মনোরমা এখন কিঞ্চিৎ সুস্থ। আর বাঙালি মায়েদের যা স্বভাব, গায়ে সামান্য জোর আসামাত্রই সমস্ত অসুস্থতা বিস্মৃত হওয়া, মনোরর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। দিনদুয়েক বাদেই তিনি রান্নাঘরে ঢুকলেন দীপাবলীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। এবং অবশ্যই রান্নাঘরের ব্যবস্থা তাঁকে খুশী করল না। নিজের কাজ চালানোর জন্যে সর্টকাট মেথডে রান্নাঘর সাজিয়েছিল দীপাবলী। অবশ্য সাজানো শব্দটিও একটু বাড়াবাড়ি মনে হবে।
মনোরমা বলেই বসলেন, ইস, তুই কি রে? ব্যাটাছেলেদের মত রান্নাঘরের হাল করে। রেখেছিল। তোর শ্বশুর-শাশুড়ি দেখলে কি বলবে?
তাঁরা নিশ্চয়ই এখানে দেখতে আসছেন না!
আসতেও তো পারেন। ছেলের বউ-এর কাছে আসবেন নাই বা কেন?
তোমরা আমাকে ছেলেবেলায় এসব শেখাওনি কেন?
মেয়েছেলেকে আবার রান্নাঘর, রান্না শেখাতে হয় নাকি? নিজেই শিখে নেয়। আমাকে কে শিখিয়েছিল? অবশ্য তোর মত বই মুখে নিয়ে বসার সুযোগ হয়নি আমার।
ঠিক আছে। আমার রান্নাঘর নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
বা রে বা। আমি কি এবাড়িতে থাকব না?
থাকবে না মানে?
তাহলে আমার আমার করছিস কেন? এখানে তো আমিও রাঁধবো।
ওরে বাবা, সেটা এখন নয়। ভাল করে সেরে ওঠো, গায়ে জোর হোক–।
আমি ভাল হয়ে গেছি। তুই যদি জোর করে শুইয়ে রাখিস তাহলে মরে যাব। আমাকে আমার কাজ করতে দে। তুই বরং কাল থেকে অফিসে যা।
দীপাবলী হালটা মনোরমার হাতে ছেড়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, তোমার জীবনে আর একটা পর্ব যোগ হল।
মনোরমা ততক্ষণে এটা নেই সেটা নেই শুরু করে দিয়েছেন। উত্তর দিলেন না। দীপাবলী বলল, ছেলেবেলায় বাপের সংসার, যৌবনে স্বামীর, প্রৌঢ়া অবস্থায় ছেলের আর বার্ধক্যে নাতনীর সংসার সামলাতে জন্মেছ বুঝি তুমি?
মনোরমা প্যাকেটে ফেলে রাখা তেজপাতার জন্যে কৌটো খুঁজছিলেন, বললেন, যাক, স্বীকার করলি তাহলে যে সংসার করছিস আজই গোটা দশেক ছোট-বড় কৌটো কিনে নিয়ে আয়। বাঙালির রান্নাঘরে সবচেয়ে কাজের জিনিস হল কৌটো।
দীপাবলী আর কথা বাড়াল না। মনোরমা নানারকম ত্রুটি ধরতে লাগলেন। রান্নার সময় এগুলোর অভাব বুঝলেও তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি সে। শেষপর্যন্ত ফ্রিজের দরজা খুললেন বৃদ্ধা, দ্যা তো কত সুবিধে হয়েছে এখন। এ-বেলায় রান্না করে ও-বেলা পর্যন্ত খাবার রাখতে আমার বুক টিপ ঢিপ করত। টকে গেলে তো তোর বাপ মুখে দিত না। নাক ছিল। খুব। এখানে কতদিন ঠিক থাকে খাবার?
সাতদিন মোটামুটি চালানো যায়।
তুই তাই করিস?
প্রায়ই। খাওয়ার সময় গরম করে নিই।
খেতে বিশ্রী লাগে না?
একটু স্বাদ পাল্টায়। তবু সময় তো বাঁচে। পরিশ্রমও।
কাজের লোক পাসনি এখানে?
রাখতে সাহস হয় না। সারা দুপুর একা থাকবে। কি হতে কি হয়ে যাবে।
বিশ্বাসী লোক পাওয়া যায় না?
বিশ্বাস? তুমি তোমার নিজের নাতিকে বিশ্বাস করতে পার?
মনোরমা চুপ করে গেলো। খোঁচাটা একটু বেশী হয়ে গিয়েছে বুঝে দীপাবলী বলল, ঠিকে লোক রেখেছিলাম। দুবেলা এসে রান্না করবে, ঘর পরিষ্কার করবে। তিনদিন আসে তো দুদিন আসে না। তার ওপর সকালে আমার বেরুনোর সময় তার কাজ শেষ হয় না। তার হাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হত। শেষপর্যন্ত তাকেও বাদ দিলাম।
কেন?
একদিন বাইরের ঘরের দরজার পাশে পোড়া বিড়ি দেখেছিলাম।
বিড়ি খেতে বুঝি? বাগানের মদেশিয়া মেয়েরা তো খায়।
না খেত না। তাই বলেছিল আমাকে। বিড়িটা কোত্থেকে এসেছিল বলতে পারেনি।
ও। তোর একা থাকতে ভয় করে না?
কেন? দরজা বন্ধ থাকলে ভয় কি?
রাত্রে যদি শরীর খারাপ হয়?
মাথাটা পেছনদিকে হেলালো দীপাবলী, কি আবার হবে! মরে যাব।
ওটা তো অত সহজ নয়। তাহলে এত চাইলেও আমার মরণ হচ্ছে না কেন?
প্লিজ, আবার শুরু করো না। আমার কাছে এসেও তোমার মরার ইচ্ছে হচ্ছে?
মনোরমা কিছু বললেন না। এখন সকাল। তরকারির ঝুড়িটা নিয়ে বললেন, এ কি রে!! শুধু কয়েকটা আলু আর পেঁয়াজ পড়ে আছে।
তাতেই হয়ে যাবে। ডাক্তার তোমাকে আলুসেদ্ধ ভাত আর দুধ খেতে বলেছে।
তুই কি খাবি?
আমিও তাই।
তার মানে? তুই মাংস ডিম খাস না?
খাই। কিন্তু ওগুলো কিনতে হলে বাজারে যেতে হবে। সেই ইচ্ছেটা নেই।
আশ্চর্য কুঁড়ে তো!
মনোমাকে একা ফ্ল্যাটে রেখে প্রথমদিন অফিসে গিয়ে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল। নতুন জায়গায় বুড়ি একা কি রকম থাকবে কে জানে। বেরুবার আগে পইপই করে বলে দিয়েছিল যেন দরজা না খোলে। যেই আসুক, দরজা বন্ধ রেখেই কথা বলে। কলকাতার ফ্ল্যাটে ডাকাতির গল্প বলে সে মনোরমাকে সাবধান করে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও অস্বস্তিটা যায়নি।
কলকাতা ইতিমধ্যে ক্রিকেট জ্বর কাটিয়ে উঠেছে। ওই পাঁচটা দিন প্রায় পুরো অফিস ফাঁকা। ইডেনে যত লোক ধরে তার বহুগুণ সরকারি অফিসগুলোতে কাজ করেন। মাঠে যাঁরা খেলা দেখতে যান তাঁদের সকলেই সরকারি কর্মচারী এমন ভাবার কোন কারণ নেই। কিন্তু খেলার ওই কটি দিন হাজিরা খাতায় সই করে দলে দলে মাঠে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে যান। যেন মাঠে যাওয়ার কথা বললে অঘোষিত ছুটিটি পাওয়া যাবে। এমন কি এই কদিন কোন আন্দোলন অথবা গেট মিটিং বন্ধ। সেগুলোর প্রয়োজন খেলার সময় সাময়িকভাবে জরুরী নয়।
কিন্তু দীপাবলী মনে মনে স্বীকার করে যে মেয়েদের নিয়ে তার সেকসন খারাপ চলছে। না। বরং বেশ ভাল কাজ হচ্ছে। এতদিন এরা দায়িত্ব পাননি। অফিসে এসে ফাঁকি দেবার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে এদের। যে মানসিকতায় অফিস টাইমের বাসে কোন মহিলা কর্মীকে পুরুষরা পরের বাসে আসার উপদেশ দেয় ঠিক সেই মানসিকতাতেই একজন সিনিয়ার মহিলাকে চালান পোস্টিং করার দায়িত্ব দেওয়া হত মুখ রক্ষা করার জন্যে। এখন কাজ করার স্বাধীনতা পেয়ে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। অন্তত কোন পার্টিকে হ্যারাস করা হচ্ছে এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত ওঠেনি।
অফিসারদের কোন কমন রুম নেই যেখানে সবাই মিলে বসতে পারে। একমাত্র আই এ সির ঘরে মিটিং থাকলে এর সঙ্গে ওর দেখা হয়। দীপাবলীর সঙ্গে প্রত্যেকের এখন মৌখিক আলাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্ত। সি হাল ছাড়েননি। লোকটা তলায় তলায় যাই করুক সামনাসামনি অত্যন্ত ভদ্রলোক। কথাবার্তায় কোনও ক্রুটি রাখে না। আই এ সির ঘরে এক মিটিং-এ নতুন অফিসারকে দেখল দীপাবলী। লম্বা ছিপছিপে এক মধ্যবয়সী মানুষ। আই এ সি প্রত্যেকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।
ঘরে বসার কিছুক্ষণ বাদেই সেই ভদ্রলোক যার নাম মলয় মিত্র দরজায় এসে দাঁড়ালেন, ভেতরে আসতে পারি? খুবই ব্যস্ত কি?
দীপাবলী সামান্য অবাক, বলল, না, না। আসুন।
মলয় সটান চেয়ার টেনে বসলেন, আপনার কথা খুব শুনেছি, তাই কথা বলতে ইচ্ছে। হল। গতকাল এখানে জয়েন করেছি। আপনার বছরপাঁচেক আগে মুসৌরিতে ছিলাম
আমি। এতদিন আয়করে ছিলাম।
আমার কথা কি শুনেছেন?
সিস্টেম ভাঙতে চাইছেন। অন্যায়ের সঙ্গে আপপাস করেন না।
চাইলেই যে পারা যাবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? আর আমি একা কি করে পারব! চারপাশে একই নিয়ম যখন চলছে তখন আমিই বেনিয়ম।
এইটে খুবই সত্যি কথা। তবে সুবিধে হল আপনি ঘুষ নিয়ে ধরা পড়লে ব্ল্যাকলিস্টেড হতে পারেন কিন্তু ঘুষ নিচ্ছেন না বলে সেরকম কিছুর সম্ভাবনা নেই।
দীপাবলী হাসল, ট্রান্সফার অর্ডার পেতে পারি।
সেটা তো সবসময়ই। তবে আপনার ক্ষেত্রে হবে না।
মানে?
আপনার বড় সহায় হলেন ওয়েস্টবেঙ্গল সার্কেলের বড় সাহেব।
আপনি একথা কি করে জানলেন?
উনিই বলেছেন। আপনার মত একজন অনেস্ট সিনসিয়ার অফিসারের জন্যে উনি গর্বিত।
দীপাবলী অবাক হল। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই। দুজনের চাকরির পদের মধ্যে এতখানি দূরত্ব যে তা হবার সম্ভাবনাও নেই। তবু ভদ্রলোক যে তার কথা মনে রেখেছেন এইটেই আশ্চর্যের।
এখন বাড়িতে ফেরার কথা ভাবলে আরাম লাগে। ব্যাগ থেকে চাবি বের করে তালা। খুলতে হবে না। বন্ধ ফ্ল্যাটের ভ্যাপসা গরম এবং গন্ধ সহ্য করতে হবে না। বেল টিপলেই মনোর পরিচয় জানতে চান। সে হেসে বলে, তোমার নাতনি। মনোরমা দরজা খুলে প্রথমেই একগ্লাস জল এনে দেন। সেটা খেয়ে প্রথমদিন দীপাবলী বলেছিল, তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি রাজ্য জয় করে এসেছি বলে আপ্যায়ন করছ?
মনোরমা হাসেন, কথা বলেন না। বৃদ্ধার দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি এখন অনেক ভাল আছেন। মুখচোখে বেশ প্রশান্তি। ইতিমধ্যে ওঁর জন্যে গোটা চারেক নরুন পেড়ে ধুতি কিনে দিয়েছে সে। জমিটা খুবই মোলায়েম। মনোরমা বলেছিলেন, তোর বাবা এইরকম কাপড় কিনে দিত আমাকে। মুশকিল হয়েছিল ওর সেমিজ নিয়ে। কলকাতার দোকানে আজকাল রেডিমেড সেমিজ কিনতে পাওয়া যায় না। মনোরমা সঙ্গে যেসব নিয়ে এসেছেন তাদের অবস্থা খুবই করুণ। অর্ডার দিয়ে বানাতে হলে তাঁকে নিয়ে দোকানে যেতে হবে। জ্ঞান হওয়া তক যে মহিলাকে সে সেমিজ পরা দেখে আসছে তার জন্যে জামা এবং সায়া কিনেছিল দীপাবলী। সঙ্কোচের সঙ্গে বলেছিল, তোমার সেমিজ পাওয়া যায়নি।
সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মনোরমা বলেছিলেন, কেন এগুলো আনতে গেলি।
বাঃ। তোমার জামার অবস্থা দেখেছ? এখানে অত পুরনো জিনিস পরা চলবে না। এখানে তোমার সব নতুন, তুমিও।
প্রথম দিনে হয়নি। দ্বিতীয় দিনে প্রায় জোর করেই ভদ্রমহিলাকে সায়া ব্লাউজ পরাল সে। সত্যি সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীপাবলী মাথা নেড়েছিল, বড় সাদা দেখাচ্ছে। একটু রঙের ব্রেক থাকা দরকার।
কি থাকা দরকার?
অত সাদা সহ্য হচ্ছে না আমার।
সহ্য হচ্ছে না বললে তো চলবে না। এতেই আমার পেটে বুকে অস্বস্তি হচ্ছে। বিধবাদের অত রঙের দরকার নেই।
বাঃ। আমিও তো বিধবা।
মারব মুখে এক থাপ্পড়। অলোক বেঁচে নেই?
দীপাবলীর মজা লাগল, আহা, একসময় তো বিধবা ছিলাম।
তোর সঙ্গে আমি কথায় পারব না।
রাতারাতি নয়, একটু একটু করে বৃদ্ধার আচরণে বদল আসছে। যে মনোরমা এককালে ছোঁয়াছুঁয়ি বাদবিচারে মগ্ন থাকতেন এখন তিনি সেসব মুখেও উচ্চারণ করেন না। রোজ রাত্রে শোওয়ার সময় ঠাকুমা নাতনিতে গল্প হয়। জানার আগ্রহ ওঁর খুব। আজ সারাদিন অফিসে কি হল, বাসে যাওয়ার আসার পথে কি অভিজ্ঞতা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ দিতে হয় দীপাবলীকে। সেটা শুনে নিজস্ব মন্তব্য করেন তিনি।
আর এইসময় অলোকের কথা খুব মনে পড়ে দীপাবলীর। একই বিছানায় সে শুয়েছে। অলোক এবং মনোরর সঙ্গে। প্রথম বিয়ের একটি রাতকে শোওয়া বলা চলে না। শেষের দিকে পাশে শুয়ে কথা বলার ক্ষমতা থাকত না অলোকের। কিন্তু অন্ধকার ঘরে পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে যে আরাম তার অভাববোধ করত তখন দীপাবলী। আজ অলোককে মনে পড়ছে বারংবার। আর তা মন থেকে সরাতেই সেই ছেলেবেলার মতো মনোরমার হাত আঁকড়ে শুয়ে থাকত সে। ওর এই শোওয়ার ভঙ্গীটার জন্যে মনোরমা হেসে বলেছিলেন, তুই এখনও বড় হোসনি রে। ছেলেবেলার কথা মনে আছে?
অন্ধকার ঘরে দীপাবলী জবাব দিয়েছিল, হুঁ। তখন তুমি অন্যরকম ছিলে।
কি রকম?
রাগী রাগী। গম্ভীর। শুচিবায়ুগ্রস্ত।
যৌবনে বৈধব্য এলে বাঙালি মেয়েকে নিজেকে আড়াল করতে একটা কিছু নিয়ে থাকতে হয়। আমার পক্ষে ওইটে ছাড়া আর কিছু নেওয়ার মত ছিল না।
দীপাবলী চমকে উঠল। মনোরমা সব জেনেশুনেই ওই আচরণ করতেন? সে মহিলাকে যেন বুঝতে পারছিল না। আজ মনোরমার বয়স কত হবে? চিরকাল তো ওঁকে একই রকম দেখে আসছে। আশির এদিকে কোনমতেই হবে না। চা-বাগানের অন্ধকারে যাঁর সারাজীবন কেটেছে তিনি কি করে এমন আধুনিক ব্যাখ্যা করেন?
মনোরমা বললেন, শোন, কাল বাজারে যাবি।
আচ্ছা।
তোর জন্যে মাছ আনবি।
কি দরকার? আমার মাছ-মাংস ছাড়া দিব্যি চলে যাচ্ছে।
ওসব বাজে কথা রাখ। তুই কেন মাছ আনা বন্ধ করেছিস জানি না ভাবছিস?
ও। তুমি জানো বুঝি। দ্যাখখা, দুটো হেঁশেল হোক আমি চাই না।
মনোরমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, আগে আমারটা করে নেব তারপর—
একঘরে আগে পরে চলবে না। অতএব এ প্রসঙ্গ থাক।
জামাই এলে নিরামিষ খাওয়াবি?
খাবে।
বাঃ। আমি থাকতে তা হতে পারে না।
কেন?
মনে হবে আমার জন্যে করছি। মনোরমা মাথা নাড়লেন।
দীপাবলী সময় নিল, দ্যাখো, আমি যদি বলি হেঁশেল আলাদা না করলে মাছ আনব তাহলে তোমার ওপর চাপ দেওয়া হবে। যেন আমার কাছে আছ বলেই আমি জোর করে তোমাকে দিয়ে মানিয়ে নিচ্ছি।
সকালে চা খাওয়ার পর যখন বাজারে বের হচ্ছে দীপাবলী তখন তাকে মাছ আনার কথা মনে করিয়ে দিলেন মনোরমা। দীপাবলী ঘাড় নাড়ল। মনোরমা হাসলেন, আচ্ছা, বাবা, আলাদা রান্না করব না।
দীপাবলী আচমকা খুশী হয়ে জড়িয়ে ধরল মনোরমকে। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ছাড়, ছাড়! উঃ, তোর গায়ে কি জোর!
সেদিন এক হেশেলে রান্না হল। একই কড়াই-তে। দীপাবলী অঞ্জলির কথা ভাবছিল। বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য দেখলে অঞ্জলি হাঁ হয়ে যেত। মনোরমার বাছবিচারের ধাক্কা সামলাতে জেরবার হতে হয়েছে অঞ্জলিকে। মনোরমার মনের এই পরিবর্তন শুধু পরিস্থিতির চাপে তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ঘটনাটা সত্যি।
একটি ব্যাপার মনোরর কাছে কিছুতেই স্পষ্ট করতে পারেনি দীপাবলী। অলোকের সঙ্গে সম্পর্ক যে আর নেই একথা বলতে তাঁর নিজের কুষ্ঠা হয়েছে। মনোরমা যা জানেন তার চেয়ে বেশী কিছু জানানোর আগ্রহ হয়নি। এরমধ্যে একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন অলোকের চিঠিপত্র এসেছে কিনা। দীপাবলী জবাবে হেসেছিল। তিনি নিশ্চয়ই সেটা এসেছে অর্থেই বুঝেছেন। হ্যাঁ, এটা অৰ্ধ মিথ্যা বলা হল। মুখে উচ্চারণ না করে সত্যি গোপন করা তো অর্ধ মিথ্যাই।
কিন্তু কোন সত্যিটা বলবে দীপাবলী? সত্যিটাই বা কি তাই তার ভাল জানা নেই। অলোকের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে, একসঙ্গে থাকা মুশকিল হয়ে উঠেছিল এমনসময় ট্রান্সফার অডারটা এল এবং সে দিল্লি ছাড়ল। মোটামুটি ছবিটা এইরকম। এক্ষেত্রে কলকাতায় বসে সম্পর্ক নেই বলে ঘোষণা করলে হাতের লোহা এবং নামের পেছনে উপাধিটা যে উপহাস করবে। মনে মনে যাই জানুক, নিজেরা যা বুঝে নিক, পাঁচজনকে ডেকে বলার পেছনে যে তথ্য থাকা দরকার তা এখনও তৈরী হয়নি। মনোরমাকে তাই বলা। যায় না, আমাদের আর কোন সম্পর্ক নেই।
এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে আর একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে যার সম্ভাবনা এতদিন ছিল না। বৈধব্যজীবমৈ তো বেশ মানিয়ে নিয়েছিলে! একা একা জীবনটা কাটানো অভ্যেসে এসে গিয়েছিল। এবার কেউ তোমার ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি। অনেক দেখে ভেবেচিন্তে নিজে বিয়ে করেছিলে পছন্দের পুরুষকে, তাহলে তার সঙ্গে টিকতে পারলে না কেন? এই নির্মম প্রশ্নটি মনোরমার মুখ থেকে উচ্চারিত হোক দীপাবলী চায় না।
মনোরমার একটি চশমা আছে। প্রায় আঠারো বছর আগে সেটি করানো হয়েছিল। ডাঁটি ভেঙে যাওয়ায় সুতো দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। নাকের ডগায় তুললে হাস্যকর দেখায়। আঠারো বছরে চোখ আরও শক্তিহীন হয়েছে কিন্তু চশমা পাল্টানো হয়নি। মনোরমাকে পাওয়ার পরিবর্তন করিয়ে নতুন চশমা দিতে গেলে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তিনি এই ফ্ল্যাটের বাইরে যাবেন না। বিকেলবেলায় বারান্দায় বসে রাস্তার যেটুকু দেখতে পান সেটাই হয় কলকাতাদর্শন। দীপাবলী তাঁকে কালীঘাট দক্ষিণেশ্বরের কথা বলেছিল। তিনি হাত নেড়ে না বলেছিলেন। বলেছিলেন, চিঠি লেখার জন্যে চশমা দরকার। আমার তো চিঠি লেখার কোন লোকই নেই। তাই চশমারও দরকার হয় না। বইপত্র তো পড়ি না।
ব্যাপারটা দীপাবলীর পছন্দ হয় না। ইদানীং কেবলই মনে হয় মনোরমাকে আরও অনেককাল তার নিজের প্রয়োজনে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেই বাঁচাটা যদি ভালভাবে না হয় তো মুশকিল। কিন্তু মনোরমার কোন চাহিদা নেই। সবকিছুই যেন তার বেশ ভাল লাগে। এই ফ্ল্যাটের জীবনে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
মনোরর সঙ্গে যে পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার আলাপ হয়েছে তা জানতে পেরে দীপাবলী ভেবেছিল একটু সতর্ক করে দেবে। আলাপ থেকে মেলামেশা হতে বাধ্য। সেই মেলামেশা অনাবশ্যক কৌতূহলী করে তুলবে প্রতিবেশীকে। এইটে সে চায় না। কিন্তু বলব বলব করেও পারল না দীপাবলী। চব্বিশঘণ্টা ফ্ল্যাটে থেকে মনোরমা নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে ওঠেন। ওইটুকু আলাপ যদি তাকে স্বস্তি দেয়, দিক। কয়েকদিন বাদে মনোরমা খবর দিলেন একটি পার্টটাইম কাজের লোকের ব্যবস্থা হয়েছে। পাশের ফ্ল্যাটের বউটি করে দিয়েছে। রান্না ছাড়া সব কাজ করবে। এখন তো তিনি আছেন। দীপাবলী অফিসে বেরিয়ে গেলেও কোনও অসুবিধে হবে না। এই অভাবটা মিটে গেল বলে দীপাবলী আপত্তি করার কোনও কারণই পেল না। যে মেয়েটি এল সে স্বামীপরিত্যক্তা, সুন্দরবনে বাড়ি। এখানে লাইনের ধারে ঝুপড়িতে থাকে। মনোরমা তার সঙ্গে কথা বলেন। সেই সমস্ত কথা ধরাবাঁধা কাজের মধ্যে থাকে না। সুন্দরবনে মধু চাষ থেকে তার স্বামীর নির্যাতন পর্যন্ত কোনও প্রসঙ্গই বাদ যায় না। বছর তিরিশের একটি মেয়ে ঝুপড়িতে একা কি করে থাকে তাই নিয়ে মনোরমার অনেক দুশ্চিন্তা। কাউকে কিছু নিয়ে থাকতে হবে, মনোরও এই নিয়ে আছেন।
রবিবার সকালে বাজারে যায় দীপাবলী। সেদিন ভাঁড়ার একেবারে শূন্য হয়ে যায়। আগের রাত্রে সর্দি হয়েছিল। সকালের দিকে বেশ জ্বরোভাব। গায়ে হাতে ব্যথা। মনোর। বললেন পেট গরমের সর্দি, বাড়ি থেকে বেরুতে হবে না। তিনি কাজের মেয়েটিকে বাজারে পাঠালেন। দীপাবলী নিশ্চিন্ত হয়েছিল। আজকের দিনটা কোনমতে চলে গেলে সে সন্ধেবেলায় না হয় বাজারে যাবে। দুপুরের আগে শরীর ঠিক হয়ে গেল। খেতে বসল সে মনোরমার সঙ্গে। মনোরমার থালার দিকে তাকিয়ে সে অবাক। তিনি আলুসেদ্ধ ডাল আর কাঁচালঙ্কা নিয়ে বসেছেন ভাতের সঙ্গে। দীপাবলীর পাতের পাশে বড় বাটিতে মাছ। সে জিজ্ঞাসা করল, এটা কি হল?
মনোরমা লজ্জা পেলেন, আমারই ভুল রে। তোকে যে বেশী টাকা দিতে বলব তা মনে, ছিল না। এদিকে আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম তোর জন্যে ভাল মাছ আনতে। কেনার পর ওর হাতে আর টাকা ছিল না।
কি আশ্চর্য! ও তরকারি কিনল না কেন? মাছের কি দরকার ছিল?
আহা। বললাম না, আমারই ভুল। কিন্তু এতে আমার অসুবিধে হবে না। ওখানে কতদিন শুধু আলুসেদ্ধ ভাত খেয়েছি। ডালও জোটেনি।
না। আমি খাব না। এভাবে খাওয়া যায় না।
সেকি? খাবি না মানে? একটা বেলা নিয়ে নে।
তর্ক চলল কিছুক্ষণ। হঠাৎ দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, নিজেকে কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পাও?
একথা কেন?
মাছটা তুলে রাখ। আমি তুমি যা খাচ্ছ তাই খাব।
ওমা। তাহলে মাছ আনালাম কেন? তোর খেতে অসুবিধে হবে।
তোমার যদি না হয় আমার হবে না।
আশ্চর্য! আমি বিধবা হবার পর মাছ খেয়েছি কখনও?
খাওনি কেন?
এদেশের বিধবারা খায় না বলে।
আমিও তো বিধবা ছিলাম। যখন জোর করে খেতে লাগলাম তখন তুমি চেঁচামেচি করোনি কেন?
সেটা তোর বাবার জন্যে। ও চাইত না তুই বিধবার মত থাকিস।
মাছ খেলে তোমার বৈধব্য নষ্ট হয়ে যাবে?
আমি জানি না।
আজকাল এইসব বাজে প্রথা কেউ মানে না।
আমি তো আজকালকার মানুষ নই।
তাহলে এককালে সহমরণে যেত সদ্যবিধবা। সেটা মানো?
আমি আর তর্ক করতে পারছি না।
তাছাড়া, ঠাকুমা, তুমি বিধবা হয়ে আছ অভিমানে। আমরা এখনও জানি না ঠাকুদা মারা গিয়েছেন কিনা। ঠিক তো?
তিনি থাকুন বা না থাকুন আমি বিধবা।
হ্যাঁ, আমি তোমার এই মানসিকতাকে মেনে নিচ্ছি। কিন্তু তুমি বিধবা বলে মাছ খাবে না কেন? একসময় বুঝিয়েছিলে মাছ-মাংস ডিম শরীরকে তপ্ত করে। বিধবার উচিত নয় সব খাওয়া। তা শরীর যে বয়সে তপ্ত হয় সেই বয়সটাকে তুমি অনেককাল আগে ফেলে। এসেছে, তাই না?
আঃ। ফাজলামি হচ্ছে, না?
তাহলে যুক্তি কোথায়?
আমি অত যুক্তিযুক্তি জানি না। যা কোনোদিন করিনি–।
দাঁড়াও। তুমি এর আগে কলকাতায় এসেছ? আসনি। এমন ফ্ল্যাটবাড়িতে থেকেছ? থাকেনি। সায়া ব্লাউজ পরেছ? পরোনি। তাহলে? আমি তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি তুমি মাছ না খেলে আমিও খাব না।
তুই আমার ওপর জোর করছিস। খাওয়া নিজের রুচিমত করতে হয়।
মাছে তোমার অরুচি?
ষাট-পয়ষট্টি বছর না খেয়ে আছি, নাকি তারও বেশি, এখন খেয়ে কি হবে?
তোমার শরীর ভাল থাকবে। চোখের প্রব্লেম কমবে।
ছাই।
বেশ, তুমি মুখে তুলে দ্যাখো, যদি খেতে খারাপ লাগে খাবে না।
আমার বমি হয়ে যাবে।
হলে খাবে না আর।
কি আরম্ভ করেছিস বল তো?
কিছুই করিনি।
মনোরমা পাথরের মত বসে রইলেন। যেন অনেক অনেক বছর ধরে যে বাঁধ শক্তহাতে গড়েছিলেন তা এখন ভেঙে পড়ার মুখে। দীপাবলী তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। প্রথমদিকে সে বিরক্ত হয়েছিল তারপর যুক্তিবাদী এবং এখন স্রেফ কৌতূহল। কিন্তু সে একটা আশঙ্কাও করছিল। হঠাৎ যদি মনোরমা বলে বসেন তোর বাড়িতে আছি বলে তুই আমাকে নষ্ট করতে চাইছিস তাহলে পিঠ ঠেকাবার মত কোন দেওয়াল পেছনে পাবে না। এইসময় মনোরমা বললেন, লোকে শুনলে ছি ছি করবে রে।
কলকাতার লোকের অনেক কাজ আছে। দীপাবলী হাসল, না। থাক। তোমাকে খেতে হবে না। যদি কখনও ইচ্ছে হয় বসো। আমি মাছ খাচ্ছি, তুমি খেতে আরম্ভ কর।
খাওয়া শুরু হল। দুজনে চুপচাপ খাচ্ছিল। মনোরমা ধীরে খান। আলুসেদ্ধ ভাতেই তাঁকে বেশ তৃপ্ত মনে হচ্ছিল। দীপাবলী যখন মাছের বাটির দিকে হাত বাড়াচ্ছে তখন তিনি মুখ তুলে বললেন, আমার জন্যে এই একটুখানি রেখে দিবি।
মানে? এবার হতভম্ব দীপাবলী, তুমি মাছ খাবে?
বললাম তো!
না বাবা। আমি জবরদস্তি করলাম বলে নিজেরই খারাপ লাগছে।
সেটা করলি বলেই তো ইচ্ছে হচ্ছে।
সত্যি? দীপাবলী খুব খুশী হল, দাঁড়াও, রান্নাঘর থেকে এনে দিই। না।
নষ্ট করে কোন লাভ নেই। একটা টুকরো দে!
দ্যাখো, তুমি আমার মন রাখতে খাচ্ছ না তো?
তোর মন না রাখলে তুই কি আমাকে তাড়িয়ে দিতিস? তাহলে মন রাখার কথা উঠছে। কেন? সেই বিধবা হবার পর খুব ইচ্ছে হত। ইচ্ছেটাকে একসময় মেরে ফেলেছিলাম। এখন তোর কথা শুনে মনে হল এটা তো মনের ব্যাপার। শরীর নিলে না খাওয়ার কি আছে!
দীপাবলী বাটি থেকেই অনেকটা মাছ ভেঙে নিজের থালায় নিয়ে বাটিটাকে ঠেলে দিল আস্তে করে। মনোরমার ডাল খাওয়া যেন শেষ হচ্ছে না। নিজের খাওয়া হয়ে গেলে সে থালা তুলে বেসিনের পাশে রেখে হাত ধুয়ে শাওয়ার ঘরে চলে এল। মনোরমা মাছ। খাচ্ছেন আর সে সামনে বসে আছে এতে ওঁর স্বস্তি না-ও হতে পারে। দীপাবলী সতর্ক হল। যেকোন মুহূর্তেই মনোরমার বমির শব্দ শুনতে পাবে বলে আশঙ্কা করছিল?
একটু বাদে জলপড়ার শব্দ হল। মনোরমা হাত ধুচেছন, সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ওদিকে কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে বলে এখনও মনে হচ্ছে না। মিনিট পাঁচেক বাদে মনোরমা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাত খেয়ে আবার জ্বর আসবে না তো? শুলি যে?
এমনি। সে মনোরমাকে জায়গা করে দিল।
পাশে শুয়ে মনোরমা কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। দীপাবলী ওঁর কোমর জড়িয়ে ধল। মনোরমা এবার বললেন, এখন মনে হচ্ছে আমি কি বোকা!
কেন? ওঁর কাঁধের কাছে মুখ ছিল দীপাবলীর।
কত বছর? ষাট-পয়ষট্টি বছর ধরে কত ভাল ভাল জিনিস থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছি। এখন খুব আপমোস হচ্ছে রে!
দীপাবলী চমকে উঠল। তার সামনে লোলচৰ্ম মনোরমা, যাঁর শরীরে সময় অজস্র দাঁত বসিয়েছে। সে বলল, তুমি এখনও অনেকদিন বাঁচবে তা জানো।
মনোরমা বললেন, বাঁচতে যে খুব ইচ্ছে করে।
তোমাকে বাঁচতেই হবে।
দুজন নিঃসঙ্গ মহিলা পাশাপাশি চুপচাপ শুয়ে রইল। দুজনের হাত দুজনকে স্পর্শ করে আছে। দীপাবলীর মনে হল মনোরমা আজ যে বিদ্রোহ করলেন তার তুলনায় সে নিজে কিছুই করেনি। এইসময় কলিং বেল বেজে উঠল প্রচণ্ড জোরে। চমকে উঠে বসল দুজনেই।