ভূকৈলাশের রাজবাড়িতে এক মহাপুরুষ এসেছেন। শহরের সকলের মুখে মুখে এখন শুধু সেই মহাপুরুষের কথা। কেউ বললো, ইনি সত্যযুগের মানুষ, সেই যে শ্ৰীরামচন্দ্রের আমলে ধ্যানে বসেছিলেন, তারপর আর খেয়ালই করেননি যে কত হাজার বছর কেটে গেছে। কেউ বললেন, ইনি বাল্মীকি মুনির ছোট ভাই, এনারও সারা গায়ে উইয়ের টিপি। কেউ বললো, শুধু উইয়ের টিপি নয়, তার ওপর আবার বড় বড় বট ও অশ্বত্থ গাছও গজিয়ে গেছে।
নবীনকুমার ঠিক করলো, সেই মহাপুরুষকে দেখতে যাবে।
বিবাহের পর নবীনকুমার অকস্মাৎ অনেকখানি বদলে গেছে। আর সে তার মায়ের নয়নের মণি, আদরের দুলালটি নেই। সে সদ্য ত্রয়োদশ বৎসর অতিক্রম করলেও এখন একজন বিবাহিত পুরুষ এবং সিংহ বাড়ির কতা। বিধুশেখর বহুমূত্র রোগে কাবু হয়ে পড়েছেন, আগেকার মতন আর প্রতিদিন তিনি এ গৃহে আসতে পারেন না, সম্প্রতি কিছুদিন তিনি একেবারেই শয্যাশায়ী। এদিকে গঙ্গানারায়ণও যে সেই মহাল পরিদর্শনে গেছে, তারপর সাড়ে পাঁচ মাস হয়ে গেল তার আর কোনো সংবাদ নেই।
বিম্ববতী গঙ্গানারায়ণের জন্য খুবই উৎকণ্ঠিত। গঙ্গানারায়ণ তো কখনো এমন করে না। অন্তত লোক পাঠিয়ে সে তো একটা খবর দিতে পারতো। বিম্ববতী বিধুশেখরকে বলেছিলেন গঙ্গানারায়ণের একটা খোঁজ নিতে, কিন্তু বিধুশেখর গা করেননি। তিনি বলেছিলেন, বজরা তো এখনো ফেরেনি, তাহলে দ্যাকো গে তোমার বড় পুতুর কোতায় না কোতায় হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্চে!
বিম্ববতী এরপর দিবাকরকে ডেকে স্বয়ং হুকুম দিয়েছিলেন গঙ্গানারায়ণের সংবাদ আনবার জন্য দ্রুতগামী ছিপে কোনো কর্মচারীকে প্রেরণ করতে। দিবাকর তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু গঙ্গানারায়ণের খবর জানতে তো তার ভারী গরজ! গঙ্গানারায়ণ যতদিন দূরে দূরে থাকে, ততদিনই তার পোয়া বারো। তাছাড়া সে একটি বাংলা সংবাদপত্রে পাঠ করেছে যে ইব্রাহিমপুর পরগনায় নীলকর সাহেব ও স্থানীয় রায়তদের মধ্যে নাকি একটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। গঙ্গানারায়ণ সেই হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়লে তো আরোই মঙ্গল। সুতরাং, গঙ্গানারায়ণ গেছে নদীয়ায়, আর তার সংবাদ আনাবার জন্য দিবাকর একজন পাইককে সত্বর পাঠিয়ে দিলে খুলনার দিকে। বিম্ববতী মাঝে মাঝে ডেকে প্রশ্ন করেন। দিবাকর নানাপ্রকার ভুজং ভাজুং দেয়।
বিয়ে দিলে ছেলে পর হয়ে যায়। নবীনকুমারের বিবাহের ছাঁ মাসের মধ্যেই বিম্ববতী অনুভব করলেন, তাঁর বুকের ধন ছোটকু আর তাঁর বাধ্য নেই। নবীনকুমারের পত্নী কৃষ্ণভামিনীর বয়েস মাত্র আট বৎসর, ঐ বয়েসী বধুরা সাধারণত পিত্ৰালয়ে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণভামিনী তার খেলার পুতুল, তাকে সর্বক্ষণ নবীনকুমারের কাছে চাই। শুধু তাই নয়, এতকাল সে মায়ের পাশে শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। এখন নবীনকুমার বিবাহিত পুরুষ, সে অবিকল কোনো বয়স্ক ব্যক্তির মতন নিজেই ব্যবস্থা করে পৃথক কক্ষে তার খেলার সঙ্গিনীকে নিয়ে রাত্রিযাপন করে।
এখন প্রতি রাত্রে বিম্ববতীর বুক নিদারুণভাবে খালি খালি লাগে, তাঁর ঘুম আসে না।
নবীনকুমার অন্যান্য ব্যাপারেও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। সে মায়ের অনুমতি না নিয়েই এখন বাড়ির বাইরে যায়। বিম্ববতী তাকে নিষেধ করতে গিয়ে বার বার হার মেনেছেন। নবীনকুমার মুখের ওপর জানিয়ে দেয়,আমি তো আর দুধের বাছটি নেই মা, যে কাবুলি মেওয়াওয়ালারা ঝোলায় পুরে নিয়ে যাবে আর গরম কড়ার ওপর উল্টো করে বুলিয়ে রেকে নাক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বার কর্বে!
নবীনকুমারকে এখন সর্বব্যাপারে তাল দিচ্ছে দিবাকর। মনে মনে সে মতলব এঁটে রেখেছে যে এই ছোটবাবুটিকে একবার খরচের হাত ধরিয়ে দিতে পারলেই হয়। অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক এই বালক, একবার এ খরচ শুরু করলে পারিষদরাই তো তার মোটা ভাগ পাবে। বাবু রামকমল সিংহ ছিলেন দিলাদরিয়া মানুষ, তাঁর আমলে দিবাকরের বিলক্ষণ দশ টাকা উপরি রোজগার হতো। তিনি অকালে গত হওয়ায় দিবাকর বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। বিধুশেখরের তীক্ষ্ণ নজর হিসাবপত্রের দিকে। আর গঙ্গানারায়ণ তো কলেজে-পড়া ম্লেচ্ছভাবাপন্ন ছোঁড়া। তার সেরকম বুনিয়াদি উঁচু নজরই নেই যে পাঁচ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকা ব্যয় করবে। আরে, কলকাতা শহরে বাবু সমাজে দুহাতে টাকা না ওড়ালে যে মান থাকে না, লোকে আড়ালে ছা ছ্যা করে, সে জ্ঞানই হলো না গঙ্গানারায়ণের। দিবাকরের খুব আশা নবীনকুমারের মতি এদিকে ফেরানো যাবে।
গত মাসে নবীনকুমার নিজে গিয়ে হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়ে এসেছে। বিম্ববতীর আপত্তিতে সে কৰ্ণপাত করেনি, এবং বিধুশেখরেরও আপত্তি জানাবার মতন আর কোনো যুক্তি নেই। হিন্দু কলেজে হীরা-বুলবুল পর্ব সমাপ্ত হয়েছে, বিতাড়িত হয়েছে চন্দ্রনাথ, এখন আর বেশ্যাপুত্রের সংসর্গে থাকার কোনো প্রশ্ন নেই। হিন্দু কলেজে আবার আস্তে আস্তে ফিরে আসছে প্রাক্তন ছাত্ররা বড়ঘরের ছেলেরাও। ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন সাহেবের নতুন কলেজের যতই রবরবা হোক, তবু হিন্দু কলেজ কতদিনের ঐতিহ্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বাপ-কাকারা যেখানে পড়েছে, অনেক ছাত্র সেখানেই পড়তে চায়।
কলেজ থেকেই নবীনকুমার শুনে এসেছে মহাপুরুষের কাহিনী। ছাত্ররা সবাই বলাবলি করছিল ঐ কথা। ক্লাসে তো এই সব গল্পই হয়।
পুনর্গঠিত হিন্দু কলেজে আগেকার সেই শৃঙ্খলা আর নেই। কোনো কিছু একবার ভাঙলে ঠিক মতন জোড়া লাগানো শক্ত। আগে হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়াই ছিল একটি কঠিন ব্যাপার। বংশ পরিচয়, বিত্ত এবং মেধার পরিচয় না নিয়ে কোনো ছাত্রকে গ্ৰহণ করা হতো না। হীরা, বুলবুল পর্বচুকে যাবার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তোষামোদ করে ছাত্রদের ডেকে এনেছেন। এই সুযোগে অনেক অগা বগা দুঃশীল বালকও ঢুকে পড়েছে ছাত্র সেজে। পড়াশুনোর বদলে ক্লাসের মধ্যে এখন হই হট্টগোলই হয় বেশী।
এই পরিবেশটি নবীনকুমারের বেশ পছন্দ। অতি অল্প দিনেই সে সদার গোছের হয়ে উঠেছে ক্লাসের মধ্যে। নানাপ্রকার দুষ্ট আমোদে সে উস্কানি দেয়। শিক্ষক যখন ক্লাসে থাকেন না। তখন কক্ষটি হয়ে ওঠে একটি হট্টমেলা। ছেলেরা কেউ শ্যামা পাখির মতন শিস দেয়, কেউ পায়রার মতন বকম বকম করে, কেউ ঘোড়া সেজে চার পায়ে ছোটে, কেউ বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করে দেখায়, আর নবীনকুমার এইসব উপভোগ করে তীক্ষ্ণ স্বরে হাসে।
এক একদিন এক একরকম হুজুগের গল্প শোনা যায়।
যেমন একদিন জলখাবার ছুটির সময় কাশীপুর অঞ্চল নিবাসী এক ছোঁকরা বললো, জানিস, কাল বৈকালে পাকপাড়ার লালাবাবুদের বাড়িতে কী হয়েচে? একদল মাতাল গোরা লালারাজাদের বাড়িতে এসে হামলে পড়ে চার পাঁচজন দারোয়ানকে বিশায় বিদে গিয়েচে!
অমনি অন্য ছাত্ররা রই রই করে উঠলো। একজন কিছু বললে অন্য কেউ তার প্রতিবাদ করবেই। একজন বললো, পাকপাড়ায় কী হয়েচে, তা তুই জানলি কী করে রে? কাশীপুরের ছাত্র বললো, আমি সন্ধেবেলা ঐ পথ দিয়ে যাচ্চিালুম, নিজের চোকে দেকিচি!
আর একজন বললো, পাকপাড়ায় মাতাল গোরা আসবে কোতা থেকে? কাল সন্ধেবেলা চরস খেয়েচিলি নিশ্চয়?
অন্য একজন কাশীপুরীর সমর্থনে বললে, কেন, দমদমা থেকে ময়দানের কেল্লায় তো গোরারা হরদমই যাতায়াত কর্চে। আর তারা তো সর্বক্ষণই মাতাল হয়ে থাকে।
অন্য কয়েকজন একসঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল, নবীনকুমার তাদের থামিয়ে দিয়ে বললো, আঃ, দাঁড়া না, তারপর কী হলো শুনি। রাজারা কী কল্লেন?
কাশীপুরী বললো, রাজারা ভয় পেয়ে হাসন হোসেন বলতে বলতে বুক চাপড়ে দৌড়ে পুরোনো এক পাতকের মধ্যে সেদিয়ে প্রাণরক্ষা কল্লেন।
নবীনকুমার বললো, রাজারা পাতকোর মধ্যে সেঁধুলো কী করে, গিরগিটি নাকি?
অমনি হাসির গরুরা পড়ে গেল।
আর একটি ছাত্র বললো, আরো তা নয়, তা নয়। আসল কতটা আমি জানি, আমার বড়দাদার কাচে শুনিচি। রাজাদের বাড়ির সামনের গাচে একটা কাগ বসেছেল, এক সাহেব শিকারী বন্দুকের তাক ঠিক আছে কিনা দেকবার জন্য সেই কাগটাকে যেই মারলো অমনি রাজাদের দারোয়ান তেড়ে তাকে মাত্তে গেল…
তাকে থামিয়ে দিয়ে আর একজন বললো, ধোৎ, যতসব বাজে কতা! আমাদের পাশের বাড়ির কতা, আমি জানি না, তোরা জানিস!
নবীনকুমার সেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো, তুই লালারাজাদের পাশের বাড়ি থাকিস? আগে তো কখনো শুনিনিকো!
সে ছেলেটি বললো, আলবত আমাদের পাশের বাড়ি। রাজাদের বাড়ির পৌঁছুনে যে বড় পগারটা রয়েচে জানো? তারই পাশে যে পচা পুকুর, সেখানেই আমাদের বাড়ির খিড়কি! তাহলে?
নবীনকুমার বললো, তাহলে তো পাশাপাশি বটেই। তুই তা হলে বল—
সে বললো, রাজাদের এক আমলার মুখখানা ঠিক বানরের মতন। দেখলেই ভেংচি কাটতে ইচ্ছে করে। আমরা কতবার তাকে দেকে ভেংচি কেটে পালিয়িচি, কালকে হয়েচে কী,একজন সাহেব ঐ আমলার ভাইকে দেখে ভেংচেছিল, তাতে আমলার ভাইও ভেংচোয় আর চেঁচিয়ে বলে, তুইও তো একটা লালমুখো বানর রে! ব্যস, অমনি সাহেব গেল ক্ষেপে, আরও সাহেবরা দলবল মিলে এসে রাজবাড়ির ওপর গুলি চালালে!
ছেলেরা হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে। ফুর্তির চোটে কেউ একজন গল্পকারকে চ্যাংদোলা করে তুলে ফেললো।
আরও কেউ কেউ এই ঘটনার অন্য ভাষ্য দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় ঢং ঢেং করে দুটোর ঘণ্টা বেজে গেল। আর মাস্টারমশাইও তামাক খাবার ঘর থেকে চলে এলেন ক্লাস রুমে। তখনকার মতন গোলমাল চাপা পড়লো।
পরদিন। কিন্তু দেখা গেল ঘটনাটা একেবারে অমূলক নয়। একটা কিছু ঘটেছে পাকপাড়ার রাজবাড়িতে। একটি বাংলা সংবাদপত্রে লিখলে, একদল গোরা বাজনা বাজিয়ে যাইতেছিল, দলের মধ্যে একজনের জলের তৃষ্ণা পাইল, রাজাদের বাড়িতে যেমন জল খাইতে যাইবে জমাদার গলাধাক্কা মারিয়া বাহির করিয়া দেয়, তাহাতে সঙ্গের কর্নেল গুলি করিতে হুকুম দ্যান।
কিন্তু ক্লাসের ছেলেরা কেউ খবরের কাগজের বিবরণ সত্য বলে মানতে রাজি নয়। পরদিন তারা আরো অনেকে একটা করে গল্প বানিয়ে এনেছে। কেউ বললে, লোক মারা গেছে দশ জন, কেউ বললে পঞ্চাশ। কেউ বললে, দৌড়ে পালাতে গিয়ে বড় রাজার ঠ্যাং ভেঙে গেছে। কেউ বললে, ছোট রাজা মুক্তকচ্ছ হয়ে এমন দৌড়েছিলেন যে গঙ্গার ধারে পৌঁছেও থামতে ভুলে গিয়ে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জলে। এদিকে তিনি আবার সাঁতার জানেন না।
সেদিন জল খাবার ছুটির সময় নবীনকুমার পালিয়েছিল কলেজ থেকে। তার কৌতূহল অপরিসীম, সে আসল ঘটনাটা জানতে চায়। কলেজের গেটের কাছে তার জুড়িগাড়ি সর্বক্ষণ অপেক্ষা করে, তাতে বসে থাকে দুলাল। নবীনকুমার গাড়ি হাঁকাতে বললো পাকপাড়ার দিকে।
এই বয়েসেই নবীনকুমার বংশমর্যাদা সম্পর্কে অতিশয় সচেতন। অনিমন্ত্রিত অবস্থায় কোনো বড় মানুষের গৃহে যাওয়া তার মানায় না। সে পাকপাড়ার রাজাদের বাড়ির সামনে এসে গাড়িতে বসেই তাকিয়ে দেখলো দেউড়ির দিকে। সেখানে অস্বাভাবিকতার কোনো চিহ্নই নেই। উদিপরা দারোয়ানরা দাঁড়িয়ে আছে বিশ হাতে, লোকজন যাতায়াত করছে, এমনকি রাজাদের একজনকেও যেন দেখা গোল বার বাড়িতে বসে গড়গড়া টানছেন।
নবীনকুমার দুলালকে পাঠিয়ে বললো, যা, গিয়ে জেনে আয় তো সঠিক কী হয়েচে।
দুলাল দেউড়ির কাছে গিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ফিরে এলো। একটা কিছু ঘটেছে ঠিকই। তবে অতি সামান্য ব্যাপার। একজন নতুন গোছের ফিরিঙ্গি শিকারী এদিকে এসে ঘোরাঘুরি করছিল দুদিন আগে। পাকপাড়ার দিকে প্রচুর শেয়াল, এমনকি দিনের বেলার দিকেও দেখা যায় শেয়ালদের ঘোরাঘুরি করতে। ফিরিঙ্গিরা অযথা শেয়াল মারতে ভালোবাসে, এক শেয়ালকে তাড়া করছিল সেই শিকারী, তারপর সে শেয়ালটি নাকি রাজবাড়ির বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ে। শিকারীটিও যেই বাগানে ঢুকতে যাবে, তখন তাকে বাধা দেয় এক দ্বারবান। কিন্তু শিকারের ঝোঁক একবার মাথায় চাপলে তখন আর শাদা চামড়াদের কোনো জ্ঞান থাকে না। তোকাঁতর্কির সুযোগে শেয়ালটা পালিয়ে যাচ্ছে ভেবে শিকারীটি তখন একজন দারোয়ানকেই গুলি করে মেরে দেয়।
তারপর রাজারা বেরিয়ে এসে শিকারীর কাছে ক্ষমা চান এবং শিকারীটিও মাথা ঠাণ্ডা হলে বলে যে লোকটিকে মেরে ফেলবার ইচ্ছে তার ছিল না, হঠাৎ হাত ফসকে গুলি বেরিয়ে যায়। সাহেবের হাত ফসকে গুলি বেরিয়েছে, তবে তো কোনো কথাই নেই। আসলে দ্বারবানটির আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছিল বলেই না সে পঞ্চাত্ব লাভ করেছে! ব্যস, সেখানেই চুকে গেছে সব কিছু। রাজারা নিহত দারোয়ানের পরিবারকে দুশো টাকা দান করেছেন।
দুলালের মুখে সব বিবরণ শুনে নবীনকুমার বক্রভাবে হাসলো।
ভূকৈলাশের রাজবাড়িতে মহাপুরুষের আগমন ব্যাপারটাও নবীনকুমার নিজের চোখে যাচাই করতে চায়। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খাবারদাবার খেয়ে নবীনকুমার দুলালকে ডেকে বললো, আবার গাড়ি যুততে বল, চল ভূকৈলাশ থেকে ঘুরে আসি।
এখানেও প্রথমে নবীনকুমার গাড়ি থেকে না নেমে প্রথমে দুলালকে পাঠালো। দুলাল ঘুরে দেখে এসে বললো, হ্যাঁ, সত্যিই একজন জটাজুটধারী লোক রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে বসে আছেন বটে, তাঁকে ঘিরে দারুণ ভিড়।
নবীনকুমার বললো, তেনাকে দোকতে কেমন?
দুলাল প্ৰথমে বললো, দোকলে ভয় করে।
তারপরই আবার বললো, ভক্তিও হয়। আমি পেন্নাম করিচি, দূর থেকে।
নবীনকুমার ধমকে বললো, তোর ভয় করে না ভক্তি হয়, সে কতা কে জানতে চাইচে? বলচি যে লোকটার চেহারা কেমন?
দুলাল বললো, ইয়া মোটা। সারা গায় মাটি ল্যাপা, তার ওপর ঘাস ঘাস মতন দেকলুম বটে, কিন্তু বট অশ্বত্থ গাছ দেকিনি। মাতায় দুটো অজগর সাপের মতন জটা, বুকের ওপর পড়ে আচে। চোক বোঁজা।
এমন মানুষকে স্বচক্ষে না দেখলে চলে না। এত লোকের ভিড় যখন, তখন এর মধ্যে মিশে গেলে কেউ তাকে চিনবে না। কৌতূহল সামলাতে না পেরে নবীনকুমার নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।
বয়সের তুলনায়ও নবীনকুমারের শরীরটি ছোটখাটো, রোগা পাতলা। কিন্তু কুচোনো ধুতি, হলুদ রঙের রেশমী বেনিয়ান ও কাঁধে চীনা সিল্কের চাদর ও পায়ে চকচকে পালিশ করা কালো পাম্প শু—এবং তার মুখের গাম্ভীর্য ও ধীর পদক্ষেপ দেখে কোনো রাশভারী ব্যক্তি বলে ভ্ৰম হয়। এবং তার দৃষ্টি অত্যুজ্বল।
দর্শনার্থীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশী। অবিদ্যা, ঘুসকি ও গোরস্ত মেয়েদের ভিড় ঠেলে নবীনকুমার গিয়ে দাঁড়ালো একেবারে সামনে। মহাপুরুষের মূর্তি দেখলে সত্যিই প্রথমটায় বুক কেঁপে ওঠে। মনে হয় মানুষ না যেন ছোটখাটো একটি পাহাড়। চার পাশের লোক গুঞ্জন করে নানা কথা বলছে। দশদিন ধরে উনি এখানে আছেন, এর মধ্যে একবারও ওঠেননি, মলমূত্র ত্যাগ করেননি, কিছু খাননি, এমনকি চোখও খোলেননি। রাজবাড়ির লোকেরা ওঁকে পরীক্ষা করবার জন্য প্রথমে দু-একদিন ক্যানের কাছে ঢাকঢোল বাজিয়েছেন, তবু কোনো সাড় দেখা যায়নি ওঁর শরীরে। এখন আর সে চেষ্টা কেউ করে না। উনি নাকি চোখ খুললেই সবাই ভস্ম হয়ে যাবে। সবাই ওঁর পায়ের কাছে টিপ টিপ করে প্রণাম করছে আর ছুঁড়ে দিচ্ছে পয়সা।
বেশীক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না ভিড়ের চাপে। নবীনকুমার আর দুলালচন্দ্ৰ আস্তে আস্তে সরে এলো সেখান থেকে। এর মধ্যে আরও অনেক খবর শোনা গেল। মহাপুরুষের গায়ের যে মাটির প্রলেপ, তা কেমন ভেজা ভেজা। দশদিন ধরে মাটি ওরকম ভেজা ভেজাই রয়েছে। গঙ্গার ধারে উনি মাটি ফুড়ে উঠেছেন, সেইজন্যই ওঁর গায়ে ভিজে গঙ্গামাটি।
ফেরার পথে নবীনকুমারের ওষ্ঠে মৃদু হাস্য লেগে রইলো। মহাপুরুষকে দেখে সে বেশ মজা পেয়েছে। বাড়ি ফিরেই সে কৃষ্ণভামিনীকে মহাপুরুষ দর্শনের অভিজ্ঞতা শোনাবার জন্য তাকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো, কৃষ্ণভামিনী বসে আছে তার মায়ের কক্ষে। সেখানে তার জ্যেঠাইমা হেমাঙ্গিনী ও আরও কয়েকজন স্ত্রীলোক বসে গল্প করছিলেন। সবাই, নবীনকুমারকে দেখে নিজেদের কথা থামিয়ে বললো, আয় এখেনে বোস, কী দেকলি? কেমন দেকলি?
নবীনকুমার মহাপুরুষের চেহারার বর্ণনা দিয়ে বললো, এমন কতা কখনো শুনোচে যে দশদিন ধরে চোক খোলে না, পেচ্ছাপ বাহ্যি যায় না?
মহিলারা চোখ কপালে তুলে বললো, ওমা তাই নাকি? ইনি তো তা হলে খুব বড় মহাপুরুষ রে! দশদিন চোক খোলে না!
হেমাঙ্গিনী বললেন, দশদিন কি গো! শহরের লোকে তো দেকচে মোটে দশ দিন, মাটির নীচে কতদিন চোক বুজে আছেন তা কে জানো! ওনারা সব পারেন।
নবীনকুমার বললো, দিনের পর দিন না খেলে মানুষ বাঁচে?
বিম্ববতী বললেন, পুণ্যাত্মাদের খাওয়া লাগে না। ওঁয়ারা তো আর সাধারণ মানুষ নন। নবীনকুমার বললো, আমার কী ইচ্ছে হচ্চিল, জানো মা? ওঁর কানের পাশে তো অনেক ঢাক-ঢোল বাজানো হয়েছেল, একবার ওনার নাকের কাচে একটু নাস্যি দিয়ে দোকলে কেমন হতো?
মহিলারা সমস্বরে বলে উঠলো, ছিছি। ছি, ও কতা বলতে নেই, ছোটকু! আমন কতা শুনলেও পাপ! মহাপুরুষদের কক্ষনো পরীক্ষা করেও দোকতে নেই।
হেমাঙ্গিনী বললেন, আমার বাপের বাড়িতে আমার সম্পর্কে এক পিসেমশাই একবার অমনি একজন মহাপুরুষ দেকোচিলেন। আমার পিসেমশাই নৌকোয় কাশী যাচ্চিলেন, গঙ্গার ধারে জঙ্গলের মধ্যে দেকালেন একজন ওরম মহাপুরুষ ধ্যানে অচৈতন্য হয়ে বসে আচেন! মাঝিরা তা দেখে বললো, বাবু, এ জঙ্গলে বড় বাঘ, এ সাধুরে তো আজই বাঘে খেয়ে ফেলবে। মাঝিরা ধরাধরি করে মহাপুরুষকে নৌকোয় তুলে আনলো। তিনি নৌকোয় বসে রইলেন পাতারের মূর্তির মতন। তখনকার দিনে ছাপাঘাটির মোহনায় জল থাকতো না বলে কাশীর যাত্রীরা বাদা বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া আসা কত্তেন, একদিন আমাদের সেই পিসেমশাইয়ের নৌকো বাদাবনের মধ্যি দিয়ে মাঝিরা গুণ টেনে নিয়ে আসচে, মাঝি আর অন্য লোকেরা হঠাৎ দোকলো কি, জলের ধারে ঠিক ঐরকম একজন মহাপুরুষ দাঁড়িয়ে আচেন। দুজনার চেহারা ঠিক এক রকম। এদিকে এ মহাপুরুষ তো নৌকোর গলুইয়ে তেমনি একই ভাবে ধ্যানে বসিচিলেন, ড্যাঙ্গার মহাপুরুষকে যেই মাঝিরা দেকালো, অমনি উনি চোক মেলে চাইলেন। এরই মধ্যে ড্যাঙ্গার মহাপুরুষ হাসতে হাসতে নৌকোর ওপরে এসে নৌকের মহাপুরুষকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করালেন, তারপর দুজনায় তেমনি হাসতে হাসতে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন, আর তেনাদের দোকতে পাওয়া গেল না।
অন্য নারীরা বললো, বলো কি গো, দিদি! এ যে মহা আশ্চর্যি কথা!
হেমাঙ্গিনী বললেন, এই দ্যাকো না, তোমাদের বললুম তো, অমনি আমার লোমাঞ্চ হচ্ছে, গা কাঁপচে। এনারা সব সে-কালের মুনি ঋষি, কেউ দশ হাজার, কেউ বিশ হাজার বছর ধরে তপিস্যে কচোন, ঐরা মনে কল্লে সব কত্তে পারেন!
অন্য আর একজন স্ত্রীলোক বললেন, আমিও এরকম একজনের কথা শুনিচিলুম। একবার ঝিলিপুরের দত্তরা সৌন্দরবন আবাদ কত্তে কত্তে ত্ৰিশ হাত মাটির ভিতরে এক মহাপুরুষকে দেকে ছেলেন। তাঁর শরীর শুকিয়ে চ্যালাকাটি হয়ে গ্যাচে। আর গা থেকে বেরিয়েছে বড় বড় শেকড়। দত্তরা অনেক করে সেই মহাপুরুষকে নিয়ে এলেন ঝিলিপুরে, সেখানে তিনি এক মাস থাকলেন, তারপর হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হয়ে গ্যালেন।
বিম্ববতী বললেন, ঐরা যখন ইচ্ছে করেন দ্যাক দ্যান আবার যখন ইচ্ছে করেন সংসার ছেড়ে চলে যান।
হেমাঙ্গিনী বললেন, ভূকৈলেশের রাজাদের কত ভাগ্য, তাদের বাড়িতে ইনি দেকা দিয়েচেন, কবে আবার চলে যাবেন ঠিক কি! হ্যা, লা, আমরা একবার দোকতে যাই না!
নবীনকুমার বললো, জ্যাঠাইমা, তোমরা সেখানে যেতে পারবে না, বড্ড পাঁচপেঁচি ধরনের লোকের ভিড় সেখানে।
পরদিন বিম্ববতী বাড়ির একজন ভৃত্যকে পাঠিয়ে মহাপুরুষের পায়ের ধুলো আনালেন খানিকটা। তা দুটো মাদুলিতে ভরে একটা বেঁধে দিলেন নবীনকুমারের বাহুতে, আর একটা রেখে দিলেন গঙ্গানারায়ণের জন্য। মহাপুরুষদের পূত রজঃ অঙ্গে রাখলে সন্তানদের সব বিপদ কেটে যাবে।
মায়ের অনুরোধ একেবারে ফেলতে পারলো না। নবীনকুমার। তবে সেই জয়ঢাকের মতন মাদুলিটা প্রায়ই সে খুলে নিয়ে লোফালুফি খেলা করে। মায়ের সামনে আবার ঠিকঠাক করে নেয়।
মহাপুরুষের নানা রকম অলৌকিক গুণাবলীর কথা কয়েকদিন ধরে খুব বাজার সরগরম করে রেখে আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এলো। তারপর একদিন স্কুলের টিফিনে নবীনকুমার গোলদিঘিতে তার বন্ধুদের সঙ্গে ফড়িং ধরে খেলা করছে, এমন সময় ওদের ক্লাসের পণ্ডিতমশাই এলেন মাঠের মধ্যে। এই পণ্ডিতমশাই এক সময় এক বড়মানুষের বাড়িতে রাঁধুনী বামুন ছিলেন, এখন এড়ুকেশান কাউনসিলে সুপারিশের জোরে পণ্ডিত হয়েছেন। ইনি পান খেতে খুব ভালোবাসেন, তাই এর হাতে যাতে কানমলা খেতে না হয় তাই ছেলেরা ঐকে দেখামাত্ৰ পান কিনে দেয়। সবাই হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে পান কিনে আনলো।
খুসী হয়ে পণ্ডিত বললেন, ওরে নবীন, ভূকৈলেশের সেই মহাপুরুষের কথা শুনিচিস? সে এক কাণ্ড হয়েচে!
কী হয়েচে, কী হয়েচে বলে সবাই পণ্ডিতকে ছেঁকে ধরলো।
তিনি বললেন, মহাপুরুষের নানা রকম কেরামতির কথা শুনে এক সাহেব গিয়েছিলেন তেনাকে পরীক্ষে করতে। বাবা, সাহেবদের কাচে অত জারিজুটি খাটে না। ভূকৈলেশের রাজারা নাকি মহাপুরুষের গায়ে গুল পুড়িয়ে ছাঁকা দিয়েছিলেন, জলে ড়ুবিয়ে রেখেছিলেন, তাতেও কিছু হয়নি। কিন্তু সাহেব সেই মহাপুরুষের নাকের কাছে কী একটা আরক যেই একটু ধরলেন, অমনি মহাপুরুষ সাতবার হ্যাঁচো হাঁচ্চো করে উঠলো। আর চোখ মেলেই সাহেব দেখে কেঁদে বললো, ওরে বাপা, গারোদে দিওনি! গারোদে দিওনি!
নবীনকুমার আনন্দে ফেটে পড়ে লাফাতে লাফাতে বললো, নাস্যি! নস্যি! আমি আগেই জানতুম!
পণ্ডিতমশাই বললেন, ভূকৈলেশের রাজারা তো ক্ষেপে আগুন! এতদিন কত মানী গুণী লোক ঐ বুজরুগটার পায়ের ধুলো নিয়েচে। তাই রাজারা এখন ঐ ব্যাটাকে দিয়ে নিজেদের পা টেপাচ্ছেন।
নবীনকুমার হেসে গড়াগড়ি দিল মাটিতে। তারপর হাতের মাদুলিটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিল জলে।
কৌতুক ও কৌতূহলের জন্য নবীনকুমার প্রায়ই এরকম নানা রকম অভিযানে বেরোয়। ইতিমধ্যেই তার একটা নিজস্ব মতামত তৈরী হয়েছে, সে আর অন্য কারুর কথা যাচাই না করে মেনে নেয় না।
ক্লাসের মধ্যে নবীনকুমারের দুরন্তপিনা দিন দিনই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। পড়াশুনোয় একেবারেই মন নেই। প্রত্যেকটি শিক্ষক তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। অথচ সবাই জানেন, এ ছেলে একটু মন দিয়ে পড়লে সবার সেরা হতে পারতো, এমন স্মৃতিশক্তি খুব কম ছাত্রেরই দেখা যায়। কিন্তু সে পড়বে না।
একদিন একজন শিক্ষক মন দিয়ে পড়াচ্ছেন, সারা ক্লাস স্তব্ধ, এমন সময় হঠাৎ নবীনকুমার দুম করে তার এক সহপাঠীর পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল সম্পূর্ণ বিনা কারণে। ছেলেটি আর্তনাদ করে তখুনি উঠে দাঁড়িয়ে নালিশ জানালো শিক্ষকের কাছে। শিক্ষক মহাশয় আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না, দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, স্ট্যাণ্ড আপ অন দা বেঞ্চ! ইউ! স্ট্যাণ্ড আপ অন দা বেঞ্চ!
নবীনকুমার হাসতে হাসতে বেঞ্চের ওপরে উঠে দাঁড়ালো।
শিক্ষক বললেন, কান ধরে। সর্বক্ষণ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কার কান ধরবো স্যার?
সারা ক্লাস ফেটে পড়লো হাসিতে।
শিক্ষকমশাই ডায়াস থেকে নেমে এগিয়ে এলেন নবীনকুমারের কাছে। ব্যথাময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন এমন করো বলো তো? কেন ওকে মারলে?
নবীনকুমার সগর্বে উত্তর দিল, মহাশয়, আমি সিংহ সন্তান। জাত-স্বভাব তো ছাড়তে পারি না!