দ্বিচারিংশ অধ্যায় – মদন-ভস্ম
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–ইহার মধ্যে শম্ভু, শিপ্রা সরোবর পরিত্যাগ করিয়া গঙ্গাতীর্থে হিমালয় পর্বতে যে স্থানে গঙ্গা ব্ৰহ্মপুর হইতে নিঃসৃত হইয়া পতিত হইয়াছেন, সেই স্থানে গমন করিলেন। ১
ওষধি-প্রস্থ-নগরের-অনতিদূরে এক সামুতে বৃষধ্বজ শিব,–পরাৎপর অচ্যুত, জ্ঞানময়, নিত্য জ্যোতীরূপ নিরঞ্জন জগৎব্যাপী, প্রদীপের আভার ন্যায় অতি প্রদীপ্ত, দ্বৈতহীন, বিশেষশূন্য পরমাত্মাকে একাগ্রচিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন। ২-৩
মহাদেব ধ্যান-রত হইলে প্রমথাদিগণসমূহও ধ্যান-রত হইল; এবং নন্দী ভৃঙ্গীও ধ্যানে রত হইলেন। ৪
পূর্বে যাহারা দ্বারে ছিল, তাহারাই দ্বারে নিযুক্ত হইল, ও সমস্ত প্রমথবৃন্দ সেই স্থানে অতি নিঃশব্দে রহিল। ৫
এবং সকলেই জানিতে পারিল যে, তাহারা নিঃশব্দভাবে সেই স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন। ৬
অন্য লোকও-গণদিগের অবস্থানের দূরে ক্রীড়া করত কুসুম-দল ও গিরি প্রস্রবণ জল-দ্বারা তাহারা সকল কার্য সম্পন্ন করিতেছে এবং গৈরিকের দ্বারা ভূষিত হইয়া রত্নভূষণে ভূষিতবৎ বোধ হইল। ৭-৮
গিরিরাজ, গণের সহিত মহাদেবকে প্রত্যহ দেখিয়া একদিন বন্ধুগণের সহিত ওষধিপ্রস্থ হইতে প্রস্থান করত পূজার নিমিত্ত তথায় উপস্থিত হইলেন এবং যথাযোগ্য পূজা করিলেন। ৯-১০
পৰ্বতস্থ শম্ভুও পূৰ্বে গঙ্গাকে যেরূপ শিরে ধারণ করিয়াছিলেন, সেইরূপ শ্রদ্ধাপূর্বক গিরিরাজের পূজা গ্রহণ করিলেন। বৃষধ্বজ পূজিত হইয়া সহসা গিরিরাজকে ধ্যানযোগস্থ হইয়াও সবিস্ময়ে বলিলেন। ১১-১২
তোমার প্রস্থে গোপনীয় স্থানে তপস্যার জন্য আমি আগমন করিয়াছি, কিন্তু যাহাতে কোন ব্যক্তি আমার নিকট আসিতে না পারে তাহাই কর। ১৩
তুমি মহাত্মা, জগতের ধামস্বরূপ, মুনিদিগের সর্বদা আশ্রয়স্বরূপ, তুমি দেবতা, রাক্ষস, যক্ষ, কিন্নর ও দ্বিজগণের সর্বদা আবাস স্থান এবং গঙ্গা প্রভাবে সৰ্ব্বদা পবিত্র। ১৪
গিরিশ্রেষ্ঠ! আমি তোমার পুর-সমীপে গঙ্গা-প্রবাহ-যুক্ত প্রস্থ আশ্রয় করিয়াছি, সম্প্রতি তাহার উপযুক্ত কাৰ্য কর। জগন্নাথ, বৃষধ্বজ এই কথা বলিয়া নিবৃত্ত হইলেন। ১৫
তাহার পর গিরিরাজ শম্ভুকে সপ্রণয়ে এই কথা বলিলেন, হে পরমেশ্বর; হে জগন্নাথ! আপনি আগমন করিয়া আমাকে পবিত্র করিলেন, ইহা হইতে অন্য কর্তব্য বিষয় কি আছে। ১৬-১৭
হে জগন্নাথ! জন্মাবধি দেবগণ মহা তপস্যা করিয়াও আপনাকে প্রাপ্ত হয় না–অদ্য আপনি স্বয়ং উপস্থিত হইয়াছেন। ১৮
অতএব আমি বিবেচনা করি, আমা হইতে ধন্যতর নাই ও পুণ্যবানও নাই; যেহেতু আপনি হিমালয় পর্বতে তপস্যার জন্য উপস্থিত হইয়াছেন। হে পরমেশ্বর! আমি, আমাকে ইন্দ্র হইতেও অধিকতর বলিয়া বিবেচনা করি। যেহেতু আপনি ইচ্ছাবশত গণের সহিত এই হিমালয়ে আগমন করিয়াছেন। ১৯-২০
গিরিরাজ এই কথা বলিয়া নিজ ভবনে গমন করিলেন, তাহার পর নিজ পরিবারবর্গকে আদেশ করিলেন, অদ্য প্রভৃতি কেহ গঙ্গাতে গমন করিও না; যে ব্যক্তি আমার শাসন অতিক্রম করিয়া যাইবে, সে দণ্ড প্রাপ্ত হইবে। ২২
গিরি এরূপ আদেশ করিয়া তিল পুষ্প ও কুশাসন গ্রহণ করত নিজ তনয়াকে সঙ্গে করিয়া হর-সমীপে গমন করিলেন। ২৩।
অনন্তর, গমন করিয়া ধ্যান-রত জগন্নাথকে গিরিরাজ, সৰ্বগুণান্বিতা নিজ তনয়া কালী দ্বারা প্রণাম করাইলেন এবং পূজার জন্য আনীত তিল-কুসুমাদিও তাঁহার অগ্রে প্রদান করিলেন। শৈলরাজ, তনয়াকে অগ্রে করিয়া শম্ভুকে বলিলেন। ২৪-২৫
ভগবন! আমার এই তনয়া আপনাকে আরাধনা করিবার জন্য সমাদিষ্টা হইয়া এস্থলে উপস্থিত হইয়াছেন। ২৬
অতএব সখীগণের সহিত আপনার আরাধনাকাক্ষিণী তনয়াকে-আমার প্রতি অনুগ্রহপূর্বক–আরাধনের নিমিত্ত আদেশ করুন। ২৭
অনন্তর শঙ্কর, নবযৌবনা শৈলরাজ-তনয়াকে দেখিলেন; গিরিতনয়ার বিকশিত নীলপদ্মের ন্যায় আভা; পূর্ণচন্দ্র সদৃশ মুখকান্তি; তিনি নীলকেশন কলাপ-শোভিতা; তাহার কম্বুগ্রীবা, আয়ত-লোচন, উজ্বল মনোহর কর্ণযুগল, মৃণালসদৃশ আয়ত ভুজদ্বয়। ২৮-২৯
অত্যন্ত মনোহারিণী দেবী কালিকার পদ্মকুট্মলসদৃশ ঘন ও স্থূল স্তনদ্বয়। ৩০
তাহার মধ্যে ক্ষীণ, পাণিতলদ্বয় রক্তবর্ণ, পাদপদ্মের যুগল স্থলপদ্মের ন্যায় মনোহর। ৩১
মধ্যদেশ ক্ষীণ ও মহাসত্ত্বসম্পন্ন, বৃত্ত, স্থূল ঘন উজ্জ্বল জঙ্ঘাদ্বয়, ওষ্ঠ বিম্ব সদৃশ, জঙ্ঘাগ্রভাগ সুবৃত্ত, তিন স্থল গম্ভীর, ছয়ভাগ উন্নত; তিনি সৰ্ব্বলক্ষণসম্পন্না যোষিৎগণের শিরোরত্ন-সদৃশী লোকত্রয়ে দুর্লভা। ৩২-৩৪
দেবী ধ্যানরূপ পঞ্জরে আবদ্ধ মুনিদিগের মনকেও দর্শনমাত্রই যোগভ্রষ্ট করিতে সক্ষম। ৩৫
শঙ্কর, গিরিরাজের বাক্যানুসারে মনোহরা, তপস্যা ও ধ্যানাদির নিত্য বিঘ্ন-হেতু, অনুরাগবৰ্দ্ধিনী কামরূপিণী গিরিতনয়াকে দেখিয়া উপবেশনের নিমিত্ত বলদকে অবলম্বন করিলেন এবং এই কথা বলিলেন। ৩৬
গিরিরাজ। তোমার তনয়া সখীগণের সহিত নির্ভয়ে নিত্য আমার সেবাতে রত হইয়া এস্থানে অবস্থান করুক। এই কথা বলিয়া মহাদেব সেবার নিমিত্ত দেবীকে আদেশ করিলেন। ৩৭
বিঘ্নের কারণ সত্ত্বেও যাহার বিঘ্ন হয় না, তাহারই মহদ্ধৈৰ্য্য। নির্বিঘ্ন স্থানে দ্বিজগণ যে তপস্যা করে, তাহা হইতে–বিঘ্নযুক্ত স্থানে বিঘ্নহেতুকে পরাভব করিয়া যে ব্যক্তি তপস্যা করে, তাহারই মহত্ত্ব ও তাপসদিগের মধ্যে তপস্যার ধীরতা। ৩৮-৩৯
তাহার পর গিরিরাজ, পরিচারকবর্গের সহিত স্বমন্দিরে গমন করিলেন। হরও পরম ব্রহ্মের চিন্তায় মনোনিবেশ করিলেন। ৪০
কালী সখীগণের সহিত প্রত্যহ চন্দ্রশেখর মহাদেবের সেবাতে রত হইয়া গমনাগমন করিতে লাগিলেন। ৪১
কোন সময়ে কালী, সখীগণের সহিত শঙ্করসমক্ষে পঞ্চমস্বরে গান করিতে লাগিলেন, কোন সময়ে তিনি সখীকূলসহ সমিধ-বারি-পুষ্পাদি আহরণ করিয়া স্নান করত অবস্থান করিতে লাগিলেন। ৪২-৪৩
কোন সময়ে অভিলাষিণী হইয়া চন্দ্রশেখরের অগ্রে তাহাকে চিন্তা করত তাঁহার মুখাবলোকন করিয়া অবস্থান করিতেন। ৪৪
যে সময়ে কোন কাৰ্যে ব্যগ্র থাকিতেন, সে সময়ে তাহার কার্য করিতেই চেষ্টা করিতেন; সে সময়ে কোন কাৰ্য্য না থাকিত, সে সময়ে হরকে চিন্তা করিতেন। ৪৫
কোন সময় ভূতেশ আমার পাণিগ্রহণ করিবেন এবং কোন সময়ে নানারূপ সদ্ভাবে আমার প্রতি অনুরক্ত হইবেন; কালী সৰ্ব্বদা এইরূপ চিন্তান্বিতা হইয়া স্বপ্নেও পরমেশ্বরকে অর্চনা করিতেন। ৪৬-৪৭
যে সময়ে কালী সম্মুখে থাকিয়া মহেশ্বরকে ধ্যান করিতেন, সে সময়ে সৰ্ব্বভূত-ঈশ্বর গিরিশ, এখনও কালী গর্ভ-গত বীর্যের দ্বারা শরীর ধারণ করিতেছে, এই বলিয়া নিসর্গ-সুন্দরী ধৃতব্রতা সেই কালীকে ভাৰ্য্যাত্বে গ্রহণ করিলেন না। ৪৮-৪৯
মহাদেবও তাহাকে দেখিয়া এই চিন্তা করিলেন, গিরি-সুতা তপস্যাচরণ করত ব্ৰত করিতেছে কেন? ৫০
কৃতব্রতা গর্ভ-বীজ-বর্জিতা হইলে ইহাকে গ্রহণ করিব; কালী ভাৰ্য্যা হইলে সুদয়িতা হয়, কিন্তু এ রমণী যোনি-জাতা অতএব দূষিতা। ৫১
যাহাতে ব্ৰত ও সংস্কারের দ্বারা গর্ভ-বীজ জনিত দোষ দূর হয়, কালী সেই রূপ ব্রত করিতে যত্ন করুক। ৫২
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–ভূতেশ, এই চিন্তা করিয়া ধ্যানস্থ হইলেন–ধ্যানাসক্ত হইয়া তাহার অন্য চিন্তার উদ্ভব হইত না। ৫৩
কালীও প্রতিদিন ভক্তিপূর্বক শম্ভুকে সেবা করিতে লাগিলেন এবং সতত তাহার রূপ চিন্তা করিতেন। ৫৪
ধ্যানস্থ হর, পূৰ্বচিন্তা বিস্মৃত হইয়া নিরন্তর সম্মুখস্থিতা কালীকে দেখিয়া সম্পূর্ণরূপে দর্শন করিতেন না। ৫৫
ইহার মধ্যে তারক নামক অসুররাজ ব্ৰহ্ম-বরে দর্পিত হইয়া দেবতাদিগকে ও সমস্ত জগৎস্থিত লোকদিগকে উৎপীড়ন করিতে লাগিল এবং ত্রিভুবন বশীভূত করিয়া স্বয়ং ইন্দ্র হইল। ৫৬
তারক তিনলোক জয় করিয়া নিজেই ইন্দ্র হইল এবং সমস্ত দেবতাদিগকে হারাইয়া স্বকীয় দৈত্যগণকে সেই পদে নিযুক্ত করিল। ৫৭-৫৮
তারক রাজা হইলে, যম ইচ্ছামত লোকদিকে শাসন করিতে পারিতেন। সূৰ্যও তাহার ভয়ে লোকদিগকে ইচ্ছামত তাপ দিতে পারিতেন না। ৫৯
চন্দ্র রশ্মি বিস্তার করিয়া তাহার নৰ্ম্ম-সাচিব্য করিতে লাগিলেন। বায়ু নিরন্তর সুগন্ধি গম্ভীর ও স্নিগ্ধ হইয়া তাহারই সেবাতে রত হইলেন। তারকের শাসনে বায়ু সৰ্ব্বদা তাহাকে বীজন করিতে লাগিলেন। ৬০-৬১
কুবেরও সারভূত ধন গ্রহণ করিয়া তারকের ইচ্ছানুসারে তাহার সেবা করিতে আরম্ভ করিলেন। ৬২
তারকের ইচ্ছানুসারে অগ্নি পাচক হইলেন,–ব্যঞ্জন ও অন্য ভোজনীয় বস্তু সকল তাহার ইচ্ছামত পাকাদিসম্পন্ন করিতে লাগিলেন; নিঋতি সমস্ত রাক্ষসগণের সহিত ভয়ে অশ্ব গজ ইত্যাদির শিক্ষা দিতেন। ৬৩-৬৪।
তারক অপ্সরাগণের নৃত্য দর্শনে, মাগধদিগের স্তুতিপাঠ শ্রবণে, গন্ধর্বগণের গান শ্রবণে, পরিতৃপ্ত হইয়া দেবতাদিগকে দ্বেষ করত ক্রীড়া করিতে লাগিল। ৬৫
ত্রিজগতে সমস্ত লোকদিগকে বিলোড়ন করিয়া লোক-দুর্লভ দেবতাদিগের সার সার বস্তু গ্রহণ করিল। ৬৬
শত্রু প্রভৃতি দেবগণ তারকের উৎপীড়নে পীড়িত হইয়া অনাথনাথ ব্ৰহ্মার শরণাগত হইলেন। ৬৭
ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ লোক-পিতামহ ব্রহ্মাকে প্রণাম করত এই কথা বলিলেন। ৬৮
সৰ্ব্বলোক-ঈশ্বর তারক-দৈত্য আপনার বরে দর্পিত হইয়া, আমাদিগকে হঠাৎ নিরাস করত বিষয় সকল গ্রহণ করিয়াছে। ৬৯
দিবা রাত্রি আমাদিগকে পীড়া দিতেছে, আমরা যেখানে সেখানে অবস্থান করিতেছি; আমরা পলায়িত হইয়াও সমস্ত দিকেই তারককেই দেখিতে পাই। ৭০
ব্ৰহ্মন! অগ্নি, যম, বরুণ, নিঋতি, বায়ু, কুবেরাদি দেবগণ–তাহার শাসনবশতঃ পরিবারবর্গের সহিত নিতান্ত পীড়িত হইতেছেন; ইহাদিগকে অনিচ্ছাতেও কার্য করিতে হয় এবং সকলেই তাহার অনুজীবী। ৭১-৭২
সমস্ত দেব-বনিতা ও অপ্সরাগণ এবং যাহা লোকে সারভূত, দৈত্য সে সমস্তই গ্রহণ করিয়াছে। ৬৮-৭৩
বর্তমান সময়ে যজ্ঞ হইতেছে না, তাপসগণ তপস্যা করিতেছে না এবং দান ধৰ্ম্মাদি কাৰ্যও কিছুই দেবলোকে হইতেছে না। ৭৪
তাহার সেনাপতি ক্রৌঞ্চ নামে দানব, পাতালে গমন করিয়া দিবারাত্র প্রজাদিগকে পীড়া দিতেছে। তারকের উৎপীড়নে জগৎ আকুল হইতেছে। অতএব পিতামহ! পাপিষ্ঠ তারক হইতে জগৎ পরিত্রাণ করুন। ৭৫-৭৬
আমরা যে স্থানে ছিলাম, সেইস্থানে পুনৰ্বার স্থাপন করুন। হে। লোকনাথ! হে জগৎগুরো। আমরা তারক কর্তৃক স্বস্থান হইতে বিচ্যুত হইয়াছি। ৭৭
আপনি আমাদের গতি, শাস্তা, ভ্রাতা, পিতা ও মাতা এবং ত্রিভুবনের স্থাপক ও পালক; তাহা হইলে হেপ্রজাপতে! যাহাতে আমরা তারক-রূপ বহ্নিতে দগ্ধ না হই, তাহাই এখন আপনার করা উচিত। ৭৮-৭৯
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–লোক পিতামহ ব্রহ্মা দেবগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া দেবগণকে সময়োচিত বাক্য বলিতে লাগিলেন। ৮০
হে দেবগণ! আমারই বর দানে তারক অত্যন্ত গর্বিত হইয়াছে, আমা হইতে তাহার মরণ যুক্তিযুক্ত নহে; তোমাদের প্রতিকার সমস্ত কাৰ্য্যেই কর্তব্য কিন্তু তাহার প্রতিকার করিতে প্রকাশ্য রূপে সক্ষম হইব না; যাহাতে তারক স্বয়ং ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তাহাই তোমরা যত্ন কর;-আমি তাহার উপদেশ দিতেছি। ৮১-৮৩
তারক–আমার, নারায়ণের, মহাদেবের এবং অন্য দেবগণের-কাহারও বধ্য নহে এই বর আমি তপস্যাকালে সেই তারককে দিয়াছি, কিন্তু এক উপায় আছে, হে সুরোত্তমগণ! তাহাই কর। ৮৪-৮৫
দাক্ষায়ণী সতী, পূর্বে প্রাণত্যাগ করিয়া শৈল-রমণী মেনকাসমীপে আগমন করিয়াছিলেন; গিরি তাহাকে মেনকাজঠরে উৎপাদন করিয়াছেন;-যেরূপ আমার তনয় ভৃগু পূর্বে স্বকীয় স্ত্রীতে লক্ষ্মীকে উৎপাদন করিয়াছিল। ৮৬-৮৭
মহাদেব সেই গিরি-কন্যার অবশ্য পাণিগ্রহণ করিবেন; হে, সূরগণ। যাহাতে মহাদেব, শীঘ্র অনুরক্ত হইতে পারেন, তাহাই চেষ্টা কর, তাহার তেজ আপনাদের প্রতিকারে সমর্থ হইবে। ৮৮
সেই ঊর্দ্ধরেতা শম্ভুকে গিরি তনয়াই প্রচ্যুতরেতা করিতে সক্ষমা, অন্য কোন স্ত্রী সে বিষয়ে সক্ষমা হইবে না। শম্ভুর পরিত্যক্ত তেজ হইতে যে পুত্র জন্ম গ্রহণ করিবে, সেই তারকের হন্তা; অন্য কেহই তাহাকে বধ করিতে সক্ষম হইবে না। ৮৯-৯০
সম্প্রতি সেই গিরিরাজ-সুতা পূর্ণ যৌবনা; তিনি গিরিপ্রস্থে ধ্যানরত হরকে নিত্য সেবা করেন। ৯১
হিমালয়ের বাক্যানুসারে সখীগণ-সহ কালীনাম্নী গিরিসুতা সৰ্ব্বজ্ঞ ধ্যানস্থ পরমেশ্বরকে নিরন্তর সেবা করেন। ধ্যানাসক্ত মহাদেব সম্মুখ-স্থিতা ত্রৈলোক্য সুন্দরী কালীকে মনের দ্বারাও ইচ্ছা করেন না। ৯২-৯৩
হে ত্রিদশগণ! চন্দ্রশেখর যাহাতে কালীকে ভাৰ্য্যাত্বে গ্রহণ করেন, তদ্রূপ চেষ্টা কর, তাহা হইলে অচিরাৎ স্বস্থান স্বর্গপুর লাভ করিতে পারিবে; তবে তারককেও আমি গমন করিয়া নিবৃত্ত করিব। হে নিৰ্জরগণ! তোমরা গমন। কর। ৯৪-৯৫
এই কথা বলিয়া সৰ্ব্বলোকেশ ব্রহ্মা তারকভবনে গমন করিলেন এবং তাহার নিকটে যাইয়া এই কথা বলিলেন, অহে তারক। তুমি স্বর্গরাজ্য শাসন করিও না; তোমার জন্য কেহ তপশ্চরণ করিতে পারিতেছে না। ৬-৯৭
সময়ানুসারে পূর্বে বর প্রার্থনা করাতে আমি বরদান করিয়াছিলাম, কিন্তু স্বর্গের রাজত্ব প্রাপ্তির জন্য আমি বর দিই নাই; অতএব স্বর্গ পরিত্যাগ করিয়া ক্ষিতিতলে রাজত্ব কর; সেই মর্ত্যলোকেই তোমার দেবভোগ্য সমস্তই হইবে। এই কথা বলিয়া সৰ্ব্বলোকেশ ব্ৰহ্মা সেইস্থানে অন্তর্হিত হইলেন। ৯৮-৯৯
তারকও স্বর্গ পরিত্যাগ করিয়া ক্ষিতিতলে গমন করিল; কিন্তু ক্ষিতিতলে থাকিয়াই নিরন্তর দেবতাদিগকে পীড়া দিতে লাগিল। মহাবল তারক, ইন্দ্রকে আদেশবর্তী করবহ করিল; ইন্দ্র, সতত দেবভোগ্য বস্তুসমূহ তাহাকে দিতে লাগিলেন; এইরূপ সেবা করিয়াও ঈশ্বর তারকের সন্তোষ সাধন করিতে সক্ষম হইতেন না। ১০০-১০২
এইরূপ দেবগণ পীড়িত হইয়া ক্রোধেও অত্যন্ত জর্জরিত হইলেন, হরের দারগ্রহণের প্রতি বিধাতার উপদেশানুসারে যত্ন করিলেন; তাহার পর ইন্দ্র, বৃহস্পতির সহিত মন্ত্রণা করিয়া কুসুমেয়ুকে ডাকিয়া এই কথা বলিতে অভিমত করিলেন। ১০৩-১০৪
ইন্দ্র বলিলেন, তুমি এই জগৎ প্রতিপালন করিতেছে, তুমিই এই বিশ্ব প্রসব করিয়াছ; তুমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব-ইহাদিগের প্রীতির হেতু হও; যেরূপ ব্রহ্মার প্রীতি সাধনের নিমিত্ত পূৰ্বে ব্ৰতাচরণে রতা সাবিত্রীকে গ্রহণ করাইয়াছিলে, মাধব লক্ষ্মীকে গ্রহণ করিয়াছিলেন, হর দাক্ষায়ণী সতীকে গ্রহণ করিয়াছিলেন, অতএব তাহাদিগকে প্রীতিযুক্ত কর। দেবেশদিগের সম্বন্ধে যেরূপ প্রীতি উৎপাদন করিয়াছিলে, কাম! তুমি দেবতাদিগের সেইরূপ প্রীতি উৎপাদন কর। ১০৫-১০৭
তুমি পাতালে, স্বর্গে, ভূতলে, কোন ব্যক্তির প্রিয় নও তাহা নহে, জগতের প্রাণিমাত্রেরই প্রিয়; অতএব দেব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস, মানব– ইহাদিগের সকলের তুমি পালক ও কর্তা এবং হৃদয়েও সৰ্ব্বদা বাস কর; তুমি সমস্ত জগতের হিতের জন্য চেষ্টা কর; দেব দানব, যক্ষ, মানব, সকলেরই হিতে রত হও। ১০৮-১১০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–মকরধ্বজ দেবরাজের এই সমস্ত বাক্য শ্রবণ করত প্রীত হইয়া ইন্দ্রকে এই বাক্য বলিলেন,–হে শক্র; আপনি যে কার্যের নিমিত্ত ইচ্ছা করিয়া আমাকে বলিতেছেন; সেটী আপনি অবগত আছেন; যদি আমি সক্ষম হই এবং উচিত হয়, তাহা হইলে আদেশ করুন। আমার পাঁচটা মাত্র বাণ; তাহা পুষ্পময়, অতএব মৃদু; সেইরূপ চাপ পুষ্পময়, ভ্রমরশ্রেণী গুণ; রতি আমার দয়িতা, বসন্ত সচিব, সারথি মলয়জ বায়ু, চন্দ্র আমার মিত্র, সেনাপতি শৃঙ্গার, হাব-ভাব সৈনিক;-সকলই আমার কঠিনতাশূন্য, অতএব মৃদু; আমিও সেইরূপ। যে যে কার্যে উপযুক্ত, ধীমান্ ব্যক্তি, তাহাকে সেই কাৰ্য্যে নিয়োগ করেন; যদি সে কাৰ্য্য আমা দ্বারা সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে নিয়োগ করুন। ১১১-১১৬
ইন্দ্ৰ বলিলেন, হে মনোভব। যে কার্য তোমা দ্বারা সম্পাদন করাইতে ইচ্ছা করি, সেটা তোমার উচিত কার্য; সে কাৰ্য্যে তুমি বলবান, কৃতকর্মা ও প্রাজ্ঞ কিন্তু অন্যের সেটী দুঃসাধ্য, সেই জন্য তোমাকে নিয়োগ করিতেছি। ১১৭১১৮
আমি শুনিতেছি, হিমালয় প্রস্থে বৃষভধ্বজ ধ্যানস্থ হইয়া তপস্যা করিতেছেন, কিন্তু দারগ্রহণে নিরাকাঙ্ক্ষ; পিতৃ-বাক্যানুসারে কালী, সখীগণ সহ হরের অনুমতিক্রমে তাহাকে নিত্য সেবা করিতেছে; কিন্তু ধ্যানরত মহাদেব আরূঢ় যৌবনা অতি সুন্দরী সেই স্ত্রীরকে মনের দ্বারাও ইচ্ছা করিতেছেন না। ১১৯-১২২
যেরূপে বৃষভধ্বজ কালীতে অনুরক্ত হন, তুমি দেবতাদিগের ও জগতের হিতের জন্য তাহার চেষ্টা কর। ১২৩
পূর্বে যেরূপ বৃষধ্বজ সতীতে অনুরক্ত হইয়াছিলেন, সেইরূপ তোমার যত্নে গিরিতনয়ার সহিত তাহার রমণাভিলাষ হউক। ১২৪
সেই গিরিতনয়ার প্রভাবে হরের রেতঃ স্খলিত হইবে; তাহা হইতে যে পুত্র জন্মগ্রহণ করিবে, সেই আমাদিগকে তারকাসুরের যন্ত্রণা হইতে উদ্বার করিবে। ১২৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–তাহার পর ইন্দ্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া মনোভবের পূৰ্বে ব্ৰহ্মদত্ত শাপের কাল উপস্থিত, ইহাই স্মরণ হইল। ১২৬
হে দ্বিজগণ! যে সময়ে কাম অস্ত্রের পরীক্ষার জন্য সন্ধ্যাকে উদ্দেশ করিয়া বিধাতার প্রতি পুষ্পময় বাণ নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, সেই সময়ে বিধি তাহাকে শাপ দিয়াছেন,-তুমি শম্ভুর নেত্রানলে দগ্ধ হইবে। ১২৭
যে সময়ে হর গিরিসুতার পাণি গ্রহণ করিবেন; সেই সময়ে তোমার সমস্ত শরীর ভস্মসাৎ হইবে। ১২৮
এইরূপ, ব্রহ্মার শাপ স্মরণ করত কাম ভীত হইয়াও ইন্দ্ৰবাক্যানুসারে শিবকে কালীর সহিত যোগ করিবার নিমিত্ত অঙ্গীকার করিলেন। ১২৯
কাম পুনর্বার ইন্দ্রকে তৎকালোচিত বাক্য বলিলেন। ১৩০
মদন বলিলেন,–হে শত্রু! আপনার বাক্য প্রতিপালন করিব। পূর্বে দাঙ্গায়ণীর সহিত যেরূপ হইয়াছিল, সেইরূপ গিরিজা কালীর সহিত হরের মিলন করাইব। ১৩১
কিন্তু হরের মোহ জন্মাইবার সময় আপনাদিগকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। ১৩২
যে সময়ে সম্মোহনাস্ত্র দ্বারা আমি হরের সম্পূর্ণ মোহ জন্মাইব, সেই সময়ে আমাকে সুস্থ করিতে হইবে, এই সহায়তা করিবেন। ১৩৩
আমি বসন্তের সহিত শীঘ্র শঙ্করাশ্রমে প্রবেশ করিব। প্রথমতঃ হর্ষণ বাণ দ্বারা মনের বিকার উৎপাদন করিয়া তাহার পর সমোহনাস্ত্র দ্বারা সেই গম্ভীর বৃষধ্বজকে মোহিত করিব। ১৩৪
হে বলসূদন; যে সময়ে কাল উপস্থিত হইবে, সেই সময়ে বল-সূদন আপনি আমাকে স্মরণ করিবেন; আমি কাৰ্য্য করিতে গমন করিলাম। ১৩৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–এই কথা বলিয়া মদন শঙ্করাশ্রমে গমন করিলেন এবং শত্রুও সমস্ত দেবগণকে বলিলেন। ১৩৬
হে দেবগণ! মনোভব যে কাৰ্যে গমন করিতেছে, তাহাতে আপনারা তাহার সাহায্য করুন এবং সেই স্থানে সময়ানুসারে আমাকে অবগত করাইবেন। ১৩৭
যে সময়ে সম্মোহনাস্ত্র দ্বারা মদন মহাদেবকে মোহিত করিবে, সে সময়ে আমিও সেই স্থানে যাইব, আমাকে আপনারা জানাইবেন। ১৩৮
শক্র এই কথা বলিলে দেবগণ-মনোভব-সমীপে গমন করিলেন এবং মদনও হিমালয়ের গঙ্গাপ্রবাহস্থানে হরের তপস্যাভূমিতে যাইয়া সেই সানুতে অনুচর বসন্তকে নিয়োগ করিলেন। ১৩৯
তাহার পর সুরভি সেই স্থানে অবতীর্ণ হইল, ক্ষণকালমধ্যে তরু গুল্মলতা দিতে তাহার চিহ্নে প্রকাশ পাইল। ১৪০
কিংশুক, রঞ্জন, কেশর প্রভৃতি পুষ্প প্রস্ফুটিত হইল; সরোবর সমস্ত প্রফুল্ল পদ্মফুলে শোভা পাইতে লাগিল; জন্তুগণ বিকারভাব প্রাপ্ত হইল। ১৪১
বায়ু-গম্ভীর ও পুষ্পরেণু দ্বারা সুগন্ধিভাবে প্রবাহিত হইতে লাগিল। কাম, ধীরে ধীরে সুখকর কারণ সমস্ত আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। ১৪২
মৃগ, পক্ষী, সিদ্ধ, কিন্নর প্রভৃতি জীবগণ দ্বন্দ্বভাব প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল। ১৪৩
সেই স্থানে চূতবৃক্ষ কুসুমিত হইয়া অভিনব স্তবক দ্বারা ভূষিত হইল। হে দ্বিজগণ! অশোক, পাটল, নাগকেশর ও করুণাদি বৃক্ষ সকল কুসুমস্তবকে সুশোভিত হইল। ১৪৪
শিবের প্রমথাদিগণসমস্তও বিকৃতভাব প্রাপ্ত হইল। শম্ভুর ভয়ে তাহারা প্রত্যক্ষভাবে বিকারজনিত কার্যে প্রবৃত্ত হইতে পারিল না। ১৪৫।
সেই স্থানে ভ্রমরকুল কুসুম-সৌরভে আকৃষ্ট হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিল এবং সুমধুর গুঞ্জন করিয়া জায়ার সহিত মধুপানে মত্ত হইল। ১৪৬
এইরূপ বসন্ত প্রবৃত্ত হইলে শৃঙ্গার, পরিজনের সহিত হাব-ভাব সহ যুক্ত হইয়া, হর-সমীপে উপস্থিত হইলেন। ১৪৭।
মদন, সমস্ত পরিজনের সহিত এইরূপ অবস্থান করিয়া, শম্ভুর কোনরূপ ছিদ্র পাইলেন না–যে, প্রবিষ্ট হইবেন। ১৪৮
যে সময়ে বা প্রবেশের ছিদ্র প্রত্যক্ষ হয়, সে সময়ে তিনি ভয়ে আকুল হইয়া পড়েন! রতি এই কার্যে অগ্রসর হইতে বারণ করিয়াছেন বলিয়া শিবের প্রতি অগ্রসর হইতেছেন না। ১৪৯
হে দ্বিজগণ! এইরূপভাবে মদনের অনেক কাল অতিবাহিত হইল; বিশেষ সাবধানে প্রতীক্ষা করিয়াও প্রবেশের পথ পাইলেন না। ১৫০
জ্বলন্ত-কালাগ্নি সদৃশ প্রদীপ্ত অত্যন্ত প্রভাশালী ধ্যানস্থ সেই শঙ্করকে কোন্ ব্যক্তি বিকৃত করিতে সক্ষম হইবে? ১৫১
অনন্তর গিরিজা কালী সখীগণের সহিত হরসমীপে তাহার কর্তব্য-কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়া প্রণাম করত অবস্থান করিতে লাগিলেন। ১৫২
শঙ্করও ধ্যান পরিত্যাগ করিয়া ক্ষণকাল অবস্থান করিতে লাগিলেন। কাম, ভাবী চিন্তা না করিয়া পরিবারবর্গকে কাৰ্য্যে নিয়োগ করিলেন এবং ছিদ্র প্রাপ্ত হইয়া প্রথমতঃ পার্শ্বে অবস্থান করত হর্ষণ বাণ দ্বারা চন্দ্রশেখরকে হাস্য পরতন্ত্র করিলে সে সময়ে শৃঙ্গার, হাবভাবও বসন্তের সহিত কামের সাহায্যার্থে গমন করিল। ১৫৩-১৫৫
হর্ষণবাণ-প্রভাবে হৃষ্ট শঙ্কর শৃঙ্গারাদির বশীভূত হইয়া কালীর বদন সাদরে অবলোকন করিতে লাগিলেন। ১৫৬
কাম সেই ছিদ্র পাইয়া পুষ্পবাণ যোজনা করিলেন; বাণটী সমোহন ও পুষ্পযুক্ত পুষ্পমালা দ্বারা বর্ধিত। ১৫৭
তাহার দক্ষিণপাশে রতি, বামে প্রীতি, পৃষ্ঠে বসন্ত তিনি পুষ্পময় তূণীর গ্রহণ করিয়া সাবধানে কর্ণ পৰ্যন্ত সেই পুষ্পচাপ যে সময়ে আকর্ষণ করিলেন, সেই সময়ে বায়ু, গন্ধ বহন করিয়া হরসমীপে যাইয়া আমোদিত করিল; পুষ্পবাণ সংযত হইলে, চন্দ্রশেখর ইন্দ্রিয়-বিকার প্রাপ্ত হইয়া, গিরিতনয়াকে সম্ভোগের নিমিত্ত গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিলেন। ১৫৮-১৬০
সেই সময়ে ইন্দ্রাদি দেবগণ বিবেচনা করিলেন, দেবকার্যে মনোভবকে উপযুক্ত নিয়োগ করা হইয়াছে। ১৬১
অনন্তর, মহাদেব ইন্দ্রিয়ের বিকৃতভাব স্মরণ করিয়া তাহাকে নিগ্রহ করিতে সংযম করিলেন এবং সহসা এই চিন্তা করিতে লাগিলেন। ১৬২
যোনিজা অননুষ্টিত-তপোব্ৰতা কালীকে অভিলাষ-যুক্ত হইয়া হঠাৎ সদ্ভোগ করিবার নিমিত্ত ইচ্ছা হইল কেন? ১৬৩
দাক্ষায়ণী সতীর ন্যায় তপোব্ৰতানুষ্ঠান-পবিত্ৰ-কলেবরা এবং তপশ্চরণে সংস্কৃত-শরীরা দয়িতাকে আমি নিজেই গ্রহণ করিব, কিন্তু সম্প্রতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এরূপ বিকৃতাভিলাষী হইতেছি কেন? ১৬৪
আমার বোধ হইতেছে যেন কেহ আকর্ষণ করিয়া সঙ্গমে ইচ্ছা জন্মাইতেছে। ১৬৫
মহাদেব এইরূপ ইন্দ্রিয়-বিকারের কারণ নিশ্চয় করিরা সম্মুখে বাণ-সংযত পুষ্প-ধনু-হস্তে কামকে দেখিলেন। ১৬৬
এই অবসরে ব্রহ্মা সময় জানিতে পারিয়া দেবতাদিগকে দর্শন করিবার নিমিত্ত সেই দেব-সমাজে উপস্থিত হইলেন। ১৬৭
তাহার পর মহাদেব কূপিত হইয়া সংযত-বাণ মনোভবকে হঠাৎ দগ্ধ করিবার ইচ্ছায় ক্রোধে অগ্নিসদৃশ জ্বলিতে লাগিলেন। ১৬৮
এই কাম, সময় জানিতে পারিয়া দেবতাদিগের কার্য উদ্ধারের জন্য আমার মনের মোহ জন্মাইতে চেষ্টা করিতেছে, অতএব ইহাকে যম-ভবনে প্রেরণ করিব। ১৬৯
এই প্রকার চিন্তা করিতে করিতে তাঁহার নেত্র হইতে ক্রোধবশতঃ বর্ধিত অগ্নির ন্যায় তেজ নির্গত হইল; পিতামহ, নেত্ৰ-নিঃসৃত জ্বলন-সদৃশ সেই ক্রোধাগ্নি দেখিয়া কামের পুষ্পবাণ, ধনু, শক্তি, প্রাণ, আত্মা এবং বসন্ত এই সমস্তই আকর্ষণ করিয়া কাম হইতে পৃথক করিলেন এবং নিজ শক্তি দ্বারা এই রূপে কামকে রক্ষা করিলেন। ১৭০-১৭২
অনন্তর আকাশস্থ দেবগণ মহেশ্বরকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া বলিলেন, হে জগন্নাথ! আপনি প্রসন্ন হউন, কামের প্রতি ক্রোধ সম্বরণ করুন; আপনিই পূৰ্বে শম্ভু রূপে সৃজন করিয়া যে কর্মে নিয়োগ করিয়াছেন, মনোভব, তাহাই করিতেছে, হে শম্ভো! আপনি কামের প্রতি নিক্ষিপ্ত ক্রোধানল সম্বরণ করুন; হে সৰ্ব্ব ভূতেশ। আমরা সকলে প্ৰণত হইয়া বলিতেছি, ক্ষান্ত হউন। ১৭৩-১৭৫
দেবগণ এইকথা বলিতে বলিতে হরের ললাটস্থিত নেত্র হইতে উদ্ভূত অনল মনোভবকে ভস্মসাৎ করিল এবং অনল, কামকে দগ্ধ করত শিখামালাতে অত্যন্ত উদ্দীপ্ত হইয়া ব্রহ্মার কৌশলে স্তম্ভিত হইয়া হর সমীপে যাইতে সক্ষম হইল না। ১৭৬-১৭৭
অনন্তর মহাদেব মনোভবশরীর-জাত ভস্ম গ্রহণ করিয়া সমস্ত শরীরে লেপন করিলেন; তাহার শেষভাগ গ্রহণ করত বিধির মত্যনুসারে গণসহ কালীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্তর্ধান হইলেন। ১৭৮-১৭৯
ক্রোধানল, দর্শকবৃন্দকে ভস্ম করিতে উদ্যত দেখিয়া ব্ৰহ্মা তাহাকে দেবতা দিগের সমক্ষেই, বড়বা-রূপ করিলেন। ১৮০
সে সময়ে দেবগণ সেই অগ্নিপ্রভাবে পূৰ্বে পীড়িত হইয়াছিলেন, বর্তমান সময়ে জ্বালামুখী সেই বড়বাকে দেখিয়া নির্বিঘ্নমনা হইলেন। ১৮১
তৎপরে জগৎপ্রভু বিধি, জ্বালামুখী বড়বাকে লইয়া, লোকের হিতের জন্য সাগরসমীপে গমন করিলেন। ১৮২
অনন্তর হে বিপ্রেন্দ্রগণ! ব্রহ্মা সাগরতটে গমনের পর সাগরের পূজা গ্রহণ করিয়া, একটা সময় প্রতিপালনের আদেশ করিলেন। ১৮৩
এই বড়বারূপ-ধারী মহাদেবের ক্রোধ, যতদিন আমি ইহাকে পুনর্বার গ্রহণ না করি, ততদিন তোমার–এই জ্বালামুখ বড়বারূপ মহাদেবের ক্রোধকে ধারণ করিতে হইবে। ১৮৪
হে সরিৎপতে। যে সময় আমি আগমন করিয়া পরিত্যাগ করিতে বলিব, সেই সময়ে এই বড়বামুখ ক্রোধকে পরিত্যাগ করিও। ১৮৫
তোমার জলপান করিয়া বড়বা অবস্থান করিবে, তুমি ইহাকে ধারণ করিবে, যেন অন্তরে না যাইতে পারে। ১৮৬
ব্ৰহ্মা এই কথা বলিলে সাগর, বড়বামুখ শম্ভুর ক্রোধকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত অশক্ত হইলেও অঙ্গীকার করিলেন। ১৮৭
তাহার পর বড়বামুখ পাবক, সাগরে প্রবেশ করত জ্বালাসমূহে প্রদীপ্ত হইয়া সম্পূর্ণরূপে বারিসমূহ দগ্ধ করিতে লাগিল। ১৮৮
শিবনেত্ৰাগ্নি যে সময়ে মদনকে দগ্ধ করে, সে সময়ে যে শব্দ হইয়াছিল, সেই শব্দে গগণ পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়াছিল। ১৮৯
মদন-দাহ সময়ে যে শব্দ হইয়াছিল, সেই ঘোর শব্দে কালী সখীগণের সহিত ভীতা হইয়া শোকাকুলাও হইয়াছিলেন। ১৯০
সেই শব্দে হিমালয় বিস্মিত ও চকিত-প্রায় হইয়া শিবের আশ্রমস্থিতা কালীর সমীপে গমন করিলেন। ১৯১
অচলেশ্বর এইস্থানে কালীকে ভীতা ও শম্ভুবিরহে শোকাকুলা দেখিয়া, হস্তদ্বারা নয়নজল মার্জনা করিলেন এবং বলিলেন, কালি! ভয় নাই, রোদন করিও না। ১৯২-১৯৩
এই বলিয়া গিরি, তাহাকে ক্রোড়ে ধারণ করিলেন। তাহার পর পীড়িতা কালীকে লইয়া নিজ ভবনে গমন করত সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।১৯৪
শিব অন্তর্হিত হইলে কালী তাহার বিরহে নিরন্তর শোক ও মোহে নিতান্ত অভিভূত হইয়া পিতার গৃহে বাস করিতে লাগিলেন। ১৯৫
অনন্তর শৈলরাজ, মেনকা, মৈনাক প্রভৃতি ভ্রাতাগণ ও সখীদ্বয়, কালীকে সান্ত্বনা করিলেন। তাহা হইলেও প্রবল পরাক্রান্তা কালী হরকেই নিরন্তর স্মরণ করিতে লাগিলেন। ১৯৬৭
দ্বিচত্বারিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৪২