৪১.
ন্যাড়ামাথা ব্রাহ্মণটি ধীরে ধীরে উঠে আসছেন। সর্ব অঙ্গে ব্রহ্মচর্যের দীপ্তি। অঙ্গজ্যোতিতে চারদিক রাঙা হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। চারদিকে তার অভ্যর্থনা। পাখি ডাকে, গাছপালাতেও নীরব কোলাহল ওঠে যেন। মাটি থেকে আকাশের মধ্যবর্তী যা-কিছু সকলকেই যেন স্পর্শ করে সেই আলোর শিহরন।
সূর্যকে কেন ব্রাহ্মণ বলে মনে হয় বলাকার কে জানে। রোজ সকালে সে গৌরহরির পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যকে প্রণাম করত। আজও করে। এক দীপ্ত ব্রাহ্মণকেই যেন নিবেদিত হয় সেই প্রণাম। পুবের জানালায় দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ সম্মোহিত চোখে চেয়ে থাকে মুণ্ডিত মস্তকটির দিকে। এই সময়টায় বড় পবিত্র মনে হয় নিজেকে। তারও হয়তো তেমন কোনও কারণ নেই। হয়তো সবই কল্পনা করে নেওয়া, ধরে নেওয়া। তা হোক, তবু এইটুকুই তার লাভ। •
আজকাল বলাকার নানা প্রশ্ন ওঠে মনের মধ্যে। তার মধ্যে একটা হল ভগবান। ভগবান বলে কেউ কি আছে? থাকলে কেমন দেখতে? ভগবানকে দিয়ে কী হয় মানুষের? কত মানুষ তো ভগবান-টগবান মেনেও দিব্যি হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। তাহলে কি সকলের ভগবান দরকার হয় না?না মানলেও চলে?
গৌরহরি সন্ধ্যাআহ্নিক নিয়মিত করত। কখনও ভুল হত না। প্রায় সময়েই গীতা খুলে বসত। গুরুগম্ভীর গলা আর চমৎকার উচ্চারণে একটু সুরের ওপর যখন পাঠ করত তখন যেন বাড়িটায় একটা ঢেউ খেলে যেত।
একবার এক ঘোর নাস্তিক মক্কেল গৌরহরিকে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা চাটুজ্জেমশাই, আপনি তো একজন শক্ত মনের মানুষ, প্রবল আপনার পারসোনালিটি; টাকাপয়সা, স্বাস্থ্য, সম্পদ সব আপনার আছে। তার ওপর আবার ঈশ্বরবিশ্বাসের দরকার কী? ঈশ্বরবিশ্বাস তো ধান্দাবাজি। ভগবানকে পটিয়ে পাটিয়ে নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য মতলববাজরা ওসব করে।
গৌরহরি বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে মিটিমিটি হেসে বলেছিল, ওরে বাবা, নাস্তিক হওয়া যে খুব কঠিন কাজ।
কেন মশাই, কঠিনটা কীসের? বিশ্বাস না করলেই হয়।
সে তোমার মতো মুখর হয়। ভাল নাস্তিক হতে গেলে মহাজ্ঞানী হওয়া লাগে। বিজ্ঞান, দর্শন, শাস্ত্র, তপস্যা সব গুলে না খেলে কি নাস্তিক্য দাঁড়ায়? সবটা জেনে বুঝে তবে বুক ফুলিয়ে বলতে পারা যায়, ওহে বাপু, আমি সাধনা-টাধনা সব করে দেখেছি, কিচ্ছু নেই। বুঝলে মক্কেল, নাস্তিক হওয়া বিস্তর ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। তার চেয়ে আস্তিক হওয়া সোজা।
আপনি কি সেই জন্যই আস্তিক?
সেই মিটিমিটি হাসি হেসেই গৌরহরি বলল, আমি কেন আস্তিক তা আমি জানি। কিন্তু বাপু, তুমি কেন নাস্তিক তা কি তুমি জানো? ভগবান আছে, এ বিশ্বাস যদি হাইপথেটিক্যাল হয় তাহলে ভগবান নেই, এই বিশ্বাসও হাইপথেটিক্যাল। সুতরাং লড়াই ছেড়ে মামলার কথায় এসো, তাতে সময় কম নষ্ট হবে।
মক্কেল চুপসে গিয়েছিল।
কিন্তু আজকাল বলাকারও ওরকম সব বিপজ্জনক কথা মাথায় আসে। গৌরহরি কাছে থাকতে এসব প্রশ্ন মনে উদয় হত না। আজকাল হয়। একদিন তো স্বপ্ন দেখল, গৌরহরি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম হাতে দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
হ্যাঁ গা তুমি নাকি নারায়ণ! ও মা! টের পাইনি তো কোনওদিন।
গৌরহরি মিটিমিটি হেসে বলল, টের পাবে কী করে? কাছে পেলে কি আর টের পাওয়া যায়? যদি পাওয়ার জন্য কষ্ট করতে হত তাহলে ঠিক টের পেতে!
তা এখন কী করব তোমাকে? পুজো করব?
ভালবেসো, তাতেই হবে।
ভালবাসার কথা আর বোলো না। ভালবেসেই তো মরেছি। তুমিও গেলে আর আমারও যেন অর্ধেক প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। আরও ভাল কী করে বাসা যায় বল তো?
তা বটে। তোমার আমার ভালবাসার কথা সবাই বলে। কত কষ্ট দিয়েছি তোমাকে, কোনওদিন রাগ করলে না আমার ওপর।
কষ্ট! কষ্ট বলে বুঝতেই পারলুম না তো কখনও। তোমার মুখখানা খুশি দেখলেই বুক ভরে যেত।– আর তুমিও কি কম কষ্ট করেছ আমার জন্য? সেই টাইফয়েডের কথা মনে নেই? তখন আমার এগারো বারো বছর বয়স। শ্বশুর-শাশুড়ি দেওরননদ সব দল বেঁধে তীর্থ করতে গেছে। ফাঁকা বাড়িতে রুগি আগলে শুধু তুমি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাস্ত হচ্ছে, এলিয়ে পড়ছি, তখন কম করেছ তুমি? কোলে করে পায়খানায় নিয়ে গেছ। পথ্যি বেঁধে খাইয়েছ। মাথার কাছে ঠিক বাবার মতো বসে থেকেছ দিন রাত।
ও কিছু নয়। আমি ছাড়া তোমাকে দেখার তো কেউ ছিল না।
অন্য কেউ হলে বউকে তার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত, নইলে শাশুড়িকে এনে সেবার কাজে বহাল করত। তাই তো নিয়ম। পুরুষেরা তো ওরকমই হয়। তুমি তো তা করোনি। হ্যাঁ গা, কেন করেছিলে আমার জন্য অত কষ্ট?
দুর! আমার তো কষ্ট বলে মনেই হয়নি।
আমার খুব ইচ্ছে হয় ফের সেই সময়টায় ফিরে যাই। ফের আমার টাইফয়েড হোক আর শিয়রে তোমার মুখখানা জ্বলজ্বল করুক। জ্বরের ঘোরে মাঝে মাঝে চেয়ে তখন তোমাকে দেখতুম, আর ভারী নিশ্চিন্ত লাগত। তখন তো আমার একটুখানি বয়স, গা থেকে বাপের বাড়ির গন্ধ যায়নি, তবু মা নয়, বাবা নয়, তখন দিনরাত শুধু তোমাকেই চাইতুম।
মিটিমিটি হাসছিল গৌরহরি, বলাই, তুমি নাকি সহমরণে যেতে চেয়েছিলে আমার সঙ্গে!
চেয়েছিলুম তো। মনেপ্রাণে চেয়েছিলুম।
কেন বলাই, আমার সঙ্গে মরতে চেয়েছিলে কেন?
এখনই কি বেঁচে আছি! কবে মরব, কবে তোমার কাছে যাব শুধু সে কথাই ভাবি।
মরার কথা ভাবতে নেই বলাই। ভগবানের দেওয়া জীবন, তাঁর কাজ করতেই তো আমরা আসি।
আমার ভগবানও যেন তোমার সঙ্গেই ছেড়ে গেছে আমাকে। মাঝে মাঝে ভাবি, বোধহয় আমার ভগবান তোমার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। তাই কি আজ অমন নারায়ণের মতো দেখছি তোমাকে! হা গা, সত্যি তুমি ভগবান?
এক হিসেবে আমরা সবাই ভগবান। কম বেশি। তুমি তো দেখতে পাও না, তোমার মধ্যে আমি কতবার ভগবতীকে দেখেছি।
যাঃ, কী যে বলো। আমি পাপিষ্ঠা মেয়েমানুষ।
যার অত স্বামীর ওপর টান, পাপ তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না যে। বলাই, তুমি জানো না, বেঁচে থাকতে তোমাকে আমার কতবার প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়েছে।
ও মা গো! ওসব কথা বলতে আছে? আমার পাপ হয় না ওতে?
তখন আমার মক্কেল জুটত না। কোর্টে যাই আসি, দু-চার টাকার বেশি আয় হত না দিনে। আমার বোন পুঁটির বিয়ে ঠিক হল। বাবা আমার কাছে দশ হাজার টাকা চেয়েছিল। মনে আছে?
থাকবে না কেন?
মুখ শুকনো করে বসেছিলুম একদিন, তুমি তোমার সব গয়না বের করে দিয়েছিলে। সিনেমায় ওসব দেখা যায় বা শরৎচন্দ্রের নবেলে। বাস্তবে তো হয় না। সেদিন তোমাকে আমার প্রথম প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়েছিল।
আহা, ভারী তো গয়না। তার দশগুণ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছ। সেই গয়নাই বা কোন কাজে লাগল বলো! দু হাতে বিলিয়ে দিলুম তো। ওসব বলে আর আমার পাপের বোঝা বাড়িও না।
শুধু গয়নাই তো নয় বলাই, সে সময়ে তোমার মুখে যে অহংকার দেখেছি তার দাম দিই কী করে? স্বামীর গর্বে তোমার বুকখানা তখন ঝকঝক করছে, মুখে উপচে পড়ছে খুশি। অবাক হয়ে ভেবেছি সব গয়না দিয়ে দিচ্ছে, তবু ও এত খুশি কেন? এত আনন্দ কেন ওর চোখে মুখে? ভেবে কূল পাইনি। তখন কী করেছিলুম মনে আছে?
উঃ মা গো! ফের লজ্জা দিচ্ছ আমায়।
মনে নেই?
কেন থাকবে না? ভাবলে আজও শরীর শিউরে ওঠে। বুকে জড়িয়ে ধরে–ইস–
কতক্ষণ ধরে যে আদর করেছিলুম তোমায়। আদর যেন আর ফুরোয় না। আর সেই আদরের ভিতর দিয়েই বুঝি পারুল এল তোমার পেটে। তাই ভারী সুন্দর হল মেয়েটা।
হ্যাঁ গো, ঠিক তাই।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সূর্য প্রণামের পর নিঝুম হয়ে বলাকা প্রত্যক্ষ করছিল এইসব দৃশ্য। গায়ে শীতের কাঁটার মতো রোমাঞ্চ। মানুষটা নেই, না থেকেও কী ভীষণ জীয়ন্ত হয়ে আছে।
মা!
বলাকা ফিরে তাকায়।
ও মা, তোমার চোখে জল কেন? কাঁদছিলে নাকি?
লজ্জা পেয়ে বলাকা আঁচলে চোখ মুছে একটু হেসে বলে, দুঃখের কান্না নয় রে, পুরনো কথা মাঝে মাঝে বড্ড মনে পড়ে যায় তো।
পারুল হেসে বলে, মাঝে মাঝে নয় মা, তুমি এখনও পুরনো কালেই রয়েছ যে! তোমাকে আর আমাদের এই সময়ে টেনে আনতে পারলাম কই!
পুরনো নতুন কোনওটাকে বাদ দিয়ে কি এই বেঁচে থাকা! জীবনটা তো কোনওটাকে বাদ দিয়ে নয়। যে ভুলে যায় সে অভাগা। হা রে, কাল রাত থেকে তো তোর উপোস চলছে। এভাবে কি চলে?
কী করব বলো! খাওয়ার কথা ভাবতেই যে অরুচি। খাবারের গন্ধে পা গুলোয়।
এ সময়টায় অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে ইচ্ছে যায়। তা অখাদ্যই বা কী দি-ই তোকে। চালভাজা খাবি?
ম্যা গো।
রোজ রাতে বমি হচ্ছে, এসব তো ভাল নয়। চেহারাটা তো সিটকে মেরে গেছে। অমন রূপ যেন কালিঢালা।
জামশেদপুরে গেলে হয়তো এটা কেটে যাবে। তোমার জামাই তো কাল আসছে নিয়ে যেতে। তোমার মন খারাপ হচ্ছে না মা?
ওমা! তা আর হবে না। কটা দিন কাছে ছিলি, ভরে ছিলুম।
মোটেই তোমার মন খারাপ হচ্ছে না।
তাই বুঝি?
একাই তুমি ভাল থাকো, আমি জানি।
খুব বুঝেছ মা! একা যেন তোকে থাকতে না হয়, থাকলে বুঝতিস।
তাহলে চলো না আমাদের সঙ্গে। তোমার জামাই ভাল গাড়ি নিয়ে আসছে। দামি এ সি গাড়ি। আঁকুনি-টাকুনি লাগবে না। বাড়ির দরজায় চাপবে, একদম জামশেদপুরের বাড়িতে গিয়ে নামবে।
প্রস্তাব তো আর খারাপ নয়। কিন্তু তোর বাবা যে-গন্ধমাদন আমার মাথায় চাপিয়ে গেছে তা কি আর ঝেড়ে ফেলে যেতে পারি। বিষয়-আশয় দিয়ে বেঁধে রেখে গেছে। কিন্তু এসব খেলনাপাতি কি আর ভাল লাগে বল!
পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাকে আর নড়ানো যাবে না এখান থেকে, সে জানে। বিষয়-আশয় নয়, এখানে তার বাবার স্পর্শ আর গন্ধ আজও পায় তার মা। লোকটা বেঁচে নেই, তবু কী ভীষণ বেঁচে আছে।
শাঁকালু নেই মা?
বাগানে আছে বোধহয়। কেন, খাবি?
চেষ্টা করে দেখতে পারি।
দাঁড়া, দুখুরিকে বলি, এনে দেবে।
বেলার দিকে ভটভটি চেপে বিজু যখন এল, তখন নীচের বড় ঘরের চওড়া বারান্দায় রোদে বসে শাঁকালু চিবোচ্ছে পারুল। মুখ বেঁকিয়ে বলল, কী খাচ্ছ? শাঁকালু! দুর, ও কি মানুষে খায়?
পারুল হেসে বলল, তবে কি গোরুতে খায়?
তোমার কী হয়েছে বলো তো, ফের ডায়েটিং করছ নাকি? অমন ডিহাইড্রেটেড চেহারা করেছ কেন?
ছোট ভাই, তাকে তো আর বলা যায় না কিছু। পারুল বলল, রোগা হওয়া কি খারাপ?
তা বলে এত রোগা! বাঁশপাতার মতো হয়ে যাচ্ছ যে!
মোটরবাইকটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে সিঁড়িতে এসে বসল বিজু।
তোর প্র্যাকটিস এখন কেমন রে?
খারাপ নয়। তবে সেটা আমার গুণে তো নয়।
তবে কার গুণে?
জ্যাঠামশাই আমাকে ল পড়তে বলেছিলেন। পাস করার পর জুনিয়র করে নেন। তাঁর মক্কেলগুলোই পেয়ে গেছি। বেশি কষ্ট করতে হয়নি।
তোকে দেখে তো ফচকে ছোঁড়া মনে হয়। মক্কেলরা তোকে বিশ্বাস করে?
যখন উকিলের ধরাচুড়ো পরে বেরোই তখন তো দেখনি। রীতিমতো গুরুগম্ভীর চেহারা তখন। জজরা পর্যন্ত সমীহ করে।
ইস রে! একদিন দেখাস তো পোশাক পরে। দেখব কেমন গুরুগম্ভীর।
এখন তো কোর্ট বন্ধ। পুজোর ছুটি ফুরোয়নি। না হলে দেখাতাম।
বিটনুনের টাকনা দিয়ে একটা-দুটো শাঁকালুর টুকরো খেতেও যেন কত পরিশ্রম হচ্ছে পারুলের। পেটের নতুন অতিথির সঙ্গে মনে মনে অনেক ঝগড়া করে পারুল। কেন রে দুষ্ট, মাকে এত কষ্ট দিস? লক্ষ্মী ছেলের মতো থাক না চুপটি করে।
আবার ভাবে, এই কষ্টটুকুর মধ্যেও তো সুখ আছে। একটা শরীরের মধ্যে আর একটা শরীর জন্মাচ্ছে, বাড়ছে, সোজা কথা? এই আশ্চর্য ঘটনা তো সাদামাটাভাবে ঘটা উচিত নয়। যে আসছে সে জানান দিচ্ছে, করাঘাত করছে দরজায়।
কাল রাতে অমলদাকে দেখলাম, বুঝলে পারুলদি?
অবাক হয়ে পারুল বলে, অমলদা! আবার এসেছে বুঝি?
হ্যাঁ। বেশ রোগা হয়ে গেছে। মাধবের ওষুধের দোকানে দেখা। প্রথমটায় আমাকে চিনতেই পারল না, কেমন ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইল। কী যে হয়েছে লোকটার কে জানে!
পারুল বলল, বোধহয় বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া।
তাই হবে হয়তো। আমার কী মনে হয় জানো?
কী?
লোকটা দুম করে মরেটরে না যায়। সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি বলেই কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে।
চমকে উঠে পারুল বলে, ওমা! সে কী রে?
কাল কথা বলতে বলতে অনেকক্ষণ হাঁটলাম একসঙ্গে। কী বলছিল জানো?
কী?
বলল, আমি কেন এসেছি জানো? নিজেকে খুঁজতে। এই যে এইসব মাঠঘাট, এই যে গাছপালা, এর মধ্যেই আমি যেন ছড়িয়ে রয়েছি। বুঝলে, সময় বলে কিছু নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কিছু ঘটে আছে। একদিন ঠিক আমার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। শুনে তো আমি হাঁ। লোকটা কি শেষে পেগলে গেল নাকি পারুলদি?
পারুল স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, এরকম অবস্থা হয়েছে বুঝি? জানতাম না তো?
আমাকে পেয়ে আর ছাড়তেই চায় না। হেঁটে হেঁটে আমার বাড়ি অবধি গেল। চা খেল। মায়ের সঙ্গে গল্প করল।
তখন পাগলামির লক্ষণ কিছু দেখলি?
না। মাঝে মাঝে নরমাল, কিন্তু মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক চোখে কেমন যেন উদাস ভাব, যেন কাউকেই চিনতে পারছে না। পরনে একটা আধময়লা পায়জামা, গায়ে হলদে রঙের একটা দোমড়ানো পাঞ্জাবি, তার ওপর খয়েরি সোয়েটার। শীতে জড়সড়। বললাম, গ্রামে বড্ড শীত, গায়ে চাদর দেননি কেন? জবাবে বলল, চাদর! ও হ্যাঁ একটা চাদরও তো গায়ে দেওয়া যেত। খেয়ালই হয়নি।
মুখে মদের গন্ধ পাসনি?
না।
একটা শ্বাস ফেলে পারুল বলল, পাগলামি নয়। অনেক রকমের অবসেশনে ভুগছে।
ওরকম একটা ব্রাইট লোক কেমন হয়ে গেল বল তো!
পারুলের জিভে শাঁকালু আরও বিস্বাদ ঠেকছিল। দুর্বল গলায় সে বলল, সেটাই তো ভাবছি, বোধহয় অত ব্রাইট হওয়ার দরকার ছিল না ওর। সাদামাটা হলে বেঁচে যেত।
অনেকে বলে, তোমার জন্যই নাকি অমলদা ওরকম হয়ে গেছে। সত্যি পারুলদি? এ আমলে তো ওরকম প্রেম দেখি না আমরা।
পারুল লজ্জা পেয়ে বলে, দুর পাগলা! সেসব কত দিনের কথা! এতদিন কেউ এসব মনে পুষে রাখতে পারে নাকি? কত মৃত্যুশোকও ভুলতে হয় মানুষকে, আর এ তো প্রেমশোক!
প্ৰেমশোক! এটা কি বানালে নাকি?
মনে হল, তাই বললাম। না রে, আমার জন্য নয়। অমলদার অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিল শহরে গঞ্জে। পারুলকে ভুলতে ওর সময় লাগেনি। অমলদার প্রবলেম প্রেম-ট্রেম থেকে নয়। হয়তো ফ্যামিলি বা ক্যারিয়ারে কিছু গণ্ডগোল আছে।
কিংবা জিন! এসব তো জেনেটিক ব্যাপারও হতে পারে।
ওসব আমি জানি না বাপু।
লোকটার জন্য ভারী কষ্ট হল। একসময়ে লোকটাকে খুব ডাঁটে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। এখন একদম জবুথবু। এই লোকটাই যে সেই লোকটা তা মনে হয় না। অমলদা যে নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটা বোধহয় সত্যি। সেই অমলদা তো এ নয়।
অত ভাবিস না। যে যেরকম কপাল করে আসে তার তো তাই হবে।
কপাল! তাই হবে। আমি তো কপাল মানি না। লোকটার সব থেকেও কিছু নেই কেন সেটাই ভাবছি।
তুই কমিউনিস্ট, না?
এক সময় ছিলাম।
এখন নোস?
দুর। সাচ্চা কমিউনিস্ট হওয়া কি সোজা কথা? যখন দেখলাম আমাকে ক্যারিয়ার-ট্যারিয়ারের পিছনে ছুটতে হবে, টাকা কামাতে হবে, সংসার প্রতিপালন করতে হবে তখনই কমিউনিজমকে নমস্কার করে পাশ কাটিয়ে এসেছি। পিছুটান থাকলে ওসব হয় না। সব ছেড়ে আদাজল খেয়ে লাগতে হয়। হাফ কমিউনিস্ট হয়ে লাভ নেই।
.
দুপুরে মা আজ নিজে রাঁধল। গোলমরিচ আর মাখন দিয়ে আলুমরিচ, সঙ্গে কলাইয়ের ডাল আর এক বাঙাল বাড়ি থেকে রাঁধিয়ে আনা শুঁটকি মাছ।
খেতে বসিয়ে বলল, আজ অখাদ্যই দিয়েছি মা। মুখে দিয়ে দেখ, দুটি খেতে পার কি না। নইলে অনল ডাক্তারকে ডাকতে হবে।
পারুল আজ খেতে পারল। এবং খাওয়ার পর বমিও পেল না। বলাকা ছাঁচি পান সেজে রেখেছিল, বমি পেলে দেবে। তার দরকার হয়নি। দুপুরে লেপমুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়েও নিল পারুল।
বিকেলে শরীর ঝরঝরে লাগছিল যেন। দুর্বল, তবে সাংঘাতিক কিছু নয়।
সন্ধেবেলা শরীরটা ভাল থাকায় ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসেছিল পারুল।
হঠাৎ কেমন একটা সূক্ষ্ম অস্বস্তি বোধ করছিল পারুল। স্পষ্ট কিছু নয়, কেমন একটা ভয়-ভয়, ছমছম অনুভূতি। শীত পড়লেও বাগানের দিকটায় পুবের জানালার একটা পাল্লা খুলে রাখে পারুল। সব বন্ধ থাকলে তার মাথা ঝিমঝিম করে। খোলা পাল্লার ওপাশে অন্ধকার বাগান। সেই দিকে চেয়ে পারুল কিছুক্ষণ আনমনা রইল। অস্বস্তিটা কীসের তা বুঝতে পারল না। পেটে বাচ্চা আসায় যে নানা রকম বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন হয়েছে তার শরীরে এটাও কি তাই?
তার ছেলেমেয়ে দুটিই লক্ষ্মী। মাথাও পরিষ্কার। ওরা নিজেরাই পড়ে, নিজেরাই বোঝে। মা কাছে থাকলে একটু খুশি হয় ঠিকই, কিন্তু পারুল ওদের পড়ায় না। পড়ানোর দরকার হয় না বলে। সময় পেলে শুধু কাছে বসে থাকে। এ দুজন লক্ষ্মী ঠিকই, কিন্তু পেটে যেটা এসেছে সেটা যে দস্যি হবে তাতে পারুলের সন্দেহ নেই। খুব দস্যি হবে, এই বয়সে পারুলকে ছুটিয়ে মারবে, হয়রান করে দেবে। ভেবে গায়ে কাঁটা দেয় পারুলের। ভয়ও পেটেরটাকে নিয়েই। এ সময়ে খারাপ হাওয়া বাতাস লাগাতে নেই। গাঁয়ে খারাপ হাওয়া বাতাসের কথা খুব শোনা যায়। খারাপ আত্মা তো কম নেই। তারাই খারাপ নজর দেয়। এসব এমনিতে বিশ্বাস করে না পারুল। কিন্তু এখন এক অপার্থিব মায়ায় আচ্ছন্ন মন বড্ড নরম আর দুর্বল। এখন কেবলই ভয়, কেবলই অমঙ্গলের ছায়া।
উঠে গিয়ে জানালার খোলা কপাটটা বন্ধ করে দিল পারুল। জানালার ওপাশের গাঢ় অন্ধকারটাকে ভাল লাগছে না তার।
জানালা বন্ধ হল, তবু অস্বস্তিটা গেল না পারুলের। অনেকদিন আগে কুমারী অবস্থায় তার এরকম অনুভূতি কখনও কখনও হত। তখন ঠিক বুঝতে পারত, আড়াল থেকে কেউ তাকে দেখছে।
রোজ স্কুলে যাওয়ার পথে বসাক বাড়ির ধার দিয়ে যাওয়ার সময় এরকম হত। পরে ধরা পড়েছিল সুধীর বসাকের ছোট ছেলে পন্টু রোজ জানালার আড়াল থেকে দেখত তাকে।
কিন্তু এখন তাকে কে দেখবে? সে দুই ছেলেমেয়ের মা, পেটে আরও একটা। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। তবু এরকম হচ্ছে কেন?
লোডশেডিং-এর জ্বালায় এখানে সন্ধের পরই হাতের কাছে টর্চ রাখে পারুল। এ-বাড়িতে উঁচু উঁচু চৌকাঠ, জিনিসপত্রে আর ভারী ভারী আসবাবে ঠাসা সব ঘর। অন্ধকারে কোথায় হোঁচট খায়, কোথায় ধাক্কা লাগে সেই ভয়ে মা বলেছে সঙ্গে সবসময় টর্চ রাখতে।
টর্চটা নিয়ে উঠল পারুল।
মেয়ে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ মা?
বারান্দায়। এখনই আসছি।
একতলার অন্ধকার বারান্দায় পারুল চুপ করে টর্চ না জ্বেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। না, ভুল নেই। অস্বস্তিটা হচ্ছে। খুব সূক্ষ্ম, খুব মৃদু, কিন্তু বিভ্রম নয়।
বারান্দার ধারে এসে পট করে টর্চটা জ্বেলে বাগানের দিকে ফেলল পারুল। শীতে গাছপালা মরে এসেছে একটু। এখন আর নিবিড় নয় গাছপালা। আলোটা অবধি দেখা যায়।
কাউকে দেখা গেল না অবশ্য।
পারুল ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে রইল। তারপর টর্চের আলো ফেলল চারদিকে। কাউকে দেখা গেল না।
ঘরের দিকে ফিরে পা বাড়াতেই হঠাৎ মৃদু একটা কাশির শব্দ পেয়ে দাঁড়াল পারুল।
কে? কে ওখানে?
আমি পারুল।
টর্চটা জ্বেলে পারুল দেখল বাগানের বেড়ার ধারে ঝুপসি বাবলা গাছটার পাশে একজন দাঁড়িয়ে।
কে?
আমি অমল।
পারুল ভারী অবাক হয়ে বলে, অমলদা! তুমি ওখানে কী করছ?
অমল খুব ধীর পায়ে এগিয়ে এল। ভারী করুণ মুখে বলল, কিছু করছি না পারুল। এমনি ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখছি।
ঘুরে দেখছ! আচ্ছা মানুষ যা হোক! এই শীতে, অন্ধকার রাতে কেউ ঘুরতে বেরোয় বুঝি?
আমাকে দেখে ভয় পাওনি তো!
ভয় পাওয়ার দোষ কী? ওখানে দাঁড়িয়েছিলে কেন? ঘরে আসতে পারতে তো!
অমল উঠোনে বারান্দার নীচে এসে দাঁড়াল। মুখে ম্লান একটু হাসি। বলল, আজকাল আমার কেমন মনে হয়, আমাকে কেউ পছন্দ করে না। কারও কাছে গেলে সে বিরক্ত হয়।
যাঃ, ওসব তোমার মনের ভুল। এসো, ঘরে এসো।
আসব?
আসতে বাধা কীসের? এসো, গরম কফি খাও এক কাপ। চেহারার অমন ছিরি হয়েছে কেন?
অমলের গালে কয়েকদিনের দাড়ি, চুল বড় হয়েছে এবং ঝকড়া হয়ে আছে। পরনে পাজামা, পাঞ্জাবি আর একটা হাতকাটা সোয়েটার। বিজু যেমন বলেছিল ঠিক তেমনি। টর্চের আলোয় তেমন বোঝা গেল না, তবে মনে হল চোখের দৃষ্টিও কেমন ঘোলাটে।
এই লোকটাকে একদিন ভালবাসত পারুল। সেই ভালবাসা এখন আর নেই। কিন্তু মায়া তো আছে। কষ্ট তো আছে।
এই ভীষণ শীতে এ কী পোশাক তোমার অমলদা? শীত করছে না?
শীত! হ্যাঁ, শীত করে খুব। আমার রক্তের জোরও তো কমে আসছে।
তাহলে গরম চাদর বা ফুলহাতা সোয়েটার পরোনি কেন?
খেয়াল থাকে না।
ইস! আবার পায়ে চটি! পায়েই সবচেয়ে বেশি শীত লাগে, জানো না?
বললাম তো, ওসব খেয়ালই থাকে না।
খেয়াল কর না কেন? এত অন্যমনস্কতা কীসের?
অমল লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে একটু হাসল।
এসো, ঘরে এসো।
পড়ার ঘরের পাশের ঘরটিতে এনে অমলকে বসাল পারুল।
কী হয়েছে তোমার বল তো। এই তো দশ বারো দিন আগে কলকাতায় গেলে, আবার আসতে হল কেন?
অমল মাথা নেড়ে বলে, ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না।
বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আসনি তো? পুরুষদের বীরত্ব দেখানোর তো ওই একটাই জায়গা।
ঝগড়া! না পারুল, আমি ঝগড়া করতে পারি না। ইচ্ছেও হয় না।
তাহলে কী হল?
মন ভাল লাগছিল না। কেবল মনে হচ্ছে, সব ভুলভাল কাজ করছি। কিছু মনে থাকছে না, সবসময়ে আবোলতাবোল কী যেন সব ভাবছি। আজকাল ভীষণ ভীষণ ভয়ের স্বপ্ন দেখি।
ডাক্তার দেখাও না কেন?
সাইকিয়াট্রিস্ট?
তাই দেখাও।
অমল একটু চুপ করে থেকে বলল, এক সময়ে তাও দেখিয়েছি। ওষুধ খেয়েছি, তাতে ফল ভাল হয়নি। আমার সমস্যাটা বোধহয় মনোরোগ বা পাগলামি নয়। তা হলে কাজ হত।
লোকে কী বলে জান?
কী বলে?
আমি অবশ্য বিশ্বাস করি না। কিন্তু কারও কারও ধারণা আমার জন্যই তুমি এমন হয়ে যাচ্ছ। শুনলে আমি কষ্ট পাই, তা জানো?
এ কথাটা আগেও বলেছ পারুল। কিন্তু একজন মানুষের কাছে নশ্বর এক নারীই তো সর্বস্ব হতে পারে না। পারে কি?
কোনও কোনও মানুষের কাছে হতেও পারে।
অমল মাথা নেড়ে বলে, তুমি আমার কাছে অন্য রকম। হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা তো তুমি নও।
ওটা তোমার আর একটা পাগলামি। আমাকে দেবী বানিয়ে কী মজা পাও বল তো?
তোমার কথা থাক পারুল। তোমাকে নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করার অর্থই হয় না।
বেশ তো! তোমার এ দশা কেন সেইটেই বলো।
আমার মনে হয় এতকাল যে অমল বেঁচে আছে সে ভুল অমল। ভুল তার মেধা, তার লেখাপড়া, তার চাকরি, তার বিয়ে। সব ভুল, ওটা আসল আমি নয়।
ওমা! সে কী কথা?
আমি আমার আসল আমিকে খুঁজে বেড়াই পারুল। তোমার কাছে পাগলামি মনে হবে হয়তো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমার ভিতরে একটা বিস্ফোরণ হবে একদিন। তারপর আসল আমির জন্ম হবে।
.
৪২.
রান্নার বামুনঠাকুর আছে। সম্প্রতি একজন বামুনদিকেও রাখা হয়েছে। বলাকার একার জন্য এত কাজের লোকের দরকার নেই। তবু রাখা হয়েছে এই নিরিবিলি বাড়ির জনহীনতার ভাবটা কমানোর জন্য। ছেলে আর মেয়েরা চায় মাকে ঘিরে একটা নিরাপত্তার বলয় রচনা করে দিতে। বলাকার তাতে ঘোর আপত্তি। প্রথম কথা হল খরচ। মাইনে এবং খাইখরচ মিলে এই মাগগিগণ্ডার দিনে বড় কম দাঁড়ায় না খরচের বহরটা। তা ছাড়া মুনিশ আছে, মালি আছে, পুষ্যি আছে। খরচ অবশ্য ছেলে-মেয়েরাই দেয়, কিন্তু বলাকার সেটা গায়ে লাগে। তার তো এত মানুষের দরকার নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
বামুনঠাকুর বা বামুনদিকে বললেই এক কাপ কফি করে দিতে পারত। কিন্তু কফি করতে উঠে এল পারুল নিজেই। আসলে অমলকে কী বলবে, কীভাবে বলবে তা ভাবতেও একটু ফাঁক দরকার ছিল তার। রান্নাঘরে অসময়ে পারুলকে দেখে তটস্থ বামুন রাঁধুনি হরনাথ বলল, কী দিদিমনি, কিছু লাগবে?
না হরদা, আমি একটু কফি করতে এসেছি।
আপনি করবেন কেন? আপনার শরীর খারাপ, আমি করে দিচ্ছি।
আমিই করব। গ্যাস খালি আছে?
খালি করে দিচ্ছি।
জল গরম করতে করতে ভাবছিল পারুল। তাদের বাল্যপ্রেম কবেই উবে গেছে। ভাটিয়ে গেছে বয়স। সময়ের অনেক পলিমাটির আস্তরণ পড়েছে ক্ষতচিহ্নের ওপর। বেড়েছে তাদের প্রিয়জন। পৃথিবীর কোনও ট্র্যাজিক ঘটনাই বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে না। তার ব্যথা-বেদনার উপশম করে দিয়ে যায় সময়। অমলের এই ভাঙচুরের জন্য পারুল কি দায়ি হতে পারে? সে কোনও অপরাধ করেনি। তার বাবার কাছ থেকে সে একটা জিনিস পেয়েছিল। সেটা হল মনের দুর্জয় শক্তি। নৈতিক সবলতা। তাই ওই বয়ঃসন্ধি পেরোনো বয়সে জীবনের প্রথম উজ্জ্বল পুরুষটিকে সে প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রেমিকই যদি হও তবে শরীরের ওপর লোভ করবে কেন? কেন রচনা করলে না প্রেমটাকে? শেষ অবধি সম্পর্কটা হয় তো বায়োলজিই, তবু কি মানুষ তার মধ্যেও সুন্দরের সঞ্চার ঘটায় না! পারুলকে কুমারী বয়সে ধ্বংস করে দিয়েছিলে তুমি, তারপর এখন দেবী বলে স্তবগান করো, এ কেমন ভড়ং!
অমলের কফি করা সোজা। চিনি নয়, দুধ নয়, শুধু কালো কফি।
হরনাথ বলল, দিদিমনি, আমি দিয়ে আসছি। ভরা গরম কাপ নিতে গিয়ে যদি পড়ে-উড়ে যান।
কিছু হবে না হরদা। পারব।
সাবধানী হরনাথ তবু বারান্দার বাতিটা জ্বেলে রান্নাঘরের সিঁড়ি পর্যন্ত সঙ্গে রইল। লোকটা বেশ বিনয়ী, কাজের লোক। তবে বলাকা বলে, হরনাথ কাজের হলে হবে কী, হাতটান আছে বাপু। জিনিসপত্র পাচার করে।
তা অবশ্য করতেই পারে। বলাকা একা কত দিকে নজর রাখবে! মাইনে-করা লোকের ওপর নির্ভর করতে গেলে কিছু ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতেই হয়। বস্তুবাদী বলাকা তাই বেশি ঘাঁটায় না।
উঠোনটা সাবধানে পেরুল পারুল। পেটে বাচ্চাটা আসার পর আজকাল সে ভীষণ সাবধানী হয়ে গেছে। খুব হিসেব করে পা ফেলে, খুব সাবধানে চারদিকে নজর রেখে চলে।
চুপ করে বসে আছে অমল। চোখে ভারী সুদূরে-হারিয়ে-যাওয়া দৃষ্টি।
তোমার কফি!
অমল সাড়া দিল না।
দুবার বলতে হল।
ওঃ হ্যাঁ। বলে তটস্থ অমল অপ্রতিভ একটু হাসল।
গরম কফিটা যেন গোগ্রাসে খাওয়ার চেষ্টা করছিল অমল। পারছিল না। হাত কাঁপছে, কফি চলকে যাচ্ছে, ঠোঁটে ছ্যাঁকা লাগছে। একবার বিষমও খেল।
তাড়াহুড়ো করছ কেন বল তো! আস্তে খাও।
অমল থমকে গেল। তারপর ম্লান মুখে বলল, আমার আজকাল হাত কঁপে কেন বল তো পারুল! এ কি নিউরোলজিক্যাল কিছু?
ডাক্তার দেখাও। এই বয়সে হাত কাঁপার কথা তো নয়!
তাই ভাবছি। কনস্ট্যান্ট হাত কাপে। আজকাল লিখতে বা ড্রয়িং করতে রীতিমতো কষ্ট হয়।
সবসময়ে কাঁপে?
হাতটা কোথাও রাখলে বা জোরে চেপে ধরে থাকলে কাপে না। কিন্তু যখনই চায়ের কাপ বা জলের গেলাস বা কম কিছু একটা ধরতে হয় তখন এত কাপে যে অবাক হয়ে যাই। এটা যে আমারই হাত তা যেন বিশ্বাস হয় না। এই হাত দুটো নিয়ে যে এরকম সমস্যা হবে তা তো কখনও ভাবিনি। তাই ভারী অবাক হয়ে যাই।
কাঁপা কাঁপা হাতেই প্লেটসুদ্ধু কফির কাপটা মুখের কাছে তুলে চুমুক দিচ্ছিল অমল। কাপে আর প্লেটে মৃদু ঠকাঠক শব্দ হচ্ছে। মলিন মুখ করে বলল, ডাক্তার দেখিয়ে কিছু হবে না পারুল। একে একে নিভিছে দেউটি।
তার মানে কী?
হাত যাবে, পা যাবে, চোখ যাবে, মাথা যাবে। সব নিবে যাবে। একদিন আমিও নিবে যাব, কিছুই থাকবে না আমার।
মরার কথা ভাব বুঝি খুব?
মাথা নেড়ে অমল বলে, আরে না। রোমান্টিক মৃত্যুচিন্তা আমার হয় না। কেন জানো? মরার রোমান্টিক চিন্তা তখনই হয় যখন তার জন্য কাঁদার বা হাহাকার করার বা অনুতপ্ত হওয়ার মতো কেউ থাকে। ভালবাসার লোক, আপনার লোক।
পারুল ভ্রূ কুঁচকে বলল, কী বলতে চাও তুমি বলো তো? তোমার জন্য ভাববার বা কাঁদবার কেউ নেই নাকি! পুরুষমানুষগুলো কি সবাই ন্যাকা আর বোকা? আজ না হয় তোমার সঙ্গে তোমার বউয়ের একটু খটাখটি আছে, তাই বলেই কি ধরে নিতে হবে যে সে তোমাকে ভালবাসে না? ছেলেমেয়ে দুটোকেই বা তুমি কতটা চেনো? ওসব ধরে নেওয়া সেন্টিমেন্টাল কথা বোলো না তো! ওসব শুনলে আমার ভারী রাগ হয়।
অমল এ কথায় যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, না, সেরকম ভেবে কিছু বলিনি।
পুরুষমানুষের দোষ কী জানো? তারা বউ বা ছেলেমেয়ের কাছে হান্ড্রেড পারসেন্ট চায়। আর চাওয়াটা সে নিজেই ঠিক করে নেয়। বউ যে একটা আলাদা সত্তা, আলাদা পারসোনালিটি, ছেলেমেয়েদেরও যে নিজের মতো করে ভালবাসার রকম থাকতে পারে, সেটাই তারা বুঝতে চায় না।
মৃদু মাথা নেড়ে অমল হাসিমুখে বলে, আরে না। আমি ওসব ভাবি না।
তাই ভাব। ভাল করে নিজের মনের ভিতরটা খুঁজে দেখ। বুঝতে পারবে।
অমল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব মৃদু স্বরে বলে, মরার কথা ভাবতে আমি যে ভয় পাই পারুল। ভীষণ ভয় পাই।
তবে বলছ কেন?
বলিনি। আসলে মনে হচ্ছে, আমি খুব বুড়ো হয়ে গেছি। জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছে। খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। হাত কঁপে, স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে, কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি।
কারণটা খুঁজে দেখেছ?
খুঁজি তো! খুব খুঁজি। খুঁজে কিছু পাই না। আমার কি আলঝাইমারস ডিজিজ হল! কে জানে?
কিচ্ছু হয়নি তোমার। একটা ঝুঁকি মেরে সোজা হয়ে যাও।
একটু অবাক হয়ে অমল বলল, কথাটা কার বল তো! কে যেন কথাটা খুব বলত। মনে পড়ছে।
পারুল হেসে ফেলে বলল, আমার বাবা। বাবার খুব প্রিয় স্লোগান ছিল এটা। সবসময় সবাইকে বলত একটা ঝাঁকি মেরে সোজা হয়ে যাও।
অমল ফের গরম কফিতে হাঘরের মতো চুমুক দিয়ে বলল, কৃতকর্ম ভুলে, অতীত ভুলে যারা ফের সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে তারা নমস্য। আমার মনে আছে জ্যাঠামশাই কথাটা আমাকেও কয়েকবার বলেছেন। টেস্টে খারাপ রেজাল্ট করেছিলাম, তখন একবার বলেছিলেন। মনে আছে, তাতে কাজ হয়েছিল। তখন কাজ হত। এখন আর হয় না।
বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছ নাকি? সত্যি কথাটা বল তো!
মাথা নেড়ে অমল বলে, না। ঝগড়া করে বিবাগী হওয়ার মতো অবস্থাটা আর নেই। আমি এমনই এসেছি। কিছু ভাল লাগছিল না। ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে আজকাল আমার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
কেন, ফ্ল্যাটবাড়ি আবার কী দোষ করল! তোমারটা তো শুনেছি দক্ষিণ খোলা সুন্দর বড় ফ্ল্যাট।
ফ্ল্যাটবাড়ির দোষ নয় পারুল। দোষ আমার। কেবলই মনে হয়, যে-জায়গায় আছি সেটা আমার সহ্য হচ্ছে না।
তোমার কি এ জায়গাটা ভাল লাগছে আজকাল?
মাথা নেড়ে অমল বলে, তাও নয়। তবে এখানটায় ওরা নেই বলে আর চারদিকটা খোলামেলা বলে একটু হাঁফ ছাড়তে পারি।
চাকরিটার কী অবস্থা?
চাকরি! বলে খুব চিন্তিতভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল অমল। তারপর হাত দুটো উলটে অসহায় ভঙ্গি করে বলল, কী জানি! চাকরির কথা তো ভাবিনি।
অফিসে না জানিয়ে ঢলে এসেছ?
হ্যাঁ।
এবার বোধহয় চাকরিটা যাবে তোমার। শুধু মুখ দেখে তো আর মাসের শেষে মোটা মাইনে দেবে তারা।
অমল একটু হাসল, মৃদুস্বরে বলল, ওসব ভাবতেও আমার আর ভাল লাগে না। যদি তাড়িয়ে দেয় দিক। ক্রীতদাস তো নই।
বাড়িতেও কি কিছু জানিয়ে আসোনি?
আবার চিন্তিত হয় অমল। বলে, জানানোর কী আছে? রাতে আমার ঘুম হচ্ছিল না। একটু তন্দ্রা এলেই ভীষণ সব দুঃস্বপ্ন দেখে চটকা ভেঙে যাচ্ছিল। মদ খাওয়ার চেষ্টা করলাম, বমি হয়ে গেল। ঝিম মেরে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল, এভাবে পড়ে থাকার মানেই হয় না। খুব ভোরবেলা উঠে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেন ধরে সোজা বর্ধমান।
আচ্ছা মানুষ যা হোক। বাড়ির লোক ভাবছে না! একটা টেলিফোন তো করা উচিত ছিল, করেছ সেটা?
আমি করিনি। তবে মনে হয় দাদা খবর দিয়েছে।
ঠিক জানো যে খবর দিয়েছে।
জানি না। তবে বউদিও তোমার মতোই চোখ পাকিয়ে আমাকে অনেক বকেছে। তাতেই মনে হচ্ছে কলকাতায় খবর দেবার দায়িত্ব ওরাই নিয়েছে।
পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কেন যে তুমি এরকম হয়ে যাচ্ছ কে জানে!
সবাই সংসারী হবে, হিসেবি হবে, সাবধানী হবে, স্বাভাবিক হবে বলে আশা কর কেন? এক আধজন অন্যরকম হলে ক্ষতি কী? সবাই একরকম হলে কি ভাল হত?
পারুল হেসে ফেলে বলল, তুমি কি পৃথিবীর বৈচিত্র্য আনার জন্য হিসেব কষে অন্যরকম হতে চাইছ?
মৃদু হেসে অমল বলে, তাহলে তো অভিনয় করতে হত! কিন্তু আমি ভাল অভিনেতা নই। পারুল, আমি মনে বড় কষ্ট পাচ্ছি। বড্ড কষ্ট।
কীসের কষ্ট তাও তো এতদিনে বুঝিয়ে বলতে পারলে না।
সে কি বোঝানো যায়? আমার ভিতরে যেন এক রুক্ষ ঊষর প্রান্তর। আর সেখানে কেবল হাহাকারে ভরা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ভীষণ ভয় করে। পারুল, আমি কি পাগল হয়ে যাব একদিন?
শঙ্কিত অমলের মুখের দিকে চেয়ে বুকটা টনটন করে উঠল পারুলের। নরম গলায় বলল, ওসব ভেবো না। পাগল হবে কেন? একটা কথা বলব?
বলো।
তুমি কি নাস্তিক?
হঠাৎ ও প্রশ্ন কেন?
বলোই না।
মাথা নেড়ে অমল বলে, সেটাও তো ভেবে দেখিনি। ভগবান নিয়ে মাথাই ঘামাইনি কখনও। ওকথা জিজ্ঞেস করলে কেন?
তোমাকে বলতে ভয় করে। তুমি মস্ত লেখাপড়া জানা মানুষ, ভগবানের কথা বললে হয়তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। নাস্তিকরা ভীষণ তার্কিক হয়।
অমল হাসল। বলল, নাস্তিক আস্তিক আমি কিছুই নই। নাস্তিক হলেও ভাল ছিল। নাস্তিকদেরও একটা ভগবান আছে বোধহয়।
সে আবার কী?
নাস্তিকদেরও একজন নেগেটিভ ভগবান থাকে।
কী যে বলো অমলদা, কিছু বুঝতে পারি না!
অমল কফিটা শেষ করে বলল, ওসব থাক পারুল। ভগবান আমাকে ভাল চোখে দেখবেন, এমন চান্স খুবই কম। তাকে ডেকে আমার লাভ হবে না।
আমি বলি বউয়ের কাছে ফিরে যাও। শান্তভাবে দুজনে মুখোমুখি বসে কথা বল। মিটিয়ে নাও।
তোমার কি ধারণা, আমার মানসিক সব অশান্তির মূলে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া?
তা ছাড়া আবার কী?
সমস্যা অত সরল হলে তো কথাই ছিল না পারুল।
দুজনেই স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল।
পারুল বলল, ঠান্ডা বাড়ছে, রাত হচ্ছে। বাড়ি যাও অমলদা।
তটস্থ অমল উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। বলল, হ্যাঁ পারুল, যাচ্ছি। একটা কথা বলব?
বল।
আমার মাথায় তো এখন স্থিরতা নেই। আমি ভূতের মতো রাতবিরেতে বেরিয়ে পড়ি! অন্ধকারে আঘাটায় ঘুরে বেড়াই। আমাকে হঠাৎ তোমার জানালার ধারে বা বাগানের কোণে কোথাও দেখতে পেলে ভয় পেয়ো না। কিংবা মায়া করে ডেকে এনে ঘরেও বসিয়ো না। ওইভাবে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে হয়ে হয়তো একদিন আমি নিজেকে ফিরে পাব।
পারুল চুপ করে রইল। অমল ধীরে ধীরে বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে আবছায়া উঠোন ডিঙিয়ে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল। মদ খায়নি, তবু কেমন যেন অনিয়ন্ত্রিত ছোটবড় পদক্ষেপ। গায়ে তেমন শীতবস্ত্র নেই। শীত-গ্রীষ্মের বোধও নেই বোধহয়।
মা, কে এসেছিল বল তো! অমলমামা?
পারুল মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বলল, হ্যাঁ।
অমলমামার কী হয়েছে মা?
মনে নানা অশান্তি।
কাল আমি অমলমামাকে দুপুরবেলায় দেখেছি। কাঞ্জিলালদের জমিতে রোদে বসে আছে। আমি তিতলিদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। দেখি বসে আপনমনে বকবক করছে। আমাকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমি কিন্তু যাইনি, দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।
আজকাল ওকে দেখলে বোধহয় সবাই ভয় পায়। অথচ অমলদা কত ব্রাইট ছিল।
গোঁসাইবাড়ির মানুদি বলছিল। তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়নি বলেই নাকি অমলমামা পাগল হয়ে গেছে!
বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকাল পারুল। দুধের মেয়েটার কানে ওসব কথা না ঢোকালেই কি নয়! গাঁয়ের মেয়েগুলোর স্বভাবই হল লোকের কানে বিষ ঢালা। কাজকর্ম তো নেই। গম্ভীর হয়ে পারুল বলে, ওসব কথায় কান দিও না।
আমাকে ডাকছিল কেন বল তো মা! অমলমামা তো আমাকে ভাল করে চেনেই না।
হয়তো চিনেছিল।
না মা, অমলমামা আমাকে চেনে না। মানুদি বলছিল, অমলমামা নাকি বাচ্চা মেয়েদের দেখলেই ডাকে।
ওঃ গড!
আমি কি পালিয়ে এসে অন্যায় করেছি?
না না। ঠিকই করেছ। অমলদার এখন মাথার ঠিক নেই।
পারুল খুব চিন্তিতভাবে দোতলায় উঠল। খুব ধীরে ধীরে।
কে এসেছিল রে পারুল? কার যেন কথা শুনতে পেলাম।
অমলদা।
বলাকা একটা পুরনো বালাগপাশে নতুন ওয়াড় পরাচ্ছিল। সঙ্গে দুখুরি।
দুখুরি খিকখিক করে হেসে বলল, পাগলাটা?
চিন্তিত পারুল তার মায়ের দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ মা, অমলদা কি শেষ অবধি পাগলই হয়ে যাচ্ছে?
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কার কী কর্মফল বাছা, তা কি জানি? ওদের বংশে তো কেউ পাগল ছিল না। ওর যে কী হল কে জানে। কী বলছিল তোকে?
কথাবার্তা তেমন অস্বাভাবিক বলছিল না। তবে কষ্টের কথা বলছিল। কীসের কষ্ট তা বুঝিয়ে বলতে পারল না।
বউটা কেমন রে?
কিছু খারাপ বলে তো মনে হয়নি।
বাইরে থেকে আর কতটুকু বুঝবি?
হ্যাঁ মা, পুরুষমানুষদের কিছু হলেই বুঝি বউকে দায়ি করতে হবে! এ তোমাদের ভীষণ একপেশে ধারণা।
তা নয় মা। আজকাল যে মেয়েগুলো স্বামীদের বড় জ্বালিয়ে মারে।
তাই বুঝি? পুরুষেরা কি ধোয়া তুলসীপাতা? তুমিও তো একজন মেয়ে, কেমন করে বল ওসব কথা?
আমি মেয়ে হলেও তোমাদের আমলের মেয়ে তো নই!
তাতে কী মা? সেই আমলের মেয়ে বলে এই আমলের মেয়েদের বুঝতে চেষ্টা করবে না!
বলাকা ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বুঝতে পারলে কি আর বলতাম? তবে জানি সংসারের বেশির ভাগ অশান্তির মুলেই থাকে মেয়েরা।
বেশ কথা! তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
পারুলের শরীর ভাল লাগছিল না। মাথাটা একটু গরম। সে গিয়ে শোওয়ার ঘরে অন্ধকারে লেপ চাপা দিয়ে শুয়ে রইল। আজকাল মন খারাপ লাগলে সে তার পেটের দুষ্টুটার কথা ভাবে। ভাবতে ভাবতে মন ভাল হয়ে যায়। এখন তার ইচ্ছে হয় আরও কয়েকটা ছেলেপুলের মা হতে। শরীর দেবে না বলে, নইলে সে বহুপ্রসবিনী হত।
.
বে-খেয়ালে বাসরাস্তার কাছে চলে এসেছিল অমল। এখানে আলোটালো আছে, দোকান পাটে লোজন। একটা বাস থেকে হুড়মুড় করে লোক নামছে।
হঠাৎ তার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, এ কিস উইল কিওর ইউ। এ কিস… এ কিস… বাই দ্যাট উওম্যান…
হঠাৎ বহুকালের ছাইচাপা একটা ক্ষুধা যেন সর্বাঙ্গে জেগে উঠল তার। বহুকাল আগে পারুলদের দোতলার নির্জন ঘরে এক দুরন্ত দুপুরে সে এক সুন্দরীর দেহের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। সেই কাণ্ডজ্ঞানহীন, অন্ধ, দেহগত কামনা ফুঁসে উঠল হঠাৎ।
দৈববাণীর মতো তার ভিতরে কে যেন ক্রমাগত বলে যাচ্ছে এ কিস উইল কিওর ইউ…এ কিস উইল কিওর ইউ… এ কিস…
মাথা টলছে তার। …দেবীদুর্লভ পারুলের কাছেই কি রয়েছে তার অমেয় আরোগ্য? …সে যাবে পারুলের কাছে, হাঁটু গেড়ে বসে ভিক্ষা চাইবে। একবার, মাত্র একবার চুম্বন করো আমাকে। হরণ করো আমার বিষাদ, আমার অন্ধকার।
অমল পারুলের কাছে যাবে বলে ফিরে পঁড়িয়েছিল। হঠাৎ ডান কাঁধে একখানা ভারী হাত এসে পড়ল।
আরে মশয়, আপনে অমলবাবু না? মহিম রায়ের পোলা?
বিরক্ত অমল মুখ ঘুরিয়ে রসিক সাহাকে দেখতে পেল। বলল, হ্যাঁ।
রসিক বিস্ময়ের চোখে তার দিকে চেয়েছিল। বলল, আপনারে তো চিননই যায় না মশয়। শরীর খারাপ নাকি?
না না, ঠিক আছে। সব ঠিক আছে।
এই কাল ঠান্ডার মইধ্যে গরম জামা গায়ে নাই, দাড়িদুড়ি ফালান নাই! কী হইছে কন তো!
লজ্জা পেয়ে অমল বলল, কিছু হয়নি তো!
দূর মশয়, কিছু হয় নাই মানে? শীতে তো কাঁপতে আছেন। আহেন আমার লগে।
কোথায় যাবো?
লন আমার বাড়িত। এক কাপ গরম চা খাইয়া যান। ভাল চা আছে।
অমল মাথা নেড়ে বলল, না না, আজ থাক।
আরে লজ্জা পান ক্যান? আপনে তো ফালাইন্যা মানুষ না। ব্রাহ্মণ সন্তান, তার উপর প্যাটে বিদ্যা গিজগিজ করতে আছে। বিলাত আমেরিকা ঘুইরা আইছেন। আপনের শ্বাসেপ্রশ্বাসে বাতাস পবিত্র হয়। লন, গরিবের বাড়িতে একটু পায়ের ধুলা দিয়া আইবেন।
হঠাৎ শীতটা খুব টের পাচ্ছে অমল। তার হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। নাকে জল আসছে, চোখে জল.আসছে, গলা কেঁপে যাচ্ছে।
কইলকাতা থিক্যা আইলেন বুঝি অখন!
অমল ভুল ভাঙার চেষ্টা না করে বলল, হুঁ।
ডান হাতে একটা মেটে হাঁড়ি সেইটে উঁচু করে দেখিয়ে রসিক বলল, গঙ্গার ইলিশ আনলাম। চলেন, কয়েকখান গরম গরম মাছভাজা খাইয়া যাইবেন। খুব ভাল জাতের ইলিশ পাইছি। ত্যালে এক্কেবারে পিছলাইয়া যাইতাছে।
অমল মৃদু একটু হাসল। হ্যাঁ তার খিদে পেয়েছে, তার শীত করছে, সে ভারী ক্লান্ত। রসিক বাঙালকে তার মোটেই খারাপ লাগছে না।
রসিক পিছন ফিরে হঠাৎ হক মারল, কী রে পুঁটি, তর কিননকাটন হইল? আয় তাড়াতাড়ি।
ফ্যান্সি স্টোর নামে নতুন একটা দোকান খুলেছে সম্প্রতি। ঝাঁ চকচকে দোকান। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা ছিপছিপে চেহারার মেয়ে কেনাকাটা করছিল। বলল, যাচ্ছি বাবা।
রসিক অমলকে বলল, আমার মাইয়া। গ্রামেগঞ্জে আইতে চায় না। অগো জান গাড়া আছে কইলকাতায়। তুয়াইয়া বুয়াইয়াও আনতে পারি না। এইবার কী খেয়াল হইছে কে জানে, হঠাৎ দেখি জিনিসপত্র গুছাইয়া লগ লইছে।
এসব কথার কী উত্তর দেবে তা ভেবে পাচ্ছিল না অমল।
রসিক হাঁক মারল, আমরা আউগাইলাম রে পুঁটি। তুই তাড়াতাড়ি আয়।
হ্যাঁ বাবা, যাচ্ছি, তুমি এগোও।
তাকে দেখে আকাশ থেকে পড়ল বাসন্তী, ওমা! এ কাকে এনেছ তুমি! কী ভাগ্যি আমার! এসো, এসো অমলদা, এসো!
রসিক যেন দৌড় প্রতিযোগিতায় ফাস্ট হয়েছে এমন মুখ করে বলল, আগো, তাড়াতাড়ি আগুনের পাতিলটা লইয়া আহ। আর পাঞ্জাবের আলোয়ানটা দিয়া ভদ্রলোকরে একটু ঢাকাঁচাপা দাও। দেখতাছ না, ঠান্ডায় এক্কেবারে কাপ উইঠ্যা গেছে।
এই দিই! ও মা এই বুঝি পুঁটি! কই, আগে জানাওনি তো!
জানামু ক্যামনে? হুট কইরা রওনা হইয়া পড়ল।
এসো মা, এসো। বলে মেয়ের দুহাত ধরে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল বাসন্তী।
কাঠকয়লার আগুনে ভরা একটা হাড়ি এনে রাখা হল অমলের পায়ের কাছে। একটা মোটা কুটকুটে আলোয়ানে তার গা ঢেকে দিল বাসন্তী। বলল, বোসো অমলদা, চা করে আনছি। চা না কফি?
চা-ই কর।
রসিক মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে বলল, জুইৎ কইরা বহেন। আর কী খাইবেন কন।
অমল মৃদু হেসে বলল, আপনি একটি বেশ লোক, তাই না!
না মশয়, বাজারে আমার খুব বদনাম। দুইটা বিয়া করছি, মাইনষের জমিজমা সব গাপ করতাছি। আরও কত কী কয় লোকে! তবে মশয় আমি ওইসব গায়ে মাখি না। খাইট্যা পিটা খাই, অসুরের মতো কাম করি। কুটকচালি কইরা তো সময় কাটাই না! গ্রামের মানুষগুলা অলস, বইয়া বইয়া কার মায়ে কত গু তা হুইঙ্গা বেড়ায়। বোঝলেননি?
অমল আগুনের তাপ আর আলোয়ানের ওমে ভারী আরাম পেয়ে চোখ বুজল। রসিক বাঙাল একজন তেজি লোক। ভোগীও বটে। কিন্তু কী সুন্দর ঘরদোরের ছিরিছাদ! বাসন্তীর সঙ্গে সম্পর্কও ভারী ভাল। এদের কোনও ইগো প্রবলেম নেই। অকারণ চিন্তা নেই, পাপবোধে কষ্ট পায় না।
হাফসাইয়া পড়ছেন নাকি অমলবাবু? একটু শুইবেন?
আরে না। একটু ক্লান্তি লাগছে।
একটু ব্রান্ডি আছে, খাইবেন? মরণের মায়ের লিগ্যা কিন্যা রাখছিলাম। হ্যায় তো একবার চুমুক দিয়াই থু থু কইরা ফালাইয়া দিল। বোতলটা পইড়াই আছে।
অমল মাথা নেড়ে বলল, না, না, থাক। আজ ওসব নয়।
না ক্যান? শরীর একটু গরম হইব।
এই বেশ লাগছে।
শুধু মাছভাজা নয়, সেই সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা পরোটা, আলুর দম, বেগুনভাজা সাজিয়ে দিল সামনে বাসন্তী।
এ কী কাণ্ড রে! এত কে খাবে!
খাও অমলদা। রাতে না হয় একটু কম খেও বাড়িতে। আজ প্রথম এলে তো! দাঁড়াও, হাত ধোয়ার জন্য উঠতে হবে না। আমি গামলায় গরম জল আনিয়ে দিচ্ছি, এখানে বসেই হাত ধুয়ে নাও।
কৃতজ্ঞতায়, কুণ্ঠায় এতটুকু হয়ে যাচ্ছিল অমল। এই বাসন্তী, এই রসিক বাঙাল–এইসব তুচ্ছ লোকজনের কোনও খোঁজখবরই তো এতকাল রাখত না অমল। তবে এরা তাকে এত যত্ন করছে কেন!
তুই খুব ভাল আছিস, না রে বাসন্তী?
বাসন্তী ভারী লজ্জা পেয়ে বলে, ভাল থাকার কথা আর বোলো না। সংসারের ঝামেলা কি কম! উনি তো বড়বাজারের দোকান নিয়ে ব্যস্ত। সব বিষয় সম্পত্তি আমার ঘাড়ে।
বাসন্তীর মুখে চাপা অহংকার আর খুশির উজ্জ্বলতা গোপন থাকল না। অমল দেখল। দেখে মুগ্ধ হল। একটু হিংসেও কি হল তার?
.
৪৩.
শিবঠাকুর একটু ভোলেভালা আদমি, কিন্তু একটু পাগলাটেও বটে। বর যখন দিতে শুরু করেন তখন দিতেই থাকেন। আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। পরশু দিনও মরণ ভাবছিল, দাদা তো হল, এবার দিদিটা আর বড়মাটা হলেই হয়। তার বোন আছে বটে, কিন্তু দিদি থেকেও ছিল না। আর মা থাকলেও, বড়মা অন্য জিনিস। দিদি আর বড়মা সম্পর্কে কত কী ভেবে রেখেছে মরণ। দিদিটা হবে ঠিক পান্নাদির মতো। আরও সুন্দর হলে তো কথাই নেই। আর বড়মা হবে ঠিক যেমন জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা।
আগে থেকে খবর দেওয়াও ছিল না। কাল একটু রাতের দিকে বাবা এসে হাজির। সঙ্গে পাগলা অমলকাকু আর দিদি। মরণ তখন পড়তে বসেছিল। উঠোনে মায়ের গলা পেয়ে বুঝল একটা কিছু হয়েছে। নতুন কেউ এসেছে বাড়িতে। এক লাফে উঠোনে নেমে এসে লণ্ঠনের আলোয় দিদিকে দেখে তার যেমন আনন্দ, তেমনই লজ্জা।
ছোট ছেলেদের অনেক সমস্যা। তার মধ্যে একটা হল কেউ সহজে পাত্তা দিতে চায় না। ভাবে, ওর সঙ্গে আর কীই বা কথা বলার আছে! শুধু ফাইফরমাশ করার জন্য তাদের ডাক-খোঁজ করা হয়। মরণ তার এই ভবিতব্য মেনেও নিয়েছে। তার কোনও গুরুত্ব নেই, তার তেমন আদরও নেই। পড়াশুনোয় ভাল হলেও না হয় হত! কিন্তু তাও সে নয়। এই অনাদরের জীবনটার জন্যই তার যা কিছু দুঃখ। সে ভাল বল খেলে, গাছ বায়, খুব জোরে দৌড়তে পারে, কিন্তু সেসব গুণকে কে আর পোঁছে!
সে ধরেই নিয়েছে তার কলকাতার দিদিও তাকে মোটেই পাত্তা দেবে না।
পড়াশুনো শেষ হল রাত নটায়। দোতলার শোওয়ার ঘর থেকে খুব হাসি আর কথার শব্দ আসছিল। কিন্তু ইচ্ছে হলেও ওপরে যেতে লজ্জা করছিল তার। দিদি তাকে দেখে হয়তো ভারী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলবে, ওঃ, এই বুঝি মরণ!
তাই মরণ মাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ চুপ করে পড়ার ঘরে বসে রইল।
বসে বসে ভাবছিল মরণ। এই যে বড়মা, দিদি, দাদা এরা নাকি তার খুব আপন কেউ নয়। অন্তত জিজিবুড়ি তাই বলে। জিজিবুড়ির জিভে নাকি বিষ আছে। তার কথা হল, ও আবার আপনার জন কবে থেকে হল রে! বাঙালের প্রথম পক্ষই হল তার আসল। তোরা তো সব দুয়োরানির ছা। কে-ই বা তোদের পোঁছে, কে-ই বা তোদের দাম দেয়। আমার মেয়েটা তো হদ্দ বোকা, পিটুলিগোলা খেয়ে দুধ বলে নাচছে। দলিল-দস্তাবেজে কত ফঁকফোকর থাকে, উকিল মুহুরিদের হাত করে সব বানিয়ে রেখেছে। যখন কেড়েকুড়ে নেবে তখন আক্কেল হবে মেয়েটার।
জিজিবুড়ি বাড়িয়ে বলে ঠিকই, কিন্তু সমস্যা যে একটা আছে তা মরণও বুঝতে পারে। যদি সমস্যা না থাকত তাহলে কি তার বাবা কখনও মরণ বা তার মাকে কলকাতার বাড়িতে নিয়ে যেত না? আর তার মাও যেন বড়মার নামে ভীষণ ভয় পায়। এইসব থেকে আজকাল মরণ বুঝতে পারে তারা ঠিক আর পাঁচটা পরিবারের মতো নয়। তাদের কিছু গোলমাল আছে। আর সেজন্য দায়ি তার বাবা।
বাবাকে কি খুব অপছন্দ করে মরণ! অনেক ভেবে দেখে তার মনে হয়েছে, যত নষ্টের গোড়া ওই লোকটাই। যেমন কেঠো চেহারা, তেমনই কেঠো স্বভাব। দুটো বিয়ে করার কী দরকার ছিল লোকটার! না, বাবাকে তার একদম পছন্দ নয়।
তার মাও টের পায় মরণ তার বাবাকে পছন্দ করে না। তাই মা মাঝে মাঝে তাকে বলে, মানুষটার বাইরেটা অমন হলে কী হবে, ওর মনটার কথা তো জানিস না! বড় হলে বুঝবি ওরকম মানুষ খুব কম হয়।
মা যে বাবাকে কেন অতটা ভালবাসে, তাও বুঝতে পারে না মরণ। মা কখনও বাবার কোনও দোষ দেখে না, কোনও অন্যায় দেখতে পায় না। বাবার ছেড়ে রাখা চটিজুতোয় পা লাগলে পর্যন্ত প্রণাম করে। অথচ জিজিবুড়ি বলে, বাঙালের নাকি জাতজন্মেরই ঠিক নেই। মায়ের সঙ্গে তার নাকি মোটে বিয়েই হয়নি।
এইসব নিয়েই সমস্যা মরণের। পড়ার ঘরে বসে সে তাই গভীরভাবে ভাবছিল।
আচমকাই জানালায় খুটখুট করে শব্দ হল একটা। ভারী চমকে গিয়েছিল মরণ।
কে রে!
জিজিবুড়ি চাপা গলায় বলল, ও মরণ, জানালাটা একটু ফাঁক কর দিকি ভাই।
মরণ গিয়ে জানালার ছিটকিনি খুলে বলল, কী জিজিবুড়ি?
বলি, কে এল রে তোদের বাড়িতে! অত হাসি-মস্করা কীসের?
দিদি এসেছে যে!
জিজিবুড়ি চোখ বড় বড় করে বলে, দিদি মানে! বাঙালের মেয়েটা নাকি? ও বাবা, এ যে একে একে সবাইকে এনে জোটাচ্ছে! তোদের ভিটেছাড়া করবে নাকি!
তুমি এখন যাও জিজিবুড়ি, কে দেখে ফেলবে।
বলি ছেলেটাও তো এখনও বিদেয় হয়নি। জ্বরের বাহানা করে চারদিন না পাঁচ দিন পড়ে আছে। ও আর যাবেও না। আর বাসন্তীরও বলিহারি যাই, পারলে পাদোদক খায়। তা মেয়েটা এয়েছে কী করতে জানিস?
বেড়াতে এসেছে।
বেড়ানোর কি আর জায়গা নেই বাপু! হিমালয় আছে, মথুরা বৃন্দাবন আছে, দিল্লি-বোম্বাই আছে, সব ফেলে এখানে এসে আবার গুঁতোগুতি কেন?
তা আমি জানি না। তুমি এখন যাও।
যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলুম, নতুন গলা পেয়ে খোঁজ নিয়ে গেলুম। ছেলে-মেয়েকে এনে তো দখল কায়েম করলে, এবার বড়গিন্নিকে এনে বসালেই চিত্তির। তোর মাকে বলিস গয়নাগাঁটি সোনা-দানা সব সামলে রাখতে। মেয়েমানুষের চোখ খুব খারাপ। আঁত করে সব জিনিসের তল্লাশি নিয়ে নেবে। আমি বাপু লক্ষণ মোটেই ভাল বুঝছি না।
এসব শুনলে মন আরও খারাপ হয়ে যায় মরণের।
ওপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে কারা নামছে শুনে মরণ বলল, তুমি এখন যাও জিজিবুড়ি। কে যেন আসছে।
বলেই পাল্লাটা বন্ধ করে দিল মরণ।
পাশেই রান্নাঘর। সেখান থেকে মায়ের গলা পাওয়া গেল, ও মুক্তা, মশলাটা তাড়াতাড়ি বেটে ফেল, আজ একটু মুড়িঘণ্ট করব।
মশলা কখন হয়ে গেছে!
তাহলে শিলটা ভাল করে ধুয়ে একটু পোস্ত বেটে ফেল দেখি।
এইসব শুনতে শুনতে আরও গভীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিল মরণ। যত বড় হচ্ছে তত তার ভাবনা বাড়ছে। এইজন্যই আজকাল বড় হওয়াটাকে তেমন পছন্দ হয় না মরণের।
ভাবতে ভাবতেই কখন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রাত সাড়ে দশটা না এগারোটায় মা এসে ডেকে তুলল তাকে।
ও মা! তাই তো বলি ছেলেটার সাড়াশব্দ নেই কেন! আয় আয় শিগগির, দিদি এসেছে তো! কতবার করে জিজ্ঞেস করছে তোর কথা!
আমার কথা! বলে মরণ অবাক। তার কথা কেন জিজ্ঞেস করবে। তাকে তো কেউ একটুও দাম দেয় না!
আয় বাবা, উঠে পড়।
ঘুম-চোখেই দেখা হল দিদির সঙ্গে। খাওয়ার টেবিলে।
দেখা হতেই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসাল।
এ বাবা, তোমার তো ভীষণ দুষ্টু দুষ্টু চোখ! খুব দুষ্টু বুঝি তুমি?
মরণ হেসে ফেলল।
রসিক সাহা বলল, আরে একেবারে ল্যাজকাটা বান্দর। পড়া নাই, শুনা নাই, সারাদিন পাড়া টহল দিতাছে। খ্যালনের কথা ক গাছ বাওনের কথা ক, ফাল দিয়া উঠব।
দাদা মৃদু-মৃদু হাসছিল। বলল, না, না, ওর ব্রেন আছে। একটু দুষ্টু হলেও পাজি নয়। হি ইজ গুড। আই লাইক হিম।
রাতে বেশি কথা হয়নি আর।
সকালে তার পড়ার ঘরে এসে হামলে পড়ল দিদি।
অ্যাই তোর এত বিচ্ছিরি নাম কেন রে? তোর পোশাকি নাম নেই?
না তো! আমার ইস্কুলের নাম তো মরণকুমার।
এ মা! তোর এনামটা ভাল লাগে?
নাঃ, একটুও না।
দাঁড়া, বাবাকে বলে তোর নামটা পালটে দিচ্ছি। কে এ-নাম রাখল বল তো!
বাবাই রেখেছিল। আমার একটা দিদি হয়ে মরে গিয়েছিল বলে নাকি এনাম রাখা হয়।
ধ্যেৎ, যত সব কুসংস্কার। তোর একটা ভাল নাম নিতে ইচ্ছে করে না?
এক গাল হেসে মরণ বলে, হ্যাঁ তো। আমার একটা নাম খুব পছন্দ।
কী নাম?
বিশ্বজিৎ
ধুর! বিশ্বজিৎ একটা নাম হল! এ তো পঞ্চাশ বছর আগের যুগের নাম।
কাঁচুমাচু হয়ে মরণ বলে, তাহলে?
পুঁটি একটু ভাবল। ভেবে বলল, অবিশ্যি মরণকুমার নামটা বেশ নতুন ধরনের কিন্তু। ইট হ্যাজ শার্প এজেস। বেশ ধারালো নাম। কোথায় শুনেছি বল তো এনামটা!
মরণ হেসে বলল, বাবা খুব ঢাকার মরণচাঁদের মিষ্টির দোকানের কথা বলে।
ওঃ ইয়েস! না, আফটার এ সেকেন্ড থট নামটা আমার খারাপ লাগছে না।
করুণ মুখে মরণ বলে, তাহলে নামটা বদলাতে বলবে না?
না। নামটার একটা অ্যাপিল আছে। তোর বিশ্বজিতের চেয়ে অনেক ভাল। অন্তত ভ্যাতভ্যাতে নাম নয়।
মরণ একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। আলোটা পট করে নিবে গেল।
কী পড়ছিস?
ইংরেজি।
আজ আর পড়তে হবে না। ওঠ।
কোথায় যাবে?
চল না। দোতলার বারান্দা থেকে দেখলাম, বাগানে একটা কুল গাছ রয়েছে। ঝেঁপে কুল এসেছে তাতে।
কুল! হ্যাঁ, কুল গাছ আরও আছে।
কুল খাস না?
মা খেতে দেয় না যে। কাঁচা কুলে নাকি অসুখ হয়। পাকলে খাই।
এ মা, ডাঁশা কুলের মতো জিনিস আছে!
অবাক হয়ে মরণ বলে, এই সকালে কুল খাবে? ভীষণ টক যে!
টক বলেই তো খাবো। তবে এখন নয়। দুপুরে ঝালনুন দিয়ে। গাছে শুঁয়োপোকা নেই তো!
খুব আছে। তবে আমার তাতে কিছু হয় না। কচু পাতার রস লাগিয়ে দিলেই কমে যায়।
চল তো, ঘুরে ঘুরে চারদিকটা দেখি।
মরণ সেটাই চায়। সে বই বন্ধ করে টপ করে উঠে পড়ল।
কোথায় যাবে দিদি?
আগে বেরোই তো, তারপর দেখা যাবে।
দিদিটা যে দেখতে খুব সুন্দর, তা নয়। রাতে ঘুমচোখে আর লজ্জায় ভাল করে দেখেনি। দিদিটা রোগা, মুখখানা ভাঙাচোরা, দাঁতগুলোও ভাল নয়। তা হোক, বেশ হাসিখুশি আছে। শিবঠাকুরের কাছে তো সে সুন্দর দিদি চায়নি। চেয়েছিল, যেন দাদা, দিদি আর বড়মা তাকে খুব ভালবাসে। সেটা হলেই হল।
মুখবাঁধা মস্ত মেটে কলসি নিয়ে বিপিন এসে বসেছে উঠোনের রোদে।
খেজুর রস খাবে না দিদি?
পুঁটি নাক কুঁচকে বলল, খেজুর রস? কেমন খেতে?
খুব ভাল। আমরা তো সবাই খাই।
পুঁটি বিপিনের দিকে সন্দিহান চোখে চেয়ে বলল, খাবো? লোকটার জামাকাপড় যা ময়লা!
মরণ হেসে বলল, ও তো মাঠে কাজ করে। জামাকাপড়ে মাটি লেগে যায়।
পুঁটি খুঁতখুঁত করে বলল, কলসির মুখের ন্যাকড়াটার অবস্থা দেখেছিস? হাকুচ কালো।
ও তো রসের দাগ। খাও না, কিছু হবে না। আমরা তো রোজ খাই।
ওপর থেকে রসিক সাহা হাঁক মেরে বলল, আরে খা, খা। খেজুর রসে মেলা ভিটামিন।
উঠোনে নেমে হাম্মিকে রোদে হামা দিতে ছেড়ে দিয়ে রসিকও বসে গেল রস খেতে।
এক চুমুক খেয়ে পুঁটি স্বাদটা বুঝবার চেষ্টা করল একটু। তারপর বলল, দুর, ভ্যাতভ্যাতে স্বাদ। কোনও কিক নেই। এর চেয়ে কোক ভাল।
মরণ হি হি করে হেসে বলল, ভ্যাতভ্যাতে মানে কী দিদি?
ভ্যাতভ্যাতে! ভ্যাতভ্যাতে মানে ভ্যাতভ্যাতে। তার মানে হচ্ছে ভাতের মতো। তাও তো বিস্বাদ।
কিন্তু ভাত তো আমরা রোজ খাই।
হু, সে কথা ঠিক। কিন্তু শুধু ভাত হল ভ্যাতভ্যাতে। বুঝলি?
হেসে ঘাড় নাড়ল মরণ।
পুঁটি চারদিকে চেয়ে বলল, তোদের সবকিছুই ভ্যাতভ্যাতে, না রে?
মরণ ফের হি হি করে হাসল। বেশ দিদি। ভাল দিদি।
.
রান্নাঘরে উনুনের কাছটি ঘেঁষে জিজিবুড়ি বসা। একটা খয়েরি রঙের ময়লা, ছেঁড়া পুরনো আলোয়ানে মাথা-টাথা ঢেকে জবুথবু। হাতে নিত্যনৈমিত্তিক দুধ-চায়ের গ্লাস। মুখখানা গম্ভীর। তোম্বাপানা। ভিতরে বিষ জমেছে ঢের। বাসন্তী মায়ের চোখ দেখলেই টের পায়, এবার বিষ ওগরাবে। তবে বিষ ওগরানো ছাড়া তার মায়ের আর কিছু করারও নেই।
ছেঁড়া আলোয়ানটা দেখে কষ্টই হয় বাসন্তীর। সেই ছেলেবেলা থেকে শীতকালে মায়ের গায়ে ওই আলোয়ানটাই দেখে আসছে। গরম জিনিস বড্ড পুরনো হয়ে গেলে ওম কমে যায়। গাঁয়ের এই চাষাড়ে শীত মানতে চায় না। তার মায়ের দ্বিতীয় কোনও শীতবস্ত্র যে নেই, তা বাসন্তী ভালই জানে। রাতে গায়ে দেয় একখানা পুরনো লেপা তুলো-টুলো সরে গিয়ে সেই লেপেরও জায়গায় জায়গায় জ্যালজ্যালে অবস্থা।
বাসন্তী ইচ্ছে করলে মাকে একখানা আলোয়ান কিনে দিতে পারে, বানিয়ে দিতে পারে নতুন লেপ। কিন্তু না-দেওয়ার কারণ আছে। কারণটা হল, সেই আলোয়ান বা লেপ কোনওটাই মায়ের ভোগে লাগবে না। তার দুই অসুর ছেলে ভোগা দিয়ে হাতিয়ে নেবেই নেবে।
অকালকুষ্মাণ্ড দুটো ছেলের জন্য মায়ের অনেক পোড়ানি আছে বুকের মধ্যে।
বাসন্তী মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ মা, আমাকে কি পেটে ধরোনি তুমি! সত্যি করে বলো তোর তোমার ভাবগতিক দেখে মনে হয় আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলে! তোমার ছেলেরাই তোমার সর্বস্ব।
এসব ভাবের কথা অবশ্য জিজিবুড়ি গায়ে মাখে না। তাকে দোষ দিয়ে লাভও নেই। সারাটা জীবন ভাত কাপড়ের কষ্ট, উঞ্ছবৃত্তি করে করে মানুষটা আর সেই মানুষও তো নেই। মনটা দড়চা মেরে গেছে।
কাল রাতে রসিক মেয়েকে নিয়ে এসেছে। আসতেই পারে। বাসন্তী খুশিও হয়েছে খুব। দুই পরিবারের মন কষাকষি আর দূর হয়ে, পর হয়ে থাকা যদি একটু কম হতে থাকে তো বাসন্তী তার মধ্যে মন্দ কিছু দেখে না। কিন্তু সংসার হল আঁস্তাকুড়। এখানে ভালকে ভাল বলে দেখা, সোজাকে সোজা বলে ধরার তো রেওয়াজ নেই! এই যে মেয়ে এসেছে এ নিয়েও কথা হয় এবং হবে।
সকালে আঁশটে মুখ করে ওই যে মা এসে বসেছে, তার মানে পেটে জিলিপির প্যাঁচ চলছে। বাসন্তী নিজে যে একটু ভালমানুষ গোছের, তার যে প্যাঁচালো বুদ্ধি নেই, সে যে ঝগড়ুটে নয়, দজ্জাল নয়, সে যে মুখ খারাপ করতে পারে না এটা সে নিজেও জানে। কিন্তু মা তার এই ভালমানুষি একদম পছন্দ করে না। হয়তো তার মা চায় বাসন্তী তার মায়ের মতোই হোক। সংসারের আঁস্তাকুড় হাঁটকে জীবনটা কাটাক।
তাই অবশ্য হওয়ার কথা ছিল বাসন্তীর। ছেলেবেলা থেকে এক অশান্তির সংসারে সে বড় হয়েছে। মায়ে বাবায় বনিবনা হত না। তার দুই দাদা ডাগর হয়ে নানা বদমাইশিতে ঢুকে পড়ল। বাসন্তীর তো ভাল হওয়ার কথাই নয়। ভিতু স্বভাবের বাসন্তী বরাবর একটু বাপ-ঘেঁষা ছিল। বাবা কৃতী পুরুষ ছিল না বটে, কিন্তু লোক খারাপ ছিল না। বাসন্তীকে ভালও বাসত খুব। বোধহয় বাবা-ঘেঁষা হওয়াতেই তার স্বভাবে বাপের ছাপ পড়েছে বেশি। আর কপালগুণে বর পেল বাঙালকে। ভগবান সবটা দেন না, দিতে দিতেও খানিক কেড়ে রেখে দেন। তাই বাঙালের মতো বর পেলেও সবটা পেল না সে। বড়বউ খানিক দখল করে রাখল।
তা হোক। এতটাই কি আশা করেছিল সে! চারদিকে ফলন্ত, ভরাট সংসার, মা লক্ষ্মী উপচে পড়ছে চারদিকে। এতটাই কি হওয়ার কথা? নিষ্কন্টক নয় বটে, কিন্তু কাঁটা গাছের ফুলও কি কম ভাল!
বাসন্তী কচুরির পুর তৈরি করতে করতে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছিল, কখন মা বিষ ওগরাবে।
গেলাসটা খালি করে রেখে দিয়ে জিজিবুড়ি বলল, তা বড়বউ কবে আসছে? এখন সুয়োরানি এসে পাটে বসলেই তো হয়।
বাসন্তীর বুক কেঁপে উঠল। তবে সে কিছু বলল না।
জিজিবুড়ি হঠাৎ ডুকরে উঠল, হরিবোল বাবা, হরিবোল। চুষিকাঠি ধরিয়ে এতকাল ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে এবার লাথি ঝ্যাঁটা মারার সময় হয়ে এল।
বাসন্তী চোখ পাকিয়ে বলল, দুধ তো গিলেছ। এবার এসে গিয়ে।
যাচ্ছি মা যাচ্ছি। শুধু বলে যাই ওই হাড়গিলে চেহারার মেয়েটা কিন্তু মনিষ্যির চেহারায় শকুন। ভিটেয় ঘুঘু চরিয়ে ছাড়বে। একে একে আসছে সব সুয়োরানির দূত। মনে রাখিস।
বাসন্তী অখণ্ড মনোযোগে পুর মেখে উনুনে কড়াই চাপাল।
হঠাৎ সুর পালটে জিজিবুড়ি বলল, হাজার দুই টাকা দিবি?
অবাক হয়ে বাসন্তী বলে, দু হাজার টাকা! কেন?
ধার বলেই দে। দু মাস বাদে ফেরত দেবো।
দু মাস বাদে কি লটারি পাবে নাকি?
মায়ের পেটের দুটো ভাইয়ের জন্য তো আর কিছু করে দিলি না। কত করে বললুম, বাঙালকে ধরে বাজারের দোকানঘরটা করে দে। দুজনে মিলে করে কর্মে খেতে পারত। বাঙালের টাকাও শোধ হয়ে যেত এতদিনে। তা আর যখন হল না তখন আর কী করা! কানু বাড়িতেই ব্যবসা ফেঁদেছে একটা। ধূপকাঠি আর মাজন তৈরি করে বেচবে।
দাদারা আজকাল বাসন্তীর কাছে বিশেষ আসতে সাহস পায় না। একসময়ে যথেষ্ট লুটপাট করে বাসন্তীকে প্রায় পথে বসিয়ে দিয়েছিল। এখন পাত্তা না পেয়ে পেয়ে আর বিশেষ আসে না। তবু তার মধ্যেও মাঝে মাঝে নির্লজ্জের মতো এসে টাকা ধার চায়। বাসন্তী ধার দেয় না বটে, তবে দু-দশ টাকা দিয়ে বিদেয় করে দেয়। মিথ্যে করেই বলে, টাকাপয়সা আমার কাছে থাকে না, সব তোমাদের ভগ্নীপতির হেফাজতে। কথাটা ওরা বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু বেশি কিছু বলতেও পারে না। বলার মুখও নেই কিনা!
বাসন্তী বলল, টাকা নেই।
জিজিবুড়ি বিরস মুখে বলে, ধান-বেচা টাকাগুলো তো সদ্য হাতে পেলি।
সেটা হিসেবের টাকা। তোমার জামাই ব্যবসা করে খায়। সে হিসেব বুঝে নেয়। বেহিসেবি চলে না।
আজকালকার বাজারে দুটো হাজার টাকা কি একটা টাকা! নাহয় একটু বানিয়ে-ছানিয়ে যাহোক বলে দিবি। কানু বলেছে এ-টাকা সে ফেরত দেবে।
সে তো খুব ভাল কথা মা। ফেরত পেতে তো আমার হাড়ে দুব্বো গজাল। আর গিল্টি করা কথাগুলো বোলো না তো!
এরপর ভাই দুটো যদি চুরি-ডাকাতি করে খায় তাতে কি তোর মান বাড়বে নাকি!
আমার মান নিয়ে তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। চুরি ডাকাতির কমটাই বা কী করেছে তারা শুনি?
জিজিবুড়ি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার ভয় কী জানিস? গলায় দড়ি-টড়ি না দিয়ে বসে।
তোমার ছেলে দেবে গলায় দড়ি! হাসালে মা। সে দড়ি এখনও তৈরি হয়নি।
জিজিবুড়ি আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে সে কি আর এমন মানুষ থাকবে? শত হলেও ভদ্রলোকের ছেলে তো। অভাবে পড়ে নাহয় অকাজ কুকাজ করে ফেলেছে। তা বলে এটা তো আর খারাপ নয়।
আমি অত তত্ত্বকথা জানি না মা। তোমার ছেলেদের আমার বিশ্বাস হয় না, জেনে রাখো। বহুবার বহু ছুতোয় টাকা নিয়ে মদ-গাঁজা খেয়েছে না হয় পেট পুজোয় গেছে।
তা কী করবে বল! অভাবের সংসার, এণ্ডি-গেণ্ডি ছেলেপুলে, সেগুলোকে তো আর ফেলে দিতে পারে না!
ছেলেপুলেই বা গণ্ডায় গণ্ডায় হয় কেন? অভাবের সংসার, এক পয়সা আয় নেই, অথচ দুই ছেলে দুই বউ জুটিয়ে আনল। জাত দেখলে না, বংশ দেখলে না, কোত্থেকে কাকে ধরে আনল খোঁজ নিলে না। তারপর বছর বছর বংশ বিস্তার করে যাচ্ছে। বেশ যা হোক।
না হয় আমাকেই দিলি টাকাটা, গরিব মাকেও তো লোকে দেয় খেতে নাকি?
তেমন মা তো তুমি নও! এতদিন বলিনি, জামাইয়ের হাতে দেবে বলে একটা ফর্দ লিখেছিলাম, তার মধ্যে আফিং-এর কথাটা কে লিখিয়েছে বলতে পারো? নাতিকে তুতিয়ে পাতিয়ে তুমিই লিখিয়েছ। এ কি ভাল?
তোম্বা মুখ করে জিজিবুড়ি বলে, তোকেই বলতুম। তা তখন তুই শীতলাবাড়িতে গিয়েছিলি বলে–
আর মিথ্যে কথা বলে পাপের বোঝা বাড়িও না। টাকাপয়সা আমি আর দিতে পারব না, বলেই দিচ্ছি।
টাকাপয়সা কি তোরই থাকবে ভেবেছিস? ভাগাড়ে তো শকুনের নজর পড়েছে দেখতেই পাচ্ছি। বুদ্ধি থাকলে সাঁট করে দশ বিশ হাজার টাকা সরিয়ে আমার কাছে গচ্ছিত রাখলেও পারতিস। আখেরে কাজ হত।
তোমার কাছে টাকা রাখা মানে তো সাপের কাছে ব্যাঙ রাখা। আমার তো আর মতিচ্ছন্ন হয়নি! আমার টাকা আমার কাছেই থাকবে। আমার ভালর জন্য ভেবে আর চোখের জল ফেলো না তো।
রান্নাঘরটা মস্ত বড়। তার এক কোণে বসে মুক্তা মশলা বাটছিল। সে সাতে পাঁচে থাকে না। আজ হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলল, কেন বাপু রোজ এসে ঘ্যানঘ্যান করো। বাবা কি তেমন লোক?
জিজিবুড়ি ভস্ম করা চোখে মুক্তার দিকে চেয়ে বলল, এঃ, বড় আমার বাবা-উলি এলেন রে! বাঙাল আবার কবে তোর বাবাকেলে বাবা হল শুনি! বাঙাল হল মগেদের দেশের লোক, সাপ ব্যাঙ সব খায়, ওদের বামুন-কায়েত নেই। ছিষ্টিছাড়া জীব। কোন সুবাদে তাকে বাপ ডাকতে যাস শুনি! দেখছিস তো কেমন একে একে ছেলে মেয়ে আমদানি করে ঘট প্রতিষ্ঠা করে রাখছে। এরপর আমার মেয়েটাকে কাঁত করে লাথি মেরে যদি না তাড়ায় তো দেখিস! কপাল খারাপ না হলে, মরতে ওই লোকের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিই! এখন বরাতে কী আছে কে জানে বাবা! আর মেয়েটাও আমার বোকার হদ্দ। নইলে বাঙালের সঙ্গে নাচে! গাল ভরে বাবা ডাকছিস। কোন সগগে তুলবে তোকে ওই ম্লেচ্ছটা শুনি!
মুক্তা তার নিজের মতো করে একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে। রসিক সাহা তাদের বন্ধকী জমি উদ্ধার করে দিয়েছে, তাদের ভাঙা ঘর ছেয়ে দিয়েছে। মুক্তার মা-বাবা এই বুড়ো বয়সে বাঙালের জন্যই একটু সুখে আছে। তার ওপর মুক্তার জন্য পাত্রেরও খোঁজ করছে বাঙাল। বলে রেখেছে বিয়ের সব খরচ তার। কৃতজ্ঞতায় আপনা থেকেই বাবা বলে ডাকে মুক্তা, কেউ শিখিয়ে দেয়নি। আর বাবার প্রতি তার অসম্ভব পক্ষপাত।
জিজিবুড়ির দিকে চেয়ে সে বলল, বাবার মতো মানুষের কুচ্ছো গাইছ, কলিকাল বলে তোমার মুখে পোকা পড়ছে না। বাবার মতো মানুষ বলেই বাবা ডাকি। তাকে ডাকব না তো কি তোমাকে বাবা বলে ডাকব? রোজ এসে এ-বাড়িতে শেয়ালের মতো ঢুকে মেয়ের সংসার ভাঙার চেষ্টা করো, তুমি কেমনধারা মা? নিজের সংসারে তো আগুন লাগিয়ে বসে আছ, সেখানে সুন্দ উপসুন্দের লড়াই হচ্ছে রোজ। সব খবর রাখি।
দ্যাখ মুক্তা, তোর বড় আস্পদ্ধা হয়েছে কিন্তু! চিরটা কাল পরের বাড়ির এঁটো পাত কুড়িয়ে বড় হয়েছিস। তোর এত গুমোর কীসের রে! বলি বাঙালের খুঁটোর জোরে সাপের পাঁচ পা দেখলি নাকি? কার সঙ্গে কইছিস সে খেয়াল আছে?
তা থাকবে না কেন? খুব আছে। তুমি হলে তো বাবুর শাউড়ি। কিন্তু শাউড়ির যা ছিরি দেখছি তাতে ঘেন্না হয় বাপু। মান চাইলে মানী হতে হয়। এ বাড়ির দুধটুকু, সরটুকু, এ বাড়ির নারকোল, সুপুরি কোনটা না হলে তোমার চলে বলো তো! আমরা এঁটো পাত কুড়িয়ে বড় হয়েছি, আর তুমি?
আমাকে খুঁড়ছিস? এ আমার মেয়ের বাড়ি, তা জানিস? আমার হক আছে।
তা আমারই বা হক থাকবে না কেন! আমরা গতরপাত করে খেটে খাই, বুঝলে! তোমার মতো মাগুনে বেওয়া নই। হাতটি তো পেতেই আছ। আবার যারটা খাচ্ছ তার মুন্ডুও পাত করছ।
লহর তুলে হেসে কুটিপাটি হয়ে জিজিবুড়ি বলল, ওলো গতরওয়ালি লো! দেখিস আবার বেশি গতরের গুমোর করিসনি। পেট-টেট বাধিয়ে না বসিস। সোহাগ করে বাপ ডাকছিস ডাক, কিন্তু গতর সামলে!
মুক্তা এই অশ্লীল ইঙ্গিতে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইল। তারপর বাসন্তীর দিকে চেয়ে বলল, শুনলে বউদি, শুনলে! এখন যদি মুখ ছোটাই তাহলে তোমরা আমার দোষ দেখবে। ও তোমার মা, নইলে জিজ্ঞেস করতুম, ওই মুখ দিয়ে খায় না হাগে, এমন লোকের মুখ দেখলে গঙ্গায় নাইতে হয়।
বাসন্তী মায়ের দিকে চেয়ে বলল, দিন দিন তুমি কী হয়ে যাচ্ছো বলো তো! ভদ্রলোকের সমাজে মুখ দেখাও কী করে?
জিজিবুড়ি দমল না। মুখে বিষাক্ত হাসিটা ধরে রেখেই বলল, ও মা! খারাপ কথা কী আবার বললুম! সোমত্ম বয়সের মেয়ে, রূপযৌবন আছে, তাই সাবধান করে দেওয়া। বাঙাল মনিষিদের কি চরিত্তির থাকে রে বাপু!
মুক্তা ফুঁসে উঠে বলল, তোমার চরিত্তির ঠিক রাখ গিয়ে। শ্মশানে বাড়িয়ে বসে আছ, তবু মুখে একটা ভাল কথা শুনলুম না। জন্মে কখনও শুনিনি বাপু কেউ নিজের মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য আদাজল খেয়ে লাগে। বলি ও ভালমানুষের মেয়ে, তোমার মতো গুয়ের পোকারা যদি ওই বাঙালের পাদোদক খায় তবে উদ্ধার হয়ে যায়। বুঝলে! এখন এ বাড়ি থেকে বিদেয় হও, নইলে আমি বাবাকে ডেকে এনে দেখাব তার শাউড়ি রোজ চোরের মতো এসে এ বাড়িতে কেন ঢোকে! তোমার লজ্জা হয় না এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে?
কথাগুলো গায়ে না মেখে জিজিবুড়ি উঠে পড়ল। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, মা-মেয়ের কথার মধ্যে তুই আসিস কেন লা? ঝি-গিরি করছিস তাই কর। আর তোরও বলিহারি যাই বাসন্তী, কাজের লোককে মাথায় তুলছিস একদিন বুঝবি। কথায় বলে গোলামের ওষুধ হল পয়জার। মেনি বেড়ালের মতো মিউ মিউ করলে কি চলে? এসব নিকৃষ্ট মেয়েছেলেদের পায়ের তলায় দেবে রাখতে হয়।
এখন যাও তো মা, আর অশান্তি কোরো না।
যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। পেটে ধরেছিলুম বলে সেই মায়ায় আসা। নইলে কে বাড়ি বয়ে জুতো খেতে আসে!
কেউ তোমাকে জুতো মারেনি মা, নিজের দোষে তুমিই জল ঘোলা কর।
খুব ভালমানুষের মতো, সব রাগ-টাগ ভুলে জিজিবুড়ি বলল, টাকাটার কথা একটু মনে রাখিস মা। কানু বলেছে না হয় সুদই দেবে। দু হাজার দিবি, দু মাস বাদে আড়াই হাজার ফেরত পাবি। টাকাটাও খাটল, ভাইটারও আয়-পয় হল।
কোণ থেকে ই..ই..ই.. বলে একটা দীর্ঘ শব্দ করল মুক্তা। তারপর বলল, পুলি পিঠের ন্যাজ বেরোবে গো! উনি দেবেন সুদ। খানেকা ঠিকানা নেহি, নও বাজে চান।
জিজিবুড়ি দরজার কাছ থেকে ফিরে বলল, তাতে তোর কী রে বেশে মেয়ে কোথাকার!
শুনলে বউদি! আমি বেশ্যে হলে ও কী?
বাসন্তী তাড়াতাড়ি দুজনের মাঝখানে পড়ে বলল, ওসব কানে তুলিসনি মুক্তা। কাজ করে যা। তুমি এবার বিদেয় হও তো মা।
জিজিবুড়ি চলে যাওয়ার পর বাসন্তী তাড়াতাড়ি উঠে রান্নাঘরের পাশের গলিটাতে এসে দাঁড়াল। তার চোখ ফেটে জল আসছে। তার মা ওইরকম বটে, কিন্তু একটু কষ্টও তো হয় বাসন্তীর। মা তো লাথি ঝাঁটা খেয়েই ছেলেদের সংসারে পড়ে আছে। জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে।
.
৪৪.
এসব কী এনেছ?
ফলমূল বুড়িমা। সন্দেশও আছে।
অ্যাঁ! ফলমূল! আবার সন্দেশ!
হ্যাঁ গো বুড়িমা, এই যে আপেল, কমলালেবু, আঙুর, সবেদা, বেদানা, কলা। আর এই বাক্সে সন্দেশও আছে।
তা ভাল বাছা। দিয়েছ, দাও। কিন্তু দাম চাইবে না তো! আমার কিন্তু বাপু পয়সা-টয়সা নেই।
আরে না বুড়িমা, পয়সা লাগবে না। এমনিই দিচ্ছি, আজ স্বাধীনতা দিবস তো, তাই।
অ, তাই বলো! আজই তাহলে সেই অনামুখো, সৃষ্টিছাড়া দিন!
আহা, ওরকম করে কি বলতে আছে? আজকের দিনটায় আমাদের দেশ যে স্বাধীন হয়েছিল।
অতশত জানি না বাপু। এক দিন দুপুরে যতুর বাপ এসে ধপ করে দাওয়ায় বসে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লেগেছিল। অত বড় মানুষটা, জীবনে তার চোখে জল দেখিনি। সেদিন কী হাউ হাউ করে কান্না! তারপর বলল, দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে গো, এবার পোঁটলা পুঁটলি বাঁধো। দেশ ছাড়তে হবে। ঘরে ঘরে নিশানও তুলেছিল বটে লোকে, বাজি পটকা কম ফাটেনি। কিন্তু আমাদের তাতে কী বলো! স্বাধীন-টাধিন তো বুঝিনি বাবা, শুধু বুঝেছি, কিছু একটা হয়েছে। আমাদের এখন পাততাড়ি গোটাতে হবে।
ওসব অতীতের কথা বলে কী লাভ বুড়িমা? কিছু লোকের কষ্ট হয়েছিল একথা সত্যি। দেশ ভাগ হওয়ায় আমরাও কি দুঃখ পাইনি?
দুঃখের কপাল তো ভগবানের কাছ থেকেই নিয়ে এসেছি, সেজন্য কি আর কাঁদুনি গাইছি? শুধু বলছি, এই দিনটায় কারও ছিল পৌষমাস, কারও সব্বোনাশ। জিনিসপত্র বাঁধাহ্যাঁদা করতে করতেই কিছু লুটপাট হল, কারা যেন এসে চোটপাট করে শাসিয়ে গেল, খবদার ভিটে ছাড়বি না, কিন্তু বাপু, আমরা তো কথাটথা জানি না, আমাদের শুধু প্রাণের ভয়। শুধু প্রাণটুকুরই তো মায়া, কী বলল!
আজকের দিনে ওসব কথা থাক না বুড়িমা।
কেন বাছা, আজকে কি আমাদের মৌনীব্রত? কথা কইতে নেই বুঝি?
না না, তা নয়।
তাহলে একটু বলিই না হয় বাপু। প্রাণটা যে কেমন জিনিস তা কি জানো?
প্রাণের মায়া কার নেই বলো বুড়িমা?
সে বটে। আমাদেরও খুব ছিল। ডাকাতে, গুণ্ডায় ধরলে শুধু হাতে পায়ে ধরে বলেছি, প্রাণে মেরো বাপু। তা মারেনি বলেই তো বেঁচে আছি। বয়সের মেয়েকে টেনে নিয়ে যায়, জোয়ান ছেলেকে বল্লম দিয়ে খোঁচায়, চোখ রাঙিয়ে কতবার টিপছাপ নিয়ে যায়, আমরা কিছু বলিনি বাপু, রুখেও উঠিনি, শুধু ওই প্রাণের ভয়। শেষে সার বুঝেছি কী জানো?
কী বুড়িমা?
যদ্দুর বাপ যেদিন গলায় দড়ি দিল সেদিন হঠাৎ বুঝলুম যা নেই তার আবার মায়া কীসের বলো! আমাদের মোটে প্রাণই নেই, শুধু দেহটা অভ্যাসের বশে চলে। প্রাণ থাকলে সেটা কি এত সহ্য করতে পারত? নাড়ি ধরে যদি দেখ বাছা, দেখবে নাড়ি আমার চলছে না।
না বুড়িমা, তুমি তো দিব্যি বেঁচে আছ!
কী জানি বাপু, দিনকে দিন, রাতকে রাত বলে চিনতেই পারি না। তা বাপু, এই যে এত সুন্দর সুন্দর সব ফল-টল দিলে এসব কি আসল জিনিস?
আসল নয় তো কি নকল বুড়িমা?
কী জানি বাপু, কেষ্টনগরে নাকি মাটি দিয়ে কী সব বানায়, ঠিক আসলের মতো দেখতে। সে জিনিস নয় তো? এই অনেকটা আমাদের মতোই, মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু মানুষ নয়।
আহা বুড়িমা, তোমার মাথাটাই গেছে, একটু খেয়েই দেখো না।
না বাছা থাক, দেখনসই জিনিস, একটু বরং দেখি।
.
অ বুড়িমা! বলি ঘুমোচ্ছ নাকি?
তা কে জানে বাছা। চোখ বুজলে কখনও মনে হয় ঘুমোচ্ছি, কখনও মনে হয় মরে গেছি। কোনটা তা বলতে পারি না।
ফলগুলো তো খাওনি দেখছি!
যত্ন করে রেখে দিয়েছি। ও কি খাওয়ার জিনিস বাপু?
খাওয়ার জিনিস না তো কী?
জন্মে খাইনি। আপেল, আঙুর ওসব কি খায় বাছা?
খায় তো। খেলে শরীর ভাল হয়।
আমার হবে?
হবে না কেন?
মরা জিব বাছা, খেলে আবার ভিরমি খাই কিনা কে জানে। সকালে এক ডেলা পাউরুটি দিয়েছিল, আর দুধ, তা বেশ খেলুম বাছা, অনেকে দুধ মুখে দিয়ে ওয়াক তুলে বলছিল ও নাকি মোটে দুধই নয়, চকখড়ি গুলে নিয়ে এসেছে। তা বাপু, আমার কিন্তু খারাপ লাগেনি। দুপুরে বেশ ভাত দিয়েছিল অনেকটা। সঙ্গে এক টুকরো মাছ আর ডাল। সেও সবাই ছি ছি করছিল, বলছিল মাছ নাকি পচা, ডাল নাকি হলদে জল, ভাতে নাকি গন্ধ, তা বাছা, আমার তো কিছু খারাপ লাগল না।
তা সেসব খেতে পারলে আর ফলগুলো পড়ে রইল? তুমি কেমন ধারা লোক?
ওই ভয়েই তো খাইনি। ওসব ফল-টল খেলে জিব যদি ফের স্বাদগন্ধ পেতে শুরু করে তখন কি। আর হাসপাতালের খাবার খেতে পারব?
নাঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
রাগ কোরো না গো ভালমানুষের ছেলে। তুমি বড় ভাল লোক। আমি আজকাল যাকেই দেখি তাকেই মনে হয় ভাল লোক। পরশুদিন আমার ভাইঝি দেখতে এসে দুটো টাকা দিয়ে গিয়েছিল। বালিশের তলায় রেখেছিলাম যত্ন করে। সকালবেলায় জমাদারটা এসে বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে বের করে নিয়ে গেল। তা বাপু তাকেও আমার কেন যেন ভাল লোক বলেই মনে হচ্ছিল। সবাই তাকে গালমন্দ করে বটে, সে নাকি আঁটপাট দেয় না, পায়খানা পরিষ্কার করতে চায় না, তার জন্যই নাকি চারধারে গু-মুত জমে আছে, কিন্তু আমার তাকে দিব্যি ভালমানুষ বলে মনে হল।
এটা সরকারের হাসপাতাল বুড়িমা, সরকার ওদের মাইনে দেয়, ওদের কাজ করা উচিত।
হ্যাঁ বাবা, এই সরকার লোকটা কে বলল তো! সবাই তাকে খুব গালমন্দ করে বটে শুনি, সে-ই নাকি নাটের গুরু, যত নষ্টের গোড়া, তা লোকটা যদি এতই খারাপ তবে তার এত নামডাক কেন বলো তো!
আহা সরকার মানে কি আর একটা লোক? অনেক লোক মিলেই তো সরকার।
ও বাবা! এত সরকার! তা বাবা সরকারেরাই বা খারাপ কেন বলো! গাঁটের কড়ি দিয়ে হাসপাতালখানা তো বানিয়ে দিয়েছে! দিব্যি পাকা ঘর, মেঝেতে পড়ে আছি বটে, কিন্তু বাড়ির চেয়ে তো ঢের ভাল, বাড়ির মাটির মেঝেতে কি এত আরাম হত।
নাঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না বুড়িমা, হাসপাতালের এইসব অব্যবস্থার জন্যই তো আমরা আন্দোলন করছি।
ওই আর একটা লোক, সবাই আন্দোলনবাবুর কথা খুব বলে। সে নাকি খুব ভাল। সে এলে সব নাকি ফের ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তা আন্দোলনবাবু আসে না কেন বলো তো! তাকে বড় দেখতে ইচ্ছে যায়। দেখতে পেলে একটু পায়ের ধুলো নিতাম।
না বুড়িমা, তোমাকে কিছু বোঝানো যাবে না, বুঝে তোমার কাজও নেই। ফলগুলো দয়া করে খেও। কাল থেকে পড়ে আছে। এরপর পচে উঠবে! মাছি তো ভনভন করছে দেখছি।
হ্যাঁ বাবা, মাছিরা খুব ছেঁকে ধরে আমাকে। বড় বড় নীল মাছি, গুয়ের মাছি, তা হোক, মাছিগুলো দেখতে ভারী সুন্দর।
বুড়িমা! ও বুড়িমা! সাড়া দিচ্ছ না কেন? … এই রে! টেঁসে গেল নাকি?
কে বাবা! যমদূত?
না বুড়িমা, আমি যমদূত নই।
তবে কি তুমি সরকার না আন্দোলন?
না বুড়িমা, আমি সরকারি লোক নই, আন্দোলন করতেও আসিনি। শাবলরাম মাড়োয়ারির ছেলের বিয়ে বলে গরিবদের কম্বল দেওয়া হচ্ছে। এই নাও, তোমার জন্যও একখানা এনেছি।
বাঃ বাঃ, এ তো ভারী বাহারি জিনিস গো! বিনি মাগনা দিচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ গো বুড়িমা, একদম বিনি মাগনা।
তা ভাল বাছা, কলিকালে এখনও বিনি মাগনা জিনিস মেলে তাহলে গো, কেমন যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
কেন বলো তো! বিশ্বাস না হওয়ার কী আছে?
এখেনে যে আমাকে ওষুধপত্তর কিছু দেয় না বাবা, শুনেছিলুম সরকারবাবু হাসপাতালে বিনি পয়সায় ওষুধ দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে। তা এখানকার লোক বলে ওসব বাজে কথা। ওষুধ খেতে হলে পয়সা দিতে হবে। এই যে চারদিকে গু-মুত-বমি-গয়ের-থুথু পড়ে আছে এসবও নাকি পয়সা না দিলে পরিষ্কার করা হবে না। ডাক্তারবাবু বুকে নল লাগালেও পয়সা লাগবে। তা বাবা, সেদিন ভয়ে ভয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, হ্যাঁ গো, এই যে শ্বাস নিচ্ছি এর জন্য পয়সা চাইবে না তো!
এ দেশে গরিবদের দেখার তো কেউ নেই বুড়িমা। সেইজন্যই তো তোমাদের আন্দোলনে নামতে বলি। একবার রুখে দাঁড়াও, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
আন্দোলনবাবুকে আমার পেন্নাম দিও বাবা। সে বড্ড ভাল লোক।
এখানে এত দুর্গন্ধ কেন বলো তো বুড়িমা?
তা আর হবে না বাছা, আমার যে পেট ছেড়েছে!
এঃ মাঃ!
পরশুও হামাগুড়ি দিয়ে পায়খানায় যেতে পেরেছি, কাল থেকে হাত-পায়ে যেন সাড়া পাচ্ছি না, বিছানাতেই হয়ে যাচ্ছে।
আঁঃ তা পরিষ্কার করছে না কেউ?
না বাবা, সেরকম নাকি নিয়ম নেই।
ওষুধপত্রও দিচ্ছে না!
এই তো বললাম, ওষুধপত্র দিলে পয়সা নেবে।
এ তো ভীষণ অন্যায়!
রাগ কোরো না বাবা, আমি কিছু খারাপও তো নেই, সবাই বলছে বুড়িটা গপগপ করে খায় বলে হাগছে। তা তাই হবে বোধহয়, তা এই সময়ে তুমি কম্বল এনেছ দেখে বাঁচলুম। কম্বলটা আমার মাথায় ঠেকিয়ে শিয়রে রেখে দাও। কম্বলেই আমার অসুখ ভাল হয়ে যাবে।
ধ্যেৎ! কী যে বলো!
কম্বলে অসুখ সারবে না বাবা?
তাই কখনও সারে? কম্বল কি পেট খারাপের ওষুধ?
তবে তুমি আনলে যে! আমি তো ভাবছি ওষুধ না হোক কম্বল তো জুটল। ভগবান বোধহয় কম্বল দিয়েই দাস্ত বন্ধ করবেন।
নাঃ, তোমার মাথাটাই গেছে দেখছি। কম্বল কেন দেয় জানো না? ওম-এর জন্য। এই যে ঠান্ডার। মধ্যে মেঝেতে পড়ে আছ, তোমার শীত করে না?
ও বাবা, তা আর করে না! খুব করে বাবা, খুব শীত করে। কিন্তু ওম কি আমার সইবে বাবা? বেশি ওম-এ আবার গায়ে ফোঁসকা না পড়ে যায়, ঠান্ডা থেকে হঠাৎ গরম হলে গোলমাল হবে না তো!
ওঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না, এই জন্যেই বলে মানুষের ভাল করতে নেই।
এটা কার কথা বাবা? বড় ভাল কথা তো!
.
ও বুড়ি!
অ্যাঁ! কে রে?
আমি যমদূত।
বটে!
হ্যাঁ রে, এবার শরীরটা ছেড়ে ফেলে দে দিকিনি।
শরীর ছেড়ে ফেলব? কেন বাপু?
তুই যে মরেছিস!
সত্যি?
হ্যাঁ রে।
নিয্যস?
হ্যাঁ, এবার বেরিয়ে আয় ভিতর থেকে।
মরলাম কখন? কই টের পেলাম না তো?
টের পাবি কী করে? মরেছিস কি আজকে? সেই কবে থেকে মরতে শুরু করেছিস। একটু একটু করে মরেছিস বলে হ্যাঁচকাটা লাগেনি, তা সেটা একরকম ভালই।
সে তো বুঝলাম। এখন বেরোই কোথা দিয়ে বলো তো বাবা যমদূত!
কেন, অসুবিধে কী? নাক মুখ কান গুহ্যদ্বার ব্রহ্মতালু যে কোনও একটা ফুটো দিয়ে টুক করে বেরিয়ে আয়।
বড্ড অন্ধকার যে, ফুটোফাটা দেখব কী করে বলো তো বাবা, একটা বাতি-টাতি দেখাতে পারো না?
দুর বুড়ি, তোর বড্ড বায়নাক্কা, চারদিকে ঢুঁ মারতে থাক, রন্ধ্র একটা ঠিক পেয়ে যাবি। শরীরের মধ্যে বাতি কোথা পাবি?
বড্ড ভয় করছে যে বাপু!
ভয়টা কীসের?
অজান জায়গায় কোথায় নিয়ে ফেলবে বাবা?
তা এটাই বা তোর কোন কালের জায়গা ছিল শুনি! এটাও তো অজানা জায়গা।
তা অবিশ্যি বটে। তবু কেন ভয়-ভয় করছে বলো তো!
ও তোর ভয় পাওয়ার অভ্যাস। মেঘ করলেও ভয়, রোদ উঠলেও ভয়, তোদের কি ভয়ের শেষ আছে? চোরে যেমন সিঁধ কাটে তেমনি সিঁধ কাটতে থাক।
তা হ্যাঁ বাবা যমদূত, আমার শরীরের মধ্যে এত যন্ত্রপাতি কেন বলো তো? ই রে বাবা, যেদিকে টু মারি সেদিকেই যন্ত্রপাতি!
তা আর হবে না! মানুষ বানাতে কি কম মেহনত লাগে আমাদের?
তা আমার ভেতরে এত যন্ত্রপাতি দিয়েছ তোমরা, কই টের পাইনি তো! শুধু পেটের খোঁদলটা খুব টের পেতাম। ই রে বাবা, এ যে কলকারখানা বানিয়ে ফেলেছিলে গো! আমাদের মতো মনিষ্যির কি এত যন্ত্রপাতি লাগে?
তবেই বোঝো, ভগবান মোটেই একচোখা নয়, তোকেও কারও চেয়ে কম দেননি।
কিন্তু বাবা, এখন যে আমার বড্ড মায়া হচ্ছে।
কীসের মায়া রে বুড়ি?
এমন সুন্দর শরীর ছাড়তে ইচ্ছে যাচ্ছে না যে!
মর বুড়ি! এখন মায়ায় পড়লে কি হয়? আর শরীরে তোর আছেটাই বা কী বল! বুড়ো থুথুরে হয়ে গেছিস, শনের নুড়ি চুল, চামড়া ঝুলে গেছে, হাড্ডিসার চেহারা, রাজ্যের অসুখে শরীর ঝাঁঝরা, ও পচা, শরীর দিয়ে কী হবে তোর?
না বাছা, শরীরটা ভেঙে গেছে বটে, কিন্তু তাতে কী? ভেতরে যে ভারী ভাল ভাল বন্দোবস্ত ছিল, এও কি জানতাম? আমার মতো এমন পোড়াকপালির জন্যও এত কিছু করেছ তোমরা।
ভাল করে ভেবে দেখ বুড়ি, শরীর ছাড়বি কিনা।
দুটো চারটে দিন সবুর করো না বাবা, তাড়া কীসের?
তবে শরীর আঁকড়ে পড়ে থাক। আমি চললুম। আমার মেলা কাজ।
.
কী করছ গো বসে বসে?
অমল একটু তটস্থ হয়ে ম্লান হেসে বলল, কিছুনা ঠাকরোন, আগডুম বাগড়ম নানা কথা মাথায় আসে, সেগুলো লিখি।
ও কি তোমার সায়েন্সের ব্যাপার? না না।
অনেকক্ষণ সাড়া না পেয়ে ভাবলাম ঘুমোচ্ছ বুঝি। কিন্তু শীতের বেলায় বেশি ঘুমোলে শরীর খারাপ করবে ভেবে বুদ্ধি করে চা নিয়ে এলাম। ভাবলাম চায়ের ছুতো করে জাগিয়ে দিয়ে যাই, তা এসে দেখছি, মন দিয়ে লেখাপড়া করছ।
লেখাপড়া নয় ঠাকরোন, এ একরকম চিকিৎসা।
ও মা! লেখাপড়া আবার কীসের চিকিৎসা?
ও তুমি বুঝবে না, মাথায় এলোমেলো চিন্তা এলে সেগুলো ঠেকানোর জন্য আমি মনে যা আসে লিখতে থাকি। লেখায় একটা প্যাটার্ন চলে আসে। তাতে মনটা একটু স্থির হয়।
হ্যাঁ গো, তোমার মনের অশান্তি কি আর শেষ হবে না?
চায়ের কাপটা হাতে নিতে গিয়ে একটু চলকে গেল। অমল টের পায় আজকাল তার হাত কাঁপে। অকারণেই কাঁপে। কিংবা কোনও গূঢ় কারণে।
কলকাতায় খবর দিয়েছ তো!
দিয়ে লাভ কী?
দুশ্চিন্তা করবে তো! আজ তিন দিন।
আজ তিন দিন? বলো কী? আমার তো মনে হচ্ছে যেন অনেক দিন হল এসেছি।
চালাকি কোরো না, আজই একটা খবর দাও। তোমার এসব হাবভাব আমার মোটেই ভাল লাগে না বাপু। অবিশ্যি তোমার দাদাটি বিবেচক লোক। সে হয়তো খবর একটা দিয়েছে।
অমল হেসে বলল, খবর যে দেওয়া হয়ে গেছে তা কি আর আমি জানি না বলে মনে করো? তোমরা সংসারী মানুষ, বেহিসাব তোমাদের কুষ্ঠিতে নেই।
বেহিসেবি চলন কি ভাল ঠাকুরপো? এবার খোলসা করে বলো তো হুট করে চলে এলে কেন।
শুনে কী করবে?
শুনিই না।
অমল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শুনলেও তোমার বিশ্বাস হবে না।
কেন হবে না?
আমি ওদের খুব ভয় পাই।
ও মা! কাদের ভয় পাও?
আমার বউ, ছেলে আর মেয়েকে।
ভয় পাও কেন? ওরা কি তোমাকে কামড়ায় নাকি?
না। এ ভয়টা একটু অদ্ভুত ধরনের।
বউকে একটু আধটু ভয় পাও সে ঠিক আছে। অনেকেই পায় বলে জানি। কিন্তু ছেলেমেয়েকে ভয় কীসের?
আমি ওদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পেরে উঠি না। সবসময়ে মনে হয় ওরা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ জীব, অনেক বেশি পাওয়ারফুল।
যত উদ্ভুটে কথা। আর তাও যদি হয় তো ভয়টা কীসের!
আমার ওদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করছিল।
তাই না বলে কয়ে চলে এলে? ওরা তোমার আপনার জন না কি?
অস্বীকার করি কী করে?
তাহলে?
সেইসবও ভাবি, কেন যে আজকাল আমার ভয় হয়
তুমি তো বামুনের ছেলে!
অমল অবাক হয়ে একটু হেসে বলল, তাতে কী?
বলি বামুনের ছেলে হয়ে জন্মেছ, পৈতেও হয়েছিল জানি, তা গলার যজ্ঞসূত্রটা কোথায় গেল?
দুর! সে কবে হারিয়ে ফেলেছি।
গায়ত্রী মন্ত্র মনে আছে?
ওং ভূর্ভুবঃ সঃ তো? কেন মনে থাকবে না?
কখনও জপ-টপ করো?
দুর দুর, ওসব কবেই চুকেবুকে গেছে।
তোমার মাথা, কিছু চুকেবুকে যায়নি। ফের শুরু করো তো!
কী শুরু করব?
সকাল সন্ধে একটু গায়ত্রী জপ করো, আমি বাবাকে বলব তোমার জন্য একটা পৈত গ্রন্থি দিয়ে দিতে। কাল স্নান করে ভক্তির সঙ্গে পৈতেটা গলায় দিও।
এসব আবার কী জুলুম শুরু করলে? আমি জন্মসূত্রে বামুন হলেও আচার আচরণে চাড়াল। আমাকে দিয়ে ওসব হবে না।
দেখো বাপু, আমি সম্পর্কে গুরুজন, তার চেয়েও বড় কথা, আমি তোমার ভাল চাই। যে তোমার ভাল চায় তার একটা কথা শুনতে দোষ কি?
অমল হেসে বলল, তোমার যে সব অদ্ভুত অদ্ভুত নিদান। একবার বললে বউয়ের সঙ্গে এক বিছানায় শুতে হবে। এখন বলছ পৈতে পরে গায়ত্রী জপ করতে হবে।
তাতে তো বাড়তি পরিশ্রম নেই। না হলে করলেই একটু, ওই যে বলছিলে মনটাকে স্থির করার জন্য লেখো, এও একরকম তাই, মন্ত্র ধরা থাকলে মন স্থির হয়।
মাথা নেড়ে অমল একটু হেসে বলে, মন্ত্র জপ করলে মন স্থির হয় না ঠাকরোন, বিশ্বাস করলে মন স্থির হতে পারে। আমার যে সেখানেই ফাঁক।
তুমি বড্ড ঝগড়ুটে লোক বাপু। একটা না একটা কাঁড়া কাটবেই। বলি বিশ্বাস কি মানুষ সঙ্গে করে নিয়ে আসে?
তবে?
করতে করতেই বিশ্বাস আসে।
আগে তো বুঝতে হবে মন্ত্রের সত্যিই কোনও জোর আছে কি না।
করেই দেখো না।
অবশ্য শাস্ত্রে বলে মনকে যা ত্রাণ করে তাই হল মন্ত্র। একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি। কিন্তু যদি কাজ না হয়?
না হলে না হবে।
তখন কিন্তু বিশ্বাস একেবারে চলে যাবে। ছায়াটুকুও থাকবে না।
কাজ হবেই, করেই দেখো।
দীপ্ত মুখে বউদি উঠে চলে গেল।
অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল অমল। ধীরে ধীরে বিকেলের আলো মরে আসছে। সন্ধের সময়টা বড় বিষাদের সময়। এই দিন গিয়ে রাত যখন আসে তখন অমলের মনটায় যেন হু হু করে বিষণ্ণতার বাতাস বয়ে যায়। সে ভারী ছটফট করে তখন।
আজও সে তাড়াতাড়ি গায়ে জামাকাপড় চাপিয়ে রোদ মরতে না মরতেই বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্যহীন যাওয়া। সে শুধু পথে বিপথে জোর কদমে হেঁটে যায়, কোথাও পৌঁছোয় না।
.
৪৫.
এবার তোর ছেলে হবে।
যাঃ, কী করে বুঝলে?
বুঝব না! সে কী রে! আমিই তো আসছি!
তুমি?
হ্যাঁ রে। জন্মাতে বড্ড ইচ্ছে যায় যে! নিরালম্ব ঘুরে বেড়াই, এ কি ভাল লাগে বল!
সত্যি বলছ?
সত্যি বলছি।
তিন সত্যি করে বলো। আমার গা ছুঁয়ে বলো।
দুর পাগল! এতে অবিশ্বাসের কী আছে? তোর ছেলে হয়ে আসতে বরাবর ইচ্ছে ছিল আমার।
আমার গর্ভ কি শুদ্ধ, পবিত্র বাবা?
কেন বল তো!
তোমার মতো মানুষ কি অপবিত্র শরীরে জন্ম নিতে পারে?
তুই অপবিত্র কেন মা?
তুমি তো জানো না বাবা, যখন আমার সতেরো বছর বয়স তখন যে আমি অপবিত্র হয়ে যাই।
জানি রে মা, জানি। পাপ-পুণ্যের হিসেব তো অত সহজ সরল নয়। দেহ ভ্রষ্ট হয়েছিল বটে, মন ভ্রষ্ট হয়নি যে! দেহ নয় মা, পাপ হল মনের। শরীর কি পাপ করে? মন তাকে যেমন করতে বলে সে তেমন করে।
তবু কেমন খুঁতখুঁত করে মনটা, ভাবি, কী দরকার ছিল ওরকম হওয়ার? কেন হল? না হলে কি পারত না?
দুনিয়ায় সব ঘটনা কি আমাদের পছন্দমতো ঘটে? দুর পাগল, তাহলে দুনিয়ায় কোনও মজা থাকত না।
কেন আমাকে নিয়েই মজা হল বলো! আমি তো কত শুদ্ধ ছিলাম, মনটাও কত সহজ সরল ছিল, লোককে টপ করে বিশ্বাস করতাম। কাউকে খারাপ বলে মনে হত না। অথচ আমার কপালেই কেন ওরকম বিচ্ছিরি কাণ্ড হল? আকাশ থেকে যেন মাটিতে আছড়ে পড়লাম। তখন আমার কী মনে হয়েছিল জানো? মনে হয়েছিল ভগবান বলেও কিছু নেই। থাকলে কেন এরকম হবে? সেই যে ঘেন্না এল লোকটার ওপর, আর ওর ছায়াটাও সহ্য হত না। এখন দেখলে মায়া হয়।
হ্যাঁ মা, একটা ভুল থেকে কত ভুলে জড়িয়ে পড়ল অমল। ওকে একটু মায়া করিস, সে ভাল। যখন ছোট্টটি ছিলি তখন থেকেই তোর বড় মায়া। আর কাউকে নয়, কিন্তু তোকেই আমি বরাবর আসকারা দিয়েছি।
হ্যাঁ বাবা, তুমি খুব আসকারা দিয়েছ আমায়। সবাই ভয় পেত তোমাকে, আমার একটুও ভয় ছিল না।
যখন হামা দিতি তখন আমি মোকদ্দমার কাগজ দেখতুম, আর তুই টেবিলের নীচে পায়ের কাছটিতে বসে খেলা করতিস। একটু যখন বড় হয়েছিস তখন কী করতিস মনে আছে? রান্নাঘরে গিয়ে যা-কিছু রান্না হত তার খানিকটা বাটি করে নিয়ে এসে আমাকে খাওয়াতিস। অসময়ে আমি কখনও কিছু খেতাম না, কিন্তু তোর পাল্লায় পড়ে খেতে হত। আরও শুনবি? বাড়ির অন্যেরা খেতে বসলে তোর ভয় হত সবাই বুঝি তোর বাবার ভাগেরটা খেয়ে ফেলবে। তাই খুব চেঁচামেচি করতি তুই, তোমরা সব খ্রাচ্ছ। যে! আমার বাবা কী খাবে তবে? তারপর কান্না জুড়তিস।
হ্যাঁ, একটু একটু মনে আছে।
তোর ছেলেই তো ছিলাম আমি। তাই ফের তোর ছেলে হয়েই আসছি।
উঃ, আনন্দে আমার বুকটা কেমন ধকধক করছে? হ্যাঁ বাবা, সত্যি তো?
সত্যি রে, খুব সত্যি।
তুমি খুব দস্যি হবে বাবা?
হয়তো হব। তা বলে মারধর করিসনি যেন!
পাগল! খুব আদর দেব তোমায়, যেমন তুমি দিয়েছ। শিগগির এসো। আমার যে তর সইছে না।
গর্ভ পূর্ণ হোক মা। অপেক্ষা করো।
এসো বাবা, এসো…
ওই এসো শব্দটা জেগে উঠে শুনতে পেল পারুল। তার নিজের গলায়। পা থেকে লেপ সরে গেছে বলে শীত করছে খুব। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, ধড়মড় করে উঠে বসল সে। স্বপ্ন! এ কি স্বপ্ন! কটা বাজে এখন? ডিমলাইটের আলোয় সে মস্ত দেয়ালঘড়িতে দেখল, পৌনে পাঁচ। এ ভোররাতের স্বপ্ন, এই স্বপ্ন সত্যি হয় বলে সে শুনেছে। সমস্ত শরীর জুড়ে আনন্দ যেন সেতারের মতো ঝংকার দিচ্ছে। বাবা আসবে! তার গর্ভে বাবা আসবে! এ কি সত্যি? বিশ্বাস হয় না যে!
উত্তেজনায় উঠে পড়ল পারুল। বেসিনে গিয়ে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিল চোখেমুখে। না, আর ঘুমোবেনা সে। ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠান্ডা মেঝের ওপর উপুড় হয়ে প্রণাম করে বলল, তাই যেন হয় ঠাকুর, তাই যেন হয়।
চোখে জল আসছে আনন্দে, আবেগে। বুকে উথলে উঠছে এক পরিপূর্ণতা। তার কি এত ভাগ্য হবে।
আর আধঘণ্টা বাদে খোলা বারান্দায় তাকে আবিষ্কার করে বলাকা অবাক।
ও মা! ও কী রে? এই চাষাড়ে শীতে বারান্দায় বসে আছিস যে বড়!
স্বপ্নাচ্ছন্ন, ঘোরলাগা দুটি অপরূপ চোখ মায়ের দিকে ফেরাল পারুল।
একটা কথা বলবে মা!
কথা পরে হবে। আগে ঘরে আয় তো শিগগির। শরীরের এই অবস্থায় ঠান্ডা লাগাতে আছে? নতুন তো মা হোসনি, তবু খেয়াল রাখিস না কেন? এ বাবা, গা তো বরফ হয়ে আছে তোর! আয় শিগগির ঘরে।
ঘরে এনে তাকে বিছানায় বসিয়ে ঢাকাচাপা দিল বলাকা।
শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
পারুল সুন্দর করে হাসল, একটুও খারাপ নয় মা, আজ আমার শরীর ভাল, মন ভাল, আজ আমার সব ভাল।
ভাল হলেই ভাল বাছা। এ অবস্থায় শরীরের খেয়াল রাখতে হয়। মায়ের শরীর খারাপ হলে পেটের কুঁচোটারও যে ভোগান্তি হয়।
শোনো মা, খুব মন দিয়ে একটা কথা শুনে জবাব দাও।
কী কথা?
ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়?
কী স্বপ্ন দেখলি?
আগে বলো।
শুনি তো সত্যি হয়। কিন্তু জোর দিয়ে বলি কী করে? লোকে তো কত কথাই বলে, তার কতক ফলে, কতক ফলেও না। স্বপ্ন দেখেছিস বুঝি? ভাল স্বপ্ন তো?
ভাল না হলে বলছি! আজ আমার আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে।
ভাল হলে কাউকে বলিস না, বললে নাকি ফলে না।
ও বাবা, এ এত ভাল স্বপ্ন যে না বললে আমার বুক ফেটে যাবে।
তাই নাকি? তাহলে টাপটোপে বল। খুলে বলিসনি।
মায়ের কাছে নাকি সব বলা যায়! মাকে বললে দোষ হয় না, জানো না?
তাহলে দাঁড়া ঠাকুরঘরের বাসি কাজ সেরে নিই আগে। নইলে দেরি হয়ে যাবে।
তুমি বড্ড বেরসিক। শোনো, আমার খুব খিদেও পেয়েছে। তাড়াতাড়ি পুজো সেরে আমাকে খেতে দাও তো!
ও মা গো! আজ কোন দিক দিয়ে সুয্যি উঠবে কে জানে? খিদের কথা শুনে তো বিশ্বাস হয় না।
খাব মা, দেখো খুব খাব আজ।
তাহলে দুখুরিটাকে তুলে দিই। একটু ময়দা মাখুক। খেয়ে আবার উগরে দিও না কিন্তু।
মিষ্টি হেসে পারুল বলে, আজ কিচ্ছু হবে না, দেখো। আজ আমার কিচ্ছু হবে না।
তাই যেন হয়। মহিম ঠাকুরপো যে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে গেছে তার চারটে বড়ি মুখে ফেলে বসে থাক না।
আজ আমার ওষুধ লাগবে না মা। আমি আজ খুব ভাল আছি।
কী জানি মা, ভয় করে। পেটে কুটো গাছটিও থাকছে না বলে দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হয় না।
আর ভয় নেই মা। আমার পেটে কে আসছে জানো?
বলাকা অবাক হয়ে বলে, পেটে কে আসছে মানে? হিটলার নাকি?
পারুল মিষ্টি হেসে বলে, তাকে অনেকে হিটলারও বলত মা। বলো তো কে?
কী জানি বাবা, সকালে উঠে হেঁয়ালি করতে লেগেছিস।
তার টকটকে ফর্সা রং, ইয়া তাগড়াই চেহারা, চোমড়ানো গোঁফ, পুরুষ সিংহের মতো বুকের পাটা। কে বলো তো? চিনতে পারছ না?
বলাকা বিহ্বল চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু গলায় বলল, কার কথা বলছিস? তোর বাবা?
দুহাতে মাকে জাপটে ধরে বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে পারুল বলল, বাবা গো, বাবা!
তাকেই স্বপ্নে দেখেছিস?
স্বপ্ন কী গো! এই যেমন তোমাকে দেখছি ঠিক সেরকম স্পষ্ট, জীবন্ত, ইজিচেয়ারটায় বসে আছে, আমি পায়ের কাছটিতে।
আমি কেন দেখি না রে! কী বলল তোকে?
পরিষ্কার বলল, আমি তোর গর্ভে আসছি, ছেলে হয়ে।
যাঃ! সত্যি?
এই দেখ, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
বলাকা পারুলের মুখটা বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তা আসবে না কেন? তুই ছিলি মানুষটার প্রাণ, তা বলে একচোখো ছিল না মোটেই। সব কটা ছেলেমেয়েকেই ভারী ভালবাসত। কিন্তু আসকারা দিত তোকে।
কত কথা হল বাবার সঙ্গে! কত পুরনো কথা!
বলাকার চোখে জল এসেছিল। ধরা গলায় বলল, কত ভাগ্যি তোর!
হ্যাঁ মা, আজ মনে হচ্ছে আমার বড় ভাগ্য।
আমারই পোড়া কপাল। রোজ ঘুমোনোর আগে তাকে বলি, ওগো, চোখের আড়ালে গেছ, আজ একবার স্বপ্নে দেখা দিও। কিন্তু একদিনও দেখি না তাকে। কত কথা জমে আছে বুকের মধ্যে। ইচ্ছে যায় মুখোমুখি বসে দুটো কথা কই, তা যাই হোক, তুই তো দেখলি! কেমন দেখলি তাকে? রোগা হয়ে যায়নি তো! মুখখানা তেমনি ঢলঢলে আছে? গায়ে রংটা তেমনি আছে?
সব ঠিক আছে মা।
মনে মনে আমারও কতবার ইচ্ছে হয়েছে মানুষটা কোনও না কোনওভাবে ফের ফিরে আসুক.. তোদের কারও ঘরে। তারপর ভেবেছি, তোরা সব বড় হয়ে গেছিস, এ বয়সে আর কি কারও ছেলেপুলে। হওয়ার কথা! মনটা ভেঙে যেত। আজ বুকটা খুব হালকা লাগছে। এখন আর মরতেও ইচ্ছে করছে না। ঠাকুরকে গিয়ে বলি, যতদিন না ছেলেটা হয় ততদিন আমাকে বাঁচিয়ে রেখো ঠাকুর।
মরার কথা বোলো না তো! এমন একটা সুন্দর সকালে এসব বলতে নেই।
না মা, মরার কথা নয়, বাঁচার কথাই তো বলছি। বাঁচতে কি ইচ্ছে যায় না, বল তো! কিন্তু বাঁচতে হলে এমন একজনকে চাই যার জন্য বেঁচে থাকার একটা মানে হয়। তার বাবা গিয়ে অবধি সেইটেই হারিয়ে গিয়েছিল।
আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে মা। শিগগির গিয়ে পুজো সেরে লুচি-টুচি ভাজতে বলে দাও। আর নতুন আলু দিয়ে পাঁচ ফোড়নের একটা চচ্চড়ি।
বলাকা চলে যাওয়ার পর গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে ফের বারান্দার কোণে এসে দাঁড়ায় পারুল। পুব দিকটা এখান থেকে দেখা যায়। সামনে বাঁশঝাড় আর একটা দোতলা বাড়ির ফাঁক দিয়ে সূর্য ওঠে। এখানে দাঁড়িয়েই তার বাবা রোজ সকালে সূর্য প্রণাম করত। আজ পারুলও করল। তারপর হঠাৎ আপনমনেই হেসে ফেলল।
সে একজন বেশ লেখাপড়া জানা মেয়ে, এম এ পাস। সে কম্পিউটার শিক্ষিত। সে একটা কারখানা চালানোর প্রায় সব কলাকৌশলই জানে। আধুনিক পৃথিবীর মোটামুটি সব খবরই সে রাখে। মুক্ত নারী, তার কোনও কুসংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাস থাকার কথা নয়। তার মনের একটা সত্তা এই স্বপ্ন-দেখার ভিতরে কোনও সত্যকে স্বীকার করে না। আবার দ্বিতীয় আর একটা সত্তা দুহাতে আঁকড়ে ধরতে চাইছে ওই অন্ধ বিশ্বাসকে। বাবা আসছে, আমার গর্ভে বাবা আসছে। বাবাই যে আসছে তার কোনও যুক্তিসংগত প্রমাণ কখনও পাওয়া যাবে না, জানে পারুল। অন্ধ বিশ্বাসই হবে একমাত্র সম্বল। এই নিষ্ঠুর সত্যকেও সে এড়াতে পারে না। আর এই দোলাচল নিয়েই রচিত হয় মানুষের অদ্ভুত মনোভূমি।
না, আজ সে অবিশ্বাস করবে না। আজ সে একজন গ্রাম্য অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন চাষি বউয়ের মতো বিশ্বাসটা করবে ভোরের ওই স্বপ্নকে। ওই অন্ধ বিশ্বাসই আজ তার বড় দরকার। সে তাই আজ সূর্যের কাছে প্রার্থনা করল, ভুলিয়ে দাও, শিখেছি, যা বুঝেছি তা ভুলিয়ে দাও, বিশ্বাস করতে দাও আমার ভোরের স্বপ্নকে….
ওই বাঙালি এসে বসেছে পশ্চিমের দাওয়ায়। পাশে দিশি বিস্কুটের টিন। রোদে ডগোমগো উঠোনে বসে আছে নেড়ি কুকুর আর তিনিটে কুশি কুশি ছানা। বাঙালি খইনি টিপছে মন দিয়ে। তার কোনও তাড়া নেই। দুখুরির মাস-মাইনেটা হাত পেতে নিয়ে যায় প্রতি মাসকাবারে।
আজ বলাকা বলল, হ্যাঁ রে বাঙালি, তুই যে ফি মাসে এসে দুখুরির মাইনে নিয়ে যাস তারপর তা পেটায় নমঃ করিস, তা মেয়েটার তো আখের দেখতে হবে। আমি ভাবি ওর নামে পোস্ট অফিসে কিছু কিছু করে রাখলে তো ওরও সুবিধে, তোরও সুবিধে। ওর বিয়ের সময়ে তাহলে আর তোকে হাত পাততে হবে না, ধারকর্জও করতে হবে না।
বাঙালি শশব্যস্তে বলে, উও বাত তো ঠিক আছে মাতাজি। এখুন কিছু মুসিবাত হচ্ছে, দু-চার মাহিনাকে বাদ আপনি ডাকঘরে রেখে দিবেন।
কেন রে, তোকে যে দোকান করার টাকা দিলুম তার কী করলি? দোকানটা নিসনি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ জরুর, দুকান তো লিয়েছি মাতাজি!
তা তোর কি দোকানে লোকসান যাচ্ছে?
নুকসান তো যাবেই মা। ভুজিয়ার দুকান তো এখানে ভাল চলে না। বর্ধমান হলে চলত।
নাঃ। তোকে দিয়ে কিছু হবে না দেখছি। মেয়েটাকে পথে বসাবি।
আর দু-চার মাহিনা বাদ সব ঠিক হয়ে যাবে মা।
দুর মুখপোড়া! সেই কবে থেকে শুনছি দু-চার মাস বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর নতুন বউটার পিছনে ঢালছিস বুঝি সব কিছু? তা মা-মরা মেয়েটার কথাও তো ভাববি! ভালমানুষের মতো মুখ করে ওর মাইনের টাকাটা নিয়ে যাচ্ছিস, ওর তো কিছু জমছে না। এবার এসেছিস, টাকা নিয়ে যা। এর পরের মাস থেকে কিন্তু আর পুরো টাকা দেব না। পোস্ট অফিসে জমা করব। বুঝলি?
বাঙালি ভারী লাজুক ভঙ্গিতে বসে মাথা চুলকোয়৷ মুখে একটু ক্যাবলা হাসি।
বলাকা রাগ করে বলে, তুই তো জন্ম দিয়েই খালাস, নামে মাত্র বাপ৷ মেয়েটাকে তো কোলেপিঠেও করিসনি বোধ হয়। বউ মরতেই আর একটা বিয়ে করে এনেছিস। ধন্যি বাপ তুই! মেয়েটা তো বাপকে দেখলে যেন ভূত দেখে।
বাঙালি লজ্জা পেয়ে বলে, আমার মুচ আছে তো মা, দুখারি মুচকে খুব ডরায়, উসি লিয়ে উ আমার পাশ আসে না।
আহা, বাপের গোঁফ থাকলে মেয়ে ভয় পায় জন্মে শুনিনি বাবা। হ্যাঁ রে পারুল, তোর বাপেরও তো গোঁফ ছিল, তার জন্য কি তোরা ভয় পেতি? মুখপোড়ার কথা শোন।
পারুল উঠোনে বলাকার পাশে রোদে বসেছিল। আজ ভারী আনমনা সে। কথাবার্তা কিছুই কানে যাচ্ছিল না তার। ভারী বিভোর হয়ে আছে নিজের মধ্যে। ডাক শুনে গভীর অন্যমনস্কতা থেকে বলল, উ!
বলাকা ফের বাঙালির সঙ্গে কথা ফেঁদে বসে। পারুল ফিরে যায় তার অন্যমনস্কতায়। তার পেটের ভিতরে এক দিব্য পুরুষ। এই পৃথিবীর কিছুই আজ তাকে স্পর্শ করছে না।
হ্যাঁ রে, জ্যোতিপ্রকাশ কখন আসবে?
ফের যেন গভীর অতল থেকে বাস্তবে উঠে আসতে হয় পারুলকে। বড় কষ্ট হয়।
কী বলছ মা?
বলি জামাই আসবে কখন?
টাটা থেকে সকালে রওনা হবে। পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যাবে মনে হয়।
কালকেই তো রওনা হয়ে যাবি! বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে।
পারুল একটু হাসল, তোমার কি ফাঁকা লাগে মা? তুমি যেদিকে তাকাও সেদিকেই তো বাবাকে দেখতে পাও, তাই না?
তা পাই। তা বলে কি তোরা আমার কিছু নয় নাকি?
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা সত্যিই তোমার কাছে কিছু নয়। বাবাই তোমার সব।
তোদের মধ্যেও তো তোর বাবাই জন্ম নিয়েছে। নইলে জায়া বলেছে কেন? বাপ তার ছেলেপুলের ভিতরে দিয়ে ফের জন্মায় বলেই না তার ছেলেপুলের মা হল তার জায়া।
তবু স্বীকার করবে না যে তুমি বাবাকে আমাদের চেয়ে বেশি ভালবাসতে?
বলাকা হাসে, ভালবাসার কমবেশি কি বোঝা যায় রে, নাকি মাপা যায়? কাকে ফেলে কাকে রাখি বল তো! তোরা যে কে কার চেয়ে কম তা কি ঠিক বুঝতে পারি? সকলের জন্যই বুক টনটন করে।
দেখলে তো মা, আজ আমার বমি হল না।
রোসো বাছা, সবে খেয়েছ। এখনও সময় যায়নি। বেশি বাহাদুরি করতে হবে না। আগে খাবারটা তল হোক তারপর বোঝা যাবে।
আর হবে না মা। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আজ আমাকে একটু বাবার কথা বলো তো মা। খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।
ওরে, ঝাঁপি খুলে বসলে কথায় কথায় বেলা হয়ে যাবে। কত শুনবি?
তা হোক, একটু বলো।
তোরা বলিস আমি নাকি একচোখো, শুধু ওই মানুষটার ওপরেই নাকি আমার যত টান। কিন্তু আমরা তো এখনকার মতো ঢলাঢলি করিনি কখনও। দুজনে যেন কুলি আর কামিন। সংসার গড়ে তুলতে দুজনেই মনেপ্রাণে খেটে গেছি। তখন শ্বশুর শাশুড়ি ছিল, দেওর ননদরা ছিল। মস্ত সংসার। দিনমানে তো স্বামী-স্ত্রীর দেখাই হত না। সংসারের নানা কাজে জড়িয়েমড়িয়ে থাকতুম। কিন্তু সবসময়ে মনটা সজাগ থাকত ওই মানুষটার জন্য।
ওরকম হ্যান্ডসাম পুরুষ তুমি আর দেখেছ?
দুর বোকা! হ্যান্ডসাম বলেই কি আর ভালবাসতুম? দেখতে কুৎসিত হলেও অন্যরকম হত না। তার। রূপটা চোখ টানে ঠিকই, কিন্তু মেয়েরা যাকে পায় তাকে ঘিরেই লতিয়ে উঠতে চায়। ওইটেই তো মেয়েদের স্বভাব। সেই স্বভাবকে এখনকার মেয়েরা জলে ভাসিয়ে দিয়ে অন্যরকম হতে চায় বলেই তো এত অশান্তি।
বাবা তোমার জন্য কেমন অস্থির হত বলো।
না বাপু, তার আদিখ্যেতা ছিল না। যখন দশ বছরেরটি এসেছিলুম, তখন তো সে ছিল বাপ দাদার মতো একজন। বয়স্ক, গম্ভীর, সবসময়ে আগলে রাখত। যখন বড় হয়েছি তখন হল অন্যরকম। আমার ওপর খুব নির্ভর করত। যা বেঁধে দিতুম তাই খেত, টু শব্দটি করত না। কাজকর্মে ভুল হলে মাথায় হাত বুলিয়ে নরমভাবে বুঝিয়ে দিত। তার মুখ থেকে যে কথা বেরোত তাই আমার মনে হত বেদবাক্য।
কখনও ঝগড়া হয়নি তোমাদের, না?
না বাপু, ঝগড়া কাকে বলে তা জানতুম না। মতের অমিল হলে দুজনে বসে কথা কয়ে কয়ে সব ঠিক করে নিতুম। যারা বলে সে অত্যাচারী পুরুষ ছিল তাদের মুখে আগুন। তারা তার হাঁকডাকটা দেখত। তার বুকের ভিতরটা তো আর দেখতে পেত না।
কথায় বাধা পড়ে গেল। দুখুরি এসে বলল, ও মা, তুমি বসে আছ যে! বামুন ঠাকুর বলে পাঠাল, কী রান্না হবে তার জোগাড়যন্তর হয়নি এখনও।
বলাকা বলে, তাড়া কীসের? যাচ্ছি বল গে। হ্যাঁ রে দুখুরি, তোর বাপটা কখন থেকে এসে বসে আছে, একবার সামনে আসিস না কেন? ওরও তো মেয়েকে একটু চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে করে।
ইল্লি! আমার জন্য মোটেই আসে না, টাকার জন্য আসে।
ছিঃ, ওরকম বলতে নেই। ও গরিব মানুষ, টাকা তো লাগবেই। তা বলে ওরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবি? তুই কী রে?
চাপা গলায় দুখুরি বলে, গায়ে ঘামের গন্ধ যে! খইনি খায়, এঃ মা! ঝাঁটার মতো গোঁফ।
ও মাঃ তাতে কী হল! তবু তো বাপ! যা না একটু কাছে গিয়ে দাঁড়া, খুশি হবে খন।
ইল্লি। ও আমি পারব না।
ছিঃ মা। ওরকম করতে নেই। লোকটা দুঃখ পাবে। যা একটু কাছে।
গিয়ে কী করব?
একটা পেন্নাম কর।
দুখুরি ভারী লজ্জা-লজ্জা ভাব করে বলে, পেন্নাম করিনি তো কখনও।
আজ কর। বাবাকে পেন্নাম করতে হয়। যা।
দুখুরি একটু গুম হয়ে থেকে তারপর খুব অনিচ্ছের সঙ্গে গিয়ে বাপের সামনে দাঁড়াল।
বাঙালির মুখখানায় ভারী বোকা একটা হাসি ফুটে উঠল হঠাৎ।
দুখু, তু তো বড় হয়ে গেছিস!
দুখুরি খপ করে নিচু হয়ে পায়ের ধুলো নিতেই বাঙালি দুহাতে আঁকড়ে ধরল তাকে। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।