কলকাতায় রুটিনমাফিক ঠাণ্ডা পড়ে গেল। গাছগাছালি কমে যাওয়া এ শহরে শীত আজকাল এক বিরল ঋতু। ক্রিসমাসের মুখে মুখে সাইবেরিয়ান হাঁসেদের ডানায় চেপে দু দণ্ড জিরোয় এই কংক্রিটের জঙ্গলে, তারপর নতুন বছর পড়তে না পড়তেই কখন চুপিসাড়ে উধাও হয়ে যায়। থার্মোমিটারের পারা নামুক ছাই না নামুক, হিমের গন্ধ পেয়েই শহরের বাবুবিবিরা মহা খুশি। স্বল্পকালীন শৈত্য তারিয়ে তারিয়ে চাখতে ট্রাঙ্ক সুটকেস আলমারি খুলে তারা গরম জামাকাপড়ের পাহাড় বার করে ফেলে, বছরভর ডায়িং ক্লিনিংএ রেখে দেওয়া শাল পুলওভার কার্ডিগানরাও সূর্যের আলোর মুখ দেখতে পায়। রঙিন শীতপোশাকের বাহারে শহরটাই এখন এক মরসুমি ফুলের বাগান।
আলমারি ঘেঁটে নীল-সাদা পুলওভারটা বার করল আদিত্য। সোয়েটারটা জয়শ্রীর বোনা, বছর তিনেক আগে। এত জমকালো সোয়েটার আর পরার অভ্যেস নেই আদিত্যর। তবু বোন ভালবেসে বুনে দিয়েছে, উলটাও খুব নরম, গাঁ-গঞ্জের দিকেও যাবে আজ, এই সোয়েটারটাই পরা ভাল। গরম টুপি নেবে একটা? থাক গে। নীচের তাক থেকে ফোলিও ব্যাগটা বার করল আদিত্য। ত্রিমূর্তি এন্টারপ্রাইজের কয়েকটা কাগজ ভরল ব্যাগে, বিল চালান গুছোল, ভাল দেখে ডটপেনও নিল একটা। চুল আঁচড়াল। কবজিতে ঘড়ি বাঁধল। দেরি হয়ে গেছে। সাড়ে আটটা বাজে, নটার সময়ে এসপ্ল্যানেডের বাস গুমটিতে অপেক্ষা করবে রঘুবীর। এত তাড়াতাড়ি স্নান-খাওয়া সারল আজ, তবু যে কী করে দেরি হয়ে যায়!
ঝটিতি আলমারি বন্ধ করেও আবার খুলল আদিত্য। পার্সে গোটা পঞ্চাশেক টাকা আছে, আরও কিছু টাকা সঙ্গে রাখা দরকার। রঘুবীর নামেই পার্টনার, কোথাও একটি পয়সাও উপুড়হস্ত করবে না। ইন্দ্রাণী যেখানে টাকা রেখে যায় সেখানটা একবার হাতড়াল আদিত্য। নেই। কী হবে তাহলে?
কপালে ভাঁজ ফেলে আদিত্য পাশের ঘরে এল। তিতির স্কুলের ব্যাগ গোছাচ্ছে, এবার স্নানে যাবে।
আদিত্য বলল, –তোর মার আলমারির চাবিটা কোথায় রে?
-তোশকের নীচে। কেন?
শ খানেক টাকা নেব।
হঠাৎ?
মেয়ে এ প্রশ্ন করতেই পারে। নিতান্ত বিপাকে না পড়লে ইন্দ্রাণীর আলমারিতে আদিত্য হাত দেয় না। মেয়ে জানে।
আদিত্য সামান্য হেসে বলল, – দরকার আছে। বিজনেস। মা এলে বলে দিস।
আলমারির লকারে হাত ঢোকাতে গিয়ে থমকে গেল আদিত্য। মোটা একটা খামে ভর্তি হয়ে আছে খুপরিটা। আদিত্য খামটা বার করে পাশের তাকে রাখল। লকার থেকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে পুরল মানিব্যাগে। খাম আবার স্বস্থানে রাখতে গিয়ে কি ভেবে ফাঁক করল মুখটা। সঙ্গে সঙ্গে যেন হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ বয়ে গেছে শিরদাঁড়ায়।
টাকা! বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকা!
কোত্থেকে এল!
মেয়েকে আড়াল করে আদিত্য আরেকটু ফাঁক করল খামটা। একশো টাকার নোটের পাঁচখানা আনকোরা বাণ্ডিল। মানে পঞ্চাশ হাজার! এত টাকা তো কস্মিনকালেও প্রেসের হতে পারে না।
কয়েক মুহূর্তের জন্য আদিত্যর স্নায়ু অসাড়। টাকা তবে জোগাড় হয়ে গেল! তাই বাপ্পার এত খুশি খুশি মেজাজ! সকালে বাথরুমে হেঁড়ে গলায় গান গাইছিল! ইন্দ্রাণী তো কই তাকে কিছু বলেনি! আদিত্যও অবশ্য জিজ্ঞাসা করেনি। একবার ধার করার কথা বলতে গিয়ে মুখঝামটা খেয়েছে, আর কেন যেচে প্রশ্ন করতে যাবে? অকর্মণ্য মানুষের কি আত্মসম্মানও থাকতে নেই?
দুর্বল হাতে খাম লকারে ঢুকিয়ে আলমারি বন্ধ করল আদিত্য। চাবির গোছা বিছানার তলায় রাখতে রাখতে প্রশ্ন করে ফেলল, তিতির, তোর ডাক্তার আঙ্কল এর মধ্যে কবে এসেছিল রে?
তিতির এক পলক ভাবল, পরশু। না না, তার আগের দিন।
–যেদিন আমি অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলাম?
–হ্যাঁ, ওই দিনই তো।
অনেকক্ষণ ছিল?
–তা ছিল। ঘন্টাখানেক মতন। কেন বলো তো?
–এমনিই!
–এমনিই? তিতির যেন বেশ অবাক।
আদিত্য ফ্যাকাশে হাসল, – তোর ডাক্তার আঙ্কল আজকাল তেমন আসতে পারে না তো, তাই…….
তিতির কি বিশ্বাস করল তার কৈফিয়ত? মেয়ের কাছে ছোট হয়ে গেল না তো আদিত্য?
সিঁড়ি ভেঙে নামার সময়ে আদিত্য বুকে একটা ভার অনুভব করছিল। ভার, না শুন্যতা? তার হৃদয়ে কোনও বিদ্বেষ নেই, ঈর্ষাও জাগে না, তবু যে কেন এক কুশবনে ছেয়ে যায় বুক? ধারালো কুশের ডগা ছুঁয়ে যায় পাঁজর, রক্ত ঝরে টপটপ। শীতল রক্ত। টাকাটা যদি শুভাশিসের কাছ থেকেই নেবে তবে সেদিন কেন ভনিতা করল ইন্দ্রাণী? চক্ষুলজ্জা! কিন্তু তার কী প্রয়োজন ছিল? নিজেকে অযোগ্য জেনে কোনওদিনই তো সে ইন্দ্রাণী আর শুভাশিসের মাঝখানে একটা কঞ্চির বেড়া হয়েও দাঁড়াতে চায়নি, তাও তাকে নিয়ে এই খেলা কেন? এ কি শুধুই অবজ্ঞা? নাকি পরিহাস?
বড়ঘরের বাইরের সরু বারান্দায় এক ফালি রোদ টেরচাভাবে গড়িয়ে আছে। রোদটুকুতে পিঠ ঠেকিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন জয়মোহন। খসখসে চামড়ায় ভিটামিন পুরছেন। আদিত্যকে দেখে ন্যুব্জ দেহ সোজা হল, কোথায় চললে?
আদিত্য অন্যমনস্ক মুখে দাঁড়াল, -কাজ আছে।
কী কাজ?
আদিত্য সবিস্তারে বলতে পারত উদয়নারায়ণপুরের কালভার্ট সারাই-এর অর্ডারটা তাদের হাতে এসে গেছে, আজ রঘুবীর আর সে সরেজমিন করতে যাচ্ছে জায়গা। যে ঠিকাদার তাদের হয়ে কাজ তুলবে তার সঙ্গেও মোলাকাত হবে আজ। নতুন লাইনে আজ থেকেই গড়গড় করে যাত্রা শুরু তার। এরপর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মজুর খাটাবে, চিমনিঅলা পিচ গলানোর গাড়ি কিনবে, হয়তো এক সময়ে আস্ত একটা রোডরোলারও….
কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না আদিত্যর। মৃদু স্বরে শুধু বলল, আছে একটা কাজ। নতুন বিজনেসের।
–হুঁহ, বিজনেস! মানে ওই ষণ্ডাটার ল্যাঙবোট হয়ে ঘোরা!
ধরো তাই।
–অনেক তো হল। এবার অন্তত সংসারের কোনও একটা উপকারে লাগো।
আদিত্য উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, জয়মোহন গলা ওঠালেন, শোনো। যেখানে চরতে যাচ্ছ যাও, তবে তার ফাঁকে বউমার একটা উপকার করে দাও।
নিজের অজান্তে ভুরু কুঁচকে গেল আদিত্যর।
চেয়ারের পাশে রাখা গোটা কয়েক ছোট ছোট খাম বাড়িয়ে দিলেন, জয়মোহন। বললেন, প্রেসের কয়েকটা বিল আছে। পার্টিদের দিয়ে আসতে হবে।
–তোমার কাছে প্রেসের বিল!
–দুর্লভ দিয়ে গেল। কাল রাত্তিরে মেসে খবর এসেছে দেশে ছোট জামাইয়ের কি একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ঘাটাল হাসপাতালে আছে। ফিরতে ওর দু-তিন দিন সময় লাগবে। তেমন কিছু হলে হয়তো আরও কয়েক দিন।
–তা আমি কী করব? তোমার বউমার বিল বউমাকেই দিয়ো।
–সে তো দেবই। কিন্তু সব জায়গায় কেন বউমাকেই ছুটতে হবে? কেন তুমি যাবে না?
বললাম তো আমার কাজ আছে। আদিত্য তেড়ে উঠল।
–পাজির পাঝাড়া। কাজ দেখাচ্ছিস তুই নিকম্মার গোঁসাই?
–অ্যাই চোপ। খবরদার। আদিত্যও হঠাৎ গর্জে উঠেছে।
কীসের চোপ রে হারামজাদা? গোবরগণেশটি হয়ে বউয়ের অন্ন ধ্বংস করছিস, আর কাজ করতে বললেই মেজাজ?
তাতে তোমার কী অ্যাঁ? আদিত্যর অবাধ্য স্নায়ু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারাল এবার। হাউমাউ করে তেড়ে গেল বাবার দিকে, অত যদি বউমার জন্য দরদ, যাও না ঘুরে ঘুরে পার্টিদের দিয়ে এসো।
ক্ষমতা থাকলে তাই যেতাম রে হারামজাদা। তোর মতো একটা কেন্নোর বেহদ্দকে সাধতাম।
–মুরোদই যখন নেই, তখন অত কথা কিসের! বাবার একদম কাছে মুখ নিয়ে গেল আদিত্য। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, – মরতে পারো না তুমি? মরলেও তো আমার হাড় জুড়োয়।
ভাঙাচোরা মুখটা চুপসে গেল মুহূর্তে। কসাইয়ের চোখে বাবার সেই মুখ কয়েক সেকেন্ড দেখল আদিত্য। তারপর ছিটকে বেরিয়ে গেল রাস্তায়।
পৌষের আকাশ ঝকঝকে। নির্মেঘ। নীলাভ কড়াই থেকে সূর্য সোনার গুড় ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে। স্বর্ণরেণু মেখে শীতল বাতাসও এখন ভারি মনোরম। বাসরাস্তা, স্টেশনের দিকে হাসিখুশি মুখে ছুটছে অফিসযাত্রীরা। কৃষ্ণচূড়ার ডালে কোত্থেকে এক টুনটুনি উড়ে এসে বসল। অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়া আকাশে বড় নিশ্চিন্তে উড়ছে দুটো চিল। পৃথিবীতে কোথাও এতটুকু ক্লেদ নেই আজ।
শুধু আদিত্যরই দিনটা বড় পাঁশুটে হয়ে গেল।
এসপ্ল্যানেডে পৌঁছে মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল আদিত্যর। বাস গুমটিতে বিজবিজে ভিড়। প্রতিটি টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ সর্পিল লাইন। উৎকট কোলাহল আর পেচ্ছাপের গন্ধে নরক হয়ে আছে ঘুপচি মতন জায়গাটা।
রঘুবীর কোত্থেকে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে দৌড়ে এসেছে, এত্ত দেরি করলেন? সাড়ে নটার বাস যে বেরিয়ে গেল!
আদিত্য নাকে রুমাল চাপল, নেক্সট বাস কটায়?
–সেই বারোটায়। পৌঁছতে পৌঁছতে দুটো বেজে যাবে।
আদিত্য নির্বিকার, তাহলে আর কি। ফিরে যাই।
শেষ টান দিয়ে জ্বলন্ত বিড়ি টোকা মেরে উড়িয়ে দিল রঘুবীর, – তা বললে কি হয়? তিলক সাউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে……। চলুন, হাওড়া থেকে মিনিবাস ধরব।
হাওড়ার শহরতলি পার হয়ে ছুটছে মিনিবাস। ছুটছে কম, থামছেই বেশি। বোঁচকা বোঁচকা মাল উঠছে। আদিত্যর সিটের নীচে ইয়া বড় বড় সাবানের পেটি ঢোকাল এক ছোকরা। খচখচ পায়ে এসে ঠেকছে বাক্সগুলো। আদিত্য পা দিয়ে ঠেলতে চেষ্টা করল। যাচ্ছে না। রঘুবীর দিব্যি গল্প জুড়েছে কন্ডাকটারের সঙ্গে। হাত বাড়িয়ে খানিকটা খৈনি ম্যানেজ করল। চেটোয় রেখে চেপে চেপে বুড়ো আঙুলে ডলছে। ফটাফট চাপড় মেরে ঠোঁট আর মাড়ির ফাঁকে গুঁজে দিল দলাটা। আদিত্যর মুখ টপকে জানলা দিয়ে পিক ফেলল।
বাইরে কী দেখেন রায়দা? প্রকৃতি?
আদিত্য কিছুই দেখছিল না। বিস্বাদ মুখে তাকিয়ে ছিল শুধু। স্বচ্ছ রোদ্দুরেও ছুটন্ত গাছগাছালি বাড়িঘরদোর সবই যেন ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে। ধান কাটা হয়ে গেছে, ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছে নিঃসঙ্গ প্রান্তর, পথের ধারে নয়ানজুলিতে কাঁপছে সূর্যবিম্ব–এ সব কিছুই চোখে পড়ছে না আদিত্যর। তার সামনে এখন শুধুই এক অতিকায় বাদামি গুহা, যেখানে পাথরের চাঙড়ের মতো পাঁচটা একশো টাকার বাণ্ডিল সাজানো আছে থাকে থাকে।
আদিত্যর কাঁধে টোকা দিচ্ছে রঘুবীর, হলটা কী আপনার? কী ভাবেন?
আদিত্য মাথা ঝাঁকাল, কিছু না।
–কিছু তো একটা ভাবছেন বটেই। রঘুবীর অদিত্যর চোখে সার্চলাইট ফেলল, –টেনশান হচ্ছে?
কীসের টেনশান?
নতুন কাজ…..নতুন মানুষ….।
নাআআ। আদিত্য উদাস, আপনি তো সঙ্গে আছেন।
–এটাই হল সার কথা। রঘুবীর চাটুজ্যে আপনার সঙ্গে আছে। যা ভাব্বার সে ভাববে। এ কথাটা মনে রাখলে আপনার সব দুশ্চিন্তা কমে যাবে। পায়ের চাপে দুটো সাবানের পেটি ভেতর ঢুকিয়ে দিল রঘুবীর। গাম্ভীর্য এনেছে মুখে, ওখানে গিয়ে তিলক সাউয়ের সঙ্গে আপনার বেশি কথা বলার দরকার নেই।
–কেন?
-কেন আবার কি। গাঁ-গঞ্জের লোক, শহরের মানী লোকেদের সঙ্গে ওরা কথা বলতে জানে! যা বলার আমিই বলব।
উদয়নারায়ণপুর পৌঁছতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল। জায়গাটা মাঝারি গঞ্জ মতন। রাস্তার দু ধারে বেশ কয়েকটি পাকা বাড়ি। বাস থেকে নেমে একটু এগোলে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা বড়সড় কোঅপারেটিভ, উল্টোদিকে পেট্রল পাম্প। দোকানপাটেও কমতি নেই। কনকনে হিমেল হাওয়ায় ভরদুপুরেও জায়গাটা কেমন নিস্তেজ।
আকাশছোঁয়া এক শিশুগোছের কোল বেয়ে সরু পিচ ঢাকা পথ। মিনিট খানেক হাঁটলে তিলক সাউয়ের প্রকাণ্ড পাকা বাড়ি। তিনতলা।
তিলক সাউ বাড়িতেই ছিল। আদিত্যদের দেখে বলল, এসে গেছেন?
আদিত্য অপ্রতিভ মুখে বলল, একটু দেরি হয়ে গেল।
সোফাসেট ছড়ানো এক বড়সড় ঘরে আদিত্যদের ডেকে নিয়ে বসাল তিলক। সরাসরি কাজের কথায় এল, –দিন, অর্ডারটা দিন।
আদিত্য ফোলিও ব্যাগে হাত দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই রঘুবীর একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল।
–এ তো জেরক্স কপি। অরিজিনালটা কোথায়?
রঘুবীর আয়েশ করে গা ছড়িয়ে দিয়েছে সোফায়। হাত পায়ের খিল ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, –এটাই রাখো। বিল সাবমিট করার আগে অরিজিনাল দিয়ে যাব।
দয়া করে ঝোলাবেন না। সেবার তো আপনি…
–পুরনো কথা ছাড়ো তিলক। তুমিও সেবার আমাকে টাকার জন্য কম ঘোরাওনি।
বছর পঁয়ত্রিশের তিলকের লম্বাটে চোয়াড়ে মুখটায় রাগের ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল যেন। ভার গলায় বলল, –টাকা আপনি আজই নিয়ে যাবেন।
কুড়ি পারসেন্ট তো?
–ফের সেই বদ অভ্যেস রঘুদা? পনেরো পারসেন্টে কথা পাকা হল না!
আদিত্য কিছু বুঝতে পারছিল না। যেন দুটো মানুষ তার সামনে বসে সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা চালাচালি করছে। তিলকের গালে একটা লম্বা কাটা দাগ আছে, চোখ দুটোও বড় হিংস্র ধরনের, তার দিকে তাকাতে কেমন ভয় ভয় করছিল আদিত্যর। ঠিক যেন ভালমানুষ বলে মনে হয় না। গলার স্বরটিও বেশ কর্কশ।
অস্বস্তি কাটানোর জন্য আদিত্য কথা বলে উঠল, –একবার সাইটটায় ঘুরে এলে হয় না?
তিলকের কঠিন মুখ হাসিতে ভরে গেল, সাইটে গিয়ে আপনি কী করবেন? কাজ তো করব আমি।
–তবু একবার যাব না!
–যেতে পারেন, তবে তার দরকারটা কী? আমার এখানে এসেছেন, এদিক ওদিক ঘুরুন, আরাম-টারাম করুন। তিনতলার গেস্টরুমটা খুলে দিচ্ছি, আজ রাত্রে থেকে যান। জমিয়ে আসর বসানো যাবে।
না না, তা কী করে হয়? আমি বাড়িতে বলে আসিনি।
তিলক গম্ভীর মুখে রঘুবীরের দিকে তাকাল, রঘুদা, আপনি এঁকে বলেননি, আমার এখানে এলে আমি অতিথিদের ছাড়ি না?
রঘুবীর আলগা ধমক দিল আদিত্যকে, কলকাতায় কী এমন আপনার রাজকার্য পড়ে আছে? থাকুন না রাতটা।
আদিত্যর বুকের ভেতরটা সিরসির করে উঠল। সত্যিই তো, কী হবে ফিরে? কে আর এমন অপেক্ষা করে থাকে তার! ঘরে কেউ প্রতীক্ষায় না থাকলে ঘরের টানও বুঝি কমে যায়।
আদিত্য উদাসীনভাবে বলল, রাতের এখনও দেরি আছে। দেখা যাবেখন। তার আগে চলুন তো, প্রথম কাজের জায়গাটা অন্তত একবার দেখে আসি।
তিলক সিগারেট ধরিয়েছে। আদিত্যর দিকেও বাড়িয়ে দিল একটা। ধোঁয়া ছেড়ে নীরস মুখে বলল, –দেখুন আদিত্যবাবু, গোড়াতেই একটা কথা আপনার সঙ্গে স্পষ্টাস্পষ্টি হয়ে যাওয়া দরকার। আপনি বারবার সাইট দেখতে চাইছেন, ভাল কথা। আমি লোক দিয়ে দিচ্ছি, সে আপনাকে এখনই কালভার্টগুলো দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তবে আমার কাজে আপনারা কিন্তু কোনও সময়েই গিয়ে নাক গলাতে পারবেন না। ওটা আমি পছন্দ করি না।
আদিত্য হাসার চেষ্টা করল, বাহ্, কাজ কেমন করছেন দেখব না! খারাপ হলে তো গভর্নমেন্ট অফিসে আমাদেরই বদনাম হবে।
রঘুবীর কটমট করে তাকাল, আহ রায়দা।
রাগ ঝেড়ে ফেলে হা হা হেসে উঠল তিলক, রঘুদা, আপনার পার্টনারের দেখছি এখনও অন্নপ্রাশনও হয়নি! আরে দুর মশাই, কাজ নিয়ে আপনাকে কে ভাবতে বলেছে? কাজ তো আপনি পেয়েছেন আমার বকলমে। তিলক সাউ বিল দিলে ওই অফিসে কারুর হাত ছোঁওয়ানোর ক্ষমতা আছে? সবার মুঠো ভর্তি করে রেখে দেওয়া আছে মশাই। আপনার এই সামান্য কালভার্টের কাজটাও কি আমার নামে বেরোতে পারত না? পারত। কেন কাজটা ধরিনি বলুন তো?
আদিত্য বোকার মতো তাকাল, –কেন?
সব কাজ এক কন্ট্রাকটার করলে অনেকের চোখ টাটায়। গরমেন্টেও ঝামেলা আছে। অডিট ফ্যাচাং করে, উল্টোপাল্টা নোট দেয়। তখন আবার এই লিডারকে ধরো, সেই লিডারকে ধরো। তার চেয়ে এই ভাল। আপনারাও কিছু করে খেলেন…আমরাও…হে হে হে বুঝলেন তো? বসুন, আপনাদের পেমেন্টটা অ্যাডভান্স দেব বলেছিলাম, এখনই দিয়ে দিই।
ভেতর থেকে নোটের তাড়া নিয়ে ফিরে এসেছে তিলক, –গুনে নিন। ফিফটিন পারসেন্ট হিসেবে উনচল্লিশশো আছে। টাকা নিয়ে অরিজিনাল অর্ডারটা আমায় দিয়ে দিন।
জেরক্স অরিজিনালের বচসা বেমালুম ভুলে নোট গুনছে রঘুবীর। খুঁটে খুঁটে। উপোসি কাকের মতো।
একটা নোটের তাড়া বার বার পাঁচটা বাণ্ডিল হয়ে যাচ্ছে। একশো টাকার পাঁচটা বাণ্ডিল। আদিত্য চোখ রগড়াল। কেন এমন হচ্ছে!
.
বেলা পড়ে এল। শীত যেন পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। চতুর বেড়ালের মতো। উত্তরের জানলা দুটো দিয়ে চোরা বাতাস আসছে একটানা। অন্ধকার নামার আগেই হিমঋতু দখল নিচ্ছে ঘরের।
সব কটা জানলাই টেনে টেনে বন্ধ করল ইন্দ্রাণী। এত করে তিতিরকে বলে যায় স্কুল থেকে ফিরেই জানলাগুলো বন্ধ করে দিস, কেন যে মেয়েটা মাথায় রাখে না! কী যে এত তাড়া থাকে টিউটোরিয়ালের। পড়তে যাওয়ার তাড়া, না আড্ডার? ইলেভেনে উঠেই মেয়ের পা অনেক লম্বা হয়ে গেছে। পরশু ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে একটা মোটরসাইকেলঅলা ছেলের সঙ্গে কথা বলছিল, ইন্দ্রাণীকে দেখে চমকে গেল। জিজ্ঞাসা করতে বলল, স্কুলের বন্ধু, সত্যিই স্কুলের বন্ধু কি?
শাড়ি বদলে গায়ে ভাল করে একটা শাল জড়াল ইন্দ্রাণী। নীচে নেমে সন্ধ্যার মাকে এক কাপ চায়ের কথা বলবে ভাবছিল, তার আগে কন্দর্প উঠে এসেছে।
–যাক ফিরেছ তাহলে। আমি তিনবার এসে ঘুরে গেছি।
–তাই?
–গেছিলে কোথায়? মানিকতলায়?
–না। দুলর্ভবাবু হঠাৎ দেশে চলে গেছেন, স্কুল থেকে ফিরে পার্টিদের বিল ধরাতে গিয়েছিলাম। বাবা তোমার দাদাকে কাজটা একটু করে দিতে বলেছিলেন, সে নাকি খুব মেজাজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেছে।
কন্দর্প যেন ইন্দ্রাণীর উত্তরে ঠিক কান দিল না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে হালকা সবুজ এক কাগজের তাড়া বার করে ধরিয়ে দিয়েছে ইন্দ্রাণীর হাতে, –অশোকদা এটা পাঠিয়ে দিল।
চমকানোর কথা নয়, তবু ইন্দ্রাণী ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে। এগ্রিমেন্টের কাগজ যে আসবে এ তো জানা কথা, তবু কিছুতেই শিহরনটাকে সে আটকাতে পারল না। বড় আলো জ্বেলে শিথিল পায়ে খাটে এসে বসেছে। পড়ছে। চোখের সামনে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে অক্ষরগুলো।
কন্দর্প পাশে এসে বসল, –অশোকদার কাজে কোনও ফাঁক নেই। তোমার সঙ্গে সেদিন যা কথা হয়নি সেগুলোও জুড়ে দিয়েছে।
ইন্দ্রাণী সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল, কী রকম?
–যদি সত্যি বাড়ি ভাঙা হয়, তাহলে নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হওয়া অবধি আমরা থাকব কোথায়?
ইন্দ্রাণী ফ্যাল ফ্যাল তাকাল, –কোথায় থাকব?
–সেই পয়েন্টটাই তো অশোকদা অ্যাড করে দিয়েছে। যদ্দিন না নতুন ফ্ল্যাটের পজেশান পাব, তদ্দিন আমরা যে ভাড়াবাড়িতে থাকব তার রেন্ট উইল বি পেইড বাই মুস্তাফি কন্সট্রাকশান।
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল ইন্দ্রাণীর। অস্ফুটে বলল, দীপুরা যদি আলাদা ভাড়া থাকতে চায়?
–থাকবে। ক্লজটা ভাল করে পড়ে দেখো না। পরিষ্কার বলে দিয়েছে এক সঙ্গেও থাকতে পারি, আলাদাও থাকতে পারি, তবে রিজনেবল রেটে রিজনেবল স্পেসে থাকতে হবে। মেজ গিন্নি যদি প্রাসাদে থাকতে চায় তাহলে আলাদা কথা। বলতে বলতে আসছে কন্দর্প, –সে অবশ্য চাইবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। ফ্ল্যাট হচ্ছে সেই পুলকেই..। বাই দা বাই, তোমার প্রিন্স খুশি তো? তার তো আজকাল বাড়িতে টিকি দেখা যাচ্ছে না!
ইন্দ্রাণীর চোখে বাষ্প জমছিল। ছোট্ট নিশ্বাস টেনে বলল, কাল কি সব ড্রাফট ফাফট তৈরি করবে।
–কবে রওনা দিচ্ছে? নিউ ইয়ারস ডে-তে?
–না। তিরিশ তারিখের টিকিট কেটে এনেছে। করমণ্ডলের। একটু আগে আগেই যেতে চায়।
কন্দর্প নির্বাক বসে রইল কয়েক মিনিট। একটু যেন চিন্তামগ্ন। হঠাৎ বলল, তুমি কি আজই বাবাকে বলবে বউদি?
–ভাবছি।
–দেরি কোরো না। শুভস্য শীঘ্রম, অশুভস্য কালহরণং। বাবার মুড বুঝে কথাটা বলেই ফেলো। এসপার ওসপার একটা হয়ে যাক।
ইন্দ্রাণীর হঠাৎ যেন খুব শীত করে উঠল। বন্ধ জানলা ভেদ করে বুঝি ছুটে এসেছে হিমালয়। ঝনঝন কেঁপে উঠল হাড় পাঁজরা। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে শরীরের গ্রন্থি।
আচম্বিতে কন্দর্পর হাত চেপে ধরেছে ইন্দ্রাণী, আমার ভীষণ ভয় করছে চাঁদু। বাবাকে আমি রাজি করাতে পারব তো?
.
তিলক সাউয়ের, ছাদ থেকে পৃথিবীকে দেখছিল আদিত্য। কী বিশাল এক আবছায়া বৃত্তাকার ব্যাপ্ত হয়ে আসে চরাচরে। খানিক আগে সোনালি খঙ্গের মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে। নীচের মাঠে ঘাটে তারই নীলাভ কিরণ। এ সব মুহূর্তে মনটা কেমন বিবশ হয়ে যায়। মায়া জাগে। বড় মায়া।
পাশের পুকুরের স্থির জলে নিথর হয়ে আছে চাঁদ। আদিত্যর বুকটা হু-হু করে উঠল। ছাদ থেকে ছোট্ট একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারল চাঁদের দিকে। সরে যাক এই মায়া। সরে যাক।
চাঁদ ভেঙে গেছে। খণ্ড খণ্ড চাঁদ ছটফট করছে জলে। আদিত্য তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। চুর্ণ-বিচুর্ণ চাঁদ আবার জোড়া লাগছে ক্রমশ। দেখতে দেখতে আবার পূর্ণ মায়া।
আবার ঢিল ছুঁড়ল আদিত্য। আবার ভেঙে গেছে চাঁদ। জল শান্ত হল। আবার সেই পূর্ণ মায়া। কেন যে বার বার ফিরে আসছে চাঁদটা! তবে কি এই মায়া থেকে মুক্তি নেই আদিত্যর।
রঘুবীর গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে, কী হল রায়দা? কখন জলখাবার দিয়ে গেছে, খাবেন না?
আদিত্য কার্নিশ থেকে ঝুঁকল–ভাল লাগছে না। বাড়িই ফিরি।
–সেকি! কেন? এখনও মন খারাপ করে আছেন?
আমার কি আর মন আছে রে ভাই, যে মন খারাপ হবে?
-ছেলেমানুষের মতো অভিমান করছেন রায়দা। কতবার তো বললাম ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এ রকম সাত-আটটা কাজ পার হয়ে গেলে আমাদেরই দু-তিন লাখ টাকার ক্রেডেনশিয়াল তৈরি হয়ে যাবে। তখন দরকার হলে আমরা অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করব। তিলক সাউ কি গোটা পৃথিবী কিনে রেখেছে নাকি? ধরুন যদি আমরা বাগনানের দিকে গিয়ে কাজ করি…
আমার আর ওই এক কথা ভাল লাগছে না ভাই। কত কিছু ভেবে ফেলেছিলাম। এত দৌড়োদৌড়ি করলাম, খরচাপাতি করলাম…
–অর্ডারটার জন্য আপনাকে তো কোনও কন্ট্রাকটার ধরতেই হত দাদা। তিলক সাউ না হলে কোনও পুলক সাউ…
তবু…
তবুও কি আছে? যা টাকা আসার কথা ছিল তা তো এসেই গেছে। আমাদের আম খাওয়া দরকার, গাছ গুনে কাজ কী?
–তাও পেলাম কত? কী রইল?
–আপনার আঠেরোশো, আমার আঠেরোশো। আর ওই শালা ঘুমন্ত পার্টনারের শ তিনেক।
কত খরচ হয়েছে তার হিসেব আছে?
তাই বলুন রায়দা, আপনি লাভ-ক্ষতির হিসেব কষছেন।
আদিত্য মলিন জ্যোৎস্নার মতোই স্রিয়মাণ। লাভ-ক্ষতির হিসেব জানলে তার জীবনটা কি এই খাতে বইত?
রঘুবীর পিঠে হাত রাখল, সব লস পুষিয়ে যাবে রায়দা। আরও দুচারটে অর্ডার আসতে দিন।
কী হবে? লাভের গুড় তো সরকারি পিঁপড়েগুলো খেয়ে যাবে।
–আরে নাহ। কানেকশানগুলো খালি তৈরি হতে দিন। তারপর দেখুন কেমন লাল করে দিই আপনাকে। রঘুবীর টানল আদিত্যকে, চলুন, আর ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। শীতে জমে যাবেন।
–ঘরে যাব না ভাই। বাড়িই যাই। মনটা কেমন আনচান করছে। এখন গেলে বাস পাব না?
রঘুবীর অম্লানবদনে মিথ্যে বলে দিল, কলকাতার লাস্ট বাস কখন চলে গেছে। এখন যেতে হলে তিন-চারবার বাস বদল করতে হবে। অতগুলো টাকা সঙ্গে রয়েছে, কোথায় কি ঘটে…!
তিলক সাউকে আমার ভাল লাগছে না চাটুজ্যেমশাই। ঠিকাদার, না খুনে ডাকাত? বিকেলে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরোল, স্বচক্ষে দেখেছি কোমরে রিভলভার গোঁজা।
সঙ্গে কাঁচা পয়সা থাকলে আর্মস রাখবে না? ও খুন-খারাপির লোক নয়, এককালে একটু মাথা গরম ছিল, এখন নিপাট গেরস্থ। ছেলেমেয়েকে দেরাদুনের কনভেন্টে পড়ায়। ডি এম, জেলা সভাধিপতি এখানে এলে একবার এ বাড়ি ঘুরে যাবেই।
–আপনি তো ওর হয়ে বলবেনই। পুরনো লেনদেনের লোক, পুরনো দোস্ত..
–ভুল ভাবছেন রায়দা। রঘুবীর গোমড়া, আমার কুলগাছিয়ার খুড়তুতো ভাই এক সময়ে নেমেছিল এই লাইনে, তখনই তিলকের সঙ্গে আমার ভাবসাব।
আদিত্যর ঠোঁট বেঁকে গেল, –সে এই লাইন ছাড়ল কেন?
–তার ধৈর্য কম। লোভ বেশি। সে এখন ব্যাংক লোন নিয়ে মুরগি পালছে। ধারে কাছে জনমনিয্যি নেই, তবু গলা নামাল রঘুবীর, –এই তো এক্ষুনি এসে পড়বে তিলক, দেখবেন কেমন দিলদরিয়া মেজাজ। রাত একেবারে মাতিয়ে দেবে। খাঁটি বিলিতি খায়, একেবারে ফরেন।
সঙ্গীসাথী কমে গেছে তো, লোক পেলে তাই ছাড়তে চায় না।
আদিত্যর দৃষ্টি আবার পুকুরের চাঁদের দিকে। মৃদু হাওয়ায় থির থির কাঁপছে চাঁদ।
আমতা আমতা করে আদিত্য বলল, বাড়িতে কিন্তু খুব ভাববে।
–দোতলায় ফোন আছে, দেখুন না কলকাতায় টেলিফোন করা যায় কিনা।
পুকুরের চাঁদ এখন থির বিজুরি। ওই নির্দয় মায়া কার মুখ অসায়? তিতিরের? ইন্দ্রাণীর? বাপ্পার?
বাপ্পার টাকাটা শেষ পর্যন্ত শুভাশিসের কাছ থেকেই নিল ইন্দ্রাণী! আদিত্যকে একবার মুখ ফুটে জানাল না পর্যন্ত!
কবেই বা কোন কথা জানিয়েছে? শুভাশিস বলে যে অত কাছের একটা বন্ধু আছে ইন্দ্রাণীর, তাও কি বিয়ের চার বছরে একবারও ভূলে উচ্চারণ করেছিল? নিজেই চেষ্টাচরিত্র করে স্কুলে চাকরি জোগাড় করল, মার মুখে কাজের খবরটা জানতে পারল আদিত্য! একের পর এক গয়না বেচেছে, বেচার আগে বলেছে কোনওদিন?
কেন এত উপেক্ষা? আদিত্য অক্ষম, তাই? আদিত্য ইন্দ্রাণীর উপযুক্ত নয়, তাই? নাকি আদিত্য শুভাশিস নয়, তাই?
আদিত্য একবার শুভাশিসের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল বলে মানে লেগেছিল ইন্দ্রাণীর।
থাক। কোন বাড়িতে টেলিফোন করবে আদিত্য! যে বাড়িতে প্রতি পলে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় সে একটা পাজির পাঝাড়া। নিষ্কর্মার গোঁসাই। একটা আস্ত হারামজাদা। কেন্নোর বেহদ্দ? দুৎ, ওই বাড়িতে কেউ ফোন করে।
হিমে আদিত্যর শরীর অবশ। আর একটা ঢেলা কুঁড়িয়ে প্রাণপণ শক্তিতে চাঁদের দিকে ছুঁড়ল আদিত্য। ভাঙাচোরা চাঁদ হাসছে খলখল।
.
৪২.
রাত নটা নাগাদ কম্পিত পায়ে জয়মোহনের ঘরে এল ইন্দ্রাণী। একটু আগে জয়মোহনের খাওয়া শেষ হয়েছে, এক পর্ব বাথরুমের পালাও সারা, এখন তাঁর ওষুধ খাওয়ার সময়। অনেক রকমের ওষুধ। প্রেশারের। হার্টের। অম্বলের। সব শেষে খাবেন ইশবগুল, এতেই তাঁর কোষ্ঠ সাফ হয় ভাল। অন্য দিন ইন্দ্রাণীকে দেখলে তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেয়, আজ হাড় হিম করা ঠাণ্ডাতেও তাঁর মুখে ভাদ্রের গুমোট। ইন্দ্রাণীর উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন, –এসো বউমা, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।
ইন্দ্রাণীর স্বর দুলে গেল, কী বাবা?
আষ্টেপৃষ্ঠে শীতবস্ত্রে নিজেকে মুড়ে রেখেছেন জয়মোহন। বন্ধ ঘরেও বাঁদুরে টুপি তাঁর মুখে সাঁটা। কোটরগত চোখ আর তীক্ষ্ণ নাকে তাঁর মুখটি যেন ধনেশ পাখির আকার নিয়েছে। শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বললেন, বোসো।
ইন্দ্রাণী বসল না। সঙ্কুচিত পায়ে শ্বশুরমশাইয়ের খাটের ধারে গিয়ে দাঁড়াল।
ইজিচেয়ারের হাতলে হাত দুটি রাখলেন জয়মোহন, তুমি কাল একবার চিত্ততোষকে খবর পাঠাতে পারবে বউমা?
ইন্দ্রাণীর বুকটা ধক করে উঠল। চিত্ততোষ জয়মোহনের লেকের বন্ধু। অ্যাডভোকেট। এখনও নিয়মিত হাইকোর্টে যান। তাঁকে হঠাৎ কি দরকার পড়ল জয়মোহনের?
ইন্দ্রাণীকে চুপ দেখে জয়মোহন আবার বললেন, শুনেছ, কী বলছি?
–শুনেছি বাবা।
–চিত্ততোষের সামনে আমি একটা উইল করতে চাই। ডাক্তারকেও ডেকো। সেও একজন সাক্ষী হবে। ভাগ-বাঁটোয়ারা আমি সেরে ফেলব। ওই হারামজাদাকে আমি কানাকড়িও দেব না।
ও। বড়ছেলের ওপর রুটিন ক্রোধ! এই নিয়ে কত বার যে আদিত্যকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন জয়মোহন! উকিলটাই এবার যা নতুনত্ব।
মুখে হাসি টেনে ইন্দ্রাণী বলল, – যার ওপর রাগ করছেন, সে কি আপনার রাগের মর্ম বুঝেছে কোনওদিন?
–এই বার বুঝিয়ে ছাড়ব। এত বড় আস্পর্ধা আমাকে মুখের ওপর … জয়মোহন সহসা কোঁৎ করে কথাটা গিলে নিলেন। বুকের হাপর বার দুই টেনে বললেন, ভাবছে আমি মরলে ও মোচ্ছ করবে? ওটি হতে দেব না। মেজ মেজর জায়গায় থাকবে, ছোট ছোটর জায়গায়। বাকি সব অংশ আমি তোমার নামে লিখে দেব।
ইন্দ্রাণী শুকনো হাসল, আমাকে দেওয়া মানে তো তাকেই দেওয়া বাবা।
–তা হোক। আমি চাই চিরকাল ও তোমার হাততোলা হয়ে থাক। বেশ খানিকটা ঝাল উগরে কিছুটা স্থিত হয়েছেন জয়মোহন। একটু হাসিও যেন খেলে গেল তাঁর জীর্ণ মুখে, উইলের দিনও আমি স্থির করে ফেলেছি।
কবে?
–তোমরা আমার পঁচাত্তর বছরের জন্মদিন করবে বললে, সেই দিন। সবার সামনে আমি ওকে বেইজ্জত করতে চাই। আমাকে ভেবেছেটা কী, অ্যাঁ? নখ দাঁত পড়ে গেছে বলে আমার কোনও মুরোদ নেই!
–বেশ তো, তাই করবেন। ইন্দ্রাণী যেন অ্যাটমকে ভোলাচ্ছে, জন্মদিনের তো এখনও দেরি আছে।
–দেরি কোথায়? আর তো এক মাস ছদিন।
হাঁ, তাও তো বটে!
জন্মদিনটা তোমরা ঘটা করে করবে তো? জয়মোহন পলকে রাগ ভুলেছেন। শিশুর হাসিতে ভরে গেছে মুখ। বার্ধক্যেও কোথায় যে লুকিয়ে থাকে এই শৈশব!
ইন্দ্রাণী বলল, – নিশ্চয়ই করব। পঁচাত্তরটা মোমবাতি জ্বালাব।
দীপু বলছিল নাহুমের কেক আনবে। ওখান থেকেই আনা ভাল, কী বল? কতদিনকার পুরনো দোকান! জানো বউমা, কলেজে পড়ার সময়ে মেট্রোতে এম জি এমের সিনেমা দেখে আমরা দল বেঁধে হগসাহেবের মার্কেটে ঢুকতাম। শুধু ওই দোকানের কেক খাওয়ার জন্য। আহ, কতকাল যে খাইনি।
উইল-টুইলের চিন্তা বেবাক হাপিশ। ইন্দ্রাণী শ্বশুরমশাইয়ের মেজাজটাকে আর একটু ভাল করতে চাইল, আমি সেদিন আপনাকে একটা গরদের পাঞ্জাবি কিনে দেব। পরবেন।
–গরদ নয়, আদ্দি দিও। জয়মোহন হাসছেন টিপ টিপ, — তা মাঘের শীতে কি আর শুধু পাঞ্জাবি গায়ে দিতে পারব?
চাঁদু আপনাকে শাল কিনে দেবে।
–খোকন কিছু দিলে আমি কিন্তু নেব না।
জয়মোহন চোখ বুজলেন। ক্ষণে ক্ষণে মুখভাব বদলে যাচ্ছে তাঁর। কখনও বা অপার্থিব হাসি ফুটছে মুখে, কখনও বা কুঁচকে যাচ্ছে কপাল।
একটা কষ্ট জমাট বাঁধছিল ইন্দ্রাণীর গলায়। প্রথম যেদিন এই মানুষটাকে দেখেছিল, তার সঙ্গে আজকের এই জয়মোহনের কত তফাত! তার বিয়ের দিন কী দাপটের সঙ্গে হাঁকডাক করে বেড়াচ্ছিলেন! কুণ্ঠিত বাবার সঙ্গে একবার মণ্ডপের এ মাথায় দৌড়োচ্ছন, একবার ও মাথায়। বরযাত্রীদের মধ্যে তিন-চারটে ছেলে, সম্ভবত আদিত্যদের কোনও দুর সম্পর্কের ভাই, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অসভ্যতা শুরু করেছিল, পাতে বারবার রসগোল্লা নিয়ে নাকি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল বাইরে, জয়মোন তাদের ঘাড় ধরে খাওয়া থেকে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। কী ব্যক্তিত্ব ছিল মানুষটার! যেদিন ইন্দ্রাণীকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখতে গিয়েছিলেন, সেদিনও কী চোখা কথাবার্তা! দেনাপাওনার কথা তুলবেন না ধীরাজবাবু, রায় বাড়িতে ছেলে বিক্রির প্রথা নেই। দাপুটে প্রৌঢ়ের দেহে তখনও কী যৌবনের গরিমা! কাল সেই মানুষটার রঙ চুন বালি পলেস্তারা সব খসিয়ে দিল! এখন পড়ে আছে শুধু নোনা ইট। সংসারের আঘাতে জর্জরিত এক ধ্বংসস্তূপ।
এই কাঙালটাকে কী করে এখন আঘাত করে ইন্দ্রাণী! উপায় নেই। উপায় নেই। ইন্দ্রাণীও যে শিকলে বাঁধা পড়ে গেছে।
চাপা গলায় ইন্দ্রাণী ডাকল, -বাবা …
উ?
–একটা কথা বলব? আপনি একটু শান্ত হয়ে শুনবেন?
বলল। শুনছি তো।
বাপ্পা মাদ্রাজ চলে যাচ্ছে জানেন তো?
ট্রেনিং কি শুরু হয়ে গেল?
–না। সামনের মাস থেকে হবে। ইন্দ্রাণী ঢোঁক গিলল, আমি একটা বিপদে পড়েছি বাবা। আপনাকে বাঁচাতে হবে।
জয়মোহনের চোখ খুলে গেল। চঞ্চল চোখে দেখছেন পুত্রবধুকে।
ইন্দ্রাণী মাথা নামিয়ে নিল, চাকরিটা ভাল। কিন্তু ট্রেনিং-এ অনেক খরচ বাবা।
কত?
–এখন তো হাজার চল্লিশেক লাগবে। পরে আরও কত লাগে কে জানে!
–অত টাকা! পাঠাচ্ছ কেন তবে?
উপায় নেই বাবা। ছেলের বড় জেদ। আমিও কথা দিয়ে ফেলেছি।
কথা তো আর ফেলা থুতু নয় যে ফেরত নেওয়া যাবে না! কথা ফিরিয়ে নাও।
–তা হয় না বাবা। শালের নীচে ধরে থাকা এগ্রিমেন্টের কাগজটাকে চাপল ইন্দ্রাণী, বাপ্পাকে নিয়ে আমার বড় ভয়। তার ইচ্ছে পূরণ করতে না পারলে সেও যদি আপনার বড় ছেলের মতন ..
জয়মোহন নির্বাক। নিস্পন্দ।
ঘরটা চকিতে থমথমে হয়ে এল। টিউব লাইটের আলোও হঠাৎ বড় মলিন।
ক্ষণিকের এই নৈঃশব্দ্যও সহ্য হচ্ছিল না ইন্দ্রাণীর। দেওয়ালঘড়ির কাঁটার আওয়াজ কট কট কানে বাজছে। কাকুতির স্বরে ইন্দ্রাণী বলল, আমি ভীষণ বিপাকে পড়ে গেছি বাবা। এখন আপনিই আমার ভরসা।
জয়মোহন অসহায় চোখে তাকালেন, তুমি তো আমার অবস্থা জানো বউমা। আমার আর কিছুই নেই।
বাইরের রাস্তায় আচমকা একটা গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। উচ্চৈঃস্বরে চেঁচাচ্ছে লোকজন। বোধহয় কোনও রিকশাঅলার সঙ্গে ঝামেলা লেগেছে পথচারীদের, প্রায়ই লাগে। অন্য সময়ে ওই কোলাহলে বিরক্ত হয় ইন্দ্রাণী, এই মুহূর্তে যেন খানিকটা স্বস্তি বোধ করল। ঝগড়া একটু নিচুগ্রামে নামতেই ঝপ করে বলে ফেলল, – আপনি চাইলেই উপায় আছে বাবা। প্রোমোটাররা তো ঘোরাঘুরি করছেই, বাড়িটা যদি আপনি ওদের হাতে ছেড়ে দেন …
কী বললে তুমি! জয়মোহন চিৎকার করে উঠেছেন। শীর্ণ দেহযষ্টি কাঁপছে থরথর, তুমি এ কথা উচ্চারণ করতে পারলে বউমা? তুমিও …!
পাশার দান পড়ে গেছে। চাল ফেরতের রাস্তা নেই। ইন্দ্রাণী মরিয়াভাবে বলল, না বলতে পারার কি আছে বাবা? এ তো শুধু আমি একা চাইছি না, আপনার ছেলেরাও চায়। আপনিই ভেবে দেখুন, আপনি উইল করুন আর যাই করুন, আপনি না থাকলে ছেলেরা কি বাড়িতে এক সঙ্গে থাকবে? তা ছাড়া প্রস্তাবও তো খুব খারাপ দেয়নি প্রোমোটার। চারটে ফ্ল্যাট দেবে, চারটেই আপনার নামে থাকবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে আরও এক লাখ টাকা করে ক্যাশ। সেও আপনি পাবেন। এই শেষ বয়সে আপনার হাতে কিছু টাকা থাকলে আপনারও কত জোর থাকে। আপনি আমার সঙ্গে থাকতে পারেন। দীপুর সঙ্গে থাকতে পারেন। যার সঙ্গে খুশি। আমি অবশ্য ঠিক করেছি এবার আপনাকে আমার কাছেই রাখব। আমি জানি আপনার অবহেলা সহ্য হয় না। একবার ভাগাভাগির সময়ে আপনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে যে দোষ করেছি, সে অন্যায় আর হতে দেব না বাবা। দীপু চাঁদুর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে …
হঠাই ইন্দ্রাণীর মনে হল, বড় বেশি কথা বলে ফেলেছে সে। যেন তার কথা শুনছেনও না জয়মোহন। যেন ফাঁকা এক ঘরে অর্থহীন প্রলাপ বকে চলেছে ইন্দ্রাণী।
একদম থেমে গেল ইন্দ্রাণী। বেশ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ। জয়মোহনের চোখে মরা মাছের দৃষ্টি। ইন্দ্রাণী চোখ সরিয়ে নিল। নিজেকে শোনাচ্ছে এমন নিচু স্বরে বিড়বিড় করে বলল, প্রোমোটারের কাছ থেকে টাকা আমি নিয়ে ফেলেছি বাবা। জীবনে আমি কখনও আপনার কাছে কিছু চাইনি, শুধু এই একটি বার …
–থামো। জয়মোহন স্পষ্ট স্বরে বললেন, আমাকে এখন কী করতে হবে?
দ্বিধা ঝেড়ে শালের তলা থেকে এগ্রিমেন্টের কাগজটা বার করল ইন্দ্রাণী, আপনাকে আমি জোর করব না বাবা। এটা আপনি পড়ে দেখুন। উচিত মনে হলে সই করবেন।
–তার দরকার নেই। তুমি কলম নিয়ে এসো।
এ রকমই হবে ভেবেছিল কি ইন্দ্রাণী? না হলে কেন কলম এনেছিল সঙ্গে?
স্তম্ভিত ইন্দ্রাণী দেখছিল সই করতে একটুও হাত কাঁপছে না শ্বশুরমশাইয়ের। প্রতিটি পাতায় যেন অভ্যস্ত হাতে কলম চালাচ্ছেন।
সই শেষ করে পেনের নিবটা ভেঙে দিলেন জয়মোহন।
.
বাইরে কোথাও ঝিঁঝি ডাকছিল। বাইরে, না ভেতরে? বন্ধ ঘরেও এত জোরে শব্দ আসে কোন পথ দিয়ে? আধো তার ঘোর কাটিয়ে কান খাড়া করল আদিত্য। আরও কি একটা শব্দ হচ্ছে না? বাতাস কাটছে জানলায়? নাহ, এ যেন অন্যরকম।
কম্বল সরিয়ে ধড়মড় উঠে বসল আদিত্য। অন্ধকার এত নিকষ যে কিছুই দেখা যায় না। কলকাতার বাড়িতে কোত্থেকে যেন আলো এসে অন্ধকারকে মিহি করে রাখে, এত আঁধারে কি ছাই অভ্যেস আছে আদিত্যর! এমনিতেই নতুন জায়গায় তার ঘুম আসে না, যাও বা একটু চোখ লাগল তাও এই অচেনা ফিসফাস!
বাইরে কেউ কথা বলছে কি? এত রাতে এ কি রহস্য রে বাবা!
কম্বলটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বিছানা থেকে নামল আদিত্য। সঙ্গে সঙ্গে টাল খেয়ে গেছে মাথা। পা কেঁপে গেল। খাটে হাত চেপে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল আদিত্য। বেহিসেবি হয়ে হুইস্কির সঙ্গে অনেকটা রামও খেয়ে ফেলেছে আজ। দুই সুরা খিচুড়ি পাকিয়ে গেছে মাথায়। কথা বলতে গিয়ে গলাটাও জড়িয়ে গেল।
–কে? কে রেহ?
কারুর সাড়া নেই। আদিত্য কান পেতে রইল। শব্দটা রয়েছে। রয়েছেই। রঘুবীর কোথায় গেল? শালা মাল টেনে পুরো আউট আজ। আদিত্যর আগেই। অসুরটা লুটিয়ে পড়ল, আর ওই শালা তিলক সাউ বোতলকে বোতল সাফ করেও দু ঠ্যাঙে খাড়া। বাহাদুর বটে! ওই খচ্চরটাই কি শব্দ করে ভয় দেখাচ্ছে!
–দাঁড়া শালা, আদিত্য রায় উঠছে।
হ্যাঁচকা মেরে শরীরটাকে টেনে তুলল আদিত্য। খলিত পায়ে সাঁতরাচ্ছে অন্ধকার। সাঁতরে সাঁতরে সুইচ বোর্ড ছুঁল। টিপিস টিপিস জ্বলে উঠেছে টিউবলাইট। চোখ কুঁচকে ঘরটাকে কয়েক সেকেন্ড জরিপ করল আদিত্য। সুবিশাল মাটন রোলের মতো জানলার ধারের খাটটায় কম্বল মুড়ে ঘুমোচ্ছ রঘুবীর। ওই ব্যাটারই নাক ডাকার আওয়াজ হচ্ছে না তো?নাহ, তাও তো নয়। তবে?
ঝিঁঝির ডাক থেমে গেল অকস্মাৎ। ফিসফিসানিটাও থমকেছে যেন। খটাং করে দরজা খুলে আদিত্য বাইরে উঁকি দিল। কেউ কোথাও নেই।
টলমল পায়ে সুনসান ছাদে এসে দাঁড়াল আদিত্য। ঠিক মধ্যিখানে। শীতের কুয়াশা মেখে রাত বড় আধিভৌতিক এখন। প্রাণহীন, অশরীরী, তবু যেন কেমন জীবন্ত। ক্ষীণ জ্যোৎস্না মাখা পৃথিবীকে ওড়না ঢাকা প্রেতিনীর মতো লাগে। বাড়ির গা ঘেঁষে খাড়া দাঁড়িয়ে এক নারকেল গাছ। তার ছায়া পড়েছে ছাদের এক কোণে। কী গাঢ় কালো ছায়া!
আদিত্যর গা ছমছম করে উঠল। এ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে? বাড়ি ছেড়ে? সংসার ছেড়ে? এ কী দুর্মতি হল তার? বাড়িতে সবাই নিশ্চয়ই খুব ভাবছে। তিতির! ইন্দ্রাণী! হয়তো বাবাও!
ওফ, আবার সেই শব্দ!
–কে? কে তুমি?
আদিত্য কার্নিশের ধারে চলে এল। ঝুঁকেছে অনেকটা। নীচের জলে চাঁদটা নেই, সেখান থেকেই ফিরে এল শব্দটা। ফিসফিস করছে, তবু স্পষ্ট, অতি স্পষ্ট।
খোকন। খোকন।
.
সকালবেলা জয়মোহনকে চা দিতে গিয়ে মিনতি চমকে উঠল। ইজিচেয়ারেই ঘুমোচ্ছেন জয়মোহন! গায়ের শাল লুটোচ্ছে মাটিতে, হাতলের বাইরে ঝুলছে দুই হাত, পা দুখানাও কেমন অদ্ভুতভাবে ছড়ান। বাঁদুরে টুপি পরা রয়েছে এখনও। গলাবন্ধ সোয়েটারটাও। মিনতির এক ঝলক মনে হল, খুব ভোরে বোধহয় উঠেছিলেন জয়মোহন। তারপর ইজিচেয়ারে বসেই ..
মিনতি ডাকল, – আপনার চা।
জয়মোহন জাগলেন না।
মিনতির কেমন সন্দেহ হল। কাছে গিয়ে শরীরে হাত ছুঁইয়েই শিউরে উঠেছে। গা যে বরফের মতো ঠাণ্ডা। শক্ত, যেন কাঠ।
মাঝরাতে কখন নিঃশব্দে চলে গেছেন জয়মোহন।
.
৪৩.
কী হল দত্তমশাই, একেবারে শয্যা নিলেন কেন?
-বড় ব্যথা ডাক্তারবাবু। কোমরটা বোধহয় অচলই হয়ে গেল।
ব্যায়াম যেগুলো করতে বলেছিলাম, করছেন?
–দেহ যে নড়ে না ডাক্তারবাবু।
বয়স তো এখনও ষাটও ছোঁয়নি, এর মধ্যে অথর্ব হয়ে পড়লে চলবে? খাটের ধারে চেয়ার টেনে বসলেন শিবসুন্দর, একবার উপুড় হন তো দেখি।
-পারব?
–খুব পারবেন। তুফান, দত্তমশাইকে একটু হেল্প করা।
তুফানকে হাত লাগাতে হল না, নিজের চেষ্টাতেই অতিকায় বালাপোশের মতো শরীরটা নড়িয়েছে মদন দত্ত, আহ উফ শব্দ করছে মুখে। শিবসুন্দর ভাল করে টিপেটুপে দেখলেন মাজাটাকে। পরতে পরতে চর্বি, হাড়ের অস্তিত্ব টের পাওয়া কঠিন। এমন হাল হবে নাই বা কেন, সারাক্ষণ তো থেবড়ে বসে আছে রামনগর বাজারে। হয় নিজের সারের গদিতে, নয় হার্ডওয়ারের দোকানে। অলকার সবজিবাগানের সুবাদে দত্তর সারের দোকানে তুফানের নিত্য আসা যাওয়া, সে স্বচক্ষে দেখেছে দুপুরবেলা দু টিফিন কেরিয়ার বোঝাই খাবার যায় দত্তর বাড়ি থেকে। যে লোক গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে শুধু শরীর ফোলায় আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই ভঙ্গিমায় গেদে বসে থাকে, তার কোমরের পেশি তো দরকচা মেরে যেতে বাধ্য।
দত্তকে আবার চিত করিয়ে প্রেশার মাপলেন শিবসুন্দর। ঠিকই আছে মোটামুটি। লোকটার সুগারও নেই, অন্তত পুজোর আগে শেষ যখন তাঁর কাছে গিয়েছিল, তখনও পর্যন্ত ছিল না। ব্লাড টেস্টও করিয়ে ছিলেন, ইউরিক অ্যাসিড-ফ্যাসিড সব স্বাভাবিক। এক্স রে-তেও হাড়ে কিছু পাওয়া যায়নি। কেস হিস্ট্রি মাথায় রেখে ব্যাগ থেকে ছোট্ট হাতুড়িটা বার করলেন শিবসুন্দর, ঠুকে ঠুকে শরীরের কয়েকটা গাঁট পরীক্ষা করলেন। সঙ্গে একটি ধাতব পাত থাকে, সেটি ঘষলেন পায়ের তলায়।
মদন দত্ত মিনমিন করছে, কী বুঝছেন ডাক্তারবাবু?
–আপনার কিস্যু হয়নি। সকাল বিকেল মিলিয়ে রোজ পাঁচ মাইল করে হাঁটুন। ভাত ছেড়ে রুটি খাওয়া শুরু করুন। কোমরের ব্যায়ামগুলো যা বলেছিলাম, নিয়মিত করে যান। ওজন কমান। নো মিষ্টি। তবে সবার আগে আপনার বসার পসচারটা বদলাতে হবে। দোকানে টেবিল চেয়ারের বন্দোবস্ত করতে পারেন না?
আর ওষুধ?
-কোনও ওষুধ দেব না। আগেও তো বলেছিলাম ভারী শরীর নিয়ে একভাবে বসে থেকে থেকে আপনার ব্যাক সাইডের মাসলগুলো স্টিফ হয়ে গেছে। ওগুলোকে আগে ছাড়ানো দরকার। ওই জন্যই যত ব্যথা।
মদন দত্ত চেষ্টা করে বিছানায় আধশোয়া হল। ভেতর-দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী, খাটের ওপারে বড় ছেলে। ভারী মুখখানা ঝুলিয়ে তাদের এক ঝলক দেখে নিল মদন দত্ত। বলল, তমাল ডাক্তার যে অন্য কথা বলে গেল!
শিবসুন্দর থমকালেন। তমাল ছেলেটি অতি সম্প্রতি চেম্বার খুলেছে রামনগরে। সপ্তাহে দু দিন করে বসে। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। তারকেশ্বরে বাড়ি। ডাক্তারি পাস করে এসে তারকেশ্বরেই চেম্বার খুলেছিল, পশার জমে ওঠার পর এখন চারদিকে চেম্বার ছড়াচ্ছে। তারকেশ্বর শেওড়াফুলি আর কোথায় কোথায় যেন নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত আছে ছেলেটা। একদিন এসেছিল শিবসুন্দরের বাড়িতে, আলাপ পরিচয় করে মন্দ লাগেনি ছেলেটাকে। বেশ ভদ্র। বিনয়ী। শিবসুন্দরের বেশ আত্মবিশ্বাসীও মনে হয়েছে তাকে। আত্মবিশ্বাসই তো ডাক্তারের মহা গুণ। তা তাকেই যখন দেখানো শুরু করেছে, তখন আবার শিবসুন্দরকে ডাকা কেন?
শিবসুন্দর গম্ভীর মুখে বললেন, কী বলল তমাল?
-উনি বলছিলেন কলকাতায় গিয়ে আমাকে একটা বোন স্ক্যান করাতে হবে। ব্লড এক্স রে-ও সব করতে হবে আবার।
আপনি আগের রিপোর্টগুলো দেখাননি?
–দেখিয়েছিলাম। উনি বললেন ওসব পুরনো হয়ে গেছে। তারকেশ্বরে ওর চেনা ল্যাবরেটরি আছে, সেখান থেকে সব করিয়ে আনতে হবে।
–বেশ তো। তা হলে আর আমাকে ডাকার কি প্রয়োজন ছিল?
মদন দত্ত যেন সামান্য অপ্রস্তুত, –তমাল ডাক্তারের থেকে আপনার ওপর আমার অনেক বেশি আস্থা ডাক্তারবাবু। ছেলে একদিন জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাই গিয়েছিলাম…এই তো দু মাস ধরে তার ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি, অবনতি বই উন্নতি বুঝলাম না।
মদন দত্তর বড় ছেলেটি মুখচোরা ধরনের। সে অপ্রতিভ মুখে বলে উঠল, তা নয় ডাক্তারবাবু, পঞ্চায়েত অফিসে একদিন তমাল ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বাবার ওই ব্যথাটার কথা শুনে উনি বললেন একদিন চেম্বারে নিয়ে যেতে…আমরাও ভাবলাম একটা সেকেন্ড মতামত নিয়ে নিই…
শিবসুন্দর মনে মনে স্থির করে ফেললেন এই রুগীটিকে নিয়ে তিনি আর মাথা ঘামাবেন না। এমনিতেই এসব ধনী লোকেদের ঘরে চিকিৎসা করতে আসতে তাঁর ভাল লাগে না। শরীরে যেটুকু ক্ষমতা অবশিষ্ট আছে তা দিয়ে তিনি কেবল মাত্র গ্রামগঞ্জের দীনদরিদ্র অচিকিৎসিত মানুষদেরই চিকিৎসা করতে চান। মাধবপুরে এসে প্রথম দিকে কিছুকাল এই নীতি কঠোরভাবে মেনে চলেছিলেন তিনি। কিন্তু এই মদন দত্তরা গিয়ে পড়লে তাদের তিনি এড়ানই বা কী করে! কোথায় যেন একটা বাধে। চিকিৎসকের নীতিবোধ? মানবিকতা? সংস্কার?
মদন দত্তর বাড়ির বাইরে এসেই গজগজ করছে তুফান, হ, সেকেন্ড ওপিনিয়ান নিতে চায়। আসল কথা বল না, বেশি টাকা না খসলে তোরা চিকিৎসা পুরো হল বলে মনে করিস না। যা, স্ক্যান করতে গিয়ে এখন আট-দশ হাজার টাকা গলিয়ে আয়।
–তাতে তোর কী? চল ফিরি। শিবসুন্দর তুফানের পিঠ চাপড়ালেন, তোদের তো আবার এখন যাত্রা দেখতে যাওয়া আছে।
হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা চলছে। রোদ্দুর পড়ে এলেই শীত যেন হা-হা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ে। তুফানের মন্থরগতি মোপেডের পিছনে বসেও ঠকঠক কাঁপছিলেন শিবসুন্দর। নীচে একটা গরম গেঞ্জি পরেছেন, তার ওপরে গলাবন্ধ ফুলহাতা সোয়েটার, মাথাও মাফলারে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া, তবু যেন হিমসুঁচ বিধে যাচ্ছে শরীরে। হাত মুখ অবশ ক্রমশ। নাকের ডগা চিনচিন করছে।
প্রবল শীতেও তুফানের কোনও হিলদোল নেই। বকবক শুরু করল, দেখলে তো তোমার তমাল ডাক্তারের কাণ্ড? আমি আগেই বলেছিলাম লোকটা ভাল নয়।
–কেন, খারাপ কী করেছে?
–অত সব টেস্ট কেন করতে বলেছে বুঝলে না? কমিশন খাবে, কমিশন। আমার তো মনে হয় ওর কলকাতার প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর সঙ্গেও জানাশুনো আছে। ওখান থেকেও টু পাইস ঝাড়বে।
–তোর অভ্যেসটাই খারাপ হয়ে গেছে তুফান। শুধু লোকের মন্দটা দেখিস।
–ভাল কিছু যে দেখতে পাই না বাবা। মাটির রাস্তায় সন্তর্পণে একটা গর্ত এড়াল তুফান, ওর পোর মুখে শুনলে তো পঞ্চায়েত অফিসে দেখা হয়েছিল। ডাক্তার কেন পঞ্চায়েত অফিসে যায়?
–হয়তো কোনও কাজ ছিল। হয়তো পঞ্চায়েত অফিস কোনও ক্লিনিক-টিনিক খুলবে।
–আমি সাত গাঁ চরে বেড়াচ্ছি, ক্লিনিক খোলার কথা চললে আমি জানতে পারতাম না? নাকি তোমাকে শোনাত না? হেলথ সেন্টারে সাত মাস ডাক্তার নেই, তাই নিয়ে তাপ-উত্তাপ দেখি না.. আসল কথা কি জানো বাবা, তুমি আছ বলে রামনগরে ওর পশার জমছে না। কজন লোকের ক্ষমতা আছে তিরিশ টাকা ফি দিয়ে ওর কাছে যাওয়ার? আর তুমি থাকতে যাবেই বা কেন। কলে গেলে আবার সাহেবের ডবল ভিজিট! হুঁহ। দায়ে ঠেকেই এখন পার্টির লোকেদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি শুরু করেছে।
–তোর আবার উদ্ভট চিন্তা। কল্পনা করতে শুরু করলে গল্পের গরুকে ডানা লাগিয়ে দিল।
–মিলিয়ে নিয়ো। ইলেকশানে তুমি কোনও পার্টির কোনও কন্মে লাগলে না। সবাই তোমার ওপর এমনিতেই চটে আছে। আগেরবার সুবিধে হয়নি, এবার কোনও না কোনও ছুতোয় একটা বড় ঝামেলা পাকাবে। কেউ না কেউ। তমাল বাগচি হল কাঁটা তোলার কাঁটা।
–অত সোজা! এটা আমার দেশগাঁ, এখানকার লোক আমাকে ভালবাসে, পছন্দ করে। আমি জানি।
–মানুষের ভালবাসাতে বিশ্বাস কোরো না বাবা। মানুষ বড় স্বার্থপর জীব। আপনি কোপনি নিজের ঘরগেরস্থালি সামলে-সুমলে, গুছিয়ে-টুছিয়ে, যতটুকু ভালবাসা দেখানো যায়, ততটুকুই দেখায়। তার বেশি ভালবাসার সাধ্য নেই মানুষের।
তুফান যে খুব একটা ভুল বলছে না, বোঝেন শিবসুন্দর। বিপদ দেখলে ছেলেমেয়েরাই বাবা-মাকে ছেড়ে পিঠটান দেয়, আর এ তো সামান্য গাঁয়ের লোক। মানুষ যেন কেয়োর ভরে নেমে যাচ্ছে দিন দিন। বুকের দুঃখটা চেপে হাসলেন শিবসুন্দর, –এই ঠাণ্ডাতেও তোর তো বেশ গরম গরম লেকচার বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে!
ঠাণ্ডাতেই তো বেরোবে।
–হুঁ। দেখে চালা।
মদন দত্তদের বেলপুকুর থেকে মাধবপুর বেশ খানিকটা পথ। মাঝে একটা আমবাগান পড়ে। জায়গাটা নিরাপদ নয়। ইলেকশানের পর পরই দু-দুটো লাশ পড়েছিল বাগানে। একজন রিভলভারের গুলিতে মরেছিল, অন্য জনের গলার নলি চপারে কেটে দিয়েছিল শত্রুপক্ষ। নির্বাচনী মহাসংগ্রামের জের।
ঝাঁকড়া বৃক্ষরাজির মাঝ বরাবর বয়ে চলা সরু অন্ধকার রাস্তাটা হেডলাইটের আলোয় দ্রুত পার হয়ে গেল তুফান। শিবসুন্দর অন্যমনস্ক। একটা চাপা বিষণ্ণতা যেন কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁকে। গ্রামীণ কূটকচালির কথা ভাবছেন না তিনি, তমাল ছেলেটার কথাই ঘুরে ফিরে মনে আসছে। ছেলেটাকে দেখে অন্য এক ধরনের ধারণা জন্মেছিল মনে, ভেঙে যাচ্ছে। কোন ধারণাই বা জীবনভর অটল থাকে? নিজের ছেলেও যে ডাক্তারিকে ব্যবসা হিসেবে নেবে তাই কি তাঁর ধারণায় ছিল? ধারণা, না প্রত্যাশা? মানুষ পরের প্রজন্মকে নিজের ছাঁদেই গড়ে তুলতে চায়। ভুল। হয় না তা। সময় মানুষকে ভেঙে চলেছে অবিরাম। আজ যে মূল্যবোধটা সত্যি ছিল, কালই হয়তো তার আর কোনও দাম নেই। আজ যে বিশ্বাসকে ধ্রুব মনে হয়, কাল সেটা ভুয়ো হয়ে যায়। তবে কি শিবসুন্দরের নীতিবোধও শুধুই এক মনগড়া ভ্রান্ত অহঙ্কার? আপন সময়ের মায়াকাজল পরে শুভাশিস তমালদের ঠাহর করতে পারছেন না তিনি? হায় রে সময়!
মোপেড বাড়ির সামনে পৌঁছতেই অলকা বারান্দায় বেরিয়ে এল। উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের এত দেরি হল বাবা?
পুলওভারের হাতা গুটিয়ে ঘড়ি দেখলেন শিবসুন্দর, –দেরি কোথায়? সবে তো সাড়ে সাতটা! তোমাদের শো কটায়?
–সে দেরি আছে। নটায়। অলকা যেন সামান্য লজ্জা পেল, ভাবছিলাম আপনারা খেয়ে নেবেন…মার খাবারটাও রেডি করে দিয়ে যাব…
শিবসুন্দর মুচকি হাসলেন। অলকার খুব যাত্রা সিনেমা দেখার নেশা। গত রবিবার বেতিয়ায় গিয়েছিল, আজ যাবে রামনগর। অলকার টিভি দেখার নেশাও খুব, তবে জ্যান্ত এন্টারটেনমেন্টের বোধহয় মজা আলাদা। গ্রামদেশে এই শীতকালটায় কিছু যাত্রাপার্টি আসেও বটে। রোজ কোথাও না-কোথাও চলছে। চাষির ঘরে ধান বিক্রির টাকা উঠলেই অধিকারী বাবুদের যেন হাত শুলোয়। দুটো পয়সা জমানোর উপায় নেই, নাচ গান হাসি কান্না দেখিয়ে চেঁছে নিয়ে চলে যায় সব। তা যাক। শিবসুন্দরের আপত্তি শুধু টুকিকে নিয়ে। এই শীতের রাতে ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে…! আজও সকালে মেয়েটা খকখক কাশছিল।
শিবসুন্দর মেজাজটাকে খারাপ হতে দিলেন না। হাসিমুখেই বললেন, আজ তোমাদের কি পালা?
টুকি মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে। টক করে জবাব দিল, –পালা নয় গো দাদু, যাত্রা।
–ওই হল। শিবসুন্দর এগিয়ে টুকির গাল টিপে দিলেন, যাত্রার নাম কি?
টুকি ঘুরে তুফানের দিকে তাকাল, কী নাম গো বাবা?
বাবা বলবে কেন? তুমিই বলো।
টুকি চোখ পিট পিট করল, বাগি শাশুড়ি নাগি বউ?
তুফান শব্দ করে হেসে উঠল, বাগি নয় রে বোকা, বাঘিনী। বাঘিনী শাশুড়ি নাগিনী বউ। খাসা নাম হয় আজকাল যাত্রাগুলোর। গেল রোববার যাত্রটার নাম আরও মজাদার ছিল। বউ এম এল এ স্বামী জেলে।
বাহ, বেশ জেল্লাদার নাম তো!
–এখন যে জেল্লারই যুগ বাবা।
–ভাল ভাল। দেখ গিয়ে। শিবসুন্দর টুকির চুল ঘেঁটে দিলেন, — ভাল করে মেয়েটার মাথাটাথা ঢেকে নিয়ে যাস। আর অলকা, কাল কিন্তু আমি খুব সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব, মাথায় আছে তো?
অলকা ঘট করে মাথা নাড়ল।
–তুফানকে আবার কারুর সঙ্গে আড্ডায় জমে যেতে দিয়ো না। আমি কিন্তু তোমরা না ফেরা অবধি জেগে থাকব।
–শো ভাঙলেই চলে আসব বাবা।
শিবসুন্দর টুকিকে কোলে নিয়ে ভেতর বারান্দায় এলেন, -কাল কলকাতায় যাচ্ছি রে বেটি। তোর দাদার বাড়ি। তোর জন্য কী আনব?
বিচিত্র মুখভঙ্গি করে ভাবল টুকি, –দাদা আমাকে একটা এরোপ্লেন দেবে বলেছিল। সাঁ সাঁ করে উড়ে যায়।
–এখন থেকেই ওড়ার শখ! ভাল।
বাইরে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে গেলেন শিবসুন্দর। তাঁর আহার পরিমিত, বাহুল্যবর্জিত। আলু কপি কড়াইশুঁটি টোম্যাটো দিয়ে একটা হালকা তরকারি, পেঁপের ডালনা, গোটা তিনেক রুটি, আর আধবাটি দুধ।
অলকা রুটি সেঁকছিল। শিবসুন্দর ঠাণ্ডা রুটি খেতে পারেন না, এইটুকুই যা তাঁর বিলাসিতা। শিবসুন্দরের পাতে গরম গরম রুটি সাজিয়ে দিতে দিতে অলকা বলল, –দুটো ভাল দেখে ফুলকপি তুলে রেখেছি বাবা। আপনার ব্যাগে ভরে দিচ্ছি।
কী দরকার ছিল? কলকাতাতে কি কপি পাওয়া যায় না?
–সে তো বাজারের কপি। এ হল ক্ষেতের।
কপি বাজারে ফলে না অলকা, ক্ষেতেই ফলে।
–কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা করছেন বাবা? এ হল নিজেদের ঘরের জিনিস।
নিজেদের ঘর! শুভ কি তাই মনে করে? মাধবপুরে বাবার বাড়িতে অতিথির মতো আসে ছেলে। কলকাতায় ছেলের বাড়িতে অতিথি হয়ে যায় বাবা। এর মাঝে নিজেদের শব্দটা কি বড় হাস্যকর শোনায় না?
অলকা আবার বলে উঠল, -টোটো কপির রোস্ট খুব ভালবাসে বাবা। দিদি নাকি খুব ভাল বানায়। কপি বড় বড় টুকরো করে কেটে…
–তুমি রাঁধতে জানো না?
–জানি। একটা পত্রিকা পড়ে শিখেছি। টিভিতেও দুপুরে দেখাচ্ছিল একদিন।
রাঁধো না কেন?
তুফান খাওয়ার মাঝে বলে উঠল, –ও অনেক ঘি-মশলার রান্না, ও তুমি খাও না।
বাবা তো ঠিকই করেন। এই বয়সে রিচ রান্না খাওয়া ভাল নয়।
–তুমি আর কদিন দেখছ বাবাকে! বাবা চিরকালই এরকম খান। পাতলা পাতলা ঝোল, মশলা ছাড়া তরকারি…
কথাটা যেন চিমটি কাটল বুকে। মনোরমার হাতের রান্না কদিনই বা জুটেছে শিবসুন্দরের, স্বাদও তার ভুলে গেছেন, জীবনটা তো কাটল কাজের লোকের হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে। তাদের রান্নায় বেশি তেল-মশলা পড়লে কি এতদিন সুস্থ থাকতেন শিবসুন্দর!
আত্মগতভাবে শিবসুন্দর বললেন, আমার ট্যালটেলে রান্নাই ভাল। শরীরের জন্য আহার, না আহারের জন্য শরীর, অ্যাঁ?
খাওয়া সেরে দোতলায় এলেন শিবসুন্দর। ঘরে গেলেন না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালেন একটা। নীচের ঘরে তালা মেরে বেরোচ্ছে তুফানরা। শিবসুন্দর তুফানদের চলে যাওয়া দেখছিলেন। বড় মায়াবী এক চাঁদ উঠেছে আকাশে, পরশু বা তার আগের দিন বোধহয় পূর্ণিমা ছিল, মোমজ্যোৎস্নায় বহু দূর স্পষ্ট দেখা যায়। চাঁদের আলোয় ছায়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে তুফানের মোপেড। যান্ত্রিক গর্জন কমতে কমতে মুছে গেল, তবু কান পেতে রইলেন শিবসুন্দর।
সহসা বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল শিবসুন্দরের। গর্জন তুলে সপরিবারে তুফানের ওই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এই জনহীন শীতার্ত রাত, এই আলোছায়ার ভৌতিক খেলা হঠাৎ কেমন যেন নিঃসঙ্গ করে দিল শিবসুন্দরকে। নিজেকে কী ভীষণ একা লাগছে!
ক্ষণ পরেই একা একাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন শিবসুন্দর। কী অর্থহীন চিন্তা। মানুষ তো চিরকালই নিঃসঙ্গ। কি ভিড়ে, কি নির্জনে। নিজের চারদিকে প্রিয়জনের বলয় সৃষ্টি করে বৃথাই সেই নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে চায় মানুষ। হায় রে মানুষ!
ঘরে ঢুকে শিবসুন্দর দেখলেন মনোরমা জেগে আছেন। দৃষ্টি কড়িকাঠে স্থির, যেমন থাকে। বিকেলে বোধহয় অলকা একটু সাজিয়ে দিয়েছিল, দুই ভুরুর মাঝে জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট লাল টিপ, সাদা চুলের মাঝে চওড়া সিঁথিতে সিঁদুররেখা। গলা অবধি লেপে ঢাকা, চিবুক ওঠানো, মাথা বালিশের পিছনে সামান্য ঝুলে আছে। পাশ থেকে হঠাৎ দেখলে শুভর মুখ মনে পড়ে যায়। মনোরমা তাঁর মুখের অনেকটাই দিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে।
শিবসুন্দর স্ত্রীর ললাটে হাত রাখলেন, -মনো ওঠো, খেতে হবে এবার।
জামবাটিতে খই-দুধ রেখে গেছে অলকা। স্ত্রীর ঘাড়ে আলগা হাত রেখে তাঁকে বসালেন শিবসুন্দর। চামচ দিয়ে একটু একটু করে খাওয়াচ্ছেন।
খাচ্ছেন মনোরমা। রোবটের মতো।
শিবসুন্দর কথা শুরু করলেন, কাল আমি শুভর কাছে যাচ্ছি মনো।
মনোরমার কণ্ঠনালি বেয়ে খানিকটা খই-দুধ নেমে গেল।
–তোমার ছেলেটা কেমন হয়ে গেল মনো! কী যে এক মরীচিৎকার পেছনে ছুটছে। বউটার দিকেও তাকানোর সময় পায় না। আমি কিন্তু কাল গিয়ে ওকে খুব বকব, তুমি রাগ করতে পারবে না।
মনোরমা কি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন? নাকি ঠাণ্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল বন্ধ জানলা?
-তুফান বলছিল ছন্দা নাকি খুব ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখের নীচে কালি জমেছে। ইউটেরাসে ফাইব্রয়েড পুষে রেখেছে, মেনোরেজিয়া হচ্ছে নির্ঘাত। নইলে কি চেহারা অমন অ্যানিমিক হয়ে যায়! কি স্টেজে সব আছে কে জানে! এই তো সেদিন রামনগরের বউটার কি হল? হিস্টেরেকটোমির জন্য পেট ওপেন করেও অপারেশন থামিয়ে দিতে হল। কলকাতার অত বড় গাইনি, অত বড় হাসপাতালও কারসিনোমা সারভিসের স্টেজ দেখে আর এগোনোর ভরসা পেল না। বেচারা বউটাকে এখন রেখে এসেছে কলকাতায় ভাইয়ের বাড়িতে। রেগুলার রে চলছে। অথচ আমি ওর বরটাকে এক বছর আগে অপারেশানের কথা বলেছিলাম। ভেবে দ্যাখো, ছন্দার যদি ওইরকম কিছু একটা…কমলেশবাবু তো আমারই ভরসায় মেয়েটাকে দিয়েছিলেন একদিন! টোটোও নাকি সারা দিন হাঁড়িমুখ করে থাকে। এদের সংসারটা কেন অমন হল মনো?
বুকের সব উদ্বেগ উগরে এক সময়ে থামলেন শিবসুন্দর। মনোরমার শোওয়ার বন্দোবস্ত করে উঠে টেবিলচেয়ারে গিয়ে বসলেন। ড্রয়ার খুলে ডায়েরি বার করেছেন।
দিনপঞ্জি লিখছেন শিবসুন্দর। দিনপঞ্জি, না জীবনপঞ্জি?
.
ছুটির দিন, তায় শীতের সকাল, তারকেশ্বর লোকাল আজ প্রায় ফাঁকা। বেশির ভাগ জানলার শার্সি নামানো, তবু যাত্রীরা সব গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তাদের আরও ভয় দেখাতে চলন্ত ট্রেনের ভোলা দরজা দিয়ে হানা দিচ্ছে কনকনে বাতাস। একটা লোক মাথা মুড়ি দিয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়ল।
শিবসুন্দর চোখ বুজলেন। মনোরমাকে ফেলে কলকাতাতে তিনি যান না বড় একটা। কোথায়ই বা যান! টোটোর পরীক্ষার আগে সেই একবার কলকাতা গিয়েছিলেন, তাও প্রায় বছর ঘুরতে চলল। শহরটা কি এর মধ্যে আরও গভীর জঙ্গল হয়ে গেছে!
ট্রেনের দুলুনিতে ঘোর নামছিল চোখে, হঠাৎ চিৎকারে চটকা ভেঙে গেল শিবসুন্দরের। এক তাগড়াই জোয়ান গাঁক গাঁক চেঁচাচ্ছে, –দেখুন বাবুরা, খেলা দেখুন। সার্কাসের খেলা দেখুন।
ছেলেটার বয়স বছর তিরিশেক হবে। এই শীতেও পরনে একটা হাফপ্যান্ট আর মোটা গেঞ্জি। চেনা চেনা লাগে যেন!
আচমকা দু হাত তুলে ট্রেনের প্যাসেজের দুটো হ্যান্ডেল চেপে ধরল ছেলেটা। হাতের চাড়ে উঠে যাচ্ছে শরীরটা। ঝুলন্ত শরীর দোল খাচ্ছে, দোল খাচ্ছে…, থেমে গেল হঠাৎ। এবার কুণ্ডলী পাকিয়ে শুন্যে ঘুরছে বনবন। দক্ষ ট্রাপিজ খেলোয়াড়ের মতো এক জোড়া হাতল থেকে অন্য জোড়ায় উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। সিটের কোনায় জোর ঠোক্কর লেগে মুখ বিকৃত হয়ে গেল, তাও পরোয়া নেই।
শিবসুন্দরের চোখ বিস্ফারিত। কামরার আর সব যাত্রীও টানটান।
শুন্যে বেশ খানিকক্ষণ কসরত দেখিয়ে কয়েক সেকেন্ড জিরোল লোকটা। ঘামছে। প্যাসেজে নিজেরই রাখা একটা থান ইট তুলে নিল। ভাঙল কপালে ঠুকে। একটা পাথরের টুকরো উরুতে, রেখে হাতের আঘাতে দু টুকরো করল। ঊরু ফেটে রক্ত ঝরছে চিনচিন, ছেলেটা নির্বিকার।
খেলা শেষ। কামরায় ঘুরে ঘুরে পয়সা চাইছে যাত্রীদের কাছ থেকে। দু-চারজন সিকি আধুলি দিল, বেশির ভাগই উদাস।
ছেলেটা সামনে এসে হাত পাততেই একটা দু টাকার নোট বার করে দিলেন শিবসুন্দর। তখনই ছেলেটাকে চিনতে পারলেন। তাঁর চেম্বারে এসেছিল একদিন। বেতিয়া থেকে। মাথার একটা পুরনো কাটা সেপ্টিক হয়ে গিয়েছিল।
শিবসুন্দরের শিউরোনো গলা থেকে শব্দ ছিটকে এল, উফ কী জীবন!
ছেলেটা হাসল, –কিছু বললেন ডাক্তারবাবু?
–ও রকম বিপজ্জনক খেলা কেন দেখাও?
–বেঁচে তো থাকতে হবে।
–আর কিছু করতে পারো না? অন্য কোনও কাজ?
–জোটেনি যে।
–এই কাটাছেঁড়া ঘা রক্তপাত…পা-টাও তো যাচ্ছে! এটা কি একটা বেঁচে থাকার উপায়?
মন্দ কী ডাক্তারবাবু? ধরাকরা করতে হয় না, ভিক্ষেও চাইছি না…
–কোনও দিন পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকবে, তখন বুঝবে। ভাল লাগে এভাবে বাঁচতে?
লাগাতেই হয়। ছেলেটা ঝকঝকে দাঁত ছড়িয়ে হাসল, –কোনওভাবে একটা তো বাঁচতেই হয়। বেঁচে থাকাটাই সুখ। বেঁচে থাকাটাই আনন্দ।
কথাটা শিবসুন্দরের মনে রয়ে গেল।
.
৪৪.
– অথর্বপ্রায় বৃদ্ধ মারা গেলে শ্রাদ্ধের দিন বাড়িতে আর তেমন শোকের ছায়া থাকে না। কাল অবধি বাড়িটায় একটা চাপা থমথমে ভাব ছিল, তা যেন হঠাৎ কেটে গেছে, আত্মীয় বন্ধু প্রতিবেশীর ভিড়ে আমূল বদলে গেছে চেহারা। ছাদে সাদা ম্যারাপ বেঁধে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে, দোতলা একতলা সব ঘরেই অতিথিদের বসার আয়োজন। বড় ঘরের সামনে ফালি জমিটাও সাদা কাপড়ে ঢাকা, সেখানে বিমর্ষ মুখে চেয়ারে বসে আছেন জনাকয়েক বৃদ্ধ। জয়মোহনের বন্ধু। হঠাৎ হঠাৎ কথা ফুরিয়ে যাচ্ছে তাঁদের, বুঝি বা মনে মনে হিসেব কষছেন তাঁদের মধ্যে আর কজন পড়ে রইলেন এ পারে।
শুভাশিস গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। অনেকক্ষণ এসেছে, এ বাড়িতে ভিড়ও বাড়ছে। ক্রমশ, এবার মানে মানে কেটে পড়লেই হয়।
ভেতরবাড়ি থেকে একটা হট্টগোল শোনা গেল। কে যেন চেঁচিয়ে ডাকছে কাকে। ভারী শরীর নিয়ে থপ থপ করে বড় ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল জয়শ্রী। তাকাচ্ছে এদিক সেদিক-শুভাশিসদা, তিতিরকে দেখেছেন?
শুভাশিস দু পা এগোল, –এই তো একটু আগে প্রেসঘরে গেল।
–দেখুন তো কী কাণ্ড! কখন ওদের ভুজ্যি দেওয়া হয়ে গেছে, অ্যাটমকে কখন খাইয়ে দিলাম, আর মেয়েটাকে কোথাও ধরতে পারছি না!
শুভাশিস বলল, –দুজন বন্ধু এসেছে দেখলাম, তাদের সঙ্গে গল্প করছে বোধহয়।
হাঁপাতে হাঁপাতে প্রেসঘরের দিকে যাচ্ছে জয়শ্রী। দামি গরদের শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে মেঝেতে। গা ভর্তি গয়না। এই সেদিন শ্মশানে বাবার জন্য কী আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদছিল, আজ বাবার মৃত্যু শুধুই এক পারিবারিক অনুষ্ঠান! মৃত্যুশোক ব্যাপারটাই বোধহয় এরকম। কালবৈশাখীর মতো আসে, কয়েক পশলা বৃষ্টি ঝরিয়ে চলেও যায় তাড়াতাড়ি। অথবা এই সব আচার অনুষ্ঠানগুলোই শোককে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ দেয় না।
জয়শ্রী ফিরছে। একাই।
শুভাশিস জিজ্ঞাসা করল, –তিতির এল না?
–আর বলবেন না। বাবা যতক্ষণ খাবে না, মেয়েও উপোস থাকবে। কোনও মানে হয়! দাদা কখন কাজ থেকে উঠবে তার ঠিক আছে?
শুভাশিসের বুকের ভেতর দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল। নিচু গলায় বলল, –জোর করলে না কেন? শরীর খারাপ হবে যে।
–সে কথা কে বোঝায়! বাপ-অন্ত প্রাণ। দেখুন না, আপনি যদি ধমকে ধামকে পাঠাতে পারেন।
জয়শ্রী চলে গেল। প্রেসঘরের দিকে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল শুভাশিস। সে বললেই কি তিতির শুনবে? থাক, যেচে আঘাত পেতে আর ভাল লাগে না।
সিগারেট নিবিয়ে পায়ে পায়ে আবার জয়মোহনের ঘরের দরজায় এল শুভাশিস। শ্রাদ্ধের কাজ চলছে এখনও। সুদীপ কন্দর্প ইন্দ্রাণী রুনার কাজ অনেকক্ষণ শেষ, মাঝে একবার অল্প সময়ের জন্য উঠেছিল আদিত্য, এখন আবার একভাবে চোখ বুজে মন্ত্র পড়ে চলেছে। পাশে এখনও ইন্দ্রাণী, তার চোখ জলচৌকিতে রাখা জয়মোহনের বাঁধানো ছবিতে স্থির। পুরোহিতের পিছনে ক্যালেন্ডারের বিবেকানন্দর পোজে দাঁড়িয়ে আছে শংকর, তার হাবভাব দেখে মনে হয় সেই যেন আজ গোটা অনুষ্ঠানটার পরিচালক। জয়মোহনের খাট খুলে সরিয়ে রাখা হয়েছে, আসবাবপত্র সব দেওয়ালের দিকে সরানো, ইজিচেয়ারটা নেই। ফাঁকা ফাঁকা ঘর, ঘরের মধ্যিখানে শ্রাদ্ধের উপকরণ, ফুল আর ধূপের উগ্র সুরভি, জলচৌকিতে মালায় মালায় ঢাকা জয়মোহন, মুণ্ডিতমস্তক আদিত্য, তার পাশে নতুন লালপাড় সাদা শাড়িতে সহধর্মিণীর বেশে বিষাদপ্রতিমা ইন্দ্রাণী–গোটা দৃশ্যটাই যেন অচেনা ছবি।
ঝান্টু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল, বাবা, মেজমামা জিজ্ঞেস করছে এখন কি ব্যাচ বসানো যাবে? শংকর চোখ ঘোরাল, বাজে কটা?
–একটা বাজতে দশ।
–সে কি রে, এত বেলা হয়ে গেল? বলেই নিচু হয়ে কি যেন ফিসফিস করল পুরুতমশাইয়ের কানে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, –আর মিনিট কুড়ি ওয়েট কর।
ক্যাটারাররা ঝামেলা করছে। রাধাবল্লভি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
–পার ব্যাচ কজন বসবে?
ছাদে চল্লিশজনের বেশি হবে না।
–দোতলার প্যাসেজে জনাদশেক বসানো যায় না?
আমি বলেছিলাম। মেজমামা বলছে লোকজনের হাঁটাচলার অসুবিধে হবে। ক্যাটারাররাও ওপর নীচ করবে না।
–যত সব ক্যালাস আইডিয়া। সেই পাঁচটা ব্যাচ হয়ে যাবে। যা, বসিয়ে দে। শংকর শুভাশিসের দিকে তাকাল, আজকাল আর সব নিয়ম কানুন মানতে গেলে চলে না, তাই না ডাক্তারবাবু?
শুভাশিস ব্যাপারটা ঠিক বুঝল না। আলগোছে ঘাড় নেড়ে দরজা থেকে সরে এল। আশপাশে এত অপরিচিত মুখ! যেসব আত্মীয় জ্ঞাতিদের সঙ্গে সাতজন্মে সম্পর্ক নেই, তাদেরও এ সব অনুষ্ঠানে ডেকে আনতে হয়! কী বিচিত্র সামাজিক নিয়ম!
বড় ঘরে এসে ক্ষণকাল দাঁড়াল শুভাশিস। সোফা টেবিল সরিয়ে এ ঘরে ঢালাও শতরঞ্চি পাতা হয়েছে, এক দিকে কিছু মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে, অন্য প্রান্তে এক পাল বাচ্চা ক্যালরব্যালর করে ছোটাছুটি করছে। রুনার বড়দির মেয়েটাকে আলটপকা একটা ধাক্কা দিল অ্যাটম, মেয়েটা চিলচিৎকার জুড়েছে।
শংকর এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। আড়মোড়া ভেঙে বলল, –ভালয় ভালয় কাজটা চুকলে বাঁচি। রাত্রে যা একটা টেনে ঘুম মারব না!
শুভাশিস চোয়াল ফাঁক করল, হুঁ, আপনার খুব ধকল যাচ্ছে।
জামাইকে তো ডিউটি করতেই হবে। বলেই গলা নামাল শংকর, –এ বাড়ির ছেলেগুলো একটাও কম্মের না। ছোটটা ময়ুর ছাড়া কার্তিক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিনেমার দোহাই দিয়ে শালা মাথাটা পর্যন্ত নেড়া করল না। মেজ শ্বশুরবাড়ির লোক সামলাতেই ব্যস্ত। আর বড়টা তো বাপের শোকে গবা পাগলা। কাল ঘাটকামানের দিন কী করেছে জানেন? বুক চাপড়াতে চাপড়াতে সোজা গঙ্গায় নেমে যাচ্ছিল। আমি না থাকলে কাল থেকে আরেক সেট অশৌচ শুরু হয়ে যেত।
শোক নিয়ে সত্যিই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে আদিত্য। এই দেওয়ালে মাথা ঠুকছে, এই কপাল চাপড়াচ্ছে! আজও কাজে বসে হেঁড়ে গলায় ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। এই দরদটা আগে এলে বাবাটাকে এত তাড়াতাড়ি মরতে হত না। মনে মনে ভাবলেও কথাগুলো অবশ্য শংকরকে বলল না শুভাশিস। জামাই মোটেই সুবিধের নয়। ছোট্ট কথাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কিভাবে রাষ্ট্র করবে তার ঠিক কি! প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, –আপনার ছেলেটাও তো দেখছি খুব খাটছে।
–ঘিলু তো নেই, ওইটিই পারে।
–ওভাবে বলছেন কেন? আপনার ছেলে তো বেশ সাদাসিধে।
–তা ঠিক। ছেলের আমার মনটা পরিষ্কার। খেলাধুলা করে তো, ময়লা জমার সুযোগ পায়। শংকর ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল, -ছেলের আমার বড় আফসোস রয়ে গেল। শ্বশুরমশাই এতদিন লড়লেন, আর বছর দুই যদি টেনে দিতে পারতেন…
শুভাশিস জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
ছেলেটার বড় শখ ছিল বড় টিমে খেলবে, দাদু টিভিতে ওর খেলা দেখবে…
কত রকম যে আফসোস থাকে মানুষের! শুভাশিস হাসি চাপল।
শংকর পাঞ্জাবির পকেট থেকে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বার করেছে। একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে প্যাকেট বাড়িয়ে দিল শুভাশিসের দিকে, –চলবে?
হাত বাড়াতে গিয়েও থামল শুভাশিস। এ ঘরে সে সিগারেট ধরায়নি কোনওদিন। একটা মানুষ চলে যেতেই ঝটিতি নিয়মটা ভেঙে ফেলা কি খুব জরুরি? শুভাশিসের মনে কোনও সংস্কার নেই, ইন্দ্রাণীর শ্বশুরমশাইয়ের জন্য বিশেষ কোনও আবেগও নেই, তবু যেন বাধছে কোথায়। শুভাশিস বলল, ভেতরটা বড় স্টাফি। বাইরে যাই চলুন।
গেটের বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়েছে দুজনে। পৌষের দুপুর মিঠেকড়া রোদের প্রলেপ মাখাচ্ছে গায়ে। ধুলো উড়ছে অল্প অল্প। এক ভিখারিণী কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে গেটের ধারে দাঁড়িয়ে। খাবারের গন্ধ পেয়ে দু-চারটে রাস্তার কুকুরও।
শুভাশিসের গাড়ির পিছনে একটা মারুতি ভ্যান এসে দাঁড়াল। প্রায় নিঃশব্দে। দরজা খুলে একটা লোক নামছে। কলো গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। ঘিয়ে রঙ সিল্কের পাজামা পাঞ্জাবির ওপর দামি উলেন জ্যাকেট। হাতে শালপাতায় মোড়া প্রকাণ্ড মালা।
লোকটাকে দেখেই শংকর এগিয়ে গেছে, আসুন দাদা।
লোকটা আলতো হাসল, কাজকর্ম সব চুকে গেছে?
–প্রায়। পিণ্ডদান চলছে। দাঁড়ান, চাঁদুকে ডাকি। বলেই বাড়ির ভেতর সেঁধিয়ে গেছে শংকর। মিনিট খানেকের মধ্যে কন্দর্পকে নিয়ে বেরিয়ে এল। কন্দর্পও খুব আপ্যায়ন করে লোকটাকে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। নির্ঘাত ফিলম কোম্পানির কোনও কেউকেটা হবে।
শংকর পাশে এসে মিটিমিটি হাসল, –আজ বোধহয় চাঁদুর নিমন্ত্রিতই সব থেকে বেশি। দুটো ক্যামেরাম্যান এল, কো-আর্টিস্টরা আসছে…কিছুক্ষণ আগে তো নায়িকাও এল। দেখেছেন মেয়েটাকে? দারুণ সুন্দরী। কী ফিগার! কে বলবে এক বাচ্চার মা!
শুভাশিস হেসে বলল, না, আমি দেখিনি।
–আরে দেখেননি, আপনার সামনে দিয়ে তো ওপরে নিয়ে গেল চাঁদু! সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল!
ওহ, মধুমিতার কথা বলছে শংকর। কন্দর্প ইন্দ্রাণীর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে মেয়েটাকে। শুভাশিস একবার ও ঘরে গিয়েছিল, ধীরাজ উমার সঙ্গে দেখা করার জন্য, তাকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল মধুমিতা।
সবজান্তা শংকরের অজ্ঞতায় মজা পেল শুভাশিস, কিন্তু প্রসঙ্গটাও এড়িয়ে গেল। কি শুনে কি কুৎসা গাইবে লোকটা তার ঠিক আছে!
শুভাশিস সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, –তা এই ভদ্রলোকটি কে?
একে চেনেন না! গ্রেট অশোক মুস্তাফি। এইই তো এখন এ বাড়ির কিম্যান। মিস্টার আলাদিন।
শুভাশিসের ভুরু জড়ো হল।
–অশৌচের কদিন বাড়িতে যে ফল মিষ্টির পাহাড় জমছিল, পাঠিয়েছে কে? কুটুমবাড়ি থেকে নতুন জামাকাপড় আসার আগে মুস্তাফির ধুতি-শাড়ি পৌঁছে গেল।
–তা তো বুঝলাম, কিন্তু লোকটা কে? চাঁদুর কোনও প্রোডিউসার বুঝি?
এবার শুভাশিসের অজ্ঞতায় যেন মজা পেল শংকর, –প্রোডিউসার তো বটেই, তবে এ বাড়িতে ওটা সেকেন্ডারি পরিচয়।
–মানে?
–কেন, বড়বউদি এর মধ্যে আপনাকে কিছু বলেনি?
শুভাশিস একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। ইন্দ্রাণী পছন্দ করে না শংকরকে, ছোট জিনিসকে বড় করে দেখানো শংকরের স্বভাব, একে কি আর বেশি প্রশ্ন করা উচিত? তবু কৌতূহলটাও চাপতে পারল না। বলল, না। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আমার তেমন কোনও কথা হয়নি। মেসোমশাইয়ের মৃত্যুতে এমন আপসেট হয়ে আছে…
–আপসেট নয় মশাই, এ বাড়ির সবাই এখন নিশ্বাস চেপে ধরে আছে। শংকর গলা নামাল, আপনি ঘরের লোকের মতে, আপনাকে বলাই যায়। না বললেও আপনি আজ নয় কাল তো জানতেই পারবেন। গলা আরও নিচু করল শংকর, –মুস্তাফি এখন আর শুধু চাঁদুর প্রোডিউসার নয়, উনি এখন বড়বৌদির লোক।
কথাটা বুলেটের মতো বিঁধল শুভাশিসকে।
শংকর কি লক্ষ করল প্রতিক্রিয়া? ধূর্ত হাসি হাসছে, বাপ্পাবাবু যে দাদুর অশৌচের মধ্যেই ড্যাং ড্যাং করে জাহাজ কোম্পানির ট্রেনিং নিতে চলে গেলেন, তার খরচটা দিল কে?
-খরচা মানে?
যাচ্চলে, আপনি কিছুই জানেন না? মৌজ করে আর একটা সিগারেট ধরাল শংকর। ঠিক মাথার ওপর একটা কাক বসেছে গাছে, সরে গেল খানিকটা। হুশ হুশ করে তাড়াল কাকটাকে। তুরীয় মেজাজে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমার গিন্নি বলছিল ট্রেনিং-এর খরচ নাকি চল্লিশ হাজার। আমার বিশ্বাস হয় না। অত মাইনের চাকরি, মিনিমাম লাখ খানেক লেগেছে। সেই টাকা বড়বউদি নিয়েছে ওই মুস্তাফির কাছ থেকে।
আর একটা বুলেট বিঁধল শুভাশিসকে। টকটকে লাল হয়ে গেল মুখ।
শংকর ভ্রূক্ষেপহীন ভাবে বলল, –নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে মুস্তাফি কেন দিল টাকাটা? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। বিকজ অফ দা ম্যাটার হল গিয়ে বউদি বাড়িটার বিলিবন্দোবস্ত সেরে ফেলেছে। ওই মুস্তাফি বাড়ি ভাঙবে, ফ্ল্যাট বানাবে। মুস্তাফিকে কাজটা পাইয়ে দিয়ে বাপ্পার আখেরটা গুছিয়ে নিল বড়বউদি।
বুলেটবিদ্ধ শুভাশিস যন্ত্রণাটাকে সহ্য করতে দাঁতে দাঁত চাপল।
–আমি তো ভাবছি নিয়মভঙ্গের পর বউদিকে একটা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করব। তিন ভাই যা নিয়ে লাঠালাঠি করল, আমার গিন্নি যে কথা পাড়তে গিয়ে বাপের কাছে জুতো পেটা খেল, সেই কাজই বউদি কী মাখন করে সমাধা করে ফেলল! শংকর চক্রান্তকারীর মতো ফিস ফিস করে বলল, শ্বশুরমশাই মারা যাওয়ার আগের রাতেই তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছে বড়বউদি। মুস্তাফির এগ্রিমেন্টে। এ কথা এখন এ বাড়ির লোক পাঁচ কান করছে না মশাই। কাজকম্ম চুকুক, তখন ঝোলা থেকে বেড়াল বেরোবে।
শুভাশিসের ফুসফুসে খুব জোর, তবু এই মুহূর্তে শ্বাস নিতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল তার। পৌষের বাতাসেও যেন চামড়া ঝলসে যাচ্ছে, আগুনের হলকা বইছে কান দিয়ে। শংকর কি সত্যি কথা বলছে? মিথ্যে বলেই বা শংকরের কী লাভ?
আধখাওয়া সিগারেট টোকা মেরে অপেক্ষমাণ কুকুরদের গায়ে ছুঁড়ে দিল শংকর, কুকুরগুলো সভয়ে সরে গেল। ফিচেল হেসে শংকর বলল, আসলি ননীটা কে খেয়ে গেল বলুন তো? ওই অশোক মুস্তাফি। দালাল লাগিয়ে বাড়িটা ধরতে গেলে সে ব্যাটা মিনিমাম পাঁচ-দশ পারসেন্ট খেয়ে নিত, সেই টাকাটা বাঁচিয়ে ফেলল। আমার গিন্নির কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা দাদন দিয়ে এ রকম একটা ঘ্যামা পজিশানে এতটা ল্যান্ড মুঠোয় ভরে ফেলা..না মশাই, মুস্তাফি লোকটার হেডে ব্রেন আছে।
শংকরের সঙ্গ অসহ্য লাগছে, আবার চুম্বকের মতো টানছেও শুভাশিসকে। অনেক চেষ্টা করে স্বর ফোটাল গলায়, –এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে।
–সময়ই বলবে কি হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আমি আমার গিন্নিকে বলে দিয়েছি এগ্রিমেন্টে কি আছে আমাদের জানার দরকার নেই, তুমি বেশি কৌতূহল দেখাবে না, তোমার দাদা-ভাইদের কাছে তুমি কিছু আশা করবে না। তারা যদি হক মনে করে কিছু দেয় তো ভাল। আমার মশাই শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির ওপর কোনও মোহ নেই। শ্বশুরমশাই আমাকে হোল লাইফ হ্যাক-থু হ্যাক-থু করে গেছেন, তবু তাঁর মরার পরে তাঁর সেবায় লাগতে পেরেছি…
কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে শংকর। পিছনে ভূতগ্রস্তের মতো হাঁটছিল শুভাশিস। চকিত আঘাতে সমস্ত স্নায়ু অসাড়। বড় ঘরে অনেকে কথা বলছে, একটি বর্ণও শুনতে পাচ্ছিল না শুভাশিস।
কে যেন ডাকছে, –শুভাশিসদা…ও শুভাশিসদা…
শুভাশিস চমকে তাকাল। সামনে রুনা। কেমন ভাবে যেন দেখছে শুভাশিসকে, –আপনি এত ঘামছেন কেন শুভাশিসদা? শরীর খারাপ লাগছে?
কই, না তো। নাহ। শুভাশিস ফ্যাকাসে হাসল।
–কখন থেকে ডাকছি আপনাকে, শুনতেই পাচ্ছেন না!
–ডাকছিলে বুঝি?
–আপনার একটা ফোন আছে।
ও।
শ্লথ পায়ে সিঁড়ি ভাঙছিল শুভাশিস। এখানে কে ফোন করল? ছন্দা? কী দরকার? নার্সিংহোম থেকে কল এল? কোথাওই তো তেমন কোনও সিরিয়াস পেশেন্ট নেই! কন্দর্প দু হাতে খানপাঁচেক কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর বোতল নিয়ে নামছে, শুভাশিসকে দেখে হাসল। হাসিটা ফেরত দিতে ভুলে গেল শুভাশিস। দোতলায় সুদীপের ঘর রুনার বাপের বাড়ির লোকজনে ঠাসা, গুঞ্জন ভেসে আসছে। কৌতূহলহীন মুখে দরজাটা পার হয়ে শুভাশিসের চোখ গেল প্যাসেজের কোণে। আদিত্যর ঘরের দরজায় বসে মধুমিতার মেয়ে আপন মনে খেলা করছে। একা, কিন্তু নিশ্চিন্ত।
শুভাশিস ফোন তুলল। ছন্দাই।
–ওদিকের কাজ মিটেছে?
–কেন?
বাবা এসেছেন।
–কে?
বাবা। তোমার বাবা। ….হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ? তোমার বাবা এসেছেন। …..
–আমি আসছি।
ফোন রেখে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল শুভাশিস। এক্ষুনি ফিরবে। ছাদে সুদীপের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে, তাকে একবার বলে যাবে কি? কেন বলবে, শুভাশিস এ বাড়ির কে? হনহন করে নীচের বড় ঘর পার হয়ে গেল শুভাশিস। সামনের ঘেরাটোপে তিতির একটা বিশালকায় দাড়িঅলা লোকের সঙ্গে কথা বলছে। লোকটা হাত রাখল তিতিরের মাথায়। ওই কি রঘুবীর? মুস্তাফি মাকে জপিয়েছে, মেয়েকে জপাচ্ছে বাবার স্যাঙাৎ! ভাল। সুন্দর দৃশ্য। এই পরিবারে এটাই মানায়।
গাড়ি চালাতে চালাতে ছটফট করছিল শুভাশিস। অপমানটা তীব্র বিবমিষা হয়ে তোলপাড় করছে শরীর। ইন্দ্রাণী কী নিষ্করুণ হাতে একের পর এক সুতো ছিঁড়ে চলেছে, কত সহ্য করবে শুভাশিস? পলকের জন্য মনে পড়ল বাপ্পার যাওয়ার আগের সন্ধেটাকে। মলিন মুখে বসে ছিল বাপ্পা, দাদুর শ্রাদ্ধের আগে চলে যেতে কুণ্ঠা বোধ করছিল সে। শুভাশিস অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছিল তাকে। এনরোলমেন্টের দিন না পৌঁছলে হয়তো বাপ্পার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। আর এমন সুযোগ জীবনে বারবার আসে না। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলাই শ্রেয়। ইন্দ্রাণী যেন সেদিন পছন্দ করছিল না শুভাশিসের বোঝানোটাকে। বারবার সন্ত্রস্ত চোখে বাপ্পার দিকে তাকাচ্ছিল। কিসের ত্রাস? গোপন কীর্তি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়? তার কাছ থেকে টাকা নয় নাই নিল, কিন্তু বিশ্বসুদ্ধ লোক, এমনকী হয়তো ওই রঘুবীরটাও যা জানে সেটাও জানার তার অধিকার নেই? কেন এই ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞা? তিতিরটাকেও এমন তৈরি করেছে, সেও আজকাল কেমন দূরে দূরে সরে থাকে!
কী চায় ইন্দ্রাণী? শুভাশিস আর না আসুক? মুখের ওপর বলতে পারছে না তাই ঠারেঠোরে ইঙ্গিত দিচ্ছে তার?
ক্ষোভে বিদীর্ণ এক শুভাশিস বাড়ি ফিরে দেখল শিবসুন্দর টোটোর বিছানায় আধশোওয়া হয়ে গল্প করছেন নাতির সঙ্গে। বাবার মুখে সেই চিরকালীন সহজ সরল নিরুত্তাপ ভাব। শুভাশিসেরই এক সেট পাজামা পাঞ্জাবি পরেছেন তিনি, একটু যেন ঢোল্লা লাগছে গায়ে। শরীর কি একটু ভেঙেছে মানুষটার!
শুভাশিস দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, কখন এলে বাবা?
–তা ধরো এগারোটা নাগাদ।
–সে তো অনেকক্ষণ। তুমি আগে খবর পাঠাওনি কেন বাবা?
ছন্দা বলল তুমি নাকি কোন শ্রাদ্ধবাড়িতে গেছ। কোনও পরিবারের অনুষ্ঠানে গেলে কাউকে বিব্রত করাটা সঙ্গত নয়।
বাবার গলায় সেই পরিচিত ঋজুতা। এই স্বর কতবার শান্তির প্রলেপ লাগিয়েছে শুভাশিসের বুকে। শৈশবে। কৈশোরে। যৌবনে। রাজনীতি ছেড়ে, ইন্দ্রাণীকে হারিয়ে দিগভ্রান্ত শুভাশিস এই শহর ছেড়ে বাবার কাছেই ছুটেছিল একসময়ে। দিনরাত মনমরা হয়ে বসে থাকত, লেখাপড়াও শিকেয় উঠেছে, তখন এই স্বরই শান্ত করেছিল শুভাশিসকে। ইন্দ্রাণীর কথা না জেনেই একটা বড় ভাল কথা বলেছিলেন শিবসুন্দর। আবেগ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না শুভ, তবে আবেগ জিনিসটা মানুষের দৃষ্টিকে বড় ঘোলাটেও করে দেয়। এখনই কেন মনে পড়ল কথাটা?
শুভাশিসের ভেতরের জ্বালা মরে আসছিল। মৃদু স্বরে বলল, বিব্রত হওয়ার কি আছে বাবা? তুমি এতদিন পরে এলে…
–তুমি তো এসেই গেছ। যাও, জামাকাপড় বদলাবে তো বদলে এসো।
শুভাশিস তবু দাঁড়িয়ে রইল একটু। বাবা শব্দটা বারবার উচ্চারণ করতে বেশ তৃপ্তি হচ্ছিল তার। মন আরও জুড়িয়ে এল। শুধু তৃপ্তি কেন, এক প্রশান্ত নির্ভরতাও বুঝি লুকিয়ে আছে ওই ডাকে। এই নিষ্ঠুর শহর থেকে বহু যোজন দূরে থেকেও ওই মানুষটা যেন শুভাশিসের এক উদ্বেগহীন আশ্রয়।
নিজের ঘরে এসে শুভাশিসের হঠাৎ মনে হল মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা হল না তো! কেন যে মার কথাটা মনে থাকে না! ছিহ্, বাবা কি মনে করল!
খুটখাট শব্দ হচ্ছে অ্যান্টিরুমে। উঁকি দিয়ে শুভাশিস দেখল ছন্দা তার ঠাকুরের জায়গাটা পরিষ্কার করছে। পুজো পুজো বাতিক ছন্দার বেড়েই চলেছে।
শুভাশিস চাপা গলায় বলল, বাবা ও ঘরে বসে আছে, আর তুমি…।
মুখ না তুলেই ছন্দা বলল, এতক্ষণ তো ও ঘরেই ছিলাম। উনি বিশ্রাম করছেন… ঠাকুরের বাসনগুলো এখন গুছিয়ে না রাখলে… আমি বাবাকে বলেই এসেছি।
-তোমার খাওয়া হয়েছে?
–অনেকক্ষণ। বাবা এসেই খেয়েদেয়ে টোটোর সঙ্গে তোমার নার্সিংহোম দেখতে গিয়েছিলেন, তখন আমিও…
বাবা নার্সিংহোম দেখতে গেল? হঠাৎ?
–আমি জোরজার করে পাঠালাম। আমার শরীরস্বাস্থ্য নিয়ে এমন জেরা শুরু করেছিলেন… আমার খুব লজ্জা লাগছিল।
হুম। তুফান কিছু বলেছে বোধহয়।
সম্ভবত।
শুভাশিস ইতস্তত করে বলল, মার কথা কিছু বলল বাবা?
–নতুন খবর কিছু নেই। আগের মতোই।
–যাক, তাও ভাল। শুভাশিস নিশ্চিন্ত মনে অ্যান্টিরুমে ঢুকে ছন্দার পাশে উবু হয়ে বসল। রাগ ঝিমিয়ে আসায় পাকস্থলী ডাক পাড়তে শুরু করেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, একটা কথা বলব?
কী?
–আমাকে কিছু খেতে দেবে গো?
ভ্রুকুটি হেনে কয়েক সেকেন্ড শুভাশিসের দিকে তাকিয়ে রইল ছন্দা।
কী খাবে? রুটি, না ভাত?
যা জুটবে। শোনো, ডাইনিং টেবিলে দিয়ো না, রান্নাঘরে দাও।
–কেন?
–আমাকে এখন খেতে দেখলে বাবা খুব অস্বস্তিতে পড়বে। ভাববে বাবার জন্য আমি না খেয়েই চলে এসেছি।
আবার ভ্রূকুটি হানল ছন্দা। শ্লেষমাখা চোখে দেখছে শুভাশিসকে, বাবাকে বলে দিতে পারো শ্রাদ্ধবাড়িতে তুমি খাও না। অনেকেই তো খায় না।
–মিথ্যে বলব? বাবাকে?
ছন্দা উদাসীন স্বরে বলল, পৃথিবীর আর সবাইকে মিথ্যে বলা যায়, তাই না?
বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল শুভাশিসের। কেন যে উঠল নিজেই জানে না। একটু আগের ক্রোধ আর তারপর এক শান্তির যাদুপ্রলেপ দুয়ে মিলেমিশে বিচিত্র এক ক্রিয়া শুরু করছে অন্তরে।
ছন্দা উঠে যাচ্ছিল, শুভাশিস পিছন থেকে ডাকল, –শোনো, এই মুহূর্তে তোমাকেও আমি একটা সত্যি কথা বলতে পারি।
ছন্দা ঘুরে দাঁড়াল।
পৌষের দুপুরমাখা গলায় শুভাশিস বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি ছন্দা।
.
৪৫.
টোটোর পড়ার টেবিলে বইয়ের স্তূপ। মনোযোগী চোখে একের পর এক বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছেন শিবসুন্দর। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথেম্যাটিকস বায়োলজি। চোখ তুলে বললেন, তোদের কোর্স তো অনেক অ্যাডভান্সড হয়ে গেছে রে!
গোপনে আহারপর্ব সেরে ছেলের ঘরে এসে বসেছিল শুভাশিস। সিগারেট ধরিয়ে ভারিক্কি চালে বলল, – বায়োলজি বইখানা দ্যাখো। আমাদের প্রিমেডিকেল কোর্সের কত কিছু ওদের সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিয়েছে!
–ভাল তো। মেডিকেল সায়েন্স যেভাবে এগোচ্ছে, ওদের আরও বেশি জ্ঞান নিয়ে ডাক্তারি পড়তে ঢোকা উচিত।
টোটো শর্টস আর পাঞ্জাবি পরে বাবু হয়ে বসে আছে চেয়ারে। একটু আগেও ছন্দার একটা শাল জড়িয়েছিল গায়ে, এখন সেটা পুঁটলি করে খাটের ওপর জড়ো। ঘন কালচে ঘাস ভরা গালে সে হাসল ফিকফিক, তা হলে তোমরা অনেক কম জেনে ডাক্তারিতে ভর্তি হতে?
অস্বীকার কী করে করি বল? মাথার পিছনে দু হাত রেখে আধশোওয়া হলেন শিবসুন্দর, তুই জয়েন্টে বসবি তো?
–দেখি। সে তো সামনের বছরের চিন্তা।
শুভাশিস যেন চেনা রুগীর অচেনা উপসর্গে বিস্মিত হল, –সে কী রে! তোর মা যে তোর জয়েন্টের প্রিপারেশানের জন্য টিউটর খুঁজছিল!
বসব না তো বলিনি। বললাম পরীক্ষা নিয়ে এখনও ভাবিনি।
বাবার সামনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল শুভাশিস। টোটো আজকাল তার সঙ্গে এরকমই কাঠ কাঠ কথা বলে। কদিন আগেও ভারি মিষ্টি একটা ছেলেমানুষি স্কুলবয় ভাব ছিল, সেটা যেন হঠাৎ হারিয়ে গেছে। বাবা নিশ্চয়ই ভাবল ছেলের সম্পর্কে শুভ খবর রাখে না!
অভিভাবকের স্বরে শুভাশিস বলল, –এ তো ভাল কথা নয় টোটো। ফিউচার সম্পর্কে এত ক্যাজুয়াল, এত আনপ্ল্যানড হওয়াটা কি ঠিক?
টোটো ঝটপট উত্তর দিল, –টোটালি আনপ্ল্যানড নই বাবা। তবে এটুকু ঠিক করেছি ডাক্তারি আমি পড়ব না।
–সে কি! কেন?
ছন্দা ঘরে ঢুকেছে। জানলার কাছে গিয়ে কি যেন দেখছে বাইরে। এক ঝলক মাকে দেখে নিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল টোটো, –ইচ্ছে।
–সব ইচ্ছেরই তো একটা কারণ থাকে। শুভাশিস আরও গম্ভীর হল।
কারণের কি আছে? আমার নিজেকে ডাক্তার ভাবতে ভাল লাগে না।
–এ কথা তো আগে কোনওদিন বলিসনি?
তুমি তো আগে কোনওদিন জিজ্ঞেস করোনি।
রূঢ় সত্যিটা হজম করতে অসুবিধে হল শুভাশিসের। ছেলের সামনে সে এক জাজ্বল্যমান সাফল্যের উদাহরণ, ফ্ল্যাট গাড়ি অপরিমিত ঐশ্বর্য সবই তো শৈশব থেকে গড়ে উঠতে দেখেছে ছেলে, তার পরেও কি ছেলে ভবিষ্যতে কি হতে চায় তা জিজ্ঞাসা করার কোনও প্রয়োজন ছিল? আদর্শ না হোক, ছেলের জীবনের লক্ষ্যও কি স্থির করে দিতে পারেনি সে?
শুভাশিসের মনে হল ছন্দারও যেন ছেলের সিদ্ধান্তটা নিয়ে কোনও হিলদোল নেই, যেন টোটোর সঙ্গে আগেই এ বিষয়ে কথাবার্তা হয়ে গেছে তার। শুধু শুভাশিসই জানে না কিছু।
যুদ্ধহীন পরাজয়টা মেনে নিতে পারল না শুভাশিস। খানিকটা মরিয়াভাবে বলল, আমার কিন্তু ইচ্ছে তুমি ডাক্তারিই পড়ো। কেন তুমি বাপ-ঠাকুরদার প্রফেশানে যাবে না?
শিবসুন্দর হেসে উঠলেন, –এ তো বড় অন্যায় কথা শুভ। টোটো কী হতে চায় সেটা তো টোটোরই স্থির করা উচিত। আমি কি তোমাকে ডাক্তারি পড়ার জন্য কখনও জোর করেছিলাম? টাকা রোজগারই যদি জীবনের মোক্ষ হয়, সে তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও হতে পারে, অন্য কোনও সার্ভিসে গিয়েও হতে পারে।
শুভাশিস যুক্তিতর্কের জাল বুনতে যাচ্ছিল, শিবসুন্দর থামালেন, আমি একটু চোখটা বুজে নিই শুভ। রোদ থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়তে হবে।
জানলার ধারে ছবি হয়ে থাকা ছন্দা নড়েচড়ে উঠেছে এতক্ষণে, হ্যাঁ বাবা, আপনি জিরিয়ে নিন। সময় হলে ডাকবেন, আমি চা করে দেব। টোটো, টুকির খেলনাটা তুই দাদুর ব্যাগে ভাল করে প্যাক করে দিয়ে দিস।
শুভাশিসের ভারি বিচ্ছিন্ন লাগছিল নিজেকে। শিবসুন্দর টোটো ছন্দা সবার মাঝেই বুঝি এক গোপন বোঝাপড়া আছে, সেই শুধু এখানে বহিরাগত।
শুভাশিস বেরিয়ে আসছিল, শিবসুন্দর ডাকলেন, তোমার কি বিকেলে কোনও কাজ আছে শুভ?
-কেন?
–তোমার গাড়িতে আমাকে একটু হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবে?
বাবা গাড়ি চড়তে চায়! বাবার কি আজ শরীর খারাপ! পলকের জন্য শিবসুন্দরকে পেশাদারি চোখে জরিপ করল ডাক্তার শুভাশিস। উঁহু, মুখে তো কোনও অস্বস্তির চিহ্ন নেই!
মুখে হালকা আহত ভাব এনে বলল, –এটা একটা প্রশ্ন হল বাবা? তবে তেমন বুঝলে আজ রাতটা থেকেও যেতে পারো।
–তুই কি ভাবছিস আমি অসুস্থ? শরীর গড়বড় করলে এসেই কি টোটোকে নিয়ে বেরোতাম?
শুভাশিস একবার ভাবল বাবাকে নার্সিংহোমের কথা জিজ্ঞাসা করবে কিনা। মনে মনে অভিমানও হচ্ছিল। বাবা ঘুরে এল, অথচ এখনও একবারও নার্সিংহোম নিয়ে কিছু বলল না তাকে। থাক গে, সেই বা কেন যেচে কথা তুলবে?
ম্লান স্বরে শুভাশিস বলল, –তোমাকে অসুস্থ ভাবিনি। মনে হল এতকাল পর এলে … একবার একটা রাত থেকে গেলে ক্ষতি কি?
–তা হয় না।
–কেন হয় না শুনি? এখন তো আর তুফান ওখানে একাটি নেই। অলকাও মার সেবাশুশ্রূষার কাজ ভালমতোই শিখে নিয়েছে।
না রে বাবা। তুফান আমার জন্য তারকেশ্বর স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবে। জানিসই তো কেমন আঁকুপাঁকু করা ছেলে, আমি না ফিরলে স্টেশনেই হয়তো একটা অনর্থ ঘটিয়ে বসবে।
কথাটাতে কি শুভাশিসের সঙ্গে কোনও সূক্ষ্ম তুলনা আছে তুফানের? শুভাশিস ঠিক বুঝতে পারল না। একটু উদ্বেগের সুরে বলল, তুমি শীতের রাত্তিরে অতটা পথ মোপেডে ফিরবে?
–দুৎ, তারকেশ্বর আর কতটুকুনি পথ? ওর থেকে কত বেশি সময় আমাকে মোপেডে করে ঘুরতে হয়।
শুভাশিসের বলতে ইচ্ছে হল, কেন ঘোরো বাবা? না বলে ড্রয়িং স্পেসে এসে সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে দিল। এতাল-বেতাল কত চিন্তা ঢুকে পড়ছে মাথায়। ভালবাসার কথা শুনে কী অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল ছন্দা! মুখটা কি ছন্দার কোমল হয়েছিল তখন? বোধহয় না। এ কথা তো শুভাশিসের মুখ থেকে কখনও শোনেনি ছন্দা, তাই হয়তো প্রতিক্রিয়াটাও …। মনসতীনের শ্বশুরের শ্রাদ্ধ থেকে ফিরে ভরদুপুরে কোনও স্বামী যদি ভালবাসার কথা শোনায়, সেটা পরিপাক করা কি খুব সহজ কাজ?
শুভাশিস কথাটা বললই বা কেন? একটা সম্পর্কের শুকনো শিকড় আজই মন থেকে পাকাপাকিভাবে উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল, তাই? ইন্দ্রাণীর দর্পিত আচরণে নাক কান কাটা গিয়ে সে কি এতদিন পরে ছন্দার কাছে আশ্রয় খুঁজছে? যাই হোক না কেন, মুখের কথাটাকেই এবার সত্যি করে তুলতে হবে। অনেককাল ভেসে ভেসে কেটে গেল শুভ, এবার তোমার ঘরে ফেরার পালা। উফ, তবু কেন ওই মেয়েমানুষটা বারবার হানা দেয় বুকে? চলতে পারে না, চলতে পারে না, এ চলতে পারে না। সতীসাধ্বী স্ত্রী সেজে আদিত্য রায়ের পাশেই বসে থাক ইন্দ্রাণী। তার জন্য আর একটি পলও অপচয় নয়। আদিত্য রায়ের মেয়ে হয়ে থাকাই যখন তিতিরের নিয়তি, শুভাশিসেরই বা এত হ্যাংলামি কিসের? উ উহ, বাপের জন্য উপোস! তাই কর।
মনটাকে সুখী সুখী করার জন্য আপন মনে গুনগুন গান ধরল শুভাশিস। পুরনো গান, কবে যেন কোন ট্রেনের কামরায় এক ভিখিরি বেসুরে গাইছিল। নয়ন মেলে দ্যাখ দেখি মন, কে তোর প্রিয়, কে তোর আপন। একই কলি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে শুভাশিস। বেখাপ্পা সুরে। ঢালাও আবেগ দিয়ে। উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে বুকের ভেতরেই সুর তারায় পৌঁছে গেল। আর একটা গানও সুড়সুড় করছে গলায়। মন চলো নিজ নিকেতনে। গাইবে? না, এই গানটাই ভাল। নয়ন মেলে দ্যাখ দেখি মন, কে তোর প্রিয়, কে তোর আপন …। শুভ রে, আর একা হয়ে থাকতে ভাল লাগে না রে। প্রিয় খোঁজ। আপন খোঁজ।
শিবসুন্দর বেরোলেন সাড়ে চারটে নাগাদ। শুভাশিস আগেই তৈরি হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেছিল, সিটে বসে শিবসুন্দর বললেন, –তোমার নতুন গাড়ি কবে ডেলিভারি পাচ্ছ?
এ খবরও কানে পৌঁছে গেছে!
শুভাশিস গাড়ির ইগনিশান সুইচ অন করল, –এ মাসের শেষাশেষি তো এসে যাবে বলছে। কথাটা বলেই রত হল আত্মরক্ষায়, ছন্দা বাজারহাট যায়, দিদি জামাইবাবুর বাড়ি যায় … টোটোর কেমিষ্ট্রি স্যারের বাড়ি সেই বেহালা চৌরাস্তায় … গিয়ে পড়ে আসতে হয় … আমি সব সময়ে গাড়ি স্পেয়ার করতে পারি না … আরেকটা গাড়ির খুব প্রয়োজন ছিল।
–হুম। মিটিমিটি হাসছেন শিবসুন্দর, মানুষের প্রয়োজনের যে কোথায় সীমা! তোমার গাড়ির সিটটা বেশ কমফর্টেবল হয়েছে। নতুন করালে?
–এই তো পুজোর পর করালাম। আগেরটা ঝরঝরে হয়ে গিয়েছিল।
শুভাশিস ক্লাচ চেপে গিয়ার বদলাল। অ্যাক্সিলেটারে আলতো চাপ দিতেই মসৃণ গতি। ছুটির বিকেল বলে পথঘাটে ভিড়ের কমতি নেই, শীতকালে এই সময়টায় সবাই বোধহয় সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে। চারদিকে অজস্র রঙের সমারোহে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
ঝোলা ব্যাগ থেকে মাফলার বার করে গলায় জড়িয়ে নিলেন শিবসুন্দর, শুনেছ বোধহয়, তোমাদের নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম আজ? তোমার পার্টনার ছেলেটির সঙ্গে আলাপ হল।
–অরূপ ছিল তখন?
–একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিল। তোমাদের নার্সিংহোমে পুলিস আসে কেন শুভ?
–বোধহয় ওর কোনও বন্ধুবান্ধব হবে। শুভাশিস এড়াতে চাইল।
বন্ধুবান্ধব! কথাবার্তা কেমন ফর্মাল মনে হচ্ছিল!
চোখ বটে। শুভাশিস প্রমাদ গুনল। একটা নার্সিংহোমে চালাতে গেলে কত রকম দেবতাকে যে তুষ্ট রাখতে হয় তার ফিরিস্তি শুনলে বাবা হয়তো গাড়ি থেকে নেমে চোঁ-চোঁ দৌড় দেবে। পাড়ার পুজো, পাড়ার মস্তান, পলিটিকাল দাদারা তো আছেই, এর সঙ্গে খেপে খেপে সরকারের হাজারও ডিপার্টমেন্ট হাত্তা মারছে। আজ লেবার কমিশনারের অফিস থেকে ইন্সপেকশনে এল, তো কাল এল রেজিস্ট্রেশান, পরশু করপোরেশান, তার পরের দিন ইনকাম ট্যাক্স, চলছে তো চলছেই। সকলেরই কী ক্ষিধে! কেউ বাটি পেতে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বাক্স বাজাচ্ছে, কেউ ঠক ঠক হাতুড়ি ঠুকছে। বুকে। এদের মধ্যে তাও বেচারা পুলিশ কাজেকর্মে লাগে, মস্তানদের বেয়াড়া হুজ্জোত সামলায়। তারা তাদের সার্ভিসের বিনিময়ে মাঝে মাঝে নার্সিংহোমে পা রাখবে না, তা কি হয়! অফিসের লোকজনই এসব সামলায় বেশির ভাগ, তবু তার মধ্যে ছুটকো-ছুটকো দুচারটে ঝামেলা শুভাশিসদের ঘাড়েও এসে পড়ে বইকি। অরূপের পাবলিক রিলেশান ভাল, অকারণে অনেকক্ষণ চোয়াল ফাঁক করে রাখতে জানে। রঙ্গরসিকতার ছলে টিটকিরি বিদ্রূপ ছুঁড়লেও আমুদে স্বভাবের জন্য থানার ওসি-টোসিরা ওকে পছন্দ করে রেশি। নার্সিংহোমের সামনে দিয়ে গেলেই ব্যাটারা একবার করে উঁকি মেরে যায়, অরূপ আছে কিনা দেখে। এসব নৈবেদ্য দেওয়ার ব্যাপারে শালিনী আবার শুভাশিসের থেকেও অগা। বাড়িতে যতই সে ছটফটে মিশুকে হোক না কেন, কাজে বেরোলেই কোত্থেকে যেন এক কাটখোট্টা ডাক্তার-দিদিমণির মুখোশ এঁটে নেয় মুখে। স্টাফেরা তাকে যমের মতো ভয় পায়। অন্যরাও। একবার এক মহিলা ইন্সপেক্টরের সামনে এমন পাথরের মতো মুখ করে বসেছিল যে মহিলা মুখ ফুটে তার অভিপ্রায় জানাতেই পারেনি। কাঁচুমাচু মুখে বীরেশবাবুকে গিয়ে বলেছিল, আপনারা আমার ট্যাক্সি ভাড়াটাও দেবেন না? দু পিঠের না হোক, এক পিঠের?
শিবসুন্দরের গলা কানে এল শুভাশিসের, দেখে চালাও শুভ। তুমি বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছ।
শুভাশিস তাড়াতাড়ি বলে উঠল, –না। হঠাৎ পুলিশ এল কেন তাই ভাবছিলাম।
–তুমি কি আমাকে ত্রেতা যুগের লোক ভাব শুভ? আমি কি কাগজ-টাগজ পড়ি না, নাকি দেশের খবর রাখি না? সব জানি। এখন গাঁ-গঞ্জও এমন কিছু সাধুসন্তে ভরা নয়। গাঁয়ের দোকানদাররাও বোঝে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গেলে চারদিকে ফুল ছেটাতে হয়। শিবসুন্দর ধূর্তের মতো হাসছেন, তোমাদের ওখানে গোটা তিনেক নার্স তো বাচ্চা হে, ওরা কি রেজিস্টার্ড?
–অত রেজিস্টার্ড নার্স কি পাওয়া যায় নাকি? শুভাশিস রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটা এক উদোমাদা লোককে কাটিয়ে গেল সন্তর্পণে। রেয়ার ভিউ মিরারে চোখ রেখে দেখে নিল উদাসীন পথচারীকে। বলল, আমাদের দুজন মেট্রনই খুব এক্সপিরিয়েন্সড, তারাই দরকার হলে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেয়।
–দু-চারটে আইন-কানুন তা হলে তোমাদেরও ভাঙতে হচ্ছে?
–আইন তো মানুষেরই জন্য বাবা। মেয়েগুলো খুব গরিব। কাজও করে খুব সিনসিয়ারলি।
অন্যায় করার আগে সব মানুষই মনে মনে যুক্তি সাজিয়ে নেয় শুভ। সমস্ত অন্যায়েরই খারাপ দিক থাকে, আবার ভাল দিকও থাকে কিছু। ভালটার জন্য কিন্তু অন্যায়টা ন্যায় হয়ে যায় না।
ন্যায়-অন্যায় ব্যাপারটাও খুব রিলেটিভ বাবা। চোখ মন পরিস্থিতি আউটলুক এরাই নিত্যনতুন ন্যায়-অন্যায়ের ডেফিনেশন ঠিক করে। এক সময়ে তো সমুদ্র পার হওয়াটাও অধর্ম ছিল, এখন কি তা আছে?
শিবসুন্দর একটা শ্বাস ফেললেন।
রবীন্দ্রসদনের সামনে পৌঁছে থমকে আছে গাড়ি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশের মাঠ জুড়ে বিশাল বর্ণাঢ্য মেলা। একটা নয়, দু-দুটো। দঙ্গল দঙ্গল মানুষ ছানাপোনা সমেত হুড়োহুড়ি করে পার হচ্ছে চওড়া রাস্তা।
ভিড় দেখতে দেখতে এক সময়ে শিবসুন্দর মৃদু স্বরে বললেন, -তর্কে সব সমস্যার সমাধান হয় না শুভ। তুমি যদি তর্কে হেরেও যাও, তোমার পথ কি বদলাবে? নাকি আমি হেরে গেলে আমার জীবনের ছাঁচটাকে বদলে ফেলতে পারব? কোনওটাই হবে না। তবে কি জানো, এত সব ঝক্কিঝামেলায় না গেলেই পারতে। নিত্যদিন ক্ষুদ্রতা নীচতার সঙ্গে আপোস করতে করতে মানুষের মনটা ছোট হয়ে যায়। আর ছোট হয়ে যাওয়া মানুষ তার চারপাশের কাউকেই বড় কিছু দিতে পারে না। বাট দ্যাটস ইওর প্রবলেম, নট মাইন। আমার তোমার সম্পর্কে অভিযোগ অন্য জায়গায়। এত চাপের মাঝে পড়ে তুমি কোনও দিকে তাকাচ্ছ না, তোমার সংসারটা নেগলেক্টেড হচ্ছে। …
–নেগলেক্ট? সংসারকে? আমি?
–হু এলস? কেন বিয়ের এত বছর পর ছন্দাকে হঠাৎ ঠাকুরঘরে রেফিউজ খুঁজতে হচ্ছে? তোমার ছেলের সঙ্গে আমি দু ঘণ্টা একসঙ্গে ছিলাম, গোটা সময়টা সে একবারও তোমার প্রসঙ্গে কোনও কথা তুলল না। কেন শুভ?
–তা আমি কি করে বলব? শুভাশিস পাংশু মুখে গাড়ি স্টার্ট দিল, আমি যা করি সবই তো ওদের জন্যে। হ্যাঁ, অঢেল সময় আমি ওদের জন্য কোনওদিনই স্পেয়ার করতে পারি না। করা সম্ভবও নয়। আমার রুগী আছে, চেম্বার আছে, নার্সিংহোম আছে …। অ্যান্ড দিজ থিংস আর নট নিউ।
কিন্তু ব্যাপারটা আমার চোখে এখন এত বেশি করে লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে ছন্দা টোটোর মধ্যে অনেক গ্রিভান্স জমেছে?
চটজলদি জবাব দিতে পারল না শুভাশিস। আজই জীবনের ধারাটা বদলাবে স্থির করল, আজই কি এসব কথা না উঠলে চলছিল না?
ময়দানে শেষ বিকেলের নরম হলুদ আভা। পথের দু ধারে সার সার কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গুলমোহর, তাদের বিরল পাতাগুলোকে এখন সোনার কুচি বলে ভ্রম হয়। গঙ্গার দিকে আকাশে অজস্র রঙের ছটা। রেড রোডের গা ঘেঁষে ট্র্যাকস্যুট পরে দৌড়চ্ছে একটি মেয়ে। দুপাশের মাঠে ক্রিকেটের আসর ভাঙার সময় হয়ে এল।
শিবসুন্দর হঠাৎ বলে উঠলেন, তুমি ছন্দার অপারেশন করাচ্ছ কবে?
শুভাশিস ঈষৎ অভিমানের সুরে বলল, – কবে থেকেই তো করাতে বলছি, ছন্দা কথা শুনছে না। জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে তাও আলট্রাসোনোটা করালাম …
–হুঁ, রিপোর্টটা দেখলাম। মালটিপল ফাইব্রোমা। ব্লাড রিপোর্টও তো অ্যালার্মিং। হিমোগ্লাবিন এইট পয়েন্ট সেভেন। তোমার কি মনে হয় না ব্যাপারটা সিরিয়াসের দিকে যাচ্ছে?
ডাক্তার শিবসুন্দর নন, পিতা শিবসুন্দর কথা বলছেন। শুভাশিস বুঝতে পারছিল। স্নেহ ভালবাসার সঙ্গে মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে তর্ক জোড়া যায় না। বলা যায় না অনেকেই এই অবস্থায় দীর্ঘদিন অপারেশন না করিয়ে থাকতে পারে। বাবাও কি তা জানে না? উদ্বেগে ভুলে গেছে।
শুভাশিস কোমল স্বরে বলল, শালিনী, মানে যার সঙ্গে তোমার আলাপ হল সেই অরূপের বউ, সেই ছন্দাকে দেখছে। খুব কড়া ডক্টর। তেমন বুঝলে ঘেঁটি ধরে নিয়ে গিয়ে ছন্দাকে ও-টিতে শুইয়ে দেবে।
যদি দেরি হয়ে যায়?
–রিসকের কোনও চান্স নেই বাবা। শালিনীর ওপর আমার ফুল কনফিডেন্স আছে।
শিবসুন্দর আবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন, সবই সত্যি। সবই ঠিক। তবু আমার বড় ভয় হয় শুভ।
বিস্মিত চোখে বাবাকে দেখে নিল শুভাশিস, কিসের ভয়?
–সে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। তবু একটা কথা বলি। পুরনো ঘটনা। তুমি বোধহয় জানো তোমার মার দুর্ঘটনাটার সময়ে আমি মেদিনীপুরে ছিলাম। কদিন ধরেই বাতাসে জোর গুজব ছিল ষোলোই অগাস্ট কলকাতাতে একটা বড়সড় গণ্ডগোল হতে পারে। আমার তখনই উচিত ছিল সোজা কলকাতায় তোমার মার কাছে চলে আসা। কিন্তু ওই…। মনে হল চিন্তার কি আছে! তোমার মা তার বাপের বাড়িতে আছে, দেখাশোনা করার লোকেরও অভাব নেই, শি ইজ সেফ, শি ইজ সিকিওরড। রায়ট বাধার তিন দিন আগে চলে গেলাম লালগড়। বর্ষার শেষ, ওখানে তখন কয়েকটা গ্রামে খুব কলেরা হচ্ছিল। দিন সাতেক পরে মেদিনীপুরে ফিরে মেসেজটা পেলাম। বাট ইট ওয়াজ টুউ লেট। …সেই ভয়ঙ্কর রাতে আমি যদি তোমার মার কাছে থাকতাম…হয়তো তাতেও আমি ঘটনাটা প্রিভেন্ট করতে পারতাম না… তবু বিপদ যে কোন দিক থেকে আসে, কখন আসে, আমরা কি জানি শুভ? স্টিল আমাদের যদি কোথাও গাফিলতি থেকে যায়, যেমন আমার ছিল, তা শোধরানোর আর কি কোনও চারা থাকে? আমার কেবলই মনে হয় আমার জীবনের ডিজাস্টারটা, যেটাকে আমি মনে মনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছি, …তোমার জীবনে আমি তার পুনরাবৃত্তি চাই না।
শুভাশিসের বুকটা ভারী হয়ে আসছিল। ডালহাউসি পাড়ার বিশাল বিশাল অট্টালিকা অতিকায় সব ছায়া ফেলেছে রাজপথে। ছুটির দিনে অফিসপাড়া অদ্ভুত রকমের নির্জন, যেন এক পরিত্যক্ত সভ্যতার মধ্যে দিয়ে ছুটছে শুভাশিসের যন্ত্রযান। এত কথা এক সঙ্গে কখনও বলেন না শিবসুন্দর। আজ শুন্যনগরীতে কথাগুলোকে কেমন স্বীকারোক্তির মতো শোনাচ্ছিল। শিবসুন্দর বললেন, এই কথাগুলোই তোমাকে একটু একান্তে বলার দরকার ছিল। তাই এই গাড়িতে আসা।
ভারী বুকে একটা কষ্ট ঘুরপাক খাচ্ছিল শুভাশিসের। বাবার জন্য মায়া হচ্ছিল বড়। শক্তপোক্ত মানুষটার মধ্যে কত কান্না জমে আছে!
অস্ফুটে বলল, গ্রামে নাকি পার্টির লোকেরা তোমাকে খুব ডিস্টার্ব করছে? এখন কী অবস্থা বাবা?
-ও তেমন কিছু না। এক সঙ্গে থাকতে গেলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মতান্তর মনান্তর হবেই।
–তবু সাবধানে থেকো। দিনকাল ভাল নয়।
হাওড়া স্টেশনের জনারণ্যে বাবাকে মিশিয়ে দিয়ে ফিরছিল শুভাশিস। শীতার্ত ঘাসের বিষণ্ণতা নিয়ে। ফেরার পথে রুটিনমাফিক নিজেদের নার্সিংহোমে এল। ভিজিটিং আওয়ারস চলছে, নার্সিংহোমে বেশ ভিড়। সচরাচর রবিবার বিকেলে অরূপ নার্সিংহোম মাড়ায় না, আজ চেম্বারে আছে, কি যেন লেখালিখি করছে বসে।
পর্দা সরিয়ে শুভাশিস তার ঘরে ঢুকল। ভারী বুকে হালকা গলায় বলল, তুই কি আজ নার্সিংহোমেই বডি ফেলে দিয়েছিস?
–আরে দ্যাখ না, দুপুরে গিয়েও আবার ফিরে আসতে হল। বাড়িতে ভিড়, গ্যাঞ্জাম। পুনা থেকে সব ইন-লরা এসেছে। ওখানে বসে কি কাজ করা যায়?
কী এমন কাজ? টেরচাভাবে চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে দিল শুভাশিস।
বারে, নিউজ পেপারে কলাম লেখা শুরু করেছি না! কাল সকালে লেখাটা নিতে আসবে।
–এবার কী টপিক?
–ব্রেস্ট ফিডিং। মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নাই।
–কেন বেবিফুড কোম্পানিগুলোকে বামবু দিচ্ছিস রে? ওদেরও তো করেকম্মে খেতে হবে।
–খাক না। হু অবজেক্টস? অরূপ চোখ তুলল, আমি আমার সোশাল ডিউটি করে যাব।
সঙ্গে নিজের পাবলিসিটিটাও। শুভাশিস চোখ টিপল, প্রতি উইকে কাগজে নাম বেরোচ্ছে… বেড়ে আছিস। পেশেন্ট-টেশেন্ট বাড়ছে?
অরূপ সরু চোখে তাকাল, তুই যে শালা লাস্ট উইকে টিভিতে গলব্লাডার অপারেশান নিয়ে লেকচার মেরে এলি, তোর পেশেন্ট বেড়েছে?
–বেড়েছে বইকি। মিডিয়ার তো একটা বড় এফেক্ট আছেই। শব্দময় হাসিতে বুক অনেক হালকা করে নিল শুভাশিস। মুখের ফ্রেমে হাসিটুকু ধরে রেখে বলল, জানিস তো, প্রোগ্রামটা শুটিং-এর দিন ভাস্করের সঙ্গে স্টুডিওতে দেখা। আমাকে দেখে ব্যাটা হেভি বমকে গেল। ওর আইডিয়া ছিল ও একা টিভি ক্যাপচার করে রেখেছে। আমাদের নার্সিংহোম স্টার্ট হওয়ার পর থেকে শালা আরও জ্বলছে। শুনেছিস তো ওর নার্সিংহোমের সেই ফিনানশিয়ার ফেরায় ফেঁসে গেছে?
–হ্যাঁ, কে যেন একটা বলছিল। শুভাশিস-ভাস্করের পেশাগত ঈর্ষায় অনুপ্রবেশ করল না অরূপ। কলম বন্ধ করে বলল, সকালে মেসোমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ হল। সত্যি রে, আ রিয়েল সেন্টলি ম্যান।
–কী বলল তোকে?
–ডিজিজ মেডিসিন নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা হল। ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন। খুব খুশি। ওই সময়ে আবার ব্যাটা মিত্তির দারোগাটাও এসেছিল। পুরনো আমলের মানুষ তো, আন্দাজ করতে পারেননি ব্যাটা গুঁড়োর লোভে এসেছে। ওর সঙ্গেও খুব গপ্পো জুড়েছিলেন। দেশের হালচাল, অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের অবস্থা, পুলিশদের ওপর পলিটিকাল দাদাদের ছড়ি ঘোরানো… মিত্তিরটাও তো খুব বকতে পারে, বড় বড় কথা শুনিয়ে মেসোমশাইকে একেবারে অ্যামেজড করে দিচ্ছিল।
শুভাশিসের হাসি পেল। বাবাকে মুগ্ধ করা এতই সোজা! পলকের জন্য হাওড়া স্টেশনের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল। হাজার লোকের ভিড়েও কেমন আলাদা হয়ে হাঁটছিল বাবা।
অন্যমনস্ক মুখে শুভাশিস বলল, শালিনীর সঙ্গে একটু দরকার ছিল। এখন বাড়ি গেলে কথা বলা যাবে?
–যেতে পারিস, তবে বললাম যে বাড়িতে আজ হেভি গ্যাঞ্জাম। আমিই উদ্বাস্তু হয়ে গেছি।
–থাক। পরে দেখা যাবে। পারলে রাত্রের দিকে একটা রিঙ করব।
–কোনও এমারজেন্সি?
–নাহ, ওই ছন্দার ব্যাপারেই… অপারেশানটা এবার জোর করেই করাতে হবে।
কথাটা তো কবে থেকে বলছি তোকে।
সে কে না বলছে! শুভাশিস প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল। লম্বা লম্বা ধোঁয়া ছাড়ছে। দুপুরে ভালবাসার কথা শুনে নির্বিকার সরে গেল ছন্দা। নতুন করে বুনতে হবে সংসারটাকে। ছেঁড়াফাটা জায়গাগুলো ঠিকঠাক রিপু করা দরকার। যেন একদম নতুন দেখায়।
দুপুরের গানের কলিটা মনে মনে ভাঁজার চেষ্টা করল শুভাশিস। মনে পড়ল না লাইনগুলো।