নৈনিতাল থেকে ঘোড়ার পিঠে যাত্রা শুরু হল। ভোর-ভোর বেরুতে পারলে ভাল হত, কিন্তু সকালের দিকে বৃষ্টি পড়েছিল কিছুক্ষণ, তারপর খেতড়ির রাজ পরিবারের লোকজন মধ্যাহ্নভোজ না করিয়ে ছাড়বেন না কিছুতেই। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার পর রাজকীয় ভোজ অবশ্য ভালই লেগেছিল, স্বামীজির জন্য আলাদা ভাবে প্রচুর ঝাল দিয়ে নানা ব্যঞ্জন রান্না করা হয়েছিল। বিকেলের দিকে আকাশ পরিষ্কার ও তরল রুপোর মতন রোদ দেখা দিতেই স্বামীজি সকলকে তাড়া দিয়ে বললেন, চলো, চলো, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে। পথে রাত হয়ে যাবে, সেই জন্য রাজবাড়ির লোকেরা আর একটি দিন থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, স্বামীজি তাতে কর্ণপাত করলেন না।
অনেক লোকজন এবং প্রচুর লটবহর। চারজন শ্বেতাঙ্গিনী, নিবেদিতা, জয়া ও ধীরামাতা ছাড়াও এঁদের সঙ্গে এসেছেন কলকাতার আমেরিকান কনসালের পত্নী শ্রীমতী প্যাটারসন। এই রমণীটি স্বামীজির পূর্ব পরিচিত। আমেরিকায় একবার এক শহরে স্বামী বিবেকানন্দকে সব হোটেলেই তাঁর গায়ের রঙের জন্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, তখন ইনি তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে জন্য এঁকে এঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে নিন্দামন্দ শুনতে হয়েছিল। ঘটনাক্রমে স্বামীর সঙ্গে এখন ইনি কলকাতায় থাকেন, স্বামীজির সঙ্গে নিজে গিয়ে দেখা করেছেন এবং হিমালয় অভিযানের কথা শুনে উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। এঁরা ছাড়াও রয়েছেন যোগীন মা, তুরীয়ানন্দ, নিরঞ্জনানন্দ, সদানন্দ ও স্বরূপানন্দ।
বিদেশিনীরা সবাই ঘোড়ায় চড়তে জানেন, স্বামীজিও জানেন, অন্য গুরুভাইরা কখনও ঘোড়ায় চাপেননি। এই পার্বত্য পথে ঘোড়া ছাড়া আর একমাত্র যানবাহন ডান্ডি তার খরচ অনেক বেশি। গুরুভাইদের মধ্যে স্বরূপানন্দের ক্ষীণ দুর্বল চেহারা, তিনি ঘোড়ায় চাপতেই ভয় পান, তিনি পায়ে হেঁটে যাবেন ঠিক করলেন। যোগীন মা বললেন, আমি বাপু ঘোড়া-টোড়ায় উঠতে পারব না মানুষে বওয়া ডান্ডিরও দরকার নেই, আমিও হেঁটেই যাব। জয়া অর্থাৎ জোসেফিন ম্যাকলাউডের সারাদিন জ্বর জ্বর ভাব, আগের রাত্রে ঘুম হয়নি, স্বামীজি তাঁর জন্য ঘোড়ার বদলে ডান্ডির ব্যবস্থা করলেন।
দলে আর একজন সদস্য বেড়েছে, স্বামী প্রেমানন্দ এসেছেন আলমোড়া থেকে, ওঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবাব জন্য। প্রেমানন্দব পূর্বাশ্রমের নাম বাবুরাম, নরমসরম স্বভাব, কাশীপুরের বাগানে থাকার সময় গুরুভাইদের কেউ কেউ তাকে ক্ষেপাবার জন্য বলত, তোর তো প্রকৃতি ভাব রে!
যাত্রার সময় বিবেকানন্দ তাঁকে বললেন, এই রেমো, তোর ল্যাকপেকে চেহারা, তুই ঘোড়ায় যেতে পারবি না। হেঁটে যা।
প্রেমানন্দ বললেন, না রে নরেন, আমি পারব! বাঃ, আলমোড়া থেকে এসেছি না!
বিবেকানন্দ বললেন, সত্যি, তুই কী করে যে এলি, তোর চোদ্দো পুরুষের পুণ্যির জোর আছে। তা কোনও রকমে এসেছিস, আর কেরদানি দেখাবার দরকার নেই। চল, আমিও না হয় হাঁটব তোর সঙ্গে।
প্রেমানন্দ শুনলেন না, তিনি দু’জন মালবাহকের কাঁধে ভর দিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলেন। শুরু হল বিচিত্র এক শোভাযাত্রা। শ্বেতাঙ্গিনীরা উত্তম সাজপোশাক পরেছেন, প্রসাধনও তাঁদের পোশাকেরই অঙ্গ, দামি দামি সুটকেশ বইছে মালবাহকেরা। আর সঙ্গের সন্ন্যাসীদলের মুণ্ডিত মস্তক, অঙ্গে মলিন গেরুয়া, মালপত্রের মধ্যে শুধু একটি করে পুঁটুলি আর কমণ্ডলু।
চড়াই পথ, আস্তে আস্তে উঠছে ঘোড়াগুলো। জো ম্যাকলাউডের ডান্ডি চলেছে আগে আগে, বিবেকানন্দ ঘোড়া নিয়ে চলেছেন পদযাত্রীদেরও পেছনে। পথের শোভা অতি সুন্দর, আবার বিপজ্জনকও বটে। বাঘ-ভল্লুকের উপদ্রবের কথা শোনা যায়, এত মানুষজন দেখলে তারা হয়তো কাছে আসবে না, আবার বলাও যায় না। অনেক সময় একেবারে শেষের লোকটিকে বাঘ নিঃশব্দে তুলে নিয়ে যায়।
কলকাতায় কিছুতেই বিবেকানন্দর শরীর ভাল থাকছে না। প্রায়ই জ্বর ও পেটের পীড়া হয়। শরীরের এই অবাধ্যপনায় তিনি নিজেই বিরক্ত। মাত্র কয়েকটা বছর বিদেশে ছিলেন, এখন দেশের জল বাতাস তাঁর সহ্য হবে না কেন? কলকাতা ছেড়ে ঠাণ্ডা কোনও জায়গায় গেলে ভাল থাকেন। মাঝখানে শরীর এত খারাপ হয়েছিল যে, বেলুড়ে নিবেদিতা ও অন্য দুজন বিদেশিনীকে রেখে তাঁকে ডাক্তারের পরামর্শে আবার দার্জিলিং চলে যেতে হয়েছিল। কিছুদিন পর কলকাতায় প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর শুনে হুড়োহুড়ি করে নেমে এসেছিলেন পাহাড় থেকে। ওই রমণীরা তাঁর টানে এদেশে এসেছে, তাদের যেন কোনও বিপদ না হয়।
শুধু তাই নয়। কলকাতায় ফিরে স্বামীজি মিশনের ছেলেদের নিয়ে সেবা কাজে মেতে উঠলেন। দীক্ষিত সন্ন্যাসীদের পাঠাতে লাগলেন বিভিন্ন বস্তিতে। রামকৃষ্ণের নামে মিশন প্রতিষ্ঠিত হবার পর বলা যেতে পারে, এটাই তাঁদের প্রথম কাজ। অনেকে এর তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। হিন্দুদের মধ্যে গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে পরোপকারের কোনও রীতি নেই। বেশির ভাগ হিন্দুই অতিথিপরায়ণ, তার বাড়িতে কেউ আশ্রয় নিলে তার খুবই সেবাযত্ন করবে, কিন্তু পথের ধারে কোনও অসহায় রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখলে ভাববে, সেটা ওর নিয়তি। আর সাধু-সন্ন্যাসীরা ভক্তদের কাছে পাদ্যার্ঘ্য নেবে, তাদের স্পর্শ করারও অধিকার নেই সাধারণ লোকের, এরকমই এতদিন ধরে সবাই দেখতে অভ্যস্ত। এখন এই নব্য সাধুরা জাতি-ধর্ম, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য নির্বিচারে দরিদ্র-আতুরদের সেবা করতে নেমেছেন, এ দৃশ্য অভিনব। দরিদ্র মানুষদের মধ্যেও যে নারায়ণ আছেন, এটা ছিল এতদিন কথার কথা, বিবেকানন্দ সেই নারায়ণ সেবায় উদ্বুদ্ধ করতে চাইলেন সকলকে।
খ্রিস্টানদের কাছে এই ধরনের কাজ খুব স্বাভাবিক, তাই নিবেদিতা বিবেকানন্দের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য স্বামীজিরা অনেকে সংশয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অধ্যাত্ম সাধনার সঙ্গে এই কাজের সম্পর্ক কী? মহামারী প্রতিকারের দায়িত্ব তো সরকারের! রামকৃষ্ণ মিশন একটা নতুন সংস্থা, তার সাধ্য কতখানি। রোগীদের ওষুধ-পত্রের জন্য প্রচুর টাকা-পয়সা দরকার, তাই বা পাওয়া যাবে কোথায়? গুরুভাইদের বোঝাতে বোঝাতে এক এক সময় বিবেকানন্দর ধৈর্যচ্যুতি হত, তিনি ধমক দিয়ে বলতেন, মানুষ মরছে, এখন ধর্মের কথা মাথায় থাক। আর টাকা-পয়সা, যদি শেষ পর্যন্ত না জোটাতে পারি, তা হলে মঠের জন্য বেলুড়ে যে জমি কেনা হয়েছে, সেটা বেচে দেব! কী হবে মঠ তুলে?
প্লেগ রোগ তেমন ব্যাপক আকার ধারণ করল না বলে ওই জমি বিক্রি করতে হল না, সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কয়েকদিনের অনিয়ম ও রাত্রি জাগরণে বিবেকানন্দর শরীর আবার দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই তিনি ঠিক করলেন কিছুদিন আলমোড়ার সেভিয়ার দম্পতির কাছে কাটিয়ে আসবেন। বিদেশিনী ক’জনও এ দেশ ভ্রমণে খুব আগ্রহী, তাঁরাও সঙ্গী হলেন, গুরুভাইরাও এসেছেন কয়েকজন। কাঠগুদামে ট্রেন থেকে নামবার পর থেকেই বিবেকানন্দ বেশ সুস্থ বোধ করছেন। এখন এই অপরাহ্নে অশ্বপৃষ্ঠে যেতে যেতে তিনি অনুভব করলেন, যেন আবার তাঁর সেই দুর্জয় স্বাস্থ্য ও মনোবল ফিরে পেয়েছেন।
পাহাড়ে সূর্যাস্ত হয় আগে আগে, হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। নিবেদিতা দূরের বরফ টাকা এক একটি শৃঙ্গের ওপর শেষ বিকেলের রক্তিমাভা দেখছেন মুগ্ধ হয়ে। ক্ষণে ক্ষণে তাঁর শিহরন হচ্ছে। এই হিমালয়! পৃথিবীর সমস্ত পাহাড়ের রাজা? যতখানি কল্পনায় ছিল, হিমালয় যেন তার চেয়েও অনেক বিশাল ও মহান। হিমালয়ের ওপর দিয়ে নিবেদিতা চলেছেন তাঁর রাজার সঙ্গে। এখনও যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। হ্যাঁ, বিবেকানন্দ কারুর কাছে গুরু, কারুর কাছে সন্তানবং, কিন্তু নিবেদিতার কাছে তিনি রাজা।
আঁধারে ছেয়ে গেছে দিকদিগন্ত, আকাশে একটি দুটি তারা ফুটি ফুটি করছে। মালবাহকেরা জ্বালিয়েছে মশাল, তারা কয়েকজন আগে আগে যাচ্ছে পথ দেখিয়ে। দুপাশের বনরাজি থেকে ভেসে আসছে বুনো ফুলের সুগন্ধ। মাঝেমাঝে বাতাসে শোনা যাচ্ছে গাছের পাতায় শিরশিরানি। নিবেদিতা অনেকক্ষণ বিবেকানন্দকে দেখতে পাননি, তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য উতলা বোধ করলেন। যেখানে পথটি কিছুটা চওড়া, সেখানে তিনি তার ঘোড়াটি সরিয়ে নিলেন এক পাশে। অন্যরা এগিয়ে গেল, একেবারে শেষে বিবেকানন্দকে দেখতে পেয়ে তিনি উৎফুল্ল স্বরে বললেন, আমার পরম সৌভাগ্য, আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। মনে হচ্ছে যেন আমরা অনন্তকালের যাত্রী, এ পথের কোনও শেষ নেই।
বিবেকানন্দ গম্ভীরভাবে বললেন, মনে হচ্ছে আজ আলমোড়ায় পৌঁছোনো যাবে না। পথে কোনও বাংলো পেলে থাকতে হবে।
নিবেদিতা বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে, এমন বিস্ময়কর পথে সারা রাত গেলেও আমরা ক্লান্ত হব না। রাজা, এক একটা পাহাড়ের চূড়া দেখলে হঠাৎ মনে হয় না ধ্যানমগ্ন শঙ্করের মতন!
বিবেকানন্দ সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য না করে বললেন, তুমি এখানে থেকো না। সামনে চলে যাও।
নিবেদিতা বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? আমি আপনার পাশাপাশি থাকতে চাই।
বিবেকানন্দ বললেন, এটা ইওরোপ নয়, ভারতবর্ষ, এ কথা সব সময় মনে রেখো। মার্গট, এদেশের রীতিনীতি তোমায় মেনে চলতে হবে।
নিবেদিতা বললেন, আমি সে চেষ্টা সব সময় করছি। আপনি আমাকে মার্গট বলে ডাকছেন কেন, আমি এখন নিবেদিতা।
বিবেকানন্দ মৃদু ভর্তসনার সুরে বললেন, এখনও পুরোপুরি হওনি। এখনও ভেতরে ভেতরে তুমি ব্রিটিশ। ব্রিটেনের পতাকা, তোমার পতাকা।
নিবেদিতা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় খানিক দূরে একটি অশ্বের চিঁহিহি ও হুড়মুড় করে কিছু পতনের শব্দ হল। ওরা দুজনে জোর কদমে এগিয়ে গেলেন।
স্বামী প্রেমানন্দ তার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে কোঁ কোঁ শব্দে কাতরাচ্ছেন।
বিবেকানন্দ ধমক দিয়ে বললেন, রেমো তখনই বলেছিলাম, তুই পারবি না। শাঁলা, তুই শুনলি না! ওঠ, ওঠ!
প্রেমানন্দ করুণভাবে বললেন, ওরে নরেন, আমার বোধহয় পা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। নড়তে পারছি না।
বিবেকানন্দ আরও জোরে বললেন, নড়তে পারছি না। শালা, তোকে কি এখন আমি কাঁধে করে নিয়ে যাব? বাপের জন্মে ঘোড়ায় চাপিসনি, তোকে কেরদানি দেখাতে কে বলেছিল?
সমস্যাটি গুরুতর বটে। পাহাড়ি অশ্বগুলি খর্বাকৃতি, দুজনে চাপা যায় না। প্রেমানন্দ হাঁটতে অক্ষম হলে তাঁকে কে বহন করে নিয়ে যাবে।
এই সময় জো ম্যাকলাউড নেমে এলে ডান্ডি থেকে। ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে তিনি বললেন, এটা কোনও সমস্যাই নয়। এই স্বামীজী আমার ডান্ডিতে চলুক, আমি এঁর ঘোড়ায় দিব্যি যেতে পারব।
বিবেকানন্দ বললেন, তা কী করে হবে। জো, তোমায় গায়ে জ্বর।
ঝলমলে মুখে জো বললেন, পাহাড়ের স্নিগ্ধ হাওয়ায় আমার জ্বর সেরে গেছে। ওই ঘেরাটোপের মধ্যে যেতেই আমার বরং অস্বস্তি হচ্ছিল।
তারপর জো তরাক করে প্রেমানন্দের ঘোড়াটিতে লাফিয়ে উঠে বললেন, এতেই আমার যেতে ভাল লাগবে।
অন্যরা ধরাধরি করে প্রেমানন্দকে তুলে দিল ডান্ডিতে। আবার শুরু হল যাত্রা। জো হাসি-গল্পে সবাইকে মাতিয়ে রাখল। জো ম্যাকলাউডের যখন মর্জি ভাল থাকে, তখন সে হয়ে ওঠে অফুরান আনন্দের উৎস। এমনকী কুলি মজুরদের সঙ্গেও সে নিকট আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করে।
মধ্যপথে এক ডাক বাংলোয় রাত্রি কাটিয়ে পরের দিন মধ্যাহ্নে দলটি পৌছল আলমোড়ায়।
সেভিয়ার দম্পতি এখানে টমমন হাউস নামে একটি বাড়ি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন। হিমালয়ের কোলে আলমোড়ার মতন এক একটি ছোট ছোট নির্জন, দৃষ্টিনন্দন স্থান ইংরেজরাই খুঁজে বার করেছে, এখানকার পাকা বাড়ি অধিকাংশই ইংরেজদের। ওকলি হাউস নামে আর একটি বাড়িতে চার বিদেশিনীর থাকার ব্যবস্থা হল।
দুই বাড়ির মধ্যে খানিকটা দূরত্ব আছে। সকালবেলা আর দু’একজনকে সঙ্গে নিয়ে বিবেকানন্দ হাঁটতে হাঁটতে ওকলি হাউসে চলে আসেন চা পানের জন্য। এদের একসঙ্গে দুতিন কাপ চা পানের অভ্যেস, অনেকক্ষণ ধরে গল্প হয়। বেদ-উপনিষদ, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, কিছুই বাদ যায় না। বিবেকানন্দ কখনও গৌতম বুদ্ধের কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে যান, কখনও বলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা।
বিকেলের দিকে এক একদিন একসঙ্গে বেড়াতে বেরুনো হয়। হাঁটতে হাঁটতে জনপদ ছাড়িয়ে অরণ্যে। দিগন্ত ছেয়ে আছে পাহাড়শ্রেণী, এমন নির্মল আকাশ যেন আর কোথাও দেখা যায় না।
বিবেকানন্দ গল্পচ্ছলে গভীর জ্ঞানের কথা বলেন, আবার হাস্য কৌতুকের কথাও এসে পড়ে মাঝে মাঝে। একদিন ভূত-প্রেতের কথা এসে পড়ল। স্বামীজি বিদেশিনীদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কখনও ভূত দেখেছ? সবাই দুদিকে মাথা নাড়লেন, তাঁদের চোখেমুখে ফুটে উঠল অবিশ্বাস। বিবেকানন্দ হাসতে হাসতে বললেন, কেন, আমেরিকায় তো অনেক ভূত আছে। আমি নিজেও দেখেছি।
সবাই সচকিত হতে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার একটি গল্প শোনালেন। আমেরিকাতে তিনি এক জায়গায় কিছুকালের জন্য একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন এবং নিজেই রান্নাবান্না করতেন। সেই বাড়িতেই থাকত শ্ৰীমতী উইলিয়ামসন নামে একটি মোটাসোটা চেহারার অভিনেত্রী আর একটি দম্পতি। এদের কারবার ছিল লোকের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে তাদের ফরমায়েশ মতন ভূত নামানো। স্বামীজি মাঝেমাঝে ওদের এই বুজরুকি কাণ্ডকারখানা উকিঝুঁকি দিয়ে দেখতেন। একদিন এল একটি ইঞ্জিনিয়ার যুবক। সে কিছুদিন আগে তার মাকে হারিয়েছে, সেই শোক এখনও ভুলতে পারছে না। মায়ের একটা ফটোগ্রাফ এনেছে সে, মাকে একবার সশরীরে দেখতে চায়। ব্যবস্থা হয়ে গেল। আধো অন্ধকার ঘর, ধোঁয়া ও আলোর চকমকি, নানারকম অদ্ভুত শব্দ, তারপর এক সময় পর্দার আড়াল থেকে সেই অভিনেত্রীটি যুবকটির মা সেজে বেরিয়ে এল। যুবকটির মা ছিল রোগা-পাতলা। তবু সে অভিভূত হয়ে চিৎকার করে উঠল, মা, মা, প্রেতলোকে গিয়ে তুমি কত মোটা হয়ে গেছ।
এই যুবকটি তো শিক্ষিত। ইওরোপ আমেরিকায় অশিক্ষিত সাধারণ লোকদের কত যে কুসংস্কার এখনও রয়ে গেছে সে প্রসঙ্গও এসে পড়ে। অতিথিদের মধ্যে বর্ষীয়ান মহিলাটি একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, ভারতে এসে সবই ভাল লাগে, শুধু একটা ব্যাপার কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমরা যেখানেই যাই, একদল লোক কাছে এসে হাঁ করে চেয়ে থাকে। শুধু চেয়ে থাকে, কোনও কথা বলে না, এটা যে অসভ্যতা, বোঝে না? ট্রেনে আসার সময় কোনও স্টেশনে থামলেই জানলার কাছে এরকম একদল লোক এসে ভিড় করত।
স্বামীজি বললেন, হ্যাঁ, এটা সত্য। তোমাদের মতন চেহারার কোনও রমণী, এরকম পোশাক অনেকেই আগে দেখেনি। তাই কৌতূহলে এসে ভিড় করে। শুধু চেয়ে থাকে, আর কোনও অত্যাচার করে কী? আমার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে শোনো। লন্ডনের রাস্তা দিয়ে আমি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে আলখাল্লা আর মাথায় পাগড়ি, একটা লোক একটা কয়লার গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে, আমাকে দেখে থমকে গেল। এরকম চেহারা ও পোশাক সে কখনও দেখেনি। কিন্তু সে শুধু হাঁ করে চেয়ে রইল না। একটা কয়লার চাঙ্গড় জুড়ে মারল আমার দিকে।
নিবেদিতা শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার লেগেছিল?
বিবেকানন্দ শুকনো কণ্ঠে বললেন, আমি ঠিক সময় মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের দেশে দরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। তবু তাদের গভীর ধর্মবোধ ও নীতিবোধ আছে। পশ্চিমি দেশের নিচু শ্রেণীর লোকরা ধর্ম ও নৈতিকতার কোনও ধার ধারে না। হাইড পার্কে দিনদুপুরে নারী-পুরুষদের মধ্যে যে রকম অসভ্যতা চলে, তা দেখলে কোনও হতদরিদ্র ভারতবাসীও শিউরে উঠবে।
কিছুদিন ধরেই নিবেদিতা লক্ষ করেছেন, অন্য মহিলাদের তুলনায় তাঁর সঙ্গে স্বামীজির ব্যবহার বেশ অন্য রকম। অন্যদের সঙ্গে তিনি হেসে গল্প করেন, আর তাঁকে মাঝেমাঝেই ধমক দেন। ব্যবহারের কিছুটা তারতম্য হতেই পারে। অন্যরা বেড়াতে এসেছেন, এক সময় ফিরে যাবেন। আর নিবেদিতা পেছনের সব বন্ধন ছিন্ন করে এদেশের সেবার জন্য সর্বস্ব পণ করে এসেছেন। তাকে স্বামীজি তৈরি করে নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সর্বসমক্ষে ছাড়া বিবেকানন্দ কক্ষনও কাছাকাছি আসতে চান না, কখনও তাঁকে নিয়ে আলাদা করে বসেন না। তিনি যখন একা থাকেন, তখন নিবেদিতা তাঁর কাছে কোনও প্রশ্ন নিয়ে গেলে তিনি অসহিষ্ণুভাবে বলে ওঠেন, যাও, স্বরূপানন্দকে জিজ্ঞেস করো গে!
স্বরূপানন্দের ওপর নিবেদিতাকে বাংলা ও সংস্কৃত শেখাবার ভার দেওয়া হয়েছে। স্বরূপানন্দ লাজুক মানুষ, তাঁর কাছে খোলাখুলি সব কথা বলা যায় না। স্বরূপানন্দ বেশ পণ্ডিত, কিন্তু তিনি রামকৃষ্ণকে অবতার মানেন না। অবতারবাদে তাঁর বিশ্বাস নেই। আরও কোনও কোনও ব্যাপারে বিবেকানন্দর সঙ্গে তাঁর মতভেদ আছে। নিবেদিতার মনে হয়, শুধু ভাষা শিক্ষাই তো যথেষ্ট নয়, তিনি বিবেকানন্দকে অবলম্বন করেই এদেশে এসেছেন, ওঁর কাছাকাছি থাকতে চান, একদিন ওঁকে না দেখলেই তাঁর মন উতলা হয়ে ওঠে, তবু উনি তাঁকে এড়িয়ে চলবেন কেন?
এক একদিন নিবেদিতার সঙ্গে বিবেকানন্দর বেশ তর্ক বেধে যায়। তাঁর মনে হয়, বিবেকানন্দ তাঁর নাম দিয়েছেন নিবেদিতা, সে জন্য তাঁকে তাঁর ব্রিটিশ পরিচয় একেবারে মুছে ফেলে সম্পূর্ণ ভারতীয় হয়ে যেতে হবে! এত তাড়াতাড়ি তা কি সম্ভব? হিন্দুরা যেমন মূর্তি পূজা করে, ইংরেজরাও বাচ্চা বয়েস থেকেই জাতীয় পতাকাকে সম্মান করতে শেখে। এখন সেই পতাকাকে অগ্রাহ্য করতে হবে? ভারতের তো নিজস্ব পতাকাই নেই। ভারতকে ভালবাসতে গেলে কি ভারতের সব কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসও মেনে নেওয়া অত্যাবশ্যক! ইংরেজদেরও অনেক গুণ আছে, ইংরেজ পরিচয় বজায় থেকেও কি ভারতের সেবা করা যায় না? নিবেদিতা এসেছেন এদেশে মূলত স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে অংশ গ্রহণ করতে, সে ব্যাপারে বিবেকানন্দ এখনও পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নেননি।
একদিন চিন দেশের কথা হচ্ছিল। বিবেকানন্দ চিন দেশটির প্রতি বিশেষ আগ্রহশীল, তাঁর ধারণা চিনে শীঘ্রই নব জাগরণ হবে। শুদ্র বা শ্রমিকশ্রেণীর উত্থান হবে সে দেশে। তিনি যখন চিনের প্রশংসা করে চলেছেন, নিবেদিতা ফট করে বলে বসলেন, কিন্তু চিনেরা তো খুব মিথ্যেবাদী হয়! সবাই তাদের এ দোষের কথা জানে।
বাধা পেয়ে দপ দপ করে জ্বলে উঠলেন বিবেকানন্দ। কঠোর স্বরে বললেন, তুমি ইংরেজ বলেই এসব কথা বললে। তোমরা এক একটা জাতির নামে এরকম একটা পরিচয় দেগে দাও! সত্য আর মিথ্যা কি আপেক্ষিক নয়? ইংরেজরা ভদ্রতার নামে অনবরত অসত্য বলে না? কারুকে প্রশংসা করতে গেলে তাদের মনের কথা আর মুখের কথা কদাচিৎ এক হয়!
বিবেকানন্দ অনবরত তাঁকে ধমক দিয়ে চললেন আর কিছু বলতেই দিলেন না।
আর একদিন কথা হচ্ছিল মোক্ষ বা মুক্তিলাভ সম্পর্কে। নিবেদিতা এক সময় বলে উঠলেন, আমি এই ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারি না। হিন্দুরা এ জীবন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে চায় কেন? এত ধ্যান এত সাধনা, সবই ব্যক্তিগত মুক্তিলাভের জন্য। যেন আর পুনর্জন্ম না হয়। কিন্তু কেন? জীবন এত সুন্দর! নিজের মুক্তি সাধনের চেয়ে যে সব মহৎ কাজ আমাদের ভাল লাগে, যাতে মানুষের উপকার হয়, তার জন্য বারবার জন্মগ্রহণই কি কাম্য নয়?
বিবেকানন্দ তার চোখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে রাগতভাবে বললেন, তোমার এখনও মুক্তি সম্পর্কে কোনও বোধই হয়নি। তুমি ক্রমোন্নতির ধারণাটা এখনও জয় করতে পারোনি। তুমি মানুষের বেশি বেশি ভাল করে নিজে আরও বড় হতে চাও? কোনও বাইরের জিনিসই ভাল হয় না, তারা যেমন আছে, তেমনি থাকে। তাদের ভাল করতে গিয়ে আমরাই ভাল হয়ে যাই।
নিবেদিতা বললেন, বারবার মানুষের মধ্যে থাকা কি আরও বেশি কাম্য হতে পারে না? কেন আমরা জীবনবিমুখ হব?
বিবেকানন্দ বললেন, তোমার এখনও অহংবোধ যায়নি। স্বরূপানন্দের কাছে শাস্ত্র বুঝে নাও!
একদিন দুপুরবেলা জো দেখলেন, নিবেদিতা দুপুরে খেতে আসেননি, নিজের বিছানায় ফুলে ফুলে কাঁদছেন। শ্রীমতী ওলি বুল বয়েসে অনেক বড়, শ্রীমতী প্যাটারসন আপনমনে থাকেন, জোর সঙ্গেই নিবেদিতার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নিবেদিতার অস্থিরতাও তিনি লক্ষ করেছেন।
নিবেদিতার পিঠে হাত দিয়ে তিনি কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মার্গারেট, কীসের জন্য কষ্ট পাচ্ছ, আমাকে বলো!
অশ্রুসজল মুখ ফিরিয়ে নিবেদিতা বললেন, জো, জো আমি এখন কী করব বলো তো। আমার যে আর ফেরার পথ নেই। এখন লন্ডনে ফিরে গেলে সবাই উপহাসের হাসি হাসবে। কিন্তু যাঁর জন্য সব কিছু ছেড়ে এলাম, তিনি আমাকে প্রীতির চক্ষে দেখেন না!
জো বললেন, না, না, তুমি অমন ভেবো না। তিনি তোমায় শিক্ষা দিচ্ছেন বলেই মাঝে মাঝে কঠোর কথা বলেন!
নিবেদিতা বললেন, তিনি হাজার কঠোর কথা বললেও আমি সহ্য করতে পারব। কিন্তু তিনি আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান। তাঁর উদাসীনতা আমার মর্মে মর্মে বেঁধে। তোমরা চলে গেলে, আমি তখন কী করব?
জো বললেন, আহা, আমরা তো এক্ষুনি চলে যাচ্ছি না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি তো সাধারণ মানুষ নন, তাঁকে বুঝতে তোমার সময় লাগবে।
নিবেদিতা জো-কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আমি তো চেষ্টা করছি। জো, আমি অন্যরকম ভেবে এসেছিলাম, এদেশের জন্য আমি সমস্তরকম কষ্ট স্বীকার করতে রাজি আছি, তিনি থাকবেন আমার পাশে। তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকলে আমার সব শক্তি চলে যায়।
সেদিনই বিকেলে জো বিবেকানন্দকে আড়ালে ডেকে কিছু কথা বললেন। জো বিবেকানন্দর দর্শন ও কর্মপরিকল্পনার সমর্থক, কিন্তু তাঁর শিষ্যা হবার কোনও বাসনা তাঁর নেই। বিবেকানন্দর সঙ্গে যে কোনও বিষয় উত্থাপন করতে তিনি কোনও সঙ্কোচ বোধ করেন না। তিনি বললেন, সোওয়ামী তুমি ওই আইরিশ মেয়েটাকে এত নির্যাতন করছ কেন?
বিবেকানন্দ হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, আমি তাকে নির্যাতন করছি? এদেশে এলে তাকে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, কতরকম অসুবিধের সম্মুখীন হতে হবে, এ সব বিষয়ে আমি তাকে আগেই সাবধান করে দিইনি?
জো বললেন, সে সব কষ্টের কথা হচ্ছে না। মার্গারেট আমাকে তোমার লেখা একটা চিঠি দেখিয়েছে। সেই চিঠিখানা সে সব সময় নিজের কাছে রাখে। ঠিক যেন বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছে। সেই চিঠিতে তুমি লিখেছিলে, ‘যদি বিফল হও, কিংবা কখনও কর্মে তোমার বিরক্তি আসে, তবে আমার দিক থেকে নিশ্চয় জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে। তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ করো আর নাই করো, বেদান্ত ধর্ম ত্যাগ করো আর ধরেই থাকো।… এই আমার প্রতিজ্ঞা’। তুমি একথা লেখনি?
বিবেকানন্দর মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল, তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন হ্যাঁ লিখেছি।
জো বললেন, এই ভরসাতেই সে এসেছে। বেচারি এখন কাজ শুরুই করেনি। অথচ তুমি যদি তার প্রতি উদাসীন থাক, তা হলে তার মন ভেঙে যাবে না? মেয়েটা বড় কষ্ট পাচ্ছে। তুমি ওর সঙ্গে একটু ভাল করে কথা বল, প্লিজ। আমরা পশ্চিমি মেয়ে, ত্যাগ, বৈরাগ্য এসব কি সহজে আমাদের মাথায় ঢোকে?
অপরাহ্নে বেড়াতে বেরুবার সময় বিবেকানন্দ নিবেদিতার পাশে এসে একটু থেমে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি আমার কাছে কী চাও?
নিবেদিতা বললেন, তুমি আমার প্রভু, আমার রাজা। আমাকে তোমার পায়ে স্থান দাও।
বিবেকানন্দ আর কিছু না বলে হনহন করে চলে গেলেন অন্য দিকে।
তারপর আর তাঁকে দেখতে পাওয়া গেল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামল, তারপর রাত্রি নামল, বিবেকানন্দ কোথাও নেই। সবাই ব্যস্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। মহিলারা ছুটে এলেন টমসন হাউসে, সেখানেও তিনি নেই। একটু পরে শ্রীযুক্ত সেভিয়ার বললেন, আপনারা অযথা চিন্তা করবেন না। তিনি আমাকে বলে গেছেন। তাঁর মন অস্থির হয়ে আছে, তাই তিনি লোকজনের সঙ্গ পরিত্যাগ করে জঙ্গলে চলে গেছেন। সেখানে নির্জনে কয়েকদিন থাকবেন।
কিন্তু চিন্তা না করে কি উপায় আছে? বিবেকানন্দের শরীর এখনও ভাল নয়, হজমের গোলমালে কষ্ট পান। অরণ্যের মধ্যে গিয়ে তিনি কী খাবেন, কোথায় শোবেন? কে তাঁর দেখাশুনো করবে? তবু, তিনি একাকী অরণ্যবাসের জন্য গেছেন, এখন তাঁর কাছে যাওয়া সঙ্গত হবে না।
জো বুঝতে পারেন যে, বিবেকানন্দও কষ্ট পাচ্ছেন। তাঁর কঠোরতা তাঁর ঔদাসীন্য সে কষ্টকেই চাপা দিতে চায়। কষ্ট পাওয়া কোনও কোনও মানুষের নিয়তি। নিবেদিতার কান্নাও থামে না।
তিন দিন পর তিনি ফিরে এলেন। ধূলিমলিন শরীর, তপস্যাক্লিষ্ট চক্ষু দুটি জ্বলজ্বল করছে, মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। গুরুভাইদের বললেন, দ্যাখ, বিলেত আমেরিকায় গিয়ে আমি একটুও বদলাইনি। এখনও আগের মতন পারি। যখন একা একা সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছি, তখন মাঠে ঘাটে শুয়ে থাকতাম। এখনও জঙ্গলে আমার কোনও কষ্টই হল না। দিব্যি ছিলাম।
নিবেদিতা-জো’দের সঙ্গে দেখা হবার পর তিনি এমন প্রশান্ত ব্যবহার করলেন, যেন কিছুই ঘটেনি। প্রত্যেকের শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিলেন। আবার চা-পানের সময় শাস্ত্র আলোচনা ও বিশ্রম্ভালাপ। মুঘল বাদশাহদের গল্প। শাজাহান ও আকবরের তিনি বিশেষ অনুরাগী। ইসলাম ধর্ম নিয়ে তিনি গভীর চিন্তা করেছেন। ভারতের উন্নতির জন্য এই ধর্মের সহায়তারও বিশেষ প্রয়োজন। মহম্মদ সরফরাজ হোসেন নামে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তিনি চিঠিতে লিখেছেন, বেদান্তের মতবাদ যতই সুক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হোক না কেন, কম-পরিণত ইসলাম ধর্মের সাহায্য ছাড়া মানবসাধারণের অধিকাংশের কাছে তা সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরূপ দুটি মহান মতের বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহের সমন্বয়ই একমাত্র আশা। আমি মানসনেত্রে দেখতে পাই, এই বিভেদ-বিশৃঙ্খলা ভেদ করে ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ নিয়ে মহামহিমাময় ও অপরাজেয় শক্তি নিয়ে জেগে উঠছে।
তাজমহলের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে করতে তিনি আত্মহারা হয়ে যান। তিনি পরিব্রাজক অবস্থায় তাজমহল দেখতে গিয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করলে এখনও রোমাঞ্চ হয়।
নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর ব্যবহার কিন্তু কিছুতেই সহজ হয় না। নিবেদিতা হঠাৎ হঠাৎ কোনও প্রশ্ন করলেই তিনি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। যেন সব নির্দেশই নিবেদিতাকে বিনা তর্কে মেনে নিতে হবে। কিন্তু পশ্চিমি জগতের এক শিক্ষিতা রমণী তাঁর যুক্তিবোধ সহজে বিসর্জন দিতে পারেন না। প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর তিনি খুঁজবেনই। স্বরূপানন্দ বা অন্য সন্ন্যাসীদের কাছেও তিনি সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যান না। তাঁর সমস্ত আগ্রহ বিবেকানন্দকে ঘিরে। অনেকের মধ্যে বসে থেকে বিবেকানন্দ নিবেদিতার দিকে যখনই চোখ তুলে তাকান, তখনই দেখতে পান নিবেদিতা তাঁর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন।
ভারত নামে এই দেশটির প্রতি নয়, একজন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি নিবেদিতার এই যে একাগ্রতা, এই যে মোহ, তা বিবেকানন্দ ছিন্নভিন্ন করে দিতে চান। ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধন তিনি কিছুতেই মানতে চাইছেন না। এক এক সময় মনে হয়, তিনি নিজের সঙ্গেই লড়াই করছেন। আবার নিবেদিতার সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর ভাষা কর্কশ হয়ে যায়, মুখে ফুটে ওঠে কঠোর ভাব।
নিবেদিতা আবার লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।
একদিন অনেকের সামনে বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে খুব বকাবকি করতে জো তাঁকে বললেন, সোওয়ামী, তুমি ওকে শিক্ষা দিতে চাও, দাও, কিন্তু একটু নরম ভাষায় বলতে পারো না? কখনও কি একটু কোমল ব্যবহার করা যায় না? ও মেয়েটা যে তোমার কাছ থেকে দুটো মিষ্টি কথা শোনার জন্যে ব্যাকুল হয়ে থাকে।
বিবেকানন্দ কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেলেন। একা একা পায়চারি করতে লাগলেন দূরের উদ্যানে। কেউ তাঁর কাছে যেতে সাহস করলেন না। তাঁর পদচারণার গতি কখনও দ্রুত, কখনও মন্দ, যেন তিনি ঝড় ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছেন।
খানিক পরে তিনি ফিরে এলেন সকলের মাঝখানে। মৃদু স্বরে বললেন, আমার ভুল, আমাকে আবার কয়েকদিন জঙ্গলে গিয়ে থাকতে হবে।
অনেকে মিলে সমস্বরে আপত্তি জানাল।
বিবেকানন্দ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তাঁর শরীর যেন অনেক বিশাল হয়ে গেছে, যেন তিনি ঢেকে দিচ্ছেন দূরের পাহাড়ের চূড়া। একটা হাত তুললেন আকাশের দিকে।
তাঁর মুখমণ্ডল এখন প্রশান্ত। সন্ধ্যার আকাশেও একটুও মেঘের মালিন্য নেই। দ্বিতীয়ার চাঁদ দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে তিনি স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, দেখো, মুসলমানরা এই দ্বিতীয়ার চাঁদকে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে। এসো, আমরাও এই নবীন চন্দ্রমার সঙ্গে নবজীবন আরম্ভ করি।
বহুবচনে বললেও কথাগুলিও যেন নিবেদিতাকে উদ্দেশ করেই বলা। নিবেদিতা উঠে এসে তাঁর প্রভুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। বিবেকানন্দ হাত রাখলেন তাঁর মাথায়।