জানা হ্যায় জিম্ম জহাঁ, দিল
ভি জল গয়া হোগা
কুরেদেত হো যো অপ্ রা জুস্তজু কেয়া হ্যায়?
(শরীর জ্বলে গেছে যখন, তখন হৃদয়ও পুড়ে গেছে
ছাই রইয়ে গেছে শুধু, আর খোঁজো কী।)
আমি তো ঐতিহাসিক নই ভাইজানেরা, তাই দেশটা দুভাগ হয়ে কত লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছিল, কত মানুষ হারিয়ে গিয়েছিল চিরতরে, কত মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, কত মানুষকে হর হর মহাদেব বা আল্লাহ আকবর চিৎকার করতে করতে হত্যা করা হয়েছিল, আমি বলতে পারব না। আমার ঝোলায় আছে শুধু কয়েকটা কিস্সা, আমি সেই কাহিনীগুলোই আপনাদের বলতে পারি। তবে কিনা, ইতিহাস তো শুধু কতগুলো সাল-তারিখ, সংখ্যার হিসেব নয়; মানুষের মুখে মুখে-গল্পে-গানেও তো ইতিহাসের ছবিটা তৈরি হয়ে ওঠে। দিল্লির এক দোস্তের কাছে শুনেছিলাম, ওখানে কুড়ি হাজারের বেশী মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল, পুরোনো। দিল্লিতে চল্লিশ হাজারের বেশী মুসলমানদের বাড়ি-সম্পত্তি অধিকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু এসব তথ্য নিয়ে আমি কী করব বলতে পারেন? শরিফান বা বিমলাদের মতো কিশোরির জীবন কীভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিল, তার কি কোনওভাবে ক্ষতিপূরণ সম্ভব? সহায়ের মতো মানুষের কি ওভাবে কুকুরের মৃত্যু মরে যাওয়া উচিত ছিল? আর যে বৃদ্ধা তার মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গিয়ে রাস্তাতেই মারা গেল, তার স্মৃতি আমি কী করে মুছব বলুন তো? রামখিানের মতো ভালো মানুষ কোন হিংসার উন্মাদনায় আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল? আমরা যারা দাঙ্গার বলি হইনি, তারা সারা জীবন তো এরকম ইতিহাসই বহন করেছি, যে ইতিহাস মহাফেজখানায় নয়, রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে পাওয়া যায়। সেই ইতিহাসের ভেতরে ভারত আর পাকিস্থানের মাঝে নামহীন এক ছোট ভূমিখণ্ডে পড়ে থাকে টোবাটেক সিং। এরা-মির্জাসাব-এই মানুষগুলোই-এরাই এখনও আমাদের নির্বাসিত হওয়ার দিনগুলির জীবন্ত ইতিহাস। শরিফানের কথা শুনলে, তাকে কি আর কখনও কেউ ভুলতে পারবে? দিল্লিতে কত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল, তার হিসেব এক-এক ঐতিহাসিক এক-একরকম দিতে পারেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হিসেবটা বাড়তে পারে, কমতেও পারে; কিন্তু মেয়ে সকিনার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সিরাজুদ্দিন যখন চিৎকার করেছিল, আমার লেড়কি জিন্দা হ্যায় হুজুর, আমার লেড়কি জিন্দা হ্যায়, সেই মুহূর্তটাকে আর তো বদলে ফেলা যাবে না। দুনিয়া যতদিন থাকবে, ওই ক্ষতচিহ্নটা থেকেই যাবে, যেভাবে। নাৎসি ক্যাম্পের, গুলাগের গণহত্যাকে মুছে ফেলা যাবে না।
দেশভাগ আমাদের জীবনে হত্যার বীভৎস উৎসব হয়ে উঠেছিল, মির্জাসাব। শুধু তো মানুষ মানুষকে হত্যা করেনি, হত্যা করেছে পারস্পরিক বিশ্বাস, ভালবাসা, নির্ভরতাকে। একটা পরিবার কোনও মতে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে বেঁচে ঝোপঝাড়ে লুকিয়েছিল। তবে তাদের কিশোরি মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। ছোট মেয়েটাকে কোলে আঁকড়ে রেখেছিল মা। দাঙ্গাবাজরা ওদের বাড়ির মোষটাকে নিয়ে গিয়েছিল। গরুটা ছিল, কিন্তু তার বাছুর হারিয়ে গিয়েছিল। তো, রাতে ঝোপের মধ্যে গরুটাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী লুকিয়েছিল। ছোট মেয়েটা ভয়ে। মাঝে মাঝে কেঁদে উঠেছিল। মা আতঙ্কে মেয়টার মুখ চেপে ধরছিল। এমন সময় দূর থেকে একটা বাছুরের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে গরুটাও উন্মত্ত হয়ে ডেকে উঠল; সে চিনতে পেরেছিল, ওটা তার সন্তানেরই আওয়াজ। স্বামী-স্ত্রী কিছুতেই গরুটাকে শান্ত করতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পর ওরা দেখতে পেল, দূর থেকে মশালের শিখা এগিয়ে আসছে বউটা তখন রাগে -হতশায় স্বামীকে বলে উঠল, জন্তুটাকে কেন আমাদের সঙ্গে টানতে টানতে নিয়ে এলে? দাঙ্গার আগুন এভাবেই আমাদের সব অনুভূতিকে পুড়িয়ে আঙরা বানিয়ে দিচ্ছিল।
মির্জাসাব, বারে বারে মনে পড়ে, কোথায় কে যেন, উন্মাদের মত বিড়বিড় করে বলে চলেছে :
মানুষ মেরেছি আমি-তার রক্ত
আমার শরীর
ভরে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে ভয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ করে ঘুমাতেছি-তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে
মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী
সকলকে আলো দেবে মনে করে অগ্রসর হয়ে
তবুও কোথাও আলো নেই বলে ঘুমাতেছে।
ঘুমাতেছে
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ–
আর তুমি?? আমার বুকের পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে- রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে
বলে যাবে, গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলায়, শ্যামবাজারে, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালির—
হ্যাঁ, কেউ নেই, কিছু নেই-সূর্য নিভে গেছে। আর যেন কখনও জ্বলে উঠবে না। সে-রকমই একদিনে কাসিম খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়িতে এসে পৌঁছল। ওর ডান পায়ে গুলি লেগেছিল, রক্তে পা ভিজে গেছে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কাসিমের চোখের সামনে কালচে রক্তের পর্দা দুলে উঠল। জমাট রক্তের মধ্যে পড়ে আছে তার বিবির মৃতদেহ। কাসিম কিছুক্ষণ। হতবাক হয়ে চেয়ে রইল, তারপর কাঠ কাটার কুড়লটা হাতে তুলে নিল। এবার হত্যার বদলে হত্যা। রাস্তায়, বাজারে এবার সে-ও রক্তের বন্যা বইয়ে দেবে। বেরোতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল, শরিফান-তার লেড়কি শরিফান কোথায়? কাসিম চিৎকার করে উঠল, শরিফান–শরিফান-
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। শরিফান হয়তো ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে। ভেতরের বারান্দায় যাওয়ার দরজায় মুখ রেখে কাসিম ফিসফিস করে ডাকল, শরিফান -বেটি আমি এসে গেছি।
যেন নির্জন কোন গুহায় এসে সে ঢুকেছে, এমনই নীরবতা। দরজা ঠেলে বারান্দায় পা রাখতেই কাসিম স্থির হয়ে গেল। একটু দূরেই পড়ে আছে শরিফানের সম্পূর্ণ নগ্ন মৃতদেহ। যেন এইমাত্র একটা গোলাপকে ছিঁড়ে কুটি-কুটি করে ফেলা হয়েছে। কাসিমের ভেতর থেকে একটা বিস্ফোরণ বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু ঠোঁট চিপে সে দাঁড়িয়েছিল। তারপর দুহাতে মুখ চেপেসে আর্তনাদ করে ওঠে, শরিফান-বেটি আমার। অন্ধের মতো সে হাতড়ে হাতড়ে সে কিছু কাপড় জোগাড় করে আনে, ছড়িয়ে দেয় শরিফানের ওপর। তারপর আর ফিরে তাকায় নি। স্ত্রীর মৃতদেহের সামনেও আর দাঁড়ায়নি। হয়তো শরিফানের নগ্ন শরীরটাই সে শুধু দেখতে পাচ্ছিল। কুঠার নিয়ে কাসিম বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।
আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা লাভার মতো সে দৌড়তে লাগল। চওকের কাছে এসে এক শিখকে দেখতে পেয়েই কাসিম কুঠার চালাল। ঝড়ে শিকড়-উপড়োনো গাছের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটি। কুঠার ঘোরাতে ঘোরাতে কাসিম এগিয়ে চলল। কাসিমের কুঠারের আঘাতে পর পর আরও তিনটি মৃতদেহ রাস্তায় ছড়িয়ে থাকল। শুধু নগ্ন শরিফানকেই দেখতে পাচ্ছিল; তার ভেতরের বারুদের স্তূপ তখন সশব্দে জ্বলছে। একের পর এক জনশূন্য বাজার পেরিয়ে সে একটা গলিতে এসে ঢুকল। কিন্তু সেখানে শুধুই মুসলমানদের বাড়ি। অন্য পথ ধরল সে। তার মুখে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে খিস্তির ফোয়ারা আর হাতে ঝলসাচ্ছে রক্তমাখা কুঠার।
একটা বাড়ির দরজায় হিন্দিতে নাম লেখা দেখে কাসিম দাঁড়িয়ে পড়ল। কুঠার দিয়ে সে দড়জায় আঘাত করতে শুরু করল। দরজা ভেঙে পড়ল। কাসিম ভেতরে ঢুকেই খিস্তি দিতে দিতে বলতে লাগল, ভেতরে যারা আছিস, বেরিয়ে আয় বেজন্মার বাচ্চারা।
ভেতরের দরজা ঠেলে খুলতেই কাসিমের মুখোমুখি একটা মেয়ে, শরিফানেরই বয়সি, নিষ্পাপ, সবুজ। কাসিম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কে তুই?
-বিমলা। মেয়েটার কণ্ঠস্বরে কচি পাতার কাঁপুনি।
-শালি হিন্দুর বাচ্চা—
কাসিম কিছুক্ষণ স্থির চোখে পনেরো-ষোলো বছরের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর হাতের কুঠার নামিয়ে রেখে মেয়েটাকে দুহাতে চেপে ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল। পাগলের মতো মেয়েটার জামাকাপড় ছিড়তে সুরু করল। সময় তখন স্থির হয়ে গেছে, মির্জাসাব। কাসিম মেয়েটাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে গলা টিপে মারল। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। একেবারে শরিফান-শরিফানই শুইয়ে আছে। কাসিম দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল। শরীরের ভেতরে এতক্ষণ আগুন জ্বলছিল, এখন শুধুই বরফ। আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভা ঠাণ্ডা পাথর হয়ে গেছে। নড়বার মতো ক্ষমতা ছিল না কাসিমের।
কিছুক্ষণ পরে একটা লোক তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে এসে ঢুকল। সে দেখল। অন্য একটা লোক চোখ বন্ধ করে মেঝেয় পড়ে থাকা কোনও কিছুর ওপর কাঁপা কাঁপা হাতে কম্বল ছুঁড়ে দিচ্ছে। লোকটা চিৎকার করে উঠল, কওন হো তুম?
কাসিম চমকে উঠে ফিরে তাকাল।
কাসিম! এখানে কী করছ?
কাসিম কাঁপতে কাঁপতে মেঝেয় পড়ে থাকা কম্বলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে ডুকরে উঠল, শরিফান
যারা হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে কত লোক এভাবেই যে পাগল হয়ে গেছে। এরা তো কেউ হত্যাকারী নয়, মির্জাসাব। তাই ঠাণ্ডা মাথায় এত বড় পাপকে সারাজীবন বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ সব তো পারে রাজনীতির মানুষরা, ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই যারা আর কখনও ভালবাসেনি, তারা প্রিয়জনের রক্তও তো হাত থেকে মুছে ফেলতে পারে। কিন্তু। কাসিমের মতো মানুষের কাছে শরিফান, বিমলা – সবাই একাকার হয়ে যায়। শুধু তো নিজের ঘর, দেশ থেকে নয়, মানুষ এভাবে সম্পর্ক থেকেও উৎখাত হয়ে যায়, সে তখন মহাকাশ থেকে ছিটকে পড়া একটা উল্কা খণ্ড। এতটাই পরিত্যক্ত যে নিজের কাছেও তার আশ্রয় নেই। মানুষ মেরেছি আমি-তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে। আমিই তো একটা বধ্যভূমি হয়ে বেঁচে
আছি। আমার স্মৃতির বধ্যভূমিতেই তো ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই মা, মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যায় সে, তারপর একদিন মরে পড়ে থাকে রাস্তায়। আমি তখন পাকিস্থানে মির্জাসাব। তখনও। মুসলমানরা ওপার থেকে এপারে আসছে; হিন্দুরা পাকিস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু শিবিরগুলি যেন গরু-ছাগলের খোঁয়াড়। খাবার নেই, চিকিৎসা নেই। মানুষ পোকার মতো মরছে। এপারে-ওপারে যেসব নারী ও শিশু পালিয়ে গিয়েছিল, আসলে অপহরণ করা হয়েছিল, তাদের উদ্ধার করার কাজ চলছে। কত মানুষ যে স্বেচ্ছায় সে-কাজে যোগ দিয়েছিল। দেখে মনে আশা জাগত। সব তা হলে শেষ হয়ে যায়নি। খোদা নিশ্চয়ই মানুষকে একাবারে নষ্ট হয়ে যেতে দেবেন না। স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে কত ঘটনাই না শুনতাম। একজন বলেছিল, সাহারানপুরের দুটি মেয়ে নাকি আর মা-বাবার কাছে ফিরতে চায় না। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে কত যে মেয়ে লজ্জায়-ঘৃণায় আত্মহত্যা করেছিল। অত্যাচারিত হতে হতে নেশায় ডুবে গিয়েছিল অনেকে, তেষ্টা পেলে জলের বদলে মদ চাইত, না দিলে তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসত খিস্তির স্রোত।
মির্জাসাব, এইসব অপহৃত মেয়ের কথা ভাবলে আমি শুধু তাদের ফুলে-ওঠা পেট দেখতে পেতাম। পেটগুলোর ভেতরে যারা আছে, তাদের কী হবে? কে নেবে ওদের? ভারত না পাকিস্থান? আর দশ মাস ধরে বহন করার দাম কোন দেশ দেবে? নাকি এর কোনও মূল্য নেই? সবটাই আমরা প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেব?
ওপার থেকে হারিয়ে যাওয়া মুসলমান মেয়েরা এপারে আসছিল; এপারের ঠিকানাহীন হিন্দু মেয়েরা ওপারে চলে যাচ্ছিল। ওদের সরকারি ভাবে বলা হল পলাতক। কিন্তু আসলে তো কেউ পালায়নি। তাদের অপহরণ করা হয়েছিল, উপযুপরি ধর্ষণ করা হয়েছিল; কেউ পাথর হয়ে গিয়েছে, কেউ উন্মাদ, কেউ তার অতীতকেই মুছে ফেলেছে।
সে-ই মায়ের কাহিনীটা আমাকে একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেছিল।
-সীমান্তের ওপারে তো আমাদের বহুবার যেতে হয়েছে, মান্টোসাব। প্রত্যেকবার একজন। মুসলিম বৃদ্ধাকে দেখেছি। প্রথমবার জলন্ধরে। পরনে ছেঁড়া কাপড়, মাথার চুল ভর্তি ধুলো ময়লা, সবসময় কাউকে খুঁজে চলেছেন।
-কাকে?
-ওর মেয়েকে। বৃদ্ধার ঘর ছিল পাতিয়ালায়। দাঙ্গায় ওঁর একমাত্র মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটিকে খোঁজার অনেক চেষ্টা হয়েছিল, পাওয়া যায়নি। হয়তো খুনই হয়ে গিয়েছিল। বৃদ্ধাকে সে-কথা বললেও কিছুতেই মানতেন না। দ্বিতীয়বার তাঁকে দেখেছিলাম সাহারানপুরে। তখন ওঁর চেহারা আরও খারাপ, আরও নোংরা। চুলে জটা ধরে গেছে। অনেকবার কথা বলে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, মেয়েকে খোজার চেষ্টা ছেড়ে দিন। ওকে মেরে ফেলেছে। বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বললেন, মেরে ফেলেছে?…না কিছুতেই না। ওকে কেউ মারতে পারে না। আমার মেয়েকে কেউ মারতেই পারবে না।
-তারপর?
-তৃতীয়বার যখন তাঁকে দেখলাম, তখন বৃদ্ধার শরীরে একফালি ন্যাকড়া, প্রায় নগ্ন। আমি কাপড় কিনে দিতে চাইলেও নিলেন না। আমি আবার তাঁকে বোঝালাম, আমাকে বিশ্বাস করুন। আপনার মেয়ে পাতিয়ালাতেই খুন হয়ে গেছে। বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বললেন, কেন মিথ্যে বলছ?
-মিথ্যে নয়। মেয়ের জন্য আপনি তো অনেক চোখের জল ফেলেছেন। চলুন আপনাকে পাকিস্থানে নিয়ে যাব।
-না-না-আমার মেয়েকে কেউ মারতেই পারে না।
-কেন?
বৃদ্ধার কণ্ঠস্বরে যেন শিশির ছড়িয়ে পড়ল।-ও কী সুন্দর ছিল, জানো না! এত সুন্দর-ওকে কেউ মারবেই না। চড় মারতে গেলেও হাত উঠবে না।
-আশ্চর্য।
-আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম মান্টোসাব। এত মার খাওয়া মানুষও বিশ্বাস করতে পারে, সুন্দরকে কেউ হত্যা করবে না।
-মার খাওয়া মানুষই তো পারে, ভাই। মার খেতে খেতে তার শেষ অবলম্বন তো সামান্য একটু সৌন্দর্য। তারপর কী হল?
-সীমান্তের ওপারে যতবার গেছি, বৃদ্ধাকে দেখেছি। দিনে দিনে তাকে প্রায় কঙ্কাল হয়ে যেতে দেখেছি। একসময় চোখেও খুব কম দেখতেন, তবু সবসময় খুঁজে চলেছেন। যত দিন গেছে, ততই তাঁর আশা দৃঢ় হয়েছে, তার মেয়েকে কেউ মারতে পারে না। একদিন তিনি মেয়েকে খুঁজে পাবেনই।
-আশাকে তাই হালাল করে জবাই করতে হয়। আমি হেসে বলি।
-একজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবক আমাকে বলেছিল, ওঁকে বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই, একেবারে পাগল হয়ে গেছেন। তার চেয়ে পাকিস্থানে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে ঢুকিয়ে দেওয়াই ভাল। আমি তা চাইনি, মান্টোসাব।
-কেন?
-মেয়েকে ফিরে পাবেন, এই আশাতেই তো বেঁচে ছিলেন তিনি। এই বিরাট পাগলাগারদে তিনি অন্তত নিজের মতো করে ঘুরে-ফিরে মেয়েকে খুঁজে চলেছেন। কিন্তু একটা কুঠুরিতে আটকে ফেললে, উনি তো আর বাঁচবেনই না। শেষবার ওঁকে অমৃতসরে দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, মান্টোসাব। তখন ভেবেছিলাম, এবার ওঁকে সত্যিই পাকিস্থানে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে ভরে দেব।
-তোমার বিবেকের কামড়ানিটা তা হলে কমত, কি বলো?
-হয়তো।
-তারপর বলো।
-ফরিদ চকে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রায় দৃষ্টিহীন চোখে চারপাশে তাকাচ্ছেন আর খুঁজছেন। আমি তখন একজনের সঙ্গে অপহৃত একটা মেয়ের ব্যাপারে কথা বলছিলাম। মেয়েটা সাবিনিয়া বাজারে এক হিন্দু বানিয়ার সঙ্গে থাকত। এমন সময় দোপাট্টায় মুখ ঢেকে একটি মেয়ে এক পাঞ্জাবি যুবকের হাত ধরে সেই পথে হাজির। বৃদ্ধার সামনে এসেই পাঞ্জাবি যুবকটি দুপা পিছিয়ে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে টানল। মেয়েটির মুখ থেকে হঠাৎ দোপাট্টার আড়াল সরে গিয়েছে আর ঝলসে উঠল তার গোলাপি মুখ। মান্টোসাব, সেই মুখের সৌন্দর্য আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না।
-জানি।
-মানে?
-আমরা সেই ভাষা ভুলে গেছি, ভাই। তারপর বলো।
-আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, পাঞ্জাবি যুবকটি মেয়েটিকে বলল, ওটাই তোমার আম্মিজান। মেয়েটা একবার ফিরে তাকাল বৃদ্ধার দিকে, তারপর যুবকটিকে বলল, তাড়াতাড়ি চলো। আর তখনই বৃদ্ধা চিল্কার করে উঠলেন, ভাগভরী! ভাগভরী! আমি তার হাত চেপে ধরে বললাম, কী হয়েছে?
-আমি ওকে দেখেছি, বেটা।
-কাকে?
-ভাগভরী- আমার বেটি। ওই তো চলে গেল।
-ভাগভরী কবেই মারা গেছে আম্মিজান। বিশ্বাস করুন, আপনার বেটি আর বেঁচে নেই। বৃদ্ধা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর চওকের রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন। নাড়ি টিপে দেখলাম, তিনি মারা গেছেন।
-খোদা কখনও তাঁর এতিম কে দয়া করবেন না, তা কখনও হয়?
-দয়া? এই-ই খোদার দয়া?
-মৃত্যুই তার সেরা দান, ভাই।
দাঙ্গার দিঙ্গুলিতে যে-মৃত্যু আমাদের কাছে এসেছিল, তা তো খোদার দান নয়, ভাইজানেরা। তাদের জন্য জানাজা হয় নি; শুনতে পাবেন, এখনও তাদের অতৃপ্ত আত্মারা ডানা ঝাপটায় তাদের হাত-পায়ের শিকলের ঝনঝন শোনা যায়-এখনও কাসিম পুরনো দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, চিৎকার করে ডাকে, শরিফান-শরিফান—
বম্বের জে জে হসপিটালের সামনের ফুটপাতে সহায়-এর মৃত্যুযন্ত্রণার স্বর এখনও চাপা পড়ে আছে, আমি জানি। ফরিস্তারা হয়তো সহায়-এর মতো মানুষ হয়েই এই দুনিয়াতে আসেন। সহায় দালাল-হ্যাঁ, বেশ্যাদের দালাল। কিন্তু তার মতো নিষ্ঠাবান হিন্দু আমি দেখিনি, ভাইজানেরা। সহায়-এর বাড়ি ছিল বেনারসে। এমন নিখুঁত মানুষ খুব কম দেখা যায়। একটা ছোট্ট ঘরে বসে সে ব্যবসা চালাত, কিন্তু পরিচ্ছন্নতার অভাব ছিল না কোথাও। সহায়-এর মেয়েদের খদ্দেরদের জন্য বিছানা ছিল না; মাদুরের ওপর চাদর পাতা আর বালিশ। চাদরে কখনও নোংরা লেগে থাকতে দেখিনি। একজন চাকর ছিল, তবু সহায় নিজেই দেখেশুনে সব পরিস্কার রাখত। আমি জানি, মির্জাসাব, ও কখনও কাউকে মিথ্যে কথা বলেনি, কাউকে ঠকায় নি। একবার আমাকে বলেছিল। মান্টোসাব, তিন বছরে আমি কুড়ি হাজার টাকা রোজগার করেছি।
-কী করে?
-মেয়েরা তো দশ টাকা করে পায়। আমার কমিশন আড়াই টাকা।
-তাহলে তো অনেক টাকা জমিয়েছ।
-আর দশ হাজার টাকা হলেই আমি কাশীতে চলে যাব।
-সে কী? কেন?
-একটা কাপড়ের দোকান খুলব। এই ধান্দাতে আর থাকব না।
কাপড়ের দোকান কেন? অন্য ব্যবসাও তো করতে পার। সহায় কিছু বলেনি। সে নিজেই যেন জানত না, কেন কাপড়ের দোকান খুলতে চায়। মাঝে মাঝে সহায়ের কথা। শুনে মনে হত, লোকটা একটা বুজরুক, ফ্রড। কে বিশ্বাস করবে বলুন, যে মেয়েদের ও ব্যবসায় খাটায়, তাদের নিজের কন্যাসম মনে করে? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েগুলোর জন্য সহায় পোস্ট অফিসে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। দশ-বারোটা মেয়ের থাকা-খাওয়ার খরচও সে দিত। আমার হিসাব কিছুতেই মিলত না। সহায়-এর ছোট্ট কোঠায় সবাইকে নিরামিষ খেতে হত। তাই সপ্তাহে একদিন সে মেয়েদের ছুটি দিত বাইরে গিয়ে আমিষ খেয়ে আসার জন্য। একদিন আমি যেতেই সহায় খুশিতে ফেটে পড়ল, মান্টোসাব,দাতা সাহেব আমাকে দয়া করেছেন।
-মতলব?।
-ইরফান এই কোঠায় আসত, মান্টোসাব। চন্দ্রার সঙ্গে ওর খুব ভাল-ভালবাসা হয়ে গেল। তা। ওদের বিয়ে দিয়ে দিলাম। চন্দ্রা এখন লাহোরে থাকে। আজই চিঠি এসেছে, দাতা সাহেবের দরগায় আমার জন্য দোয়া করেছিল। দাতা সাহেব নাকি চন্দ্রার কথা শুনেছেন। বাকি দশ হাজারের জন্য আমাকে আর বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
এরপর সহায়-এর সঙ্গে বেশ কিছুদিন দেখে হয় নি। শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। কারফিউ চলছে, রাস্তায় লোকজন, ট্রাম-বাস নেই। একদিন সকালে আমি ভিন্ডিবাজারের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। জে জে হসপিটালের কাছে এসেই দেখলাম, একটা লোক ফুটপাথে পড়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। দাঙ্গার আরেক শিকার। হঠাৎ দেখলাম, শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাস্তায় কেউ কোথাও নেই। আমি ঝুঁকে পড়ে লোকটার দিকে তাকালাম। আরে, এ যে সহায়, রক্তের কুয়াশা ছড়িয়ে আছে তার মুখে। আমি ওর নাম ধরে ডাকতে লাগলাম। অনেকক্ষণ সাড়া না পেয়ে যখন উঠতে যাব, তখনই সহায় চোখ মেলে তাকাল।-মান্টোসাব—
আমি তাঁকে অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম। উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না সহায়-এর। কোনওমতে বলতে পারল, আমি আর বাঁচব না, মান্টোসাব।
তখন এক অদ্ভুত অবস্থা হয়েছিল, মির্জাসাব। একটা মুসলিম মহল্লায় সহায় রক্তের ভিতরে পড়ে আছে-কোনও মুসলইমই তাকে মেরেছে-আর আমিও একজন মুসলিম, তাঁর মৃত্যু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। কেউ দেখতে পেলে, আমাকে তো তার হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। একবার ভেবেছিলাম, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাব; পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, ও যদি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকেই ফাঁসিয়ে দেয়! দাঙ্গা এভাবেই আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে ওলটপালট করে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কি, আমি তখন পালিয়ে যেতে চাইছি।
সহায় আমার নাম ধরে ডাকল। আমি কিছুতেই যেতে পারলাম না। সহায় ওর জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু বার করার চেষ্টা করছিল। শেষপর্যন্ত না পেরে বলল, মান্টোসাব, আমার জামার ভেতরের পকেটে কিছু গয়না আর বারো হাজার টাকা আছে.সবগুলোই সুলতানার..আপনি তো ওকে চেনেন..ওকে ফেরত দিতে যাচ্ছিলাম..দিনকে দিন যা অবস্থা দাঁড়াচ্ছে…কে কোথায় থাকবে, কেউ তা জানে না…আপনি দয়া করে ওগুলো সুলতানাকে দিয়ে দেবেন..বলবেন, ও যেন এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়…হ্যাঁ আপনি.আপনিও কোথাও চলে যান..নইলে বাচবেন না…। সহায়-এর বাকি কথাগুলো তার রক্তের সঙ্গেই ফুটপাতে জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ওর মতো আমিও তো বম্বের রাস্তায় খুন হয়ে যেতে পারতাম। সে এক সময় ছিল, ভাইজানেরা, যখন বাঁচা আর মরার মধ্যে সত্যিই কোন পার্থক্য ছিল না। একদিন মান্টোর বন্ধুরা করাচিগামী জাহাজে তার মৃতদেহ তুলে দিয়ে এসেছিল।