৪২. মা

৪২
হাবিবুল আলমদের দিলু রোডের বাসাতেই জুয়েল আহত হওয়ার পরের কটা দিন ছিল ৷ ভালোই ছিল ৷ হাবিবুল আলমের বাবা হাফিজুল আলম ইঞ্জিনিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যেন মিলেমিশে গেছেন ৷ তিনি নিজেও তাঁর হেরাল্ড ট্রাম্প গাড়িতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেওয়া করেছেন ৷ বাড়ির মেয়েরা-আসমা, রেশমা, শাহনাজ-এরাও একেকজন অস্ত্র-এঙ্পার্টে পরিণত হয়েছে ৷ রেশমা আর শাহনাজ অস্ত্রের ব্যারেল পরিষ্কার করা, ম্যাগাজিনে গুলি ভরার কাজ এমনভাবে করে যে মনে হয় এটাই তাদের প্রধান কাজ ৷ শাহনাজ আবার শুধু ডান হাত দিয়েই অস্ত্র পরিষ্কার করার কাজটা করে ৷ শাচৌ ব্যাপারটা লক্ষ করেন ৷ আসলে শাহনাজ যখন ছোট, তখন কেমন করে যেন ওর বাঁ হাতে চোট লাগে ৷ ডাক্তাররা ঠিকভাবে হাতটা জোড়া লাগাতে পারেননি বলে ওর বাঁ হাতের সব কটা আঙুল কাজ করে না ৷ জুয়েল যখন তার জখম হওয়া ডান হাত নিয়ে ওই বাসায় যায়, তখন শাহনাজ বলে, ‘জুয়েল ভাই, কী আর হবে, সবচেয়ে খারাপ হবে যদি আপনি আমার মতো একহাতি হয়ে যান ৷ কিন্তু আমার দিকে দেখেন, আমি তো সব কাজই ঠিকমতো করছি ৷’ তবে আসমা এ কথা শুনে একটু মন খারাপ করেছিল ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আসমা ৷ আলমের বন্ধুরা, ছোট-বড় সবাই, তাকে ডাকে মেজপা বলে ৷ কারণ সে আলমের মেজপা ৷ সেপ্টেম্বরে যখন আসমা সীমান্ত অতিক্রম করে চলে গিয়ে সেক্টর-টুর ফিল্ড হাসপাতালে যোগ দেবে, তখনও বড়-ছোট সব সৈনিক ও যোদ্ধারা তাকে ডাকবে মেজপা বলে ৷ সে-ই জুয়েলের হাত নিয়মিত ড্রেসিং করে দেয় ৷
জুয়েলের ভালো নাম আবদুল হালিম চৌধুরী ৷ তার বাবা আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী অ্যাকাউনটেন্ট পদে চাকরি করেন একটা বেসরকারি প্রাইভেট ফার্মে ৷ জুয়েলরা চার বোন আর তিন ভাই ৷ এর মধ্যে বড় ভাই মারা গেছে ছোটবেলাতেই ৷ জুয়েলই এখন বড় ৷ ‘৬৯ সালে সে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেছে ৷ এখন চাকরি করে সাত্তার গ্লাস ওয়ার্কে এনালিস্ট কেমিস্ট হিসেবে ৷ ইচ্ছা আছে, দেশ স্বাধীন হলে সে এই বিষয়ে ট্রেনিং নিতে বিদেশে যাবে ৷ তবে তার আসল পরিচয় সে ক্রিকেটার ৷ আজাদ বয়েজে খেলেছে ৷ মোহামেডানে খেলেছে ৷ আজাদ বয়েজ থেকে মোহামেডানে যাওয়ার পেছনেও কারণ ছিল ৷ ১৯৬৭ সালে লন্ডন থেকে এমসিসি দল ঢাকায় খেলতে এলে যে টিম তাদের সঙ্গে খেলতে নেমেছিল, তাতে জুয়েলকে নেওয়া হয়নি ৷ নির্বাচকমণ্ডলীর এই সিদ্ধান্তের পেছনে আজাদ বয়েজের কর্মকর্তাদের হাত আছে ভেবে রাগ করে জুয়েল মোহামেডানে যায় ৷
নিউজিল্যান্ড টিমের বিরুদ্ধে খেলার জন্যে অল পাকিস্তান দলের ক্যাম্পেও সে ডাক পেয়েছিল ৷ চূড়ান্ত টিমে অবশ্য তার জায়গা হয় নাই ৷ সে ট্রেনিং নিতে আগরতলা বর্ডার অতিক্রম করতে বাসা ছাড়ে ৩১শে মে ৷ বাসার কাউকে কিছু বলে যায়নি ৷
জুয়েলের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল শহীদ ক্রিকেটার মুশতাকের লাশ দর্শন ৷
২৭শে মার্চ সৈয়দ আশরাফুল হক আর জুয়েল গিয়েছিল ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সামনে মুশতাকের মরদেহ দেখতে ৷ মুশতাকের মরামুখটা জুয়েলের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ৷ একটা মানুষ একটু আগেও ছিল মানুষ, তার কত আশা, কত স্বপ্ন, কত সার্থকতা, এই মুখটাই তো ক্রিকেট খেলত, জয়-পরাজয় নিয়ে কত হিসাব-নিকাশ, কত অধ্যবসায়, আর দ্যাখো এখন সে শুয়ে আছে সবকিছুর অন্য পারে ৷ জুয়েল নীরবে শুধু মাথা নাড়ছিল, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নিচের ঠোঁট ৷ তখনই সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, একটা কিছু করতে হবে, শুধু শুধু বিনা প্রতিরোধে লাশের কাফেলায় শুয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না ৷
ফার্মগেট অপারেশনের পরে বাসার চার বোনের জন্যে জুয়েলের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয় ৷ এ কারণে তাদেরকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে ৷ এখন অবশ্য সে ঝাড়া হাত-পা ৷ মাঝখানে ঝামেলা হলো নিজের ডান হাতের আঙুল জখম হওয়ায় ৷ তার প্রধান চিন্তা, সে কি আর ক্রিকেট খেলতে পারবে ? তবে মুখে সে এই কথা কাউকে বলে না ৷ নিজেও হাসিমুখ করে থাকে ৷ সঙ্গীদেরও হাসায় ৷
ড্রেসিং করার সময় জুয়েল যেন ব্যথা টের না পায়, সেজন্য আসমা জুয়েলের সঙ্গে নানা গল্প করে ৷ এর মধ্যে একটা হলো ক্রিকেট ৷ জুয়েল ঢাকা শহরের ব্যাটিংয়ে তুফান বলে খ্যাত ৷ সে ব্যাট করে ঝড়ের গতিতে ৷ যতক্ষণ সে উইকেটে থাকে, ততক্ষণ রানের চাকা ঘোরে ৷ শুধু ঘোরে না, বনবন করে ঘোরে ৷
আসমা জিজ্ঞেস করে, ‘জুয়েল, রকিবুল হাসান তো অল পাকিস্তান টিমে চান্স পেয়েছে ৷ তুমি পাবে না ?’
জুয়েল কিন্তু স্বভাবে জন্মরসিক ৷ ‘আরে, আমারে এইবার নিউজিল্যান্ডের এগেইনস্টে নিল না বইলাই তো আমি অল পাকিস্তানই ভাইঙ্গা দিতেছি ৷ দেশটা স্বাধীন হইলে আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম বানাব ৷ এইটাতে আমি ঠিকই চান্স পাব, দেইখেন মেজপা ৷’
আসমা বলে, ‘তা তো পাবেই ৷ পাকিস্তান টিমেও চান্স পেতে ৷’
জুয়েল বলে, ‘আরে আবার পাকিস্তান ৷ পাকিস্তানকে বোল্ড কইরা দিতেছি ৷ মিডল স্টাম্প আউট ৷ উফ্ ৷ ব্যথা লাগে তো ৷’
আসমা পুরনো তুলাটা সরিয়ে একটা পরিষ্কার তুলা নেয় ৷ জুয়েলের ক্ষতস্থান মুছে দেয় ডেটল-ভেজা তুলা দিয়ে ৷ জুয়েলকে বলে, ‘তোমার বাসা না টিকাটুলিতে ৷ বেঙ্গল স্টুডিওর পাশে ৷ নায়িকাদের দেখ না!’
জুয়েল বলে, ‘গেটের সামনে পাবলিকে ভিড় কইরা থাকে ৷ একদিন দেখি আজিম-সুজাতা ঢুকতেছে ৷’
জুয়েল আজিম-সুজাতার ঢোকার দৃশ্যটা মনে করতে না করতেই আসমার ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হয়ে আসে ৷
তো জুয়েল দিলু রোডে ভালোই ছিল ৷ কিন্তু ওখানে একা একা আটকে থাকাটা কতক্ষণ সম্ভব ? একটু সিগারেট খাওয়া, একটু কার্ড খেলা-এসব করতে ইচ্ছা করে কিনা! আজাদদের বাসা এদিক থেকে উত্তম ৷
২৯শে আগস্ট ১৯৭১ ৷
দুপুরবেলা ইব্রাহিম সাবের আসে আজাদদের বাসায় ৷ আজাদের মায়ের রান্না দুপুরে খাওয়াটা তার কাছে একটা দারুণ আনন্দের ব্যাপার বলে মনে হয় ৷
আজাদদের বাসায় যাতায়াতের রাস্তায় একটা দোকান ৷ তাতে তিনজন যুবক বসে ৷ তারা মাথা বের করে দেখছে কে যায় আজাদদের বাসায় ৷ মনে হয় যেন ফলো করছে ৷ সাবেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের একজন বলে, ‘ভৈরব ব্রিজটা পাহারা দিতেছে পাকিস্তানি আর্মিরা, ওই আর্মিগো অ্যাটাক করতে হইলে আমি সাহায্য করতে পারি ৷’ শুনে ইব্রাহিম সাবেরের সন্দেহ হয়, এরা আর্মির ইনফরমার নয় তো ৷ আজাদদের বাসায় ঢুকে সাবের প্রথমেই আজাদকে বলে, ‘দোস্তো, আজকের রাতটা তোরা এখানে থাকিস না ৷’
আজাদ বলে, ‘কেন ?’
‘দোকানে দেখলাম…’
‘আরে না ৷ চোরের মন তো, তাই সবাইকে পুলিশ পুলিশ লাগে ৷’ আজাদ হেসেই উড়িয়ে দেয় কথাটা ৷ দুপুরের খাওয়াটা ভালোই হয় সাবেরের ৷ খেয়েদেয়ে সে বেলাবেলি ফিরে যায় নিজের বাসায় ৷
জুয়েলের সঙ্গে আর দেখা হয় না সাবেরের ৷ জুয়েল আবার আজকের দুপুরবেলাটা কাটাচ্ছে সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসায় ৷
বিকালবেলা আজাদদের বাসায় কাজী কামাল, বাকি, হ্যারিস, হিউবার্ট রোজারিও-সবাই একসঙ্গে এসেছে ৷ বাকি অনেকক্ষণ ছিল, রাত ৮টার দিকে চলে গেছে ৷ হ্যারিস অবশ্য চলে গেছে খানিকক্ষণ পরই ৷ রোজারিও ইদানীং প্রায়ই রাতে থাকে আজাদদের বাসায় ৷ কিন্তু আজকে রাতে সে থাকবে না ৷ তার মাকে দেখতে নাকি যেতেই হবে ৷ সেও রওনা হয়ে গেছে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ৷ বিকালেই জায়েদ একবার ঢোকে আজাদের ঘরে, আড্ডার মধ্যে রসভঙ্গ করে বলে, ‘দাদা, কামরুজ্জামানরে চিনো না ৷ ওই বেটা তো আর্মির দালাল ৷ আজকা কিন্তু খানিক আগে ওই বেটা আইসা বাসার সামনে থাইকা ঘুইরা গেছে ৷ আমার কেমুন সন্দেহ হয় ৷ আইজকা রাইতে এই বাসায় থাকাটা নিরাপদ না ৷’
‘আরে রাখ তো ৷ কামরুজ্জামান ৷ কামরুজ্জামানরে কামান বানায়া দেব ৷ কত কামরুজ্জামান আসল গেল ৷ ওই এমনি ঘোরে ৷ ইস্কাটনের বাসায় তো কাজ করে ৷’ আজাদ পাত্তাই দেয় না জায়েদের কথায় ৷
‘আরে না ৷ ওই বেটা আর্মির ইনফরমার ৷ সবাই জানে’-জায়েদ ঘাড় গোজ করে বলে ৷
‘তরে কইছে সবাই জানে ৷ আজাইরা কথা বলিস না তো ভাগ ৷’ আজাদ তাকে হাত নেড়ে কেটে পড়ার সংকেত দেয় ৷ জায়েদ বেরিয়ে যায় ৷
জুয়েল চলে আসে আশরাফুল হকদের বাসা থেকে ৷ আশরাফুল তাকে নিষেধ করে, ‘যাস না ৷ থাইকা যা ৷’
জুয়েল বলে, ‘আজাদগো বাসায় রাইতে কার্ড খেলা যাইব ৷ আর তা ছাড়া আম্মা আমারে না দেখলে চিন্তা করব ৷’
জুয়েল আর টগর আবার চাচাতো ভাই ৷ টগররা যেহেতু সাফিয়া বেগমকে আম্মা বলে ডাকে, জুয়েলও তাই ডাকে তাঁকে ৷
জুয়েল গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে বলে, ‘বদি থাকলে থাকন যাইত এইহানেই ৷’
আশরাফুল বলে, ‘হ, বদি ভাইয়ের ব্যাপারটা বুঝলাম না ৷ দুই দিন ধইরা গায়েব ৷ কই না কই আছে ৷’
‘যাই রে ৷’ জুয়েল বেরিয়ে যায় ৷
আশরাফুলদের ইস্কাটনের বাসা থেকে আজাদদের মগবাজারের বাসা খুবই কাছে ৷ গলি দিয়ে গলি দিয়েই সহজে জুয়েল পৌঁছে যায় সেখানে ৷
ওই সময় আড্ডা জমে ওঠে খুব আজাদদের বাসায় ৷
আজাদ বলে, ‘কাজী, শাহাদত ভাই মেলাঘরে গেছে না ?’
কাজী কামাল বলে, ‘গেছে ৷ আলমও সাথে গেছে ৷’
‘মেজর খালেদ মোশাররফ আর ক্যাপ্টেন হায়দার যখন জিজ্ঞেস করবে, সিদ্ধিরগঞ্জে কী করলা, কী জবাব দেবে!’ আজাদ ফোঁড়ন কাটে ৷
‘আছে, জবাব আছে ৷ সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের ব্যাপারে একটা প্লান করা হইছে ৷ ওই স্টেশনের দুই কর্মচারী ইব্রাহিম আর শামসুল হককে ট্রেনিং দেওয়া হইতেছে ৷ ট্রেনিং চলতেছে ধানমন্ডি ২ নম্বরের একটা আর্ট গ্যালারিতে ৷ চিনছ তো বাসাটা ৷ ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদ যেইখানে বসে ৷ ট্রেনিং চলতেছে ৷ এই ধরো টাইম পেন্সিল ব্যবহার করা ৷ পি.কে. ফিট করা ৷ এইসব ৷ ওই গ্যালারিতে তো এখন কেউ যায় না ৷ কেউ বুঝব না’-কাজী কামাল জবাব দেয় ৷
জুয়েল বলে, ‘ওই দুইজনকে তো তোরা খরচের খাতায় ধইরা রাখছস ৷ যদি পাওয়ার স্টেশন উড়ে তাইলেও অগো পাকিস্তানি আর্মি ছাড়ব না ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘অরাও জাইনা-শুইনাই আইছে ৷ সাহস আছে ৷ তবে অগো ঢাকার কোনো হাইডআউট, কোনো গেরিলার নাম-ঠিকানা জানানো হয় নাই ৷ খালি আলম, শাচৌ এই রকম একজন-দুইজনের নাম জানে ৷ কওয়া যায় না, সাবধানের মাইর নাই ৷’
আজাদ বলে, ‘তাইলে তো তোর মুখরক্ষা ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘ক্যান ৷ ঢাকা শহরটা যে কাঁপায়া দিলাম, মাউড়াগুলানের যে হাঁটুকাঁপা রোগ শুরু হইছে, তার কী হইব ৷ এইটার একটা এপ্রিসিয়েশন দিব না!’
তা অবশ্য দেওয়াই উচিত ৷ ঢাকার চারটা পাওয়ার স্টেশনের দুটো উড়ে গেছে ৷ আলমের দল পিজির পাশে এলিফ্যান্ট রোডের স্টেশন ওড়াতে গিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে পড়ে গিয়ে লড়াই করে বেরিয়ে এসেছে ৷ পাওয়ার স্টেশন ওড়ানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও খালেদ মোশাররফ সবচেয়ে খুশি হন এটার জন্যেই ৷ কারণ পৃথিবীর বহু কাগজে বাংলাদেশ খবর হয়ে আসে : ঢাকায় গেরিলারা স্ট্রিট ফাইটে নেমে পড়েছে ৷ এ ছাড়া স্ট্রিট ফাইট হয়েছে গ্রিন রোডে, উড়ে গেছে ফার্মগেটের আর্মিক্যাম্প ৷ আজিজের দল গ্রিন রোডে উড়িয়ে দিয়েছে আর্মিবহর ৷ ঢাকার ছেলেরা এখন তুচ্ছ মনে করছে সবকিছুকে ৷ ঢাকাবাসীর মনোবল ফিরে এসেছে ৷ ভয়টা এখন পাকিস্তানি আর্মির ৷ এসব খবর তো খালেদ মোশাররফের অজানা নয় ৷
এখন রাত ৮টার পরে জমে উঠেছে তাস খেলা ৷ আজাদ, জুয়েল, কাজী কামাল আর সেকেন্দার ৷ জয়েন সেক্রেটারির ছেলে সেকেন্দার এসেছিল টিভি দেখতে ৷ তাসের টানে সে বসে পড়েছে ৷
মর্নিং নিউজের রিপোর্টার বাশার আসে রাত ৯টার পরে ৷ এসেই এই ঘরে উঁকি দেয় ৷ ‘কী ভাই, কেমন চলছে ৷’
জুয়েল বলে, ‘বাশার, তোমাদের মর্নিং নিউজ ফিউজ হইয়া গেছে ৷ বাল্বটা বদলাও ৷’
বাশার শার্ট খুলতে খুলতে বলে, ‘বুঝলাম না ৷’
জুয়েল বলে, ‘তোমরা তো রাজাকারেরও অধম হইয়া গেছ ৷ এত মিথ্যা কথা লেখো কেমনে!’
বাশার বলে, ‘পিছন দিয়া বন্দুকের নলা ঢুকায়া দিলে মুখ দিয়া আপনি যা চাইবেন তা-ই বাইর করতে পারবেন ৷’
জুয়েল বলে, ‘মর্নিং নিউজরে একটু নাইট নিউজ বানাইয়া দিতে হইব ৷ দুইটা পাইন অ্যাপেল গড়ায়া দিলেই তো বোঝা যাইব পেন ইজ মাইটার দ্যান সোর্ড, উইকার দ্যান গান ৷’
‘পাইন অ্যাপেল মানে কী ? বাশার কও তো!’ আজাদ বলে ৷
‘আনারস যে না এটা বুঝি’-বাশার উত্তর দেয় ৷
‘হ্যান্ড গ্রেনেডের নিকনেম-আজাদ জানিয়ে দেয় ৷’
কাজী কামাল কোনো কথা বলছে না ৷ সে একমনে তার হাতে পাওয়া তাসগুলো পর্যবেক্ষণ করে ক্রমানুসারে সাজিয়ে নিচ্ছে ৷
জুয়েলের ডান হাতে ব্যান্ডেজ ৷ অন্য হাত দিয়েই সে চমৎকার তাস বাটতে পারে, ধরতে পারে ৷
আজাদ বলে, ‘তুই তো জুয়েল একটা জিনিয়াস ৷ ওয়ান্ডারফুল বয় ৷ এক হাতে কেমন করে শাফল করছিস!’
জুয়েল বলে, ‘আরে আমি তো ভাবতেছি এক হাতে ব্যাট চালাব ৷’
তখন ঘরে নীরবতা নেমে আসে ৷ এত ভালো একটা ক্রিকেটারের তিনটা আঙুল মোটামুটি থেঁতলে গেছে ৷ সে কি আর এ জীবনে ক্রিকেট খেলতে পারবে!
জায়েদ আসে ঘরে ৷ সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরে ঢোকা মুশকিল ৷ বলে, ‘দাদা, ওঠেন ৷ খেলায় বিরতি দ্যান ৷ আম্মা ভাত নিয়া বইসা আছে ৷’
আজাদ বলে, ‘আরেক দান ৷ এই, তোরা খেয়েছিস ?’
জায়েদ বলে, ‘খাইছি ৷’
আজাদ বলে, ‘টগর, চঞ্চল, কচি, মহুয়া, টিসু-সবাই খেয়েছে ?’
‘হ ৷’
‘মনোয়ার দুলাভাই খেয়েছে ?’
‘জি খাইছে ৷’
তারা আরেক দানের নাম করে তিন-দান খেলে ফেলে ৷ তখন ও-র থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে, ‘আজাদ, খাবি না তোরা ?’
আজাদ বলে, ‘মা ডাকছে ৷ এইবার উঠতেই হয় ৷ এই ওঠো ৷’
খাবার টেবিলটা ছোট ৷ একসঙ্গে ছয়জনের বেশি বসা যায় না ৷ বড় টেবিল যে ফেলা হবে, তার জায়গাই বা কোথায়! বাসাটাই তো ছোট ৷ আগে, ইস্কাটনের বাসায় তাদের ডাইনিং টেবিলে একসঙ্গে ১০ জন বসতে পারত ৷ সেসব দিনের জন্যে সাফিয়া বেগমের মনে কি একটা ছোট্ট গোপন আফসোস রয়ে গেছে ? সাফিয়া বেগম তা স্বীকার করবেন না ৷ যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর আজাদও আর টাকা-পয়সা দিতে পারছে না ৷ গয়না বিক্রি করতে হচ্ছে ৷ এখন ঘরের আত্মীয়স্বজন বাদ দিয়েও বাসায় রোজই আজাদের বন্ধুবান্ধব ভিড় করে থাকে ৷ তারা খায়দায় ৷ গাদাগাদি করে এখানেই শোয় ৷ আজাদের মায়ের এটাই ভালো লাগে ৷ লোকজন খাওয়ানোটা তাঁর প্রিয় একটা শখ ৷ আর নিজের ছেলের বন্ধুবান্ধবদের তদারকি করতে পারা, আদর-যত্ন করতে পারাটায় এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায় ৷ কলজের মধ্যে এক ধরনের আরাম লাগে ৷
গতকাল যেমন তিনি মালিবাগ থেকে দাওয়াত করে এনেছেন তার বোন মাবিয়ার মেয়ে দুলু, মেয়ের জামাই মনোয়ার হোসেনকে ৷ তাদের ছোট্ট মেয়ে লীনাটা কেমন ঘুরছে সবার কোলে কোলে ৷ এত রাত হলো, মেয়েটার চোখে ঘুম নাই ৷ রাতের বেলা জন্মালে বাচ্চারা রাতে জেগে থাকে ৷ দুলুর বোন ফুলুও এসেছে বেড়াতে, তারও সঙ্গে আছে তার ছোট্ট মেয়ে বিভা ৷
টেবিলে প্লেট বিছিয়ে ভাত-তরকারি বেড়ে আজাদের মা অপেক্ষা করছেন ৷ জুয়েল, আজাদ, কাজী কামাল, সেকেন্দার আসে ৷ বেসিনের কলটা নষ্ট ৷ তিনি একটা গামলা দিয়েছেন টেবিলে ৷ বলেন, ‘সবাই গামলায় হাত ধুয়ে নাও ৷’ তিনি পানি এগিয়ে দেন ৷ গামলাটা একজনের সামনে থেকে নিয়ে ধরেন আরেকজনের সামনে ৷ শুধু জুয়েলের হাত ধোয়ার দরকার পড়ে না ৷ তার ডান হাতের তিন আঙুলে ব্যান্ডেজ ৷ সে বাকি দু আঙুলে চামচ দিয়ে তুলে খাবে ৷ মা বলেন, ‘বাশার কই বাশার ? তুমিও আসো ৷ খেয়ে নাও ৷ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না ৷’ বাশার আসে ৷
‘কী হয় ? টিভিতে শাহনাজ বেগমের গান হয় নাকি!’ আজাদ বাশারকে খেপানোর চেষ্টা করে ৷
রান্না হয়েছে গরুর মাংস, আলুভর্তা, পটলভাজা, লাউশাক আর ডাল ৷
এত অল্প তরকারি দিয়ে ভাত দিতেও সাফিয়ার লজ্জা লজ্জা লাগে ৷ কিন্তু কিছুই করার নাই ৷ একে তো আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়, তার ওপর মাছ খাওয়া বন্ধ ৷ দেশের সব নদীতে এখন শুধু মানুষের লাশ ভাসে ৷ মানুষের লাশ ঠুকরে খেয়ে খেয়ে মাছগুলো হচ্ছেও বেশ নধরকান্তি ৷ মাছ খেলে কলেরা না হয়েই যায় না ৷ তাই মাছ খাওয়া সবাই বন্ধ করে দিয়েছে ৷ তার ওপর গতকাল মনোয়ার জামাইয়ের আগমন উপলক্ষে ভালো খাবারের আয়োজন ছিল ৷
সবাই খেতে বসেছে ৷ জুয়েল ছেলেটা সব সময় রসিকতা করতে পছন্দ করে ৷ সে বলে, ‘আম্মা, আপনি নিজে রানছেন!’
‘হ্যাঁ বাবা ৷’
‘আর কত দিন কষ্ট করবেন আম্মা ৷ আজাদরে একটা বিয়াশাদি দ্যান ৷ বউয়ের হাতের সেবাযত্ন খান ৷’
‘দ্যাখো, তোমরা পাত্রী দ্যাখো ৷ বিয়ে তো দিতেই হবে ৷’ মা যে একটা মেয়ে ঠিক করে রেখেছেন, এটা আর বলেন না ৷
‘তা আম্মা যৌতুক হিসাবে কী নিবেন ? ডিম্যান্ড কী ?’
‘না না ৷ ছেলে বিক্রি করতে পারব না ৷’
‘না ৷ এই যুদ্ধের বাজারে এই কথা কইবেনই না ৷ আপনার ডিম্যান্ড না থাকতে পারে ৷ আমাদের আছে ৷ ছেলেকে একটা অন্তত এলএমজি আর চারটা ম্যাগাজিন আর ২ হাজার রাউন্ড গুলি দিতে হইব ৷’
বাশার বলে, ‘একেবারে ট্যাঙ্ক ডিম্যান্ড করো ৷ ট্যাঙ্ক চাইলে পিস্তল পেতেও পারো ৷’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই ওঠে ৷ মা গামছা পর্যন্ত এগিয়ে দেন ৷
তারা সবাই আবার আজাদের ঘরে গিয়ে ঢোকে ৷ মা বলেন, ‘পানের অভ্যাস থাকলে বলো ৷ পান দিতে পারি ৷’
বাশার বলে, ‘দ্যান ৷ যার লাগে সে খাবে ৷’
তারা ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আবার আজাদের ঘরে আসে ৷
বাশার বলে, ‘ঘরে সিগারেট আছে ? রাতে লাগবে না ? আজাদ চলো, সিগারেট আনি!’
আজাদ বলে, ‘জায়েদরে দিয়া আনাই ৷’
বাশার বলে, ‘আরে চলো না ৷ তোমার সাথে কথা আছে ৷’
আজাদ আর বাশার ঘর থেকে বের হয় ৷ এরই মধ্যে রাস্তাঘাট সব ফাঁকা হয়ে পড়েছে ৷ হওয়ারই কথা ৷ গেরিলারা প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার নানা জায়গায় নানা অপারেশন চালাচ্ছে ৷ গাড়ির চাকার নিচে ছোট ছোট মাইন পুঁতে গাড়ির চাকা সশব্দে ব্লাস্ট করা থেকে শুরু করে একেবারে সুসজ্জিত আর্মি শিবিরে হামলা করা পর্যন্ত ৷ আর মিলিটারিও হয়ে পড়েছে পাগলা কুকুরের মতো ৷ কখন যে কাকে ধরে নিয়ে যাবে, তার ঠিক নাই ৷ তার ওপর কারফিউ ৷
বাশার বলে, ‘শোনো, মিলি নাকি দেশে ফিরেছে ৷’
মিলির কথায় আজাদের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে ৷ হাত-পা অবশ হয়ে যায় ৷ সে অতি কষ্টে স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গি করে বলে, ‘তাতে আমার কী!’
‘আছে ৷ তোমারও কিছু আছে ৷ মিলির আসলে বিয়ে হয়নি ৷ তোমার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য মিথ্যা কথা বলেছিল ৷’
‘বলো কি!’
‘দেশে এসেছে’-বাশার একটু ভাবগম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে ৷
‘তুমি কেমন করে জানলা!’
‘জানলাম ৷ খবরের কাগজে চাকরি করি ৷ সব খবরই রাখতে হয় ৷ তবে আরেকটা অসমর্থিত সূত্রের খবর, মিলির ডিভোর্স হয়ে গেছে ৷’
‘তার মানে বিয়া হইছিল ৷’
‘হ্যাঁ ৷ তার ইচ্ছার এগেইনস্টে ৷’
‘তুমি এটা কী শোনাচ্ছ ৷ আমার তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতেছে ৷ বাট আই জাস্ট ক্যাননট বিলিভ দিস নিউজ অ্যটঅল ৷’
‘ওকে ৷ উই ক্যান চেক ইট ৷’
‘পুরানা পল্টনে বাসা ৷ চেক তো করাই যায় ৷ তুমি যাবা ৷ তোমার সাথে তো আর কোনো সমস্যা নাই ৷’
‘ঠিক আছে যাব ৷’
‘তুমি আমারটা খোঁজখবর করো ৷ আমি তোমারটা দেখছি ৷ তোমাকে আর কষ্ট করে পাত্রী খুঁজতে হবে না ৷ পাত্রী আমাদের বাসা থেকেই বের করে ফেলব ৷’
বাশার লজ্জা পায় ৷ গলির ভেতরে একটা হোটেলের মধ্যে একটামাত্র দোকান আছে ৷ দোকানটা বাইরে থেকে বন্ধই থাকে ৷ তবে টুক টুক করে টোকা দিলে একটা ছোট্ট জানালা খুলে যায় ৷ টাকা দিলে সিগারেট বেরোয় ৷ এখানেই কেবল রাত্রিবেলা সিগারেট পাওয়া যায় ৷ বেনসন অ্যান্ড হেজেস-এর প্যাকেট কেনে আজাদ ৷
সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে টানতে ফিরে আসে ৷ রাস্তায় শুধু কুকুর ৷ গলির মুখটা অন্ধকার ৷ আকাশে পোয়াখানেক চাঁদও দেখা যাচ্ছে ৷ নিজেকে কেমন তুচ্ছ, সামান্য লাগে আজাদের ৷ সে আরো জোরে সিগারেটে টান দেয় ৷ মনে হচ্ছে সিগারেটের মুখের আগুনটুকুকে সে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতে চায় ৷ অন্ধকারে প্রতিটা টানে তার মুখে লাল আভা পড়ে ৷
মহুয়া, কচি, দুলু, ফুলু, আজাদের খালাতো বোনেরা, আর আজাদের মা এক ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল ৷ মহুয়ার কোলের কাছে তার অল্পদিন আগে জন্ম নেওয়া মেয়ে ৷ দুলু, ফুলুর সঙ্গেও তাদের ছোট বাচ্চারা ৷ এর মধ্যে বালিকা কচির ঘুম ভেঙে যায় কিসের যেন শব্দে ৷ সে দেখতে পায়, ঘরে আলো ৷ আর আলোর মধ্যে সে দেখতে পায়, চোখে সুরমা, ফরসা, যেন চাঁদের আলো দিয়ে তার দেহ গড়া, লম্বা, স্বাস্থ্যবান এক যুবক, যেন রাজপুত্র, বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ৷ সে মহুয়াকে ধাক্কা দেয়, বলে, ‘বুজি দ্যাখো, কী সুন্দর’ সে বুঝতে পারে না সে স্বপ্ন দেখছে নাকি এই দৃশ্য বাস্তবে ঘটছে ৷ মহুয়ার ঘুম ভেঙে যায়, সে ঘরের মধ্যে মিলিটারি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যায় আর কচির মুখ চেপে ধরে ৷
তারও আগে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে ৩৯ মগবাজারের বাসাটা, হাজি মনিরুদ্দিন ভিলা, ঘিরে ফেলে ৷ তারা দরজায় সজোরে ধাক্কা দিতে থাকে ৷ তখন আজাদের ঘরে জুয়েল বিছানায় শোয়া ৷ কাজী কামালের পিস্তলটা, যেটা মেজর নুরুল ইসলাম শিশু তাকে দিয়েছিল, জুয়েলের কাছে ৷ এটার প্রতি তার লোভ ছিল ৷ বিকালেই কাজী কামাল বলেছে, ‘থাকুক, পিস্তলটা তোর কাছেই থাকুক ৷’ সেটাকে সে বিছানার ওপরেই রেখে শুয়েছিল ৷ নিচে পাটিতে বসে তাস খেলছে কাজী কামাল, আজাদ, সেকেন্দার আর বাশার ৷ ভাদ্রের মাসের রাত, ভাপসা গরম ৷ কাজী কামালের পরনে একটা লুঙ্গি মাত্র, শরীরে আর কিছু নাই ৷ মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে ৷ আজাদের খালাতো ভাইরা, জায়েদ, টগর, চঞ্চল, টিসু আর খালাতো দুলাভাই মনোয়ার হোসেন শুয়েছে আরেক ঘরে ৷ দরজায় আঘাতটা বেড়েই চলেছে ৷ আজাদরা তখন হকচকিত ৷ জায়েদের ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে ভাবে, শব্দ হয় কেন ? মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে দাদাদের রুমে এখনও আলো জ্বলছে ৷ দরজায় আবার প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা ৷ জায়েদ বিছানা ছাড়ে ৷ দাদারা জেগে আছে, দরজা খোলে না কেন ? উঠে জানালার পর্দাটা ফাঁক করে জায়েদ, তখন তার বয়স সতেরোর মতো, বাইরে তাকায়, দেখতে পায়, সাক্ষাৎ সর্বনাশ বাইরে দাঁড়িয়ে ৷ জায়েদ কী করবে বুঝতে পারে না ৷ পাশের ঘরে যায়, দেখে আম্মা সবাইকে নিয়ে কই লুকাবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না ৷ আর জুয়েলের পিস্তলটা আলুর বস্তার পেছনে ফেলা হচ্ছে ৷ জায়েদের একটা গোপন দরজা আছে, মেথরদের আসার চোরা রাস্তা ৷ ওই রাস্তা দিয়ে সে অনেকবার অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে আলমদের দিলু রোডের বাড়িতে ৷ ওই দরজা খুলে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে সে পালানোর চেষ্টা করে ৷ কিন্তু সামনে যমদূতের মতো খাড়া হয়ে আছে পাকিস্তানি আর্মি ৷ হ্যান্ডস আপ ৷ জায়েদ হাত উঁচু করে ৷ দরজা খোলা পেয়ে জায়েদকে বন্দুকের মুখে ঠেলে ভেতরে নিয়ে আসে সৈন্যরা ৷ এসে সামনের দরজা খুলে দেয় ৷ একে একে ঢুকে যায় বেশ কজন ৷ একজন কমান্ডো ধরনের ৷ তার বুকে লেখা : মেজর সরফরাজ ৷ একজনের বুকে লেখা : ক্যাপ্টেন বুখারি ৷ ক্যাপ্টেন বুখারির হাতে স্টেনগান ৷
সৈন্যরা এসেই বলে, ‘আজাদ কোন হ্যায় ৷’
কেউ স্বীকার করে না ৷
আজাদকে ওরা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমারা নাম কিয়া ?’
আজাদ বলে, ‘মাগফার আহমেদ চৌধুরী হ্যায় ৷’
কম্যান্ডো ধরনের লোকটা বলে, ‘তুম আজাদ হ্যায় ৷’
‘মে আজাদ নেহি হ্যায় ৷’
‘শালা মাদারচোত, তুম নাম কিউ নিদানা হ্যায় ৷’ সে আজাদের ঘাড়ে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারে ৷
ইতিমধ্যে অন্য ঘর থেকে টগর, চঞ্চল, মনোয়ারকেও এনে একপাশে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে ৷ মোট আটজন বাঙালি বিভিন্ন বয়সের পুরুষ এখানে বলির পাঁঠার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কাজী কামাল খেয়াল করে ৷ আজাদ, জুয়েল, বাশার, সেকেন্দার, মনোয়ার হোসেন, জায়েদ, টগর, চঞ্চল ৷ কাজী কামালের মনে হয়, তাকে ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম সব সময় বলেছে, ‘স্যার, দুইজন সেন্ট্রি দাঁড় করায়া রাখেন ৷ এইভাবে সেন্ট্রি ছাড়া আপনারা থাকেন ৷ কোন দিন জানি বিপদে পড়েন ৷’ ইস্, দুইজন গার্ড যদি বাইরে দাঁড় করানো থাকত, পজিশন নেওয়ার সময় পেলে ওদের গুলি করেই উড়িয়ে দেওয়া যেত ৷ এভাবে বিনা চ্যালেঞ্জে মরতে হতো না ৷
‘আর্মস কিধার হ্যায় ?’ বুখারি নির্দেশ দিচ্ছে ৷ স্টিলের একটা আলমারি আছে ঘরে ৷ আজাদের মা আঁচল থেকে চাবি খুলে দিলে একজন সৈন্য আলমারি খোলে ৷ সবাই আগ্রহভরে অস্ত্র খুঁজছে ৷
হঠাৎই ক্যাপ্টেন বুখারি লক্ষ করে, একটা ছেলের হাতের আঙুলে ব্যান্ডেজ দেখা যায় ৷ সে জুয়েলের জখমি জায়গাটা চেপে ধর বলে, ‘বাস্টার্ড, হয়ার আর দি আর্মস ?’
ব্যথায় জুয়েল ‘ও মাগো’ বলে কুঁকিয়ে ওঠে ৷ কাজী কামালের মাথায় রক্ত উঠে যায় ৷ সে নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, আয়ুরেখা বড় আর স্পষ্ট ৷ তার মানে এখানে তার মরণ নাই ৷ সে হঠাৎই মেজরের হাতের স্টেনগানটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু হাতে স্টেন ধরে ফেলে ৷ মুহূর্তের মধ্যে এ কাণ্ড ঘটে যায় ৷ স্টেনের দখল কে নেবে এই নিয়ে টানাটানি হতে থাকে ৷ ট্রিগারে কাজীর হাত ৷ গুলি বেরুতে থাকে ৷ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় গুলির শব্দে ৷ কাজীর পরনের একমাত্র বস্ত্র লুঙ্গিটা ধস্তাধস্তিতে যায় খুলে ৷ ক্যাপ্টেন আর কাজী দুজনেই খাটে পড়ে গেলে খাট ভেঙে পড়ে যায় মেঝেতে ৷ ক্যাপ্টেন আহত হয়ে মেঝেতে গড়ায় ৷ স্টিলের আলমারির সামনের সৈন্যটা গুলিবিদ্ধ হয় আর পড়ে যায় ৷ ওপাশে মেজর সরফরাজ ফায়ার ওপেন করলে জায়েদ আর টগর গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ৷ কাজী জানে এখানে ধরা পড়ার মানে হলো মৃত্যু ৷ সে সোজা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে আসে ৷ সম্পূর্ণ উলঙ্গ কাজী গেট দিয়ে বাইরে যায় ৷ বাইরে বাউন্ডারি দেয়ালের কাছে দুপাশে দুজন সৈন্য দাঁড়িয়ে ৷ চাঁদের আলোয় এক নগ্ন লম্বা ফরসা যুবককে দেখে তারা মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয় হয়তো ৷ নইলে কেন তারা তাকে চার্জ করেনি, ১৪ বছর পরও কাজী সেটা অনুমান করতে পারে না ৷ কাজী একদৌড়ে বেরিয়ে রেললাইন ধরে সোজা দিলু রোডে চলে যায় ৷
রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে ৷ জায়েদ আর টগর বুঝি মারাই গেছে ৷ তিনজন মিলিটারিও রক্তাক্ত ৷ আরো মিলিটারি প্রবেশ করে ঘরে ৷ তারা আজাদ, জুয়েল, বাশার, মনোয়ার, সেকেন্দার আর চঞ্চলকে ধরে নিয়ে প্রচণ্ড মার দিতে দিতে গাড়ির দিকে চলে যায় ৷ আজাদের মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে তাকে, বাশারের হাত ভেঙে যায়, জুয়েলেরও নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরে ৷
আজাদের মা দেখেন তাঁর চোখের সামনে থেকে তাঁর ছেলে চলে যাচ্ছে ৷ তিনি কেঁদে ফেলেন ৷ আর্তনাদের সুরে বলেন, ‘আজাদ, তুই চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে থাকব ৷’
আজাদ বলে, ‘আল্লাহ আল্লাহ করো মা ৷’ আরেক দফা মার তার ঘাড়ে এসে পড়লে সে সেটা সহ্য করে শেষবারের মতো তার মায়ের দিকে তাকায় ৷
চঞ্চল তখন খুবই ছোট ৷ নিতান্তই বালক ৷ তাকে কেন আর্মি ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলছে ৷ সে তো যুদ্ধ করেনি ৷ কোনো পক্ষ-বিপক্ষ বোঝেও না ৷ সৈন্যরা তার পেটে ঘুসি মারছে আর বলছে, ‘বাতাও, হাতিয়ার কিধার হ্যায়’, সে চিৎকার করে বলছে, ‘হাম বেকসুর হ্যায়, হাম বেগুনা (নিষ্পাপ) হ্যায় ৷’ আজাদের মা দৌড়ে যান গাড়ির কাছে, ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আসেন চঞ্চলকে ৷
গুলিবিদ্ধ, আহত অথবা নিহত তিন পাকিস্তানি সৈন্যকে ওরা একটা গাড়িতে তোলে ৷ বন্দি সবাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পাকসেনারা বিদায় হলে হঠাৎ করেই পুরো পাড়া নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ৷
টগরের আজও মনে পড়ে, ঘটনার ১৪ বছর পরও, যখন গুলি এসে লাগল তার পেটে, তার মনে হচ্ছিল, যেন লক্ষ লক্ষ ব্লেড ঢুকে যাচ্ছে পেটের ভেতরে, এত যন্ত্রণা, আর মনে হচ্ছে, তার বুকের ভেতরটা মরুভূমি হয়ে গেছে, তার পানি চাই, এত তৃষ্ণা যেন কলসের পরে কলস পানি খেলেও তার পিপাসা মিটবে না, সে চিৎকার করছে, ‘আম্মা পানি, আম্মা পানি…’ তখন লক্ষ লক্ষ পাখি ছেয়ে ফেলে তার আকাশটা, তারা একযোগে মুখর হয়ে ওঠে পানি পানি বলে, আর আজাদের মা এসে ঢোকেন ঘরে ৷
তিনি আজাদের ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখেন শুধু রক্ত আর রক্ত ৷ যেন রক্তের পুকুরে ভেসে আছে জায়েদ আর টগর ৷ তারই মধ্যে রক্তের মধ্যে বসে আপন মনে খেলছে মনোয়ার হোসেন ও দুলুর ছোট্ট মেয়ে লীনা, যে কিনা কেবল হামাগুড়ি দিতে শিখেছে ৷ কে কার দিকে খেয়াল করে, এ এমন এক দুর্যোগময় মুহূর্ত ৷ আজাদের মা দৌড়ে জগ নিয়ে আসেন ৷ পানি ঢালেন টগরের মুখে ৷ টগর পানি খেয়ে বলে, ‘পানি, আম্মা পানি…’ আর পাখিরা ডেকে ওঠে আম্মা পানি, আম্মা পানি, বলে…
জায়েদ বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে কে জানে! টগরের লক্ষণও তো সুবিধার মনে হচ্ছে না, এও বুঝি মারা যাবে ৷ আজাদের মা ধপাস করে পড়ে যান, জ্ঞান হারান ৷ তাঁর ভাগি্নরা তাঁর মাথায় পানি ঢেলে তাঁকে সুস্থ করে তুললে তিনি উঠে কর্তব্য স্থির করেন ৷
টগর আর জায়েদকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ৷ তিনি পাশের বাসায় গিয়ে হাজির হন, যেখানে টেলিফোন আছে ৷ পাশের বাসায় থাকতেন একজন মাড়োয়ারি মহিলা ৷ মা মাড়োয়ারির বাসার দরজায় ধাক্কা দেন ৷ কিন্তু মহিলা দরজা খোলে না ৷ মা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন মহিলা কোরআন শরিফ নিয়ে বসেছে ৷ তিনি আরেকবার ধাক্কা দেন ৷ মহিলা কোরান শরিফ থেকে মুখ তোলে না ৷ মা জানালার ধারে দাঁড়িয়েই থাকেন ৷ মহিলা কোরআন শরিফ পড়েই চলেন ৷ মহূর্ত মুহূর্ত করে ঘন্টা চলে যায় ৷ মহিলা কোরআন শরিফ থেকে চোখ সরায় না ৷ আজাদের মাও জানালা থেকে সরেন না ৷ ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যায় ৷ মহিলা মুখ তোলে ৷ আজাদের মা বলেন, ‘বুবু দরজা খোলেন ৷ একটা ফোন করব ৷’
তখন একা বাসায় তিনটা মেয়ে, তার মধ্যে কচি ভাবে, তার স্বপ্নের রাজপুত্ররা ঘরে ঢুকে এ কোন রক্তের খেলা খেলে গেল ৷ তাহলে ওরা কি রাজপুত্র ছিল না, ছিল রাজপুত্রের ছদ্মবেশে দুষ্ট রাক্ষস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *