৪২. আনিস গিয়েছিল দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে

আনিস গিয়েছিল দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে। সেখানে হাত-সাফাইয়ের এক জন বড়ো ওস্তাদ থাকে। ঠিকানা জানা ছিল না। ষ্টার ফার্মেসির উল্টো দিকে তার বাসা। নাম-ইনাম শেখ।

সৃষ্টার ফার্মেসি নামে কোনো ফার্মেসির সন্ধ্যান পাওয়া গেল না। ইনাম শেখের নামও কেউ শোনে নি। এতগুলি টাকা খরচ করে আসা; আনিসের ইচ্ছা করছে ডাক ছেড়ে কাঁদে। যাদের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছে, তারা ভুল খবর দেবে এটা বিশ্বাস্য নয়। ইনাম শেখ আছে নিশ্চয়ই—কেউ খোঁজ জানে না। ম্যাজিশিয়ানদের খোঁজখবর কে আর রাখবো? এককালে মুগ্ধ ও বিস্মিত হবার জন্যে মানুষ ম্যাজিক দেখত। আজকাল মানুষকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করবার আয়োজনের কোনো অভাব নেই।

আনিস হাল ছাড়ল না। রিকসাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, চায়ের দোকানের মালিক, সিনেমা হলের গেট কিপার, সবাইকে জিজ্ঞেস করে, ভাই, আপনারা একটা খোঁজ দিতে পারেন? ইনাম শেখ। ম্যাজিক দেখায়। হাত-সাফাইয়ের খেলা জানে!

উত্তরে সবাই বলে, উনার বাসা কোথায়? মানুষের নির্বুদ্ধিতায় তার গা জ্বালা করে। বাসা কোথায় জানা থাকলে সে জনে-জনে জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছে কেন? নিজেই তো উপস্থিত হত। সেখানে।

আনিস ঠিক করল, সে সব মিলিয়ে এক শ জনকে জিজ্ঞেস করবে। তারপর মাইক ভাড়া করে হারানো বিজ্ঞপ্তি দেবে-ভাইসব। ইনাম শেখ নামে এক জন ম্যাজিশিয়ানের সন্ধ্যানপ্রার্থী। বয়স পঞ্চাশ। মুখে দাড়ি আছে, রোগা, লম্বা। পরনে নীল লুঙ্গি।

আনিস অবশ্যি জানে না, ইনাম শেখের বয়স পঞ্চাশ কিনা। মুখে দাড়ি, রোগা, লম্বা এসব তার কল্পনা। দরিদ্র মানুষ এ-রকমই হয়।

শেষ পর্যন্ত মাইকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার দরকার হল না। ইনাম শেখকে পাওয়া গেল। বয়স ষাটের উপরে। দুটি চোখেই ছানি পড়েছে। চলাফেরার সামৰ্থ্য নেই। ছেলের বাড়িতে থাকে। ছেলে মোটর মেকানিক। বাসা মেয়েদের হাই স্কুলের পেছনে। দু কামরার একটা টিনের ঘর। চট দিয়ে ঘেরা বারন্দায় ইনাম শেখের জন্যে খাটিয়া পাতা। বিকট দুৰ্গন্ধ আসছে লোকটির গা থেকে। কিছুক্ষণ পরপরই সে প্রবল বেগে মাথা চুলকাচ্ছে এবং বিড়বিড় করে বলছে-শালার উকুন।

ঢাকা থেকে এক জন লোক তার কাছে হাত-সাফাইয়ের কাজ শিখতে এসেছে শুনে সে বলল, যা শালা, ভাগ।

বাড়ির ভেতর থেকে দশ-এগার বছরের একটি বালিকা বের হয়ে বলল, দাদার মাথা খারাপ। আপনে যান গিয়া। আপনেরোমারব।

আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, সবাইকে মারে নাকি?

হ, মারে। থুক দেয়। খুব বজ্জাত।

বুড়ো ছানিপড়া চোখে তাকিয়ে আছে। যেভাবে তাকিয়ে আছে, তাতে মনে হচ্ছে কিছু একটা করে বসতে পারে।

তোমার দাদা ম্যাজিক জানে?

না। খালি মানুষের শ‍ইলে খুক দেয়। খুব বজ্জাত। আফনে যান গিয়া। আপনেরে থুক দিব।

আনিস একটু সরে দাঁড়াল। এ বুড়োর কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। এত দূর এসে চলে যেতেও মন সরছে না। আনিস অনুনয়ের স্বরে বলল, চাচামিয়া, হাতের কাজ কিছু জানেন?

বুড়ো কুৎসিত একটা গাল গিয়ে আনিসের দিকে সত্যি সত্যি থুথু ফেলল। অদ্ভুত নিশানা। সেই থুথু এসে পড়ল আনিসের প্যান্টে। ছোট মেয়েটা মজা পেয়েছে খুব। হাসতে—হাসতে ভেঙে পড়ছে। হাসি থামিয়ে বলল, আপনারে কইলাম না, বুড়া খুব বজ্জাত। বিশ্বাস হইল?

তোমার নাম কী খুকি?

ময়না।

স্কুলে পড়?

না।

বুড়ো আবার থুথু দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। আনিস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চলে এল। শুধু শুধু এতগুলি টাকা নষ্ট হল। ঢাকায় ফিরে গেলেও সমস্যা হবে। যে দুটি বাচ্চাকে সে প্রাইভেট পড়ায়, তাদের মা কাটা-কাটা স্বরে কথা শোনাবেন-কোথায় ছিলেন এই ক দিন? বাচ্চাদের পরীক্ষার সময় আপনি যদি এ-রকম ড়ুব মারেন, তাহলে কীভাবে হবে? একটা কাজ কুরুদায়িত্ব নিয়ে করবেন না? আপনাকে তো রেগুলার বেতন দিচ্ছি না?

এইসব কথা অবশ্যি সে গায়ে মাখে না। কোনো কথাই আজকাল সে গায়ে মাখে না। কেউ যদি গায়ে থুথু ফেলে, তাও সে অগ্রাহ্য করতে পারে। এসব সহ্য হয়ে গেছে। তবে টুশনি দুটি চলে গেলে তার কষ্ট হবে। রাস্তায়-রাস্তায় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতে হবে।

ঢাকায় ফেরবার পথে জাপানি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আলাপ হল। ভদ্রলোকের নাম কাওয়ানা। বাসে তিনি বসেছেন আনিসের পাশে। টেকনিক্যাল টিমের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিন বছর কাটিয়ে দেশে ফিরবেন। দেশে যাবার আগে বাংলাদেশ ঘুরতে বের হয়েছেন। হাসিখুশি ধরনের মানুষ। বয়স পঞ্চাশ, কিন্তু দেখায় ত্ৰিশের মতো। ভালো বাংলা বলতে পারেন। শুধু ক্রিয়াপদগুলি একটু ওলট-পালট হয়ে যায়। আনিস এক জন ম্যাজিশিয়ান শুনে তিনি খুবই অবাক হলেন।

আপনি কি এক জন পেশাদার ম্যাজিশিয়ান?

শখের ম্যাজিশিয়ান। পেশাদার ম্যাজিশিয়ান হবার মতো সুযোগ নেই।

সুযোগ থাকলে হতেন?

হ্যাঁ, হতাম।

ম্যাজিকের ব্যাপারে আমার নিজেরও অগ্রহ। আমি দেশের একটা ম্যাজিক ক্লাবের সদস্য।

আপনি নিজে ম্যাজিক জানেন?

না, আমি জানি না, আমার দেখতে ভালো লাগে। আপনি কী ধরনের ম্যাজিক দেখান? যন্ত্রনির্ভর?

জ্বি-না। যন্ত্রপাতি কোথায় পাব? বেশির ভাগই পামিংয়ের কৌশল।

পামিং কেমন জানেন?

ভালোই জানি।

এই সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে লুকাতে পারবেন?

হ্যাঁ, পারব।

আনিস মুহূর্তের মধ্যেই সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে ফেলল। প্রথম ডান হাতে, সেখান থেকে অতি দ্রুত বা হাতে। বাঁ হাত থেকে আবার ডান হাতে। জাপানি ভদ্রলোক মুগ্ধ হয়ে দেখলেন। এতটা তিনি আশা করেন নি।

দয়া করে আরেক বার করুন।

আনিস দ্বিতীয় বার করল। বাসের অনেকেই কৌতূহলী হয়ে দেখছে। দুটি ছোট বাচ্চ উঠে এসেছে আনিসের কাছে। জাপানি ভদ্রলোক বললেন, অপূর্ব!

আমি এত চমৎকার পামিং এর আগে দেখি নি। পামিংয়ের কৌশলে সবচে ভালো খেলা আপনার কোনটি?

গোলাপ ফুলের একটি খেলা আমি দেখাই। শূন্য থেকে গোলাপ তৈরি করি। ঐটি চমৎকার খেলা।

কটি গোলাপ বের করতে পারেন?

গোটা দশেক পারি।

ভদ্রলোক আনিসের ঠিকানা রাখলেন। বললেন, আমি দেশে যাবার আগে অবশ্যই আপনার গোলাপের খেলা দেখে যাব।

ভদ্রলোক তাঁর কথা রাখলেননা, তবে কিছু দিন পর আনিস জাপান ইয়াং ম্যাজিশিয়ান সোসাইটির সম্পাদকের কাছ থেকে একটা চিঠি পেল। যার রক্তব্য হচ্ছে-তারা তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আনিসকে নিমন্ত্রণ করছে তার গোলাপের খেলা দেখানোর জন্যে। আনিসের যাওয়া-আসার খরচ এবং এক সপ্তাহ জাপানে থাকার খরচ সোসাইটি বহন করবে। আনিসের সম্মতি পেলেই তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

আনিস দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। কত আনন্দের খবর। কিন্তু এমন কষ্ট হচ্ছে কেন? সত্যি সত্যি তার চোখে পানি এসে গেছে।

পৃথিবী বড়োই রহস্যময়। সে যদি ইনাম শেখ বলে এক বুড়োর খোঁজে না যেত, তাহলে হৃদয়বান ঐ জাপানি ভদ্রলোকের সাথে তার দেখা হত না। এই যোগাযোগের পেছনে কারোর অদৃশ্য হাত সত্যি কি আছে? কেউ কি আড়ালে বসে লক্ষ করছে আমাদের? অসীম করুণাময় কেউ?

টুকটুক করে দরজায় টোকা পড়ছে। শাহানা যেমন করে টোকা দিত। আনিস বলল, কে? বীণা বলল, আমি।

আনিস দরজা খুলল। বীণার মুখ গভীর। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই সে কেঁদেছে, চোখ ফোলা-ফোলা।

কী খবর বীণা?

দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসতে দিন।

আনিস সরে দাঁড়াল। বীণা ভেতরে ঢুকল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসল। আনিস বলল, কী হয়েছে বল তো?

আপনাকে কি মা কিছু বলেছেন?

না, কিছু বলেননি।

সত্যি করে বলুন।

সত্যি বলছি।

মা কিছুই বলেন নি?

না।

আনিস ভাই, আপনি এই বাসা ছেড়ে চলে যান।

আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় যাব?

জানি না কোথায় যাবেন! মোটকথা, আপনি এখানে থাকবেন না। কাল ভোরে যেন আপনাকে আর না দেখি।

কী হয়েছে বল তো বীণা।

কিছু হয়নি। কাল ভোরে চলে যাবেন।

আমার যাবার তো কোনো জায়গা নেই।

জায়গা না-থাকলে রাস্তায় থাকবেন। ফুটপাতে ঘুমুবেন। এই শহরে হাজার হাজার লোক ফুটপাতে ঘুমায়। আপনিও ঘুমুবেন। যখন খাওয়া জুটবে না, ভিক্ষা করবেন। .

বীণা উঠে দাঁড়াল। আনিসকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। আনিস বীণার অদ্ভুত কথাবার্তায় কিছুই বুঝল না। বোঝার কথাও নয়। বীণা কখনো পরিষ্কার করে কিছু বলে না। অর্ধেক কথা বলে, অর্ধেক নিজের মধ্যে রেখে দেয়।

গত রাতে মার সঙ্গে তার বড়ো রকমের একটা ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার শুরুটা এরকম-রাতে ঘুমুতে যাবার আগে লতিফা একটা ছবি আঁচলে লুকিয়ে বীণার ঘরে ঢুকে নানান কথাবার্তা বলতে লাগলেন। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বীণা বলল, কী বলতে এসেছ বলে ফেল, আমি ঘুমুর। আঁচলে ওটা কী? কার ছবি?

লতিফা বললেন, ছেলেটার নাম ইমতিয়াজ। ইন্টানি ডাক্তার।

ইন্টার্নি ডাক্তারের ছবি আঁচলে নিয়ে ঘুরছ কেন?

কী জন্যে ঘুরছি, তুই ভালোই জানিস। এমন করে আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন? আমি তোর মা না?

মা, তুমি ছবি নিয়ে বিদেয় হও। এই ঘোড়ামুখী ছেলে আমার পছন্দ না! ছবি দেখলেই ইচ্ছা করে ব্যাটার গালে এ্যাকটা খামচি দিই।

লতিফা স্তম্ভিত। কী ধরনের কথাবার্তা বলছে মেয়ে! সামান্য ভদ্রতা, আদব-কায়দাও কি সে জানে না? অশিক্ষিত মুখ মেয়েও তো নয়। লতিফা হিসহিস করে বললেন, তোর সমস্যাটা কী, আমি জানি।

জানলে বল।

তোর গলার দড়ি বাঁধা আছে দু তলার ছাদে। ঐ দড়ি না। কাটলে তোর মুক্তি হবে না।

দাঁড়ি কেটে মুক্তি দিয়ে দাও। দেরি করছ, কেন?

তাই করব হারামজাদাকে লাথি দিয়ে বের করব।

গালাগালি করছ কেন?

গালাগালি করব না তো কী করব? কোলে নিয়ে বসে থাকব? হারামজাদ ছোটলোক। সকাল হোক, কানে ধরে বের করে দেব। ফুটপাতের ছোকরা, ফুটপাতে থাকবে। ভিক্ষা করবে।

সকাল হলে বের করে দেবো?

হ্যাঁ, দেবই তো।

বেশ, দাও।

বীণা হাই তুলল। মশারি ফেলতে-ফেলতে বলল, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার কী? এখনি বিদেয় করে দাও। অপ্রিয় কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই ভালো। তুমি মা দয়া করে এখন ওঠা। আমি এখন ঘুমুব।

লতিফ, উঠলেন। সেই রাতে তাঁর ঘুম হল না। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপতে লাগল। আনিস ছেলেটি শনিগ্রহের মতো এ বাড়িতে ঢুকেছে। বড়ো কোনো সর্বনাশ সে করবে, এটা তিনি অনুভব করছেন। যে করেই হোক একে বিদেয় করতে হবে। হাতে শ পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলা যায়-এখানে আমার কিছু অসুবিধা আছে, তুমি অন্য কোথাও যাও।

না, এ-রকম বলা ঠিক হবে না। অসুবিধা আছে বলার দরকার কী? কোনোই অসুবিধা নেই। বলতে হবে, ছাদের ঘরটা আমাদের দরকার, কাজেই তুমি কোনো মেসেটেসে গিয়ে ওঠ।

ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা গলায় বলতে হবে, যাতে সে বুঝতে পারে যে, এবার তাকে আসর ভেঙে উঠতে হবে।

লতিফা গভীর রাতে বাথরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢাললেন। কপালের দু পাশের শিরা দপদপ করছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। ঠাণ্ডা পানি ঢেলেও সে-যন্ত্রণার আরাম হল না। বসার ঘরে একা জেগে বসে রইলেন। আনিসকে কী করে অতি ভদ্রভাবে অথচ শক্ত ভাষায় বাড়ি ছাড়ার কথা বলা যায়, তাই ভাবতে লাগলেন।

তাঁকে কিছু বলতে হল না। বীণার কথাতেই কাজ হল। পরদিন সন্ধ্যাবেলা আনিস তার বিছানা ও সুটকেস গুছিয়ে বিদায় নিতে এল। লতিফাকে বলল, বীণা কোথায়, মামী?

পড়ছে।

ওকে একটু ডেকে দিন না।

পড়াশোনার মধ্যে ডাকাডাকি করলে ও খুব বিরক্ত হয়। যা বলাবার আমাকে বল, ওকে আমি বলে দেব।

আমি চলে যাচ্ছি মামী। অনেক দিন আপনাদের বিরক্ত করলাম।

লতিফা বিব্রত স্বরে বলল, না না, বিরক্ত কিসের? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছ, খুব ভালো কথা।

যদি অজান্তে কোনো অন্যায় করে থাকি, ক্ষমা করবেন। কিছু মনে রাখবেন না।

লতিফা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। অতি দ্রুত চিন্তা করেও এই ছেলেটির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাঁড় করাতে পারলেন না। মামী, আপনি কি কোনো কারণে আমার উপর অসন্তুষ্ট?

না না, অসন্তুষ্ট হব কেন?

তাহলে যাই, মামী। স্নামালিকুম।

লতিফা প্রায় জিজ্ঞেস করে ফেলছিলেন-কোথায় যাচ্ছ? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালেন। বাড়তি খাতির দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। যাক যেখানে ইচ্ছা। আবার উদয় না হলেই হল!

আনিস চলে গিয়েছে, এই খবর বীণা সহজভাবেই গ্রহণ করল। কখন গিয়েছে, যাবার সময় কী বলেছে, এইসব নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাল না। অবহেলার ভঙ্গি করে বলল, গিয়েছে, ভালো হয়েছে। আপদ বিদেয় হয়েছে। তুমি এখন এক কাজ কর তো মা, চিলেকোঠার ঘরটা আমাকে পরিষ্কার করে দাও।

লতিফা বিস্মিত হয়ে বললেন, ঐ ঘর দিয়ে তুই কী করবি?

ওখানে পড়াশোনা করব। ওটা হবে আমার রিডিং রুম, বেশ নিরিবিলি।

লতিফা আর কথা বাড়ালেন না। এই প্রসঙ্গ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করার কোনো দরকার নেই। চাপা পড়ে থাকুক। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল।

 

নীলুচিটাগাং গিয়েছিল দু দিনের জন্যে। তাকে থাকতে হল ছ দিন। অফিসের কাজকর্মে এমন এক জট তারা পাকিয়ে রেখেছে, যা খোলার কোনো রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ছত্রিশ লক্ষ টাকার হিসেবে গরমিল। এক বার অডিট হওয়ার পর দ্বিতীয় বার অন্য একটি কোম্পানিকে দিয়ে অডিট করানো হল। তারা আবার সব ঠিকঠাক পেল। কোম্পানির একটি মাইক্রোবাস হরতালের দিন পুড়ে গেছে, এমন রিপোর্ট আছে। আবার গোপন চিঠিও আছে যে, বাসটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। রং বদলে সেটা এখন চিটাগাং-নাজিরহাট লাইনে টিপ দেয়। চিঠিতে চেসিস-এর নম্বর পর্যন্ত দেয়া।

অফিসে বিভিন্ন লোকের ইন্টারভু্যু নেওয়ার সময় মনে হয় কেউ সত্যি কথা বলছে না। এটাও বিশ্বাস্য নয়-এতগুলি লোকের সবাই মিথ্যা কথা বলবে কেন?

নীলু, অস্থির হয়ে পড়ল। অফিসের এই ঝামেলা তার সহ্য হচ্ছে না। সন্ধ্যাবেলা ডাকবাংলোয় ফিরে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। চলে যাবে।-সে উপায়ও নেই। তদন্তের দায়িত্ব তার উপর ক্রমে-ক্রমে চলে আসছে। দায়িত্ব অস্বীকার করার সাহস তার নেই।

রাতে তার ভালো ঘুম হয় না। এক রাতে ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখল—উলের কাঁটা নিয়ে টুনি খেলছে, হঠাৎ খোঁচা লাগল চোখে। রক্তারক্তি কাণ্ড! ডাক্তার এল এবং গম্ভীর মুখে বলল, একটা চোখে খোঁচা লাগলেও দুটি চোখেই নষ্ট। তবে চিন্তার কিছু নেই, পাথরের চোখ লাগিয়ে দেব। আসল, নকল কেউ বুঝতে পারবে না। নীলু স্বপ্নের মধ্যেই চেঁচিয়ে বলল, এসব আপনি কী বলছেন?

ডাক্তার তার দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, পাথরের চোখ আপনার পছন্দ না-হলে মার্বেল বসিয়ে দিতে পারি। মার্বেলেও খারাপ হবে না। অনেক রকমের রঙ আছে, আপনি নিজে পছন্দ করে নিতে পারেন।

ঘুম ভেঙে গেল। নীলুর গা দিয়ে টপটপ করে ঘােম পড়ছে। এ-রকম কু ৎসিত স্বপ্ন মানুষ দেখো! এ-রকম স্বপ্ন দেখার পরও কি কেউ বাসায় ফিরে না-গিয়ে থাকতে পারে? নীলুকে থাকতে হল।

ঢাকায় যেদিন রওনা হল, সেদিন তার মনে হল যেন কত দীর্ঘকাল বাইরে কাটিয়ে ফিরছে। ঢাকা পৌঁছেই দেখবে, সব বদলে গেছে। সবাইকে অচেনা-অচেনা লাগবে। টুনি সম্ভবত লজ্জা—লজ্জা মুখে পর্দার আড়ালে থাকবে। লজ্জা ভাঙতে সময় লাগবে। ইস, কতদিন যে সে মেয়েটাকে দেখে না।

কল্পনার সঙ্গে বাস্তব বোধহয় কখনোই মেলে না। নীলু, ঢাকায় পৌঁছল। বিকেলে। কিছুই বদলায় নি। সব আগের মতো আছে। টুনির হাতে একটা চকবার আইসক্রিম। আইসক্রিম তার জামা মাখামাখি হয়ে আছে। নীলু ভেবেছিল, তাকে দেখেই টুনি ছুটে আসবে, তা হল না। ঠিক সেই মুহুর্তে টুনির আইসক্রিমের একটা বড়ো অংশ ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। সে তার ভাঙা টুকরো সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কেমন আছ মা?

ভালো। তুমি আজ আসবে আমরা জানতাম।

কী ভাবে জানতে?

আবু টেলিফোন করেছিল।

তোমাদের আর সব খবর কী?

দাদীর একটা দাঁত পড়ে গেছে।

তাই নাকি?

হুঁ, দাদীকে পেত্নীর মতো লাগছে।

ছিঃ এসব বলতে নেই।

বললে কী হয়?

আল্লাহ পাপ দেন। কাছে আসমা, আমাকে একটু আদর দাও।

উঁহু, তোমার গায়ে আইস্ক্রিমের রস লেগে যাবে।

লাগুক। এস, আমাকে একটা চুমু দাও।

টুনি লজ্জিত মুখে মাকে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল, জান মা, বাবলু এখনও আসে নি।

সে কী! কেন?

কী জানি।

বাসার আর সব লোকজন কোথায়? মনে হচ্ছে তুমি ছাড়া কেউ নেই।

বুয়া আছে। দাদা দাদীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। আব্বু অফিসে। চাচাও অফিসে।

তোমাকে একা ফেলে গেছে?

একা কোথায়, বুয়া তো আছে।

নীলু গোসল করতে ঢুকল। টুনিকে বলল দরজারপাশে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে। টুনি বলল, কেন মা? নীলু হেসে বলল, অনেক দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা তো, তাই। তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে।

আমি খুব সুন্দর করে কথা বলা শিখেছি, তাই না মা?

হ্যাঁ।

বাবলু কি আমার মতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে?

না। সে তো কথাই বলে না।

ছোট চাচী কি আর আসবে না, মা?

নিশ্চয় আসবে।

বীণা খালার মা বলেছে আর আসবে না।

তাই বলেছে বুঝি?

হ্যাঁ।

গোসলের পানি কনকনে ঠাণ্ডা। তবু নীলু মাথায় মগের পর মগ ঠাণ্ডা পানি ঢালছে। বন্ধ দরজার ওপাশে টুনি দাঁড়িয়ে ছেলেমানুষি সব কথা বলছে। বড়ো ভালো লাগছে শুনতে।

তুমি আমার কথা ভেবেছিলে টুনি?

হ্যাঁ, ভেবেছি।

কেঁদেছিলে আমার জন্যে?

না।

কাঁদ নি কেন?

আমি বড়ো হয়েছি যে, তাই।

বড়োরা বুঝি কাঁদে না?

না।

বড়ো বড়ো মেয়েরা যখন বিয়ে করে বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তখন তো কাঁদে। কাঁদে না?

হ্যাঁ, কাঁদে।

তুমি কাঁদবে না?

হ্যাঁ, কাঁদব।

মনোয়ারা ফিরলেন সন্ধু্যা মেলাবার পর। নীলুকে দেখেও কিছু বললেন না। তাঁর মুখ গভীর। রাগী-রাগী চোখ। হোসেন সাহেবও কেমন যেন বিপর্যন্ত। নীলু বলল, ঝামেলায় এত দেরি হল মা। আপনারা ভালো ছিলেন তো?

তিনি জবাব না-দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। হোসেন সাহেব বললেন, আজ আর তোমার শাশুড়িকে কিছু জিজ্ঞেস করোনামা, জবাব পাবে না।

নীলু বিস্মিত হয়ে তাকাল। হোসেন সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার শাশুড়ির সামনের দুটা দাঁত ডাক্তার ফেলে দিয়েছেন। আগে পড়েছে একটা। বিশ্ৰী দেখাচ্ছে। তাকান যাচ্ছে না।

হোসেন সাহেবের মুখ করুণ হয়ে গেল। যেন তাঁর নিজেরই সামনের দুটি দাঁত নেই।

মেয়েদের সৌন্দর্যই হচ্ছে দাঁত, বুঝলে মা?

বাঁধিয়ে নিলেই হবে বাবা।

বাঁধান দাঁত কি আগের মতো হয়? তুমি ভালো ছিলে তো মা?

জ্বি, ভলোই ছিলাম।

তুমি দূরে থেকে বেঁচে গেছ, তোমার শাশুড়ি দাঁতের যন্ত্রণায় চিৎকার-চেঁচামেচি শুরে সবার মাথাখারাপ করিয়ে দিয়েছে।

শফিক এবং রফিক দু জন একই সঙ্গে এল-রাত এগারটায়। নীলুর চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে। তবু সে জেগে আছে। মনোয়ারাও জেগে। ডেনটিষ্ট যে তাঁকে কী পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে, এটা তিনি চতুৰ্থ বারের মতো বলছেন।

ব্যাটা গৰ্ধভ কিছুই জানে না। আমার মনে হয় নকল করে পাশ করেছে। অবশ্য না করেই দাঁত তুলে ফেলেছে।

বলেন কী মা!

মহা হারামজাদা। উল্টা আমাকে ধমক দেয়।

সে কি!

হ্যাঁ, বলে কি-আপনি শুধু-শুধু এত হৈচৈ করছেন কেন?

খুব অন্যায়!

আপনি শুয়ে পড়ুন মা। দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন।

মনোয়ারা ঘুমুতে যেতে রাজি নন। তিনি আজকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তাঁর দুই ছেলেকে না-শুনিয়ে ঘুমুতে যেতে রাজি নন। সেই সুযোগ তাঁর হল না। রফিক ঘরে ঢুকেই বলল, বাহ্মা, তোমাকে তো সুন্দর লাগছে! কেমন যেন ড্রাকুলার মতো দেখাচ্ছে।

মনোয়ারা কিছুক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। রফিক বলল, ভাবী, তাড়াতাড়ি ভাত দাও। খিদে লেগেছে।

এত দিন পর এলাম, প্রথম কথাটাই এই? কেমন ছিলাম, কী, জিজ্ঞেস করা। সাধারণ ভদ্রতাটা দেখাও।

কেমন ছিলে ভাবী?

প্রশ্ন করে রফিক উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না। বাথরুমে ঢুকে গেল।

রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে শফিক তার অভ্যাসমতো এক কাপ চা খেতে চাইল বলল, তোমার যাবার দরকার নেই। কাজের মেয়েটাকে বল ও দেবে।

আমিই বানিয়ে আনি।

নীলু রাতে শোবার আগে কখনো চা খায় না। আজ সে নিজের জন্যেও এক কাপ বানাল। শফিককে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে—দিতে বলল, তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?

রাগ করব কেন?

দু দিনের কথা বলে ছ দিন কাটিয়ে এলাম, এই জন্যে।

প্রয়োজন হয়েছে থেকেছ, এই নিয়ে রাগ করব কেন? তোমার কথা শুনে মনে হয়, আমার স্বভাব হচ্ছে অকারণে রাগ করা। আমি কি সে রকম?

না।

শফিক হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল, এক বার ভাবছিলাম তোমাকে কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ টুনিকে নিয়ে চিটাগাং উপস্থিত হব। দেখব। তুমি কী কর।

এলে না কেন? তোমরা এলে আমার কত ভালো লাগত।

বলতে-বলতে কী যে হল, নীলু ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। শফিক অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?

কী যে ব্যাপার, তা কি নীলু নিজেও জানে? আমরা আমাদের কতটুকুই-বা জানি?

শফিক আবার বলল, কী হয়েছে নীলু? তার গলার স্বর আশ্চর্য কোমল শোনাল। নীলু বলল, কিছু হয় নি, এস ঘুমুতে যাই।

বিছানার মাঝামাঝি টুনি শুয়ে আছে। নীলু নিজেই তাকে এক পাশে সরিয়ে দিল। সরিয়ে দিতে গিয়ে লক্ষ করল, টুনির বা চোখের নিচে ছোট একটা কালো বিন্দু উঁচু হয়ে আছে। নীলু বলল, ওর এখানে কী হয়েছে?

উলের কাঁটা দিয়ে খোঁচা লাগিয়েছে। আরেকটু হলে চোখে লাগত।

নীলুর গা দিয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। সে তার মেয়ের কপালে হাত রাখল। গা কেমন যেন গরম-গরম লাগছে। নীলু বলল, দেখ তো, ওর শরীরটা কি গরম?

শফিক গা করল না। সহজ স্বরে বলল, এই ঠাণ্ডায় পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে ঘুরে জ্বরজারি হয়েছে আর কি। বাচ্চাদের মাঝে-মাঝে অসুখবিসুখ হওয়া ভালো-এতে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়।

কে বলেছে তোমাকে?

কেউ বলেনি। কোথায় যেন পড়েছি।

এস, ঘুমুতে এস। নীলু আবার মেয়ের কপালে হাত রাখল। গা গরম। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাচ্চাদের জ্বরজারি সব সময়ই হয়। কত বার এমন হয়েছে, কিন্তু আজ নীলুর এ-রকম লাগছে কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *