উচিত। বোঝা উচিত যে এটা মর‌্যালএর প্রশ্ন। এই মর‌্যালটাই সমাজের বেশির ভাগ মানুষের নেই, যে, পুরুষকে পুরুষ হওয়ার কারণে লাঙ্গিত করা যেমন অন্যায়, মেয়েদেরও মেয়ে হওয়ার কারণে লাঙ্গিত করা একই রকম অন্যায়। মানুষ জানেই না যে স্বাধীনতা যেমন পুরুষের জন্মগত অধিকার, স্বাধীনতা মেয়েদেরও তেমন জন্মগত অধিকার। মেয়েরা অসম্পূর্ণ নয়, সম্পূর্ণ মানুষ, এবং মানুষ হিসেবে যতটুকু শ্রদ্ধা পাওয়া উচিত, সবটুকুই তাদের প্রাপ্য। ফুর্তি করার উজ্ঞেশে মেয়েদের দিকে যৌনগন্ধময় শব্দ বা বাক্য ছুড়ে দেওয়ার, তাদের নিয়ে মজা করার, তাদের অপমান করার কোনও অধিকার কোনও বানচোত পুরুষের নেই।

এখন শিকারটিকে শিকার করার চেষ্টা হচ্ছে। শিকার বাস ফসকে পালিয়ে গেছে। চোঙ বাজিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘শিকার তুমি যেখানেই থাকো, বেরিয়ে এসো। পুলিশের কাছে দুষ্টুরা কী কী করেছে সব বলো। শিকার তুমি না দেখা দিলে, তোমার চাঁদমুখ সাধ মিটিয়ে দেখতে না পেলে বঙ্গবাসীর প্রাণ জুড়োবে না। তুমি দেখা না দিলে অন্য শিকাররাও দেখা দিতে শিখবে না গো। সভ্যতার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’

শিকার চোঙের শব্দ শুনছে না। বংশীবাদকের বংশীর সুর শিকারের কর্ণকুহরে পৌঁছোচ্ছে না। শিকার হাতে পেতে খোঁজ খোঁজ রব চাঙ্গিকে। আদালতে দাঁড়িয়ে জলজ্যান্ত মেয়ে নিজের মুখে নিজের হেনস্থার পুংখানুপুংখ বর্ণনা দেবে, ভেবেই অনেকে উজ্ঞেজিত। মেয়েটি যেন দয়া করে একবারটি তার ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া সেলেব্রিটি ফেসটি জনগণকে দেখায়।

কিন্তু মেয়ে কেন এসব আহ্বানে ভুলবে? যথেষ্ট কি হয়নি তার নিজেকে দেখানো সেদিন? সেদিন যখন বাসে বসে সে কাঁদছিল! তার কান্না, তার যন্ত্রণা, তার হাহাকার, তার অসহায়তা কারও কি বাকি ছিল দেখার? কেন সে নিজেকে, নিজের চেহারাকে দেখাবে বাইরে? বাসের বাইরের মানুষ কি বাসের ভেতরের মানুষের চেয়ে ভিন্ন কিছু? কে গ্যারেন্টি দেবে যে বাসের বাইরের মানুষ তাকে একইভাবে হেনস্থা করবে না? ওই ভ্রাম্যমান গণআদালতটি তো মেয়েটির দেখা হয়ে গেছে, যেখানে জুরিরা শুধু নীরব দর্শক হয়ে বসেছিলেন। তার কি আর কোনও আদালত দেখার দরকার আছে?

ভদ্রলোকেরা বলাবলি করছেন যে এই মেয়েটিও ঠিক সেই মেয়েটির মতো পালিয়ে গেল, যাকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশ সার্জেন্ট বাপি সেনকে খুন হতে হয়েছিল। অনেকে মেয়েদের দোষ দিয়ে বলছে যে মেয়েরা নাকি পালিয়ে বাঁচার শিক্ষা পেয়েছে। আসলে, এই মেয়েরা শিক্ষা পেয়েছে যে, যৌন হেনস্থার শিকার হলে এবং তা প্রকাশ করলে তাকে আরও বেশি যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়। হেনস্থাকারী পুরুষের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করলে আরও বেশি হেনস্থার আশংকা থাকে। শিখেছে মামলা করলে ঝামেলা নিজেরই হয়, অন্যের নয়। সত্যি বলতে, হেনস্থাকারীর সত্যিকারের কোনও শাস্তি হয় না। শিখেছে বাঁচানোর কথা যারা বলে, তারা আসলে বাঁচায় না। তারাই করুণার ঘায়ে সপাং সপাং করে মেরে জীবন রক্তাক্ত করে। যতই নিরাপত্তার কথা বলা হোক, মেয়েদের নিরাপত্তা কোথাও নেই। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কোথাও কোনও মেয়েরই একবিন্দু নিরাপত্তা নেই।

মেয়েরা খুব ভালো করেই জানে যে, একবার যদি লোকে জেনে যায় বাসের মেয়েটি কোন মেয়ে ছিল, সকলে হামলে পড়ে তাকে দেখবে। ধরা না পড়া অপরাধীরাও দ্বিতীয়বার তাদের যৌনবস্তুটিকে দেখে নেবে। পাড়ার যৌন হেনস্থাকারীরা তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে, ‘ওই যে দেখ, ইভ টিজিংএর শিকার যায়।’ চেনা অচেনা প্রত্যেকে মুখে অথবা মনে মনে বলবে, বলবেই, ‘বাসে বা রাস্তায় তো আরও মেয়ে ছিল, ওসব মেয়েদের পেছনে তো ছেলেরা লাগলো না, ওর পেছনে লাগলো কেন? নিশ্চয়ই ওর দোষ ছিল কোনও!’

মেয়েটি হেনস্থা হওয়ার হেনস্থা থেকে বাঁচতে চায় বলে মুখ দেখাচ্ছে না। হেনস্থাকারীর দিকে জগন্নাথ আর শুভেন্দুর অমন মারমুখো এগিয়ে যাওয়ার বোকামো নিয়ে নিশ্চয়ই সে আফশোস করছে। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে যে এভাবেই ঘরে বাইরে, বাসে, ট্রেনে, অটোয়, মাঠে ঘাটে হাটে অপমান সয়ে বাকি জীবন পার করতে হবে তা সে জানে। কেবল ‘অপমানিত হয়েছি’ এ কথা রাষ্ট্র করে নিজেকে দ্বিতীয়বার অপমান করার সুযোগটি সে দিতে চায় না। ডবল ট্রিপল অপমান থেকে নিজেদের বাঁচানোটাই মেয়েদের অত্যন্ত যুক্তিবুদ্ধি খাটিয়ে নিজেদের বাঁচানো।

এত যে সাহসী বলা হয় আমাকে, এই আমিও যদি ওই মেয়েটির জায়গায় হতাম, এই অশিক্ষিত নারীবিদ্বেষী সমাজের লোককে আমিও জানাতাম না, যে, বাসের মেয়েটি আমি ছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *