বিয়াল্লিশ
মহাদেবদার সঙ্গে রিকশায় যেতে যেতে অনিমেষ চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। বন্ধ চোখের পাতায় সুবাসদার মুখ। সেই উজ্জ্বল উদ্দাম সুবাসদা। কলকাতায় প্রথমে পা দেবার পর যে তাকে পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল আহত হবার পর, যাকে সে প্রথম চিনেছিল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সেই সুবাসদা আজ নেই। কেমন ফাঁকা লাগছিল অনিমেষের। তার জীবনের বড় বড় বাঁকগুলো সে সুবাসদার হাত ধরেই ঘুরেছে। বিপ্লবের স্বপ্ন ছিল যার চোখে, স্বপ্ন অন্য মানুষের চোখে ছড়িয়ে দিতে যে জানত, বিপ্লব শুরু হওয়ার আগেই তাকে চলে যেতে হল। সত্য বড় নিষ্ঠুর, দুরমুশের মতো মানুষকে বিশ্বাসে বাধ্য করে। অনিমেষের বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। এখনও তার পেটের ওপর সুবাসদার দেওয়া অস্ত্র, তার আত্মরক্ষার কিংবা আক্রমণের জন্য সুবাসদার ভালবাসা, এখনও প্রমাণিত হয়নি সে এর কতটা যোগ্য!
আজ শিলিগুড়িতে এসে একটার পর একটা খারাপ খবর পেল অনিমেষ। বারীনদার মার খাওয়া, পার্টির ভাঙন এবং সুবাসদার মৃত্যু। অনিমেষের কথা বলতে আর ভাল লাগছিল না। শিলিগুড়িতে আজ যে উদ্দেশ্যে আসা তার কোনওটাই সম্ভব হল না। এখন মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। করুণাসিন্ধু ঠিকই বলেছিল, শিলিগুড়ি এখন সত্যিই গরম হয়ে আছে। কিন্তু এবার তার সঙ্গে আছেন মহাদেবদা। ওঁর মতো ডেডিকেটেড নেতাকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে। অন্য কোনও চিন্তা মাথায় আসছে না, এক করুণাসিন্ধু যদি রাজি হয়। এভাবে প্রকাশ্যে রিকশায় যাওয়াটাও বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ছাড়া তো কোনও উপায়ও নেই।
নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে খুশি হল অনিমেষ। করুণাসিন্ধুদের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। পাশের একটা সিগারেটের দোকানে খুচরো পয়সা দিয়ে করুণাসিন্ধু এগিয়ে এল, ‘আপনার জন্য খুব চিন্তায় ছিলাম—।’ তারপর একজন অপরিচিত মানুষের উপস্থিতি ভেবে চুপ করে গেল আচমকা।
অনিমেষ রিকশা থেকে নেমে করুণাসিন্ধুর সামনে এসে নিচু গলায় বলল, ‘আপনার কাছে একটা সাহায্য চাই। এঁকে শেল্টার দিতে হবে ক’দিন।’
‘আমার ওখানে তো আর জায়গা নেই।’
‘কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যবস্থা করতে হবে।’
‘কী আশ্চর্য, আপনি একা আছেন বলে কেউ কিছু ভাবছে না কিন্তু আর-একজন গেলে— একটা অন্যায় অনুরোধ হয়ে যাচ্ছে না?’
‘বুঝতে পারছি, কিন্তু কোনও রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। ইনি ধরা পড়লে আমাদের লজ্জার শেষ থাকবে না।’
‘কে ইনি?’
‘মহাদেবদা।’
‘মহাদেববাবু?’ করুণাসিন্ধুর মুখ দ্রুত পালটে গেল। সে আরও নিচু গলায় অনিমেষের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে মাথা নেড়ে জিপের দিকে এগিয়ে গেল। এবার একটু হালকা হল অনিমেষ। সে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে বলল, ‘নেমে আসুন মহাদেবদা, এই জিপটায় উঠতে হবে।’
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘হাসিমারার কাছে একটা রিভারবেডে। এই ছেলেটি ওখানে কাজ করে।’
মহাদেবদাকে সঙ্গে নিয়ে জিপের দিকে এগিয়ে যেতে অনিমেষের মনে পড়ল করুণাসিন্ধুর ছোটমালিকের কথা। সে যদি মহাদেবদাকে দেখে বিগড়ে যায়! করুণাসিন্ধু কীভাবে ম্যানেজ করবে ওকে?
জিপের ভেতর তাকিয়ে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। পেছনের সিটে পা গুটিয়ে ছোটমালিক হাঁ করে ঘুমুচ্ছে। করুণাসিন্ধু বলল, ‘তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন।’
অনিমেষ ছেলেটিকে ইশারা করে দেখাতে করুণাসিন্ধু বলল, ‘পুরো আউট হয়ে গেছে। কাল সকালের আগে ডিস্টার্ব করবে না। অবশ্য আউট না-হলে আজ বিকেলে ফেরা যেত না। উঠে পড়ুন।’
ওরা পেছনে উঠে বসতেই জিপ ছেড়ে দিল। বিশ্রী টোকো গন্ধ ছড়াচ্ছে ছেলেটির মুখ থেকে। অনিমেষের শরীর গুলিয়ে উঠছিল। মহাদেবদা একটা কোণে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। চশমাটা বাঁ হাতে ধরা। বাইরে শিলিগুড়ি শহর সরে সরে যাচ্ছে। অনিমেষ ছেলেটির দিকে তাকাল, মৃতদেহের মতো নিঃসাড়। এটাকে মাঝরাস্তায় কোনও জঙ্গলের মধ্যে নামিয়ে দিলে কেমন হয়। ড্রাইভারটা না-থাকলে তাই করত সে। মহাদেবদাকে ড্রাইভার লক্ষ করছিল, কী ভাবছে কে জানে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ যাওয়ার পর মহাদেবদা বললেন, ‘বারীনের খবর শুনেছ?’
মাথা নাড়ল অনিমেষ। তারপর মহাদেবদার মুখের দিকে তাকাল।
মহাদেবদা চোখ বন্ধ করেই বললেন, ‘মুঠোটা খুলে গেছে অনিমেষ, আঙুলগুলো যে যার ইচ্ছে মতন কাজ করছে। শত্রুপক্ষের এখন মহা সুবিধে।’
‘কেন এমন হেচ্ছ?’
‘মত পার্থক্য। আমরা বিপ্লব করি কিংবা খেলি, আমাদের প্রত্যেকের যে নিজের নিজের মত আছে। আমরা চাই প্রত্যেকে আমারটাই মানুক।’
‘তা হলে আমরা কি হেরে যাব?’
সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললেন মহাদেবদা, ‘কে বলল হেরে যাব? নো, নেভার। যারা আজ ভুল করছে তাদের বাদ দিয়েই আমরা এগিয়ে যাব।’
‘কিন্তু একমত হবার কি উপায় নেই?’
‘আছে, যদি প্রয়োজনটা এক হয়। একটা কনস্টেবলের গলা কেটে কিংবা একটা মূর্তির মুন্ডু ভেঙে এদেশে বিপ্লব আসতে পারে না। এতে প্যানিক ছড়ানো যায়। এসব করে আমরা ইতিমধ্যে জনসাধারণকে আমাদের সম্পর্কে ভয় পাইয়ে দিচ্ছি। ওদের বাদ দিয়ে বিপ্লব হবে কী করে তা এরা চিন্তা করছে না। কিন্তু একবার পাহাড় ছেড়ে বেরিয়ে এলে ঝরনা আর ফিরে যেতে পারে না। অতএব আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মুশকিল হল সমুদ্রের পথটা এখন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ মহাদেবদা হাসবার চেষ্টা করলেন।
‘সারা দেশ জুড়ে একটা সেন্ট্রাল কমিটি তা হলে গঠন হল না?’
‘না।’
‘তা হলে?’ গলা কেঁপে গেল অনিমেষের।
‘অপেক্ষা করো। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’
যেন যুদ্ধ শুরু করার মুখে জানা গেল কারও রাইফেলে গুলি নেই। অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল। না, এ হতে পারে না। হাজার হাজার ছেলে আজ ভবিষ্যৎ না-ভেবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, তারা কিছুতেই থেমে থাকতে পারে না। যাঁরা থিয়োরি নিয়ে মাথা ঘামান তাঁদের বিরোধের জন্য এতগুলো আগুন নিবে যেতে পারে না। যেতে যেতে মহাদেবদার কাছে আরও অনেক খবর শুনল অনিমেষ। কলকাতা বীরভূম এবং মেদিনীপুরে পুলিশ এখন নকশাল-হত্যার জন্য সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা নিয়েছে। ছেলেদের ধরতে পারলে কুকুর বেড়ালের মতো প্রকাশ্যে হত্যা করছে তারা। দলের সবাই এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। সাধারণ মানুষ প্রথম দিকে ছেলেদের আশ্রয় দিচ্ছিল, খাবার দিচ্ছিল কিন্তু এখন যেন তারা সন্ত্রস্ত। এক একটা এলাকা ঘিরে ফেলে পুলিশ চিরুনির মতো তল্লাশ চালিয়ে সন্দেহজনক ছেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের সঙ্গে মদত দিচ্ছে পুনর্নির্বাচিত মার্ক্সবাদে দীক্ষিত এক বামপন্থী দল। তাদের নেতা ময়দানে প্রকাশ্যে ঘোষণা কেরছেন যে তিনি ইচ্ছে করলে এক দিনে নকশাল আন্দোলন ঠান্ডা করে দিতে পারেন। বাইরে থেকে আন্দোলন ভাঙার এই প্রচেষ্টা বোঝা যায় কিন্তু দলের ভেতর থেকে সবকিছু ভেস্তে দেবার জন্য সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে। মহাদেবদা বলতে পারলেন না কোনও বিদেশি শক্তি কিংবা কোনও রাজনৈতিক দলের এ ব্যাপারে কোনও ভূমিকা আছে কিনা, কিন্তু সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। কিন্তু আজ কলকাতা শহরে একটা গুজব খুব ছড়াচ্ছে। গুজবটা হল নকশাল আন্দোলন বিদেশি শক্তির পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। ঠিক এইরকম আন্দোলন পৃথিবীর নানান দেশে সময়ে সমেয় হয়েছে। এতে আর কিছু না-হোক সেই দেশের সরকার এমন বিব্রত হয় যে তা থেকে সেই শক্তি হয়তো মুনাফা পেতে পারে। কিন্তু অনিমেষ তো বটেই, মহাদেবদাও এ ব্যাপারে কোনও তথ্য জানেন না।
মহাদেবদা চুপ করে গেলে অনিমেষ দেখল জিপ স্বর্গছেঁড়া ছাড়িয়ে গেল। করুণাসিন্ধু এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। চুপচাপ সামনে তাকিয়ে আছে। এপাশে ছোটমালিক নিঃশব্দে পড়ে আছে। করুণাসিন্ধু নকশাল আন্দোলনের সমর্থক। ওর পরিচয় এবং মানসিকতা অনিমেষ জানে। কিন্তু সক্রিয়ভাবে করুণাসিন্ধু আন্দোলনে নামেনি। সে সাহায্য করেছ কিন্তু তাকে বিপদে ফেলতে ইচ্ছে নেই অনিমেষের। মহাদেবদার কথায় জানা গেছে যে পুলিশ তাঁকে ধরলেই হত্যা করবে। কথাটা করুণাসিন্ধুও শুনেছে। যদি কোনও কারণে তার মতটা পালটে যায়! একটা বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে হবে। ফুন্টশিলিং-এ ওদের সমবেত হবার দিনটা এসে গেল।
দু’পাশে জঙ্গল, একটানা ঝিঁঝি শব্দ করে যাচ্ছে। সন্ধে হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও পৃথিবী থেকে শেষ আলোটুকু মুছে যায়নি। অনিমেষ সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ড্রাইভার এবং করুণাসিন্ধুর মাথার মাঝখান দিয়ে সামনের কাচ ভেদ করে সরু পিচের রাস্তাটা দেখছিল সে। আর মিনিট দশেকের মধ্যে ওরা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। হঠাৎ অনিমেষের চোখে পড়ল অনেক দূরে ঠিক রাস্তার মাঝখানে একটা কালো বিন্দু নড়ছে। একটু বাদেই বোঝা গেল ওটা একটা মানুষ। লোকটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন জিপটি চিনতে পেরেই হঠাৎ দু’হাত তুলে নাচতে লাগল। বোঝা যাচ্ছে লোকটা ওদের থামতে বলছে। ড্রাইভার চাপা গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে সামনে হাতি বেরিয়েছে।’
করুণাসিন্ধু বলল, ‘হাতি?’
কিন্তু ততক্ষণে অনিমেষ ওকে চিনে ফেলেছে। সে চিৎকার করে গাড়িটাকে থামাতে বলল। ড্রাইভার যেন একটু অবাক হয়ে গাড়িটা থামাতেই অনিমেষ লাফিয়ে নেমে ছুটে গেল সিরিলের কাছে। সিরিল উত্তেজিত, তার কালো মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিন্তু প্রথমে সে যেন অনিমেষকে চিনতেই পারল না। পরক্ষণেই দাড়িটা কামানো হয়েছে বুঝতে পেরেই সে তার হাত চেপে ধরল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে, তুমি এখানে কেন?’
‘নেমে পড়ুন চটপট, ওদিকে যাবেন না।’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘আপনারা চলে যাওয়ার পর পুলিশ ক্যাম্পে ক্যাম্পে সার্চ শুরু করেছে। ওরা নাকি আমাদের কথা জেনে গেছে। আমি কোনও মালপত্র নিয়ে আসতে পারিনি।’
সিরিল মুখ দিয়ে বাতাস টানছিল।
অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল। ওরা যে রিভারবেডের ক্যাম্পে আছে তা পুলিশ জানল কী করে? কোনওরকম সন্দেহ তারা উৎপাদন করেনি, তা হলে! যাওয়ার সময় ছোটমালিক বলেছিল যে দারোগা ক্যাম্পে এসেছিল। সেটা কি এই উদ্দেশ্যেই? এখন নিশ্চয়ই ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া যায় না। অথচ মহাদেবদা সঙ্গে আছেন। যেমন করেই হোক ওঁকে বাঁচাতে হবে। সে সিরিলের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘শাবাশ কমরেড, তুমি এখানে না-এলে আমরা বিপদে পড়তাম।’
সিরিলের কালো মুখে সাদা মুক্তো ঝলসে উঠল।
অনিমেষ একটু চিন্তান্বিত গলায় বলল, ‘কিন্তু মুশকিল হল আমার সঙ্গে মহাদেবদা আছেন। ওঁকে বাঁচানো দরকার। কোথায় যাওয়া যায়!’
‘মহাদেবদা কে?’
‘আমাদের প্রথম সারির নেতা। কলকাতা থেকে এসেছেন। পুলিশ ওঁকে পেলেই মেরে ফেলতে পারে।’ অনিমেষ কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াল। জিপটা খানিক দূরে, করুণাসিন্ধু গাড়ি থেকে নেমে বনেটে ঠেস দিয়ে ওদের দেখছে। অনিমেষ ওকে ডাকল। করুণাসিন্ধু বেশ গম্ভীর মুখে কাছে আসতেই অনিমেষ বলল, ‘আপনাদের ক্যাম্পে পুলিশ আমাদের জন্যে বসে আছে। এ অবস্থায় আমি মহাদেবদাকে নিয়ে এখানে যেতে চাইছি না।’ অনিমেষ জানাল।
‘কী করবেন?’
‘আমাদের হাসিমারায় পৌঁছে দিন।’
করুণাসিন্ধু মাথা নাড়ল, ‘এখন আর সম্ভব নয়।’
‘কেন?’
‘আপনাদের জন্যে আমি আর ঝুঁকি নিতে রাজি নই। অনেক করেছি।’
‘করেছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এ অবস্থায় যদি এখানে ছেড়ে দেন তা হলে সেই করার কোনও মূল্য থাকবে না।’ অনিমেষ যথেষ্ট নরম গলায় বলল।
‘দেখুন ইতিমধ্যেই আমার যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে। আপনি আমার সঙ্গে ছিলেন বলে হয়তো অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। আমি আর রিস্ক নিতে চাই না।’ করুণাসিন্ধু ফেরার জন্যে ঘুরতেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু হাসিমারা পর্যন্ত ফিরে যেতে আপনার আপত্তি কেন?’
করুণাসিন্ধু বলল, ‘ড্রাইভার পুলিশের কাছে ঘটনাটা জানিয়ে দেবে।’
অনিমেষ আবেদনের ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি আর-একবার ভেবে দেখুন।’
‘না, ভাববার কিছু নেই। অনেক হয়েছে।’
‘আপনি আন্দোলনের বিপক্ষে যাচ্ছেন!’ অনিমেষের গলা শক্ত হল।
‘আন্দোলন? সে তো শিকেয় উঠেছে। আমি আর এই হঠকারিতার সঙ্গে যুক্ত হতে চাই না।’
করুণাসিন্ধু ফিরে যাচ্ছিল। অনিমেষ খুব দ্রুত মন স্থির করে নিল। সে সিরিলের মুখের দিকে তাকাতেই সিরিল মাথা নাড়ল। যেন তার মনের কথা সিরিল বুঝে নিয়েছে। যতটা সম্ভব নিরাসক্ত মুখ করে জিপের কাছে এগিয়ে গেল। ভেতরে মহাদেবদা যেন কিছুটা আন্দাজ করেই উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। ড্রাইভার ওদের দেখছে। জিপের বাইরে দাঁড়িয়েই করুণাসিন্ধু বলল, ‘আপনি নেমে আসুন। আমি আর সময় নষ্ট করতে রাজি নই।’
হতভম্ব মহাদেবদার গলা শোনা গেল, ‘কী হল?’
ততক্ষণে অনিমেষরা করুণাসিন্ধুর পেছনে এসে গেছে। এবং কিছু বোঝার আগেই সিরিল ঝাঁপিয়ে পড়ল। সামনে করুণাসিন্ধুর গলায় হাতের প্যাঁচ দিয়ে পেছনে টানার চেষ্টা করতেই সে ঘুরে লাথি মারতে চাইল। কিন্তু সিরিল আরও চটপটে। সে দু’হাত এক করে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল করুণাসিন্ধুর মাথায়। ওরকম রোগা ছেলে যে এমন জোরে আঘাত করতে পারে তা অনিমেষ ভাবতে পারেনি। দেখা গেল করুণাসিন্ধুর শরীরটা টলতে টলতে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ল। অনিমেষ দেখল সিরিলের কালো মুখে আবার মুক্তো ঝলসাচ্ছে।
ড্রাইভার ব্যাপারটা দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিল। করুণাসিন্ধু পড়ে যেতেই সে ইঞ্জিনটা চালু করল। কিন্তু অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে রিভলবার ঠেসে ধরল, ‘যা বলব তা না-শুনলে মরতে হবে তোমাকে।’
রিভলবার দেখে লোকটা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে সে জানাতে চাইল সে কথা শুনবে। অনিমেষ রিভলবারটা মহাদেবদার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটার দিকে লক্ষ রাখুন, আমরা ওটার ব্যবস্থা করছি।’
করুণাসিন্ধুর শরীরটাকে ওরা দু’জনে ধরাধরি করে রাস্তা থেকে নেমে এল। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে এখন বেশ অন্ধকার। মানুষের চোখের আড়ালে ওরা করুণাসিন্ধুকে শুইয়ে দিল। তারপর জিপে ফিরে আসতেই খেয়াল হল আর-একজনের কথা। এই অবস্থায় আর কোনও ঝুটঝামেলা বাড়ানো উচিত নয়।
ছোটমালিকের নেশা কেটে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। এখনও তার চোখ বন্ধ কিন্তু মুখে অস্পষ্ট শব্দ বের হচ্ছে। ওরা তার শরীরটা নিয়ে নীচে নামতে দূরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। অনিমেষ বলল, ‘কেউ কথা বলবেন না। গাড়িটা দাঁড়ালে বলবেন ইঞ্জিনে গোলমাল হয়েছে। লোক গেছে খবর দিতে।’
দ্রুত ওরা ছোটমালিককে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। এইসময় গোঙানি শুরু হয়ে গেল। ছোটমালিক জিজ্ঞাসা করল, ‘কে, কে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে?’ অর্থাৎ এর জ্ঞান ফিরে এসেছে। মাটিতে শুইয়ে দিতেই সে উঠে বসতে চাইল। অনিমেষ আর ঝুঁকি নিল না। সজোরে একটা লাথি মারল ছোটমালিকের পেটে। কক্ করে একটা শব্দ করেই শরীরটা নিথর হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে গাড়িটা হেড লাইটের আলোয় রাস্তা আলোকিত করে হুস করে বেরিয়ে গেল। জিপটাকে তারা নিশ্চয়ই দেখেছে কিন্তু থামবার কোনও চেষ্টা করল না। অনিমেষ সিরিলকে আর-একবার করুণাসিন্ধুর খোঁজ নিতে বলল। কয়েক মিনিট বাদেই সিরিল এসে জানাল সব ঠিক আছে।
ওরা রাস্তায় উঠে এল। চারধার চুপচাপ, এমনকী ঝিঁঝিগুলোও শব্দ করছে না। এবার সিরিল চাপা গলায় বলল, ‘ড্রাইভারকে শুইয়ে দিন।’
‘গাড়ি চালাবে কে?’
‘আমি পারি!’
‘ও হ্যাঁ।’ অনিমেষের নিজের ওপরেই রাগ হল, এই উত্তেজনার সময় সে মাথাটা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। সে এগিয়ে মহাদেবদার কাছ থেকে রিভলবারটা চেয়ে নিয়ে ড্রাইভারকে বলল, ‘নেমে দাঁড়ান’।
সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড়া করে লোকটা ককিয়ে উঠল, ‘আমি কিছু জানি না বাবু, আমাকে ছেড়ে দিন।’
‘তোমাকে কিছু জানতে হবে না। নেমে এসো।’
অনিমেষের আদেশ সত্ত্বেও লোকটা হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। আর সময় নষ্ট করা যায় না। সিরিল গিয়ে ওকে টানতেই যেন গড়িয়ে নেমে এল লোকটা। ওর শরীরে ভয়েতেই কোনও শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। সিরিল ওকে ঠেলতে ঠেলতে জঙ্গলে নিয়ে চলল। অনিমেষ বুঝল তাকে যেতে হবে না। ড্রাইভারের ব্যবস্থা সিরিল একাই করবে।
এতক্ষণ মহাদেবদা চুপচাপ দেখছিলেন, এবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছেলেটা কে?’
‘ওর নাম সিরিল। খুব অ্যাকটিভ।’
‘দেখতেই পাচ্ছি। ওর জন্যে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত।’
একটু বাদেই সিরিল হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। এই অন্ধকারেও ছেলেটার ভাবভঙ্গি দেখে অনিমেষ বুঝতে পারল ওর চেহারাটা যেন আমূল পালটে গেছে। সেই নিরীহ ভাবটুকু উধাও। এসেই জিপে লাফিয়ে উঠল। অনিমেষরা জায়গা নিতেই একেবারে ইউ টার্ন করে জিপ ঘুরিয়ে ছুটে চলল হাসিমারার দিকে।
এখন গাড়িতে তিনজন কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছিল না। অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না এখন কোথায় যাওয়া যায়। আজ রাত্রের মতো একটা শেল্টার দরকার। কাল সকাল হলে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তা ছাড়া, এতক্ষণে বেশ খিদে পেয়ে গেছে। কোথাও বসে খেয়ে নেওয়া দরকার। কিন্তু এদিকে বেশি গাড়ি চলে না বলেই বোধহয় কোনও চটি নেই। খেতে হলে হাসিমারায় যেতে হবে। যদি পুলিশ তাদের গন্ধ পেয়ে থাকে তা হলে হাসিমারায় গিয়ে খাওয়া মানে যেচে জেলখানায় ঢোকা।
অনিমেষ যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘কোথায় যাওয়া যায়?’
মহাদেবদা বললেন, ‘এদিকে তোমার জানাশোনা কেউ নেই?’
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। তারপরেই ওর খেয়াল হল জলপাইগুড়িতে চলে গেলে কেমন হয়! ওখানে যে-কোনও পরিচিতের বাড়িতে কয়েকদিন থাকা যেতে পারে। নিজের বাড়ির কথা একবার মনে এলেও সে এখন মহীতোষের মুখোমুখি হতে চাইল না। কথাটা সিরিলকে বলতেই সে ঘাড় নাড়ল, ‘অতদূর যাওয়ার মতো তেল নেই বোধহয়। মুশকিলে পড়ে যেতে হবে।’
‘তা হলে?’
‘ফুন্টশিলিং-এ চলুন।’
হাসিমারা এসে গেল। এই রাতে তেমন দোকানপাট খোলা নেই। তেমাথা থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিল ওরা। ফুন্টশিলিং-এ হোটেল আছে। জায়গাটা ভুটানে। অতএব ভারতীয় পুলিশের কোনও এক্তিয়ার নেই। অনিমেষ কিছুটা স্বস্তি পেল। এ-দেশের পুলিশ ও-দেশের সরকারকে অনুরোধ করে ওদের ধরতে চাইলে অনেক সময় পাওয়া যাবে।
সামনে পেছনে কোনও গাড়ি নেই। যেন ওদের জিপটা একাই অন্ধকার সাঁতরে চলছে। কিন্তু হঠাৎ জিপটা নড়ে উঠল বেয়াদপভাবে। রাস্তার একপাশে জিপটাকে কোনওরকমে দাঁড় করিয়ে সিরিল লাফিয়ে নামল। তারপর ঘুরে এসে বিষণ্ণ গলায় জানাল, ‘তেল নেই’।
অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল। এইটুকু আসতেই তেল যদি শেষ হয়ে যায় তা হলে সে কীভাবে জলপাইগুড়ি যেত? ওরা জিপ থেকে নেমে এল। গাঢ় অন্ধকারেও আকাশের রং পরিষ্কার থাকে। তার নিজস্ব আলোয় মানুষ অভ্যস্ত হলে পরস্পরের মুখ বোঝা যায়। অনিমেষ সিরিলকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এদিকে কোনও পাম্প নেই?’
‘জানি না।’
মহাদেবদা বললেন, ‘থাকলেও সেখানে যাওয়া সেফ হবে না। ফুন্টশিলিং এখান থেকে কতদূর?’
দেখা গেল সঠিক আন্দাজ কারও নেই। তবু যেটুকু আঁচ করা যায় তাতে এখন হাঁটা শুরু করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
মহাদেবদা বললেন, ‘জিপটার কী গতি হবে? এটা এখানে থাকলে পুলিশ আমাদের হদিশ জেনে যাবে।’
কথাটা শোনামাত্র অনিমেষ স্থির হল। করুণাসিন্ধুর জ্ঞান ফিরে আসতে নিশ্চয়ই দেরি হবে না। আর তারপরেই সে পুলিশের মন পাওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগবে। এই রাত্রেই পুলিশ যদি বেরিয়ে পড়ে তা হলে হদিশ পেতে দেরি হবে না। কথাটা মাথায় আসামাত্রই দূরে হেডলাইট দেখা গেল। ওরা আর জিপের কাছে না-দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে রাস্তার পাশে গাছের আড়ালে চলে এল। দু’ধার আলোয় ভাসাতে ভাসাতে একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটা বেশ স্পিডে খানিক এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর হেডলাইট জ্বালা অবস্থায় ব্যাক করে এল ওদের জিপটার কাছে।
রাস্তা থেকে বেশি দূরে না-থাকায় স্পষ্ট গলা কানে এল, ‘জিপটা এভাবে পড়ে আছে কেন?’
‘বোধহয় খারাপ হয়ে আছে।’
‘কিন্তু এখানে খারাপ হবে কেন? নাম্বারটা আমার চেনা। নেমে দেখো তো কী ব্যাপার!’
‘খারাপ হয়েছে স্যার, না-হলে লোক থাকত।’
‘দূর, যা বলছি তাই করো। এটা কনট্রাক্টরবাবুর জিপ।’
বোঝা যাচ্ছে বেশ অনিচ্ছায় একটি লোক নেমে এল গাড়ি থেকে। অনিমেষ শক্ত হয়ে দাঁড়াল। গাড়িটা পুলিশের। এই রাত্রে এ পথে পুলিশের গাড়ি কেন এল তার মাথায় ঢুকছে না। অনিচ্ছুক লোকটা বাতিল জিপের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে বলল, ‘কেউ নেই স্যার।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি, চাবি আছে?’
‘হ্যাঁ স্যার আছে।’ বলে লোকটা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। তারপর ইঞ্জিনের বিকট একটা গোঙানি শোনা গেল। সেটাকে থামিয়ে লোকটা নিশ্চিন্ত গলায় জানাল, ‘তেল নেই বলে এখানে রেখে গেছে। গাড়ি অলরাইট।’
‘তেল নেই? যারা এসেছিল তারা জানত না তেল নেই?’
‘বোধহয়।’
‘কিন্তু যাওয়ার সময় তো গাড়িটাকে দেখিনি!’
‘তা ঠিক স্যার। তবে এ নিয়ে ভাববার কী আছে?’ বাতিল জিপ থেকে লোকটা নেমে এসে নিজেদের গাড়ির দিকে এগোল। কিন্তু অফিসার তাকে আবার ফিরিয়ে দিল, ‘চাবিটা নিয়ে এসো। তেল আনতে কেউ চাবি ফেলে গেছে বলে কখনও শুনিনি। সামথিং ফিশি ব্যাপার আছে। চলো গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি।’ ওদের গাড়ি থেকে চাবি খুলে নিয়ে লোকটা ফিরে যেতেই গাড়িটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল হাসিমারার দিকে।
আবার সব চুপচাপ, অন্ধকার আরও ঘন হয়ে নির্জনতা আনল। ওরা রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে পাশাপাশি দাঁড়াল।
অনিমেষ বলল, ‘আর ঘণ্টাখানেক সময় পাওয়া যেতে পারে, তার মধ্যে এই এলাকা ছেড়ে যেতে হবে আমাদের।’
সিরিল বলল, ‘রাস্তা দিয়ে তো হাঁটা যাবে না।’
মহাদেবদা বললেন, ‘ওরা কিন্তু সহজেই বুঝবে আমরা ফুন্টশিলিং-এ গিয়েছি। যাদের জঙ্গলে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাদের স্টেটমেন্ট পেয়ে গেলে তো আর কোনও কথা নেই। ফুন্টশিলিংটা অ্যাভয়েড করাই ভাল।’
অনিমেষ একটু উত্তেজিত হল, ‘ফুন্টশিলিং অ্যাভয়েড করবেন আবার এদিকে হাসিমারাতেও যাওয়া যাবে না। তা হলে?’
মহাদেবদা হাসলেন, ‘উত্তেজিত হয়ো না। ভেবে দেখো, এই অবস্থায় হাসিমারাই আমাদের পক্ষে নিরাপদ। কারণ ওরা ভাববেই না যে ওদের নাকের ডগায় আমরা যেতে পারি।’
হঠাৎ একটা গোঁ গোঁ শব্দ কানে বাজল। পায়ের তলায় পথটা কাঁপছে। সিরিল হাত দিয়ে রাস্তাটা ছুঁয়ে বলল, ‘ফুন্টশিলিং থেকে একটা গাড়ি আসছে।’
মহাদেবদা বললেন, ‘সাধারণ গাড়ি হলে লিফ্ট চাওয়া যায় না?’
সিরিল হাসল, ‘এরকম ফাঁকা জায়গায় থামাবেই না।’
অনিমেষ বলল, ‘ওটাকে থামাতে হবে। দরকার হলে গায়ের জোরে ওই গাড়িতে উঠতে হবে।’
মহাদেবদা বললেন, ‘কীভাবে করবে? ওটা তো স্পিডে আসছে। হাত দেখালে থামবে?’
সিরিল মাথা নাড়ল। তারপর অনিমেষকে বলল, ‘মনে হচ্ছে লরি আসছে। কোনওভাবেই থামাতে পারবেন না। রাত্তিরে ওরা অচেনা লোককে ভয় পায়। তার চেয়ে চলুন হাঁটতে শুরু করি।’
ততক্ষণে গাড়ির হেডলাইট ডাইনির চোখের মতো জ্বলছে অন্ধকারে। ক্রমশ গর্জন করে গাড়িটা ছুটে এল। ওরা জিপটার আড়ালে দাঁড়িয়ে গাড়িটাকে চলে যেতে দেখল। একটা মালবোঝাই লরি।
কোন দিকে যাচ্ছে ওরা কেউ জানে না। কিন্তু মূল পিচের পথটা ছাড়িয়ে এসেছে ওরা অনেকক্ষণ। এদিকে জঙ্গল তেমন গভীর নয় কিন্তু ডুয়ার্সের বনের মধ্যে দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাঁটা যায় না। অনিমেষের শরীর ক্লান্তিতে টলছিল। সিরিল আগে আগে যাচ্ছে, মাঝখানে মহাদেবদা পেছনে অনিমেষ। নিজের শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বুঝলেও অনিমেষ মুখে প্রকাশ করেনি। কারণ মহাদেবদার পক্ষে এই দুর্গম পথে হাঁটা যে অসম্ভব হয়ে পড়ছে এটা ওরা টের পাচ্ছিল। চটি এবং ধুতি পরে এভাবে জঙ্গলে হাঁটা যায় না। পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে ওদের। একসময় মহাদেবদা ভেঙে পড়লেন। মাটিতে উবু হয়ে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন। অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল?’ মহাদেবদা কোনও শব্দ করলেন না। অনিমেষ ওঁর শরীরে হাত দিল, বেশ গরম। মহাদেবদার জ্বর হয়েছে?
সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি হাঁটতে পারবেন?’
এবার মাথা নাড়লেন মহাদেবদা, ‘না।’
‘তা হলে?’
‘তোমরা এগোও, আমি ভোর অবধি এখানেই বিশ্রাম নিই।’
‘তা কি হয়! এই জঙ্গলে কী বিপদ আছে জানি না, তা ছাড়া আপনাকে আমরা ছেড়ে যেতে পারি না।’
হঠাৎ সিরিল মহাদেবদার দুই বগলে হাত দিয়ে ওঁকে সোজা করে দাঁড় করাল, ‘আপনি আমার পিঠে উঠুন।’
মহাদেবদা চমকে উঠলেন, ‘না। তা হয় না!’
‘কেন হবে না? আপনার বয়স হয়েছে আর ওজনও বেশি নয়। আমার মাল বয়ে নেবার অভ্যেস আছে।’ কথা শেষ করে মহাদেবদার আপত্তি সত্ত্বেও সিরিল ওঁকে পিঠে তুলে নিল। অনিমেষ অবাক চোখে ব্যাপারটা দেখল। এই কালো প্রায়-অশিক্ষিত ছেলেটি প্রতি মুহূর্তে তাকে নতুন করে শিক্ষা দিচ্ছে। ওর পিঠে উঠেও মহাদেবদা আপত্তি জানাচ্ছিলেন। সিরিল স্বচ্ছন্দ গলায় বলল, ‘চলুন। আপনি আগে যান।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?’
সিরিল হাসল, ‘জানি না।’
সারাটা জঙ্গল যেন ওরা মাড়িয়ে এল। যদিও মাঝে মাঝেই ওরা বিশ্রাম নিয়েছে কিন্তু অনিমেষের মনে হল ওর শরীরে এখন একটুও শক্তি নেই। মাথা ঘুরছে, খিদে এবং পরিশ্রমে শরীর টলছে। এদিকে আকাশ এখন প্রায় পরিষ্কার। অন্ধকার চলে যাওয়ার আগে সামান্য সময় ধন্ধ বাড়ায়। এটি সেই মুহূর্ত। টলতে টলতে অনিমেষ এগোচ্ছিল। পেছনে সিরিলের দিকে তাকাবার সাহস কিংবা ইচ্ছে ওর নেই। একটা প্রমাণ সাইজের মানুষকে কী অবলীলায় বয়ে আনছে ওই ছিপছিপে ছেলেটা, একটুও কষ্টের কথা বলেনি। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষের চোখের সামনে সব টলছিল এখন। কোমর থেকে পা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে হঠাৎ চোখ বন্ধ করল। সামনে ওটা কী? পেছন থেকে সিরিলের গলা পাওয়া গেল, ‘ব্যস, আ গিয়া।’
অনিমেষ নিজের দৃষ্টি কয়েকবারের চেষ্টায় সহজ করে ভালভাবে তাকাল। একটা ছোট্ট একতলা ঘর। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা জঙ্গলের শেষ। ঘরটা যে একটা স্টেশন তা বুঝতে অসুবিধে হল না। কারণ ও পাশে রেললাইন দেখা যাচ্ছে। দু’-তিনটে লোক এই প্রায়-ভোর-হওয়া সময়টায় প্রায় গুটিসুটি মেরে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। কোনও রেলের লোককে নজরে পড়ল না।
সিরিল মহাদেবদাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিতেই অনিমেষ দেখল ওর মুখ ফ্যাকাশে। মহাদেবদা এখন অনেকটা সুস্থ কিন্তু ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। যেন এতক্ষণ পিঠে বোঝা ছিল বলেই সে চলতে পারছিল, বোঝা নামিয়ে সে বেসামাল হয়ে পড়েছে। সিরিলের কাঁধে হাত দিল অনিমেষ , ‘কী হয়েছে?’
মাথা নাড়ল সে, ‘কিছু হয়নি।’
জোর করে ওকে মাটিতে বসিয়ে অনিমেষ নিজেও বসল। এখানে কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই। যেহেতু জায়গাটার হালচাল বোঝা যাচ্ছে না তাই সামান্য সময় অপেক্ষা করা দরকার।
মহাদেবদা বললেন, ‘কোনও ট্রেন এলে উঠে পড়তে হবে। কোনদিকে যাচ্ছে জানার দরকার নেই। এই এলাকাটা অবিলম্বে ছাড়া দরকার।’
‘মনে হচ্ছে বাঁ দিকটা শিলিগুড়ি, ডান দিকটায় অসমের পথ।’
‘অসম! এখান থেকে আলিপুরদুয়ার কতক্ষণ লাগবে?’
‘ঘণ্টা দুয়েক।’
‘গুড। চলো ওখানেই যাই। তুষার সেন ওখানে থাকে, স্কুলে পড়ায়। ওটা খুব ভাল শেল্টার হবে।’
‘তিনজনেই যেতে পারব?’
‘হ্যাঁ। ওর বাড়িতে বুড়ি মা ছাড়া লোকজন নেই।’
ঠিক এইসময় একটা জিপ সজোরে এসে ব্রেক চাপল স্টেশনের সামনে।
তিন-চারজন পুলিশ লাফিয়ে নেমে স্টেশনে ঢুকে গেল। হাঁকাহাঁকির পর দেখা গেল রেলের লোকজন বেরিয়ে এসেছে। অফিসার কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। অনিমেষরা পাথরের মতো চুপচাপ ওদের দেখল। সন্দেহ না-থাকলে ওরা এখানে আসবে না এবং শেষ পর্যন্ত নীচ থেকেই ওরা ঘুরে গেল। এ সবই যে তাদের তল্লাশে তা বুঝতে অসুবিধে হল না।
শেষ পর্যন্ত পুলিশের গাড়িটা ফিরে গেল কিন্তু যাওয়ার আগে দু’জন কনস্টেবলকে এখানে রেখে গেল। একজনের হাতে রাইফেল অন্যজনের হাতিয়ার লাঠি। মিনিট কয়েক তারা খুব আগ্রহের সঙ্গে পায়চারি করে শেষ পর্যন্ত পাশাপাশি বসে গল্প করতে লাগল।
মহাদেবদা বললেন, ‘ঝুঁকি নিতেই হবে। এদের সামনে দিয়েই ট্রেনে উঠতে হবে। মনে হচ্ছে ম্যানেজ করা যাবে।’
সিরিল কী বুঝল বোঝা গেল না, আস্তে আস্তে উঠে নীচে নামতে লাগল। অনিমেষ চাপা গলায় তাকে ডাকলেও ততক্ষণে সিরিল নেমে গেছে। যেন কোনও উত্তেজনার সঙ্গে সংস্রব নেই এমন ভঙ্গিতে স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগল সে। অনিমেষরা দেখছিল ওকে। কনস্টেবলের সামনে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করল সিরিল। বেশ বিরক্ত হয়ে কোনও উত্তর দিল না তারা। সিরিল বোকা বোকা ভাব করে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। খানিক বাদেই একটু চাঞ্চল্য দেখা গেল স্টেশনে। তিন-চারজন যাত্রী ব্যগ্র চোখে বাঁদিকে তাকাচ্ছে। তারপরেই ট্রেনের হুইস্ল শোনা গেল। মহাদেবদা চাপা গলায় বললেন, ‘চলো, এগিয়ে যাই।’
দু’পায়ে যেন লোহার ওজন, অনিমেষ কোনওরকমে নীচে নেমে এল। এবার মহাদেবদাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে?’
ঘাড় নাড়ল অনিমেষ এবং সেই মুহূর্তেই পুলিশ দুটোর নজর পড়ল ওদের দিকে। বোধহয় চেহারার বিবরণ আগেই পেয়েছিল ওরা, কারণ দেখামাত্র সোজা হয়ে দাঁড়াল দু’জনেই। নিজেদের মধ্যে কথা বলেই একজন রাইফেল উঁচিয়ে চিৎকার করল, ‘হল্ট!’
অনিমেষরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। একজন রাইফেল তাগ করে দাঁড়িয়ে, অন্যজন লাঠি হাতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। এমনভাবে আসছে যে সঙ্গীর লক্ষ থেকে সে এদের আড়াল না-করে। দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল লোকটা, ‘কাঁহাসে আতা হ্যায়?’
অনিমেষের নজর তখন রাইফেলধারীর দিকে। তার পেছনে বেড়ালের পায়ে হেঁটে এসেছে সিরিল। লোকটার একাগ্র নজর এদিকেই। এক পলকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সিরিল। আচমকা আক্রমণে ছিটকে পড়ে গেল লোকটা, রাইফেলটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রিভলবার বের করে লাঠিধারীকে পাথর করে দিল অনিমেষ। তখন গাড়ি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে।
যদিও যাত্রী কম তবু সবার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটল। কিন্তু কেউ এক পা এগিয়ে এল না। অনিমেষ মহাদেবদাকে গাড়িতে উঠতে বলে সিরিলকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যেতেই অন্য পুলিশটা চোঁ চোঁ দৌড় শুরু করল। অনিমেষ যখন ওদের কাছে পৌঁছেছে তখন সিরিল মাটিতে আর তার ওপর দু’পা দিয়ে পুলিশটা বসে আছে। ওর হাত দুটো সিরিলের গলায় সাঁড়াশির মতো বসে যাচ্ছে। উন্মাদ হয়ে গেল অনিমেষ। জোরে রিভলবারের বাঁট দিয়ে আঘাত করল পুলিশটার মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল মাথা থেকে, চুপচাপ শুয়ে পড়ল লোকটা।
‘সিরিল!’ অনিমেষ চাপা গলায় ডাকল। চিত হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা। চোখ বিস্ফারিত, মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে। অনিমেষ দু’হাতে ওকে ঝাঁকাতে লাগল। একটা নিশ্বাস টেনে স্থির হয়ে গেল কালো শরীরটা। এক মুহূর্ত মাত্র, কিন্তু অনিমেষের বুকের ভিতরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। সিরিল নেই, ওদের বাঁচাতে ছেলেটা লড়ে গেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। সারা রাতের ক্লান্তির কথা আমল দেয়নি। সেই মুহূর্তে অনেক শব্দ বাজল কানে। ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে। মহাদেবদার গলা পাওয়া গেল, ‘অনিমেষ উঠে এসো।’
অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। ট্রেনটা সাপের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। কামরায় কামরায় মুখগুলো এখন ওর দিকে তাকিয়ে। রিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়ে সে ছুটে গেল ট্রেনটার দিকে। সামনে মহাদেবদার হাত, হাতটা সরে গেল। অনিমেষ পরের কামরার হাতল ধরার জন্যে লাফ দিতেই হাঁটুতে সেই ব্যথাটা আচমকা চলকে উঠল। নিজের শরীর এক পলকেই নিজের নয়, ট্রেনের গায়ে আঘাত খেয়ে নীচে গড়িয়ে পড়ল অনিমেষ। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে কেন্নোর পায়ের মতো ট্রেনের চাকাগুলোকে ছুটে যেতে দেখল সে। তারপর সব অন্ধকার।
একটা রেললাইন, তার ওপরে ছোট ছোট গাছ যার ওপর আকাশটা উপুড় হয়ে আছে। এমন একটা স্থিরচিত্র দু’চোখের সামনে, অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। পরক্ষণেই মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্ত তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভবে এল। হাত চলে এল অজান্তেই, অনিমেষ চটচটে উষ্ণতা স্পর্শ করতেই আবার চোখ খুলল। আঙুলগুলো গড়িয়ে রক্ত ঝরছে। এক মুহূর্ত মাত্র, অনিমেষ চট করে সোজা হয়ে বসল। যন্ত্রণাটা এখন যত তীব্রই হোক না কেন, অনিমেষ সাদা চোখে চারধারে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। দশ-বারোজন দেহাতি মানুষ গোল হয়ে ঘিরে তাকে দেখছে। সে উঠে বসতেই একটা অস্ফুট শব্দ হল কারও কারও মুখে, ভাবটা এমন যে লোকটা বেঁচে আছে! একজন চেঁচিয়ে কাউকে ডাকল।
কোনওরকমে উঠে দাঁড়াতেই মানুষের বৃত্তটা বড় হল। অনিমেষ বুঝতে পারছিল তার আঘাত বীভৎস রকমের, কারণ লোকগুলোর চোখে দারুণ বিস্ময়। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর মাথায় চিন্তাটা চলকে উঠল। পালাতে হবে, এখান থেকে এক্ষুনি চলে যাওয়া দরকার। আশেপাশে কোথাও রেলগাড়ির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, এমনকী সেই ছুটে-যাওয়া পুলিশটাও নেই। অনিমেষের চোখের ওপর এখন একটা লালচে পরদা আসতেই সে রগড়ে নিল চোখ। ও পাশে সিরিলের শরীর মাটিতে শক্ত হয়ে পড়ে আছে, পুলিশটার দেহের পাশে।
অনিমেষ এক পা এগোতেই মানুষগুলো যেন চিন্তিত হল। কোন দিকে গেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে সে জানে না। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা বোকামি হবে। সে পা ফেলল। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, বারংবার ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে চোখ, কাঁধ থেকে মাথা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে, অনিমেষ জঙ্গলের দিকে এগোল। বৃত্তটা এর মধ্যে ভেঙে গেছে। অনিমেষ এগিয়ে যেতে লোকগুলো কৌতূহলী হয়ে ওর পেছনে হাঁটা শুরু করল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ওদের নিষেধ করতে গিয়ে উত্তেজিত হল অনিমেষ, ‘কেউ আসবে না, খবরদার বলছি, আমার সঙ্গে বোমা আছে, সবক’টাকে মেরে ফেলব!’
চিৎকারটা শুনে লোকগুলো প্রথমে থতিয়ে গেল। কিন্তু অনিমেষ হাঁটা শুরু করতেই ওরা এগোতে লাগল। সঙ্গে একটা পেনসিল-কাটা ছুরিও নেই, অনিমেষ এবার দৌড়াবার চেষ্টা করল। আর তার ফল হল বিপরীত। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো চিৎকার করে উঠল, ‘ভাগতা হ্যায়, ডাকু ভাগতা হ্যায়।’ আচম্বিতে একটা পাথর এসে ছিটকে পড়ল পিঠে। মাথা থেকে যন্ত্রণাটা যেন এবার সারা শরীরে ছড়াল। অনিমেষ ঘুরে তাকাল। লোকগুলো এবার তার দিকে ছুটে আসছে। প্রত্যেকের হাতে পাথর। সে না-তাকালে এতক্ষণে ওগুলো ছোড়া হয়ে যেত। এখন তাকাতেই হাতগুলো নেমে এল কিন্তু পাকড়ো পাকড়ো চিৎকারটা কমল না।
অনিমেষ দু’হাত জোড় করল, ‘শুনুন, আপনারা ভুল করবেন না, আমি ডাকাত নই, আমি আপনাদের মতোই একজন মানুষ। আমি নিজের জন্যে কখনও খুন করিনি। আপনারা বিশ্বাস করুন।’
‘পাকড়ো পাকড়ো, মার ডালা সিপাইকো।’ পেছনে আরও গলা পাওয়া যেতেই সামনের লোকগুলো উজ্জীবিত হল। অনিমেষ বুঝতে পারছিল এদের এখনই থামানো দরকার। সে মরিয়া হয়ে চিৎকার করল, ‘শুনুন, আমি ডাকাত নই। আমরা এই দেশের জন্য কাজ করছি। আপনাদের অবস্থা আমরা পালটাতে চাই। সারা দেশে আজ আমরা লড়ছি। আপনারা নিশ্চয়ই নকশালবাড়ির নাম শুনেছেন।’
‘ন-ক-শা-ল।’ শব্দটা অস্পষ্ট শোনা গেল মানুষগুলোর মুখে। সেই মুহূর্তে দূরে পালিয়ে যাওয়া পুলিশটাকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। সমানে চিৎকার করছে সে, ‘পাকড়ো পাকড়ো’!
অনিমেষ আবার কিছু বলতে গিয়ে হতাশ হল। সে লোকগুলোর হাত থেকে দূরে সরে যাওয়ার শেষ চেষ্টা করল। এতক্ষণে চোখ অন্ধ, রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে মুখে। অনিমেষের ছুটন্ত শরীরে ছোট ছোট পাথর ছিটকে পড়ছিল। একসময়ে মাথার পেছনটা ঝনঝন করে উঠতেই অনিমেষ বসে পড়ল। পরমুহূর্তেই অনেকগুলো হাত একসঙ্গে নেমে এল ওর শরীরে। অনিমেষ শেষবার চেষ্টা করল কথা বলতে। হাতগুলো এখন নির্মম।
সারা শরীর আগুনে পুড়ছে এমন অনুভব হল অনিমেষের। চোখ বন্ধ, চেষ্টা করেও দুটো পাতা খুলতে পারল না সে। একটু বাদে বুঝতে পারল কোনও চলন্ত জিনিসের ওপর সে শুয়ে আছে। দুর্বল একটা চিন্তাশক্তি কোনওরকমে টিকে ছিল মাথায়, সেটাকে জিইয়ে রাখতে চাইছিল সে। ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল, দু’-একবার হর্ন, কোনও ছুটন্ত গাড়িতে শুয়ে চলেছে সে। গাড়িটা কার, কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন কোনও ভাবনা মাথায় এল না। আচ্ছন্নের মতো বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যাবার পর সে কাঁধে নরম স্পর্শ পেল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে একটা কিছু তার শরীর স্পর্শ করছে বারংবার। পেটের ওপর পড়ে থাকা হাত দুটো তোলার চেষ্টা করল সে। কাঁধের কাছটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, দুটো হাত একসঙ্গে ওপরে উঠেই পড়ে গেল। কবজিতে সাড় নেই। দুটো কবজি একসঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হয়ে আছে। অর্থাৎ এখন সে বন্দি। আর-একবার চোখ খোলার চেষ্টা করল সে প্রাণপণে। অস্পষ্ট সাদা যেন সামনে ঝুলছে। সে কি অন্ধ হয়ে গেল। অনিমেষ চেষ্টা করল মনে করতে কোনও আঘাত তার চোখে লেগেছিল কিনা। ভাবতে পারছে না, কিছুই মনে পড়ছে না।
মুখ ঘোরাল সে। একটা বোধ তার হচ্ছিল, মাথার বাঁ দিকটা ফেটেছে। ডান দিক দিয়ে পাশ ফেরার চেষ্টা করল সে এবার। যে জিনিসটার সে স্পর্শ পাচ্ছে সেটা মানুষ। অথচ সেই মানুষটা এমনভাবে ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে গড়িয়ে পড়ছে যে বোঝাই যাচ্ছে তার নিজের কোনও শক্তি নেই। অনিমেষ চাপা গলায় ডাকবার চেষ্টা করল, ‘কে?’
কোনও উত্তর এল না। গাড়ির একটানা ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া কোনও কিছু কানে বাজছে না। পাশের মানুষটি কোনও সাড়া দিল না। মাথার মধ্যে ফিকে অন্ধকার হঠাৎ দুটো টুকরো হয়ে গেল। পাশের মানুষটাকেও তা হলে তারই মতো বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কে হতে পারে? চিন্তাটা স্পষ্ট হতে শক্ত হয়ে গেল সে। সিরিল নয় তো! আর কেউ তো তাদের সঙ্গে ছিল না। মহাদেবদা তো সেই ট্রেনেই চলে গেছেন। সিরিল যদি হয় তা হলে তো—! জোর করে চোখ বন্ধ করে আচমকা পাতাগুলো খুলতেই অস্পষ্ট একটা মুখ ভেসে উঠল। মুখটা যে সিরিলের তা বুঝতে অসুবিধে হল না ওর। সিরিলের মৃত শরীরের পাশে সে শুয়ে যাচ্ছে। আহ্, সিরিল! সেই উজ্জ্বল ছেলেটা! অনিমেষ চোখ বন্ধ করতেই আর একটা আওয়াজ এই প্রথম তার কানে ঢুকল। অস্ফুট যন্ত্রণার অভিব্যক্তি কারও গলায় বাজছে। মাঝে মাঝেই ককিয়ে উঠছে সে। কে হতে পারে? নির্ঘাত সেই পুলিশটা। নিশ্চয়ই তাকেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই গাড়িতে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।
গাড়িটা কখন থেমেছিল টের পায়নি অনিমেষ। স্পষ্ট একটা গলা কানে এল, ‘ডেড?’ শব্দ হল, কেউ গাড়িতে উঠল। মচমচ শব্দটা কানে যেতে অনিমেষ স্থির হয়ে গেল। বেশ জোরে কেউ লাথি মারল তার পাছায়। অনিমেষ অনেক কষ্টে শক্ত হয়ে থাকল। লোকটার গলা কানে এল, ‘মরে গেছে মনে হচ্ছে।’
‘ভাল করে দেখো।’ হুকুমটা এল বাইরে থেকে।
‘নড়ছে না। কিন্তু এখনও রক্ত বের হচ্ছে।’
‘মড়ার শরীর থেকে রক্ত বের হয় না। তা হলে বেঁচে আছে।’ একটা হাত গলা এবং বুকের ওপর কিছুক্ষণ হাতড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মরেনি স্যার, অজ্ঞান হয়ে আছে।’
‘হরমোহনের কী অবস্থা?’
‘গোঙাচ্ছে।’
‘ওটাকে নামিয়ে আনো।’
‘কাকে স্যার!’
‘নকশালটাকে। শেষ করে নিয়ে যাই।’
‘গুলি করবেন স্যার?’
‘হ্যাঁ। এখানে ধারে কাছে কেউ নেই।’
‘কী দরকার স্যার। জলপাইগুড়িতে পৌঁছোবার আগেই পাশের বডিটার মতো শক্ত হয়ে যাবে। এ কেস টিকবে না।’
‘নকশালদের তুই চিনিস না।’
‘তা হলে স্যার গাড়িতেই গুলি করুন। কষ্ট করে নামালে আবার ওঠাতে হবে তো।’
‘তা ঠিক। তবে এমনভাবে গুলি করবি যাতে গাড়িতে দাগ না হয়। বুঝলি?’
‘আমি করব স্যার?’
‘আমি তুমি আবার কী কথা? জলদি কর। করা দরকার সেটাই আসল কথা। এই শালা নকশালদের ঝাড়েবংশে শেষ করা দরকার।’
পায়ের আওয়াজ একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল। আসাটা খুব স্বচ্ছন্দ নয় বুঝতে পারা যাচ্ছিল। এবার ওরা গুলি করবে, অনিমেষ এটুকু ভাবতে পারল। গুলিটা গায়ে লাগলেই সে মরে যাবে। অথচ তার হাত নাড়ার সামান্য ক্ষমতা নেই। গুলিটির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে অনিমেষ নিজের অজান্তেই ভয়ের কথা ভুলে গেল। এই মুহূর্তে, সম্পূর্ণ অসচেতনতায় মাধবীলতার মুখ চলকে উঠল সামনে। মাধবীলতার সেই আদুরে হাসিটাকে বন্ধ চোখের পাতায় অনুভব করতে করতে কান-ফাটানো শব্দটা তার শরীর কাঁপিয়ে দিল। পেটের ভেতর আর-একটা যন্ত্রণা জন্ম নিল মাত্র। কিন্তু চোখের সামনে থেকে মাধবীলতা এখন উধাও, তার চেতনা মুছে যেতে যেতে একটা সুতোয় যেন ঝুলতে লাগল। সিপাহিটা বলল, ‘হয়ে গেছে স্যার।’
‘মরেছে?’
‘একদম পেটের ভেতরে।’
‘রক্ত পড়ছে?’
‘গলগল করে।’
‘মুছে ফেল।’
‘মুছব? মুছব কীসে?’
‘সেই জন্যেই তো বাইরে বের করে কাজটা শেষ করতে বলেছিলাম। এত কুঁড়ে হলে চলে! এখন ওই রক্তের দাগ নিয়ে তো আর ফেরা যাবে না।’
‘যেতে যেতে রক্ত বের হতেও তো পারে।’
‘তা পারে। রক্ত বের হলে আমরা কী করব। ঠিকই তো!’
‘তা হলে নামি স্যার?’
‘বেশ, নাম।’
দুটো শরীরকে ওরা পাশাপাশি রাখছিল। এমন সময় একটা গলা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘স্যার, মরেনি এখনও।’
‘মরেনি? এই যে বললি মরে গেছে।’
‘তাই তো ভেবেছিলাম তখন।’
‘ভেবেছিলাম! এরকম ভাবলে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চলে?’
‘তবে বেশিক্ষণ টিকবে না স্যার। হয়ে গেল বলে।’
‘এখন তো কিছুই করা যাবে না। পাবলিক দেখছে, এটা হাসপাতাল। এই যে, আপনারা কী দেখছেন এখানে? যান যান, নিজের কাজে যান। ডেডবডি দেখেননি কখনও? যান।— আসুন ডক্টর।’
‘দুটোই ডেড কেস?’
‘অলমোস্ট।’
‘অলমোস্ট মানে? এ দেখছি এখনও মরেনি। খুব সিরিয়াস কেস। অনেকগুলো উন্ড হয়েছে দেখছি। এই, একে তোল শিগগির।’
অফিসারের গলা শোনা গেল, ‘ঝামেলা বাড়াচ্ছেন কেন? মর্গে যেতে যেতে টেঁসে যাবে। এখন জামাই আদর করে কী লাভ?’
তা সত্ত্বেও অনিমেষ যেন টের পেল সে দোলনায় দুলছে। অথবা পালকিতে চড়ে যাচ্ছে কোথাও। শারীরিক যন্ত্রণার বোধগুলো কখন নেতিয়ে গিয়েছিল। অনন্ত শূন্যে সে যেন একা ভেসে যাচ্ছে। তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না, কাউকে কিছু করার ক্ষমতা অথবা ইচ্ছেটুকুও তার নেই। আঃ, কী আরাম!
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনিমেষ চুপচাপ দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। এখানে সে কতদিন এসেছে হিসেব নেই। যেটুকু অনুমান তাতে দুটো মাসের হিসেব সে পাচ্ছে না। জ্ঞান হবার পর শরীরের কষ্টগুলো ওকে পাগল করে তুলেছিল। এখন সেগুলো থিতিয়েছে। সবসময় অবসন্ন লাগে। আজ সকালে প্রথম পা রেখেছিল মাটিতে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শরীর টলতে লাগল। নিজেকে এখন ঝাঁঝরা লাগছে।
মাথায় চুল নেই বললেই হয়। ক’বার কামানো হয়েছে সে জানে না। ব্যান্ডেজ খুলে এখন হাওয়া লাগানো হচ্ছে। হাত দিতেই বোঝা যায় খুব বড় অপারেশন হয়ে গেছে। পেটের কাটা দাগ এখন শুকনো। কিন্তু শরীরে জোর নেই এক ফোঁটাও। যে নার্স অথবা ডাক্তার তাকে দেখতে আসেন তাঁরা কথা বলেন না বাড়তি। মেশিনের মতো কাজ করে যান তাঁরা। অনিমেষ চেষ্টা কেরও জানতে পারেনি সে কী অবস্থায় আছে। তবে দরজার দিকে তাকালেই পাহারাদার চোখে পড়ছে।
প্রথমবার পায়ে গুলি লাগার পর দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কলকাতার সেই হাসপাতালে থাকার সময় মনের ওপর চাপ পড়ত খুব। এখন একটা দিন এল কি গেল তাতে কিছুই এসে যায় না। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে চিন্তা করার ক্ষমতাটাই তার হারিয়ে গেছে। বোধ যদি ভোঁতা হয়ে যায় তখন যন্ত্রণা অনুভবে আসে না। যেমন সকাল থেকে সে একটা চিরকুট পড়ার পর থেকেই সেটা নিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। অবশ্য ঘর মোছার পর যে লোকটা ওটা এনেছিল সে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যে লিখেছে তাকে অনিমেষ মনে করতে পারছে না। আজ দুপুরে নাকি তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন নিয়ে যাবে তখন যেন সে চুপচাপ থাকে। সেখানে বেশি পুলিশ যাবে না। তাই যে চিঠি লিখেছে সে জানিয়েছে একটা চেষ্টা হবে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে। সে যেন সজাগ থাকে।
দরজার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ সকাল থেকে ব্যাপারটা ভেবে কূল পাচ্ছিল না। কেনই বা তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে কিংবা কেনই বা তাকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে? ছিনিয়ে যারা নেবে তারা কোথায় তাকে রাখবে? মুশকিল হল, এইসব ভাবনা চিরকুট পড়ার পর থেকেই মাথায় তুবড়ির মতো ফিনকি দিয়ে উঠেই নিবে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ ভাবলেই কান-মাথা গরম হয়ে শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে।
‘এখন কেমন আছ হে?’
একটি বয়স্ক গলা জুতোয় শব্দ তুলে পাশে এসে দাঁড়াল। অনিমেষ তার ইউনিফর্মটা দেখল। মোটাসোটা লোকটার কোমরে রিভলবার ঝুলছে। অনিমেষ মুখ ফেরাল। লোকটি হিকহিক করে একটু হাসল, ‘নাও, মুক্তি। ডাক্তার তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে। এবার শ্বশুরবাড়িতে চলো। ওঠো।’
কোনও প্রতিবাদ না-করে অনিমেষ উঠে বসতে চেষ্টা করল। শরীর কাঁপছে। লোকটা বলল, ‘এখনও কাহিল দেখছি। আরে বাবা মিছিমিছি কষ্ট করছ তুমি। আমার সঙ্গে হাত মেলাও দেখবে তুমি ড্যাং ড্যাড্যাং করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছ। কী, হাত মেলাবে?’
অনিমেষ তাকাল লোকটার দিকে। কী বলতে চাইছে ধরতে পারল না সে। লোকটা ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘মহাদেব কোথায়?’
মহাদেব! অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল। মহাদেব কে? তারপরেই মহাদেবদার কথা মনে পড়ল। মহাদেবদা রেলের কামরায় দাঁড়িয়ে তাকে চিৎকার করে ডাকছিলেন। সেই মহাদেবদার কথা জিজ্ঞাসা করছে এরা। অনিমেষ আর কিছু ভাবতে না পারলেও এটা স্থির করতে পারল মহাদেবদার কথা কিছুেতই বলা উচিত নয়। সে নীরবে মাথা নাড়ল। জানি না।
‘হারামির বাচ্চা! একশো বার প্রশ্ন করলাম তবু এক উত্তর। মেরে পেছনের ছাল ছাড়িয়ে নেব যখন তখন বুঝতে পারবে। আরে বাবা, বলেই ফেলো না বাবা লোকটা কোথায় লুকিয়েছে? কেউ জানতে পারবে না, মাইরি বলছি, আমার প্রমোশনটাও হয়ে যাবে আর তুমিও ছাড়া পেয়ে যাবে। বলো ভাই!’ লোকটি ওর কাঁধে হাত রাখল। কিন্তু অনিমেষ ততক্ষণে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এই প্রশ্নটা তাকে অনেকবার করা হয়েছে? কিন্তু তার এ-কথা একটুও মনে পড়ছে না কেন? স্মৃতিশক্তি কি একদম অকেজো হয়ে গেছে! অনিমেষ চোখ বন্ধ করল।
‘তোমরা তো একসঙ্গে হাসিমারা থেকে হাওয়া হয়েছিলে। আরে বাবা, ওই করুণাসিন্ধু সে-কথা আমাদের বলেছে। মহাদেব ট্রেনে উঠে পড়েছিল, তুমি পারোনি। লোকটা কী স্বার্থপর দেখো, তোমাকে একা ফেলে বেশ কেটে পড়ল। তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে সেইটে বলে দাও ভাই।’
অনিমেষ চোখ খুলল, ‘আমি জানি না।’
নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা লাগল তার। সরু এবং কাঁপা কাঁপা হয়ে গেছে কখন।
‘শালা! সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না দেখছি। তখনই টেঁসিয়ে দিলে ভাল হত। ঠিক আছে, এক ঘণ্টা সময় দিলাম, এর মধ্যে ভেবে দেখো বলবে কি না। তারপর তোমার হচ্ছে। এখন ওঠো, থিয়েটার করে আসবে চলো।’
থিয়েটার! অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাতেই লোকটা ওর কাঁধ ধরে টেনে দাঁড় করাল। সমস্ত শরীরে ঝনঝনানি শুরু হয়ে গেল তার। এবার পেছন থেকে একটা লোক এগিয়ে এসে ওর কোমরে একটা দড়ির ফাঁস পরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে টানতে লাগল।
তাল রাখেত অনিমেষের অসুবিধে হচ্ছিল। সুতো-কাটা ঘুড়ির মতো সে টাল খাচ্ছিল। অফিসার ওর পাশে হেঁটে এসে নিজের মনেই বলল, ‘মালের হাল যা দেখছি তাতে হাতকড়া পরাবার কোনও দরকার নেই।’ তারপর গলা চড়িয়ে বলল, ‘গাড়িতে তোল। যত আদিখ্যেতা হয়েছে আজকাল। কেউ মরলেই নিয়ে যেতে হবে দেখাতে।’
গাড়ির দরজা ধরে নিজেকে সামলাল অনিমেষ। কে মরেছে? সে অফিসারের দিকে তাকাতেই তাকে প্রায় তুলে ভ্যানের পেছনে ফেলে দেওয়া হল। দুটো সিপাই বন্দুক নিয়ে ওর সঙ্গে উঠল। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হওয়ামাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কিছুক্ষণ চেষ্টার পর নিজেকে সামলাতে পারল অনিমেষ। পুলিশ দুটো নির্বিকার মুখে বসে আছে। মাথার পাশে ছোট্ট জানলার মতো চৌকো গর্ত। অনিমেষ তাতে চোখ রাখল। দিনবাজার ছাড়িয়ে শিল্প-সমিতিপাড়ার দিকে যাচ্ছে গাড়ি। দু’ধারে নির্বিকার লোকজন হাঁটছে বা আড্ডা মারছে। দেওয়ালের গায়ে গায়ে লেখা “নকশালবাড়ি লাল সেলাম”।
একসময় গাড়ি থামল। সিপাই দুটো দরজা খুলে নীচে নেমে দড়ি ধরে টানতে অনিমেষ নেমে এল। এই সময় অফিসারটি হাসতে হাসতে এসে ওর হাতে হাতকড়া পরিয়ে বলল, “যাও, শেষবার দেখে নাও। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে যেতে হবে।’
অনিমেষ গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেই লোকজন দেখতে পেল। সবাই চুপচাপ বসে আছে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চিতা সাজানো হয়ে গেছে। চিতার পাশেই মাটিতে কাপড়ের ওপর একটি দেহ শুয়ে আছে। সিপাই ওকে দড়ি ধরে টেনে নিয়ে এল শরীরটির কাছে। অনিমেষ পাথর হয়ে গেল।
সরিৎশেখর শুয়ে আছেন। খুব স্বাভাবিক মুখের চেহারা, যেন ঘুমাচ্ছেন। তাঁর শরীর একটা কাপড়ে বুক অবধি ঢাকা, চোখ বন্ধ। দাদু মারা গেছেন? অনিমেষের চিবুক বুকের ওপর নেমে এল। ঠিক সেই সময় অনিমেষ কনুইতে হাতের স্পর্শ পেল। অনিমেষ মুখ তুলল, ছোটমা।
ছোটমায়ের মাথায় ঘোমটা, মুখ পাথরের মতো। নিচু গলায় বলল, ‘কাছে চলো। তোমার জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছিল।’
আচ্ছন্নের মতো অনিমেষ ছোটমায়ের সঙ্গে দাদুর পাশে এসে দাঁড়াল। দুটো চন্দনমাখা তুলসীপাতা দাদুর চোখে লাগানো। অনিমেষের বুকের ভেতর হুহু করছিল কিন্তু আশ্চর্য, তার চোখে জল আসছিল না। কাঁদতে চাইছিল সে কিন্তু কিছুতেই কান্না আসছিল না। ছোটমায়ের গলা শুনতে পেল সে, ‘উনি তোমাকে দু’দিন দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু ওরা দেখতে দেয়নি। তবে উনি জেনে গেছেন তুমি ভাল হয়ে গেছ।’
এইসময় শ্মশানবন্ধুরা দাদুর শরীরটাকে চিতায় শোওয়াবার ব্যবস্থা করতে লাগল। ছোটমা অনিমেষের বাজু থেকে হাত সরায়নি। চাপা গলায় বলল, ‘তোমাকে মুখাগ্নি করতে হবে।’ অনিমেষ ছোটমায়ের দিকে তাকাল। ছোটমা বলল, ‘তোমার দাদুর শেষ ইচ্ছে তাই।’
অনিমেষ মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। বেশ কিছুটা দূরে মহীতোষ বসে আছেন দু’হাতে মুখ ঢেকে। বাবার কাছে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে ওর। কিন্তু ছোটমা ওকে চিতার পাশে টেনে নিয়ে গেল। দাদুর শরীর আগুনের অপেক্ষায়। ছোটমা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘দু’মিনিটের জন্যে হাতকড়া খোলা যাবে না?’ অফিসারটির গলা শোনা গেল, ‘হাতকড়াতে কোনও অসুবিধা হবে না।’
‘আপনারা কি মানুষ!’ হিসহিস করে উঠল ছোটমা।
হাতকড়া পরা অবস্থায় মুখাগ্নি করল অনিমেষ। চিতা জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। হঠাৎ অনিমেষের চোখের সামনে বহু বছর আগের সেই ছবিটা ছিটকে চলে এল। এই শ্মশানে সে একদিন মায়ের মুখে আগুন ছুঁইয়েছিল। মায়ের শরীরের রক্ত তার হাতে শুকিয়েছিল । লাল আগুনের আড়াল থেকে মায়ের ছড়ানো চুল দেখা যাচ্ছিল। সেদিন সে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। মহীতোষ তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। আজ, দাদুর চিতার দিকে তাকিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সেই প্রিয় শরীরটা, জন্ম থেকেই যা ছিল তার আশ্রয় তা এখন কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে আগুনে। চোখ বন্ধ করল সে।
হরিধ্বনি চলছিল তখনও। এমন সময় কানের পাশে ফিসফিসে গলা পেল অনিমেষ, ‘কোমরের দড়িটা কেটে দিলেই আপনি ডান দিকে দৌড়ে যাবেন। ওখানে গাড়ি স্টার্ট করা আছে। আমরা ওদের বোম মারব।’
চিতায় কাঠ শব্দ করে ফাটছে। অনিমেষ বিস্ময়ে ছেলেটির দিকে তাকাল। শ্মশান বন্ধুদের মধ্যে একজন এরকম পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছে! কিন্তু সে দৌড়ে যাবে কী করে? স্বাভাবিক ভাবেই সে হাঁটতে পারছে না। তা হলে? সে মাথা নাড়ল, না। ছেলেটি বলল, ‘সে কী! সবাই রেডি, এখন না বলছেন কেন?
‘আমি পারব না।’
‘বোকামি করবেন না।’
অনিমেষ পেছনের দিকে তাকাল। পুলিশ দুটো অন্যমনস্ক হয়ে চিতার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু অফিসারের একটা হাত কোমরে ঝোলানো রিভলবারের ওপর। চোখ তার দিকে সতর্ক। অনিমেষ বুঝতে পারল পালিয়ে যাওয়ামাত্র তাকে গুলি খেতে হবে। এখন তার শরীরের যা অবস্থা তাতে গুলির হাত থেকে রক্ষা পাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শুধু তাকে মেরেই এরা শান্ত হবে না, যারা এই পরিকল্পনা করেছে তারাও বিপদে পড়বে। অনিমেষ এটুকু ভাবতে পারল এটা খুব বোকামি হবে। হ্যাঁ, হঠকারিতা বোধহয় একেই বলে। নিজের জন্যে সে চিন্তা করছে না, এই ছেলেগুলোকে বিপদে পড়তে সাহায্য করা কিছুতেই উচিত হবে না। সে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে অফিসারটির দিকে এগিয়ে গেল, ‘চলুন’।
অফিসার বলল, ‘ছোঁড়াটা তোমাকে কী বলছিল?’
‘আমার শরীরের কথা জিজ্ঞাসা করছিল। চলুন।’
‘ভাবভঙ্গি ডাউটফুল। পরে দেখব। এই, চলে এসো সব।’ অফিসার গাড়ির দিকে এগোলেন। অনিমেষের মাথার ভেতরটা টনটন করছিল। মাঝে মাঝেই সব সাদা হয়ে যাচ্ছে। গাড়ির দরজায় হাত রেখে ওর মহীতোষের কথা মনে পড়ল। এখন দূরত্বটা অনেক বেড়ে গেছে। বাঁদিকে নদীর গায়ে দাদুর শরীর এখন পূর্ণ-আগুনে গলে গলে পড়ছে। ডানদিকে সেই একই অবস্থায় মহীতোষ বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি এখন অনিমেষের দিকে। চোখাচোখি হলেও চোখ সরিয়ে নিলেন না। বিমর্ষ ওই চোখ দুটো যেন অনিমেষকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল। বাবার সঙ্গে কোনওদিনই তার আন্তরিক সম্পর্ক হয়নি। কিন্তু বাবা একলা, খুব একলা এ-কথা অনিমেষ বুঝল। আজ পুলিশের ভ্যানে ওঠার সময় সে যেন এই বোঝার ব্যাপারটা বাবাকে নতুন করে বোঝাতে পারলে খুশি হত। এইসময় সে ছোটমাকে এগিয়ে আসতে দেখল। পেছনে চিতার উজ্জ্বল আলোর পটভূমিতে ছোটমাকে খুব দীপ্ত দেখাচ্ছে। ভ্যানের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল ছোটমা, ‘ওকে শ্রাদ্ধের দিন বাড়িতে আনা যাবে।’
অফিসার ঘাড় নাড়ল, ‘না।’
‘কেন?’
‘পরশু ওকে কলকাতায় চালান করা হবে। ডেঞ্জারাস এলিমেন্ট তো। ওঠো, উঠে পড়ো।’
অনিমেষ ভ্যানে উঠে বসামাত্র সিপাই দুটো দরজা বন্ধ করল। তারের জানলার মতো ফোকর দিয়ে অনিমেষ বাইরে তাকাতেই চিতাটাকে চোখে পড়ল। দাদুর শরীর আর চেনা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই একটা গোল পিণ্ডের মতো হয়ে গেছেন সরিৎশেখর। দাদু নেই। দাদুর চলে যাওয়াতে ওর কোনও কষ্ট হচ্ছে না। শেষ সময়ে উনি যে কষ্ট পাচ্ছিলেন তার চেয়ে চলে যাওয়া ওঁর পক্ষে এনক ভাল হল। কিন্তু মুখাগ্নিটা ওকেই করতে বলে গিয়েছিলেন কেন? তার এত কথা জানার পরও কি দাদুর কোনও মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়নি? বাবা মহীতোষের যে তার সম্পর্কে অভিমান রাগ কিংবা আক্ষেপ হয়েছে একথা স্পষ্ট। কিন্তু দাদু কি তাকে সমর্থন করতেন?
চিতাটা এখন চোখের আড়ালে চলে গেছে। পিচের রাস্তায় উঠে এসেছে গাড়ি। এমন সময় কান ফাটানো শব্দ হল। গাড়িটা সামান্য নড়ে উঠল, বোধহয় সামনের কাচগুলোই ঝনঝন করে পড়ে গেল। অনিমেষের পাশে বসা সিপাই দুটো চেঁচিয়ে উঠল, ‘বোমা মারতেছে।’
দরজাটা ভাল করে এঁটে অনিমেষকে আঁকড়ে ধরে বসে রইল ওরা। পুলিশভ্যানের ওপর বোম চার্জ হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে পালটা ফায়ারিং-এর শব্দ কানে এল। বোধহয় সামনের সিটে বসে থাকা অফিসার গুলি ছুড়ছেন। ড্রাইভার বোধহয় আচমকা আক্রমণেই গতি কমিয়েছিল, এখন সেটা বাড়িয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব হারিয়ে গেল। শহরের মধ্যে এসে গাড়িটা খুব শান্ত ভঙ্গিতে চলতে লাগল। অনিমেষ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করল। আর তখনই আচম্বিতে দু’চোখ থেকে জল গড়িয়ে এল গালে। ওরা ওকে ভালবেসেই ছাড়িয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু শুধু ভালবাসা কখনওই ধারালো হয় না যদি তাতে বাস্তবের শান না-দেওয়া থাকে। ঠোকর খাওয়ার আগে আমরা যে সেটা বুঝতেই চাই না।
হাসপাতালে নয়, জলপাইগুড়ি থানায় এসে থামল ভ্যানটা। প্রথমে বেশ উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পেল অনিমেষ। মানুষজনের ছুটোছুটি, গাড়ির আওয়াজ থেকে বোঝা গেল আর-একদল ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। অনিমেষের পাশের সিপাই দুটো দরজা খুলে নেমে দাঁড়িয়েছিল। এইসময় অফিসার ওদের কাছে এলেন, ‘গর্তে মুখ লুকিয়ে ছিলি কেন তোরা? ফায়ার করতে পারিসনি?’
‘কী করে করব? গাড়ি যে থামেনি।’
‘থামেনি! এই করে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালানো যায়? এই যে হিরো, নেমে এসো। এবার তোমার চামড়া দিয়ে তবলা বানাব। বন্ধুদের দিয়ে আমার ওপর বোম মারানো হচ্ছিল! পালিয়ে যাওয়ার মতলব? নামো!’ চিৎকার করে উঠল অফিসার।
অনিমেষ এটুকু বুঝতে পারছিল তার ওপর ঝড় নেমে আসছে। কিন্তু যতটা পারা যায় নিজেকে ততটা নির্লিপ্ত রাখতে চাইছিল সে। কিন্তু ভ্যান থেকে নামতে গিয়েই মাথাটা এমন টলে উঠল যে, সে তাল রাখতে পারল না। হুড়মুড় করে পড়তে পড়তে সে একবার মাত্র আকাশটাকে দেখতে পেল।
স্যাঁতসেঁতে মাটির উপর অনিমেষ শুয়ে ছিল। জ্ঞান ফিরতেই বুঝতে পারল তার হাত এবং পা ভাল করে বাঁধা। তবে ঘরটায় আলো আসছে। প্রথমে ওর মাথায় একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এল না, বরং পেট চিনচিন করছে, বেশ ক্ষুধা বোধ হল তার। এখন বোধহয় বিকেল। কারণ ক্রমশ আলো কমে আসছিল। এইসময় লোহার দরজা খুলে অফিসারটি ঘরে ঢুকল, ‘ঘুম ভাঙল?’
অনিমেষ কোনওরকমে উঠে বসল, বসে বলল, ‘খাবার দিন।’
‘খাবার! ও গড। তোমার খাবার দরকার। খিদে পায় তা হলে! কী খাবে, এখানে যা পাওয়া যায় সব এনে দেব! মহাদেব কোথায়?’ লোকটা পা ফাঁক করে ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
‘এক প্রশ্ন বারবার করছেন কেন?’
চাবুকের মতো হাতটা নেমে এল, ‘অ্যাই বাঞ্চোত, বলবি কিনা বল।’
প্রচণ্ড যন্ত্রণা মাথা থেকে ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ল। অনিমেষ দাঁতে দাঁত টিপে সামলাতে থাকল নিজেকে। তার মুখ হাতের টানে এখন ওপরের দিকে। অফিসার গরগর করল, ‘সবক’টাকে ধরব আজ। পুলিশকে মারার তাল হচ্ছিল। বিপ্লব করছেন। পেচ্ছাপ করে দিই বিপ্লবের মুখে। হাঁ কর হাঁ কর বলছি।’
হঠাৎ শরীরের মধ্যে অস্থিরতা টের পেল অনিমেষ। ঘেন্নায় গুলিয়ে উঠছে পেট বুক, সর্বাঙ্গ। তার মাথা এখনও অফিসারের হাতের মুঠোয়। সেই অবস্থায় সে সজোরে সমস্ত ঘেন্না জড়ো করে ছুড়ে মারল। এক দলা থুতু লোকটার শরীরে মাখামাখি হতেই প্রথমে হতভম্ব হয়ে হাত ছেড়ে দিল লোকটা। তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে অনিমেষের ওপর, শকুনের মতো।