কতকাল পরে রেলগাড়ি দেখছে প্রীতম!
আম্বুলেন্স থেকে স্ট্রেচারে নামিয়ে ট্রেনের একটা ফার্স্টক্লাশ কুপেতে চটপট তাকে তুলে দিয়ে গেছে বাহকেরা। কিন্তু ওই সময়টুকুতেই সে অবাক হয়ে ঠিক লাবুর মতো ছেলেমানুষি কৌতূহলে রেলগাড়িটাকে দেখেছে।
নীচের বার্থে নরম বিছানায় শুয়ে সে রেলগাড়ির অদ্ভুত নেশারু গন্ধটা পাচ্ছিল। কাঠের পালিশ, গদি আর মৃদু ফিনাইল মিলে বোধহয় এই গন্ধটা তৈরি হয়। বড় ভাল লাগে।
কাঁদবে বলে লাবুকে স্টেশনে আনা হয়নি। তবু কি কঁদেনি? অসহায় তোষাপানা মুখ করে সারাদিন বেড়ালের মতো ঘুরঘুর করেছে প্রীতমের বিছানার আশেপাশে। রওনা হওয়ার সময় সামলাতে পারেনি, হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। প্রীতম মড়ার মতো মুখ করে শক্ত হয়ে রইল। মনে মনে জপ করল, ওরা কেউ না, ওরা আমার কেউ না। তবু সে তো জানে, আমৃত্যু লাবুর মুখখানা চোখে ভাসবে তার।
স্ট্রেচারে অ্যাম্বুলেন্সে ভেসে ভেসে চলে আসার সময় সে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, এ শোক বেশিদিন তো নয়। শোনোনি তোমার শরীরের ভিতরে কোলাহল আর জয়ধ্বনি করছে জীবাণুরা। বেশিদিন নয় হে, বেশিদিন নয়।
এতদিনে গতকালই প্রথম সে তার বিজ্ঞাপনের একটা জবাব পেয়েছিল। ছোট একটা কোম্পানি তাকে দিয়ে অডিট করাতে চেয়েছে। সামান্য ফি দেবে। একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিল প্রীতম, হয়তো কাজ-টাজ হাতে নিলে বেঁচে যাব। তারপর ভাবল, খেলাটা শেষ হওয়াই ভাল। খামোখা টানাহ্যাঁচড়া করে ক্ষতবিক্ষত হওয়া। আর লড়াই নেই। এবার নিশ্চিন্ত।
সারাক্ষণ বিলু পাশাপাশি রয়েছে। ট্রেনের কামরা অবধি। পায়ের কাছে বসে প্রীতমের রোগা হাঁটুর ওপর হাত রেখে পলকহীন চেয়ে আছে। বিকেল থেকে কেবলই ওই মূক চেয়ে থাকা। কথা নেই। প্রীতম অবশ্য চাইছে না। চেয়ে কী হবে? মায়া বাড়বে।
তবু এই শেষ সময়টুকু এভাবে কাটিয়ে দেওয়া অভদ্রতা বলে প্রীতম বিলুকে জিজ্ঞেস করল, মেজদা আসবে না?
বিলু সংবিৎ পেয়ে বলল, তুমি যে কে সেজদাকে মেজদা ডাকো!
আমি তো মেজদাই ডাকব। পিসিমার ছেলেরা ডাকত। ও আমাদের ছেলেবেলা থেকে ডেকে অভ্যাস। তবে আজকাল সেজদাও ডাকি, কিছু ঠিক নেই।
বিলু বলল, আসবার তো কথা। হয়তো অফিসে কাজ পড়েছে।
মেজদা আসবেই। তুমি একটু দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াও। হয়তো কামরাটা চিনতে পারছে না। বিলু নিঃশব্দে উঠে গেল। একটু বাদে ফিরে এসেই বলল, শতম তো রয়েছে বাইরে।
ট্রেন ছাড়তে কত দেরি?
এখনও কুড়ি মিনিটের মতো।
শতমটা যে কেন একগাদা টাকা খরচ করে ফার্স্ট ক্লাশের টিকিট কাটতে গেল। সেকেন্ড ক্লাশেই দিব্যি যেতে পারতাম।
এই ভাল হয়েছে। সেকেন্ড ক্লাশে ভিড়, গোলমাল, ধাক্কাধাকি।
সেটাই তো ভাল। কতকাল মানুষজন দেখি না, গোলমাল কানে আসে না। জ্যান্ত তাজা, একগাদা মানুষ দেখতে কত ভাল লাগত।
অসুবিধে হত।
তুমি বুঝবে না মানুষের ভিড় আমার এখন কত প্রিয়।
ঘরবন্দি থাকলে ওরকম মনে হয়। কিন্তু ভিড় তো আর সত্যিই ভাল কিছু নয়।
আচমকাই অরুণের দীর্ঘ গৌরবর্ণ চেহারাটা দরজা জুড়ে দেখা দিল। পরনে ধুসর রঙের সাফারি শার্ট আর প্যান্ট। হাতে গাড়ির চাবি।
একটুও চমকাল না প্রীতম। মনে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। শান্ত গলায় বলল, আসুন।
চললেন তা হলে?–অরুণ ভিতরে এসে দাঁড়ায়।
চললাম। বিলু আর লাবু রইল।
বিলু উঠে দাঁড়িয়ে অরুণকে বলল, এখানে বোসো।
অরুণ বসল না। হাত নেড়ে বিলুকে বসে থাকার ইঙ্গিত করে বলল, বিলুও তো ছুটির অ্যাপ্লিকেশন করেছে শুনলাম। করোনি বিলু?
হ্যাঁ।
শিলিগুড়ি কবে যাচ্ছ?
সামনের মাসে।
প্রীতম এই সংলাপ নীরবে শুনল। কথা বলল না। বিলু সামনের মাসে শিলিগুড়ি যাবে, এ কথা তাকে আগে বলেনি। এখন জেনেও প্রীতমের ভাল বা খারাপ কিছু লাগল না। মাথার মধ্যে কোনও কথাই তরঙ্গ তুলছে না। কেমন একটা জমাট নিরেট ভাব।
অরুণ ওপরের বাঙ্কে হাতের ভর রেখে ঝুঁকে বলল, আমার বিয়েটা পর্যন্ত আপনি থাকবেন আশা করেছিলাম।
প্রীতম সামান্য হাসল। বলল, বিয়েটা হোক। দুর থেকে শুভকামনা করব।
অরুণ মুখ গম্ভীর করে বলে, আপনার ওয়েল উইশিং-এর দাম আছে। আপনি সত্যিকারের ভাল লোক।
প্রীতম আবার হাসে। মাথাটা এত প্রতিক্রিয়াহীন কেন? এত জমাট কেন?
বিলু আবার হাঁটুতে হাত রেখেছে। আস্তে করে বলল, আমি আর দিন কুড়ি-পঁচিশ বাদেই যাচ্ছি। ততদিন ওষুধ-টষুধ ঠিকমতো খেয়ো।
ভেবো না। বাড়িতেই দেখার লোক আছে।
তবু বলছি।
গাড়ি ছাড়ার মিনিট সাতেক বাকি থাকতে দীপনাথ এল। মুখে ঘাম, উদ্বেগ। বড় বড় ঘাস ছাড়ছে।
এলে মেজদা? ভাবছিলাম, বোধহয় পৌঁছতে পারবে না।
দেরি হয়ে গেল। বউবাজারে যা জ্যাম। ট্যাক্সি ছেড়ে প্রায় দৌড়ে এসেছি।
তোমার নর্থবেঙ্গলের ট্যুর আর নেই?
আছে। খুব শিগগিরই যাচ্ছি। অফিসে কিছু বকেয়া কাজ জমে গেছে বলে ডেটটা পিছিয়েছে।
তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি বেশিদিন—
চুপ কর প্রীতম।
প্রীতম আবার হাসে। মাথা একটু তোলার চেষ্টা করে বলে, পাঁচ মিনিটের বেশি বোধহয় সময় নেই। বিলু, তুমি নামো।
বিলু মৃদুস্বরে বলে, অনেক দেরি আছে।
প্রীতম দীপনাথের দিকে চেয়ে বলে, মাথাটা কেমন লাগছে মেজদা। বোধবুদ্ধি কমে যাচ্ছে। কটা বাজে বলো তো? সময় আছে?
দীপনাথ ঘড়ি দেখে বলে, মিনিট তিনেক।
শতম গাড়িতে উঠল না?
উঠবে। অত অস্থির হচ্ছিস কেন?
অস্থির নয়। গাড়িটা চললে আমার খুব ভাল লাগবে। কতকাল চলন্ত রেলগাড়িতে…কতকাল.. প্রীতম!
উঁ।
ওরকম করছিস কেন? শরীর কেমন লাগছে?
ভাল। খুব হালকা।—চোখ বুজে গভীর শ্বাস টেনে প্রীতম বলে, গাড়ি ছাড়লেই ভাল লাগবে।
দীপনাথ ওর কপালে হাত রাখে। করোটির মতো কপাল। চামড়ায় খসখসে ভাব। ঠিক এতটা দুর্বল কিছুদিন আগেও ছিল না প্রীতম। ডাক্তাররা পাকেপ্রকারে জবাব দিয়েছে অনেককাল আগেই, তবু অসম্ভব মনের জোরে লড়ে গেছে প্রীতম।
দীপনাথ ক্রুদ্ধ বিরক্ত চোখ তুলে অরুণের দিকে তাকায়। সুন্দর শয়তান। বলবে দীপনাথ? বলবে যে, আপনিই প্রীতমের এ অবস্থার জন্য দায়ী?
বলা যায় না। মানুষের সমাজে আজও ভদ্রতা, শিষ্টতার মতো কিছু ভাঁড়ামি এসে সত্যের মুখ চাপা দিয়ে ধরে।
অরুণ একদৃষ্টিতে দীপনাথকে দেখছিল। হঠাৎ বলল, আমেরিকায় এক জায়গায় মোটর নিউরো ডিজেনারেশন নিয়ে রিসার্চ চলছে। আমি চিঠি লিখেছিলাম। জবাব এসেছে, ওরা এখন এই রোগটা নিয়ে অ্যানিম্যাল রিসার্চ করছে। কোলোনে আর-এক জায়গায় যোগাযোগ করেছি।
কী লিখেছে?
এখনও জবাব আসেনি। যদি আসে তবে জানাব।–এইটুকু স্বাভাবিক গলায় বলে হঠাৎ মুখটা কাছে এনে বলল, এস এন ডি ইজ ইনকিউরেবল ইউ নো।
দীপনাথ মাথা নাড়ে।
শতম দরজায় আসে। ছোট কুপটায় ভিড় হয়ে গেছে। শতম বলল, গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। বউদি, নামো।
কথাটা শুনেও কয়েক সেকেন্ড বসে থাকে বিলু। তারপর উঠে প্রীতমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কোমল স্বরে বলে, আসছি। ভাল থেকো।
প্রীতম চোখ চাইল। বলল, গাড়ি চলছে বিলু?
না, এখনই ছাড়বে। আমি যাচ্ছি।
আচ্ছা।–বলে আবার চোখ বোজে প্রীতম। গাড়ি যখন সত্যিই ছাড়ল তখনও তার চোখ বোজা। গাড়ি নড়ে উঠলে হঠাৎ বলল, আমি বাড়ি যাচ্ছি।
একটু বাদে কলকাতার চৌহদ্দি পেরিয়ে দার্জিলিং মেল মাঠঘাটের অন্ধকার ভেঙে যখন দৌড়োচ্ছ ঊর্ধ্বশ্বাসে তখনও প্রীতম কিছু টের পেল না। শতম শিয়রে বসে দাদার কপালে হাত রাখল। রোগা, পাণ্ডুর মুখখানার দিকে চেয়ে রইল গভীর দৃষ্টিতে। অনেকক্ষণ তার মুখে রাগ, অভিমান, দুঃখ খেলা করে গেল। তারপর শান্ত হল শতম।
দাদা!
উঁ।
ওদের কথা বিশ্বাস কোরো না।
কাদের কথা?
ডাক্তারদের কথা, বউদি বা অরুণদার কথা। ওরা কি দুনিয়ার সব কিছু জানে?
দুনিয়ায় সব কথা কেই-বা জানে!
শোনো দাদা, আমি বলছি, এ অসুখ ভাল হয়ে যাবে। তোমাকে এত সহজে মরতে দেব নাকি? ওরা তোমাকে মেরে ফেলছিল বলে আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
ভাল করবি? শুনিসনি, মোটর নিউরো ডিজেনারেশনের কোনও চিকিৎসা নেই?
রাখো তো! নাম চিকিৎসায় সব ভাল হয়।
প্রীতম মুখে কিছু বলল না। শুধু একটু প্রশ্রয়ের হাসি হাসল।
শতমের চোখে মুখে একটা গভীর বিশ্বাসের প্রত্যয় ফুটে উঠল, নামই সব। নাম থেকেই প্রাণ। নামে সব হয়। দেখবে দাদা?
ক্লান্ত চোখে একটু উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে প্রীতম বলে, এসব তো এতদিন বলিসনি।
বলব কী? ওরা তোমার এত চিকিৎসা করছে অথচ নিজেরাই বিশ্বাস করছে না যে, তুমি বাঁচবে। মূলে একটু বিশ্বাস না থাকলে কি হয়! ওদের কারও স্বভাবেই বিশ্বাস জিনিসটা নেই। বীজমন্ত্র জপে অসুখ সারে, এ কথা শুনলে হাসত। আজ তোমাকে ওই পরিবেশ থেকে তুলে আনতে পেরেছি বলে বলছি। তুমি শুধু একটু বিশ্বাস করো যে, তুমি বাঁচবে।
কিন্তু সব যে বড় দুরে সরে যাচ্ছে।
কিছুই দূরে সরছে না। তুমি চুপ করে চোখ বুজে থাকো। আমি তোমার শিয়রে বসে একটু জপ করি।
আচ্ছা।–প্রীতম চোখ বোজে।
শতম কামরার বাতি নিভিয়ে দেয়। প্রীতমের শিয়রে শিরদাঁড়া টানটান খাড়া রেখে বসে।–যুগল এবং নাসামুলের সঙ্গমে ত্রিকূটি। আজ্ঞাচক্র। তেসরা তিল। দার্জিলিং মেলের ঝোড়ো গতি, দুলুনি এবং প্রবল শব্দের জন্য মনটাকে সংহত করতে একটু দেরি হয়। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে পারেও তা। আজ্ঞাচক্রে স্মিত হাস্যময় অপার্থিব সুন্দর মুখশ্রী ফুটে ওঠে। শুরু হয় বীজনামের স্পন্দন। একটু একটু কাঁপতে থাকে শতম। নামের ধ্বনির সঙ্গে তাল রেখে তার হৃৎপিণ্ডের শব্দ পালটে যায়। শব্দ ধ্বনিত হতে থাকে। ত্রাতা ডাকে, অনাহত শব্দ ডাকে… শোন ওই অনাহত শব্দসব শব্দ শব্দ শব্দ। তিনি বলেছিলেন, দ্যাখ, আমাদের যেতে হলে সেই গঙ্গার ধারে যেতে হবে। শব্দগঙ্গা, আকাশগঙ্গা, দ্যাখ, আমার নাম করতে করতে আসলেই ওই ত্রিবেণীঘাটে পৌঁছিবে, তারপর ওই ত্রিবেণীতে পৌঁছিলে ওই শব্দগঙ্গা পেলেই গা ঢেলে দিয়ে বসে যা। রূপের রাজ্য আস্তে আস্তে পার হয়ে পড়। তারপর রূপও যাবে নামও যাবে। আমি কে জানিস? ওই শব্দটা। ওটা কী জানিস? ওই প্রণব।
স্টেশনের বাইরে এসে অরুণ বলল, দীপনাথদা, আপনাকে গাড়িতে পৌঁছে দিই?
দীপনাথ ভীষণ আনমনা ছিল। কথাটা শুনতেই পেল না। অরুণ দ্বিতীয়বার বলায় সে মাথা নাড়ল, না দরকার নেই। আমি তো কাছেই থাকি।
বিলু কিছু বলছিল না এতক্ষণ। এবার হঠাৎ বলল, আজ তোমাকে মেসে ফিরতেই হবে সেজদা?
কেন বল তো!
আজ প্রীতম চলে গেল। আমার খুব একা লাগবে।
তোর সঙ্গে যেতে বলছিস?
গেলে খুব ভাল হয়। যাবে?
অন্যমনস্ক দীপনাথ প্যান্টের পকেটে হাত ভরে কী যেন ভাবে অনেকক্ষণ। বলে, প্রীতমকে যেতে দিলি কেন?
গেলে আমি কী করব? জোর করল যে।
তোর জোর ছিল না?
তাতে ভাল হত?
দীপনাথ আবার একটু ভেবে বলে, না বোধহয়। এই ভাল হয়েছে।
ও ওর মা-বাবা ভাই-বোনকে বড় বেশি ভালবাসে। তাই আমি ভাবলাম, ও যদি নাই বাঁচে তা হলে অন্তত শেষ ক’টা দিন প্রিয়জনদের কাছে থাকুক। কোনও ভুল করেছি?
না তো।–দীপনাথ অবাক হয়ে বলে, ভুল করবি কেন?
অরুণ তার গাড়িটা দুরে পার্ক করে রেখেছে। তিনজন হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে যায়।
যাবে সেজদা?
চল।
অরুণ সামনে, গাড়ি চালাচ্ছে। পিছনের সিটে বিলু আর দীপনাথ।
বিলু মৃদু স্বরে বলে, প্রীতম বড় কষ্ট পাচ্ছে সেজদা।
দেখলাম তো।
শুধু শরীরের কষ্টই তো নয়। দিনরাত ঘরবন্দি থাকতে কেমন লাগে বলো।
দীপনাথ একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
বিলু মাথা নিচু করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, সবাই হয়তো আমার দোষ ধরবে।
আনমনা দীপনাথ বলল, কে দোষ ধরবে?
ওরা, ওই প্রীতমের বাড়ির সবাই।
কেন? তুই কী করেছিস?’
আমি আবার কী করব? ওরা হয়তো বলবে, আমি প্রীতমের যথেষ্ট সেবা করিনি। শতমও সেইরকমই সব কথা বলে গেল। ওদের বিশ্বাস, আমি চাকরির নাম করে প্রীতমকে অ্যাভয়েড় করেছি।
প্রীতমের বাড়ির লোককে আমি চিনি। ওরা খারাপ নয়।
এ কথাটাকে সমর্থন করল না বিলু। তবে জবাবও দিল না। গোঁজ হয়ে বসে রইল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, তুমি প্রীতমকে বড় ভালবাসো, না সেজদা?
উঁ।—স্বপ্নোত্থিত দীপনাথ বিলুর আবছা মুখের দিকে চায়। তারপর বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, প্রীতমটা যে ভীষণ ভাল। শিলিগুড়িতে আমরা একসঙ্গে মানুষ হয়েছি। ওকে কি ভাল না বেসে পারা যায়?
প্রীতমও তোমাকে ভীষণ ভালবাসে।
জানি।
ও চলে যাওয়ায় তুমি আমার চেয়েও বেশি শক্ড।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, ঠিক তা নয়।
তুমি যে ভীষণ আনমনা হয়ে আছ।
দীপনাথ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে আস্তে আস্তে বলল, প্রীতম বাড়ি গেল। তাতে শম্ভ হওয়ার কিছু নেই। আমি শুধু আমাদের ছেলেবেলার কথা ভাবছিলাম।
বলে চুপ করে রইল দীপনাথ। কলকাতায় প্রীতম ছিল। অশক্ত, শয্যাশায়ী, পঙ্গু হলেও ছিল। কিন্তু এখন, আজ থেকে আর নেই। কলকাতা এখন তো অনেক বিবর্ণ লাগবে দীপনাথের কাছে।
অরুণ বিলুদের বাসার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে গেল।
নিঃশব্দে ফ্ল্যাটে উঠে এল দীপনাথ আর বিলু। লাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। খোলা জানালা দিয়ে হুঁ হু করে হাওয়া এসে ফাঁকা ঘরে হুটোপুটি খাচ্ছে। প্রীতমের বিছানার বেডকভারের কোণ বাতাসে উলটে আছে। ওষুধের ফাঁকা শিশিগুলো দাড় করানো বিছানার পাশের টেবিলে।
বিলু বাথরুমে গেছে। দীপনাথ দাঁড়িয়ে প্রীতমহীন ঘরখানা খুব মন দিয়ে দেখে। ঘরের কোণে প্রীতমের হুইল চেয়ার বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রীতম চলে গেছে, এটা কি বুঝতে পারছে প্রীতমের বিছানা, টেবিল বা হুইল চেয়ার!
রাতে খেতে বসে কিছুই প্রায় খেতে পারল না দীপনাথ। বমি আসছে। মুখ ধুয়ে এসে বলল, প্রীতমের বিছানায় একটা ফর্সা চাদর পেতে দে। আমি আজ এই বিছানায় শোব।
বিলু আপত্তি করল না।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে বিলু এসে প্রীতমের বিছানায় দীপনাথের পাশে বসল।
পান খাবে সেজদা?
না।
এক্ষুনি শুয়ে পড়বে নাকি?
দীপনাথ অসহায়ভাবে হেসে বলে, শুয়ে লাভ নেই। আজ রাতে ঘুম আসা শক্ত।
তবে আমাকে প্রীতমের গল্প বলো। তোমাদের ছেলেবেলার গল্প।
শুনতে চাস?
চাই। আজ প্রীতমের কথা শুনতেই তো তোমাকে ডেকে আনা।
কথাটা হয়তো সত্যি নয় বিলুর। প্রীতমের কথা শুনতে তার হয়তো ততটা ইচ্ছে হচ্ছে না, কিন্তু সে জানে, সেজদা প্রীতমের কথা বলতে পারলে খুশি হবে।
প্রীতম। প্রীতমের কথা বলতে গেলেই বিশাল পাহাড়, বনশ্রেণি চোখে ভেসে ওঠে। ছেলেবেলার শিলিগুডির জনবিরল রাস্তাঘাট, উদোম মাঠ, অবারিত প্রসার মনে পড়ে যায়। প্রীতম তো কোনও বিচ্ছিন্ন মানুষ নয়। সে যেন এই ছেলেবেলার এক অবধারিত শর্ত।
অনেক অনেক কথা জমা হয়েছিল বুকে। বলতে বলতে ফাঁকা হয়ে গেল বুক। হাঁটু মুড়ে ভিখিরির মতো করুণ ভঙ্গিতে বসে যতদূর সম্ভব মন দিয়ে শোনে বিলু।