তমিজ আজ এতো রাত করে কেন? দরজা খুলে চৌকাঠে বসলে কুলসুমের চোখের সামনে ঝোলে ঘন কুয়াশা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চাঁদের ময়লা আলোয় কুয়াশা একটু তরল হয় এবং হালকা বাতাসে একটু দোলেও বৈ কি! মরার উঁদ যদি উঠলিই তো কয়টা দিন আগে উঠলি না কেন? সাত মাসের পোয়াতির মতো প্রায় ভরা ভরা চাঁদটা যদি দশ দিন আগে এমনি থাকে তো মানুষটা কী বিলের ধারে দলদলায় অমনি করে গড়িয়ে পড়ে। নিন্দের মধ্যে যে মানুষ হাঁটে তার সলকই কি আর আন্ধারই বা কি? কে জানে চোরাবালিকে পানি ঠাউরে সে নিজেই হয়তো ঝাঁপ দিয়েছিলো মুনসির ভেড়ায় সওয়ারি হবার আশায়। এ ছাড়া মুনসিকে সে আর ধরবে কোত্থেকে? পাকুড়গাছের নাকি চিহ্ন পর্যন্ত কোথাও নাই। তা মুনসি এখন তা হলে বিল শাসন করে কোন চুলায় বসে? চোরাবালির ভেতর থেকেই কী তমিজের বাপ এখনো উচাটন হয়ে খুঁজে বেড়ায় মুনসির কালো পাগড়িতে ঢাকা লম্বা দাড়িওয়ালা মুখ? তা টলতে টলতে মানুষটী কী একবার তার নিজের ভিটাটা দেখতে আসতে পারে না?
এক রবিবার আরেক রবিবার আট দিন, তারপর সোমবার গেলো মঙ্গলবার গেলো, কয়দিন হলো? এই দশ দিনে কুসুমের খোয়বেও সে কি একবার উঁকিটাও দিতে পারে না? এই কাৎলাহার ছেড়ে, গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙা ছেড়ে, তাদের সবার মায়া কাটিয়ে নিজের পাকুড়গাছটাকে পর্যন্ত উপড়ে নিয়ে মুনসি যদি হাওয়া হয়ে যেতে পারে তো তার জন্যে তমিজের বাপের অতো দরদ কিসের?
মাটির হাঁড়িতে রেখে রোজ পান্তা খাওয়া হচ্ছে আজ কয়দিন থেকে। পান্তা মজে টক হয়, সেই ঘেরানে ভুরভুর করে সারা ঘর। সানকিতে পান্তা নিয়ে পেঁয়াজে কামড় দিতে গিয়ে কুলসুমের দাত বসে থাকে পেঁয়াজে, চিবানোর বল আর পাওয়া যায় না। দুই সানকি ভাত খেতে যে মানুষ শেষ করে ফেলে পাঁচটা পেঁয়াজ তার খোরাক এখন জোটে কীভাবে? কুলসুমের শুকনা চোখ খরখর করে। চাঁদের আলো তার চোখের সব পানি শুষে নিয়ে শিশিরের ফোঁটা করে ফেলে দিচ্ছে সামনের উঠানে, ঘরের চালে, নতুন খড়ের গাদায়। কুলসুমের চোখে পানি আর জমতে পারে না। তবে চোখে পানি না এ জমার একটি কারণ কিন্তু হতে পারে তার বড়ো বড়ো নিশ্বাস। গন্ধ নিতে নিতে কুলসুম হাপসে হাপসে পড়ে। কৈ তমিজের বাপের গন্ধ কোথাও নাই। মানুষটা তার গায়ের আঁশটে গন্ধ, মুখের পচা মাছের গন্ধ, হাঁটুর ওপরকার ঘায়ের পূজের গন্ধ, উরুর ঘায়ের বাসি গন্ধ সব নিয়ে গেছে মুনসিকে ভেট দিতে? এই যে দশটা দিন গেলো, কৈ কুলসুমের খোয়াবের মধ্যেও তো একবার এলো না।
আর মুনসিরই বা এ কেমন ধারা গো? তমিজের বাপকে কি মুনসি এতোই ভালোবাসে যে, তার নিজেরই খাস মানুষ ছিলো চেরাগ আলি, সারা জেবন কাটালো তারই শোলোক বলে বলে, তার নাতনিটার কথাটা কি একবার মনেও করলো না? আবার তমিজের বাপই বা কেমর মরদ যে, মুনসিকে বলতে পারলো না, তোমার নিজের আরস পাকুড়গাছের খবর নাই, ইটের ভাটায় ঢুকলো না কি উড়েই গেলো, তুমি আমাকে বসতে দেবে কোথায়? বলতে পারে না, এখানে আমি খাবো কী? আধপেটা খেয়ে কাটলো তার কতোগুলো দিন, এখন হুরমতুল্লার জমিতে ধান কেটে বেটা তার নতুন ধানের চালের ভাত খাওয়াবে। সে কি বলতে পারে না, তার বৌ আমন ধানের আতপ চালের পিঠা করবে, গুড় দিয়ে খির করবে, আমি এখন যাই!
হয়তো নতুন চালের ঘেরানে পিঠা খাবার লালচেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে মাথায় শিশির নিয়ে এগিয়ে আসে তমিজের বাপ। তার ছায়া লেপ্টে থাকে জ্যোৎস্না মাখানো কুয়াশার সঙ্গে। কুলসুম চোখ বন্ধ করে রাখে, পাছে তার চোখের কাপনে মানুষটা ফেরম হারিয়ে যায়!
দরজাত বস্যা কী করো? ভাত খাছো? তমিজের গলা ঠাহর করতে পেরেও কুলসুম। কঁপে; ভয়ে কাঁপে, খুশিতে কাঁপে। মরার পর তমিজের বাপ বেটার রুহের সাথে মিশে এসেছে নিজের ঘর দেখতে।
ধান কিন্তু তমিজ এবারে তেমন পেলো না। মজুরি নিয়ে কাম করলেই ভালো হতো। হুরমতুল্লার মন খারাপ, তার ধানের ভাগ তো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। তমিজের সঙ্গে সে গজগজর করে, তোক কেটা কী কয়, আর তুই তাই লিয়া নাফ পাড়িস?
হুরমতুল্লা পরামাণিক হদ্দ চাষা, তার দৌড় বড়োজোর গোলাবাড়ি হাট পর্যন্ত।
আবদুল কাদের বলেছে। কেরামত গান বেঁধেছে। ইসমাইল হোসেনের মতো মানুষ পর্যন্ত কতবার করে বলেছে, পাকিস্তানে জমিদারি মহাজনি থাকবে না। তেভাগা নিয়ে বলেছে, পাকিস্তান হলে ওসব এমনি এমনি হয়ে যাবে। মোসলমান চাষারা অন্তত এসব নিয়ে হুজ্জত করা বন্ধ করলো কি মিছেমিছি? জেলখানায় তেভাগার নেতারা আফসোস। করেছে, তাদের কতো তেজি তেজি মুসলমান ছেলে পাকিস্তানের ডাকে মুসলিম লীগে ভিড়ে গেছে। তারা কি এমনি এমনি ভিড়েছিলো?
গোলাবাড়িতে কাদেরকে জিগ্যেস করলে সে গম্ভীর হয়ে যায়, উগলান কথা এখন রাখ। আমাদের নতুন রাষ্ট্র, ইনডিয়ার দালালরা মানুষকে খেপাতে চায়, মানুষ গোলমাল করলে ইনডিয়া সুযোগ নিয়া নয়া দেশটাকে খপ করা খায়া ফালাবি। ইনডিয়ার সমস্যাও কাদের তাকে বোঝায়, হিন্দুস্থানেত যারা চাষাদের নিয়া গোলমাল করে ঐ দেশের সরকার তাদের জেল দেয় : জহরলাল নেহেরু নিজে কতো জেল খাটিছে, এখন প্রধান মন্ত্রী হয়া কম্যুনিস্টদের জেলের মধ্যে ভরে।
তমিজ ধন্দে পড়ে। এই দলের মানুষ পাকিস্তানে গোলমাল করে হিন্দুস্থানের টাকা খেয়ে। আবার হিন্দুস্থানে গেলে তারা জেল পাটে। এর মানে কি? কিন্তু লোকে এখানে গোলমাল করবে কেন? ইসমাইল সাহেব না সেদিনও বলে গেলো, নতুন আইন পাস হলে বর্গাচাষাকে তার ন্যায্য পাওনা দেওয়া হবে।
সেই কথা বল। কাদের এবার তমিজের কথাটা বোঝে, জমিদারি উচ্ছেদের একটা। বিল সেদিন সরকারের মন্ত্রী তুলিছে। তার মধ্যে একটা কথা আছে, জোতদার ইচ্ছামতো বর্গাদারেক জমি থেকে উচ্ছেদ করবার পারবি না। হঁ্যা, বিল একটা উঠিছে।
এবার তমিজ খুশি, বিল হোক আর জমি হোক, মাঝি হোক আর চাষা হোক, হামরা ল্যায্য হক পালেই খুশি।
বিল সম্বন্ধে তমিজের ভুলটা ভাঙাবার ধৈর্য কাদেরের এখন নাই। সে হাসে, তোর এতো খবরের দরকার কী? তুই তো আর জমি বর্গা করিচ্ছিস না।
এবার না পারুক, সামনের আবাদ তমিজ বর্গায় করবে। জগদীশ সাহা আড়াই বিঘা জমি বেচলো হামিদ সাকিদারের কাছে। তবে তার এক দাগে প্রায় বারো বিঘা জমি বেচবে, কালাম মাঝি নাকি সবটাই কিনে নেবে। এই দুজনের যে কোনো একজনের কাছে গেলে তমিজকে কি আর খালি হাতে ফিরতে হবে? আবার একই জমিতে চিরকাল বর্গা করার হক পেলে তেভাগার আইন হতে আর কদ্দিন লাগবে?
নিশ্চিন্ত হলে তমিজের মনে পড়ে বাপের কথা। তিন চার দিন হয়ে গেলো বাজানের কাছে যাওয়া হয় নি।
চোরাবালির ধারে দাঁড়িয়ে তমিজের শীত শীত করে। বাপটা তার ঢুকে আছে ওর মধ্যেই, অথচ ঐ শরীর থেকেই তাপ নিতে তমিজের গা আইঢাই করে। সারা জীবন বিলের ধারে ধারে ঘুরলে কি হয়, বাজানের গতরে তাপ ছিলো অনেক। এখানে আছে,–একদিক থেকে ভালোই, বাপ তো তার এই বিলেরই মানুষ। তমিজকেও রাখতে চেয়েছিলো পানিতে পানিতে। বাঘাড় মাঝির বংশের ছেলে হয়ে সে লাঙল ধরবে বাজান এটা কখনোই চায়নি। আবার এই নিয়ে যে জেদ করবে সেই জোরটাও তো তার ছিলো না। এই দুনিয়ায় বাপ যদি কাউকে ভয় করতে তো সেই মানুষটা সে নিজে ছাড়া আর কে? খিয়ারে ধান কেটে বাড়ি ফিরে বাপকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে কি রাতভর বিলে কাটিয়ে তাকে ফিরতে দেখেলে তমিজ কী তারাতারা কথাই না বলতো! বাপের খাবার। লালচ নিয়েও কী না বলেছে! মানুষটা খেতে বড়ো ভালোবাসতো। তার খুব খাওয়ার হাউস ছিলো গো। খালি জেয়াফতের ধান্দায় থাকত। জেয়াফতে খেতে খেতে তার তবনের গেরো খুলে গেছে, বমি করে ফেলেছে, খেতে বসে পাদতে শুরু করে পাশের লোকের গালি খেয়েছে। এখানে এই শীতের মধ্যে তার খাওয়া নাই, পেট ছোেটানো নাই, বমি করা নাই। মরার আগে কতোদিন সে আধপেটা খেয়ে কাটিয়েছে। তখন নিত্যি রাত হলে বিলে চলে আসতো, পাকুড়গাছ খোঁজ করে করে খালি ঘুরপাক খেয়েছে। চোরাবালিতে ঢুকে মানুষটা এখন করে কী? এখানে না আছে পাকুড়গাছ, না আছে তার মুনসি। আবার বালির মধ্যে জেয়াফতের ধান্দাই কি সে করে বেড়ায়? খাওয়ার ঘেরান খুজতে খুঁজতে মানুষটা বালি খুঁড়ে খুঁড়ে কোথায় যে চলে গেলো কে জানে?
ডোবার এপার থেকেই ঘরের দরজার চৌকাঠে বাপকে বসে থাকতে দেখে তমিজ চমকে ওঠে, ভয়ও পায়। বাপ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরে নতুন চালের ভাত রান্না। হচ্ছে, সকালে পান্তা, দুপুরে ভাত, রাত্রে ভাত। এই দুটো মাস তিন বেলাই ভাত খাওয়া। বাজান এখানে হাজার বসে থাকুক, সেই ভাত খাবার অবস্থা কি তার আর হবে?
তবে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কুলসুমকে সে ঠিক কুলসুম বলেই ঠাহর করে ফেলে এবং কুপির আলোয় তার চোখে বাজানের চাউনি দেখে সটান শুয়ে পড়ে বাজানের বিছানায়। বাজান! বাজান! কী খাবা গো? ডাকতে ডাকতেই শুরু হয় তার ফোঁপানো কান্না, এই কান্না তার জমতে শুরু করেছিলো চোরাবালির ধারেই, এবং কাঁদতে কাঁদতেই বাপকে তার প্রিয় খাদ্য সম্বন্ধে জিগ্যাসা করা অব্যাহত রাখে। পাশে বসে কুলসুম হাত রাখে তমিজের ঝাঁকড়া চুলে, তারপর ঐ চুলে নাক খুঁজে সে নিশ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। এই ঝাঁকড়া চুলে মিশেছে তার বাপের পাটের আঁশ কিসিমের চুলের গন্ধ। এতোকাল পর গন্ধটাকে পাখির ডানা ঝাপটানোর গন্ধ বলে সনাক্ত করতে পারলো। তমিজের ঘাড়ের গন্ধে মিশেছে তার বাপের গায়ের আঁশটে গন্ধ, তার বুকে কাদার গন্ধ। তমিজের সারা গায়ের গন্ধ নিতে নিতে কুলসুমও কোঁপাতে শুরু করে এবং এখন কিছুক্ষণের মধ্যে সে কেঁদে ওঠে হাউমাউ করে। তমিজ তার বাপের গতরের ওম নিতে মুখ গুঁজে দেয় কুলসুমের উঁচু বুকে। কাঁদতে কাঁদতে কুলসুম বলে, প্যাট ভরা ভাতও খাবার পারে নাই গো মানুষটা, মুনসির ডাক শূন্য কোটে চলা গেলো, একবার কয়াও গেলো না। বাজান জেয়াফতের বাড়ি উটকাতে ঐ বালুর মধ্যে কোটে কোটে ঘুরিচ্ছে গো। এবার একটা পিটা মুখোত পড়লো না তার। শোলোক শুনবার গেলো, আর এই ফিরলো না। ত্যাল পিঠা হলে তাই একলাই এক কুলা শ্যাষ করিছে। তমিজ হামলে, কেঁদে ওঠে, মণ্ডলবাড়িত জিয়াফতের ভাত খাবার যায় কি কাউলটা তাই করিছিলো গো। কুলসুম জানায়, কালাহারের কৈ মাছ দিয়া নাউ দিয়া ভাত খাবার চাইছিলো গো উদিনকা, খাবার পারলো না।
পেটুক বাপের আধপেটা খাওয়া গতরের তাপ নিতে তমিজ হাত রাখে কুলসুমের পিঠে, তমিজের বাপের তাপ পোয়াতে তাকে নিবিড় করে টেনে নেয় নিজের শরীরে। পায়ের দুটো ঘা থেকে তার আধপেটা গতরের গন্ধ নিতে কুলসুম হাত বোলায় তমিজের হাঁটুতে আর উরুতে। আর তমিজের বাপ অনেক দূরে কাৎলাহার বিলের চোরাবালির ভেতর থেকে তার লম্বা হাত বাড়িয়ে কিংবা হাতটাই লম্বা করে আলগোছে টেনে নেয় তমিজের বন আর কুলসুমের শাড়ি। গরহাজির মানুষটার গায়ের ওম পেতে আর গায়ের গন্ধ শুকতে দুজনে ঢুকে পড়ে দুজনের ভেতরে।