আগরতলা থেকে প্লেনে চাপলো সিরাজুল। এর আগে আকাশ দিয়ে সে প্লেন উড়তেই দেখেছে শুধু, সে যে কখনো আকাশপথের যাত্রী হবে, তা যেন স্বপ্নেও ভাবেনি। তার ধারণা ছিল প্লেনে বুঝি শুধু সুট-টাই পরা বড়লোকরাই যাওয়া-আসা করে, কিন্তু আগরতলার এই প্লোনের অনেক যাত্রীরই চেহারা ও পোশাক গ্রামে-গঞ্জে দেখা মানুষের মতন। কেউ কেউ সঙ্গে এনেছে চটের থলে, তার থেকে উপছে বেরিয়ে আসছে লাউ-কাঁঠাল। অনেকদিন পর সিরাজুল নিজেই পরেছে পরিষ্কার নতুন জামা-কাপড়, পায়ে কেডস। তাকে দু’ সেট এই পোশাক কিনে দেওয়া হয়েছে।
আকাশ আজ পরিষ্কার, বিমানের জানলা দিয়ে নীচের অনেক কিছুই দেখা যায়। প্রথম প্রথম তো ছোট ছোট বাড়ি ও মাঠের লাঙল হাতে চাষা আর গরুর পালও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, একটু পরে বন-জঙ্গল ও পাহাড়, তারপর একটা নদীতে পাল তুলে নৌকো যাচ্ছে। মোচার খোলার মতন ছোট্ট দেখাচ্ছে নৌকোগুলোকে, তবু ঐ নদীর দৃশ্য দেখে সিরাজুলের বুকটা মুচড়ে উঠলো। এটা কি তার খুব চেনা মেঘনা নদী? ইন্ডিয়ার প্লেন কি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যায়?
তার পাশ থেকে মতিনও গলা বাড়িয়ে জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, তাকে সিরাজুল জিজ্ঞেস করলো, এইডা কোন নদী রে?
মতিনও বলতে পারে না। আকাশ থেকে দেখা ভূ-চিত্র সম্পর্কে তারও কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
ওদের সামনের সীটে বসেছে নির্মল আর জাহাঙ্গীর। এই চারজন এসেছে কাছাকাছি ক্যাম্প থেকে, পরস্পরের চেনা। এখনও ওরা কেউই জানে না যে ওদের গন্তব্য কোথায়।
দুটি সুন্দরী এয়ার হস্টেস দু’পাশ দিয়ে খাবারের প্যাকেট আর চা দিয়ে গেল। প্যাকেটের মধ্যে রয়েছে দুটি স্যান্ডুইচ, একটি চপ ও একটি মিষ্টি। সিরাজুল মতিনের দিকে তাকালো, দু’জনে নিঃশব্দে একই কথা বলতে চাইছে। একদিন আগেও ওরা ছিল ক্যাম্পে, সেখানে মানুষের ভিড়ে একেবারে গাদাগাদি, প্রবল বৃষ্টিতে চারপাশে থিকথিকে কাদা আর ব্লিচিং পাউডারের কটু গন্ধ, দু বেলা খিচুড়ি খেতে খেতে জিভে আর কোনো স্বাদ ছিল না। আর এখন তারা এরোপ্লেনের মধ্যে বাৰু সেজে স্যান্ডুইচ খাচ্ছে। ঠিক যেন সিনেমার মতন।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল দমদম বিমানবন্দরে।
এই তা হলে কলকাতা! সিরাজুলের এক মামু একসময় কলকাতায় চাকরি করেছে, পাটিশানের আগে, সেই মামুর কাছ থেকে সে কলকাতা সম্পর্কে অনেক লম্বা-চওড়া গল্প শুনেছে। কলকাতার রাস্তায় নাকি মানুষ হারিয়ে যায়। সারা রাত দোকান খোলা থাকে, পয়সা। দিলে বাঘের দুধও মেলে। ছেলেবেলায় শোনা সেই গল্পের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে শোনা অনেক খবর মিলে যায়। কলকাতায় রয়েছেন তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সবাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী। কলকাতার নকশাল ছেলেরা যখন-তখন পুলিশ খুন করে, রাস্তায় যে-কোনো সময়ে বোমা ফাটে, আবার তারই মধ্যে অনেক গান-বাজনার অনুষ্ঠান হয়। সিরাজুলের প্রিয় গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসকে স্বচক্ষে দেখা যায় বহু ফাংশানে।
সিরাজুলের বুক উত্তেজনায় ধক ধক করতে লাগলো। সে যেন কল্পনায় দেখতে পেল, কর্নেল ওসমানী তার কাঁধ চাপড়ে বলছেন, তোমার কথা অনেক শুনেছি, তোমাকে এবার আরও বড় দায়িত্ব নিতে হবে।
সিরাজুলদের তোলা হলো একটা ছাউনি দেওয়া আর্মি ট্রাকে। সেখানে তার মতন আরও পঁচিশ-তিরিশজন যুবক। এরকম পর পর চারটি ট্রাক, সেই ট্রাকের কনভয়টি বিমানবন্দর ছেড়ে ঘুরে গেল ডান দিকে। কলকাতা দেখার জন্য সিরাজুল আর মতিন উৎসুকভাবে চেয়ে রইলো বাইরের দিকে, কিন্তু খানিকক্ষণ যাবার পরই মনে হলো তারা তো শহরে যাচ্ছে না, ক্রমশই রাস্তার দু’ধারে গ্রামের মতন দৃশ্য চোখে পড়ছে। কেন যেন সিরাজুলের ধারণা ছিল যে তাদের দেশের তুলনায় পশ্চিমবাংলা অনেক শুকনো, খটখটে। কিন্তু এখানকার গ্রামের সঙ্গে তো তাদের গ্রামের কোনো তফাত দেখা যাচ্ছে না। একই রকম ধানের ক্ষেত, মাটির বাড়ি, গরুর গাড়ি, রাস্তার দু’ধারে খাল, মাঝে মাঝে নদীর ওপরের ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছে তাদের গাড়ি, রাস্তা। দিয়ে পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেলে যে-সব মানুষজন যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেককেই মুসলমান বলে চেনা যায়। চোখ পড়ে মসজিদ-মাজার।
তবু তফাত একটা আছে ঠিকই। এখানে যুদ্ধের করাল ছায়া নেই। রাস্তা দিয়ে যে এতগুলো। আর্মি ট্রাক যাচ্ছে, সেদিকে কেউ মুখ তুলে তাকাচ্ছে না।
সিরাজুলদের যে ইন্ডিয়ার মধ্যে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, সে সম্পর্কে তাদের সেকটর কমান্ডারও কিছু বলেননি। তাদের শুধু জানানো হয়েছিল যে ক্যাম্প ‘সি-২ পি’-তে তাদের পাঠানো হচ্ছে একটা বিশেষ ট্রেইনিং-এর জন্য।
প্রায় বিকেলের দিকে ট্রাকগুলি বড় রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে এসে আরও বেশ কিছুটা দূর যাবার পর একটা গাছপালা ঘেরা জায়গায় থামলো। এখানে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটি তাঁবু খাটানো রয়েছে, রাইফেলধারী সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে গেটে।
প্রথমে সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে একজন পাঞ্জাবী অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানিয়ে বললেন, আজ কোনো কাজ নেই, আজ যার যার থাকার জায়গা বুঝে নিয়ে তারপর বিশ্রাম। এখানে ভলিবল খেলার ব্যবস্থা আছে, যার ইচ্ছে সে খেলাতেও অংশ নিতে পারে। সন্ধের পর ক্যান্টিনে সিনেমা দেখানো হয়। কাল ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে ট্রেনিং শুরু হবে। শিক্ষার্থীদের প্রতি একটাই অনুরোধ, তারা যেন কোনোক্রমেই কখনো বিনা অনুমতিতে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে না যায়।
সিরাজুলেরা চারজনে একটাই তাঁবু পেয়ে গেল। জাহাঙ্গীর উত্তেজিত ভাবে বললো, তোরা জানোস, এই অঞ্চলটার নাম পলাশী। আমি রোড সাইন দেখছি!
মতিন বললো, কোন পলাশী? আমরা ইতিহাসে যে পলাশীর নাম পড়ছি?
জাহাঙ্গীর বললো, আর কোন পলাশী হবে? এইডা একটা হিস্টোরিক্যাল সাইট! বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ ধারেকাছেই হবে মনে লয়।
নির্মল বললো, আসার পথে অনেকগুলা আমগাছ দ্যাখলাম। তাইলে এইডাই বোধ করি সেই পলাশীর আম্রকানন। চল, একটু ঘুইরা ঘাইরা ক্যাম্পাসটা দেখি!
বিছানা-টিছানা সাজিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো। এখানের আর্মি ক্যাম্পটি নতুন মনে হয়, সবকিছুই পরিষ্কার, ঝকঝকে। একপাশে গোটা বারো আরমারড় কার, সেগুলির লম্বা লম্বা কামানের নল দেখলে মনে হয়, এখনো একবারও ব্যবহার করা হয়নি। ওরা সেগুলোর খুব। কাছে গেলেও কেউ বাধা দিল না। একদিকে অফিসার্স কোয়াটার, সেখানে খাঁকি হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে ভলিবল খেলছে কয়েকজন অবাঙালী জওয়ান। ওদের দেখে দাড়ি ও মাথার চুলে গিট বাঁধা একজন সদারজী জিজ্ঞেস করলো, আও, খেলা গে?
সিরাজুলরা কেউ তখনই খেলতে চাইলো না, তারা জানালো, তারা শুধু দেখতে এসেছে।
ঘুরতে ঘুরতে ওরা এলো ক্যান্টিনে। এটা একটা লম্বা হলঘরের মতন, ওপরে টালির চাল। একদিকের দেয়ালে সিনেমা দেখবার স্ক্রিন, তার কাছেই টেবিল টেনিস-এর বোর্ড। এখানে সিগারেট, চকলেট, সাবান, ব্লেড ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। আগরতলায় প্লেনে ওঠার আগে। সিরাজুলদের প্রত্যেককে দু শো করে ভারতীয় টাকা দেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে দেখা গেল সেগুলোর দাম খুবই শস্তা। জাহাঙ্গীর পাঁচ টাকা দিয়ে দশখানা চকলেটবার কিনে ফেললো, তার একটা মুখে দিয়ে ফ্যাকাসে ভাবে হেসে বললো, জীবনে আর কোনোদিন যে চকলেট খামু, তা ভাবি নাই! তোগো মনে হয় নাই যে ক্যাম্পের খিচুড়ি কিংবা হানাদারগো বুলেট খাইয়াই একদিন প্রাণডা বাইরইয়া যাবে?
সেই ক্যান্টিনে বসে ওরা ‘ডক্টর কোটনীস কি অমর কাহানী’ নামে একটি হিন্দী সিনেমা দেখলো, ফিলমের নায়ক একজন ভারতীয় ডাক্তার, সে বিপ্লবের সময় চীনে গিয়েছিল ডাক্তার-নার্সদের একটি দল নিয়ে আহতদের সেবা করতে। খুব মহৎ ব্যাপার, নাচ-গান বিশেষ
দেখতে দেখতে সিরাজুল ফিসফিস করে নির্মলকে জিজ্ঞেস করলো, ইন্ডিয়ানগো সাথে তো চায়নার এখন শত্রুতা, তবু অরা আর্মিব্যারাকে এই সিনেমা দ্যাখায় ক্যান রে?
নির্মল বিজ্ঞের মতন বললো, এইডা অনেক পুরানো বই।
মতিন বললো, নোটিস বোর্ডে দ্যাখলাম, এই শনিবার ‘মোগল-ই-আজম’ দ্যাখাবে, সেই বইয়ের খুব নাম শুনছি।
খাওয়া দাওয়া সেরে ওদের দশটার মধ্যে শুয়ে পড়তে হলো। পাশাপাশি চারখানা নেয়ারের খাঁটিয়া। অন্ধকারের মধ্যে চারটি সিগারেটের আগুন জ্বলছে। গতকাল রাত্রেও ওরা ছিল আখাউড়া সীমান্তের এক ছোট ক্যাম্পের খড়ের শয্যায়, পাশের তাঁবু থেকে কেউ একজন হঠাৎ সাপ সাপ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। তারপর ওরা আর ভালো করে ঘুমোতেই পারেনি। আজ ওদের বিছানায় নতুন নতুন গন্ধ, তাতেও ঘুম আসতে চায় না।
এক সময় মতিন বললো, আইজ যে আরমারড় কারগুলো দ্যাখলাম, ঐগুলা দেইখ্যা আমার কী মনে হইতাছিল জানোস? ঢাকার রাস্তায় এই গাড়িগুলা দ্যাখলেই ভয়ে প্রাণ কাঁপতো। এখন গায়ে হাত বুলাইলাম। একই তো গাড়ি!
জাহাঙ্গীর বললো, এই মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্টে কোথায় জানি আমার বাবায় পোস্টমাস্টার আছিলেন। পার্টিশানের পর অপশান দিয়া ঐ ধারে চইল্যা গ্যালেন। এইখানে নাকি আমাগো বাড়িও আছিল। বাবা-মায় যে জায়গা ছাইড়া পলাইয়া গ্যালেন, আমি আবার সেহানেই আসলাম ট্রেইনিং নিতে। মজার ব্যাপার না?
সিরাজুল বললো, সিক্সটি ফাইভের ওয়ারের দিনগুলার কথা তোগো মনে আছে?
নির্মল বললো, হ, সেই সময় আমি অ্যারেস্ট হইছিলাম।
সিরাজুল বললো, সেই সিক্সটি ফাইভে এই ইন্ডিয়ান আর্মি আমাগো চোখে ছিল কী দারুণ দুশমন। আর এখন তাগো ক্যাম্পেই আমরা শুইয়া আছি। হুঁ, মজা না মজা! অবস্থা ক্যামনে বদলায়!
মতিন বললো, ইন্ডিয়ান আর্মির বড় বড় অফিসার সবই তো দেখি পাঞ্জাবী! আমাগো ঐদিকের মেজর-মুজর, ক্যাপ্টেন-ম্যাপ্টেনগুলাও পাঞ্জাবী! কে যে কখন ফ্রেন্ড আর কখন এনিমি হয়, তার ঠিক নাই!
জাহাঙ্গীর বললো, পঁয়ষট্টির সেই যুদ্ধের ফ্যাচাংয়ে আমি লাহোরে আটকা পড়ছিলাম, ইন্ডিয়ান আর্মির বোমার তা খাইয়া মইরা যাইতেই তো পারতাম তখন। আর আইজ ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাম্পে মুর্গীর মাংস আর রুটি খাইলাম। সবই কপাল!
মতিন বললো, আবার কোনদিন আমাগো ইন্ডিয়ান আর্মির এগেইনস্টেই লড়াই করতে হবে কিনা তাই-ই বা কে জানে!
নির্মল বললো, মাংসে বেশি ঝাল দিছিল, নারে? সিরাজুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরলো। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেছে মনিরার মুখখানা। কী ঝাল খেতেই না ভালোবাসতো মেয়েটা! সে বলতো, বেশ ঝাল দিলে শুধু কৰ্মী শাক দিয়েই এক থাল ভাত খাওন যায়!
পরদিন ভোর পৌনে পাঁচটায় বিউগল বাজলো। আগেই নির্দেশ দেওয়া ছিল, ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়ে সামনের মাঠে ফল ইন করতে হবে। বাইরে ভালো করে আলো। ফোটেনি, তবু ওরা বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে শুরু করে দিল হুড়োহুড়ি।
প্রথম কয়েকদিন ফিজিক্যাল ট্রেইনিং আর দৌড় করানো হলো ওদের। তারপর এক সপ্তাহ ধরে শুধু সাঁতার। ক্যাম্পের পাশেই একটা বড় পুকুর আছে, কিছুদূরে রয়েছে একটা সদ্য কাটা খাল, এই বর্ষার জলে একেবারে টইটম্বুর ভরা। ছোট ছোট দলে ভাগ করে সাঁতারের প্রতিযোগিতা হয়। একজন সুবেদার স্টপ ওয়াচ নিয়ে রেকর্ড করে, কে কতক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারে জলের তলায়। কিংবা ডুবো সাঁতারে কে কতখানি দূরে যায়।
এদিককার পানি একটু ভারি, সাঁতার কাটার পক্ষে তেমন সুবিধেজনক নয়, তবু সিরাজুল কয়েকদিনেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। ডুবসাঁতারে তার রেকর্ড কেউ ছুঁতে পারে না। গোটা ক্যাম্পের মধ্যে সিরাজুল চ্যাম্পিয়ান।
হঠাৎ একদিন মাঝ রাত্রে ওদের ঘুম থেকে তুলে এনে দশ বারোজনের একটি দলকে চাপানো হলে গাড়িতে। মিনিট পনেরো পর একটা নদীর ধারে গাড়ি থামলো। চতুর্দিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, এর মধ্যেই তাদের সাঁতরে নদী পার হতে হবে। প্রত্যেককে দেওয়া হলো এক জোড়া করে ফিন, এই ফিন পায়ে বেঁধে নিলে সাঁতারের পরিশ্রম কম হয়, শব্দও কম হয়।
পর পর কয়েকটা রাত নদীতে সাঁতার কাটার পর এক রাতে একটা চমকপ্রদ কাণ্ড হলো। সে। রাতে দেখা গেল, নদীর মাঝখানে স্থির হয়ে রয়েছে এক লঞ্চ, সেটা আলোর মালায় সাজানো। চতুর্দিকের নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে সেটাকে দেখাচ্ছে যেন স্বপ্নতরীর মতন। সেটার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
ব্রিগেডিয়ার জ্ঞান সিং প্রত্যেকের হাতে লিমপেট মাইন দিয়ে বললেন, নিঃশব্দে মাঝনদীতে সাঁতরে গিয়ে ঐ লঞ্চের গায়ে সেগুলো আটকে দিয়ে আসতে হবে। সাবধান, এটাকে খেলা মনে করো না। ঐ লঞ্চের লোকেরা যেন কিছু টের না পায়।
চারজনের ছোট দলটির নেতা নির্বাচিত হলো সিরাজুল। যাওয়া-আসা মিলিয়ে সময় ঠিক আধ ঘণ্টা।
কাজটা খুব শক্ত মনে হলো না সিরাজুলের। এই নদীর নাম ভাগীরথী, আবার স্থানীয় লোক একেই বলে গঙ্গা। স্রোতের টান বেশী নেই। সিরাজুল গায়ে তেল চাপড়াতে লাগলো। পানিতে নামার আগে তার বরাবর গায়ে সর্ষের তেল মাখা অভ্যেস।
পাঁচজনে নিঃশব্দে সাঁতরে গিয়ে লঞ্চের গায়ে লিমপেট মাইন আটকে দিল স্বচ্ছন্দে। লঞ্চের মধ্যে খুব খানাপিনা নাচ গান হচ্ছে মনে হয়, কেউ ওদের দেখতে পায়নি। কাজ সেরে ওরা ফিরতে শুরু করার দু’তিন মিনিট পরেই অকস্মাৎ যেন বজ গর্জন শুরু হয়ে গেল। এই আওয়াজ সিরাজুলের খুব চেনা। মেশিনগানের ফায়ারিং হচ্ছে। লঞ্চ থেকে জোরালো আলোও এসে পড়লো তাদের দিকে। ডেকের ওপর ছোটাছুটি করছে অনেক মানুষের ছায়া।
সিরাজুল প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল। কী ব্যাপার, এটা কি পাকিস্তানী জাহাজ? আজ রাতে সত্যিকারের কোনো অপারেশান? তাদের কিছুই বলা হয় নি! এখন প্রাণে বাঁচার একমাত্র উপায় ডুবসাঁতার।
একবার মাথা তুলতেই সিরাজুল মতিনের কাতর গলা শুনতে পেল, উঃ মইলাম রে, মইলাম!
কাছেই আর একটা মাথা দেখে সিরাজুল বললো, নির্মল, ওরে ধর! মাথা ডুবাইয়া থাক।
অতি কষ্টে ওরা পাড়ে এসে পৌঁছে আরও অবাক হলো। সুবেদার জ্ঞান সিং নেই, গাড়ি নেই, কেউ নেই। ওদের কি মৃত ভেবে অন্যরা চলে গেছে? জাহাঙ্গীর একটু দূরে চিৎপাত হয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছে, কিন্তু তার গুলি লাগেনি, একমাত্র আহত হয়েছে মতিন। এ জায়গাটা যদি পাকিস্তানী সৈন্যদের এলাকা হয়, তাহলে এখানে বসে থাকা একটুও নিরাপদ নয়। মতিনকে বয়ে নিয়ে ওরা ছুটলো।
যে রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি এসেছিল, আন্দাজে সেই রাস্তা বুঝে বুঝে ওরা এগোতে লাগলো। হাতে কোনো অস্ত্র নেই বলেই সিরাজুল ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। শত্রুর মুখোমুখি পড়ে গেলে অন্তত একজনকেও খতম করা যাবে না?
এক সময় দেখা গেল তাদের ক্যাম্পের আলো। গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ব্রিগেডিয়ার জ্ঞান সিং, সে এগিয়ে এসে সিরাজুলকে জাপটে ধরে বললো, ব্রাভো! ব্রাভো! তুমনে কামাল কিয়া, সিরাজুল! এক্সেলেন্ট টাইমিং!
সবটাই ট্রেইনিং! গুলি থেকে আত্মরক্ষা করা, অন্ধকার রাস্তা খুঁজে ক্যাম্পে আসা, এই সবকিছুই। মতিনের আঘাত গুরুতর নয়, সে ভয় পেয়েছে বেশী। মেশিনগানের ফায়ারিং হয়েছে আকাশের দিকে, আর ওদের দিকে ছোঁড়া হয়েছে ছররা। তারই একটা লেগেছে মতিনের পায়ে। মেশিনগানের গুলি ভেবে সে এরমধ্যেই প্রায় মুমূর্য হয়ে পড়েছিল।
ব্রগেডিয়ার জ্ঞান সিং বললেন, আজ দারুণ আনন্দের রাত। এইমাত্র মেসেজ এসেছে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের ফ্রেন্ডশীপ ট্রিটি সাইনড হয়েছে। কুড়ি বৎসরের মৈত্রীচুক্তি। গ্রোমিকো দিল্লিতে এসে ঘোষণা করেছেন, পৃথিবীর যে-কোনো দেশ ভারতকে আক্রমণ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে এসে দাঁড়াবে।
অনেক রাত পর্যন্ত হৈ চৈ করে মিষ্টি খাওয়া হলো। ভাংরা নাচ নেচে দেখালো কয়েকজন জওয়ান। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলা গান গাইলো সমস্বরে।
ঠিক একমাস পাঁচ দিন পর ট্রেনিং সমাপ্ত করে সিরাজুলদের দলটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কলকাতায়। শেষের কয়েকটা দিন সিরাজুল অস্থির বোধ করছিল, এদের এখানে তার সাঁতারের ব্যাপারে আর কিছু শেখার নেই। এই ক্যাম্পে ভালো খাওয়াদাওয়া হয় বটে, কিন্তু সে রণাঙ্গনে। ফিরে যেতে চায়। মনিরার কথা মনে পড়লেই শক্ত হয়ে ওঠে তার চোয়াল।
কলকাতায় এসে হঠাৎ তারা ছুটি পেয়ে গেল। তাদের রাখা হলো বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটা ফাঁকা ফ্ল্যাটবাড়িতে, যাওয়া-আসার কোনো কড়াকড়ি নেই, ভোরে উঠেই ট্রেইনিং-এর বালাই নেই, শুধু খাও-দাও, ঘুমোও আর ইচ্ছেমতন ঘুরে বেরাও।
সিরাজুলেরা বাংলাদেশ মিশন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, নাখোদা মসজিদ, জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দেখলো, চিৎপুরের রয়াল হোটেলের বিখ্যাত চাঁপ ও রুমালি রুটির স্বাদ নিল। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করার খুব সাধ সিরাজুলের, বাংলাদেশ মিশনের একজন কর্মীকে ধরে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও ঠিক হলো দু’দিন পরে। সেই কর্মীটি বললো, আইজ ময়দানে কলকাতার সাহিত্যিক-শিল্পীদের খুব বড় মিটিং আছে, দ্যাখতে যাইবেন নাকি?.বাংলাদেশের সাপোর্টে…
সেখান দেবব্রত বিশ্বাসকে দেখতে পাওয়া যেতে পারে এই আশায় সিরাজুল যেতে রাজি হলো। সিরাজুলরা পৌঁছোবার আগেই সভা শুরু হয়ে গেছে, বক্তৃতা দিচ্ছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সে বক্তৃতার একটি অক্ষরও শোনা হলো না সিরাজুলের। বড়রাস্তা পেরিয়ে, টাটা বিল্ডিং-এর উল্টোদিকের ময়দানে সবে মাত্র পা দিয়েছে সে, এমন সময় এক নারী তাকে জিজ্ঞেস করলো, এই, তুমি সিরাজুল না?
জীবনে যেন এতটা কখনো চমকে ওঠেনি সিরাজুল। বস্তৃত কলকাতায় এসে একবারও মঞ্জুর কথা মনে পড়েনি তার। মনে পড়লে তো এসেই সে মঞ্জুর খোঁজ করতো। গত কয়েক মাসে মনিরা ছাড়া আর কোনো নারীর কথা তার চিন্তায় স্থান পায়নি। সেইজন্যে মঞ্জুই কে প্রথম দেখেছে! এখন সিরাজুলের চোখের সামনে থেকে যেন আর সবকিছু মুছে গেল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পরমা রূপবতী রমণী। শুধু রমণী নয়, সিরাজুলের চোখে দয়াবতীও, মনিরাকে মঞ্জু ছোট বোনের মতন ভালাবাসতো, তাদের দৈন-অপমানের দিনে মঞ্জু তাদের কত আপন করে নিয়েছে।
যেন কৃতজ্ঞতার শোধ দেবার জন্যই সিরাজুল প্রথমেই বললো, মঞ্জুভাবী! বাবুলভাই ভালো আছে! আপনারা কোথায় উঠেছেন! কোনো অসুবিধা নাই তো!
যেন একজন নিকট-আত্মীয়কে দেখেছে মঞ্জু, আনন্দে তার চোখে জল এসে গেল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, সিরাজুল, তুই কলকাতায় আসলি কবে? আমাদের সাথে দেখা করিস নাই!
সিরাজুল বললো, আমি তো জানি না, আপনেরা কোথায় আছেন।
মঞ্জু অভিমানের সঙ্গে বললো, বাংলাদেশ মিশনে মামুনমামাকে সকলেই চেনে। সিরাজুল, তোর সাথে ওনার দেখা হয়েছিল? উনি কোথায়?
–ভাবী, বাবুলভাই আর আমি এক ক্যাম্পে আছি। বাবুলভাই এখনে ‘ভালো আছেন, সেই যে চোট লেগেছিল, এক্কেবারে সেরে উঠেছেন।
–কিসের চোট লেগেছিল?
–ও, তাও আপনি জানেন না? জানবেনই বা ক্যামনে। সে এমন কিছু না, পায়ে গুলি লেগেছিল। এখন বাবুলভাই ফ্রিডম ফাইটার। অনেক চেইঞ্জ হয়ে গেছে মানুষটার।
–তুই একা আসছোস, সিরাজুল? মনিরা কই?
–মনিরা?
সিরাজুল উদ্ভ্রান্তের মতন তাকালো তার সঙ্গী মতিন, নির্মল, জাহাঙ্গীরের দিকে। তারা চোখের ইসারায় মঞ্জুকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু মঞ্জু বুঝলো না। সে আবার সরল ভাবে জিজ্ঞেস করলো, মনিরা আসে নাই? তারে কোথায় রেখে আসলি? স্থান-কাল ভুলে গেল সিরাজুল। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে!
তাকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে, মিটিং থেকে খানিকটা দূরে একটা বড় রেইনট্রি গাছের তলায় বসলো এই ছোট দলটি। তারপর দুঃখের কাহিনী বিনিময় হতে লাগলো। সিরাজুল আর মঞ্জু দু’জনেই কেঁদে ভাসালো বুক।
একটু পরে মজুদের উঠতে হলো, আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন মামুন। সিরাজুলদেরও সন্ধেবেলা একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বি এস এফ-এর একজন অফিসারের সঙ্গে। তাই ঠিক হলো, আগামীকাল দুপুরে সিরাজুলরা চারজনেই খেতে যাবে মঞ্জুদের কাছে, মঞ্জু বাবুল চৌধুরীর নামে চিঠি লিখে দেবে। চোখের জল মুছে ওরা চলে গেল দু দিকে।
সিরাজুলরা নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরতেই দেখলো বি এস এফ-এর অফিসার মেজর যশোবন্ত চোপরা আগে থেকেই বসে আছে। ওদের দেখেই বললো, অর্ডার এসে গেছে, প্যাক আপ ইয়োর থিংস! আজ রাতেই এয়ার ফোর্সের প্লেনে তোমাদের যেতে হবে।
সিরাজুল উত্তেজিত ভাবে বললো, আজ রাতেই যেতে হবে কেন? কোথায় যাবো? কোথায় যাবো?
মেজর চোপরা বললো, নো কোয়েশ্চেন! অর্ডার এসেছে যেতে হবে! ব্রিগেডিয়ার জ্ঞান সিং যেরকম হাসিহাসি মানুষ, মেজর চোপরা সেরকম নয়। তার নাকের নীচে মস্ত বড় মোচ, ঠোঁটের ভঙ্গিতে উৎকট গাম্ভীর্য।
সিরাজুলরা আরও একটা দিন কলকাতায় থেকে যাবার জন্য সময় চাইলেও সে সেই অনুরোধে কর্ণপাতও করলো না। তখন সিরাজুল প্রায় বিদ্রোহ করে বলে উঠলো, বাংলাদেশ সরকার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর কোনো কমাণ্ডারের নির্দেশ না পেলে সে মেজর চোপরার আদেশ মানতে বাধ্য নয়।
মেজর চোপরা এবার সামান্য একটু হাসলো। তারপর বললো, শোনো, অপারেশন জ্যাকপট শুরু হবে কাল থেকে। তোমাদের ট্রেইনিং দেওয়া হয়েছে সেইজন্য। তোমরা যদি এবার অপারেশানে যোগ দিতে না চাও, ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাও, তাহলে কি তোমাদের জোর করা হবে? মোটেই না! তোমরা তো ইন্ডিয়ান আর্মি কিংবা বি এস এফ-এর রিক্রুট নও। তোমরা মুক্তিযোদ্ধা, তোমরা স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করতে এসেছো, এখন যদি যুদ্ধ করতে না চাও, করো না। তোমরা ফ্রি, যেখানে খুশি যেতে পারো!
এ যে উল্টোরকম চাপ। তারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে কে বললো? জাহাঙ্গীর আর নির্মল সিরাজুলের কাঁধে হাত রাখলো।
সিরাজুল বললো, আমরা নিশ্চয়ই অপারেশানে যেতে চাই। আমরা শুধু একটা দিন সময় চাইছি।
মেজর চোপরা বললো, নো ওয়ে! শোনো, পূর্ণিমা, জোয়ার-ভাটা, আবহাওয়া, বাতাসের গতি এইসব অনেক কিছু ক্যালকুলেশন করে টাইমিং ঠিক হয়। অপারেশান জ্যাকপট পরিচালনা করবে তোমাদের মুক্তিবাহিনীরই কমান্ডাররা, আমরা নয়। আমরা যুদ্ধে নামিনি। তোমরা চেয়েছে বলে আমরা তোমাদের ট্রেইনিং দিয়ে সাহায্য করছি, জায়গামতন পৌঁছে দিচ্ছি। এক শো পঞ্চাশজনকে ট্রেইনিং দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ফাইনাল সিলেকশান করা হয়েছে ষাটজনকে, তোমরা তার মধ্যে আছো। তোমরা যেতে না চাও, কোনো অসুবিধে নেই, কলকাতায় থাকো, ফুর্তি করো। অন্য চারজন যাবে। তোমাদের আর কোনোদিনই ডাকা হবে না।
এরপর আর ক্ষীণতম আপত্তিরও প্রশ্ন ওঠে না। জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করলো, আমাদের কখন রেডি হতে হবে, মেজর সাহেব?
সিরাজুলের মনটা যথেষ্ট দমে গেল। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো না? মঞ্জুভাবীর সঙ্গেও আর দেখা হবে না?
অনেক কাকুতি-মিনতি করে এইটুকু শুধু অনুমতি পাওয়া গেল যে এয়ারপোর্ট যাবার পথে ওদের গাড়িটা মদের বাড়ির সামনে থামানো হবে। সেখানে সময় পাওয়া যাবে মাত্র দশ মিনিট।
মামুন হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছেন ঘণ্টাখানেক আগে। কোনো দরকার না থাকলেও তাঁর গায়ে একটা চাঁদর মুড়ি দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনি জোড়াসনে বসে আছেন খাটের ওপর। মামুন সম্পাদক থাকার সময় দিনকাল’ অফিসে কিছুদিন প্রফ রিডারের চাকরি করেছিল। সিরাজুল। সে এসে মামুনের দুই হাঁটু ছুঁয়ে অভিবাদন করলো। তার দেখাদেখি অন্যরাও।
সিরাজুল মঞ্জুকে বললো, ভাবী, এবারে আর দাওয়াত খাওয়া হলো না। ইনসাল্লা, কলকাতায় আবার যখন আসবো, কিংবা আপনেরা ঢাকায় গ্যালে একটুও সময় নাই, এয়ারফোর্সের প্লেন আমাদের জন্য এক মিনিটও দেরি করবে না! আপনি বাবুল ভাইকে জলদি জলদি চিঠি লিখে দ্যান।
মামুন বিস্ফারিত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরা মুক্তিযোদ্ধা? এত কাছ থেকে তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেননি। অল্প সময়ের নোটিসে এয়ারফোর্সের বিমানে এদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার মানে এরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে যাচ্ছে। তিনি শুনেছেন, ১৪ আগস্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিনে সারা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী একসঙ্গে খুব বড় রকম আঘাত
মামুন অসুস্থ, বয়েসও হয়েছে, তা ছাড়া তিনি লেখক মানুষ, রাইফেল নিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে তিনি পারতেন না। তবু আজ তাঁর আত্মার এক একটা টুকরো যেন এই চারটি যুবকের সঙ্গে রণাঙ্গনে যেতে চাইছে।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, বাবুল চৌধুরীকে তুই দেখেছিস? সে ভালো আছে! এ খবর শুনে কী যে শান্তি পাইলাম! আর আলতাফ কোথায়? শুনেছিলাম, সেও একজন ফ্রিডম ফাইটার?
সিরাজুল বললো, শখের! আলতাফ সাহেব প্রথম প্রথম দুই চারদিন খুব লাফালাফি করছিলেন, তেনার পায়ের কাছে একদিন শেল ফাটলো, এমন কিছু লাগে নাই, তাইতেই ওনার চক্ষু চড়কগাছ! দশ বারোদিন হাসপাতালে রইলেন, তারপর কোথায় যে উধাও হইলেন, কেউ জানে না। তার কোনো খবর নাই। কিন্তু বাবুল ভাই সক্কলরে অবাক কইরা দিচ্ছেন। শরীরে যেন এক বিন্দু ভয়ডর নাই। প্রত্যেক অ্যাকশানে সামনে থাকেন–
জাহাঙ্গীর বললো, সত্যিই, বাবুল চৌধুরীর এই চেইঞ্জ না দ্যাখলে বিশ্বাস করা যায় না। অসম্ভব সাহসী মানুষ!
মঞ্জু ওদের একেবারে ধার ঘেঁষে বসে সব শুনছে, তার চোখে মুখে আনন্দ-গর্ব-বেদনা মাখানো। অতিদ্রত বাবুলকে চিঠি লিখছে সে, তার মধ্যে চার পাঁচ বার আছে, তুমি ভালো থেকো, তুমি ভালো থেকো।
চিঠিখানা দেবার আগে সে সিরাজুলকে জিজ্ঞেস করলো, তোরা এমন হুট করে চলে যাচ্ছিস। কোনো বিপদ হবে না তো?
সিরাজুল হেসে বললো, বিপদ আর কী! জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন! দ্যান চিঠিটা, আর দেরি করা যাবে না!
চাঁদরটা ফেলে খাট থেকে নেমে এসে মামুন ওদের গায়ে হাত বুলোতে লাগলেন। এরা যেন তাঁরই সন্তান, এদের তিনি পাঠাচ্ছেন সাঙ্ঘাতিক বিপদের মুখে।
সিরাজুল বললেন, মামুনসাহেব, দোয়া করবেন। আমরা যেন কার্যসিদ্ধি করে আসতে পারি।
মামুন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি কী বললেন তা বোঝাই গেল না। অসুখ তাঁকে দুর্বল করে ফেলেছে, তাঁকে এভাবে কাঁদতে আগে কেউ দেখেনি।
নীচে গাড়িতে হর্ন দিয়েছে, আর সময় নেই, মঞ্জুর কাছ থেকে অসমাপ্ত চিঠিটা প্রায় কেড়েই নিতে গেল সিরাজুল। কোনোরকমে নিজের নামটি লিখে, একটা খামে ভরে মঞ্জু ভারী গলায় বললো, ওরে দিস, দিয়া বলিস যে, কোনো উপায়ে যেন আমারে একটা উত্তর পাঠায়।
সিরাজুল মাথা নেড়ে পেছনে ফিরতে যেতেই মঞ্জু তার হাত ধরে বললো, মনিরারে তুই ঠিক ফিরা পাবি। আমি কইলাম, সে ফিরা আসবে!
অন্যরা আগেই নামতে শুরু করেছিল, সিরাজুল দৌড় মারলো সিঁড়ির দিকে।
এয়ারফোর্সের বিমান আগরতলায় পৌঁছে দেবার পর সেই রাত্রেই সিরাজুলদের নিয়ে যাওয়া হলো হরিণা ক্যাম্পে। সিরাজুলরা নিজেদের ঘাঁটিতে একটুক্ষণের জন্যও যেতে পারলো না, সুতরাং বাবুল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হবারও প্রশ্ন রইলো না।
অপারেশন জ্যাকপটের কার্যসূচি হলো চট্টগ্রাম ও মঙ্গলার সামুদ্রিক বন্দর দুটিতে এবং চাঁদপুর, দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, আসুগঞ্জ, নগরবাড়ি, খুলনা, বরিশাল, গোয়ালন্দ ও ফুলছড়ি ঘাট ও আরিচা ঘাটের নদী বন্দরগুলির ওপর সরাসরি আক্রমণ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ, চট্টগ্রাম বন্দরে আঘাত হানার দায়িত্ব দেওয়া হলো যে তিনটি দলকে, তার একটির কমান্ডার নিযুক্ত হলো সিরাজুল। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে পেল।
পরদিন সকাল থেকেই যাত্রা শুরু। সঙ্গে বেশ কিছু মালপত্র ও একজন গাইড, চারদিনের হাঁটা পথ। গাইডটা কিছুটা এলাকা পার করে দিলে আবার আসবে অন্য গাইড। পূর্ব নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মতন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে গেরিলারা অপেক্ষা করছে তাদের নিরাপদে পার করে দেওয়ার জন্য। হরিণা ক্যাম্পেই সিরাজুল আভাস পেয়েছিল যে ধরা পড়ার সম্ভাবনা এত বেশি যে তাদের বিকল্প আরও দুটি দল তৈরি রাখা হয়েছে। একদল ধরা পড়লে অন্য দল এগিয়ে যাবে। তাদের পৌঁছোতে হবে চট্টগ্রাম শহর পার হয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপারে চরলাক্ষায়।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম শহরটা পার হওয়াই সবচেয়ে বিপজ্জনক। সন্ধে থেকেই কারফিউ, তাই। রাত্তিরে বেরুনো যাবে না। দিনের বেলাতেও মেশিনগান ফিট করা অনেকগুলো জিপ সারা শহর টহল দিচ্ছে, পথের মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট, যখন-তখন তল্লাশী হয়, কারুকে একটু সন্দেহ হলেই আর বিচারের প্রশ্ন নেই, তৎক্ষণাৎ সেখানেই গুলি করে মারে।
তবু, এখনো চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে গেরিলারা অতি গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। তারা যোগাড় করে রেখেছিল একটা অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান, তাতে সিরাজুলদের ভরে নিয়ে, ভোরবেলা কারফিউ শেষ হতেই সেটা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। সাতখানা চেকপোস্ট পেরিয়ে গেল তারা, কেউ সন্দেহ করলো না।
অ্যাম্বুলেন্স ভ্যানটা ওদের নামিয়ে দিল নদীর ধারে একটা বাজারের কাছে। এর মধ্যেই সিরাজুলরা পোশাক বদলে নিয়েছিল। লুঙ্গি আর ছেঁড়া গেঞ্জি, কাঁধে গামছা। প্রত্যেকের সঙ্গে একটা বড় আকারের ধামা। বাজারে নেমে ওরা লাউ, কুমরো, কচুর শাক, কুমড়োর শাক, কিছু পুঁটি বাঁশপাতা মাছ কিনল। যেন ওরা সাধারণ গ্রাম্য মানুষ, হাট-বাজার সেরে বাড়ি ফিরছে।
ফেরীঘাটেও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে পাহারা দিচ্ছে পাক আর্মি, তাদের নাকের ডগা দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে ওরা উঠে পড়লো নৌকোয়। কর্ণফুলীতে ফেরী নৌকোটা ভেসে পড়বার পর ওরা নিশ্চিন্তে বিড়ি ধরালো।
বাজার এখনও ভালো করে জমে ওঠেনি, গ্রাম থেকে খদ্দেররা সবে মাত্র আসতে শুরু করেছে, ফেরার যাত্রী কম। নৌকোতে সিরাজুলরা সাতজন, কয়েকজন স্ত্রীলোক ও শিশু, দু’জন মাঝি ছাড়া আর একটি বলিষ্ঠকায় লোক। মথার চুল ছোট করে ছাঁটা, গায়ে একটা ঝ্যালঝেলে সিল্কের পাঞ্জাবি, দু’ হাতের আঙুলে গোটা ছয়েক সোনার আংটি, তার একটি দাঁতও সোনা দিয়ে বাঁধানো।
সেই লোকটি সিরাজুলদের মতন একই বয়েসী সাতজন জোয়ান ছেলের দিকে বারবার চোখ বুলিয়ে কিছু যেন সন্দেহ করলো। লুঙ্গির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কোমর চুলকোতে চুলকোতে সে জিজ্ঞেস করলো, এই, তোগো বাড়ি কোন গেরামে?
আগে থেকে মুখস্থই ছিল, চরলাক্ষা বাদ দিয়ে আর তিনটে গ্রামের নাম বললো ওরা। লোকটি একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে হাসলো। তারপর ওদের একজনের ধামা থেকে একটা লাউ তুলে জিজ্ঞেস করলো, এইডার দাম কয় পয়সা?
সিরাজুল বিনীত ভাবে বললো, এইগুলা বিক্রির না কী, আমরা খরিদ কইর্যা আনছি!
লোকটি সেকথা গ্রাহ্য না করে ধামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কুমড়ো শাক টেনে তুললো। তারপর বললো, লালশায় থাকোস আর আমারে চেনোস না?
লোকটি কথা বলে যাচ্ছে খাস চিটাগাং-এর উচ্চারণে, সিরাজুলদের গলায় সে টান আসছে। তা ছাড়া লোকটি অভদ্রের মতন অন্যের ধামায় হাত দিয়ে একটার পর একটা জিনিস তুলে নিচ্ছে। অন্যের জিনিস জোর করে নিয়ে নেবার স্বভাব আছে নিশ্চয়ই। লোকটিকে প্রথমে মনে হয়েছিল রাজাকার, এখন মনে হচ্ছে শান্তি কমিটির কেউকেটা। এদের এড়িয়ে যাবারই কথা। ছিল, কিন্তু লোকটি যেভাবে ধামার মধ্যে হাত ঢোকাচ্ছে, তাতে এক্ষুনি অন্য কিছুর সন্ধান পেয়ে যাবে। লাউ-কুমরো, শাক-পাতা দিয়ে ঢাকা দেওয়া আছে বস্তায় বাঁধা লিমপেট মাইন, ফিন, মেশিনগান ও ট্রানজিস্টার।
লোকটির ঠিক পেছনেই বসে আছে নির্মল। সিরাজুল তাকে চোখের সামান্য ইঙ্গিত করতেই নির্মল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড জোরে লোকটির ঘাড়ে একটা রদ্দা কষালো, তারপর এক ধাক্কায় ফেলে দিল নদীতে। লোকটি হাবুডুবু খেয়ে একবার মাথা তুলতেই সিরাজুল প্রায়। কোমর পর্যন্ত ঝুঁকে ওর চুলের মুঠি ধরে ঠেসে রাখলো।
লোকটি জলের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড মাছের মতন দাপাচ্ছে, সিরাজুল তাকে একবারও নিশ্বাস নেবার সুযোগ দিল না। কিন্তু সিরাজুলের মুখে কোনো উত্তেজনা নেই, তার বজ্রকঠিন ডান হাতের মুষ্টিই লোকটিকে চেপে রেখেছে নদীতে।
জাহাঙ্গীর স্ত্রীলোকদের দিকে হাতজোড় করে বললো, মা জননীরা ভয় পাবেন না। ওড়া একটা নামরুদ।
তারপর মাঝিদের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনেরা থামলেন ক্যান, চালান, চালান!
একটু পরেই সিরাজুলরা নৌকো বদল করলো। বেশ খানিকটা ঘুরে দুপুরের ঠা-ঠা রোদে এসে নামলো চরলাক্ষায়। সেখানে দুটি কুড়ে ঘরের বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই বাড়িদুটি ওদের জন্য প্রস্তুত।
মতিন আর জাহাঙ্গীর নৌকোর ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করতে যেতেই সিরাজুল বললো, ঐ বিষয়ে আর একটা কথা না। মনে কর, কিছুই ঘটে নাই। এহানে শুধু আমরা খাবো-দাবো আর ঘুমাবো। আয় গান শুনি।
সে ট্রানজিস্টার রেডিও খুলে সত্যিই ভারতীয় বেতারের গান শুনতে লাগলো। সারাদিন সেই রেডিও কানের কাছে নিয়ে শুয়ে শুয়ে কাটালো সিরাজুল। অন্যরা কেউ রান্না। করলো, কেউ ঘুমোলো। রাতটা কেটে গেল নিরুপদ্রবে। পরদিনও গান শুনতে শুনতে হঠাৎ এক সময় একটা গান শুনে লাফিয়ে উঠলো সিরাজুল। পুরোনো আমলের একটা বাংলা গান বাজছে, “আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি”। সিরাজুল ফিসফিস করে বলে উঠলো, সব রেডি হয়ে নে। আর টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স। আইজই আর একটা দল আইস্যা পড়বে!
এদের মধ্যে জাহাঙ্গীরই একটু বেশী লেখাপড়া করেছে। সে জানে যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নমন্ডি উপকূলে যখন মিত্র বাহিনী ল্যান্ড করে, তখন লন্ডনের বি বি সি থেকে এরকম সাংকেতিক গান বাজানো হয়েছিল। কিন্তু একটা গান তো নয়, চব্বিশ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় আর একটি গান বাজবার কথা। সেই দ্বিতীয় গানটি কী?
সিরাজুল বললো, সেটা আমাকে জানানো হয়নি। অন্য দলের কমান্ডার সেটা জানে।
তারপর সে ব্যাগ থেকে একটা খাম বার করে বললো, দ্যাখ, যদি আমি আর ফিরতে না পারি, তাইলে এই চিঠিখান বাবুল চৌধুরীরে তোরা পৌঁছাইয়া দিস।
জাহাঙ্গীর বললো, এডা কী কও মিঞা? তুমি না ফেরলে আমরাই বা ফেরবো ক্যামনে?
সিরাজুল হেসে বললো, গেরিলাদের টার্গেটে পৌঁছানোর থিকাও ফেরা অনেক কঠিন।
সন্ধের পর অন্যদিক থেকে নদীপথে এসে পৌঁছোলো দ্বিতীয় একটি দল। তার কমান্ডার বাচ্চু। সিরাজুলদের তুলনায় তারা অনেকগুলি বিপদ পার হয়ে এসেছে, খুবই ক্লান্ত, এসেই তারা ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন দুপুরে বাচ্চু ট্রানজিস্টার শুনতে শুনতে এক সময় বললো, আইজ রাত একটায় জিরো আওয়ার! তখন সাইগলের একটি অতি পরিচিত গান বাজছে, “আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান, তার বদলে আমি চাইনি কোনো দান…”।
সন্ধের আগে খেয়ে নিয়ে সবাই ঘুমিয়ে নিল কিছুটা। তারপর এক সময় উঠে বেশ কিছুটা হেঁটে এসে ঠিক রাত একটায় তারা নদীতে নেমে পড়লো। জোয়ার শেষ, এখনো ভাটা শুরু হয়নি, নদী এখন শান্ত। এদিকে অন্ধকার, ওদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলো আলোয় ঝলমল করছে। নদীর ওপরেও অনেকখানি সার্চ লাইটে আলোকিত, কোনো রকম নৌকো কিংবা জলযান দেখলেই শান্ত্রীদের গুলি ছুটে আসবে।
এখন যারা বন্দর পাহারা দিচ্ছে, তাদের ডিউটি শেষ রাত দুটোয়। তখন আসবে নতুন দল। ডিউটির শেষ দিকটায় প্রহরীরা খানিকটা অসতর্ক ও অলস হয়ে পড়ে, ঘুম তাড়াতে ব্যস্ত হয়। সেটাও হিসেবের মধ্যে ধরা আছে।
১২ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা রয়েছে এম ভি আল আব্বাস, এতে আছে ১০৪১ টন। সামরিক সরঞ্জাম। ৬ নম্বর অরিয়েন্ট বার্জে ২৭৬ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সবচেয়ে বড় জাহাজ এম ভি হরমুজ, তাতে রয়েছে ৯৯ ১০ টন কামান ও ট্যাঙ্ক। এছাড়া আরও কয়েকটি গান। বোট ও বার্জ।
পায়ে ফিন বেঁধে, মাথাটা অল্প একটু জলে ভাসিয়ে সাঁতরে এলো একদল যুবক। কে-কোন জাহাজে মাইন লাগাবে ও আগে থেকে নির্দিষ্ট আছে। অতি দুঃসাহসী সিরাজুল হরমুজ জাহাজের তলা দিয়ে ডুব দিয়ে পোর্ট সাইডে চলে এলো। জল থেকে উঠে আসা একটা প্রাণীর মতন সে সেঁটে রইলো জাহাজটার গায়। আলো পড়েছে তার ওপরে, প্রহরীদের নজর একবার এদিকে ফিরলে সেই মুহূর্তে সে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। লিমপেট মাইনগুলো ঠিক মতন আটকে দিয়ে সরে আসতেই শুরু হলো ভাটার টান। নিঃশব্দে তারা গা ভাসিয়ে দিল। তাদের পরিকল্পনা শতকরা এক শো ভাগ সার্থক।
প্রথম বিস্ফোরণ হলো ঠিক রাত ১-৪০ মিনিটে। সেই শব্দে কেঁপে উঠলো পুরো চট্টগ্রাম শহর। তার পাঁচ মিনিট পর আর একটা, এই বিস্ফোরণ আরও জোরে, কানের পর্দা ফেটে যাবার জোগাড়, এবার এম ভি হরমুজ ডুবছে। এবার পর পর গর্জন। যেন প্রলয় এসে গেছে, এই ভেবে কান্নাকাটি শুরু করে দিল শহরের মানুষ।
সিরাজুলরা চরলাক্ষায় আগের জায়গায় ফিরে গেল না। তারা একসময় এসে উঠলো পাটিয়া গ্রামের প্রান্তে। এখানে তারা বিশ্রাম নিতে লাগলো। ভোরের আগে যাত্রা করা যাবে না, তাদের ফেরার পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে স্বেচ্ছাসেবকরা।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ দিয়ে উড়ে এলো হেলিকপ্টার। গ্রামগুলোতে ব্রাস ফায়ার চালালো, নদী দিয়ে লঞ্চে করেও নেমে এলো আর্মি, গ্রামের লোকদের টেনে টেনে বাইরে এনে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, মুক্তি কোথায়? কোথায় সেই ছেলেরা?
সিরাজুলদের সাহায্য করার লোক আগেই এসে গেছে। তারা নদীর ঢাল দিয়ে দৌড়াচ্ছে, খানিক পরেই তারা জঙ্গলে ঢুকে যেতে পারবে। হঠাৎ সিরাজুল পেছন ফিরে বললো, পাটিয়া গ্রামে আগুন! সাধারণ মাইনষের ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিতাছে!
তা জ্বলুক, ওদের আর দেরি করার সময় নেই। কমান্ডার বাচ্চু সিরাজুলকে ঠেলা দিয়ে বললো, চল, চল!
সিরাজুল তবু থমকে দাঁড়িয়ে বললো, আমাগো জইন্যে গ্রামের লোকগুলা মরবে?
এসব চিন্তা করার উপায় নেই। এখন যুদ্ধ চলছে। গেরিলারা শুধু নির্দেশ মতন চলবে, অন্যদিকে তাকানো যাবে না। কিন্তু সিরাজুল রুখে দাঁড়ালো। তার চোখ দুটো যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সে পেছন ফিরে দৌড় শুরু করতেই মতিন-জাহাঙ্গীর-নির্মলরা তাকে টেনে ধরাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু সিরাজুলের শরীরে তখন অসুরের শক্তি, বন্ধুদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে সে ছুটে গেল। দুতিনবারের চেষ্টাতেও তাকে আটকানো গেল না।
মতিনরা খানিকটা দূর তার পেছন পেছন গিয়েও থেমে যেতে বাধ্য হলো। গ্রামের লোকদের সারবেঁধে দাঁড় করিয়েছে পাক আর্মি, এখুনি গুলি চালাবে। ওপর দিয়ে উড়ে আসছে। একটা হেলিকপ্টার।
এই অবস্থায় ফিরে যাওয়া মানে আত্মহত্যারই নামান্তর। গেরিলারা এরকম অপারেশানে এসে কক্ষনো বিপক্ষের সৈন্যদের মুখোমুখি যেতে চায় না। সেরকম নিয়ম নেই। সিরাজুল তবু ছুটছে। দিনের পর দিন উত্তেজনা, টেনশান, তারপর আসল কার্যসিদ্ধির পর অনেকে মাথার ঠিক রাখতে পারে না, সমস্ত রুদ্ধ আবেগ এক সঙ্গে বেরিয়ে আসে। ট্রেইনিং-এর সময়েই এই ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল।
মতিন, জাহাঙ্গীর চিৎকার করছে, সিরাজুল! সিরাজুল!
সিরাজুল তা শুনতে পাচ্ছে না। সামনের গ্রামটায় আর্মির অত্যাচারে মেয়েরা আর্ত চিৎকার করছে, সিরাজুল তার মধ্যে যেন চিনতে পারছে মনিরার কণ্ঠস্বর। সিরাজুলের দৃঢ় ধারণা হলো, ওখানেই রয়েছে মনিরা। বাবুল চৌধুরী একবার বলেছিল না যে মনিরাকে নিয়ে আসা হয়েছে। চিটাগাং-এর দিকে! মনিরাকে উদ্ধার না করে সিরাজুল ফিরে যাবে?
সে চেঁচিয়ে বললো, মনিরা, মনিরারে, আমি আসতেছি…
তার মাথার ওপরে গর্জন করে উড়ে এলো একটা হেলিকপ্টার।
সিরাজুল চিৎকার করে উঠলো, হারামজাদারা? পুঙ্গিরপুত।
মেশিনগান দিয়ে গুলি চালাতে চালাতে সে নিজেও একটা বুলেটের মতন ছুটে গেল গ্রামের দিকে।
জাহাঙ্গীর কপাল চাপড়ে বললো, হায় আল্লা, পাগল হইয়া গ্যাছে গা!
তারা আর ফিরে তাকাবারও সময় পেল না। সিরাজুলের দেহটা মাটির সঙ্গে ফুড়ে যাবার দৃশ্যটা তাদের আর দেখতে হলো না।